১. সিভিলিয়ান হিট
জওয়ান : স্যার, দুজন সিভিলিয়ান হিট হয়ে খাদে পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ; কানে ইয়ারপ্লাগ লাগিয়ে গান শুনছিল মনে হয়, ট্র্যানসেন্ড বা মোবাইল থেকে, তাই আমাদের আর শত্রুদের ফায়ারিঙের আওয়াজ শুনতে পায়নি ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : মোবাইল ? এখানে মোবাইলের কোনো টাওয়ার একশ কিলোমিটারের মধ্যে নেই । যাকগে, যেতে দাও, অমন আনুষঙ্গিক দুর্ঘটনার জন্য আমরা দায়ি নই । বাস্টার্ডগুলো এই অঞ্চলে এসেছিলই বা কেন ! ডিসগাস্টিং ।
জওয়ান : ওদের বডি কি রিকভার করা হবে ? উওমেন না মেন বুঝতে পারছি না ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাণ্ডান্ট : তোমার কি মাথা খারাপ ? থাকুক যেখানে পড়ে আছে । আমাদের অপারেশান ক্লোজ হলে স্হানীয় প্রসাশন বা বনবিভাগ গতি করবে ।
জওয়ান : গ্রাম তো কাছে পিঠে নেই স্যার; দুজনেই জীবিত বলে সন্দেহ হচ্ছে ।
অ্যাসিস্ট্যান্ট কমাংণ্ডান্ট : বাজে ব্যাপারে মাথা ঘামিও না । ওটা সিভিল প্রশাসনের মাথাব্যথা ।
.
দুই
আগুনের ঢেউ-তোলা আর ফিনকি-ওড়ানো কয়েকটা জ্বলন্ত খোড়ো চালাঘরের সোনালি আলোয় , চারিদিকে ছিৎরে ছড়ানো লাশের মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল ক্রুদ্ধ অপু, পোশাকি নাম অশ্বমেধ ঘোষ, যার বাবা সুশান্ত ঘোষকে অনেককাল আগে কিডন্যাপ করে, দশ লাখ টাকা ফিরৌতি বা র্যানসাম না পেয়ে, নিজের চোদ্দ বছরের কচি শ্যামলিমা নিরক্ষর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন তারিণী মণ্ডল, মহানন্দে, ধুমধাম করে, যেভাবে অপরাধ-জগতের ছাতিঠোক অখণ্ডপ্রতাপ বাহুবলি বীরেরা ভাগলপুর আর মাধেপুরা জেলার গঙ্গার চরের দিয়ারায় করে থাকে, করে আসছে বহুকাল যাবত, আর তারিণী মণ্ডল তো অপরাধিদের জগতে ছিল মহাজ্যোতিষ্ক, যার কদমছাঁট হাফটেকো মাথা ঘিরে ভনভন করত দুপুর গঙ্গার ঢেউ-গনগনে চনমনে রোদ, তেল-চুকচুকে সোঁটার পেতলমাথায় ধরা থাকত অমাবস্যার নদী-ছলছলে অন্ধকার । সে সোঁটার অভিজ্ঞতা তারিণী মণ্ডলের চেয়ে পুরোনো, ব্যাপক আর গভীর, কেননা ওটা উনি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকারসূত্রে, লাঠিয়াল বাবার কাছ থেকে, যে তার বাবার, সে তার বাবার । তারিণী মণ্ডলের দুঃখ যে ওনার ছেলে নেই, জামাই যদিও ঘরজামাই, তিনি ওসব সোঁটাসুটির প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্রে বিশ্বাস করেন না, আধুনিক পিস্তলও শুধু লুঙ্গির গেঁজেতে গুঁজে রাখেন, কখনও একটু-আধটু চালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন না । নাতি অপু বরং ওর বাবার চেয়ে আধুনিক, আজকালকার তেজিয়ান ছোকরা ।
অপু জানতে পেয়েছিল, বেশ একটু দেরিতেই, আত্মীয়-স্বজন জ্ঞাতিগুষ্টি দলচররা চেষ্টা করেছিল নানা-নানির অপঘাতে মৃত্যুর দুঃসংবাদটা ওর কানে যাতে দেরিতে পৌঁছোয়, যে, দাদু তারিণী মণ্ডল আর দিদিমা মন্হরা দেবী খুন হয়ে গেছে সকালবেলায়, একেবারে ছলনি । রোজকার মতন তেলমাখা লাঠি আর দুজন কালচে-কেঁদো খইনিঠোকা বন্দুকধারী দেহরক্ষীর গাঁট্টাগোট্টা পাহারায়, পটলের লোডিং তদারকি করতে বেরিয়েছিল, ট্রাকে পটলের পঞ্চাশটা বস্তা চালান হবার কথা ছিল ভোরবেলায় ।
