Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কথা ছিল না || Shamsur Rahman

কথা ছিল না || Shamsur Rahman

কথা ছিল না
কথা ছিল না এখানে এভাবে এসে দাঁড়াবার।
কথা ছিল না এখানে দাঁড়িয়ে নিজস্ব ভাবনাগুলোকে
নিপুণ অশ্বারোহীর মতো বাগ মানিয়ে
খেলা দেখাবার। খুব যে একটা কসরৎ করেছি,
বলা যাবে না। যেখানে রৌদ্র দরকার, সেখানে ছড়িয়ে দিয়েছি
বিকেল বেলার রোদ আর যেখানে
ছায়া জরুরি, সেখানে মেঘ থেকে কর্জ এনেছি ছায়া।
একটু হাওয়া বইয়ে দেয়ার প্রয়োজন ছিল,
বৃষ্টির শব্দ মিশিয়ে ভাবনাগুলোকে
মুখর করে তোলার উদ্যম থেকে বিরত থাকার
কোনো চেষ্টাই করিনি।

আমার কথা ছিল ঝরে-যাওয়া নক্ষত্র কুড়িয়ে এনে
মনের মতো একটি মালা গেঁথে তাকে পরিয়ে দেবার,
আমার তো কথা ছিল ঝর্ণাতলার আহত হরিণের আর্তনাদ শুনে
চমকে ওঠা, যেখানে রঙ বেরঙের পাখি
খুঁটে খুটে খায় স্বপ্নবীজ। কথা ছিল অতল জলরাশির ফেনা
ছেড়ে

উঠে আসা জল কন্যার ভাষাহীন ভাষা
শোনার আশায় সমুদ্র তীরে ছুটে যাবার। স্বপ্নে বুঁদ হয়ে
বস্তু জগতের প্রতি উদাসীনতার ডিঙি ভাসিয়ে
ভাটিয়ালী গাওয়া অথবা বনবাদাড়ে
একা-একা ঘুরে বেড়িয়ে গোধূলির ঘণ্টাধ্বনি শোনার কথা
ছিল আমার।

অথচ আমি জল পায়রার ডানার অজস্র ঝাপটানি,
বন দোয়েলের শিস, স্থলপদ্মা আর
পাতার মর্মর আর ডাঙার পাথরে হেলান দেয়া
জলকন্যার চাউনি, যা শুনিয়ে ফেলে আত্মা, বহু যুগের
ঘোড়ার কংকাল দু’পায়ে মাড়িয়ে
আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি স্পন্দিত বুকে তোমাদের
মাঝখানে।

আজো কিছুতেই একথা আমার কাছে স্পষ্ট নয়,
সে কোন শক্তি আমাকে অসুস্থতার নাছোড় বেষ্টনী থেকে,
মধ্যরাতের পাখির বিলাপ,
নক্ষত্ররাজির কুহক, স্তব্ধতার ঢলাদি আর
আকাশের বুক থেকে মাটির দিকে ঝুঁকে-থাকা আধখানা
চাঁদের ঢুলুনি থেকে মুক্ত করে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এখানে।

এখন আমার আর ফেলার পথ নেই। অঙ্গারের
উপর দিয়ে হলেও
হেঁটে যেতে হবে আমাকে, জীবন যত রক্ষ্ণতা বিছিয়ে দিক
পথে, এগিয়ে যেতেই হবে, যত নারকীয় হোক

পায়ে চলার পথ, থামতে পারবো না কিছুতেই।
যে আমার সর্বক্ষণের ভাবনায় জেগে থাকে
ফুটন্ত গোলাপের মতো,
যে আমার হীরের ঝালর সাজানো ঘোড়ার পিঠে
সওয়ার হয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে ঘনীভূত করে
সান্নিধ্যের মধুধারাকে,
যে পছন্দ করে আমার নির্জনতায় হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে,
ভয় পায় জনসমুদ্রে আসতে,
তাকে আমি দ্বিধার টিলা থেকে নামিয়ে
নিয়ে এসেছি এখানে।

আগুন, আগুন, আগুন বলে সবাই
চিৎকার করে উঠেছে দশ দিক কাঁপিয়ে; অনেকে দুঃস্বপ্ন থেকে
জেগে উঠে ঝাঁপ দিয়েছে নদীতে,
অনেকে ভৌতিক স্তব্ধতাকে আলিঙ্গনে করে,
ভেসে গেছে কোথায়, আগুনের ঝড়ে পুড়ে খাক হয়ে গেছে
ঘাটে-বাঁধা নৌকো, রাশি রাশি
শস্যদানা, শত শত কবুতর, গাছের সবুজ পাতা।
আগুনের তাপে ঝলসে যাওয়া মুখ নিয়ে,
জিঘাংসার কুণ্ডলী এক লাফে পরিয়ে
ছুটে এসেছি এখানে।

হন্তারকের ঝাঁক যখন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমাকে
চতুর্দিকে, তখন কিছু লোক
তা তা থৈ থৈ নাচের চূড়ায় তুলে দিয়েছে
ওদের উল্লাসকে, নিরন্নের দল যখন হাহাকারের সমুদ্রে
হাবুডুবু খাচ্ছে, তখন কিছু লোক স্বৈরাচারের অঙ্গের চাদর
আহলাদের সঙ্গে খানিক স্পর্শ করার জন্যে বেজায়
হুটোপুটি জুড়ে দিয়েছে। যখন শহীদদের মা-বোনেরা
উজাড় বুকের শূন্যতা নিয়ে বসে আছেন
মর্মর মূর্তির মতো, তখন কিছু লোক
খুনীদের বিলানো বকলেস গলায় এঁটে
একালের মহত্ত্বকে কামড়ে চকচকে চোখ তুলে দেখছে
কেউ ওদের উদ্দেশে জয়ডঙ্কা বাজাচ্ছে কিনা।
যখন অত্যাচারীর হিস হিস চাবুকের ছোবলে
নীল হয়ে যাচ্ছে আমার শহরের পিঠ,
যখন জালিমের সাঁড়াশি উপড়ে ফেলছে
আমার শহরের চোখ, যখন পালিশ করা বুটের লাথিতে
ভেঙে যাচ্ছে আমার শহরের পাঁজর,
তখনও কি আমাকে ভাবতে হবে বিশুদ্ধ কবিতার
আবৃত স্তনের কথা? এ শহরের বুক যখন ছিঁড়ে যাচ্ছে শ্বাপদদের
নখরের হিংস্রতায়, তখনও কি আমাকে বাঁশিতে তুলতে হবে,
বসন্তবাহার?
স্বদেশ, তুমি তোমার বীর সন্তানদের মরতে দেখেছো
ধুলো-ওড়া প্রান্তরে, নদীতীরে, রাজপথে।
স্বদেশ তুমি দেখেছো কী করে গরম রক্ত টপকে পড়ে
তোমার সন্তানদের বুক থেকে আঙুরের রসের মতো।
স্বদেশ তুমি গোলাপবনে রক্তবন্যা বয়ে যেতে দেখেছো।
স্বদেশ, মা আমার, মাগো,
আর কত শহীদ চাও তুমি আর কত রক্ত ঝরলে
তোমার উদরে জন্ম নেবে সবার ক্ষুধা মেটানো শস্যকণা?
মা আমার, মাগো,
এই পবিত্র স্থানে আমাদের সবার মাথার উপর
হাত রাখো তুমি, যেন ভয়ে আমরা পিছিয়ে না যাই
রণে ভঙ্গ দিয়ে, যেন আমাদের
কোনো মুহূর্তেই মনে না হয় নিঃসঙ্গ আমরা,
বৃথা পচবে না আমাদের শরীর
কবরের বিষণ্ন অন্ধকারে। স্বদেশ, মা আমার,
আজ এই আশ্বাস তুমি আমাদের দাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress