কড়ি দিয়ে কিনলাম (Kari Diye Kinlam) : প্রথম খণ্ড – 10
–যে বউকে শাড়ি-গয়না দিতে পারে না, যে বৌকে খেতে-পরতে দিতে পারে না, যে বউকে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারে না, তার গলায় দড়ি, তার গলায় দড়ি, তার গলায় দড়ি–
অনেকক্ষণ পরেও কথাটা কানের মধ্যে বাজছিল। সত্যিই তো, এও একটা রোগ! দীপঙ্কর ট্রামে বসে বসে অনেক কথা ভাবছিল। কাল আবার নতুন ঘরে, নতুন চেয়ারে গিয়ে বসতে হবে। মিস্টার ঘোষাল গিয়ে বসতে আরম্ভ করবে রবিনসন সাহেবের ঘরে। আবার সেই নতুন করে দায়িত্ব নিতে হবে। আবার নতুন করে চলবে রেলের চাকা! এতদিন রবিনসন সাহেবের রাজত্ব ছিল। নামে ক্রফোর্ড সাহেব মাথার ওপর ছিল। কিন্তু আসলে রবিনসন সাহেবই তো ছিল সব।
ফেয়ারওয়েল মিটিং-এ সাহেব অনেক কথাই বলেছিল। কিছুই বিশেষ কানে যায় নি। সাহেব ইন্ডিয়াকে ভালবেসে ফেলেছিল। বড় অপাত্রে পড়েছিল সাহেবের ভালবাসা। কোন্ দূর সাত সমুদ্র তের নদীর পারের মানুষ কিসের টানে এখানে এসেছিল কে জানে! হয়ত টাকার টানে। টাকাই হয়ত সাহেবকে টেনে এনেছিল ইন্ডিয়ায়। তারপর এখানে থাকতে থাকতে যেটুকু ইন্ডিয়া দেখেছিল, সবটাই ভাল লেগে গিয়েছিল। সাহেব কাউকে উপোস করতে দেবে না। কোনও মানুষের দুঃখ সইতেও পারতো না সাহেব। হাতের কাছে যে-মানুষ ক’টা এসেছিল, তাদের ওপরেই সবটুকু ভালবাসা ঢেলে দিয়ে সাহেব চলে গেল। তার বাইরে আর কিছুই দেখলে না। কিন্তু সাহেব জানতে পারলে না যে, যে-রেলের চাকরি করতে সাহেব ইন্ডিয়ায় এসেছিল, সেই রেলও গরীব মানুষদের বড়লোক করবার জন্যে আবিষ্কার হয় নি। সাহেব জানতে পারলে না যে শুধু রেলই নয়, সব কল-কজাই একদিন তৈরি হয়েছিল গরীব মানুষের মুখের খাবার কেড়ে নেবার জন্যে। ওই টেলিগ্রাফ, ওই স্টীম-ইঞ্জিন, ওই কাপড়ের কল-ওসব শুধু বড়-মানুষদের আরো বড়লোক করবার জন্যে, আর গরীবদের আরো গরীব। যখন সেই এইটিনথ সেঞ্চুরীতে কলকজার জোয়ার এল য়ুরোপে, তারও আগের কথা। কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও নিউটন-কত সব প্রাতঃস্মরণীয় নাম! কে ভেবেছিল তাঁদের সেই সব আবিষ্কার অষ্টাদশ শতাব্দীতে এসে এমন করে গরীবদের মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে আফ্রিকা আর এশিয়ার ভূখণ্ডে! তারা কি জানতো, সেই রেলের আপিসেরই জার্নাল সেকশানের বি-গ্রেড পি-কে-গাঙ্গুলী মাসে মাসে দেনা করে আপাদমস্তক ডুবে যাবে তাদের আবিষ্কারের আশীর্বাদেই! তারা কি জানতো, এই উনিশশো ঊনচল্লিশ সালে দীপঙ্কর সেই রেলের চাকরির প্রমোশনের গোলকধাঁধায় সারা সন্ধ্যেটা এমনি করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াবে! অথচ অবস্থা কি ফেরে নি লোকের? ফিরেছে বৈকি। জুলিয়াস সীজার, ক্যাথেরিন দি-গ্রেট, লুই ফোর্টিল্থ কিংবা আকবর বাদশা পর্যন্ত যে বিলাসিতার কল্পনা করতে পারেনি, তাই-ই ভোগ করছে বিংশ শতাব্দীর একজন বড়লোক। ওই রবিনসন সাহেবেরই ব্রেকফাস্টের টেবিলে থাকে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার আপেল, তানজিয়ারের কমলালেবু, ব্রেজিলের কফি, দার্জিলিং-এর চা, অস্ট্রেলিয়ার বীফ আর ডেনমার্কের বেকন। যে খবরের কাগজ রবিনসন সাহেব পড়ে, তাতে চব্বিশ ঘণ্টা আগের তিব্বতের ভূমিকম্পের কথা যেমন থাকে, তেমনি চিকাগোর শেয়ার মার্কেটের খবরও থাকে। আবার হলিউডের টাটকা আনকোরা নতুন ফিল্ম-স্টার ভিভিয়ান রে’র কথাও থাকে। কিন্তু রবিন্ সাহেব কি কখনও খবর রেখেছে, কোথা থেকে কত কষ্ট করে কাদের মুখের গ্রাস কেড়ে ওই ব্রেকফাস্টের আয়োজন করেছে তার খানসামা! কোন্ রেল গাড়িতে চাপিয়ে সেই খাবারগুলো এসে পৌঁছেছে তার টেবিলে! কে সেই ট্রেনের ড্রাইভার, কে খালাসি? তারা ব্রেকফাস্ট খেয়েছে কিনা? কিম্বা রবিনসন সাহেব কখনও কি ভেবেছে, খবরের কাগজের এই খবরের বাইরেও আরো অনেক খবর আছে, যা ছাপা হয় না, যা ছাপা হতে নেই! যা ছাপা হলে ওই ব্রেকফাস্টের প্লেটেই একদিন ছাই পড়বে! রবি সাহেবের ব্রেকফাস্ট খাওয়া চিরকালের মত ঘুচে যাবে।
আশ্চর্য! মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করেছে দীপঙ্কর স্বদেশী করবে না সে। কিন্তু রবিনসন সাহেব যেন সেই স্বদেশীর বিরুদ্ধাচরণ করতেই তাকে যাবার আগে প্রমোশন দিয়ে গেল। যাতে দীপঙ্করও ব্রেকফাস্ট খেতে পায়। যাতে দীপঙ্করের ব্রেকফাস্টের টেবিলেও ওই সব এসে পৌঁছোয়! কিন্তু দীপঙ্কর তো প্রমোশন না নিলেই পারে! কে তাকে মাথার দিব্যি দিয়েছে। কে তাকে বলেছে নিতেই হবে প্রমোশন!
দীপঙ্করকে যেন রবিনসন সাহেব তার সব পাপের উত্তরাধিকারী করে গেল যাবার সময়। কিরণের মা’কে সে যে দশ টাকা করে মাসোহারা দিয়ে আসছে, তাতেই কি তার পাপঙ্খলন হবে? সব কলঙ্ক মুছে যাবে? নাকি গাঙ্গুলীবাবুকে কাশ্মীরে যাবার খরচ দিলেই তার সব দুষ্কৃতির প্রায়শ্চিত্ত হবে?
–দাদাবাবু!
শম্ভুকে দেখে দীপঙ্করও অবাক হয়ে গেছে। শম্ভু ছিল সেকেন্ড ক্লাস ট্রামে। আর দীপঙ্কর ফার্স্ট ক্লাসে। রাস্তায় নেমেই দেখে ফেলেছে।
শম্ভু বললে আমি তো আপনার বাড়িতেই যাচ্ছিলাম–
দীপঙ্কর বললে–ভালোই করেছ এসে, আমারও খুব আগ্রহ ছিল জানতে। বৌদিমণি বাড়িতে পৌঁছোতে খুব হৈ-চৈ হলো তো!
শম্ভু বললে–-হৈ-চৈ? বলছে কি আপনি?
শম্ভু কিছু বুঝতে পারলে না। আবার বললে–কিসের হৈ-চৈ?
দীপঙ্কর বললে–সকাল থেকে কোথায় ছিল তোমার বৌদিমণি, কেউ খোঁজ নেয় নি? বাড়ি ফেরার পর তোমার মা-মনি কিছু বললে না তোমার বৌদিমণিকে?
শম্ভু যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। বললে–কার কথা বলছেন? কে বাড়ি ফিরে গেছে?
–কেন, তোমার বৌদিমণি?
শম্ভু বললে–সেই বৌদিমণির কথা জিজ্ঞেস করতেই তো এসেছি আপনার কাছে। ভোর রাতৃতির থেকে তো পাওয়া যাচ্ছিল না, আমার কাছ থেকে আপনার ঠিকানা নিয়েছিল কালকে, তা ভাবলাম এখানেই বোধ হয় এসেছে। সারাদিনের মধ্যে আর সময় করতে পারি নি, তাই এখন আসছিলাম খবরটা নিতে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তোমার বৌদিমণি তো ফিরে গেছে আবার! তুমি জানো না?
–আজ্ঞে না। কখন?
–তুমি কখন বেরিয়েছ?
শম্ভু বললে আমি তো খেয়ে-দেয়েই সরকার মশাই-এর সঙ্গে মুদিখানায় গিয়েছিলাম। মাসকাবারি চাল-ডাল-তেল-নুন-মশলা সব খরিদ করে বাড়ি ফিরেছি বিকেলে, তখন তো দেখি নি বৌদিমণিকে। শুনিও নি তো কিছু।
দীপঙ্কর বললে–ওই দুপুরবেলাই গিয়ে পৌঁছেছে তোমাদের বাড়িতে। তুমি তখন বাজারে গিয়েছিলে তাই টের পাও নি।
–তারপর বিকেলবেলা অতক্ষণ ছিলুম, তা-ও তো কিছু কানে গেল না!
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–তুমি ওপরে গিয়েছিলে?
শম্ভু বললে–না, ওপরে যাবার আর সময় পেলাম কোথায়? ভাঁড়ারঘরের জিনিসপত্র বার করা হয়েছিল, সেইগুলো আমি আর কৈলাস মিলে তুললাম, তারপর সন্ধ্যেবেলা বাতাসীর মা’র মুড়ি আনতে গিয়েছিলুম–
দীপঙ্কর বললে–সেই জন্যেই টের পাও নি,এখন যাও, গিয়ে বৌদিমণির ঘরে গিয়ে দেখবে সব ঠিক আছে–
–তাই যাই।
বলে শম্ভু চলে যাচ্ছিল।
দীপঙ্কর বললে–তা সকালবেলা খুব হৈ-চৈ করেছিল তো তোমার মা-মণি?
শম্ভু বললে–আজ্ঞে না, মা-মণির কানে যখন খবরটা দিলে কৈলাস, বুড়ি কিচ্ছু, বললে না-না রাম না গঙ্গা না কিচ্ছু–
–সে কি?
–আজ্ঞে হ্যাঁ, বাড়িসুদ্ধ আমরা সব্বাই অবাক হয়ে গেছি তখন আজ্ঞে। বাতাসীর
মা বললে–বুড়ী খুব সেয়ানা মাগী
ভূতির মা বললে–হ্যাঁ গা, তা খবরটা একবার নেবে না কেউ, বউটা কোথায় গেল?
রান্নাবাড়িতে যে কজন ঝি-ঝিউড়ি কাজ করে, তাদেরই মধ্যে গুজ-গুজ ফিস ফিস হতে লাগলো। কৈলাস গিয়েছিল সতীর ঘরে চা দিয়ে আসতে। গিয়ে দেখলে ঘর ফাঁকা। তাড়াতাড়ি গিয়ে এ-ঘর ও-ঘর দেখেছে। তারপর মা-মণির কাছে গিয়ে বলেছে।
মা-মণি কথাটা শুনে বললে–দারোয়ানকে ডাক, ডেকে দে–
দারোয়ান এল। বললে–আমি বাইরে খাঁটিয়ায় শুয়েছিলুম হুজুর, যখন নিদ ভাঙলো, দেখি গেট খোলা–
–তা চাবি কোথায় রেখেছিলে তুমি?
দারোয়ান বললে–হুজুর আমার কাছে
–তোমার কাছে যদি চাবি ছিল তো গেটের তালা খুললো কী করে?
দারোয়ান আর কিছু জবাব দিতে পারে না।
মা-মণি বললেন–যাও তুমি–
ধমক খেয়ে চলে গেল দারোয়ান। তারপর কৈলাসকে বললেন–সোনা কোথায়? সোনাকে ডেকে দে–
সনাতনবাবুর তখন চা খাওয়া হয়ে গিয়েছে। এসে বললেন–কী হলো মা?
মা-মণি বললেন–শোন্ এখানে বোস—
সনাতনবাবু বসলেন। মা-মণি বললেন–বৌমা চলে গিয়েছে, শুনেছ?
সনাতনবাবু বললেন—ও–
–হ্যাঁ, তা সে গেছে আপদ গেছে। আমি চাই না তাই নিয়ে কেউ হৈ-চৈ করুক। গয়না-টয়না যা কিছু ছিল বউমার সে-সব তো আমার কাছেই আছে। দু’একখানা চুড়ি হাতে ছিল, তার জন্যে আমি ভাবি না। এখন তোমায় যে-জন্যে ডেকেছি তা হলো এই যে, তুমি যেন ওই নিয়ে মাথা ঘামিও না আবার, বুঝলে?
সনাতনবাবু বললেন—বুঝেছি–
সনাতনবাবু চলেই যাচ্ছিলেন। মা-মণি আবার ডেকে বললেন–কোথায় গেছে, কী করতে গেছে, কেন গেছে, তা নিয়েও যেন কেউ মাথা না ঘামায়। দেখি কোথায় যায়! কোথায় গিয়ে এই সুখ পায়! অনেক অহঙ্কার দেখেছি, এবার বৌমার অহঙ্কারটাও না হয় দেখা যাক–
সনাতনবাবু বললেন—আচ্ছা–
–আর যদি কখনও ফিরে আসে, ফিরে এলেও যেন কিছু বোল না তুমি বাবা। যা বলবার আমি বলবো। আমিই পছন্দ করে ঘরে এনেছিলুম, এখন আমারই জ্বালা! বড় মেয়ে একদিন পালিয়ে গিয়েছিল বাড়ি থেকে, ছোট মেয়েও সেই পথ ধরলো আর কি! বংশের ধারা যাবে কোথায়? তার একটা কথা–
সনাতনবাবু দাঁড়ালেন।
মা-মনি বললেন–তুমি যেন বেয়াইমশাইকে কোনও খবরাখবর দিও না আবার এ বিষয়ে। যা করবে আমাকে জিজ্ঞেস করে করবে–কেমন?
শুধু দারোয়ান নয়। শুধু সনাতনবাবুও নয়। একে একে সকলেরই ডাক পড়লো। কে কোথায় বৌদিমণিকে দেখেছে সেই ফিরিস্তি দিলে। কারোর কথাতেই কিছু সুরাহা হলো না। আসলে কেউ-ই দেখে নি। সবাই যখন ঘুমোচ্ছিল, সেই সময়েই বৌমা চলে গেছে বাড়ি থেকে।
শম্ভুকেও ধমকালেন মা-মণি। বললেন–তুই-ই যত নষ্টের গোড়া, তোর সঙ্গেই যত শলা-পরামর্শ হতো তার, খবরদার বলে দিচ্ছি শম্ভু, এ-বাড়িতে যদি অন্ন রাখতে চাস তো, মুখ বুজে থাকবি, আমার হুকুম মেনে চলবি, নইলে জুতো পেটা করে দূর করে দেব এখান থেকে। আমারই খাবি সবাই আবার আমারই ডালে কাটি দিবি, এ আমি সহ্য করবো না-যা সব এখান থেকে, আপদ বিদেয় হ–
শম্ভু বললে–তারপর খাওয়া-দাওয়া সেরে বাজারে গেলুম সরকার মশাই-এর সঙ্গে। তারপর এখন একটু হাল্কা পেতেই দৌড়ে এসেছিলাম–
দীপঙ্কর বললে–তুমি কিছু ভেবো না শম্ভু, আমি তোমার বৌদিমণিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি, আর বাড়িতে কী ঘটছে এখন, সেটাও কাল সকালে আমাকে একবার জানিয়ে যেও–
শম্ভু চলে যেতে গিয়ে বললে–তা জানাবো, ফুরসুত পেলেই আপনাকে জানাবো
দীপঙ্কর বললে–আর দেখ, তোমার বৌদিমণিকে একটু ধৈর্য ধরে থাকতে বোল, হুট করে যেন আবার একদিন এখানে চলে না আসে-আর বোল, আমি বৌদিমণির বাবার কাছে চিঠি লিখে দিচ্ছি–ভাবতেও বারণ কোর!
শম্ভু চলে যাচ্ছিল।
দীপঙ্কর আবার মনে করিয়ে দিলে। বললে–তাহলে কালকে খবর দিয়ে যেও বৌদিমণি কেমন আছে, বুঝলে?
শম্ভু চলে গেল। ট্রাম রাস্তা থেকে সোজা আসতে বাড়ির একেবারে কাছে এসে কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো আবার। মা নেই। মা এতন কাশীতে ধর্মশালায় শুয়ে পড়েছে হয়ত। সারাদিন ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখে বেড়িয়েছে। পা বোধ হয় ব্যথা হয়ে আছে। কাল সকালে বোধ হয় চিঠি আসবে। এই সাড়ে আটটা নটা নাগাদ পিওন এ রাস্তায় আসে। তখন জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে।
এদিকে সতী ছিল, সে-ও নেই। সতী থাকলেও বেশ হতো। অন্তত এত ফাঁকা লাগতো না আর তাহলে। আশ্চর্য মেয়ে বটে! বাবাকে চিঠি লিখেছে, তবু নিজের বিপদের কথাটা লেখে নি। কী জেদী মেয়ে সতী! এত জেদ কিসের? কে শেখালে এত জেদ?
সদর দরজার কড়া নাড়তেই কাশী দরজা খুলে দিয়েছে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলো রে, সকাল বেলা দিদিমণিকে ভালো করে খেতে দিয়েছিলি তো?
কাশী বললে–না দাদাবাবু, খায় নি–
–সে কী রে, না খেয়েই চলে গেল?
কাশী বললে–না, আমি অনেক সাধাসাধি করলুম, কিছুতেই খেলে না। আর কী চেঁচামেচি দুজনে। সে চেঁচানিতে কান পাতা যায় না কিছুতে–একজন যত চেঁচায়, আর একজন তত চেঁচায়–
দীপঙ্কর অবাক হয়ে গেল। অফিস যাবার সময় দীপঙ্কর দেখে গিয়েছিল লক্ষ্মীদির কোলে মাথা রেখে সতী কাঁদছে। ভেবেছিল বুঝি দু’বোনে খুব ভাব হয়ে গেল।
–তারপর?
কাশী বললে–তারপর একজন তো রেগেমেগে বাড়ি থেকে চলে গেল, আর একজন দিদিমণি রইল–
–কে রইল?
কাশী বললে–প্রথমে সকালবেলা যে-দিদিমণি এসেছিল–সেই দিদিমণি–
অবাক কাণ্ড! সতী যায় নি তাহলে? তাড়াতাড়ি সেই অবস্থায়ই ওপরে উঠে গিয়ে ঘরের সামনে যেতেই দেখলে সতী তার বিছানাতেই চোখ বুজে সেই রকম শুয়ে আছে। দীপঙ্করের জুতোর আওয়াজ পেতে চোখ খুললে।
দীপঙ্কর বললে–কী হলো? তুমি যাও নি?
সতী বললে–আমি যাবো না, দেখি লক্ষ্মীদি কী করতে পারে!
–কেন লক্ষ্মীদি কী করলে? অফিস যাবার সময় দেখে গেলাম সব মিটমাট হয়ে গেছে, হঠাৎ আবার কী হলো! আর তাছাড়া তুমি খেলে না-ই বা কেন? সারাদিন ঝগড়া করে উপোস করে রইলে? তোমার সত্যিই কী হলো বলো তো? আমি অফিস থেকে বেরিয়ে ভাবছি এতক্ষণে তুমি বোধ হয় শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সব মিটমাট করে ফেলেছো–
সতী বললে–না আমি আজ রাত্তিরটা এখানেই থাকবো—
বলে আবার চোখ বুজলো।
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু খেলে না কেন? উপোস করলে কার ওপর রাগ করে?
সতী বললে–তোমার ওপর–
দীপঙ্কর হেসে বললে–তুমি রাগ করে না খেলে কি আমি জব্দ হবো মনে করেছ? আর এদিকে আমি যে পেটভরে খেয়ে আবার টিফিন খেলুম-চলো ওঠো ওঠো–খেয়ে নাও–
কাশীও পেছন-পেছন এসে দাঁড়িয়েছিল দরজার কাছে। দীপঙ্কর বললে–খাবার দে আমাদের, দুজনে এক সঙ্গে খাবো–
কাশী চলে যেতে দীপঙ্কর বললে–আশ্চর্য দেখ, আমি ধরে বসে আছি যে তুমি চলে গিয়েছ, এই একটু আগে শম্ভু এসেছিল তোমার খোঁজে–
সতী এতক্ষণে চমকে উঠে মুখ তুললো। বললে–শম্ভু এসেছিল? আমার খোঁজে? কী বললে সে? বাড়িতে খুব হৈ-চৈ হচ্ছে তো ওখানে?
দীপঙ্কর বললে–তা তো হবেই, তোমার শাশুড়ী সব্বাইকে ডেকে বলে দিয়েছেন, যেন এই নিয়ে ঘেট পাকানো না হয়, সনাতনবাবুকেও বলে দিয়েছেন!
সতী জিজ্ঞেস করলেশ আর কী বললে?
দীপঙ্কর বলল–আর কিছু বললে না।
সতী বললে–তা শম্ভুকে ডেকে নিয়ে এলে না কেন এখানে?
দীপঙ্কর বললে–তা আমি কি জানি যে তুমি এখনও এখানে আছো, আমি জানি লক্ষ্মীদির সঙ্গে তুমি চলে গিয়েছ, লক্ষ্মীদি তোমাকে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডে পৌঁছে দিয়েছে। আপিস যাবার আগে তো সেই ব্যবস্থাই হয়েছিল?
সতী আবার জিজ্ঞেস করলেশম্ভু ওঁর কথা কী বললে? উনি কি খুব মুষড়ে পড়েছেন?
–কার কথা বলছো? সনাতনবাবু? তাঁর কথা তো শম্ভু কিছু বললে না।
সতী আবার জিজ্ঞেস করলে কিছু বললো না? কোন ঘরে শুচ্ছেন এখন?
–তা তো আমি জিজ্ঞেস করি নি!
সতী বললে–তাহলে তুমি কী আর জিজ্ঞেস করলে? তুমি তো জিজ্ঞেস করবে আমি চলে আসার পর কী হচ্ছে বাড়িতে? দারোয়ানের চাকরি গেছে কিনা, বাতাসীর মা কী বলে, ভূতির মা কী বলছে–সেই সব কথাই তো আসল! সেইগুলোই জিজ্ঞেস করলে না?
দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা, কাল তো শঙ্কুকে আসতে বলেছি, সে এলে সব কথা তাকেই জিজ্ঞেস কোর–
তারপর একটু থেমে বললে–কিন্তু তা তো হলো, এখন তুমি গেলে না কেন?
সতী প্রথমে কিছু উত্তর দিলে না। তারপর একটু থেকে বললে–আমি চলে গেলেই কি তুমি খুশি হতে?
হঠাৎ সতীর এ-প্রশ্নের জন্যে দীপঙ্কর যেন প্রস্তুত ছিল না। বললে তুমি শ্বশুর বাড়িতে মানিয়ে-গুনিয়ে সুখে ঘরকন্না করবে এইটেই তো স্বাভাবিক, এইটেই তো লোকে দেখতে চায়।
–লোকের কথা ছেড়ে দাও, তুমিও কি তাই চাও? তুমিও কি চাও আমি ওই বাড়িতে ওই জেলখানার মধ্যে পচে মরি? যেখানে আমার নিজের কথার কোনও দাম নেই, আমার নিজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বলে কিছু জিনিস নেই, যেখানে আমি নামে মাত্র বউ, যেখানে আমার কোনও অধিকারই নেই, সেখানেই থাকি, এইটেই তুমি চাও? তুমি তো জানো তোমাকে একদিন নেমন্ত ন্ন করেছিলুম বলে আমার অপমানের শেষ ছিল না, আর সে-অপমান তোমার সামনেই আমাকে সহ্য করতে হয়েছিল? এর পরেও তুমি আমাকে সেখানে যেতে বলছো?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু সেখানে না-গিয়ে কী করবে?
সতী বললে–এতদিন সেই কথা ভাববার সময়ই তো পাই নি, এখন একটু ভাবতে সময় দাও–
দীপঙ্কর বললে–সকালবেলা তোমার বাবাকে চিঠি লিখতে বললুম, কিন্তু বাবাকেও তো তুমি নিজের অবস্থার কথা কিছু লেখো নি?
সতী মুখ তুলে চাইল সোজা দীপঙ্করের দিকে। বললে–তুমি কী করে জানলে? তুমি কি চিঠি খুলেছ আমার?
–হ্যাঁ খুলেছি, কিন্তু বলো কেন তুমি নিজের অবস্থার কথা জানালে না?
সতী বললে–তুমি আমার বাবাকে জানো না তাই অমন কথা বলছো! লক্ষ্মীদির ব্যাপারে বাবা যা কষ্ট পেয়েছেন, এর পর আমার অবস্থা শুনলে আরো কষ্ট পাবেন–
দীপঙ্কর বললে–তিনি কষ্ট পাবেন বলে তুমি নিজের কথা গোপন করে রাখবে? এ কি গোপন রাখবার জিনিস? আর এ কি গোপন থাকবে ভেবেছ?
সতী বললে–তা জানি না, তবে এমনি করে যতদিন লুকিয়ে রাখা যায়, ততদিনই ভালো!
–কিন্তু তারপর?
সতী বললে–তারপরের কথা আমি আর ভাবতে পারি না।
বলে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। দীপঙ্কর বললে–তুমি ভাবতে না-পারো কিন্তু আমাকে তো ভাবতেই হবে–
সতী এবারও কথা বললে না। দীপঙ্কর বললে–একটা কিছু তো জবাব দেবে আমার কথার। তোমার নিজের দায়িত্ব যে এখন আমার দায়িত্ব, তোমার ভালো-মন্দ যে এখন আমারও ভালো-মন্দ-। তোমার ভবিষ্যৎ ভাগ্যের সঙ্গে যে আমারও ভাগ্য জড়িয়ে ফেলেছ!
সতী এবার মুখ তুলে চাইল। বললে–তার মানে?
দীপঙ্কর বললে–তুমি যদি সেদিন আমাকে তোমার বাড়িতে নেমন্তন্ন করে না খাওয়াতে তো আমার কিছু বলবার ছিল না। তোমার সঙ্গে আমার যদি আবার দেখা না হতো তো আমিও তোমার কথা নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু এখন তো আর তার উপায় নেই। এখন যে তুমি আমার বাড়িতে এসে উঠেছ, এখন যে এক-বাড়িতে এক ঘরে বসে আছ আমার সঙ্গে-এ-কথা যে আর কারো জানতে বাকি থাকবে না দুদিন পরে–
সতী হাসলো ঠোঁটের আড়ালে। বললে–কেউ জানতে পারবে বলেই বুঝি তোমার এত ভয়?
দীপঙ্কর বললে–ভয় আমার নয়, আমি পুরুষ মানুষ কিন্তু তুমি যে মেয়েমানুষ। ভয় তো তোমারই।
সতী বললে–আমার ভয়ের জন্যে তোমাকে এত ভাবতে হবে না।
দীপঙ্কর বললে–তোমার জন্যে আমি ভাববো না তো কে ভাববে? কে আছে তোমার এখানে?
সতী বললে–আমার জন্যে যদি তোমার এতই ভাবনা তো আমাকে না-হয় তোমাদের বাড়িতে থাকতে দাও দুটো দিনের জন্যে, আমি একটু ভালো করে ভেবে দেখি নিজের অবস্থাটার কথা!
কাশী হঠাৎ ঘরে ঢুকলো। বললে–খাবার দেব দাদাবাবু?
দীপঙ্কর সতীকে জিজ্ঞেস করলে–এখন খাবে তো, না এ-বেলাও আমার ওপর রাগ করে উপোস করে থাকবে?
সতী হেসে বললে–সত্যিই আমি সকালবেলা তোমার ওপর রাগ করেছিলুম আচ্ছা সকালবেলা কেন তুমি লক্ষ্মীদিকে ডেকে এনেছিলে বলো তো? তুমি কি ভেবেছিলে তোমার কথা না শুনে আমি লক্ষ্মীদির কথা শুনবো? তোমার চেয়ে লক্ষ্মীদিই বড়ো হলো আমার কাছে?
দীপঙ্কর কাশীকে বললে–খাবার দে আমাদের–
তারপর সতীর দিকে চেয়ে বললে–লক্ষ্মীদি না তোমার নিজের মায়ের পেটের বোন? তার কাছে আমি কে তোমার?
সতী হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–তুমি সকাল থেকে আমাকে অনেক অপমান করেছ দীপু, আমি মুখ বুজে সব সহ্য করেছি, আর আমার সহ্য হচ্ছে না–তুমি চুপ করো–
দীপঙ্কর আর কিছু না বলে পাশের ঘরে গিয়ে জামা-কাপড় বদলে হাত মুখ ধুয়ে নিলে। তারপর বেরিয়ে এ-ঘরে এসে সন্তোষকাকার মেয়ের শাড়িটা দিয়ে বললে এইটে তুমি পরে নাও–
সতী শাড়িটা নিলে। তারপর বললে–যার শাড়ি সে যদি জানতে পারে তো রাগ করবে না?
দীপঙ্কর বললে–ভাবনা তোমার নয়, রাগ করলে তোমার ওপরে তো আর রাগ করবে না?
সতী বললে–তোমার ওপরে রাগ করলেও তো আমাকেই ভাবতে হবে!
–কেন? আমার ওপর রাগ করলে তোমার তাতে কী?
সতী হেসে ফেললে। বললে–বা রে বা, মিছিমিছি আমি কেন দু’জনের মধ্যে কাঁটা হয়ে থাকবো বলো তো?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু তুমি যা ভেবেছ তা নয়, কাশী তোমাকে সব ভুল বুঝিয়েছে
সতী বললে–ভুল হোক ঠিক হোক আমি কেন নিমিত্তের ভাগী হতে যাই মাঝখান থেকে
দীপঙ্কর বললে–তা হোক, তোমার শ্বশুরবাড়িতেও তো আমি নিমিত্তির ভাগী হয়ে আছি, এর পরে তুমি নিমিত্তের ভাগী হলে না-হয়, শোধ-বোধ হয়ে যাবে-যাও, ও-ঘরে গিয়ে কাপড়টা বদলে এসো–দেরি কোরো না—
তা কাশী নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে রান্না-বান্না করেছিল মন্দ না। দীপঙ্কর বার বার চেয়ে চেয়ে দেখলে সতী খাচ্ছে কী না। আগের দিন সতীদের বাড়িতে সতী সামনে বসিয়ে দীপঙ্করকে খাইয়েছিল। সেদিন অনেক আয়োজন, অনেক অনুষ্ঠান করেছিল সতী দীপঙ্করকে একরকম না-জানিয়েই বলতে গেলে। সেদিন ছিল দীপঙ্করের জন্মদিন। আর আজ নিতান্ত অপ্রত্যাশিত অবস্থায় সতী এসে পড়েছে। নিতান্ত অযাচিত, রবাহুত নেমন্তন্ন।
দীপঙ্কর বললে–পেট ভরে খাও সতী, আজকে তো আর বাড়িতে মা নেই যে তোমাকে আদর করে সেধে সেধে খাওয়াবে! আর তা ছাড়া আমি ঠিক মনের কথা মুখে বলতেও পারি না।
সতী বললে–বহুদিন থেকে আমার একটা সাধ ছিল যে তোমার জন্মদিনে ভালো করে তোমাকে খাওয়াবো-উল্টে তুমিই আজ আমাকে খাইয়ে দিলে দীপু–
দীপঙ্কর বললে–এখনো কিন্তু সেইদিনকার কথাটা ভুলতে পারি না, মনে হয় কেন তুমি আমাকে অমন করে খাবার নেমন্তন্ন করেছিলে সেদিন!
সতী বললে–কিন্তু সেদিন খাবার নেমন্তন্ন করেছিলুম বলেই তো আজকে এখানে এমন করে দু’জনে এক সঙ্গে খেতে বসবার সুযোগটা হলো!
দীপঙ্কর বললে–কথাটা তুমি এমন করে বললে যেন মনে হচ্ছে খেতে তোমার খুব ভাল লাগছে! অথচ মা থাকলে কি তোমাকে এই খাওয়া খেতে দিতে পারতো? সেদিন তুমি আমার জন্যে কত-কী খাবার আয়োজন করেছিলে বলো তো! কত রকম রান্না করেছিলে সারাদিন ধরে? কী কষ্টটাই না করেছিলে আমার জন্যে?
সতী বললে–কিন্তু কী লাভটাই বা হলো তাতে তোমার?
দীপঙ্কর বললে–বাঃ বলছো কী? লাভ হলো না, কত ভাল-ভাল জিনিস খেতে পেলাম!
সতী বললে–জানো, তুমি চলে আসার পর আমি সেদিন কিছু খাই নি, খেতে পারি। নি–সারারাত কেবল নিজের মনেই হায়-হায় করেছি, আর কেঁদেছি! উনি বললেন– দীপঙ্করবাবুকে আর একদিন নেমন্তন্ন করে খাইয়ে দিও–
দীপঙ্কর বললে–সনাতনবাবু কিন্তু তোমাকে খুব ভালবাসেন সতী–
সতী বললে–সত্যিই মানুষটা তো খারাপ নয় দীপু,আমার রাগ হয় বটে ওঁর ওপর, কিন্তু সত্যিই মানুষটা খারাপ নয়। এত ভাল মানুষ যে মাঝে-মাঝে যখন বকি ওঁকে, কষ্টও হয় নিজের–
দীপঙ্কর বললে–তুমি হাসালে সত্যি—
সতী বললে–তুমি ঠিক বুঝবে না দীপু। আর তোমারই বা দোষ কী, কেউই বোঝে। যে শুনবে ভাববে বুঝি আমারই দোষ। বুঝি আমিই ঝগড়া করি দিনরাত, আমিই বুঝি সাধ করে অশান্তি সৃষ্টি করি, আমিই বুঝি ও-বাড়িতে সব অশান্তির মূল।
কথা বলতে বলতে সতীকে যেন নেশায় পেয়ে গিয়েছিল সেদিন। কথা বলতে বলতে সতী সেদিন ক্রমেই যেন বড় সহজ হয়ে গিয়েছিল। সকালবেলার সেই রুক্ষ মেজাজের মানুষ যেন আর নয় সে তখন। কাশী পরিবেশন করছে দু’জনকে। বালিগঞ্জের স্টেশন রোডে সন্ধ্যে অনেকক্ষণ উতরে গেছে। সেই গোল গোল চাপার কলির মত আঙুল দিয়ে ভাত খেতে খেতে সতী যেন ভুলে গেল কোথায় কাদের বাড়িতে বসে সে। গল্প করছে। মাথার কোঁকড়ানো চুলের খোঁপাটা আলগা হয়ে কাঁধে ঝুলছে। কথা বলতে বলতে সে যেন ক্রমে সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের অঘোরদাদুর দোতলা ভাড়াটে বাড়ির ভেতরে রান্নাঘরে চলে গিয়েছে একেবারে। বিয়ের আগের সেই ছোট্ট চঞ্চল ছটফটে মেয়েটি। দীপঙ্করের তখন খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সতীর তখনও শেষ হয় নি। একটু একটু করে মুখে দিচ্ছে আর গল্প করছে।
সতী হঠাৎ বললে–ওমা, ওই দ্যাখ, গল্প করতে করতে কত ভাত খেয়ে ফেলেছি দেখেছ–
দীপঙ্কর বললে–তাতে কী হয়েছে, এখানে খেতে আর দোষ কী! এ তো আর শ্বশুরবাড়ি নয়
সতী উঠলো। বললে–এবার ওঠো, ওঁর কথা বলতে বলতে খেয়ালই ছিল না একেবারে–
হাত ধুয়ে ঘরে বসেও সতী যেন তখনও আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে সনাতনবাবুর কথায়।
বললে–জানো দীপু, ও-মানুষের সঙ্গে এক সঙ্গে খাওয়া আমার কপালে হয় নি, অথচ কতদিন আমার সাধ হয়েছে দু’জনে একসঙ্গে খেতে বসি, দু’জনে গল্প করি, দু’জনে একসঙ্গে মুখোমুখি হয়ে থাকি।
দীপঙ্কর বললে–তা করো না কেন? সময় হয় না বুঝি?
সতী বললে–ওমা, সময় হবে না কেন? সময় তো অঢেল, ওঁরও সময় যথেষ্ট, আমারও কোনও কাজ নেই–
–তাহলে অসুবিধেটা কোথায়?
সতী বললে–ওদের ওসব নিয়ম নেই যে, স্বামী আগে খাবে, শাশুড়ী খাবে, তারপর বাড়ির বউ, তারপর ঝি-চাকর সবাই–
দীপঙ্কর বললে–এসব নিয়ম তো সেকালে ছিল, একালে কে আর ও-নিয়ম মানে?
সতী বললে–কেউ না মানুক, ওরা মানে!
দীপঙ্কর বললে–তা ও-নিময় না মানলেই পারো তোমরা? তুমি সনাতনবাবুকে নিয়ে গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেই পারো-তোমাদের গাড়ি রয়েছে, চাকর-বাকর রয়েছে ঠাকুর রয়েছে, ভাবনা কী?
সতী বললে–সে হলে তো বেঁচে যেতাম দীপু, উনি যদি আমাকে একটু বকতেন, কিম্বা বারণ করতেন, তাতেও ভালো লাগতো, তবু বুঝতুম যে আমি বলে একটা মানুষ আছি সংসারে। কিন্তু উনি এক-এক সময়ে ভুলে যান যে আমি বেঁচে আছি, ভুলে যান যে আমারও একটা নাম আছে! তা নয় আমি যেন বাড়ির একটা টেবিল কি চেয়ার কি আলনা কি ওনি একটা কিছু-আমি যেন ও-বাড়ির একটা ফার্নিচার ছাড়া আর কিছু নই–
তারপর একটু হেসে ফেললে।
দীপঙ্কর বললে–কী হলো? হাসছো যে হঠাৎ?
সতী বললে–হঠাৎ হাসি পেল–জানো দীপু, একদিন আমি জিজ্ঞেস করলুম, আচ্ছা বলো তো আমার নাম কী? আমি রসিকতা করেই কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলুম, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার ভাই, আমার নামটাই ভুলে গেছেন–
দীপঙ্কর বললে–সে কি? তাই কখনও হতে পারে?
সতী বললে–সত্যি ভাই দীপু, এই তোমার গা ছুঁয়ে বলছি—
সতী সত্যিই নিজের একটা আঙুল দিয়ে দীপঙ্করের হাতটা ছুঁলে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে–কী রকম?
–আর কী রকম! হঠাৎ কথাটা জিজ্ঞেস করতেই যেন ভাবনায় পড়ে গেলেন। বললেন–নাম? কী যেন তোমার নামটা, কী যেন–
বলে ভাবতে লাগলেন।
আমি বললাম-যাক, তোমার আর কষ্ট করে মনে করতে হবে না, খুব হয়েছে—
উনি তখন বললেন–মনে পড়েছে–সতী, সতী–
আমি বললাম-যথেষ্ট হয়েছে, তোমার স্মরণ-শক্তি খুব ভালো, এই স্মরণ-শক্তি নিয়ে তুমি এম-এ পাশ করতে পারলে আর আমার নামটা তুমি ভুলে গিয়েছিলে?