যে ট্রাক আসার কথা ছিল সেই নম্বরের ট্রাকই এসেছিল, বনেটে বজরংবলির গেরুয়া টুনিপতাকা উড়িয়ে, কিন্তু তা থেকে মুখে লাল গামছা বাঁধা চারজন লাফিয়ে নেমে তারিণী মণ্ডলকে লক্ষ করে একনল্লা দুনল্লা একে-সানতালিস চালিয়ে চকাচৌঁধ ধুঁয়াধার অন্ধাধুন ব্রাশফায়ারে ছলনি করে, ট্রাক ফেলে রেখে, ট্রাকের পেছনে যে ছাইরঙা ইনোভা আসছিল, তাতে চেপে দক্ষিণের ভোররাতের গু-শোভিত আর মাটির সোঁদা দেয়ালে ঘুঁটেতে পাঁচ আঙুলের ছাপ-মারা গোবর-সুসজ্জিত কাঁচা রাস্তা ধরে আধাশীতেল অলস কুয়াশার সঙ্গে ধুলো মিশিয়ে উধাও।
মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল দাদু , বাঁ-চোখের কোটর থেকে নকল সিনথেটিক মণি বেরিয়ে ছিটকে নর্দমায়, আর ডাকসাইটে দিদিমা ওপরমুখো চিৎ ; দেহরক্ষীরা পিছু ধাওয়া করে কাঁধ থেকে একে সানতালিস নামাতে-নামাতেই বেতাহাশা গুলি খেয়ে হাত-পা ছড়িয়ে তারা দুজনেও মোরাম-পথের ওপর ঠ্যাং ছড়িয়ে লালজবজবে-চিৎ, আকাশের দিকে হাঁমুখ, চোখ-খোলা । দিদিমা, মানে নানি, নানিকে নিয়ে বেরোত না নানা সচরাচর । নানির হাঁটুর ব্যাথা সারাবার জন্যে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল, যাতে পায়চারি করে জাম হয়ে থাকা হাঁটুর চাকতি আলগা হয় ।
.
তিন
চারজনের রক্ত গড়িয়ে মিশেছে মাছিদের আহ্লাদী জমায়েতে, মাছিরা তাদের এঁদো-পলটন ভাইবেরাদর সবাইকে ডেকে এনেছে, র্যালিতে-মিছিলে, যারা ভোরের দিয়ারায় ডোমপাড়ার শুয়োরদের আড্ডায় টাটকা-তাজা গু খেতে বেরিয়েছিল, তারাও তাজা রক্তের সু-বদবুর সংবাদ পেয়ে, হাঁফ-ফুরোনো বাংলা বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দামড়া-চোয়াল ভাতচিকন সাংবাদিকের অনুকরণে, কুয়াশাভেজা ঘষাকাচ-ডানা নাচাতে-নাচাতে পৌঁছে গেছে ।
–হ্যাঁ দীপঙ্করদা-মাছি, ঘটনাস্হলে কী দেখতে পাচ্ছেন ?
–সুমিতা-মাছিনী, এখানে চারজনকে কে বা কারা খুন করে বডি ফেলে তিনচার দিকে দৌড়ে চলে গেছে বলে জানাচ্ছেন প্রত্যক্ষদর্শী মাছিরা ; ইশে, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে বিভিন্ন পাড়ার বিশেষজ্ঞ মাছি-মাছিনীদের । একজন মহিলা কেন খুন হলেন তা ভেবে দেখতে হবে, অ্যাবং খুন হলেও কেন তিনি লজ্জা নিবারণ করতে পারলেন না, তার জন্য সরকারকে জবাবদিহি করতে হতে পারে ।
–দীপঙ্করদা-মাছি, আপনি কী স্বয়ং স্বাদ নিয়েছেন, রক্তের অ্যাবং গুয়ের ? না নিয়ে থাকলে ঘটনাস্হলে যাঁরা একত্রিত হয়েছেন, তাঁদের দিকে একটু ক্যামেরা প্যান করতে বলুন, আমরা মাছি-দর্শকদের দেখাতে চাই, যাতে মানুষের কাঁচা গু খেয়ে-খেয়ে বিরক্ত দর্শকরাও রক্তের স্বাদ নিতে পারেন ; চার-চার জনের রক্তের স্বাদ কীরকম তা আমাদের গুয়েমাছি চ্যানেলেই প্রথম দেখানো হচ্ছে । অ্যাবং নারীরক্তের স্বাদ সম্পর্কে একটু পরেই স্টুডিওর রাসায়নিক মাছি ও ফরেনসিক মাছিনী তাঁদের মূল্যবান মতামত গু-ঞ্জরিত করবেন ।
–সুমিতা-মাছিনী, স্টুডিওতে যে গুসেবক অ্যাবং রক্তসেবক মাছিরা বিতর্কে অংশ নিতে এসেছেন, তাঁদের জন্য আরেকবার আমরা ক্যামেরা প্যান করে তারিণী মণ্ডল নামে মানব প্রজাতির জনৈক প্রতিকল্পের ছিৎরে-যাওয়া মগজ দেখাতে চাই ; ইশে, ঘিলুসেবন করার জন্য স্হানীয় নির্বাচনক্ষেত্রের নীলমাছি পৌঁছে গেছেন, তাঁর ভোজন সমাপ্ত হলে স্টুডিওর সঙ্গে যোগাযোগ করব । ইশে, তারিণী মণ্ডলের স্ত্রীর শব দেখাতে পারছি না, কেননা স্তনদ্বয়ে গুলি খেয়ে পড়ার পর তাঁর শাড়ি ওপরে উঠে গিয়ে অকুস্হলের পাকাচুল বেরিয়ে পড়েছে । ইশে, রাজ্য প্রশাসন দেশের প্রগতি দাবি করে অথচ আজ পর্জন্ত অকুস্হলের পাকাচুলের সমস্যার সমাধান করতে পারেনি ।
–দীপঙ্করদা-মাছি, দ্রুত সংবাদের জন্য ধন্যবাদ । এতক্ষণ আপনারা ভাগলপুরের দিয়ারা-সম্রাট তারিণী মণ্ডল হত্যার দৃশ্য দেখছিলেন । সময়াভাবে আমরা পৃষ্ঠভূমি সঙ্গীত তৈরি করতে পারিনি । পরবর্তী কোনো হত্যাকাণ্ডে যাতে ব্যাকগ্রাউণ্ড স্কোর দেয়া যায় তার ব্যবস্হা করা হয়েছে । সঙ্গে থাকুন ; রক্তের অ্যাবং গুয়ের স্বাদ উপভোগ করুন ।
–সুমিতা-মাছিনী : দর্শকগণ, কেউ একজন আমাদের সংবাদ পরিবেশনকে ঠাট্টা করে তার ঔরস উপন্যাসে যা নয় তাই লিখেছে । ল্যাখককে বিশ্বাস করবেন না, কেননা আপনারা ওনাকে দেখতে পাচ্ছেন না, আমাকে স্বচক্ষে চব্বিশ ঘণ্টা দেখছেন । মনে রাখবেন, যা দেখছেন তা-ই সত্য ।
.
চার
সাড়ে ছ’ফিটের ছিয়াত্তুরে তাগড়া-কালো তারিণী মণ্ডলের টেকো খুলির হাড় গুলিতে ছিৎরে গিয়েছিল, মুখের আদরা চৌচির, টেরিকটের ফিকে-গেরুয়া পাঞ্জাবি রক্তে জবজবে, বুক পকেট থেকে উঁকি মারছে হাজার টাকার গোটাকয় করকরে নোট । ধুতি থেকে বেরিয়ে-থাকা পায়ের গোছের পাকাচুল ঘিরে লতানো ফুলে-ওঠা শিরা । ভারিভরকম মন্হরা দেবী হাঁটবার সময় শাড়ি দুহাতে সামান্য তুলে পা ফেলছিল বলে আচমকা গুলির চোট খেয়ে সম্পূর্ণই তুলে ফেলেছে । মাছিরা তার পাকাচুলশোভিত হাট করে খোলা হাটে বসে কী যে পান করছে তা মাছিগুলোই জানে ।
অপু ক্লাস বাংক করে বাড়ি এসেছিল দিনকতকের জন্যে । দিল্লির জওয়াহারলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে, মানে জে এন ইউতে একই সঙ্গে, দিল্লির হবু দেশসেবকদের খাদিয়াল ঢঙে, সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আর বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করছিল । বামপন্হী ছাত্র ইউনিয়ান করার সুবিধা এই যে পরে ইচ্ছেমতন এবং হাওয়া বুঝে ভিনপন্হী বিজয়ী দলে সেঁদিয়ে যাওয়া যায়, ভিনপন্হী হলে বামপন্হীতে ঢোকা একটু কঠিন কেননা ভিনপন্হীদের ছ্যাঁদা বড়ো, বামপন্হীদের ছ্যাঁদা ছোটো । এই করেই দিল্লি-গুড়গাঁওয়ার ছাত্ররা জীবনে এগিয়ে যেতে পারে, জানে ও, দেখেছে আগের ব্যাচের ফেলটু ছাত্ররাও দিল্লির রাজনীতিতে কেমন করেকম্মে টরটরিয়ে টঙে চড়ে গেছে, কোনো চাকরি-বাকরি না করেই ফাঁপিয়ে তুলছে দুদিকের পকেট, ডেনিম-প্যাণ্টের হোক বা খাদিয়াল পাঞ্জাবির, নিজের বা জ্ঞাতিগুষ্টির । ইউনিয়ানের নির্বাচনে টাকা দরকার বলে দাদুর কাছে এসেছিল অপু, ফোমচামড়ার ব্যাগ নিয়ে, কাঁচা টাকা নিয়ে যাবে, যা তারিণী মণ্ডলের তিজোরিতে সব সময়েই থাকে, কেননা দিয়ারার জীবন বেশ ঝুটঝামেলার, দরিন্দগির, লেনদেনের, কখন কী হয় কত টাকা ঝপ করে কার দরকার তার নিশ্চিতি নেই ।
হাত-পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্হায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল, প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধি রাষ্ট্রিয় কর্মইয়োজনার টাকা মেরে তৈরি খামারে। ট্রাকচালক বৈসাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে । আররে, বৈসাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়ত যাদব নহিঁ হ্যায়,মুহ খোলেগা ক্যায়সে নহিঁ ; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কঁহিকা ।
