Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কল্যাণী || Jibanananda Das » Page 18

কল্যাণী || Jibanananda Das

শালিখবাড়িতে এসে অব্দিই অবিনাশ ভেবেছিল যে কল্যাণীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে একদিন–কিন্তু যাওয়া তার ঘটে ওঠেনি।

সে অলস হয়ে গেছে—এত অলস যে যে সঙ্কল্পের পিছনে নরনারীর ভালোবাসার মত এমন একটা অনুপ্রেরনার জিনিস তাও যেন তাকে জোর দেয় না।

সে ঢের ভাবতে শিখেছে—

অনেক সময়ই বিছানায় শুয়ে থেকে ভাবে শুধু কোনও কাজ করে না, বিশেষ কারুর সঙ্গে কোনো কথা বলে না; এক একদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি ঠাই বিছানায় শুয়ে থাকে—মাঝে গিয়ে একটু স্নান করে খেয়ে আসে শুধু

ভালোবাসার কথা আজকাল সে বড় একটা ভাবে না—

এক এক সময় মনে হয় কল্যাণীকে আর ভালোবাসে সে কি?

এক সময় এই ভালোবাসা তাকে ঢের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল—এই রূপ এমন গভীর এমন সম্পূর্ণভাবে অধিকার করে রেখেছিল তাকে যে পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রার অন্যতম আশা আকাঙ্খা ও সার্থকতার সমস্ত দরজাই চাবি দিয়ে বন্ধ করে ভালোবাসা মোহ ও কামনার উপাসনা করেছে বসে বসে সে—তাতে কি হ’ল?

জীবন তাকে পদে পদে ঠকিয়ে গেল শুধু; কল্যাণীও যেমনি দূর—তেমনি দূর হয়ে রইল। তবুও কল্যাণীকে পাওয়ার জন্য জীবনের সব দিকই একদিন সে অক্লেশে ছারখার করে ফেলতে পারত; কল্যাণী ছাড়া আর কোনো জিনিসেরই কোনো মূল্য ছিল না—কোনো নাম ছিল না যেন; হে বিধাতা, কোনো নামও ছিল না।

আর্টের কোনো অর্থ ছিল না, প্রতিষ্ঠার কোনো মানে ছিল না, সংগ্রাম সন্মান মনুষ্যত্ব সাধনা প্রতিভা এগুলোকে এমন নিম্ফ মনে হ’ত সাধারণের ফুর্তি আহ্লাদ দিয়েই বা সে কি করবে? ভালোবাসা ছাড়া মনে হ’ত–আর সমস্তই সাধারণের জিনিস। নিজের রোজগারের টাকাটুকু মানুষের জন্য যে স্বাধীনতা ও আত্মসম্মানের পথ ঠিক করে রাখে তাকেও সে প্রাণ ভরে অবজ্ঞা করেছে—

কিন্তু আজ এতদিন পরে এই জিনিসটাই চায় শুধু সে—নিজের রোজগারের নিশ্চিন্ত কয়েকটা টাকা মাসে মাসে—সেই সামান্য ভিত্তির ওপর যেটুকু স্বাধীনতা থাকে যেটুকু তৃপ্তি থাকে।

কিন্তু এই অকিঞ্চিৎকর জিনিসও আজ তাকে কেউ দিচ্ছে না। কলকাতা ছেড়ে দেশে এসে মায়ের ওপর নির্ভর করে থাকতে হচ্ছে তার।

এমন অনেক কথা ভাবছিল অবিনাশ বিছানায় শুয়ে শুয়ে—এমন সময় কল্যাণী এল।

ব্যাপারটা যে কি হ’ল সহসা অবিনাশ বুঝতে পারল না; ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বললে—তুমি—

বিছানার এক পাশে এসে চুপে চুপে বসে কল্যাণী বললে—শুয়েছিলে–শোও।

—না—নানা—এখনই উঠতাম—

—বেড়াতে যেতে?

অবিনাশ বললে—আজ লক্ষ্মী পূজো না?

—হ্যাঁ

—এ রাতে তুমি কেমন করে এখানে এলে?

—দেখছই তো এসেছি

—পূজা ফেলে?

—পূজো খানিক হয়েছে—খানিক হচ্ছে—

—তোমাকে ছেড়ে দিল?

কল্যাণী—কৈ, তোমাদের বাড়ি পূজো হবে না?

—কে আর করে?

—আহা, লক্ষ্মী পূজো

—লক্ষ্মী সরস্বতী সব একাকার—তুমি তো জানই সব—আহা, এই জ্যোৎস্নাটা–বেশ লাগছে! এতক্ষণ শুয়ে থেকে এই জ্যোৎস্নাটার দিকে ছিলাম পিঠ ফিরিয়ে–তুমি যদি না আসতে তা হ’লে হয়তো ঘুমিয়েই পড়তাম

—কেন, এ বাড়ির লোকজন সব কোথায়?

—পাড়ায় গেছে হয়তো—

কল্যাণী বললে—তুমিও তো কলকাতায় ছিলে?

—হ্যাঁ।

—কবে এসেছ?

–দিন পঁচিশেক—

—আমি যে এখানে এসেছি তা জানতে না তুমি?

অবিনাশ ঘাড় নেড়ে বললে—জানতাম

—একদিনও গেলে না যে বড়?

অবিনাশ বললে—তোমার কাছে গেলে মনটা খুব ভালো লাগত বটে—রাতে বেশ সুন্দর স্বপ্ন দেখতাম—কিন্তু ঐ অব্দি—আর কি?

কল্যাণী অবোধের মত তাকিয়ে রইল।

অবিনাশের মনে হ’ল এই মেয়েটি বড্ড বোকা, ভেবেই তার বড় কষ্ট হল; মনে হ’ল, ছি, কল্যাণীর সম্বন্ধে এ রকম ভাবনাও এক দিন কত বড় অপরাধের জিনিস বলে মনে হত! আজো পৃথিবীর মধ্যে এই মেয়েটিকেই সব চেয়ে কম আঘাত দিতে চায় সে—নিক্তির মাপের চেয়ে একে একটু বেশি কষ্ট দিতে গেলেই নিজের মন অবিনাশের আজো কেমন একটা বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। হয়ে পড়ে বটে, কিন্তু পড়া উচিত নয়।

কিন্তু, তবুও সেই ব্যথা কয়েক মুহূর্তের জন্য শুধু;—আগেকার মন তেমন দীর্ঘস্থায়ী হয় না আর। এ একটা চমৎকার রফা।

কল্যাণীর সময় হয়তো খুব সংক্ষেপ; সে উশখুশ করছিল—

—কি ব্যাপার?

কল্যাণী বললে—একটু দরকার—

এই বলে সে থামল —

অবিনাশ তাকাল মেয়েটির দিকে

কল্যাণী বললে শুনেছ নাকি?

অবিনাশ একটু ভেবে বললে—হ্যাঁ, শুনেছি

—কি বলো তো।

—তোমাদের বাসায় চন্দ্রমোহনবাবু আছেন—

কল্যাণী বললে—তাকে চেন নাকি?

—না।

—কোনো দিন দেখো ও নি–

—এই এবার দেখলাম—এ দিককার রাস্তায় মাঝে মাঝে বেড়ায়, তোমার মেজদার সঙ্গে তোমাদের বগি গাড়িটাতে চড়ে—

কল্যাণী বিছানার ওপর আঁক কাটছিল—

একটু পরে বললে—তুমি কি বল?

অবিনাশ বললে—আমার মন ক্রমে ক্রমে নিরস্ত হয়ে উঠেছে—কাজ করতে ভালো লাগে না—দুঃসাধ্য জিনিসকেও সফল করে তুলবার মত উদ্যম হারিয়ে ফেলেছি—দিন রাত চিন্তা করে করে সব কিছুরই নিষ্ফলতা প্রমাণ করতেই ভালো লাগে শুধু—এই সব অদ্ভুত ব্যাপারের কথাই ভাবি আমি। এর পর আমার কাছে কি আর শুনতে চাও তুমি?

কল্যাণী বললে—আমি দিন রাত কি….চন্দ্রমোহনবাবুর জুতোর শব্দ শুনলেও আমার ভয় পায়—এমন কান্না আসে।

অবিনাশ একটু হেসে বললে—একদিন এই জুতোর শব্দ না ভালো লাগবে যে তা নয়

কল্যাণী বললে—তার আগে যে আমি মরে যাব।

—বুড়ী হয়ে তুমি বুড়ো চন্দ্রমোহনকে রক্ত গরম করবার জন্য মরধ্বজ ঘষবে—

কল্যাণী বললে—মিছে কথা বাড়াও কেন? তুমি তো সব জান। তোমার কাছে এসে কি আমার অনেক কথা বলবার দরকার।

–শোন তবে—

কল্যাণী অবিনাশের দিকে তাকাল—

অবিনাশ বললে—অনেক দিন আমাদের দু’জনাব দেখা নেই—তোমার খোঁজ তবুও আমি সব সময়ই রেখেছি—কিন্তু আমার ব্যাপারটা তুমি একেবারেই জানতে পারনি—

–তোমাকে আমি অনেক দিন থেকে জানি-আর জানবার দরকার নেই—

মেয়েটিকেই অবিলম্বেই নিজের কথা সব জানিয়ে দিয়ে এই ক্ষণিক মুহূর্তের সৌন্দর্য অবিনাশ নষ্ট করতে গেল না।

এই জ্যোৎস্নায় এই রূপসীকে–এবং এই রূপসীর এই ক্ষণিক প্রেমকে প্রেমিকের মত না হ’লেও শিল্পী আয়ুষ্কালের মত উপভোগ করতে লাগল সে; মনে হল এ উপভোগ প্রেমিকের উপভোগের চেয়েও ঢের প্রবীণ,—একটায় মানুষ মানুষের মত আত্মহারা হয়— আর একটায় বিধাতার মত সমাহিত হয়ে থাকে। ঢের প্রবীণ—ঢের সুপরিসর এ উপভোগ। কিন্তু এক আধ মিনিটের জন্য শুধু; তার পরেই নিজের অনিকেত পৃথিবীতে ফিরে এল অবিনাশ।

কল্যাণী বললে—চন্দ্রমোহনের মুখ দেখেছ তুমি?

—দেখেছি

—কেমন বলো তো—

অবিনাশ ভাবছিল–

কল্যাণী অত্যন্ত অসহায় বলে বললে—এমন মেনি বাঁদরের মত মুখ আমি মানুষের মধ্যে কোনো দিনও দেখিনি—তুমি তা কল্পনাও করতে পারবে না অবিনাশদা

—মানুষের মুখের সৌন্দর্যই যদি এত ভালো লেগে থাকে তোমার তাহ’লে কোনো মুখ নিয়েই কোনো দিন তৃপ্ত হতে পারবে না—

—তোমাকেও কেউ ঘুষ দিয়েছে নাকি? তুমিও যে চন্দ্রমোহনের হয়ে কথা বলছ?

অবিনাশ একটু হেসে বললে—কল্যাণী—আমি—

—তুমি এ রকম অসঙ্গত কথা বল কেন

—জীবন ঢের অসঙ্গতি শিখিয়েছে; সবচেয়ে অসংলগ্ন জিনিসকেও দেখলাম শেষ পর্যন্ত সবচেয়ে সত্য—

অনিবাশ বললে—আমার নিজের সুখকে এক সময় বেশ পুরুষ মানুষের মত বলে মনে হত; কিন্তু দিনের পর দিন যতই কাটছে চামড়া ঝুলে পড়ছে, মাংস খসছে—হাড় জাগছে—

তারপর এক এক দিন ঘুমের থেকে উঠে আরসীতে মুখ দেখে মনে হয়, এ কি হ’ল? নানা রকম বীভৎস জানোয়ারের আভাস মুখের ভিতর থেকে ফুটে বেরুতে থাকে। কিন্তু তাই বলে আমার কোনো দুঃখ নেই; মেয়েদের ভিতর যারা সবচেয়ে কুশ্রী তারাও আমাকে ক্রমে ক্রমে বসুশ্রী বলে ঠাট্টা করছে–হয়তো দূরে সরে যাবে আমার কাছ থেকে; আমিও তাদের কুৎসিৎ বলে টিটকারি দেব—