উনি বললেন–আমি একটু অন্য কথা ভাবছিলাম কি না, তাই—
বললাম-তুমি অন্য কথাই ভাবো তাহলে, আমি আর তোমায় বিরক্ত করবো না–
–তা ওমা, আমি যেই ওই কথা বলেছি আর তিনি ওপাশ ফিরেই নাক ডাকিয়ে ঘুম। ভাবতে পারো দীপু, এমন মানুষকে নিয়ে কেউ ঘর করতে পারে! না করতে ভাল লাগে! অথচ মানুষটা যে খারাপ তাও বলতে পারবো না। এমনিতে তো কোনও দোষ নেই। লোকের কত রকমের দোষ থাকে, চরিত্রের দোষ যাকে বলে। বড়লোকের ছেলে, চরিত্রের দোষ থাকলেই বা আর আমি কী করতে পারতুম? মদের নেশাও থাকতে পারতো। তা সে-সব কিছু নেই। একেবারে সাধু-পুরুষ যাকে বলে আর কি! এমন কি পানটা পর্যন্ত খান্ না। বাড়িতে বাস করেন, সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরেন, নইলে গেরুয়া পরিয়ে দিলে ওঁকে সন্ন্যাসী বলুতম আমি। পুরোপুরি সন্ন্যাসী হলেও তবু বাঁচতুম। ভাবতুম যে হ্যাঁ আমার সঙ্গে না-হয় একজন সন্ন্যাসীরই বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এ এদিকেও না, ওদিকেও না, এক-এক সময়ে মনে হয় উনি মাতাল লম্পট চরিত্রহীন হলেও বুঝি ভালো হতো এর চেয়ে। তবু বুঝতে পারতুম যে উনি মানুষ। কিন্তু এ যে পুরোপুরি দেবতাও নয় আবার পুরোপুরি মানুষও নয়। এ যেন দুই-এর মাঝামাঝি।
তারপর হঠাৎ দীপঙ্করের দিকে চেয়ে বললে–আচ্ছা, তুমিই বলো তো দীপু, পুরুষ মানুষ পুরুষ-মানুষের মত হলে কারো ভালো লাগে?
দীপঙ্কর এ-কথার কোনও উত্তর দিতে পারলে না। সতীর গলার সুরে কোথায় যেন একটা কান্নার সুর মেশানো ছিল। অভিযোগ নয়, অনুযোগ নয়, কান্না। দীপঙ্করের সত্যিই মায়া হলো সতীর ওপর।
–তা এসব কথা তোমাকে বলছি বলে যেন কিছু মনে কোরো না দীপু!
–না, না, তুমি বলো না।
সতী বললে–আর তাছাড়া তোমাকে না বললে আর কাকে বলবো বলো? এসব কে শুনবে আর কে-ই বা বুঝবে? আর কারই বা এত মাথা-ব্যথা হবে আমার জন্যে! বাবাকে তো এসব কথা বলা যায় না। আর লক্ষ্মীদি? লক্ষ্মীদি গোল্লায় না গেলে হয়ত বুঝতো! কিন্তু লক্ষ্মীদি তো আমার সে-রকম দিদি নয়। একেবারে গোল্লায় গেছে। আশ্চর্য, লক্ষ্মীদি কিনা মদ খায়! আমি কি সাধ করে ঝগড়া করলুম আজ!
দীপঙ্কর বললে–কে বললে তোমাকে মদ খায়?
সতী বললে–আমি জেনেছি—
–লক্ষ্মীদি তোমাকে বলেছে?
সতী বললে–না, আমি যে মুখে গন্ধ পেলুম। তুমি অফিস যাবার পর আমাকে উপদেশ শোনাতে এসেছিল। ভাবলাম হয়ত এখন নানান কষ্টে ভুগে ভুগে অনুতাপ হয়েছে লক্ষ্মীদির। কিন্তু মুখে মদের গন্ধ পেতেই আমি ধরলাম। বললাম–তুমি মদ খাও লক্ষ্মীদি? তোমার মুখে মদের গন্ধ পাচ্ছি যে–
লক্ষ্মীদি বললে–না, ও হোমিওপ্যাথিক ওষুধের গন্ধ–
–প্রথমে লুকোতে চেষ্টা করেছিল, জানো দীপু! প্রথমটায় ভেবেছিল আমি বুঝতে পারবো না। কিন্তু রেঙ্গুনে বার্মিজদের দেখেছি তো, রাস্তা দিয়ে মদ খেয়ে মাতলামি করতে করতে যেত। ও আমার চেনা গন্ধ। আমি এক ধাক্কায় ঠেলে ফেলে দিলুম লক্ষ্মীদিকে। বললাম-বেরিয়ে যাও এ-ঘর থেকে। তুমি মদ খেয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে এসেছ?
ধাক্কা দিতেই লক্ষ্মীদি একেবারে ওইখানে ওই দেয়ালে লেগে ছিটকে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
দীপঙ্কর বললে–সর্বনাশ! তাই নাকি? লাগে নি তো?
সতী বললে–লেগেছে বৈ কি! খুব লেগেছে, বোধহয় মাথাটা কেটে গেছে, আমি তখন রেগে গেছি, আমার কোনও জ্ঞান নেই তখন, আমাদের চেঁচামেচিতে তোমার চাকরটাও দৌড়ে এসেছে। সেই অবস্থাতেই আমি লাথি মেরেছি লক্ষ্মীদিকে, যা-নয় তাই বলে গালাগালি দিয়েছি, যা মুখে আসে তাই বলে চেঁচিয়েছি
দীপঙ্করের নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল। বললে–ছি ছি, লক্ষ্মীদিকে তুমি মারলে? লাথি মারলে লক্ষ্মীদিকে?
সতী বললে–কী করবো? তখন কি আমার জ্ঞান আছে! আমি তখন নিজের জ্বালায় জ্বলছি, ক’দিন ঘুমোতে পারিনি, ক’দিন খাইনি, চান করিনি তার ওপর লক্ষ্মীদির কাণ্ড দেখে আমার মাথায় রাগ চড়ে উঠেছে
–তারপর কী হলো?
সতী বললে–তারপর আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম-বেরিয়ে যাও তুমি, বেরিয়ে যাও। লক্ষ্মীদির মাথায় তখন বোধহয় খুব জোরে লেগেছে। দু’হাতে মাথাটা টিপে ধরে আস্তে আস্তে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল–বোধ হয় মাথাটায় খুব লেগেছে
দীপঙ্কর বললে–ছিঃ, তুমি লক্ষ্মীদিকে এইরকমভাবে মারলে? আগে জানলে আমি গিয়ে দেখে আসতাম–আমি নিজে গিয়ে যে তাকে ডেকে এনেছিলাম, লক্ষ্মীদি আসতে চায়নি। দেখো তো কী সর্বনাশ করলে তুমি! তার কত কষ্ট তুমি তা জানো? জানো যে লক্ষ্মীদি ছাড়া অন্য কোন মেয়ে হলে এতদিন কোথায় ভেসে তলিয়ে যেত!
–তলিয়ে যেতে আর বাকিটা কী আছে?
দীপঙ্কর বললে–ও-রকম করে বলতে নেই সতী-ছি! দিদি হোক আর না-হোক, মনুষ তো! লক্ষ্মীদিও তো মানুষ! ভুল তো মানুষেই করে, পাপ তো মানুষেই করে, তোমার নিজের কথাটাই আজ ভাবো না!
সতী বললে–তা বলে মদ খাবে লক্ষ্মীদি? মদ কখনও ভদ্র মেয়ে-মানুষরা খায়?
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু কেন খায় সেটা তো তুমি জিজ্ঞেস করোনি লক্ষ্মীদিকে! তাহলে আর তোমার অমন রাগ হতো না।
সতী বললে–কিন্তু তার জন্যে তো লক্ষ্মীদি নিজেই দায়ী, নিজে সাধ করে যদি কেউ দুর্ভাগ্য ডেকে আনে তো কাকে দোষ দেবে? সেটা বলো?
দীপঙ্কর বললে–আচ্ছা ধরে নিলাম লক্ষ্মীদি না-হয় নিজের দুর্ভাগ্যের জন্যে নিজেই দায়ী, লক্ষ্মীদি না-হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে অসামাজিক কাজ করে ফেলে তাই এত কষ্ট পাচ্ছে, কিন্তু তুমি? তোমাকে তো তোমার বাবা অনেক দেখেশুনে অনেক টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছেন, অনেক বড়লোক তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকরা, অনেক বংশ মর্যাদা, কোথাও কোনও খুঁত নেই–তবু তুমি কেন কষ্ট পাচ্ছো? তোমাকে কেন শ্বশুর বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হয়েছে? জবাব দাও এর?
সতী যেন সত্যিই কোনও উত্তর খুঁজে পেলে না এ কথার।
তারপর হঠাৎ এক-সময়ে বললে–সত্যি বলো তো আমি কী করি?
দীপঙ্কর বললে আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি–
–কী? কী বলেছ?
দীপঙ্কর বললে–তোমার শ্বশুরবাড়িতেই ফিরে যাওয়া উচিত–
সতী বললে–কিন্তু সেখানে যে আমার সুখ নেই, শান্তি নেই, সেখানে থাকলে যে আমি পাগল হয়ে যাবে, সেখানে থাকলে যে আমি আত্মঘাতী হবো–
দীপঙ্কর বললে–অত ভেবো না ও-নিয়ে। যত ভাববে তত অশান্তি বাড়বে।
–কিন্তু না ভেবে যে থাকতে পারি না আমি দীপু! স্বামীর কথাও ভাববো না, নিজের সুখ-দুঃখের কথাও ভাববো না তো বাঁচবো কী নিয়ে? আমার কি ছেলে আছে, আমার কি মেয়ে আছে যে তাদের বুকে করে সব ভুলে থাকবো?
দীপঙ্কর দেখলে সতী যেন ক্রমেই মুষড়ে পড়ছে কথা বলতে বলতে। যেন আর কিছুক্ষণ কথা বললেই একেবারে ভেঙে পড়বে। বললে–যাও ওঠো, এবার শুয়ে পড়ো গে যাও, কদিন ঘুমোওনি, না ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে তোমার শরীরটাও ভেঙে পড়বে শেষকালে।
সতী বললে–কিন্তু তুমি আমাকে বলো দীপু, কী করব? আমার কী গতি হবে? আমি কোথায় থাকবো, কার কাছে যাবো, কে আমায় বাঁচাবে?
দীপঙ্কর বললে–এ-সব কথা যত আলোচনা করবে, যত ভাববে তত মন খারাপ হয়ে যাবে, তত শরীরটাও ভেঙে পড়বে–চলো ওঠোও-ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ো গে–
নিচেয় কাশী বোধহয় তখন রান্নঘর ধুচ্ছিল। ঝাটার আওয়াজ আসছে ওপরে। বাইরে বড় রাস্তার ট্রামের আওয়াজও এতক্ষণে কানে আসছে। দীপঙ্করের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে। সেই ভোর থেকে এত রাত পর্যন্ত কত জায়গায় ঘুরেছে। কত দীর্ঘ পথ পরিক্রমা করেছে। কত আনন্দের কত বেদনার আর কত উত্তেজনার সংঘাতে জর্জরিত হয়েছে, এখন এতক্ষণ পরে তারও যেন ক্লান্তি নেমে এল শরীরে।
সতী বললে–আমার জন্যে তোমাকেও কত কষ্ট দিচ্ছি দীপু, তোমারও ঘুম পাচ্ছে হয়ত-তুমি তো সারাদিনই ঘুরছো, সারাদিন অফিসে খেটে কাজ করে এসেছ
দীপঙ্কর বললে–আমার কথা যাক, একটা দিন বেশি খাটলে আমার এমন কিছু ক্ষতি হবে না–
সতী বললে–কিন্তু আমি যে কী করি কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। দেখ দীপু, এ নিয়ে যে একা-একা কত ভেবেছি কী বলবো তোমাকে। আজ তো তবু তুমি আছো, তোমার সঙ্গে কথা বলে তবু খানিকটা হাল্কা হচ্ছি। কিন্তু এমনি রোজ ভাবি ভাই। বিছানায় শুই গিয়ে আর ভাবনাগুলোও পাখা মেলতে শুরু করে। ভেবে-ভেবে শেষকালে আর কূল-কিনারা পাই না। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজে, এগারোটা বাজে, বারোটা বাজে, একটা বাজে-কখন সব কটা বেজে যায় একে একে, কখন রাত কাবার হয়ে যায়, সব শুয়ে শুয়ে টের পাই–কিন্তু কিছুতেই কিছু উপায় বার করতে পারি না–
দীপঙ্কর বললে–কাল সকালে উঠে যা ভাববার ভেবো, এখন ঘুমোও গিয়ে–
সতী বললে–ঘুমোবার জন্যে চোখ ঢুলে আসছে আমারও, কিন্তু শুলেই ঘুমগুলো সব কোথায় উড়ে পালাবে-তখন চিৎ হয়ে শুয়ে এলোপাতাড়ি যত রাজ্যের ভাবনা ভাবতে বসবো।
–কিন্তু ভেবে তো কিছু করতেও পারবে না! সতী বললে–না তা-ও পারবো না, কিন্তু তবু ভাববো-এই-ই আমার রোগ
দীপঙ্কর বললে–কাল সকালে শম্ভুকে আসাতে বলেছি, সে যা বলে তা শুনে ব্যবস্থা করো–
সতী বললে–সে-মানুষকে তো তুমি চেনো না দীপু, তাই এমন কথা বললে–
দীপঙ্কর বললে–আমি ভাল রকমই চিনেছি, সনাতনবাবুর মত স্বামী কারো হয় না–
সতী বললে–অমন স্বামী যেন কারো না হয় দীপু, যেন কারো না হয়! ওর চেয়ে যদি বাবা আমাকে একটা গরীব কেরানীর সঙ্গেও বিয়ে দিতেন তাতেও যেন আমি সুখী হতে পারতাম ভাই। ছোট বাড়ি, ছোট সংসার, কম টাকা মাইনে, তবু সেই কম টাকাতেই আমরা সুখে না হোক শান্তিতে কাটাতাম, সে সারাদিন আপিসে পরিশ্রম করে আমার কাছে এসে বিশ্রাম চাইতো, আমিও উন্মুখ হয়ে থাকতাম তাকে সুখী করবার জন্যে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের মধ্যে সে-রকম ছোট সংসার অনেক দেখেছি দোতলার জানলা দিয়ে। আজ মনে হয় আবার ফিরে যাই সেই ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে। কিন্তু কেন যে এত বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হলো, কেন যে ওদের এত টাকা হলো, কেন যে ওদের কিছু করতে হয় না–! জানো দীপু, ও-বাড়িতে জল তেষ্টা পেলেও কেউ নিজের হাতে গড়িয়ে জল খায় না। আমি না থাকলেও ও-মানুষটার কোনও কষ্ট হবে না, পা টেপবার দরকার হলে চাকর আছে, অসুখ হলে ডাক্তার-নার্স আছে, এক গেলাস জল খেতে ইচ্ছে করলেও জল দেবার চাকর আছে ও-বাড়িতে, দেখেছি আমি ও-মানুষের কাছে একেবারে ফাউ–
দীপঙ্কর বললে–যাক, ওসব কথা ভাবলেই তো কষ্ট, কেন ভাবছো আর?
সতী বললে–কিন্তু না ভেবেই বা কী করবো বলো?
–ভেবে কি তুমি কিছু সুরাহা করতে পারবে?
সতী আবার বলতে লাগলো–জানো দীপু, এক-এক সময় মনে হয় সত্যিই কোথাও চলে যাই–এই যেমন আজ তোমার কাছে চলে এসেছি, এরকম লুকিয়ে চলে আসা নয়, অন্যরকম। একেবারে ওদের জানিয়ে ওদের চোখের সামনে দিয়ে চলে যাই কোথাও-দেখি না ওরা কী করে!
দীপঙ্কর বুঝতে পারলে না কিছু। বললে–তার মানে? কোথায় চলে যাবে?
সতী বললে–এই ধরো ওদের বাড়ির সামনেই, একেবারে ঠিক উল্টো দিকের বাড়ির একটা ঘর ভাড়া নিয়ে বাস করি, করে লক্ষ্মীদি যেমন করে কাটাচ্ছে সেইরকম ভাবে জীবন কাটাই। মনে হয় ওদের চোখের সামনেই বাড়িতে বাইরের লোক এনে ঘরে বসাই, তাস খেলি, গান গাই, আমার যা খুশি করি, আর লক্ষ্মীদির মত পান খেয়ে জর্দা খেয়ে হেসে হেসে গল্প করি ওদের শুনিয়ে শুনিয়ে, আর ওরা দেখুক জানলা দিয়ে–দেখে কী করে তাই শুধু আমার জানতে ইচ্ছে করে–
দীপঙ্কর বললে–যত সব উদ্ভট কল্পনা তোমার–তুমি এতও ভাবতে পারো!
সতী বললে–না দীপু, উদ্ভট কল্পনা নয়, আমার সত্যিই ইচ্ছে হয়, ওদের বাড়ির সামনের বাড়িটা ভাড়া নিই, নিয়ে সেখানে আমি ওদের চোখের সামনেই হৈ-হল্লা করে কাটাই। ওরা দেখুক যে আমিও প্রতিশোধ নিতে পারি, আমিও জানি কেমন করে ওদের ব্যবহারের জবাব দিতে হয়।
দীপঙ্কর দাঁড়িয়ে উঠলো। বললে–যাও ওঠো, শোও গে যাও-যত সব বাজে কথা তোমার।
সতী উঠলো। বললে–বাজে কথা বলছো বটে দীপু, কিন্তু দেখবে একদিন হয়তো আমাকে সেই পথই বেছে নিতে হবে–
–ছি সতী, তোমার বাবার কথাটা মনে রেখো!
সতী বললে–বাবার কাছে তো আমি এখুনি চলে যেতে পারি, বাবাকে চিঠি লিখলেই বাবা এসে নিয়ে যাবেন, কিন্তু তাতে তো আমিই হেরে যাবো দীপু, তাতে তো ওরাই জিতে যাবে–
বলে সতী অনেকক্ষণ মুখ নিচু করে ভাবতে লাগলোলা। রাত অনেক হয়েছে। বাইরের পৃথিবীতে নিস্তব্ধতা নেমে আসছে আস্তে আস্তে। পাশে মা’র ঘরে কাশী এসে বিছানা করে দিয়ে গেছে সতীর শোবার জন্যে।
দীপঙ্কর বললে–এবার ওঠো সতী—ওঠো–
সতী যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠলো। বললে–জানো দীপু, তুমি বিশ্বাস করো, এর চেয়ে একজন অল্প মাইনের কেরানীর সঙ্গে বিয়ে হলেও আমি বোধহয় সুখী হতে পারতাম! ছোট্ট একটা এক-কামরার ভাড়াটে, বাড়ি, বছরে দু’খানা শাড়ি, একটা কাঠের তক্তপোশ, আর দিনরাত পাওনাদারদের তাগাদা এর চেয়ে সেও ভাল ছিল
বলতে বলতে সতী গিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো। ঘরটায় ঢুকে চারদিকে দেখতে লাগলো।
দীপঙ্কর বললে–ওই দেখ, দক্ষিণ দিকেও একটা দরজা আছে, রাত্রে যদি দরকার হয়, ওই দরজা দিয়ে বাইরে বেরোতে পারবে–
সতী দেখলে ভাল করে। দীপঙ্কর বললে–আর আমার এই ঘরের দিকের দরজার ছিটকিনিটা দিয়ে দাও–
সতী বললে–কেন ছিটকিনি বন্ধ করার কী দরকার?
দীপঙ্কর বললে–আমার তো কোনও দরকার নেই এ-ঘরে, তুমি ছিটকিনি বন্ধ করে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবে–
সতী যেন কী করবে বুঝতে পারল না।
দীপঙ্কর বললে–ছিটকিনি বন্ধ করে আলো নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ো–
সতী বললে–বন্ধ করবো? তোমার কোনও দরকার হবে না তো এ-ঘরে? ঠিক বলছো?