তারিণী মণ্ডলরা, তার নিজের দাবি অনুযায়ী, যখন সে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করে বন্ধক রেখেছিল, তখন পোড়াটে-কালো বুকে ঘুষি ঠুকে বলেছিল, তার পূর্বপুরুষরা লালেলাল খাঁটি-রক্তের বাঙালি ছিল, তিন-চারশ বছর আগে, আংরেজদের জমানায় । যে পূর্বপুরুষ প্রথম খুন করে মহাঅপরাধীর খেতাব পেয়েছিল, সে শত্রুর জিগর বা হৃদয়ের রক্তে ভেজা পৈতে পরার চল আরম্ভ করলে, হলেই বা নিচু জাত, উত্তরপুরুষরাও প্রথাটা বজায় রেখেছিল, যদিও শত্রুর হৃদয়ের রক্তের বদলে অমাবস্যায় জবাই করা পাঁঠার দিল-কা-খুনে ভেজা পৈতে পরার চল করে গেছে কোনো পূর্বপুরুষ । তারিণী মন্ডলের পৈতেও অমাবস্যার দিন পাঁঠা কেটে জিগরের রক্তে ভিজিয়ে পরানো হয়েছিল । নাতি অপুকেও অমন পৈতে পরাবার চেষ্টা করেছিল তারিণী মন্ডল, জামাইয়ের প্রতিবাদের জন্য সফল হয়নি । জামাই বলেছে, মনে রাখবেন, ও সুশান্ত ঘোষের ছেলে, ঘোষরা যতই খুনোখুনি করুক না কেন, কায়স্হই থাকবে।
বেবি নামের চোদ্দ বছরের মেঠোগন্ধা নিরক্ষর মেয়েকে বিয়ে করে, ভাগলপুরের দিয়ারায় থেকে গিয়েছিলেন ছাপোষা বাঙালি বাড়ির কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক চাকুরে যুবক সুশান্ত ঘোষ, প্রথমে রোগাটে বাংগালি জামাই, তারপর দোহারা সুশান্তবাবু নামে, তারপর পেটমোটা গদাইলস্কর জামাইবাবা নামে অপরাধীদের রাজপুত্র হয়ে উঠেছেন গোপালপুরের ফলকিয়া, পরবত্তা, ডিমহা, কেলওয়ারি, তিনহেংগা আর কহলগাঁও-এর অনাদিপুর, আভাপুর আর অঠগম্মা দিয়ারায় ।
সুশান্ত ঘোষ প্রথম দিকে ফিতেবাঁধা কুকুরবাচ্চার মতন গোমড়া মুখে বোবা সেজে থাকলেও, গ্রাম্য অশিক্ষিত বাংলা জানে না এমন, গংগোতা জাতের চোদ্দ বছরের কচি নিরক্ষর শ্যামলিমা তুলতুলে মাংসের মেয়ের সঙ্গে বাসা বেঁধে ফেলেছিলেন, ঠান্ডা মেঠো দেয়ালের সোঁদা-ছমছমে প্রায়ান্ধকারে, খালি গায়ে, মাদ্রাজি হাফ-লুঙ্গিতে, শাশুড়ির দেয়া কালো কাপড়ের চৌকো তাবিজ গলায় , ছত্রিশ ডিগ্রির বালি-ওড়ানো থমথমে গ্রীষ্মে, এগারো ডিগ্রির কম্বলচাপা হিহি ঠাণ্ডায়, বর্ষার মেঘপাগল ঝোড়ো ঝড়ের টালিভাঙা দাপটে । যখন কিডন্যাপ হয়েছিলেন, তখন দিয়ারার এই এলাকায় বিজলি ছিল না, যাতায়াতের রাস্তা ছিল না, পানীয় জল ছিল না । তারপর ওনার রাজত্ব ক্রমশ প্রসারিত হয়েছে, স্কুল-কলেজের লিখাপড়হিকে কাজে লাগিয়ে বিজলি সড়ক পানি এনেছেন।
দিয়ারার লোকেরা মনে করে উনি, সুশান্ত ঘোষ, আড়ালে কলকাঠি নাড়েন । সামনে সবসময় ভঁয়সাবদন কউয়াডোল তারিণী মণ্ডল । যদিও কখনও-কখনও, হয়ত নদীর ওপর বিদ্যুতের কিলবিলে কেউটে রুপোলি খোলোস ছেড়ে ঝাঁপিয়ে-পড়া সন্ধ্যায়, মগজের ব্যাস্টিলে নিজেকে পায়ে চেন-বাঁধা কয়েদির ঢঙে, ভেবে ফ্যালেন, তিনি আসলে একজন মহা-অপরাধীর জামাই, গংগোতা-ডন নামক এক ভয় উদ্রেককারী দুষিত চরিত্রের মানুষ, যে ওই মহাডনত্বে আটকা পড়ে ছটফট করতে পারে, নিজের কারাগার থেকে নিজেকে ছাড়াতে পারে না । চারিদিকে এত সাঙ্গপাঙ্গের জি-হুজুরি, কচি নিরক্ষর স্নেহদেহ স্ত্রীর নিঃশর্ত আগুনযোনি-ভালোবাসা, শশুরশাশুড়ির অফুরন্ত আদরযত্ন সত্ত্বেও, তিনি নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্বের বিষে ক্ষয়ে চলেছেন । আসলে তিনি, সুশান্ত ঘোষ, মনে করেন যে এই ক্ষয়-রোগের আনন্দে সুফিসন্তের মতন অজানা ঐশ্বর্যে আলোকিত হয়ে চলেছেন প্রতিদিন।
যে-সময়ে সুশান্ত ঘোষকে অপহরণ করা হয়েছিল, ভাগলপুরের ষোলোটা ব্লকের ছয়টায় দিয়ারা ছিল , যাদের গঙ্গা দয়া করে ছাড় দেয়ায়, চিকচিকে পলিমাটির চাদরে ঢাকা প্রায়-পাকা চেহারা নিয়েছে সেগুলো । গঙ্গার সুমতি বা দুর্মতি যা-ই হোক, আরও তেরোটা ব্লকে জেগে উঠেছে চর, যাকে লোকে বলে দিয়ারা । এই চরগুলো অনেক সময়ে বেগড়বাঁই করতে-করতে মেটেল জলের তলায় বর্ষায় ডুবকি মেরে লুকিয়ে পড়ে, আবার ফিরে আসে ঝিলিকদার হাসি ফুটিয়ে সারমাটি মাখা মাথা উঁচু করে । নারায়ণপুর, বিহপুর, খারিক, ফুলাউথ, নৌগাছিয়া, ইসমাইলপুর আর গোপালপুরে লোকবসতি জমে উঠেছে জামাইবাবার রাজত্বে ।
