কম্পিউটার চৌর্যবৃত্তি
ঝন্টুমামা সিগারেটের কাগজে তামাক ঢেলে পাকাতে পাকাতে চোখ না তুলেই বললেন, আমি বেশ কয়েকবার রিফিউজ করেছিলাম। সব কথা খুলে না বললে তো আর কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ পেরিয়ে হুট করে পাড়ি দেওয়া যায় না। হ্যাঁ, ফোটন রকেট মানছি। কাজ সেরে ফিরে আসব যখন, বয়সটা একটু কমেও যেতে পারে। তা সত্ত্বেও মাছের ঝোল ভাত মিস করতে হবেই। যত বলি ব্যাপারটা ভেঙে বল, তা সেই এক কথা–প্রাচীনকালের কিছু তালাচাবি জোগাড় করতে পার ভালো, না হলে সে সম্বন্ধে খোঁজখবর নিয়ে রাখ, বাকিটা আসার পরেই জানতে পারবে।
যা-ই হোক, ভাবতেও পারিনি, ওরা আমার অনুমতি পাওয়ার আগেই স্বয়ংচালিত মহাকাশযান পাঠিয়ে এমন একটা কাণ্ড করে বসবে। কাণ্ড ছাড়া কী! আমি যদি তখন না যেতাম, ওই বেগুনী মহাকাশযান পাগলের মতো পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেই চলত আর সংকেতে করুণ আবেদন পাঠাত বারবার আমার কাছে। আর ঠিক এমনি একটা সুযোগের জন্যই কবে থেকে প্রতীক্ষা করছে ডক্টর হেরম্যান। হেরম্যানই একমাত্র আন্দাজ করেছে, বিটা গ্যালাক্সির একমাত্র বুদ্ধিমান জীব অধ্যুষিত গ্রহ রেঙ্গোর সঙ্গে আমার যোগ আছে। এখন ওই মহাকাশযানটিতে সে যদি কোনওরকমে উঠতে পারে তাহলে আর রেঙ্গোতে গিয়ে হাজির হতে কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়। তার পরের কথা ভাবতেও আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। কারিগরি বিদ্যায় রেঙ্গোয়ানরা যতই এগিয়ে থাকুক, কোনও কোনও ব্যাপারে তারা বেজায় সরল-প্যাঁচপয়জারে ওস্তাদ বদমাইশ হেরম্যান তাদের কতটা ক্ষতি করতে পারে, ভাবতে ভাবতেই দেখলাম, মহাকাশযানে উঠে বসেছি।
ভুল খুব একটা করিনি, কারণ হেরম্যান বা অন্য যে কেউ প্রথম এসে প্রবেশ করত, তাকে নিয়েই যন্ত্রমশাই ফিরতি পথে পাড়ি দিতেন। চেকিং বলে কোনও কিছুর বালাই নেই। আমাকে ভাঁড়িয়ে অন্য কেউ আসতে পারে–এটা ওরা কল্পনাও করতে পারে না।
বসার জন্য নির্দিষ্ট স্থানটি গ্রহণ করামাত্র মহাকাশযানে শুরু হয়ে গেল নতুন তৎপরতা। যার একটা হল, আমাকে মধুর স্বপ্নে ডুবিয়ে রাখা।
স্বপ্ন ভাঙল রেঙ্গোর আকাশে দুটো সূর্যের ঝলসানিতে। প্রথম নজরে পৃথিবীর সঙ্গে এটাই মূল তফাত। এদের আকাশের দুটো সূর্য কোনটা যে কখন উঠছে আর ডুবছে, কখন যে দিন, কখনই বা রাত, আমার পক্ষে তার হিসেব রাখা দুরূহ হয়ে উঠল।