–হ্যাঁ বন্ধ করে দাও-খুব জোরে বন্ধ করে দাও আমার কিছু দরকার নেই–
দীপঙ্কর নিজেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এদিক থেকে বললে–দাও, এবারে ছিটকিনি বন্ধ করো–
কোনও আওয়াজ হলো না ও-পাশ থেকে।
দীপঙ্কর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলে। তারপর বললে–কই, বন্ধ করলে না তুমি?
সতী তখনও বন্ধ করছে না। দীপঙ্কর দরজাটা খুলে দেখলে সতী বিছানায় গিয়ে বসেছে। বোধহয় শোওয়ার কথা ভাবছে।
দীপঙ্কর বললে–কই, বন্ধ করো?
সতী বললে–বাবা রে বাবা, তুমি দেখছি আমাকে এখনো বিশ্বাস করতে পারছো না–
দীপঙ্কর বললে–বিশ্বাসের কথা নয়, তোমারই ভালোর জন্যে বলছি, আমার আর কী?
সতী শেষপর্যন্ত উঠে দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিলে। ভেতরে ছিটকিনি বন্ধ করার শব্দ হলো। তখন যেন নিশ্চিন্ত হলো দীপঙ্কর।
দীপঙ্করও শোবার আয়োজন করছিল। অনেক পরিশ্রম হয়েছে। অনেক পরিক্রমাও হয়েছে। ঘুমে দু’চোখ জড়িয়ে আসছে। হঠাৎ কাশী এসে ঘরে ঢুকলো। বললে দাদাবাবু, সেই অন্য দিদিমণিটা এসেছে
–সে কী রে? কে?
ততক্ষণে লক্ষ্মীদি ঘরে এসে ঢুকেছে। লক্ষ্মীদির চেহারা দেখে অবাক হয়ে গেছে দীপঙ্কর। বললে–লক্ষ্মীদি, তুমি এত রাত্তিরে যে?
লক্ষ্মীদির মাথায় ব্যান্ডেজ বাধা। ব্যান্ডেজটা ঘোমটা দিয়ে ঢেকে রেখেছে। বললে সতী কোথায়?
দীপঙ্কর বললে–পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছ। কেন?
লক্ষ্মীদি বললে–ভেবেছিলাম আমি আসবো না। কিন্তু না এসেও পারলাম না। সতী না-হয় আমাকে দেখতে পারে না, কিন্তু বাড়িতে গিয়েও মনটা কেমন করতে লাগলো জানিস! ভাবলাম, আচ্ছা আমার জন্যেই তো ওর এই শাস্তি! তাই আবার দেখতে এলাম, আর এই টাকাটাও নে তুই, এ আর কাজে লাগলো না আমার–
বলে দশ টাকার নোটটা এগিয়ে দিলে দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর বললে–এই জন্যেই তুমি এত রাত্রে এলে নাকি? এ তো পরে দিলেও চলতো
লক্ষ্মীদি বললে–না, আসলে এসেছি সতীর জন্যে, ভাবলাম, সত্যিই মেয়েটার কপালে এত কষ্টও ছিল, বাড়িতে গিয়েও সারাদিন ওর কথাই ভেবেছি, সারাদিন মুখে ভাত ওঠেনি আমার ওই কথা ভেবে–
দীপঙ্কর বললে–এত রাত্রে কার সঙ্গে এলে?
লক্ষ্মীদি বললে–শুধাংশু আজকে ওর গাড়িটা এনেছিল, সে-ই আমাকে পৌঁছে দিয়েছে, আমাকে আবার বাড়ি পেঁছৈ দিয়ে তবে সে বাড়ি যাবে, এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ থেকেই আসবো-আসবো করছি। সন্ধ্যেবেলা ওরা সব এসে গেল, তারপর খেলা ওদের আর ভাঙতেই চায় না। শেষে জোর করে ওদের তুলে দিলুম আমি। তা সতী কি ঘুমিয়ে পড়েছে?
দীপঙ্কর বললে–হ্যাঁ, অনেকক্ষণ–
লক্ষ্মীদি বললে–ঘরে খিল দিয়ে শুতে বলেছিস তো?
দীপঙ্কর বললে–হা ছিটখিনি বন্ধ করে শুয়েছে–
লক্ষ্মীদি কী যেন ভাবলে মনে মনে। তারপর বললে–আমি তাহলে যাই এখন দীপু, ওরা আবার গাড়িতে বসে আছে আমার জন্যে! আর আমি তো ওকে পাঠাতে পারলুম না শ্বশুরবাড়িতে, তুই যদি পাঠাতে পারিস দেখিস
দীপঙ্কর বললে–আমি কী করে পাঠাবো বলো? আমার কথা কি শুনবে ও?
লক্ষ্মীদি বললে–আমি ভাই হাল ছেড়ে দিয়েছি, আমার যথাসাধ্য আমি করেছি, শেষে আমাকে গালাগালি দিয়ে টেনে ফেলে দিলে মেঝের ওপর, তা আমি আর কী বলবো? আমিও মুখ বুজে সব সহ্য করে গেলুম। এখন বাবার কাছে চিঠি গেছে, বাবা এসে যা ভাল বুঝবে করবে
দীপঙ্কর বললে, না, সে চিঠি কিন্তু তোমার বাবার কাছে আমি পাঠাইনি–
–কেন?
দীপঙ্কর বললে–ফেলতে গিয়েও আমার কীরকম সন্দেহ হলো, ভাবলাম পড়ে দেখি সতী বাবাকে কি লিখেছে! দেখি ভেতরে সমস্ত মিথ্যে কথা লেখা। আমি সে-চিঠি টুকরো-টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি–
–সে কী? বলছিস কী তুই? তাহলে কী হবে?
দীপঙ্কর বললে–আমি ভাবছি সতী যখন নিজের আসল অবস্থাটা জানাবে না, তখন আমিই সমস্ত কথা খুলে লিখে দিই একটা চিঠি-ভাবছি টেলিগ্রাম করে দেব কাল, যাতে শিগগির শিগগির তাঁর হাতে খবরটা পৌঁছোয়–
লক্ষ্মীদি বললে–যা ভালো বুঝিস তাই কর–আমি আর কিছু ঠিক করতে পারছি না–
বলে লক্ষ্মীদি বাইরে দিয়ে নিচে চলে যাচ্ছিল।
দীপঙ্কর বললে–তুমি আজকে এখানে থাকলে কিন্তু ভাল হতো লক্ষ্মীদি–আমি অন্তত নিশ্চিন্ত হতে পারতুম–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি কী করে থাকি বল, আমার দিকটা তো কেউ তোরা বুঝবি? সকালবেলা যে-কাজ করেছে সতী, তারপরে অন্য কেউ হলে আর এ-বাড়ি মুখো হতো না–মাথার দু ইঞ্চি চামড়া আমার কেটে গেছে, ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে, সোজা এখান থেকে ডাক্তারখানায় গিয়ে তবে আমি বাঁচি!
বাইরে রাস্তায় মোটরের হর্ন বেজে উঠলো। অর্থাৎ তাগাদা দিচ্ছে ওরা।
লক্ষ্মীদি বললে–এই দ্যাখ, ওরা তাড়া দিচ্ছে। হ্যাঁ ভাল কথা, সতী তো শাড়ি-টাড়ি কিছু সঙ্গে আনেনি, ভাবলাম আমার কাপড় নিয়ে আসবো কিনা, কিন্তু আবার ভাবলাম, আমাকেই যখন দেখতে পারে না ও, তখন আমার শাড়ি কি আর ও ছোঁবে, হয়ত রেগে মেগে ছুঁড়েই ফেলে দেবে
দীপঙ্কর বললে–সে-সবের জন্যে তোমায় ভাবতে হবে না, দরকার হলে আমি কিনে দেব’খন
লক্ষ্মীদি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বললে–তা মাসীমা কবে ফিরবেন?
দীপঙ্কর বললে–আজ তো কাশী পৌঁছিয়েছে, কাল সকালবেলা চিঠি আশা করছি–
লক্ষ্মীদি বললে–দেখি আমি যদি পারি তো কাল একবার সকালবেলা খবর নিয়ে যাবো–
দীপঙ্কর আবার বললে–কিন্তু তুমি আজ রাত্তিরটা থেকে গেলে খুব ভালো হতো লক্ষ্মীদি–
লক্ষ্মীদি বললে–তাহলে তোর দাতারবাবুকে কে দেখবে বল? সে-মানুষটাকে বাড়িতে একলা রেখে কী করে থাকবো এখানে?
বলে লক্ষ্মীদি নিচে নেমে দরজা খুলে বাইরে চলে গেল। অন্ধকারের মধ্যেই দীপঙ্কর দেখলে বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে কয়েকজন আবছা মানুষের ছায়ামূর্তি। সকলের মুখে জ্বলন্ত সিগারেট। হাসি চলছে সশব্দে। লক্ষ্মীদি গিয়ে গাড়িতে উঠতেই গাড়িটা আর্তনাদ করে উঠলো একবার। তারপর ধোঁয়া উড়িয়ে পাড়ার নিস্তব্ধতা কাঁপিয়ে দূরে অদৃশ্য হয়ে গেল। গাড়িটা চলে যাবার পরে দীপঙ্কর সেই অত রাত্রে অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সেইখানে।
যদি কখনো দীপঙ্করকে কোনও দিন কারো কাছে কৈফিয়ৎ দিতে হয় যে মানুষের আত্মার আহ্বানকে কেন সে এমন করে সেদিন অস্বীকার করেছিল, তাহলে হয়ত কোনও জবাবদিহি করবার কিছু থাকবে না তার। হয়ত নিজেকে ক্ষমা করবার অবসরও আর কোনও দিন মিলবে না। এতদিন ছোট ছিল সে। ছোট হয়ে বড়র দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। ছোট থেকে বড় হতে হবে। শুধু মানসিকতায় নয়, মনুষ্যত্বের দুর্লভ আয়ত্তেও নয়, প্রেমে জ্ঞানে সহযোগিতা আর সহানুভূতির মুক্ত-প্রাঙ্গণে পদার্পণ করে!
কিন্তু মার চোখে তো দীপঙ্কর বড়ই হয়েছিল। মা যা চেয়েছিল, দীপঙ্কর তো তাই হয়েছিল। অর্থে প্রতিষ্ঠায় প্রতিপত্তিতে অত ছোট থেকে আর কী-ই বা সে হতে পারতো? আর কেই-বা হতে পেরেছে দীপঙ্করের মত! আপিসে ঢুকলেই গেটের গুর্খা দারোয়ান স্যালিউট করতো। মধু শশব্যস্ত হয়ে সুইং-ডোরটা ফাঁক করে দাঁড়াতো। ক্লার্করা সসম্মানে সভক্তিতে সভয়ে তার সঙ্গে কথা বলতো। অল্প বয়েস তার। ক্রমে আরো পদোন্নতি হবে, তখন আরো সম্মান করবে, আরো ভয় করবে ক্লার্করা, তখন আরো সভক্তি স্যালিউট করবে গেটের গুর্খা দারোয়ান। পাড়ার দ্র প্রতিবেশীরা সাগ্রহে চেয়ে দেখে দীপঙ্করের দিকে আপিস যাবার সময়। কত বড় চাকরি করে, কত বিরাট মাইনে পায়! এ-পাড়ার ছেলেরাও চাঁদা চাইতে এসে সমীহ করে কথা বলে। সম্মান করে চলে। হয়ত তার মাইনের খবরটা তারা পেয়েছে। তার পদমর্যাদার খবরটা তারা পেয়েছে। কিন্তু একেই কী বলে বড় হওয়া?
এক-একদিন মাকে জিজ্ঞেস করতো দীপঙ্কর। বলতো তুমি যা চেয়েছিলে তা পেয়েছ তো মা?
মা কিছু বুঝতে পারতো না। বলতো–আমি তোর কথার মাথা-মুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি নে, কী বলছিস তুই?
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো-আমি যদি ছোট-কেরানী হতাম, মাসে-মাসে দেনা করে সংসার চালাতে হতো আমাকে, জামা-কাপড় সাবান দিয়ে কেচে অফিসে যেতাম, কিন্তু সৎপথে থেকে সৎভাবে জীবন কাটাতাম, তাহলে কি তুমি আমাকে কম ভালবাসতে মা?
মা হাসততা। বলতো-তাই কখনও কোনও মা করতে পারে রে?
দীপঙ্কর বলতো–কিন্তু মা, তুমি তো আমার টাকা হওয়াই চেয়েছিলে? তুমি চেয়েছিলে আমি মস্ত বড় চাকরি করি, সাহেবের মন পাই, তা তো হয়েছে। আমি নিজে আলাদা সংসার করেছি, তোমাকে আর পরের বাড়ি ঝি-বৃত্তি করতে হয় না, এই-ই তো তুমি চেয়েছিলে?
মা বলতো-কেন, আজ হঠাৎ ও-কথা জিজ্ঞেস করছিস
দীপঙ্কর বলতো-না, তুমি আমার কথার জবাব দাও না, তুমি তো একদিন তোমার পা ছুঁইয়ে আমাকে প্রতিজ্ঞা করেয়ে নিয়েছিলে যে আমি যেন কখনও স্বদেশী না করি, কখনও জেলে না যাই। তোমার সে-কথা তো আমি রেখেছি। কিন্তু জিজ্ঞেস করছি এতে কি তুমি সুখী হয়েছে?
মা অবাক হয়ে যেত–ওমা, ছেলের কথা দেখ, তা আমি কি খারাপ কিছু করেছি তোর? তোর ভাল হয়নি এতে? তুই বলছিস কী?
দীপঙ্কর বলতো–আমার কথা ছেড়ে দাও মা তুমি। আমি যদি সুভাষচন্দ্র বোসের মত হতুম তাহলে কি তুমি রাগ করতে?
–তা রাগ করবো না? ভদ্দরলোকের ছেলে হয়ে জেল খাটবি তুই? ভদ্দরলোকের ছেলেরা জেল খাটে কেউ? ওই দেখ না, নৃপেনবাবু, সেই তোকে যিনি চাকরি করে দিয়েছিলেন, সেদিন দেখলুম কেমন চমৎকার বাড়ি করেছেন, আহা চোখ জুড়িয়ে গেল বাড়ি দেখে-তাই বলে এলাম, আপনি দাদা গরীবের উপকার করে এসেছেন বরাবর, আপনার সুখ হবে না তো কার হবে?
দীপঙ্কর হাসততা। বলতো–আর যদি কিরণের মত হতুম মা?
–দূর, দূর, বখাটে ছেলে যত, ওর সঙ্গে মিশলে ওই রকমই হয়ে থাকতে হতো, আর ওর মা’র মত আমাকেও ভুগতে হতো, অনেক পাপ করলে তবে ওইরকম ছেলে পেটে ধরে মানুষে–
দীপঙ্কর বলতো–কিন্তু মা, ছিটে-ফোঁটার মত ছেলে?
মা রেগে যেত। বলতো-তুই আর বলিসনে বাপু ওদের কথা, ও-বাড়ি থেকে চলে এসেছি আপদ চুকেছে
–কিন্তু তুমি তো জানো না মা, ওদেরও বাড়ি হয়েছে।
–বাড়ি হয়েছে কী রে? কোথায় বাড়ি হলো?
মা আকাশ থেকে পড়লো যেন।
দীপঙ্কর বললে–সেই অঘোরদাদুর বাড়িটাই ভেঙে ফেলে সেখানে এখন বিরাট কক্রীটের বাড়ি করেছে ওরা। গাড়ি করেছে, কংগ্রেসের মেম্বার হয়েছে, আলো দিয়ে ফুলগাছ দিয়ে সাজিয়েছে, সে-বাড়ি আর চিনতেই পারবে না তুমি গেলে–
মা বললে–কই, আমি তো শুনি নি কিছু?
দীপঙ্কর বললে–ছিটে-ফোঁটার চেহারা ভাল হয়ে গেছে এখন, বউরা মোটরগাড়ি চড়ে বেড়ায়, বাড়ির মাথায় বাড়ির নাম লিখে রেখেছে—’অঘোর সৌধ’। বাড়িতে ঢুকতেই ভয় করবে তোমার, এত বড় বাড়ি!
মা প্রথমে অবাক হয়ে গিয়েছিল খবরটা শুনে। বলেছিল–তুই গিয়েছিলি নাকি ওদিকে? কবে গিয়েছিলি?
দীপঙ্কর সে-কথার উত্তর না দিয়ে বললে–আমি যদি ওদের মতও হতুম, তাহলেই কি তুমি খুশী হতে?
মা বললে–পারিনে বাপু তার সঙ্গে তর্ক করতে–যত সব অনাছিষ্টি কথা–
বলে মা কাজের অছিলায় রান্নাঘরে চলে গিয়েছিল। হয়ত যুক্তিতে মা হেরে গিয়েছিল, কিন্তু প্রশ্নটার সমাধান হয়নি। কিরণ কিছু হতে পারেনি জীবনে। তাই কি কিরণ ছোট? আর ছিটে-ফোঁটা? বিরাট বাড়ি, বিরাট প্রতিষ্ঠা–সেও কি তাদের বড় হওয়ারই পাসপোর্ট?
একদিন ও-পাড়ায় গিয়েছিল দীপঙ্কর। প্রত্যেক মাসেই অবশ্য একবার করে ও পাড়ায় যেতে হতো। কিরণের মা’র হাতে গিয়ে দশটা দিয়ে আসতে হতো। প্রতি মাসেই অফিসের ফেরত ডাকতে গিয়ে দরজায়—মাসীমা–
শেষের দিকে কিরণের মা’র স্বাস্থ্য ভেঙে গিয়েছিল। হাঁফাতে হাঁফাতে উঠে এসে উঠোনের দরজাটা খুলে দিতো কোনও রকমে।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করতো-এ কি, আপনি কি শুয়ে পড়েছিলেন নাকি?
কিরণের মা’র সেই আগেকার স্বাস্থ্য, আগেকার শক্তি ছিল না আর। পৈতেও কাটতে পারতো না। আর কাটলেও বেচবার লোক ছিল না। হয়ত সেই সময় থেকেই পৈতে পরা উঠে যাচ্ছিল। হয়ত সেইসময় থেকেই দারিদ্র্য আর দরিদ্রকে ঘৃণা করবার যুগ আরম্ভ হচ্ছিল কলকাতায়। সেই উনিশশো উনচল্লিশ সাল থেকে। যাদের টাকা নেই, তাদের দয়া করবার প্রতিষ্ঠান পত্তন হচ্ছিল পাড়ায় পাড়ায়–কিন্তু যত দাঁতব্যশালার প্রতিষ্ঠানের আড়ালে দারিদ্রের ওপর সভ্য মানুষের ঘৃণা আর অবজ্ঞা পুঞ্জীভূত হয়ে উঠছিল সেই সময় থেকেই। সেই সময় থেকেই গান-বাজনা-জলসা অনুষ্ঠানের নামে দাতব্যের উৎপত্তি। কিরণের মা’র সেই সব দাঁতব্য প্রতিষ্ঠানগুলোই লক্ষ্যস্থল। কিন্তু শেষপর্যন্ত সেখানে এসে পৌঁছতো না সে-সব অনুগ্রহ, সে-সব ঘৃণা!
দীপঙ্করের বলতো-কিরণের আর কিছু খবর পেয়েছেন মাসীমা?
কিরণের নামও যেন শেষকালের দিকে ভুলে গিয়েছিল কিরণের মা। কিরণ বলে যে একজন মানুষ ছিল এ পৃথিবীতে, সে-কথা নিজের মা’রও যেন আর মনে ছিল না শেষাশেষি। কিরণের নামটা শুনে যেন আস্তে আস্তে আবার সব মনে পড়তে চাইত। কিন্তু দীপঙ্কর তখনও কিরণের কথা ভুলতে পারেনি। কিরণকে ভুললে যেন দীপঙ্করের নিজেকেই ভুলতে হয়।
–তুমি কিছু খবর পেয়েছ নাকি তার বাবা?
পৃথিবীতে যেন তখনও একটি লোকই কিরণকে স্মরণ করে রেখেছে। আর স্মরণ করে রেখেছে রায়বাহাদুর নলিনী মজুমদারের আই-বি অফিসের পুরোন রেকর্ডের খাতা।
দীপঙ্কর বলতো-শুনেছি নাকি কিরণ ইন্ডিয়া ছেড়ে পালিয়েছে–
–তাহলে সে তো বেঁচে আছে বাবা!
যেন বেঁচে থাকলেই হলো। যেন কিরণ বেঁচে থাকলেই মা’র শান্তি। তার বেশি আর কিছু আশা করবারও নেই।
–এবার যে দু’খানা নোট দিলে বাবা? আমি তো চোখে দেখতে পাইনে, কত দিলে এবার?
দীপঙ্কর বললে–আমার মাইনে বেড়েছে মাসীমা, অফিসে অনেক টাকা মাইনে বেড়েছে, এবার থেকে কুড়ি টাকা করেই দেব আপনাকে।
কৃতজ্ঞতায় হয়ত বুড়ির চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইত। কিম্বা হয়ত নিজের ছেলের অপদার্থতার কথা মনে করে তুলনামূলক বিচারে ভারি কষ্ট হতো। বলতো–আর বেশিদিন তোমাকে দিতে হবে না বাবা, আমি তোমাকে আর বেশিদিন জ্বালাবো না–বেশিদিন জ্বালাতে পারবো না
বলে মাসীমা চোখে আঁচল দিয়ে জল মুছতো।
কিন্তু কিরণের মা তো জানতো না যে এ টাকা দেওয়া তার কৃতজ্ঞতার দান নয়, এ দীপঙ্করের দয়ার বহিঃপ্রকাশও নয়। কিম্বা এ দয়া তার অহঙ্কারের আত্মপ্রচারও নয়। শুধু কিরণের মা-ই বা কেন, কেউই বুঝতো না। কাউকে বললেও কেউ বুঝতে পারতো না। কেউ জানতো না কেন প্রত্যেক মাসের পয়লা তারিখে আপিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে দীপঙ্কর কালীঘাটের মোড়ে এসে নেমে পড়ে। কেন সেই জনবহুল রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে সকলের অগোচরে এসে দাঁড়ায় নেপাল ভট্টচার্যি লেনের বস্তিটার মধ্যে। কেউ জানতো না কেন সে ওই বাড়ির দরজার কড়া নাড়ে! কিন্তু কেউ না জানুক, দীপঙ্কর নিজে তো জানতো। দীপঙ্কর নিজের কাছে তো বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারতো না। দীপঙ্কর তো জানতো সারাটা মাস আপিসে মানুষের হীনতার আর নীচতার পরিবেষ্টনীতে কাজ করে যত পাপ যত কলঙ্ক তার জীবনে পুঞ্জীভূত হয়ে উঠতো, তার সমস্তটুকু লালন হতো প্রতি মাসের এই পয়লা তারিখটিতে। এ যেন ঠিক সেই সারাদিনের পর সন্ধ্যেবেলায় দেবতার মন্দিরে এসে আত্মনিবেদন করার মতো। দীপঙ্কর মাসীমার হাতে টাকাটা দিয়ে নিঃশব্দে বলতো-কিরণ, আমি পারিনি ভাই, আমি হেরে গেছি, তুই আমাকে ক্ষমা কর–
তারপর তাড়াতাড়ি নিজেরই অযোগ্যতার লজ্জায় যেন নিজেই বেরিয়ে পড়তো রাস্তায়। নিজের ওপরেই তার লজ্জা হতো। নিজের পৌরুষের ওপরই লজ্জা। দীপঙ্করের মনে হতো সব জিনিসের যেন সীমা আছে। অর্থের, গৌরবের, স্বাস্থ্যের অহঙ্কারের-সব কিছুরই সীমা আছে। মহাভারতের অক্ষৌহিণী সৈন্যেরও সীমা-সংখ্যা আছে একটা। কিন্তু তার সেই লজ্জার যেন আর শেষ নেই। তার তেত্রিশ টাকার ঘুষের লজ্জা। তার তেত্রিশ টাকায় আত্ম-বিক্রয়ের লজ্জা।
এমনি করেই একদিন কিরণের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হঠাৎ যেন পথ হারিয়ে ফেলেছিল দীপঙ্কর। সেদিনও মাসের পয়লা। সত্যিই পথ হারাবার মতই অবস্থা তার। ছোটবেলা থেকে যে-পাড়ায় মানুষ সেই পাড়ার সেই রাস্তায় এসেই যেন পথ ভুল হয়ে গেল! এ কোথায় এল সে! সে উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন। সেই পরিচিত দরজা, সেই সতীদের বাড়ির সিঁড়ি, সেই ইট-বার-করা দেয়াল, সেই ভেতরে আমড়া গাছটা। যে গাছটার ডালে একটা কাক সারাদিন বসে থাকতো চুপ করে। কোথায় গেল সে-সব? কোথায় গেল সে-বাড়িটা?
দীপঙ্কর ওপর দিকে চেয়ে দেখলে। বাড়ির বাইরে লোহার গেট হয়েছে। পাশে গ্যারেজ হয়েছে। হলদে রং-এর নতুন একটা বাড়ি উঠেছে। আগাগোড়া কক্ৰীটের। দোতলা থেকে ক্ষিরির আওয়াজ আসছে কানে। ঝকঝকে তক্তকে ফিটফাট বাড়িটা।
কোথায় গেল সেই পুরোন অঘোরদাদুর বাড়িটা? কোথায় গেল সেই ঘরটা যেখানে দীপঙ্কর ছোট থেকে বড় হওয়ার যন্ত্রণা অনুভব করেছে সকাল থেকে গভীর রাত্রি পর্যন্ত? সব কি মুছে গেল তার জীবন থেকে? কে মুছে দিলে? কে এমন করে দীপঙ্করকে বিলীন করে দিলে বিস্মৃতির সমুদ্রে! দীপঙ্করের সমস্ত অস্তিত্বকে এমন করে নিঃশেষ করে দিলে পৃথিবী থেকে? দীপঙ্কর ওপর দিকে চাইলে। চাইতেই নজরে পড়লো বাড়িটার মাথায় বড় বড় করে পাথরে খোদাই করা অক্ষরগুলো–’অঘোর সৌধ।
আর দীপঙ্করের হঠাৎ মনে হলো অঘোরদাদু যেন উকট একটা অট্টহাসি করে উঠলো ওপর থেকে।
বললে–মুখপোড়া দেখলি তো, কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়, সব কেনা যায় কড়ি দিয়ে দ্যাখ মুখপোড়া, চেয়ে দ্যাখ
দীপঙ্করও প্রতিবাদ করে উঠলো।-না, না, না-না—
ঘুম নয়। জেগেই ছিল দীপঙ্কর। কিন্তু জেগে জেগেই চিৎকার করে উঠেছে।
এতক্ষণে যেন দীপঙ্করের খেয়াল হলো। খেয়াল হলো সমস্ত। খেয়াল হলো সে দীপঙ্কর সেন। অফিসের সেন সাহেব। কাল থেকে সে অফিসের অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার। এ-টি-এস। কাল থেকে আরো বড় আর মাথা নিচু করা স্যালিউট পাবে সে। খেয়াল হলো সতীও রয়েছে এ-বাড়িতে। এই পাশের ঘরেই। পাশের ঘরে দরজার ছিটকিনি বন্ধ করে শুয়ে আছে।
সকাল হয়ে গেল নাকি? সেই লক্ষ্মীদি চলে যাবার পর থেকে এতক্ষণ জেগে-জেগেই কেটে গেল! সমস্তটা রাত! সমস্ত রাত এলোপাতাড়ি কত সব চিন্তা করেছে সে?
দীপঙ্কর উঠলো। উঠে ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা মুখে তুলে নিয়ে সব জলটা খেয়ে ফেললে। তারপর ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখতেই অবাক হয়ে গেল। মাত্র রাত দুটো!
দীপঙ্কর আবার এসে বিছানায় বসলো। তারপর শুতে গিয়েও শুতে পারলে না। কোনও রকমেই যেন আর ঘুম আসবে না তার। তবু সমস্ত রাত বসে কাটালে শরীর খারাপ হয়ে যাবে। সকালে অনেক কাজ। সকালে শম্ভু আসবে। সকালেই সতীকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পাঠিয়ে দিতে হবে। তারপর হয়ত লক্ষ্মীদিও আসবে। তারপর অফিস আছে। কাল থেকেই মিস্টার ঘোষালের চেয়ারে গিয়ে বসতে হবে। নতুন দায়িত্ব নতুন ভূমিকা জীবনের।
হঠাৎ খট করে পাশের ঘরে যেন একটা শব্দ হলো!
দীপঙ্কর উঠে বসলো আবার। সতী কি এখনও জেগে আছে! সতীরও কি ঘুম আসছে না! অনেকক্ষণ কান পেতে রইল দীপঙ্কর। না, কোনও শব্দ নেই। হয়ত ভুল শুনেছে দীপঙ্কর। সতী কেন জেগে থাকতে যাবে তার মতন! সতী হয়ত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। দীপঙ্কর উঠে আবার একবার জল গড়িয়ে খেলে। তারপর আবার এসে বসলো নিজের বিছানায়। তারপর আলোটা নিভিয়ে দিলে।
কিন্তু আবার উঠে বসলো বিছানায়।
আজ কী যে হলো! দীপঙ্করের মনে হলো যেন বড় একলা সে। সারা জীবনই বড় একলা। এই এখন খানিকক্ষণ গল্প করতে পারলেও যেন তার একাকীত্ব ঘুচতো। অন্ত ত মা পাশের ঘরে থাকলেও মাকে ডেকে নিয়ে গল্প করতে বসততা। এক-একদিন মা ও হঠাৎ দরজা খুলে এ-ঘরে এসেছে। বলেছে–কী রে, ঘুমের ঘোরে কী সব বকছিলি?
দীপঙ্কর বলতোনা মা, ঘুমের ঘোরে নয়, জেগে জেগে
আজ মা-ও নেই। কেউই নেই। দীপঙ্কর আবার একবার জল খেলে। অনেক তৃষ্ণা যেন জমে জমে শুকনো মরুভূমি হয়ে গেছে ভেতরটা। তারপর বিছানায় ফিরে এসে বসতে গিয়েও বসতে পারলে না। একবার দাঁড়িয়ে ভাবলে খানিকক্ষণ। সতীকে যদি এখন ডাকে, ডেকে গল্প করে তো ক্ষতি কী! কীসের ক্ষতি!
কিন্তু না, সতীকে সে নিজে ছিটকিনি বন্ধ করে শুয়ে ঘুমোতে বলেছে। তাকে এখন ডাকা উচিত নয়।
দীপঙ্কর ফিরে আবার বিছানাতেই বসতে যাচ্ছিল। কিন্তু কি মনে হলো, পায়ে পায়ে আবার দরজাটার দিকে গেল। হয়ত সতী অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অনেক বিনিদ্র রাতের পর বিশ্রামের প্রশান্তিতে এলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। নিজের সুবিধের জন্যে কেন তাকে বিরক্ত করতে যাবে!
কিন্তু তবু দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। যদি জেগে থাকে তো সামান্য একটা টোকা দিলেই সতী সাড়া দেবে। একবার টোকা দিলেই বোঝা যাবে সতীও তার মত জেগে আছে কি না।
দীপঙ্কর দরজার গায়ে হাত দিতে গিয়েও দ্বিধা করতে লাগলো। এই রাত দুটোর সময় এমন করে সতীকে ডাকা কি ভাল হবে! যদি দীপঙ্করকে সন্দেহ করে! যদি মনে করে দীপঙ্কর অসৎ, দীপঙ্কর লোভী, দীপঙ্কর নীচ, হীন, জানোয়ার একটা! ছি ছি! দীপঙ্কর সেই বন্ধ দরজার সামনেই চোরের মত দাঁড়িয়ে দ্বিধায় দ্বন্দ্বে এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো।
–খট!
আর সঙ্গে সঙ্গে দরজাটা ভেতর থেকে খুলে গেছে হঠাৎ।
সেই অন্ধকারের মধ্যেই দীপঙ্কর দেখলে ছিটকিনিটা খুলে দরজা ফাঁক করে সতী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। লজ্জায় ধিক্কারে দীপঙ্করের মাথা থেকে পা পর্যন্ত থর থর করে কাঁপতে লাগলো।
সতী বললে–এ কি, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? কী করছিলে?
দীপঙ্কর অপরাধীর মত নিজেকে লুকোতে চাইলে অন্ধকারের আবরণে। কিন্তু সতীর কাছে সে বোধহয় ধরা পড়ে গেছে।
সতী বললে–এ কি, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? কী করছিলে?
দীপঙ্কর অপরাধীর মত নিজেকে লুকোতে চাইলে অন্ধকারের আবরণে। কিন্তু সতীর কাছে সে বোধহয় ধরা পড়ে গেছে।
সতী আবার বললে–হঠাৎ মনে হলো তুমি যেন চিৎকার করে উঠলে-না-না-না–
বলে! কী হয়েছিল তোমার? স্বপ্ন দেখেছিলে নাকি? তোমার চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল। ভয় পেয়েছিলে বুঝি?
দীপঙ্কর কী বলবে হঠাৎ বুঝতে পারলে না। হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল সেইখানেই। সতীর মুখের দিকে চাইতেও যেন তার সঙ্কোচ হলো। মনে হলো সতী যেন তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে চেয়ে দেখছে। যেন সতী তাকে সন্দেহ করছে। দীপঙ্করের বিশ্বাসঘাতকতা সতী যেন ধরে ফেলেছে।
সতী হঠাৎ তার দুটো হাত ধরে ফেলে ঝাঁকুনি দিলে। ঝাঁকুনি খেয়ে দীপঙ্করের যেন চৈতন্য ফিরে এল।
সতী বললে–কী হলো? কী হলো তোমার? তুমি এমন করছো কেন দীপু? দীপঙ্করের মুখ দিয়ে তবু যেন কোনও কথা বেরোতে চাইল না।
সতী দীপঙ্করকে আস্তে আস্তে ধরে নিয়ে এসে তার বিছানায় বসালে। বসিয়ে নিজেও তার পাশে বসলো। বললে–অমন করছো কেন দীপু? কী হয়েছে তোমার, বলো না?
দীপঙ্করের সমস্ত স্নায়ুতন্ত্রীগুলো যেন নেশা লেগে অসাড় হয়ে গেছে। বললে–ঘুম হয়নি আমার–
সতী বললে–ঘুম হয়নি? তা আমারও তো ঘুম হয়নি! তা বলে অমন করছো কেন?
দীপঙ্কর বললে–অনেকবার জল খেলুম, অনেকবার ঘুমোতে চেষ্টা করলুম, তবু ঘুম এল না।
সতী বললে–তা আমাকে ডাকলে না কেন?
সতী আবার বললে–আমারও ঘুম আসেনি, জেগে জেগেই যেন স্বপ্ন দেখছিলুম। দেখছিলুম ও-বাড়িতে আমাকে না দেখতে পেয়ে খুব যেন হৈ-চৈ হচ্ছে, ওরা পুলিসে খবর দিয়েছে, পুলিস আমাকে খুঁজতে এখানেও এসেছে। এখানে এসে তোমার ঘরে ঢুকেছে। পুলিস জিজ্ঞেস করলে-আমি আছি কি না। উত্তরে তুমি খুব রেগে গেলে। রেগে চিৎকার করে উঠলে-না-না, না-না-আর সেই চিৎকারে আমার ঘুম ভেঙে গেল–
দীপঙ্কর কিছু বললে না। একটু পরে শুধু বললে–তুমি তোমার ঘরে শুয়ে পড়ো গে যাও-এখন মাত্র রাত দুটো
–কেন, তুমি ঘুমোবে?
দীপঙ্কর বললে–না, না-ঘুমোলে তোমার শরীর খারাপ হবে! আর না-ঘুমোলে সর্বনাশ হয়ে যাবে–
সতী জিজ্ঞেস করলে-কার? কার সর্বনাশ হবে? তোমার?
দীপঙ্কর বললে–আমার নয়, তোমার–
সতী হেসে উঠলো খুব। বললে–আমার জন্যে তোমাকে আর ভেবে ভেবে শরীর খারাপ করতে হবে না। আমার যা সর্বনাশ হবার, তা হয়েই গেছে–
দীপঙ্কর বললে–না, তোমাকে কাল ফিরে যেতেই হবে। এখানে থাকা আর তোমার উচিত নয়। কাল আমি নিজে গিয়ে তোমাকে রেখে আসবো। রাত্রে তোমার এখানে থাকাই উচিত হয়নি। আর কোনও দিন এখানে এসো না। যদি শ্বশুরবাড়িতে না থাকতে পারো তো অন্য কোথাও চলে যাও–আমার এখানে আর এসো না–
সতী দীপঙ্করের কথাগুলো শুনতে শুনতে কেমন অবাক হয়ে গেল। দীপঙ্করের গলায় যেন আজ অন্য সুর বাজছে।
দীপঙ্কর নিজের মনেই বলতে লাগলো–ইচ্ছে হয় শ্বশুরবাড়িতে থেকো, অত্যাচার সয়েও থেকো, তাইতেই তোমার মঙ্গল হবে, আর তা যদি না থাকতে পারো তত বাবার কাছে চলে যেও, কিম্বা অন্য কোথাও, যেখানে তোমার খুশী! কিন্তু দয়া করে আমার এখানে আর এসো না! এমন কি মা ফিরে আসার পরও এসো না!
বলতে বলতে দীপঙ্কর উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরের এধার থেকে ওধারে পায়চারি করতে লাগলো। বললে–আমি তোমাকে কালকেই বলেছিলাম, এখানে থাকলে তোমার ভাল হবে না। আমার মা নেই, লক্ষ্মীদিও তো তোমায় বুঝিয়ে বলেছিল কত, তবু তুমি শুনলে না! কেন তুমি এলে? কেন তুমি এলে আমার বাড়িতে? আমি তোমার কী ক্ষতি করেছিলুম?
সতী স্তম্ভিত হয়ে চেয়ে রইল দীপঙ্করের দিকে।
দীপঙ্কর বলতে লাগলো–আমি তোমাকে বার-বার বারণ করিনি এখানে থাকতে? বার-বার বলিনি যে, তোমার বিয়ে হয়ে গেছে, শ্বশুরবাড়ির বাইরে অন্য কোনও লোকের বাড়িতে থাকা উচিতন নয়? তুমি জানো আমার মা নেই এখানে, এ-বাড়িতে আমি একলা, অন্য কোনও মেয়েমানুষ নেই এখানে, তবু কেন তুমি থাকলে? কেন তুমি এখানে রাত কাটাতে এলে?
সতী তখনও দীপঙ্করের মুখের দিকে হতবাক হয়ে চেয়ে আছে।
–যদি তুমি আমার কথা না শোন, তাই লক্ষ্মীদিকে ডেকে এনেছিলুম এইখানে। ভেবেছিলুম, আমার কথা না শোন নিজের বড় বোনের কথা অন্তত শুনবে। কেন তুমি তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিলে? তুমি না লেখাপড়া শিখেছ? তোমাকে না তোমার বাবা কত টাকা খরচ করে লেখাপড়া শিখিয়েছেন? সে-সব কি এই জন্যে? নিজের স্বামীকে ভালবাসতে পারলে না তুমি, নিজের শাশুড়ীকেও শ্রদ্ধা করতে শিখলে না, এর জন্যে দায়ী কে? তুমিই তো দায়ী! তাঁদের সঙ্গে ঝগড়া করে ভেবেছ কোনওদিন তুমি শান্তি পাবে জীবনে?