কিন্তু তারপর যখন কাজের সময় আসবে—তার যদি অনুমতি হয়—ওদের মধ্যে একজন পাঁচশো টাকার ইনস্পেকট্রেসকে বিয়ে করতে আমার একটুও বাধবে না; কি বাধা কল্যাণী? মুখের দোষগুণ শেষ পর্যন্ত আর থাকে না। টাকা জীবনটাকে সুব্যবস্থিত করে দেয়—

কল্যাণী দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে অবিনাশের দিকে তাকাল, নাক চোখ মুখ এমন কি দাঁতের ভিতর থেকেও যেন তার আগুন ঠিকরে পড়ছে; কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হ’ল অনিবাশ ঠাট্টা করছে; তামাসা করতে যে এ লোকটি খুব ভালোবাসে তা কল্যাণী বরাবরই জানে—

কাজেই মনটা তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল প্রায়—আস্তে আস্তে—কেমন একটা অদ্ভুত অসঙ্গতির খোঁচা খেয়ে নিরুপায়ের মত হাসতে হাসতে বললে—তোমার মুখকে তুমি চন্দ্রমোহনের মত মনে কর?

—সেইরকমই তো হয়ে যাচ্ছি —দেখছিই তো

—চন্দ্রমোহনের ও দোষটা তুমি ধোরো না—

—সে আমি বুঝব

অবিনাশ বললে—তাকে বিয়ে করতে হয় কর, না করতে হয় না কর; কিন্তু যে কুৎসিৎ মানুষ প্রাণ দিয়ে তোমাকে ভালোবেসেছে তাকে কুৎসিৎ বলে ঘৃণা করে খারিজ করবে তুমি এটা বড় বেকুবি হবে।

কল্যাণী নিস্তব্ধ হয়ে রইল।

একটু পরে বললে—তুমি পরিবর্তিত হয়েছ বটে।

অবিনাশ বললে—তুমি হওনি? যদি না হয়ে থাক, হওয়া উচিত তোমার।

অবিনাশ বললে—আর্টিস্ট ছিলাম—কিন্তু আর্ট জীবনকে কি দিল? ‘প্রেমিক হয়েও জীবনের কাছ থেকে কি পেলাম আমি?

—প্রেমিক হয়ে? এখন তুমি আর প্রেমিকও নও তাহলে?

—কাকে ভালোবাসব? একজন রূপসীকে নিয়ে আমার কি হবে কল্যাণী? আমি নিজে খেতে পাই না; প্রেম বা শিল্পসংস্থান মানুষের জীবনের থেকে যে দুরন্ত চেষ্টা সাহস কল্পনা দুঃসাধ্য পরিশ্রম দাবী করে আমার জীবনের যে মূল্যবান জিনিসগুলো খরচ হয়ে গেছে সব— কিছু নেই এখন আর। উপহাস আছে এখন; জীবনের গতিশীল প্রগতিময় জিনিসগুলোকে টিটকারি দিতে পারি শুধু নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভোরের থেকে রাত, রাতের থেকে ভোর সৌন্দর্যকে মনে হয় কাদা আর লাল স্রোত, ভালোবাসাকে মনে হয় পুতুলখেলা, পলিটিক্সকে মনে হয় উতোর, আর্টকে ভাঁড়ামি, জীবনের মহত্ব গুরুত্ব মঙ্গল বলে যে সব জিনিস নিয়ে লোকে দিনরাত হৈ হৈ করছে সবই আমার কাছে ভড়ং ঢং নিষ্ফলতা শুধু। আমি আজো বুঝি না এরা সত্য—না আমি সত্য। আমার কোনো বিধাতা নেই। আমার মার দুঃখ কষ্ট দেখে একটা চাকরির সামান্য ক’টি টাকা ছাড়া অন্য কোনো কিছু জিনিসের জন্যই আমার কোনো প্রার্থনা নেই। কিন্তু সে চাকরিও আমাকে দেয় না কেউ?

কল্যাণী কাঠের মত শক্ত হয়ে বসে রইল।

অবিনাশ বললে–চন্দ্রমোহন তোমাকে বিয়ে করবে এ জন্য ঈর্ষাও নেই আজ আমার; তেমন কোনো একটা যৌনকাতরতাও নেই। কিন্তু গত বছর হ’লে এই শেষের জিনিসটাও কি ভয়াবহ হয়ে উঠত—অবাক হয়ে আজ ভাবতে পারা যায়। এক বছরের মধ্যে কতখানি ঘুরে গেছি—

কল্যাণী বলল—উঠি

—আচ্ছা

কিন্তু তবুও সে বসে রইল—

অবিনাশ বললে—কার সঙ্গে যাবে?

ছোড়দা আসবে—

কিশোর কোথায়?

—তোমাদের পাশের বাড়িতেই—

—হিমাংশুবাবুর বাড়ি?

—হ্যাঁ; ডেকে দেবে?

আচ্ছা দেই

অবিনাশ উঠল

কল্যাণী বললে—সত্যিই ডাকতে গেলে

—তুমি বাসায় যাবে না?

কল্যাণীর চোখ ছলছল করতে লাগল—

অবিনাশ একটা চেয়ার টেনে বসে বললে–দিব্বি রাত—লক্ষ্মীপূজোর–

—সে দিনগুলো ফুরিয়ে গেল কেন?

—কোন দিন

—যখন তুমি ভালোবাসতে পারতে—

অবিনাশ চশমাটা খুলে বললে—ফুরুলো তো

—আমরা তো ফুরোয় নি —

–অনেক স্বামী স্ত্রীর জীবনই আমি দেখেছি—ভালোবাসা কোথাও নেই, সৌন্দর্যের মানে শিগগিরই ফুরিয়ে যায়; সমবেদনা থাকে বটে—কিন্তু সমবেদনা তো প্রেম নয়–

কল্যাণী বললে—আমি স্বামী স্ত্রীর জীবনের কথা বলছি না—

অবিনাশ বাইরের দিকে তাকিয়ে বললে—একটা গল্প মনে পড়ছে—এমন লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সেই গল্পটার ভেতর ঢের মাধুর্য জমে ওঠে বটে। তোমাকে নিয়ে যদি আজ এই জ্যোৎস্নায় কোনো দূর দেশে চলে যাই আমি যেখানে কেউ আমাদের খুঁজে পায় না—তুমি আমার স্ত্রী হও, আমি তোমার স্বামী হই—তাহ’লে আমি কোনো চরিতার্থতা পাব না।

কল্যাণী বুকের ভিতর কেমন যেন ক’রে উঠল, কোনো কথা বলতে পারল না সে। —এই, জ্যোৎস্না উৎরে আবার ভোর আসবে দুপুর আসবে—অমাবস্যা আসবে—বৃষ্টি আসবে

—নানা দিক থেকে অনেক বিরুদ্ধাচারের সঙ্গে লড়াই করতে হবে। সে সংগ্রাম তুমি হয়তো কিছু দিন করতে হবে। কিন্তু আমি পারব না।

কল্যাণী বললে— কেন?

—ভালোবাসা ও সৌন্দর্যকে অন্তঃসারশূন্য মনে হয় যে

—কেন?

—সৌন্দর্য তো একটা ফুলের পাপড়ির মত! কি তার মূল্য একটা কবিতার খাতায় ছাড়া এ পৃথিবীর আর কোথাও তার কোনো দাম নেই। মন আমার আজ কবিতার খাতার বদলে বিলের খাতায় ভরে উঠেছে—

কল্যাণী আঁতকে উঠল

অবিনাশ বললে–ভালোবাসাও তো শেষ পর্যন্ত লালসায় গিয়ে দাঁড়ায় শুধু— লালসার কি যে মূল্য তা গত দু’বছরের আমি খুব বুঝতে পেরেছি। সে গুখখুরির কাছে তোমার জীবনকে বিসর্জন দিতে চাই না আমি, আমার জীবনকেও নষ্ট করতে পারি না—

কল্যাণী একটি মৃতপ্রায় মানুষের মত কে কোণে জড়সড় হয়ে বসেছিল

অবিনাশ বললে—কিন্তু এও সব হ’ত আমাদের—খুব ভালোই হত যদি চন্দ্রমোহনের মত টাকা থাকত।

অবিনাশ একটু কেশে বললে—কিম্বা তোমার মেজদার মত টাকা থাকলেও আমি একবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু আমার কিছুই নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *