কন্যাভ্রূণ – পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত
এ পৃথিবীর আলো দেখিয়া কি হইবে?
সমাজের বিষাক্ত মানসিকতা
তাহাদের দম আটকাইয়া মারিবে।
১৯৯০ -এ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের “missing women” – থেকে ২০২১ এর ‘বেঁটি বাঁচাও বেঁটি পড়াও’ বা ‘রূপশ্রী’, ‘কন্যাশ্রী’ – এই দীর্ঘ সংগ্রামে , এই দীর্ঘ পথচলায় আমরা এই অসুখের সঠিক ঔষধ বার করতে পারিনি , উপরন্তু হারিয়েছি আমাদের মাতৃভূমির আগামী মায়েদের। রাষ্ট্রসঙ্ঘের UNFPA রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা বিশ্ব জুড়ে নিখোঁজ শিশুকন্যা প্রায় ১৪ কোটি ২০ লক্ষ এবং ভারতে সেই সংখ্যা প্রায় ৫ লক্ষ । উত্তর প্রদেশ, বিহার , রাজস্থান ও হরিয়ানার মত জায়গা থেকে শুরু করে আধুনিক মহারাষ্ট্র এবং রাজধানী দিল্লি নিয়ে মোট ৯ টি রাজ্যে এর অবস্থা ভীষণ রকম শোচনীয়।
ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩১৫ ও ৩১৬ নং ধারায় ভ্রূণ হত্যা ও শিশু হত্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে – যদি কোনো ব্যক্তি এমন উদ্যেশ্য নিয়ে কোনো কাজ করে, যাতে কোনো শিশুর জীবিত অবস্থায় জন্মানোর বাধা দেওয়া হয় , বা কেউ যদি এমন কিছু করে যাতে শিশুটির জন্মের পরেই মৃত্যু হয়, তবে তাকে ভ্রূণ হত্যা বা শিশু হত্যা বলা হবে। যদি না সে মায়ের স্বাস্থ্য ও জীবনের স্বার্থে তা করে থাকে। যদি কোনো ব্যক্তি এমন কিছু করে যাতে গর্ভাবস্থায় একজন শিশুর মৃত্যু হয়, তাহলে তাকে হত্যার অপরাধে অভিযুক্ত করা হবে, উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে। কিন্তু এর পরেও ভারতে প্রতি তিনটির মধ্যে দুটি কন্যা ভ্রূণ নির্ধারণে জন্মের পূর্বেই মারা যায়।
যার ফলস্বরূপ পুত্র অপেক্ষা কন্যা সন্তানের হার দিনদিন কমে যাচ্ছে এবং এক অসম অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। তবুও কিছু মানুষের এখনো বোধোদয় হয়নি। সমাজের ঘুন পোকা কুরে কুরে খাচ্ছে সমাজকে কিন্তু তাদের বিনাশের পথ নেই, কোনক্রমেই বাঁচার উপায় নেই অপ্রস্ফুটিত সেই কুঁড়ি দের। আমার নিজের দেশের কথা যদি বলি তাহলে আমি আমার এই সমাজকে তিন ধরনের পরিবারে ভাগ করব। প্রথম ধরনের পরিবার লিঙ্গ নির্ধারণ করে এবং কন্যা সন্তান হওয়ার খবর শুনে অঙ্কুরেই বিনাশ করে সেই ভ্রূণ। তাতে সন্তানের মায়ের কি অবস্থা হল এটা ওদের ভাবনার বিষয় নয় এবং যতদিন না কোনো পুত্র সন্তান পেটে ধরতে পারবে ততদিন ধরে চলবে এই এক নিয়ম। দ্বিতীয় ধরনের পরিবার একটু উন্নত – তারা লিঙ্গ নির্ধারণ করে না ঠিক ই কিন্তু পুত্র কামনায় মানত করে বিভিন্ন দেবতার কাছে। আর সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে যখন শিশু কন্যা কেঁদে ওঠে তখন তার কান্নাকে ছাঁপিয়ে আত্মীয় পরিজনের কান্নার রোল ওঠে। সেই কন্যা যত বড়ো হয় তার প্রতি অপমান আর অবহেলা ততোধিক বাড়তে থাকে, প্রতি পদে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয় যে সে অনাহুত। অবশেষে একদিন পরিবার সেই কন্যার দায়িত্ত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাঁচে। তৃতীয় পরিবারে পুত্র – কন্যা সমান ভাবে কাঙ্ক্ষিত। তাই সেই পরিবারের আর্থিক অবস্থা যেমনই হোক না কেনো কন্যা সন্তান সর্বদা সমাদৃত।
আমাদের সমাজে কন্যা সন্তানের জন্মে এতো বাধা কেনো? কারণ খুঁজতে গেলে শিহরণ জাগানো আরও কিছু তথ্য সামনে আসবে। আমাদের দেশে কন্যা জন্ম দেওয়ার আগে একটি পুত্র জন্ম দেওয়া বাধ্যতামূলক – কারণ সেই কন্যাকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত ও রক্ষা করবে এই পুত্র সন্তানটি। কিন্তু এখানে প্রশ্ন তাদের রক্ষা করার প্রয়োজন কেনো? কোনো ছেলেকে তো রক্ষা করতে হয়না। এবং এখানেও ঘুরে ফিরে আঙ্গুলটা সেই সমাজের দিকেই উঠছে। এমন এক গলাপচা সমাজে আমরা বাস করি যেখনে সাত মাস থেকে সত্তর বছর – কোনো বয়সের নারীই সুরক্ষিত নয়। তাই পরিবার কন্যা চায় না। এমনকি এই দূষণ যুক্ত সমাজকে দূষণ মুক্ত করার কোনো ইচ্ছাও এদের মধ্যে জাগরিত হয় না।
পরবর্তী কারণ পণপ্রথা। আমাদের এই রুগ্ন সমাজে পণপ্রথা আর এক বড়ো অসুখ। মেয়ের বিয়ের সময় আসবাব ও অলঙ্কারের সাথে মোটা টাকা পণ না দিলে শ্বশুর ঘরে মেয়ে ভালো থাকবে না – একথা প্রতিটি মা বাবারই জানা। কিন্তু ছেলে হলে ব্যাপারটা পুরো উল্টো , তাই পুত্র সন্তান জন্ম দিয়ে ঘরে লক্ষ্মী ( অর্থ ) আনা অনেকে বেশি সহজ ও লাভের ব্যাপার – নিজের ঘরে লক্ষ্মী (কন্যা) জন্ম দেওয়ার থেকে।
তবে এখানেই শেষ নয় – শ্বশুর বাড়ির লোভের পরিমাণের উপর নির্ভর করছে মেয়েটির গোটা জীবন। শুধুমাত্র টাকার জন্য বিয়ের পরেও যে কোনো দিন, যে কোনো সময় মেয়েটিকে শারীরিক ও মানসিক অত্যাচার করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার বাপের বাড়ি। এই ধারা বজায় রাখতে আমাদের শিক্ষিত সমাজের ভূমিকাও কিছু কম নয় কিন্তু। বধূ নির্যাতন , তাকে পুড়িয়ে মারা – এগুলো তো খবরের কাগজের গোটা একটা পৃষ্ঠা দখল করে আছে বিগত এক শতক ধরে।
একটু আধুনিক সমাজে না হলেও আর্থিক দিক থেকে সমাজে যারা নিচের স্তরে বাস করে বা উত্তর প্রদেশ ও বিহারের মত রাজ্যে বহু নাবালিকা মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। সরকারী পূর্ব নিয়ম অনুযায়ী বিবাহের বয়স আঠারো বছর এবং বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী তা বেড়ে একুশ বছর হওয়ার পরও এই রকম ঘটনা ঘটে চলেছে অবিরত। কোনো আইন, কোনো নিয়ম বা কোনো শাস্তির ভয় না করেই বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে মেয়েদের । এই সব জায়গায় মেয়েরা শুধুমাত্র ভোগের বস্তু।
১৯৯৪ সালের আইন অনুযায়ী ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ এবং ভ্রূণ হত্যা যখন দণ্ডনীয় অপরাধ তখন এবং ঘোরতম শাস্তিযোগ্য – তারপরেও এই ঘৃণ্য কাজ থেকে সরে আসার কোনো লক্ষণই নেই কিছু মানসিক বিকারগ্রস্ত পরিবারের। এই জঘন্য অপরাধ হতে হতে শিশুপুত্রের সংখ্যার তুলনায় শিশুকন্যার সংখ্যা কমে গেছে অনেক। তাহলে এই শাস্তি কি যথাযোগ্য নয়? নাকি আরও কিছু কড়া শাস্তিতেই এদের বুদ্ধি ফিরবে? প্রমাণ না পেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।
শেষ আদমশুমারি অনুযায়ী আমাদের দেশে জনসংখ্যা তো বৃদ্ধি পেয়েছে কিছু কমে গেছে মেয়েদের অনুপাত। শুধুমাত্র শিক্ষিত কেরালা আর পুদুচেরি ছাড়া প্রত্যেকটি রাজ্যে ছেলের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা কম। যার ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে সমতা। এই বিজ্ঞানের যুগে আমাদের সাক্ষী থাকতে হচ্ছে এই রকম মর্মান্তিক ঘটনার। তবুও মেয়েদের অবস্থার উন্নতি নেই।
তবুও মেয়েরা এখনো দাস, মেয়েরা এখনো অন্যের বোঝা, মেয়েরা এখনো অপরের বাড়ির ঝিঁ, মেয়েরা এখনো দুর্বল – পদাহত – পদানত।
তবুও মেয়েরা এখনও খুন হয় মাতৃ গর্ভে।