মনে আছে সেই রাত দুটোর সময় অন্ধকার নিস্তব্ধ রাত্রে দীপঙ্কর চিৎকার করে সতীকে যা-নয়-তাই বলে শাসন করতে লাগলো। সতী চুপ করে সব কথা শুনছিল। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, সতী বিছানা ছেড়ে উঠলো। তারপর কোনও দিকে না চেয়ে সোজা গিয়ে আবার মা’র ঘরের ভেতরে ঢুকলো। ঢুকে ভেতর থেকে সজোরে দরজার ছিটকিনিটা বন্ধ করে দিলে। তারপর আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
সতীর এই ব্যবহারে দীপঙ্করও এতক্ষণে অবাক হয়ে গেল যেন। ঝোঁকের মাথায় খুব অন্যায় কিছু বলে ফেলেছে কী সতীকে? এতক্ষণে যেন খেয়াল হলো দীপঙ্করের। এতক্ষণে যেন সম্বিৎ ফিরে পেরে দীপঙ্কর। এমন করে সতীকে সে এত কড়া কথাগুলো বলতে গেল কেন? সতী তার সত্যি সত্যিই কী ক্ষতি করেছে!
হঠাৎ আবার বড় মায়া হলো সতীর জন্যে। সতী তো তার কোনও ক্ষতি করেনি। কোনও অন্যায় করেনি তো সতী তার! দীপঙ্করবাবু আপনার জন মনে করেই সতী তার কাছে এসেছিল। হঠাৎ এত উত্তেজিত হয়েই বা উঠলো কেন সে? এখানে কে আছে সতীর? দীপঙ্করের কাছে না এসে কার কাছে সে যেতে পারত?
দীপঙ্কর তাড়াতাড়ি দরজায় গিয়ে ধাক্কা দিতে লাগলো–সতী-সতী-দরজা খোল, দরজা খোল–
ভেতর থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।
দীপঙ্কর আবার ধাক্কা দিতে লাগলো।–সতী, দরজা খোল, দরজা খোল–
তবু কোনও সাড়াশব্দ নেই। দপিঙ্কর কান পেতে শুনতে লাগলো। সেই রাত্রি দ্বিপ্রহরের আত্মা নিথর-নিশ্চল হয়ে যেন দীপঙ্করকে নিঃশব্দে ব্যঙ্গ করতে লাগলো। আর দীপঙ্কর লজ্জায় অপমানে আত্মগ্লানিতে পাথর হয়ে চুপ করে সেইখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
সেদিন মনে আছে, শম্ভুর ডাকে প্রথম সম্বিৎ ফিরে এসেছিল দীপঙ্করের। শম্ভুর সামনেও যেন মুখ দেখাতে সঙ্কোচ হচ্ছিল। সকাল হয়ে গিয়েছে স্টেশন রোডের পৃথিবীতে। বাইরের রোদ এসে পড়েছে ঘরের মেঝের ওপর। দীপঙ্কর নিজের তুচ্ছতায় নিজেকে লুকোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
শম্ভু বলল–আমি শম্ভু–
যেন শম্ভু এসে দীপঙ্করকে আরও অসাড় করে দিলে। আরো অসহায়। দীপঙ্কর মুখ তুলে চাইতেও যেন ভয় পাচ্ছিল। শম্ভু বললে–বৌদিমণি তো ও-বাড়িতে যায়নি দাদাবাবু!
দীপঙ্কর বললে–বাড়ির খবর কী?
শম্ভু বললে–আমি বাড়িতে গিয়ে বাতাসীর মা’কে জিজ্ঞেস করলুম-বৌদিমণি এসেছে? দেখলুম সবাই যেন ফিস ফিস করে কথা বলছে। কেউ কিছু খুলে বলে না। মা-মণি সকালবেলায় পুজোয় বসেছিল, আমি সোজা চলে এলুম এখানে–
–আর তোমার দাদাবাবু?
–আজ্ঞে, দাদাবাবু নিচেয় নামলো তখন। আমি যখন বেরিয়ে আসছি, তখন ব্যারিস্টারবাবুর গাড়ি এসে ঢুকলো ভেতরে! ব্যারিস্টারবাবুকে চেনেন তো?
ব্যারিস্টারবাবু! নির্মল পালিত? নির্মল পালিত নতুন ব্যারিস্টার। ঘোষ-পরিবারের শেষ ভাগ্যের সঙ্গে সে-ও জড়িয়ে নিয়েছিল নিজেকে। ঘোষ-বংশানুক্রমিক ঐশ্বর্যের রক্ষক শুধু নয়, ধারকও হয়েছিল সে শেষপর্যন্ত। কোথায় কোন জমির কত দর উঠেছে, কোন্ জমি কাকে বেচলে তিন পার্সেন্ট বেশি প্রফিট হবে, সে-বুদ্ধি ঘোষ-গৃহিণীকে নির্মল পালিতই দিত। বিধবা ঘোষ-গিন্নীর একমাত্র সহায় ছিল সনাতনবাবু নয়, নির্মল পালিত। নির্মল পালিতের জন্যে এ-বাড়ির ছিল অবারিত দ্বার। যখন সতীর জন্যে সদর-গেটে তালা-চাবির বন্দোবস্ত হয়েছে, কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেবার নিয়ম নেই, তখনও নির্মল পালিতের গাড়ি এসে হাজির হলেই দারোয়ান লম্বা সেলাম করে সদরগেট খুলে দিত। ব্যারিস্টারবাবুর আসার খবর পেলেই মা-মণি ওপর থেকে নেমে আসতেন। সঙ্গে সঙ্গে চা আসতো, শরবৎ আসতো, স্ন্যা আসতো। চাকর-বাকর মহলেও সাড়া পড়ে যেত। হাঁকডাক শুরু হয়ে যেত। ব্যারিস্টারবাবু জাদরেল লোক। এক মিনিট চুপ করে বসে থাকতে পারে না। হয় কথা বলবে, নয় চুরোট চিবোবে। আর কিছু কাজ না থাকলে শিস দেবে। শিস দেবে পা দুলিয়ে দুলিয়ে। তারপর মা-মণি ঘরে এলেই দাঁড়িয়ে উঠবে। বলবে–এই যে মা-মণি, আসুন, বসুন–
বলে চেয়ারটা এগিয়ে দেবে। মা-মণি গরদের থান পরে এসে বসতেন তাঁর নিজের চেয়ারটিতে। সরকার মশাই, খাতাপত্র নিয়ে এসে হাজির হবে তখন। সুন্দরবনের আবাদ নিয়ে একটা-না-একটা ঝঞ্ঝাট লেগেই থাকে। তারপর আছে শ্যামবাজারে কয়েকটা বাড়ি। ভাড়াটে বাড়ি। কোনওটা বেচে বেশি প্রফিট পেলে আবার একটা নতুন বাড়ি কিনতে হয় সেই টাকা দিয়ে। জমি কেনার পর হয়ত দেখা গেল দু ভাইয়ের সম্পত্তি। এক ভাই মোকদ্দমা করে বসলো শ্রীমতী নয়নরঞ্জিনী দাসীর নামে। একটা মামলা শেষ হতে-না-হতে আর একটা মামলা শুরু করতে হয় বউবাজারের প্রপার্টি নিয়ে। ঈশ্বর গিরিশচন্দ্র ঘোষের বিধবা পত্নী শ্রীমতী নয়নরঞ্জিনী দাস্যার প্রপার্টি নিয়ে হাইকোর্টের অরিজিন্যাল সাইডে মামলা চালায় ব্যারিস্টার পালিতের ছেলে ব্যারিস্টার নির্মল পালিত!
নির্মল পালিত বলে–যে-প্রপার্টি যত এনকামবার্ড, সে-প্রপার্টিতে তত লাভ–
মা-মণি বলেন–কিন্তু আমার বেলায় তো সব লাভ লোকসানে দাঁড়াচ্ছে বাবা–আমি আর পেরে উঠছি না!
নির্মল পালিত বলে-না-পারলে তো চলবে না মা-মণি, পারতেই হবে–তাহলে আমি আছি কী করতে? আমার হাতে সব ছেড়ে দিন, আমি আপনার সব প্রপার্টি গোল্ডে কনভার্ট করে দেব-তখন আপনি পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে আয়েস করবেন বসে বসে–
মা-মণি বলেন-আয়েস আমার কপালে নেই বাবা-আমার আরাম হবে ম’লে–
–সে কী মা-মণি? প্রপার্টি করে তো লোকে আরামের জন্যেই, আর যাতে সেই প্রপার্টি নিয়ে বারেশন না হয়, সেই জন্যেই তো ব্যারিস্টার-অ্যাটর্নীর সৃষ্টি-এটা আপনি কী বলছেন? আর যদি এই সামান্য ঝঞ্ঝাটটুকু না চান তো বনে চলে যান, সেখানে গিয়ে ফলমূল খেয়ে থাকুন, কোনও বদারেশন নেই সেখানে, সেখানে অরিজিন্যাল, ডিফেন্স, অ্যাপিলেট-কেউই নেই, বাদী, বিবাদী, সাক্ষী, জুরী, জজ, কোর্ট, পুলিস কিছু নেই; সেইরকম চান আপনি?
মা-মণি বলেন–একথা তো তোমার বাবাও বলতেন—
নির্মল পালিত বলে–একথা শুধু বাবা কেন, প্রত্যেক সেন-ম্যানই বলবে। জানেন ইংরেজীতে একটা কথা আছে–খুব দামী কথা, সকালে ঠিক বোঝে না-Put not your trust in money, but put your money in trust. আপনার শ্বশুরমশাই নাকি বলে গিয়েছিলেন শুনেছি, টাকা নচ্ছার জিনিস! কিন্তু টাকা নচ্ছার কার কাছে? আপনার আমার কাছে নয় মা-মণি, নচ্ছার ওই যারা মামলাবাজ, যারা ফোর-টুয়েন্টি, যারা ডিব, যারা পুওর, তাদের কাছে! টাকা হাতে এলে তারা আরো মদ খাবে, আরো রেস খেলবে! টাকার মহিমা বুঝবো আমরা। আমাদের কাছে টাকা রুট অব অল ইভল নয়। টাকা হলো পাওয়ার, আপনার ছেলে বলুন পুত্রবধূ বলুন–তারা যে এখনও আপনাকে ভক্তি করে, শ্রদ্ধা করে, সে কিসের জন্যে? সিমপ্লি টাকা!
মা-মণি বলেন-আমিও তো তাই ভেবেছিলাম যে আমি মেয়েমানুষ, স্টিভেডোরের ব্যবসা চালাবো কেমন করে? তাই সব বেচে দিয়ে নগদ টাকা করে ব্যাঙ্কে রেখে। দিয়েছিলাম। তা তোমার বাবাই তো পরামর্শ দিলেন প্রপার্টি কিনতে–তখন কি জানতাম, সেই প্রপার্টি মানে এত মামলা-মোকদ্দমা?
নির্মল পালিত হেসে উঠলো। বললে–তা সংসারে বাস করবেন আর ট্যাক্স দেবেন na?
মা-মণি বললেন–কিন্তু ট্যাক্স দিতে দিতে যে ফতুর হয়ে গেলাম বাবা, আমার যে ধর্ম-কর্ম, পুজো-আচ্চা কিছু হয় না এই ঝামেলার জন্যে। আর ঝামেলাও কি একটা? আমার যে আবার ঝামেলা নেবার কেউ নেই সংসারে! তোমার বাবা আমার এই সর্বনাশটা করে গেলেন আমার বুড়ো বয়েসে
নির্মল পালিত বললে–বাবার কী অন্যায় বলুন মা-মণি, বাবা হয়ত ফাইভ পার্সেন্ট কমিশন পেয়েছেন বড় জোর, কিন্তু কাজটা তো ভালোই করেছেন। টাকা তো আইড়ল রাখতে নেই। হিন্দুদের বাড়িতে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পুজো না-করা যেরকম পাপ, টাকা। উপায় করে আই রাখাও সেইরকম পাপ! এই ভেবে দেখুন না, আপনি ছেলের বিয়েতে ডাউরি কত নিয়েছিলেন ক্যাশ?
মা-মণি বললেন–সে আর বোল না বাবা, তোমার বাবার কথা শুনে সে যা ঠকেছি, সে আর কী বলবো?
–কী রকম?
কোত্থেকে এক সম্বন্ধ নিয়ে এলেন। শুনলাম বড়লোক, একমাত্র মেয়ে তার! তা তখন কি জানি অত বড়লোক, আমি বোকার মত চেয়ে বসলাম দশ হাজার টাকা নগদ–
নির্মল পালিত জিভ কাটলে। বললে–ইস-স, একেবারে ড্যাম লস–
–আমি আর কী বলবো, তোমার বাবাই সম্বন্ধটা এনেছিলেন, তাঁরই ওপর আমি বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছিলুম। তিনি যদি একবার আভাস দিতেন, পাত্রীর বাপের অত টাকা তো আমি তিরিশ হাজার চেয়ে বসতাম। আমার ছেলেও তো খারাপ নয়। তুমি তো দেখেছ, কোনও নেশা করা নেই। এম-এ পাশ সচ্চরিত্র, কারো সাতে-পাঁচে থাকে, নিজের বই আর লাইব্রেরী নিয়েই কেবল আছে–সাত চড়েও কথা বলবে না! অমন হীরের টুকরো ছেলে মাটির দরে বিলিয়ে দিলাম, আমার লোকসানের কপাল! তোমার বাবার জন্যেই এটা হলো–
নির্মল পালিত বললে–কিন্তু মেয়ের তো ভাই-টাই কেউই নেই, একমাত্র সন্তান, বাপ মারা গেলে তো সমস্ত প্রপার্টি আপনিই পাবেন–
মা-মণি বললেন–না, তুমি যা ভাবছো তা নয়–
–কী রকম?
মা-মণি বললেন–ওই মেয়েই পাবে, আমি কিছুই পাবো না, আমার ছেলেও পাবে–
–তা মেয়ে পেলেও তো আপনার ছেলের পাওয়া হলো। আপনার ছেলে পেলেই তো আপনারও পাওয়া হলো!
মা-মণি বললেন–না–
নির্মল পালিত অবাক হয়ে গেল। বললে–কেন? হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে তো তাই-ই। আছে-না যদি পান তো আমি আছি, আমি লিটিগেশন করবো, এ কী কথা!
মা-মণি বললেন–না, তা নয়—
–তা নয় মানে?
বলতে গিয়েও মা-মণি যেন কেমন একটু দ্বিধা করলেন। বললেন–তোমার বাবার সঙ্গে তো সব বিষয়েই পরামর্শ করতাম, এখন তোমার পরামর্শও নিই। আমার বলবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু কথাটা তুললে বলেই বলছি, বৌমা নেই বাড়িতে—
–নেই মানে?
–মানে, চলে গেছে।
–বাপের কাছে গেছে? বর্মায়?
মা-মণি বললেন—না–
হঠাৎ মা-মণির নজর পড়লো বাইরে বারান্দার দিকে। বললেন–কে রে? শম্ভু? তুই এখানে কী করছিস? কী শুনছিস ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? যা, এখান থেকে চলে যা–
শম্ভু পাশ থেকে সরে গেল।
দীপঙ্কর জিজ্ঞেস করলে-তারপর?
শম্ভু বললে–তারপর ব্যারিস্টারবাবু আর মা-মণি দুজনে মিলে কথা বলতে লাগলো, আর আমি চলে এলুম। এখন তো সরকার মশাই আর বাজারে যেতে পারবে না। ব্যারিস্টারবাবু যতক্ষণ থাকবে, ততক্ষণ সরকার মশাইকেও থাকতে হবে খাতাপত্র নিয়ে। সরকার মশাই-ই আদালত-কাছারি সব করে কি না।
নিচে কড়া নাড়ার শব্দ হতেই দীপঙ্কর কান খাড়া করে রইল। হয়ত লক্ষ্মীদি এসেছে। কাশী দরজা খুলে দিতেই কার যেন পায়ের আওয়াজ হলো। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠছে। দীপঙ্কর ঘরের বাইরে যাবার উদ্যোগ করতেই লক্ষ্মীদি ঘরে এসে ঢুকলো। বললে–কী দীপু, সতী কোথায়?
দীপঙ্কর বললে–সতী ঘুমোচ্ছে—
লক্ষ্মীদি বন্ধ দরজার দিকে চেয়ে দেখলে।
দীপঙ্কর বললে–এই দেখ, সতীর শ্বশুরবাড়ির লোকও এসেছে, এর কাছেই সব বাড়ির ভেতরের ব্যাপার শুনছিলাম। শুনলাম, ওদের ব্যারিস্টারের সঙ্গে এইসব পরামর্শই হচ্ছিল।
লক্ষ্মীদি বললে–সতী কী বলছে? যাবে?
দীপঙ্কর বললে–তা তো বলতে পারছি না। এখনও ডাকিনি। ও তো কাল বলছিল যাবে না কিছুতেই–
লক্ষ্মীদি বললে–তুই ডাক না একবার!
দীপঙ্কর বললে–তুমিই ডাকো–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি ডাকবো না, আমার কথা শুনবে না ও। শুনলে তোর কথাই শুনবে। তুই ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে পৌঁছে দিয়ে আয়। ওর শাশুড়ীর সঙ্গে দেখা করে ক্ষমাও চেয়ে আয়। বলিসবয়েস কম, না-বুঝে ভুল করে ফেলেছে–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু আমি কে বলো না? আমার কথা শুনবে কেন? তুমি বরং চলো, আমি সঙ্গে থাকবো–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি গেলে জিজ্ঞেস করবে কে আমি? অনেক কথা উঠবে, তাতে উল্টো বিপত্তি হবে। তার চেয়ে তুই ওকে দিয়ে আয়–
দীপঙ্কর বললে–কিন্তু যেতে চাইলে তবে তো!
শম্ভু এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব কথা শুনছিল। বললে–আমি ডাকবো বৌদিমণিকে?
–ডাকো না।
শম্ভু দরজার সামনে গিয়ে আস্তে আস্তে টোকা দিতে লাগলো। বললে–বৌদিমণি, বৌদিমণি–
দীপঙ্করের আজও মনে আছে, সেদিন সে অনেক কিছু ভয় করেছিল। সমস্ত রাতের ঘটনাটা তার তখনও চোখের সামনে ভাসছে। সেই ঘটনার পরেও কি সতী তার সঙ্গে কথা বলবে। তার দিকে চেয়ে দেখবে! দ্বিধা আর সঙ্কোচের পাহাড় যেন তার মাথার ওপর কে চাপিয়ে দিয়েছিল সেদিন। দীপঙ্কর ভালো করে নিজের মুখোমুখি হতেও যেন ভয় পেয়েছিল। যেন সে নিজেকে অমন করে হারিয়ে ফেলেছিল সেই রাত্রের অন্ধকারে। এতদিনের সব শিক্ষা কি তবে তার মিথ্যে? এতদিনের এত চিন্তা কি তবে তার ব্যর্থ! তবে কি বার বার তাকে পরীক্ষা করবার জন্যেই তাঁর দূতকে পাঠিয়ে দেন ঈশ্বর! এমনি করেই যেন সেই হাত-কাটা ভিখিরির মেয়েটা তাকে পরীক্ষা করতে এসেছিল কাল! এমনি করেই যেন সতী তাকে পরীক্ষা করতেই রাত দুটোর সময় তার ঘরে ঢুকেছিল!
শম্ভু আবার ডাকলে-বৌদিমণি, বৌদিমণি, আমি শম্ভু–
আজ এতদিনের পরেও সেদিনকার সেই ঘটনার ছোটখাটো খুঁটিনাটিগুলো পর্যণত মনে আছে দীপঙ্করের। সতীর শাশুড়ীর সেই প্রপার্টি-প্রীতি, নির্মল পালিতের সেই বৈষয়িক-বৃত্তি-সমস্ত যে কোথায় ভেসে গেল! সমস্ত পৃথিবীটাই যেন নতুন দৃষ্টি দিয়ে। চেয়ে দেখছে আজ সতীর শ্বশুরবাড়ির দিকে। মানুষের বনেদিয়ানার চিহ্ন পর্যন্ত টলে গেল এই কটা বছরে। আবার নতুন একটা বড়লোকের জাত তৈরি হলো, আবার কলকাতায় নতুন বনেদ পত্তন হলো। সেই ভবানীপুর, সেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোড, ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেন, সেই স্টেশন রোড, সেই ফ্রি-স্কুল স্ট্রীট, সেই গড়িয়াহাট লেভেল
ক্রসিং-নতুন করে সকলের মূল্যায়ন হলো সেই উনিশশো উনচল্লিশ সাল থেকে।
ট্যাক্সিটা গিয়ে সেদিন সকালবেলা পৌঁছুলো সেই প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ভেতরে।
লক্ষ্মীদি প্রথমে আসতে চায়নি, প্রথমে সঙ্কোচ হয়েছিল। সঙ্কোচ হবারই কথা। বলেছিল–আমি আর কেন যাবো দীপু, আমি গেলে হয়ত রাগ করবে ওর শাশুড়ী
তবু দীপঙ্করের মনে হয়েছিল, সবাই মিলে সতীর শাশুড়ীকে ধরলে হয়ত তার রাগ কমতে পারে। সতীর বাবা-মা থাকলে আর কারো সঙ্গে যাবার দরকার হতো না। আর কারো সাহায্যও লাগতো না। দীপঙ্করের নিজের মা থাকলেও অনেকটা সাহায্য হতো। মা একলাই সতীকে নিয়ে গিয়ে রেখে আসতে পারতো তার শ্বশুরবাড়িতে। কিন্তু কেই যখন নেই, তখন তাদেরই যেতে হবে।
লক্ষ্মীদি বলেছিল–আমার যে আবার অনেক কাজ পড়ে রয়েছে রে বাড়িতে–
দীপঙ্কর বলেছিল–তা আমারও তো কাজ রয়েছে লক্ষ্মীদি, আমাকেও তো আপিসে যেতে হবে, আজ থেকে আবার আমার নতুন কাজ আরম্ভ হচ্ছে–
অথচ যে-সতীকে নিয়ে এত সমস্যা ছিল, সেই সতী কিন্তু আর আপত্তিত করেনি। সেই রাত্রি দুটোর পর থেকে সতী যেন আমূল বদলে গিয়েছিল। যেন বড় নীরব হয়ে গিয়েছিল। শম্ভু ডাকবার পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। সামনে এতগুলো লোককে দেখেও কিছু বলেনি। যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিল সেই ঘটনার পর থেকেই। দেখে মনে হয়েছিল সতীর যেন সারারাতই ঘুম হয়নি। চোখ দুটো লাল হয়ে রয়েছে। একবার সকলের দিকে চেয়ে দেখে নিলে। তারপর শ্যুকে দেখেই এগিয়ে এল। বললে–কী খবর রে শম্ভু? ও-বাড়ির খবর কী?
শম্ভু সতীকে দেখে যেন কেঁদে ফেলবার মত করলে। বললে–তোমাকে খুঁজতেই এসেছিলুম বৌদিমণি–
–ওরা কি খুঁজছে সবাই আমাকে?
শম্ভু বললে–কেউ খুঁজছে না তোমাকে বৌদিমণি, মা-মনি সবাইকে খুঁজতে বারণ করে দিয়েছে, মা-মণি তোমার নাম পর্যন্ত উচ্চারণ না করতে বলে দিয়েছে সবাইকে–
সতী যেন একটু ভাবলে। বললে–কেউ খুঁজছে না? থানায় খবরও দেয়নি? আর দারোয়ানকেও বলেনি কিছু গেটের চাবি খোলার জন্যে?
শম্ভুবললে–কিছুছু বলেনি কাউকে। শুধু মা-মণি সকলকে ডেকে সাবধান করে দিয়েছে। আমাকেও চাকরি ছাড়িয়ে দেবার ভয় দেখিয়েছে
–আর তোর দাদাবাবু?
শম্ভু বললে–দাদাবাবুও তেমনি আছেন, তিনিও কিছু বলছেন না–
–কোথায় শুয়েছিলেন কাল রাত্রে? কোন্ ঘরে?
–মা-মণির ঘরে, যে-ঘরে রোজ শোন। দাদাবাবুকেও মা-মণি বলে দিয়েছেন কিছু না বলতে, বলেছেন যা করবার তিনি নিজেই করবেন। আজ সকালবেলা ব্যারিস্টারবাবুকে ডেকে আনিয়েছেন। তার সঙ্গে আপনার কথাই হচ্ছিল–
–কী কথা হচ্ছিল?
–তা শুনতে পাইনি, আমাকে দেখতে পেয়েই তাড়িয়ে দিলেন।
কথাগুলো শুনে সতী আবার কী-সব ভাবতে লাগলো। বললে–ঠিক আছে, আমি ফিরেই যাবো–
শম্ভু বললে–হ্যাঁ বৌদিমণি, ফিরেই চলুন, আমাদের আর ও-বাড়িতে ভাল লাগছে না থাকতে, বাতাসীর মা ভূতির মা সব্বাই আপনার কথা বলাবলি করছে। সক্কলের বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেমন–
শঙুর বাকি কথাগুলো যেন সতীর কানেও গেল না। সতী যেন নিজের মনেই ঠিক করে ফেলেছে যে সে ফিরে যাবে।
সতী হঠাৎ বললে–একটা ট্যাক্সি ডাক্–
শম্ভু ট্যাক্সি ডাকতে গেল। দীপঙ্কর বললে–যদি বলো তো আমরাও তোমার সঙ্গে যেতে পারি–
সতী বললে–না তোমাদের কাউকে সঙ্গে যেতে হবে না–
লক্ষ্মীদি বললে–দীপুর যাওয়াই ভালো, শাশুড়ী যদি কিছু বলে তো দীপু কিছু বলতে পারবে, নইলে ভাববে কোথায় ছিলি, কোথায় রাত কাটিয়েছিস, নানা কথা উঠবে–
দীপঙ্কর বললে–তাহলে তুমিও আমাদের সঙ্গে চলো লক্ষ্মীদি, সবাই মিলে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসি, একজন মেয়েমানুষ থাকলে তবু ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসবে–
সেদিন শেষপর্যন্ত তিনজনেই গাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। অপরাধ যখন ঘটেছে, তখন সবরকমে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। গাড়িতে যেতে যেতে লক্ষ্মীদি বলেছিল–আমি গিয়ে যদি কোন উল্টো ফল হয়?
দীপঙ্কর বলেছিল–তোমার কিছু ভয় নেই লক্ষ্মীদি, সতীর হয়ে আমরা ক্ষমা চেয়ে নেব ওর শাশুড়ীর কাছে–
লক্ষ্মীদি বলেছিল–ক্ষমা চাইতে তো আমার আপত্তি নেই ভাই, আমি না-হয় পায়ে হাত দিয়ে মাথায় ঠেকাবো। আমাদের যখন মেয়ে, তখন আমরাই তো অপরাধী! বরপক্ষের কাছে ক্ষমা চাইতে লজ্জা কী? কিন্তু তিনি আমাকে দেখে যদি আরো রেগে যান!
দীপঙ্কর বললে–সেই জন্যেই তো তোমায় নিয়ে যাচ্ছি লক্ষ্মীদি, বলবো, যার জন্যে আপনি এত গঞ্জনা দেন সতীকে, এই সেই লক্ষ্মীদি আমার, এখন দেখুন সেই লক্ষ্মীদি নিজে আপনার কাছে মা চাইতে এসেছে। তোমাকে একবার দেখলে নিশ্চয়ই তাঁর ভুল ধারণা ভেঙে যাবে-তোমার চেহারা একবার দেখলে কারো রাগ থাকতে পারে না–
লক্ষ্মীদি বললে–আমি তার পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইতে পারি, আমার তাতে কোনও আপত্তি নেই। তিনি আমাকে গালাগালি-মন্দ যা-ইচ্ছে করুন, আমি সব মাথা পেতে নেব। শুধু বলবো, সতীকে আপনি ক্ষমা করুন। আমাদের মা নেই, আপনিই সতীর মা-। তাতে আমার অপমানও নেই, লজ্জাও নেই–
তারপর একটু থেমে বললে–সতী তো জানে না, ও যখন ছোট, তখন থেকে ওর জন্যে আমি কীই-না করেছি। আজকে ও হয়ত ভুলে গেছে। আমায় একটা জিনিস কিনে দিলে ওকেও আমি বাবাকে বলে কিনিয়ে দিয়েছি–আমি ছিলাম বড় মেয়ে, বাবা আমাকেই বেশি ভালবাসতো, কিন্তু বলুক দিকি ও যে কখনও আমি ওকে না-দিয়ে কিছু নিয়েছি কি না! আমার সঙ্গে ও-ই বরাবর ঝগড়া করেছে, কিন্তু ওকে আমি কোনওদিন কিছু বলেছি তার জন্যে!
সত্যিই গাড়ির মধ্যে সেদিন লক্ষ্মীদির কথাগুলো শুনে সতীও কিছু বলেনি। হয়ত তার বলবার কিছু ছিলও না। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হওয়ার দীর্ঘ দিনগুলো হয়ত তার মনে উদয় হচ্ছিল। হয়ত সেই সকালবেলা গাড়িতে দুই বোনে পাশাপাশি বসে চলতে চলতে বিগত দিনের স্মৃতিগুলোর জন্যে দুঃখ হচ্ছিল। এমনি করেই হয়ত মানুষ একদিন বড় হয়ে ছোটবেলাকার জন্যে দুঃখ বোধ করে। ছোটবেলায় ফিরে যেতে চায় মানুষ আবার। দীপঙ্কর দুজনের মুখের দিকেই চেয়ে দেখছিল। দুই বোন। এত তাদের ঝগড়া, অথচ এত তাদের প্রীতি! সতী লক্ষ্মীদিকে গালাগালি দিয়েছে, আঘাত করেছে, কত কী বলেছে, তবু তো লক্ষ্মীদি আজ না এসে পারেনি এখানে!
লক্ষ্মীদি বললে–আর তাছাড়া এই-ই তো বলতে গেলে আসল জীবন আরম্ভ হলো সতীর। বিয়ের পর থেকেই তো মেয়েমানুষের সত্যিকারের জীবন আরম্ভ হয়। জীবনের কতটুকু জানতে পারা যায় বিয়ের আগে, কতটুকু দেখতে পাওয়া যায়! আসল পরীক্ষা তো এই সময়েই। বাপের বাড়িতে সব মেয়েই ভাল। হাজার দোষ করলেও সেখানে ক্ষমা করবার, মিষ্টি কথা বলবার লোকের অভাব নেই। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি? শ্বশুরবাড়িতেই তো ভাল-মন্দ যাচাই হবে! যে শ্বশুরবাড়িতে শ্বশুর-শাশুড়ীকে খুশী করতে পেরেছে স্বামীকে বশ করতে পেরেছে, তারই তো জয়। তুমি কত গুণের মেয়ে তা বোঝা যাবে শ্বশুরবাড়িতে গেলে! আমার কাকীমা বলতো’তেলের পরীক্ষা বেগুনে আর সোনার পরীক্ষা আগুনে’-তা মেয়েমানুষের পরীক্ষাও ওই শ্বশুরবাড়িতে–
দীপঙ্কর সতীর দিকে আবার চেয়ে দেখলে। সতী তখনও কথা বলছে না। চুপ করে একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে আছে। কোথায় যেন সে হারিয়ে গেছে। যেন নিরুদ্দিষ্ট হয়ে গেছে জীবনের গোলক-ধাঁধায়। নিজের বুদ্ধি দিয়ে যা সে হারিয়েছিল, হৃদয় দিয়ে তা যেন সে ফিরে পেয়েছে। যেন সে এতদিনে বুঝতে পেরেছে বিশৃঙ্খলতায় উদ্দীপনা আছে কিন্তু কল্যাণ নেই, আনন্দও নেই। যেন সেই জন্যেই চুপ করে বসেছিল আপন মনে।
লক্ষ্মীদি হঠাৎ বললে–মা’কে তো তুই দেখিস নি, আমি দেখেছি, আমার একটু একটু মনে আছে–
সতী কোনও কথা বললে না।
লক্ষ্মীদি বলতে লাগলো-আমার মুখে আজ মায়ের কথা শোভা পায় না ঠিক, কিন্তু তবু বলছি, মা আজ বেঁচে থাকরে আমাদের সংসারটা এমন করে ছারখার হয়ে যেত না। মা থাকলে তুই-ই কি আর এমনি করে চলে আসতে পারতিস শ্বশুরবাড়ি থেকে? মা’র কথা মনে করেও তোর একটু কষ্ট হতো। আর শুধু তোর কথাও বা বলি কেন? আমিও কি যা হয়েছি তা হতুম? ছোটবেলায় মনে আছে মা আমাকে কত ছড়া শেখাতোমা একদিন বলেছিল–হাতে হলুদ না লাগলে রাধুনী হয় না। তা মেয়েমানুষেরও তাই রে। বিয়ে না হলে মেয়েরা মেয়েমানুষই হয় না। যতদিন বিয়ে হয়নি ততদিন অন্যরকম। অন্যায় করলেও কেউ বকবার নেই। কিন্তু একদিন তো সকলকেই স্বামীর সংসার করতে হবে। একদিন তোমারই আবার ছেলে হবে, তোমারই আবার ছেলের বউ ঘরে আসবে। তখন সেই ছেলের বউকেও আবার নিজের মনে করে তার সঙ্গে ঘর করতে হবে। তখনও তো আর এক পরীক্ষা–
দীপঙ্কর বললে–শুধু মেয়েদের কেন লক্ষ্মীদি, মানুষের জীবন মানেই তো পরীক্ষা। স্কুলে কলেজে পরীক্ষা দিয়েছি একদিন। এখন মনে হচ্ছে এই পরীক্ষার কাছে সে পরীক্ষা কত সহজ!
লক্ষ্মীদি বললে–কলেজের বইতে পড়েছি অসকার ওয়াইন্ডের একটা কথা-The Book of Life begins in a garden, and ends in Revelations. এই তো সবে আমাদের জীবন আরম্ভ হলো। সবে শুরু! এখনই থেমে গেলে চলে?
দু’জনের কথার লক্ষ্যস্থলই সতী। যাকে লক্ষ্য করে কথাগুলো বলা সে কিন্তু একটাও কথা বলেনি। সে তখনও একদৃষ্টে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে নির্বিকার নির্বিকল্প। গড় গড় করে গড়িয়ে চলেছে গাড়ি। সামনে ড্রাইভারের পাশে বসেছে শম্ভু আর তারা তিনজনে বসে কেবল কথা বলে চলেছে।
লক্ষ্মীদি আবার বলতে লাগলো-আজকে হয়তো আমার কথাগুলো তোর ভাল লাগছে না সতী, কিন্তু দেখবি, একদিন যখন আবার গিন্নীবান্নি হয়ে উঠবি, একদিন যখন তুই-ই আবার ছেলে-মেয়ের মা হবি, তখন তুই-ই বলবি-লক্ষ্মীদি ঠিকই বলেছিল। আমার জীবন তো ফুরিয়েই এসেছে। আমি হয়ত তখন আর দেখতেও আসবো না, বলতেও আসবো না তোকে–কিন্তু যেখানেই থাকি, তাকে সুখী দেখলে আমি স্বর্গে গিয়েও সুখ পাবো রে–
দীপঙ্কর বললেও কথা কেন বলছো লক্ষ্মীদি, তোমারই বা বয়েস কী এমন হলো?
লক্ষ্মীদি বললে–বাইরের বয়েসটাই বুঝি সব? মনের বয়েসটা তো দেখছিস না। কত ঝড়-ঝাঁপটা যে জীবনের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, অন্য কেউ হলে বোধহয় পাগল হয়ে যেত এতদিনে। আমি যে বেঁচে আছি, সেইটেই তো ঢের! ওই একটা আশা নিয়েই তো বেঁচে আছি-ভাবছি জীবনের শেষটা দেখবো। তা সে যত দুঃখেরই হোক আর যত কষ্টেরই হোক। দেখি ভাগ্য আমাকে কোন ঘাটে নিয়ে তোলে! সতীর এখন এই সবে জীবন আরম্ভ হয়েছে, এখনই এত মুষড়ে পড়লে চলে? তোর যে এখনও অনেক বাকি রে! তোকে যে এখনও অনেক দূর যেতে হবে রে! আর জীবনটা শুধু সুখের যারা মনে করে তাদের কথা আলাদা! আবার যারা শুধু দুঃখের মনে করে তাদের কথাও আলাদা! কিন্তু ভাই আমি দেখেছি জীবনটা যত দুঃখের তত মধুর! দুঃখের মধ্যে দিয়েই সুখকে খুঁজে বার করে নিতে হবে-তা না করলে যে উপায় নেই–
লক্ষ্মীদির মুখ থেকে এত কথা কোনও দিন শোনেনি দীপঙ্কর আগে। এত কথা যে লক্ষ্মীদি ভাবে তা-ও দীপঙ্কর কল্পনা করতে পারেনি কখনও।
দীপঙ্কর বললে–তুমি এত কথা কী করে জানলে লক্ষ্মীদি?
লক্ষ্মীদি বললে–আমি জানবো না তো কে জানবে রে? আমার মত করে কোন মেয়ে জীবনকে এমন করে দেখেছে? কলকাতার সবচেয়ে উঁচু মহলের সঙ্গে যেমন মিশেছি তেমনি একেবারে রাস্তার নর্দমার জীবনও দেখেছি আমি–আমার দেখতে কিছু বাকি আছে? তবু মনে হয়, কিছুই যেন দেখা হলো না। জীবনের যেন অনেকটুকুই দেখতে বাকি রয়েছে এখনো! এত দেখেছি বলেই তো সতীকে বলছি এত কথা! আজ সতী এইটুকু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে পারছে না, কিন্তু ও তো জানে না সহ্য করতে পারার কত লাভ! মানুষ সহ্য করতে পারে বলেই তো মানুষ। মানুষই সামনে দেখতে পায়, মানুষই আশা করে, মানুষই ভালবাসে, মানুষই বড় হয়। যে সহ্য করতে পারে না সেই তো ঠকে। সে-ই আত্মহত্যা করে। কিন্তু যে সহ্য করতে পারে, তার কি কম লাভ! সে সব পায়। সে দুঃখও পায়, কষ্টও পায়, বেদনাও পায়, আনন্দও পায়। আর যে আত্মহত্যা করে সে শুধু পায় কষ্ট। সে জীবনের একটা দিকই দেখলে, অন্য দিকটা তার চোখে পড়লো না–। সে একচক্ষু হরিণ–
সব কথাগুলোই সতীকে লক্ষ্য করে বলা। তবু দীপঙ্করেরও শুনতে ভাল লাগছিল। এত কথাও শিখেছে লক্ষ্মীদি! এত দেখেছে, এত ভেবেছে!
লক্ষ্মীদি বলতে লাগলো–কিন্তু আশ্চর্য, একদিন সতীই যখন আবার নিজে শাশুড়ী হবে, নিজের সংসারের গিন্নী হবে, তখন এই সতীই আবার ছেলের বউকে ঠিক এমনি করেই কষ্ট দেবে, এমনি করেই সতী আবার তার ছেলের বউকে অত্যাচার করবে–তখন নিজের জীবনের অতীতের কথাটা একেবারে ভুলে যাবে। এইটেই হলো নিয়ম, এইটেই হলো রীতি–এইটেই হলো মেয়েমানুষের জীবনের চরম আয়রনি! কিন্তু দ্যাখ…..
হঠাৎ প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের ভেতরে গাড়িটা ঢুকতেই দীপঙ্কর বললে–এইবার এসে পড়েছি লক্ষ্মীদি, ওইটেই সতীর শ্বশুরবাড়ি–
–কোনটা রে?
–ওই যে ডানদিকের তেতলা বাড়িটা, ওইটে!
যথারীতি দারোয়ান বসেছিল গেটের ভেতরে। গাড়ির আওয়াজ পেতেই দৌড়ে এসে গেট খুলে দিলে। তারপর সতীকে গাড়ির ভেতরে বসে থাকতে দেখে হাত তুলে সেলাম করলে একবার। সতী কিন্তু তখনও নির্বিকার। লক্ষ্মীদি বাড়িটার বিরাটত্ব দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। ভেতরে বাগানের দিকটা নজরে পড়তেই বললে–খুব বড়লোক তো এরা।
গাড়িটা থামতেই শম্ভু আগে নেমে গিয়ে কোন দিকে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। দীপঙ্কর নামলো, লক্ষ্মীদিও নামলো। নেমে চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। সঙ্গে সঙ্গে সতীও নেমে পড়েছে। দীপঙ্কর গাড়ির ভাড়াটা মিটিয়ে দিতেই সেটা বেরিয়ে গেল বাইরে।
বাগানের মালীটা দূর থেকে দেখতে পেয়েছিল। গ্যারেজের পাশে ড্রাইভারটাও বসে ছিল। সবাই এল কাছে। এসে সতীকে প্রণাম করলে। কারো মুখ দিয়ে যেন কিছু কথা বেরোচ্ছে না। সবাই যেন ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেছে সতীকে দেখে। সমস্ত বাড়িটা যেন থমথম করছে। সমস্ত বাড়িটা যেন নিথর নিস্পন্দ হয়ে আছে। দীপঙ্করের ভয় করতে লাগলো। কোথায় এর প্রাণ, কোথায় এর আত্মা? কার কাছে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে? কার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে এসেছে তারা?
মনে আছে সেদিন, সেই সকালবেলা দীপঙ্করের প্রথমটায় একটু ভয় করেছিল। কিসের ভয়, কেন ভয়, তার স্পষ্ট ধারণা কিছু ছিল না। আর অপরাধটা যে কী, সে-সম্বন্ধেও কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। পরেও কোনও দিন স্পষ্ট হয়নি! অপরাধ তো মানুষই করে। দেবতাদের তো অপরাধ করতে হয় না। ক্ষমাও মানুষই করে। তবু অপরাধী মানুষকে নিয়ে অপরাধী মানুষেরই যে মর্মান্তিক প্রায়শ্চিত্তের বিড়ম্বনা তার পরিচয় তো সারাজীবনই দীপঙ্কর দেখে এসেছে। যে অপরাধ করে তারই মুখে অপরাধের বিরুদ্ধে নির্লজ্জ প্রচার সংসারকে চিরদিনই বিড়ম্বিত করে এসেছে! তবু দীপঙ্কর সেই মামুলী প্রায়শ্চিত্ত আর সেই মামুলী ক্ষমার বুলি সম্বল করে সেদিন ঘোষবাড়ির উঠোনে হাজির হয়েছিল।
সতী আগে-আগে যাচ্ছিল। লক্ষ্মীদিও তাকে অনুসরণ করে ভেতরের বারান্দার দিকে যাচ্ছিল। দীপঙ্করও চলেছিল তাদের পেছন-পেছন। কোথায় যে যেতে হবে আসলে, তা বোধহয় তিনজনেই কেউই জানতোনা। হয়ত সনাতনবাবুর ঘরটা লক্ষ্য করেই সতী চলেছিল। সনাতনবাবুর কাছে গেলেই যে সব সমস্যার সমাধান হবে না তা জানতো সতী। কিন্তু সনাতনবাবুর ওপরেও যে আর একজন শ্ৰীমতী নয়নরঞ্জিনী দাসী আছে তা যেন ইচ্ছে করেই ভুলতে চেয়েছিল।
হঠাৎ বাধা পড়লো একটা শব্দে।
–কে যায় ওখানে?
সতী দাঁড়িয়ে পড়লো প্রথমে। পেছনে লক্ষ্মীদিও দাঁড়িয়ে পড়লো। তার পেছনে দীপঙ্কর।
পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন সতীর শাশুড়ী।
–কে তোমরা? কোথায় যাচ্ছো?
দীপঙ্করেরই উত্তর দেবার কথা। কিন্তু কোনও উত্তর না দিয়ে সোজা সামনে গিয়ে সতীর শাশুড়ীর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকালে।
–থাক, থাক, ছুঁয়ে ফেলো না, আমি পুজো করে উঠছি এই মাত্র!
দীপঙ্কর বললে–আমাকে চিনতে পারবেন না বোধহয়, আমি দীপঙ্কর, অনেকদিন আগে আমি দু’বার এসেছিলাম এ-বাড়িতে।
সতীর শাশুড়ী চিনতে পারলেন কি চিনতে পারলেন না তা বোঝা গেল না। বললেন–আর এ কে?
লক্ষ্যটা লক্ষ্মীদির দিকে।
দীপঙ্কর বললে–এই-ই সতীর বড় বোন লক্ষ্মীদি–
কিন্তু পরিচয় দেবার আগেই লক্ষ্মীদি আঁচলটা গলায় জড়িয়ে নিয়ে সতীর শাশুড়ীর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় ঠেকিয়েছে।
–ছি ছি, ছুঁয়ে ফেললে তুমি? তুমিই তো বড় মেয়ে। বৌমার বড় বোন?
লক্ষ্মীদি সবিনয়ে বললে–হ্যাঁ মা, আমারই বোন সতী।
–তা তুমিই তো বেরিয়ে গিয়েছিলে বাড়ি থেকে? বিয়ে দেবার সময় বেয়াই মশাই তোমার কথা কিছুছু বলেননি। আমাকে বিধবা মেয়েমানুষ পেয়ে ঠকিয়ে ছোট মেয়েকে আমার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন! তা তুমি এখন কোত্থেকে? কে তোমাকে ঢুকতে দিয়েছে এ-বাড়িতে? তোমার কাছেই কি বৌমা রাত কাটিয়েছে?
দীপঙ্কর বললে–আজ্ঞে না, আমাদের বাড়িতে ছিল, আমিই লক্ষ্মীদিকে খবর দিয়ে আনিয়েছি
–তা তোমাদের বাড়িতেই যদি একটা রাত কাটাতে পারলো বৌমাকে এখানে আবার ফিরিয়ে আনলে কেন তোমরা? একটা রাতেই মনের সাধ মিটে গেল?
এ-সব কথার জন্যে তৈরিই ছিল দীপঙ্কর। এ-সব কথার উত্তরও কেউ আশা করে। তাই চুপ করে রইল দীপঙ্কর। চুপ করে রইল লক্ষ্মীদি।
–তা বৌমার না-হয় সাধ মিটে গেল, তোমরা কী করতে এসেছ? তোমরা কোন্ অধিকারে এ-বাড়িতে ঢুকেছো? কে এ-বাড়িতে ঢুকতে বলেছে তোমাদের? ভদ্দরলোকের বাড়িতে ঢুকতে তোমাদের লজ্জা করলো না? এত বড় আস্পর্ধা তোমাদের?
তারপর মুখটা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন–এই দারোয়ান, দারোয়ানটা কোথায় গেল? দারোয়ান
এ-ঘটনার জন্যেও প্রস্তুত ছিল লক্ষ্মীদি। লক্ষ্মীদি সামনে গিয়ে আবার সতীর শাশুড়ীর পায়ের কাছে মেঝেতে মাথা ঠেকাল। বললে–আপনার পায়ে পড়ছি মা, আমাদের মা নেই, আপনিই ওর মা, আপনিই ওর সব-ওকে ক্ষমা করুন মা আপনি। ওর সব দোষ আমি মাথা পেতে নিচ্ছি–আমায় আপনি শাস্তি দিন
সতী এ-ঘটনার পর বারান্দা পেরিয়ে সোজা সামনের দিকে যাচ্ছিল। সেদিকে শাশুড়ীর নজর পড়তেই বললেন–তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো বৌমা? কোথায় যাচ্ছো? দাঁড়াও এখানে চুপ করে!
সতী আর নড়লো না। যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো—
লক্ষ্মীদি বলতে লাগলো-আপনি যা শাস্তি দেবেন, সব আমি মাথা পেতে নেব মা, সব অপরাধ আমাদের। আপনি সব অপরাধ ক্ষমা করে সতীকে আপনার বাড়িতে আশ্রয় দিন। ওর বয়েস কম, ও না-বুঝে ভুল করে ফেলেছে, কিন্তু আপনি তো বিচক্ষণ, আপনি ওকে তাড়িয়ে দেবেন না, আপনি আশ্রয় না দিলে ও কোথায় দাঁড়াবে? কার কাছে যাবে? কে আছে ওর?
দীপঙ্কর এতক্ষণ দেখতে পায়নি। নির্মল পালিত ঘরের ভেতরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল। সে এতক্ষণ পরে হঠাৎ বাইরে এল। এসেই বললে–আমি তাহলে আসি মা-মণি–
শাশুড়ী নির্মল পালিতের দিকে ফিরলেন। বললে–সে কি? তোমার সঙ্গে যে আমার কাজ আছে, একটু অপেক্ষা করো–অনেক কাজ আছে তোমার সঙ্গে যে–
নির্মল পালিত আবার ঘরের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ দীপঙ্করকে দেখেই। অবাক হয়ে গেল।
–আরে দীপু, তুই?
দীপঙ্কর বললে–এই এসেছি একটা কাজে! তুমি এখানে?
–আরে এরা যে আমার ক্লায়েন্ট! তা এখানে কী কাজ তোর? এদের বাড়ির সঙ্গে তোর কিসের সম্পর্ক?
দীপঙ্কর বললে–আছে কাজ, সনাতনবাবুর স্ত্রী আমার চেনা, সেই ব্যাপারেই এসেছি
সতীর শাশুড়ীর কানে গিয়েছিল কথাগুলো। বললেন–তুমি ওই ছোকরাকে চেনো নাকি বাবা?
–চিনি না? খুব চিনি। ছোটবেলায় এক ক্লাসে পড়েছি আমরা, ধর্মদাস ট্রাস্ট মডেল স্কুলে পরে ক্যাথিড্রাল মিশনারিতে চলে এসেছিলাম। তা সেই কিরণ কোথায় গেল রে? শুনেছিলাম নাকি টেররিস্ট পার্টিতে ঢুকে একেবারে উচ্ছন্নে গেছে! বড় পুয়োর ছিল ওরা–
দীপঙ্কর শুধু বললে—হ্যাঁ–
–তারপর রায়বাহাদুর একদিন বলছিলেন যে, সে নাকি অ্যাবসক করে জার্মানীতে গিয়ে পালিয়ে আছে! উঃ, মানুষের কতরকম অধঃপতনই হয়, বেঁচে থাকলে অনেক কিছু দেখা যায় রিয়্যালি–
দীপঙ্করের এসব কথা ভাল লাগছিল না। বলতে গেলে এই বাড়িতে এই অবস্থায় নির্মল পালিতের সঙ্গে দেখা হওয়াটাও তার ভাল লাগেনি।
নির্মল পালিত কিন্তু ছাড়বার পাত্র নয়। বললে–তোদের বুড়ো রবিনসন তো রিটায়ার করলে। শুনেছিস বোধহয়? আমরা রোটারিতে একটা পার্টি দিলাম ওন্ড ম্যানকে। তা তোর কিছু প্রমোশন হলো? না সেই থার্টিথ্রিতেই আছিস? আমি বলছিলাম বুড়োকে, রেলওয়েতে এরকম পুওর-পে দিলে সব্বাই তো অটোমেটিকেলি টেররিস্ট পার্টিতে ঢুকবেই–ইউ কান্ট চেক ইট, ইটস্ নেক্সট টু ইমপসিবল–
–ওঠো, ওঠো বলছি—
লক্ষ্মীদি তখনও পায়ের কাছে পড়ে ছিল।
শাশুড়ী আবার চেঁচিয়ে উঠলেন–ওঠো, ওঠো বলছি, ঢের মড়া-কান্না শুনেছি আমি, আর মড়া-কান্নায় আমি ভুলছি না–ওঠো, ওঠো–যেমন বেয়াড়া আমার বউ, তেমনি বেয়াড়া তার বড় বোন! ওঠো–
লক্ষ্মীদি বললে–আপনি আগে বলুন সতীকে ক্ষমা করলেন আপনি–
–তুমি আগে ওঠো তো বাপু! আমি কী এমন পাপ করেছি যে, তোমাদের কাছে আমায় কথা দিতে হবে-ওঠো বলছি, নইলে দারোয়ান ডাকবো–
লক্ষ্মীদি বললে–আপনার দুটি পায়ে ধরছি মা, আপনি সতীকে একটু আশ্রয় দিন—
সতীর শাশুড়ী বললেন–পা আমার অমন সস্তা নয় বাছা, সরো তুমি—
বলে নিজেই একটু সরে গেলেন। কিন্তু লক্ষ্মীদিও এগিয়ে গেল তার দিকে।
শাশুড়ী বললেন–বলি আবদার তো মন্দ নয়! বাইরে রাত কাটিয়ে এল গেরস্থবাড়ির বউ, আর আমি দেব আশ্রয়! কেন, আমি কী অপরাধ করতে গেলুম যে তাকে আশ্রয় দিতে যাবো?
লক্ষ্মীদি বললে–ক্ষমাও তো মানুষে করে! অপরাধ যেমন মানুষে করে, ক্ষমাও তো করে মানুষেই! আর যদি ক্ষমা না করতে পারেন তো শাস্তি দিন। হয় আমাকে দিন, নয়তো ওকেই শাস্তি দিন! শাস্তি নিতেই তো এসেছি আমরা মা আপনার কাছে-আপনার যেমন খুশী শাস্তি দিন–
কথাটায় যেন কাজ হলো একটু মনে হলো।
শাশুড়ী নিজের মনেই কী যেন ভাবলেন এক মুহূর্তের জন্যে। তারপর সামনে শঙ্কুকে দেখতে পেয়ে ডাকলেন–শম্ভু এদিকে শুনে যা–
শম্ভু কাছে এল। শাশুড়ী বললেন–ভেতর-বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে আয় তো সকলকে, ভূতির মা, বাতাসীর মা, কৈলাস, ঠাকুর–যে যে আছে সবাইকে ডেকে আন্ তো–
–কোথায় ডাকবো মা-মণি?
–এই উঠোনে ডেকে আনবি। আবার কোথায়? আর দারোয়ানকেও ডাক–
শম্ভু চলে গেল ডাকতে। শাশুড়ী লক্ষ্মীদিকে বললেন–তুমি শাস্তি দেবার কথা বললে, তাই শাস্তিই আমি দিচ্ছি–
তারপর নির্মল পালিতের দিকে চেয়ে বললেন–তুমি যেন চলে যেও না বাবা, একটু দাঁড়াও, তোমার সঙ্গে আমার কাজ আছে–
তারপর উঠোনের দিকে চেয়ে দেখলেন। বললেন–কই, সবাই এসেছে?
শম্ভু বললে–হ্যাঁ মা-মণি, সবাই এসেছে–
শাশুড়ী সকলকে দেখলেন। বাতাসীর মা, ভূতির মা, কৈলাস, দু’জন ঠাকুর। আরো কয়েকজন চাকর-বাকর সবাইকে দীপঙ্কর চেনে না।
শাশুড়ী বললেন–ড্রাইভার কোথায় গেল? ড্রাইভারকেও ডাক–
ড্রাইভারও দৌড়তে দৌড়তে এল। মা-মণি বললেন–এখানে আসতে হবে না, ওইখানে সার দিয়ে দাঁড়াও
তারপর দারোয়ানের খোঁজ পড়লো। দারোয়ান? দারোয়ান কোথায় গেল? দারোয়ানকেও ডাক?
শেষে সবাই এল। সবাই উঠোনে সার দিয়ে দাঁড়াল। দীপঙ্কর কিছুই বুঝতে পারছিল নাকী মতলব সতীর শাশুড়ীর!
মা-মণি হঠাৎ ডাকলেন—সোনা–!
সনাতনবাবু এতক্ষণ নিজের লাইব্রেরী-ঘরে নিজের মনেই পড়ছিলেন। শম্ভুর ডাকে চমকে উঠলেন। বললেন–কী রে?
শম্ভু বললে–মা-মণি আপনাকে ডাকছেন বাইরে–
–কেন রে?
–তা জানিনে, আসুন–
সনাতনবাবু এসে এত লোককে দেখে অবাক হয়ে গেছেন। সতী এসেছে! সতীর দিকেই এগিয়ে যাচ্ছিলেন।
মা-মনি ডাকলেন–ওদিকে নয়, আমার কাছে এসো সোনা সনাতনবাবু এসে বললেন–কী মা?
মা-মণি বললেন–তোমার চটি-জোড়াটা পা থেকে খুলে দাও তো–
–চটি-জোড়া?
–হ্যাঁ, যা বলছি শোন–
সনাতনবাবু পা থেকে চটি-জোড়া খুলে নিয়ে মা’কে দিচ্ছিলেন। মা-মণি বললেন–আমাকে নয়, বৌমাকে দাও–
সনাতনবাবু কী করবেন বুঝতে না পেরে সতীর হাতে দিলেন।
মা-মণি সতীকে বললেন–নাও, ওই জুতো দুহাত দিয়ে মাথায় তুলে নাও–
সতী একবার দ্বিধা করতে যাচ্ছিল। কিন্তু মা-মণি আবার চিৎকার করে বললেন নাও, মাথায় তোল–
সতী জুতো-জোড়া নিয়ে মাথায় তুললো। চটি-জোড়া দু’হাত দিয়ে ধরে মাথার ওপরেই রেখে দাঁড়িয়ে রইল।
মা-মণি বললেন–হ্যাঁ এইরকম করে দাঁড়িয়ে থাকো, আমি যতক্ষণ না নামাতে বলি, ততক্ষণ তুলে রাখবে, নামিও না–
সমস্ত লোকের মুখ যেন বোবা হয়ে গেছে। নির্মল পালিত, লক্ষ্মীদি ঝি-চাকর দারোয়ান ড্রাইভার সবাই সেই আশ্চর্য ঘটনা দেখে নিথর নিস্পন্দ হয়ে গেছে। যেন চোখের পলক ফেরতেও ভুলে গেছে সবাই।
সনাতনবাবু আর থাকতে পারলেন না। বললেন–জুতো কেন মাথায় রাখলে সতী–?
মা-মনি ধমকে উঠলেন। বললেন–তুমি থামো–
আর সতী! পাথরের মূর্তিও বোধহয় অত অচল, অত অনড় নয়। পাথরের চোখও বুঝি অত শুকনো, অত কঠিন, অত তীক্ষ্ণ হতে পারে না। সর্বংসহা পৃথিবীও বুঝি অত সহনশীল হতে জানে না। মানুষের সমস্ত লজ্জা, সমস্ত পাপ, সমস্ত ঘৃণা আত্মসাৎ করে সতী যেন সেই সকালবেলার প্রখর সূর্যের আলোর তলায় সকলের সঙ্কুচিত দৃষ্টির সামনে ধৈর্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল একান্ত অপরাধীর মত। আর অসংখ্য সাক্ষীর যেন সেই লজ্জাশীলার লজ্জার আবরণ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দূরে বহুদূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলে। আর সতী সকলের সামনে যেন উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াল। ঘোষ-বাড়ির কুললক্ষ্মী যেন সেই প্রথম অপবিত্র হলো সকলের চোখের সামনে।
লক্ষ্মীদি হাতটা ধরে টান দিতেই দীপঙ্করের যেন সম্বিৎ ফিরে এল। বললে–চলো লক্ষ্মীদি, চলো–আর দেখতে পারছি না–
নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এসেছে দু’জনে। বাইরে এসে লক্ষ্মীদি বললে–ছি, কাঁদতে নেই–কাঁদে না–
–কিন্তু এ কী হলো লক্ষ্মীদি? এ তো চাইনি আমি!
লক্ষ্মীদি বললে–ভালই হয়েছে দীপু, তুই কিছু ভাবিস নি–ওতে সতীর ভালোই হবে–
কিন্তু দীপঙ্করের মনে হলো এ-ও যেন একরকম আউটুরেজ! দীপঙ্করের চোখের সামনে সতীকে সবাই মিলে আউটরেজ করলে। সবাই মিলে সতীকে রেপ করলে। আর দীপঙ্কর কিছুই করতে পারলে না। অসহায়ের মত চুপ করে শুধু দু’চোখ মেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে। দীপঙ্করের মনে হলো হাজরা রোডের মোড়ের ভিড়ের মধ্যে তার অন্তরের ক্রুদ্ধ প্রতিবাদ যেন আর্তনাদ হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইল।
লক্ষ্মীদি বললে–চল, ট্রাম এসে গেছে–