প্রথম যে রেঙ্গোয়ানের দেখা পেলাম, তিনি আমার পূর্বপরিচিত, তবে এই প্রথম চোখের দেখা। দু-হাতে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে। থ্যাঙ্ক ইউথ্যাঙ্ক ইউ–যান্ত্রিক স্বরে আপ্যায়ন। কম্পিউটার কেন্দ্রের সাহায্যে তিনি ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বা বাংলায় কথা চালাতে পারেন। দু-খিলি পান এগিয়ে দিয়ে বললেন, খেয়ে নাও। পানই বলছি, কারণ ওইরকম খিলি করা। এদের একমাত্র খাদ্য। এবং এর কোনও অভাব নেই এখানে।
পৃথিবীর তুলনায় আয়তনে গ্রহটা ছোট। বেশি খুঁটিনাটির মধ্যে যাব না, আমাদের হিসেবে দিনচারেক শুধু সুপার রকেটে চড়ে ঘুরে বেড়ালাম দু-জনে। পোশাকটা পালটে নিয়ে কৃত্রিম সবুজ দাড়ি লাগাবার পরে আর চেনার উপায় ছিল না যে আমি রেজোয়ান নই।
সব চাইতে অবাক হলাম, কিংবা আমাকে অবাক করার জন্যেই বোধহয় ওরা আমাকে নিয়ে এসেছিল ওদের স্পোর্টস ক্লাবে। ওদের ভাষা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছিল না, একটা রেডিয়ো লিংক মারফত আধ সেকেন্ডের ব্যবধানে কম্পিউটার অনুবাদ করে পাঠাচ্ছিল। কিন্তু জিজ্ঞেস করার বাধা ছিল। তাহলেই ওরা সন্দেহ করবে। অবশ্য তার দরকারও পড়ল না। খানিকক্ষণ দেখার পরেই ওদের খেলার ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করলাম।
একটা সিন্দুকের দশ-বারোটা কবজা, তাতে নানা রকমের তালা পরানো আছে। এবার একে একে ওরা সেই তালা খোলার চেষ্টা করছে। কে কত তাড়াতাড়ি তালাগুলো খুলতে পারে, তারই প্রতিযোগিতা। অবশ্য মুখে বলছি, বোঝাবার জন্য বলছি তালা–আসলে সুরক্ষার ব্যবস্থাগুলো খুবই জটিল। বেশির ভাগই কম্বিনেশন লক। অর্থাৎ নম্বর মিলিয়ে খুলতে হয়। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। পাঁচ অঙ্কের এক-একটা সংখ্যাকেও কী দ্রুত ওরা মিলিয়ে ফেলছিল। তারপর দেখলাম একটা যান্ত্রিক বাধা। এখানে অঙ্ক নয়, দক্ষতা প্রয়োজন। সিন্দুকের গায়ে প্রচণ্ড গতিতে দোল খাচ্ছে একটা অংশ। এই দোলকের মধ্যেই রয়েছে একটি গর্ত, যার মধ্যে চাবির মতোই একটা বিশেষ আকারের যন্ত্র পুরে পাক খাইয়ে ওটাকে খুলতে হবে। একজন প্রথমবার ভুল করেই দোলকের ঝটকায় ছিটকে পড়ল। অমনি সবাই হেসে লুটোপুটি। ছোট্ট একটা যন্ত্র বাঁ হাতে নিয়ে সে আবার উঠে এল। কিছুক্ষণ যেন কী ভাবল, তারপর দোলাতে শুরু করল হাতটা। দোলকের গতির তালে তাল মিলিয়ে খপ করে পুরে দিল চাবি। অবিশ্বাস্য! এরই মধ্যে চাবিটার চেহারাও দেখছি পালটে গেছে। কাজ হাসিল। আরেকটা বাধা ছিল, সেটা রং মেলানোর তালা। কাচের টুকরোর ওপর বেশ কয়েকটা ফালির ওপর নির্দিষ্ট রঙের আলো ফেললে তবে বাধা উন্মুক্ত হবে।
দেখলাম, ওরা একের পর এক আসছে আর তালা ভাঙছে। কমবেশি সময় নিচ্ছে। সবাই, তবে একেবারেই পারছে না এমন একজনকেও দেখিনি।
বন্ধুকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। ও আমার অবস্থা নিশ্চয় টের পেয়েছিল। বলল, এ আর কী দেখছ, এ তো গতানুগতিক ব্যাপার। খেলা। যে কোনও ধরনের রেঙ্গোয়ান তালাই ওরা খুলে ফেলতে পারে। ওই যে হাতে একটা করে যন্ত্র দেখছিলে, ওগুলো কম্পিউটার টার্মিনাল। কম্পিউটার চৌর্যবৃত্তি–০৭ (জেনারেশন ওয়াই) সারাক্ষণ ওদের সাহায্য করছে। কয়েক হাজার বছর ধরে ওই কম্পিউটারকে আমরা শিখিয়েছি তালা তৈরির যাবতীয় পদ্ধতি। লকিং অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্বন্ধে এখন ওর প্রখর বুদ্ধি। অবশ্য গত দু-শো বছর ওকে আমরা বয়কট করেছি। কিন্তু আশ্চর্য, তা সত্ত্বেও এই দু-শো বছরের মধ্যে আমরা যা কিছুই উদ্ভাবন করছি, সে সবই ওর পরামর্শে খুলতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগেনি।
আমি শুনেই যাচ্ছি।
-এবার বুঝতে পেরেছ তো, কেন তোমাকে ডেকে এনে কষ্ট দিলাম? তোমাদের জগতের কথা ও জানে না। তাই তুমি হয়তো খুব সামান্য একটা কিছুও এমন বাতলে দিতে পার যে চৌর্যবৃত্তি ঠকে যাবে। খুব বেশি নয়, দুটো ঘণ্টা ওকে যে করে হোক আটকে রাখতে হবে। প্লিজ
অনেকগুলো কথা একসঙ্গে মাথায় এল। প্রথমত, এই বিকট মগজের কাছে পৃথিবীর কোনও লকিং অ্যারেঞ্জমেন্টই নিরাপদ নয়। দ্বিতীয়ত, সত্যিই যদি দু-ঘণ্টা চোরেদের হাত থেকে রেহাই পেতে চায়, তবে ওকে সাময়িকভাবে অচল করে দিলেই তো হয়। তৃতীয়ত, দু-ঘণ্টা আটকে রাখা কেন দরকার?
রেঙ্গোয়ান বন্ধু বোধহয় কিছুটা আন্দাজ করেই বলল, পরশু আমাদের একটা গোপন কনফারেন্স বসছে সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে। নিরাপত্তার জন্যই মিটিং-এর সময় অন্তত দু-ঘন্টা কেউ যাতে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে না পারে… না, না, আমাদের এখানে পুলিশ, পাহারাদার–এসব কিছু নেই। দরজা যদি কেউ খুলে ফেলে, তাকে আর আটকানোর উপায় নেই। আর চৌর্যবৃত্তিকে অচল করে দেওয়ারও কোনও উপায় নেই। প্রেসিডেন্ট স্বয়ং হস্তক্ষেপ করলে সেটা সম্ভব, কিন্তু তাহলে তো তখুনি সবাই বুঝে যাবে যে, একটা কিছু গোপনীয় কাণ্ড ঘটতে চলেছে।
এরপর পৃথিবীর হিসেবে নাগাড়ে ছ-ঘণ্টা রেজোয়ান বন্ধুর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেলাম। গোটা চল্লিশ পানের খিলি হজম হয়ে গেল। পৃথিবীতে তালাচাবির উদ্ভবের কাহিনি থেকে আজ অবধি তার যত রকমফের জানা ছিল, সবই বলেছি, দরকার হলে ছবি এঁকেও দেখিয়েছি। শেষ পর্যন্ত ওকে স্বীকার করতেই হল, এর মধ্যে কোনওটাই চৌর্যবৃত্তি-০৭-কে রুখতে পারবে না।
করুণ মুখে আমার বন্ধু বলল, সরি। তোমাকে খামকা কষ্ট দিয়ে নিয়ে এলাম। আমিও অবশ্য বিপদেই পড়লাম। তোমার সফরের টাকাটা তো আমিই মঞ্জুর করেছি। এখনও সবই গোপন, কিন্তু সামনের অডিটে প্রশ্ন উঠবেই। কী যে কৈফিয়ত দেব… যাক গে, সে আমার চিন্তা। তুমি তো এখন ফিরে যাও। নাকি, আরেকটু বেড়াবার ইচ্ছে…
ঘাড় নেড়ে বললাম, না, বেড়াবার মতলব নেই, তবে এখুনি ফিরছিও না। তোমাদের সম্মেলন শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আছি এবং চৌর্যবৃত্তিকে যদি না রুখতে পারি…
ওর মুখ দেখে বুঝলাম, বিশ্বাস করতে পারছে না। সেটাই স্বাভাবিক। যুক্তি দিয়ে ওর অবিশ্বাস দূর করা যাবে না। সময়মতো সাফল্যই প্রমাণ করবে, আমি মিথ্যে আশ্বাস দিইনি। মুখে বললাম, তোমার যখন কোনও বিকল্প নেই, দাও-না সদর দরজাটার ভার আমার ওপর?
-তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু মনে রেখো, গায়ের জোর খাটানোর অপরাধে এখানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
–আর চুরি করতে পারলে, তালা ভাঙতে পারলে সেটা…
–সেটা তো বুদ্ধিমত্তা!
আরও একটা দিন থেকে গেলাম। দু-ঘণ্টার মিটিং নির্বিবাদে শেষ হল। কয়েকশো রেঙ্গোয়ান চেষ্টা করেছিল সদর দরজা খুলতে, কিন্তু চৌর্যবৃত্তি-০৭-এর সহায়তা সত্ত্বেও তারা হার মেনেছে।
অবশ্য আমার কৌশলের কথা ওদের আমি জানাতে পারিনি। ওরা জোরও দেয়নি, কারণ ভবিষ্যতে ফের যদি এমার্জেন্সি দেখা দেয়, তখন আর এই বুদ্ধিটাও কাজে লাগবে না। আমাকে আরেকবার ডেকে নিয়ে যেতেও ওদের কোনও আপত্তি নেই।
–তা লংওয়ালদের না বলুন, আমাদের তো বলতে বাধা নেই।–পরেশবাবু ব্যাকুল।
–লংওয়াল নয়, রেঙ্গোয়ান। না, আপনাদের বলব বলেই তো এত কথা। ব্যাপারটা খুবই সোজা। ওদের সদর দরজাটা আমি খুলেই রেখেছিলাম।
তার মানে?
–মানে, পাল্লা ভেজানোই ছিল, কিন্তু ওদের যে এলাহি লকিং অ্যারেঞ্জমেন্ট তা আমি ব্যবহার করিনি। ধরুন আপনার এই যে আলমারি, এর পাল্লা দুটো ভেজানো আছে, কিন্তু চাবি বন্ধ করা নেই। এই আর কী।
–অ্যাঁ! সে কী মশাই! অত বড় জাঁদরেল জোচ্চোর কম্পিউটারটা এতেই ভড়কে গেল! পরেশবাবুর কথা শুনে নিলয়ের গলা দিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ বেরিয়েছিল। ঝন্টুমামা বললেন, বোকার মতো হেসো না। ভালোমতো খেয়াল করে দেখ, কম্পিউটারকে কী নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, চাবি খোলার ব্যবস্থা করতে বা সেটা বাতলাতে। যে জিনিসটা খোলাই আছে, সেটাকে দ্বিতীয়বার কি খোলা যায়? কম্পিউটারের যন্ত্র-মগজ এ ধরনের সম্ভাবনা নিয়ে কখনও চিন্তা করতে পারে না। দরজা খুলতে যারা এসেছিল, তারা যদি কেউ একটু টেনে দেখত, তাহলেই জানতে পারত, সেটা ভোলা আছে।