হেমন্তে, ঝিরিঝিরি হাওয়ার আদুরে সুড়সুড়িতে, বালির ছোটোছোটো নাভি ঘিরে আলতো ঘুর্ণিরা দিয়ারাময় খেলে বেড়ায় । সেই হাওয়াই আবার গ্রীষ্মকালে বালির ঘোমটা মাথায় দল বেঁধে দেহাতি বউদের ঢঙে দৌড়োয় চরের ওপর দিয়ে । বসন্তকালের বালি ডেকে আনে পোয়াতি পাখিদের, তাদের খোকা-খুকুকে বাছাই পোকা, ফড়িং, প্রজাপতি খাওয়াবে বলে ।
জামাইবাবা চোখে কালো রেব্যান চশমা, লাল বা নীল টিশার্ট আর ডেনিম-জিন্স পরে টাটা সুমোতে বা বোলেরোয় তবিয়ত খুশ করার জন্য ভাগলপুর শহর ঘোরেন, তমঞ্চাধারী দেহরক্ষীদের পাহারায় । বাবা-জ্যাঠার বাড়ি যেতে কি ইচ্ছে করে না ওনার ? করে । ছেলে হবার আগে আর পরে সবসুদ্দু পাটনার গর্দানিবাগের বাড়িতে গেছেন সাকুল্যে চারবার, বোলেরোয়, বন্দুকধারী দেহরক্ষী নিয়ে । কিন্তু দিয়ারার হারামখোর মৌজমস্তি আর শোধ-প্রতিশোধের আঘাত-প্রত্যাঘাত আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ তো নেই সেই ছাপোষা বাঙালি জীবনে, বেবি নামের মেঠোগন্ধা সুঠামবুক নধরউরু গাঁইয়া নিরক্ষর চোরাটান বউ নেই, যার আয়ত গোবেচারি চাউনি সেই চোদ্দ বছর বয়সেই আটক থেকে গেছে। বাবা মারা যাবার খবর পেয়ে গিয়েছিলেন বটে, তবে ওনাকে কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, ক্রিমিনাল পরিবারে ছোটো জাতে বিয়ে করে ওনার কাঁধ নিচে নেমে গেছে বলে । ওনার ছেলেকেও কাঁধ দিতে দেয়া হয়নি, তার কাঁধ জারজ বলে আরও তলায় । শোকার্ত বিষণ্ণতার মর্মপীড়া ফর্দাফাঁই করে, ওনার মা ঘোষণা করেছিলেন যে সুশান্তর কুকর্ম সহ্য করতে না পেরেই বাবা মারা গেলেন।
বাবা মারা যাবার আগে যখন সুশান্ত ঘোষ পাটনার বাড়িতে গিয়েছিলেন, বাড়ির ছোটোবড়ো প্রতিটি সদস্যের জন্য হালআমলের স্মার্টফোন কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, সিম কার্ড তোমরা যে-যার নিজেদের নামে কিনে নিও, আর যদি চাও তাহলে মাঝে-মাঝে ফোন কোরো । মেজজ্যাঠার নাতনি ইতু ছাড়া, প্রথমে ইতস্তত করলেও সকলেই নিয়ে নিয়েছিলেন, জেঠি-কাকি, ভাই-বউদি, ভাইপো-ভাইজি, এমনকি মা-বাবাও । বাবা মুখ গোমড়া করে বলেছিলেন, ঠিক আছে, টেবিলের ওপর রেখে দে । মা বলেছিলেন, এ তোর খুনোখুনির টাকায় কেনা নয়তো, দেখিস বাবা, তোর পাপের ভাগি করিসনি যেন আমাদের।
জবাবে সুশান্ত বলেছিলেন, আমি সেখানে কোনো কাজই করি না মা , ঠ্যাং ছড়িয়ে আরাম করি, সারাদিন খবরের কাগজ পড়ি, বাংলাও, টিভি দেখি, ইনটারনেট ঘাঁটি, খাইদাই আর ঘুমোই, যেমন ঘরজামাইরা করে । একটু থেমে, যোগ করেছিলেন, পিঁজরেপোলের ষাঁড়ের মতন ।
খোশগল্পপ্রিয় বড়জ্যাঠাইমা, প্রায়-ফোকলা হাসিমুখে, তখনই মোবাইলের কাগজ-বাক্স খুলে ফোনটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলেছিলেন, আমি তোর সঙ্গে প্রায়ই কথা কইব, তুই আমাকে তোর নম্বরটা দিয়ে যা। কথা কইবার টাকা ফুরিয়ে গেলে তোর ওখান থেকে ভরিয়ে দিস । কেউ তো অ্যাদ্দিন কিনে দেয়নি, তুই দিলি ।
অমিত কোথায়, দেখছি না ? জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত ঘোষ । অমিত ওনার প্রথম যৌবনের বন্ধু অতনু চক্রবর্তীর ছেলে, যাকে শৈশবে ওনাদের গর্দানিবাগের বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন অতনু চক্রবর্তী ও তাঁর সঙ্গিনী মানসী বর্মণ ; তাঁরা জানিয়েছিলেন যে, নওয়াদায়, যেখানে তাঁদের বাস, সেখানে অমিতকে পড়াশোনা করানো সম্ভব নয়, তাঁদের রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে খাপ খাবেনা একটি শিশুর আধুনিক লালন-পালন, বুঝিয়েছিলেন অতনু-মানসী জুটি ।
–অমিত উচ্চমাধ্যমিক দেবার পর বাড়ি থেকে চলে গেছে, কাউকে কিছু বলে যায়নি । কাগজে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছিল, হাসপাতাল, থানা-পুলিশ করা হয়েছিল, ওর কোনো পাত্তা নেই , বলেছিলেন ইতুর রাঙাকাকা, সুশান্তর ছোটো ভাই, যিনি অমিতের দায়িত্ব নিয়েছিলেন ; ওনার ছেলেপুলে হয়নি বলে বাড়ির সবাই অমিতকে পরিবারের সদস্য করে নিয়েছিল । সুশান্ত যখন সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছিলেন, অকালমৃত ভাই অপাংশুর মেয়ে ইতুর সঙ্গে দেখা করার জন্য, সিঁড়ির বাঁকে অপেক্ষারত রাঙাবউ সুশান্তকে ফিসফিসিয়ে বলেছিল, অমিত আর ইতুর মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল, তিন তলার ছাদে অন্ধকারে গাঁজাপাতা খেয়ে দুজন জড়াজড়ি করছিল, তখন সেজোকর্তা ধরে ফেলেছিলেন । জানাজানি হতে অমিতকে এমন অকথা-কুকথা বলা হয়েছিল যে যেদিন ওর উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল বেরোলো সেদিন রাতেই কাউকে না বলে কোথাও চলে গেছে । তোমার কিডন্যাপ হয়ে চলে যাবার পর এটা এই বাড়ির আরেক মর্মান্তিক অঘটন । বিজ্ঞাপন-ফিজ্ঞাপন, হাসপাতাল-পুলিশের গল্প সব বানানো, বিশ্বাস কোরোনি ।
মানসী বর্মণ-অতনু চক্রবর্তীর ইচ্ছানুযায়ী, অমিতের পদবি স্কুলে বর্মণ হিসাবে নথি করানো হয়েছিল বলে বাবার সম্পর্কে অবজ্ঞামেশানো চাপা ক্রোধ পুষতো অমিত ।
সুশান্তর মেজজেঠার নাতনি, অপাংশুর মেয়ে ইতান, অর্থাৎ ইতুর সঙ্গে ওর তিন তলার ছাদের ঘরে দেখা করতে গেলে বলেছিল, কী করব মোবাইল ফোন নিয়ে, আমার কে আছে জগত-সংসারে যার সঙ্গে কথা বলব, সামনা-সামনিই কথা হয় না কারোর সঙ্গে, তো ফোনে কার সঙ্গে কথা কইব, আর দরকার পড়লে বাড়িতে তো ল্যাণ্ডলাইন আছেই ; তুমি কখনও আমাকে ফোন করেছ, যে মোবাইল ফোন দিতে এসেছ বড়ো ।
অমিত নিরুদ্দেশ হবার পর, ইতু মনে করে, ওর বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে ; ভ্রু কুঁচকে থাকার দরুন কপালে ভাঁজ পড়ে গেছে, কোমর হয়ে গেছে ভেতো , বয়সের তুলনায় উঁচু বুক। অপাংশুর একমাত্র সন্তান । অপাংশু আর ওর বউ যখন ডাক্তার দেখিয়ে হাতেটানা রিকশা করে কংকরবাগ থেকে ফিরছিল, তখন একটা ট্রাক ওদের রিকশাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে, দুজনকেই চাপা দিয়ে, চলে যায় । ইনশিওরেন্সের টাকা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । সেই থেকে, মনে করে ইতু, একান্নবর্তী পরিবারে ওর জায়গা ক্রমশ নেমে-নেমে ডিলুক্স চাকরানির স্তরে চলে গেছে । বাবা-মা মারা যেতে, এম বি বি এস এক বছর পড়ে ছেড়ে দিতে হয়েছে, কে-ই বা খরচ যোগাবে? বেশ কিছুকাল দুঃখিত ক্রোধে আচ্ছন্ন থাকার পর নিজের প্রগলভা সদালাপী দুঃসাহসী নির্ভীক আন্তরিকতায় ফিরেছে । এম বি বি এস এর বিকল্প হিসাবে, বাবার রেখে যাওয়া সঞ্চয়ে, পড়েছে অলটারনেটিভ মেডিসিন । মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, সমাজের জন্য কিছু করতে হবে, দেশের জন্য কিছু করতে হবে, অন্তত অলটারনেটিভ মেডিসিনের মাধ্যমেই করা যাক, ভেবেছিল ইতু ।
সুশান্ত বেফাঁস বলে ফেলেছিলেন, বিয়ে করলি না কেন ?
গোখরো সাপের ছোবলের আগে সতর্কবার্তার মতন ইতু বলে উঠল, বিয়ে ? চাইলেই বিয়ে করা যায় নাকি? বাড়ির কেউ কি কখনও চেষ্টা করেছে আমার বিয়ের ? তোমার ভাইরা তোমার ভাইপো-ভাইঝিদের বিয়ে দিয়েছে, তারা যে যার বিয়ে করে সংসার পেতে ফেলেছে, আর প্রায় সকলেই মা-বাপের দায়-দায়িত্ব এড়াবার জন্য এবাড়ি ছেড়ে, নানা অজুহাত দেখিয়ে, পালিয়েছে । তোমার জেঠা-কাকারা নিজের-নিজের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, ব্যাস, সবায়ের সব দায়িত্ব শেষ । সহানুভূতির জন্য টিকে আছে শুধু তিনজন বুড়ি, বটঠাকুমা, মেজঠাকুমা আর তোমার মা, মানে আমাদের অন্নমা, যাঁদের আর তেমন গুরুত্ব দেয় না এই একান্নবর্তী নৌটাংকি পরিবার । এরা এমন যে এদের সুবিধা হবে ভেবে রেলপার বস্তি থেকে একজন বাংলাদেশি বউকে এনেছিলুম রান্নাঘরের পুরো কাজ করার জন্য, থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে, তা তোমার কায়েত পরিবার বামুনগিরি ফলিয়ে বলল যে বাড়ির কাজে মুসলমান চলবে না ।
–কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিন পড়লি, তার একটা দাম তো আছে, কত লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা করছিস ।
–হুঃ, অলটারনেটিভ মেডিসিন । এম বি বি এস কোর্স পুরো করার মতন টাকা খরচ করতে চায়নি তোমার খুড়তুতো-জাঠতুতো ভাইরা, জ্যাঠা-বাবা-কাকারা, তোমার নিজের ভাই রাঙাকাকার কথা তো যত কম বলা যায় ততই ভালো , তাই ওই সস্তার ডাক্তারি পড়তে হল, তাও ডিপ্লোমা, একটা অখদ্দে প্রাইভেট কলেজে । তুমি তো এ-বাড়ির ত্যাজ্যপুত্র, নয়তো তোমার দিকে হাত বাড়াতে পারতুম । কিন্তু তুমি কখনও জানতে চাওনি যে মা-বাপ মরার পর ইতুটা কেমন আছে, কী করছে । আমার বাবা তো আর জেঠাদের মতন মাইনে পেত না, যেটুকু সঞ্চয় রেখে গেছে, তা থেকেই চেম্বার খুলেছি, সাইনবোর্ড টাঙিয়ে, বিহারি ডাক্তারদের মতন বড়ো-বড়ো করে ডাক্তার ইতু ঘোষ লিখে। মাসে একটা কি দুটো রোগি আসত, তাও তাদের পয়সাকড়ি খরচ করার যোগ্যতা নেই বলে আসত ; যারা আসত তারাও অবাক হতো যে আমি কেন রাংতায় মোড়া ট্যাবলেট দিচ্ছি না । খগোলের গরিব বস্তিতে গিয়ে ফোলডিং টেবিল পেতে রোগিদের সেবা করার চেষ্টা করেছি ; তারাও ভাবে ওষুধের বড়ি নেই, ইনজেকশান নেই, এ আবার কেমন ডাক্তার, জড়িবুটি দ্যায়, গা-হাত-পা টেপে, জলে মাথা ডোবাতে বলে । শুধু ভাড়াই গুণে যাচ্ছি । এবার বন্ধ করে দেবো । ভেবেছিলুম যে গরিবদুঃখিদের জন্য অন্তত এইটুকু তো করি, জীবনের একটা উদ্দেশ্য তো হোক । কিছুই হল না । আই অ্যাম জাস্ট এ ফেলিয়র ।
–কেন, অলটারনেটিভ মেডিসিনের প্রচার তো ভারতের ট্যুরিস্ট ডিপার্টমেন্টও করে ।
–সেই ডাক্তারদের চেম্বারে গিয়েছ কখনও, তাদের তো চেম্বার নয়, বিরাট দপতর থাকে, বাগানবাড়ি থাকে, কয়েকজন লোক খাটে, ওষুধের বিরাট ভাঁড়ার । ব্যবস্হাও ভালো । অলটারনেটিভ মেডিসিন জিনিসটা কী তা জানো ?
–না । কী ?
–হাইড্রোথেরাপি, অ্যাকুপাংচার, অ্যারোমাথেরাপি, আয়ুর্বেদ যাকে আমরা বলি হার্বালিজম, হিপনোথেরাপি, রেইকি, ম্যাগনেট থেরাপি, চিরোপ্র্যাকটিক এটসেটরা । একবার কেরলে গিয়ে দেখে এসো , তোমার যা ঝিল্লিদার চর্বি জমছে, ট্রিটমেন্ট করিয়ে এসো । অনেকে হোমিওপ্যাথিও করে , যদি কোর্সটা আলাদা করে পড়া থাকে । আমার সঙ্গে যারা অলটারনেটিভ মেডিসিন পাশ করেছিল তারা প্রায় সবাই ক্লিনিকে বসে অ্যালোপ্যাথিক মেডিসিনকে গুঁড়িয়ে পুরিয়া তৈরি করে রোগিদের রোগ সারাচ্ছে । আমি এখনও, আনফরচুনেটলি, বিবেক নামের ইডিয়সিটা ঝেড়ে ফেলতে পারিনি বলে গরিব মানুষদের ঠকাতে পারছি না। ট্রাই করে যাচ্ছি ।
–বিয়ে করলি না কেন । অলটারনেটিভ মেডিসিন বাদ দে । এমনি হাউসওয়াইফ ম্যারেজ তো করতে পারতিস ।
–কে বিয়ে করত আমায় । তোমার মতন গায়ের রং পাইনি । তোমার মায়ের মতন নাক, দিদিদির মতন চোখ, কিছুই তো পাইনি । শুধু একরাশ চুল পেয়েছি আমার মায়ের মতন । চুল দেখে কে-ই বা বিয়ে করে আজকাল ? লাখ দশেক টাকা ছড়ালে হয়তো দুচারটে কাক-চিলকে ফাঁসানো যেত । তা কে করবে ? তোমাকে যখন কিডন্যাপ করেছিল তখন তোমার শশুরবাড়ির লোকেরা দশ লাখ টাকা চেয়েছিল । দিতে পারেনি তোমার বাবা-জেঠারা । সবাই মিলে হয়ত যোগাড় করতে পারত টাকাটা, কিন্তু এ-বাড়ি হল মানসিক দারিদ্র্যে সমৃদ্ধ।
–তুই কি কাউকে বিয়ে করতে চাইছিলি ?
–বিয়ে করতে চাইলেই তো আর তাকে বিয়ে করা যায় না । পাত্র যদি বাপের পদবির বদলে তার মায়ের পদবি নিয়ে জন্মায়, যদি সেই পাত্রের মা তার বাবার নয়, অন্য কারোর বউ হয়, যদি সেই পাত্রকে তার মা-বাপ অনাগ্রহী এক দম্পতির কোলে ফেলে দিয়ে কেটে পড়ে, তাহলে সেই পাত্রকে কোন চোখে দেখা হয় জানো ? কুলের কলঙ্ক । আমি সেরকম এক পাত্রকে পছন্দ করেছিলুম, কিন্তু বাড়ির গুরুজনদের মতে, যদিও তারা পষ্টাপষ্টি সেকথা বলেনি, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলেছে যে অমন পাত্র এই বাড়ির সম্মানের উপযুক্ত নয় । তোমাকেই এরা আজ পর্যন্ত স্বীকার করতে পারল না তো যার বাবা-মায়ের সম্পর্ক সন্দেহজনক তাকে স্বীকার করবে কী ভাবে ? তোমারই তো নিকট বন্ধু ছিল অতনু চক্রবর্তী আর তোমার এককালের সহকর্মী ছিল মানসী বর্মণ । মানসী বর্মণ নাকি অতনু চক্রবর্তীর চেয়ে দশ বছর বড়ো, আর তাঁরা লিভ টুগেদার করতেন, মানসী বর্মণ আর অতনু চক্রবর্তী নাকি মানসীর স্বামীর সঙ্গে একই বাড়িতে থাকতেন । তাতে তাদের ছেলে কী দোষ করল ? আর যদি তোমরা এতই রক্ষণশীল ছিলে তো শিশুটাকে এবাড়িতে রেখে মানুষ করবারই বা কী দরকার ছিল ? ওনারা কোথায় থাকেন তাও এবাড়ির কেউ জানে না, জানবার চেষ্টা করেনি । তোমার তো বন্ধু ছিল ওরা, এই অতনু-মানসী জুটিকে কেমন দেখতে বলোতো ? কেমনতর রাক্ষস-রাক্ষসী যে নিজেদের বাচ্চাকে অন্যের কোলে চাপিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে?
–কেন, রাঙা আর রাঙাবউ তো অমিতকে নিজের ছেলের মতনই মানুষ করেছে বলে জানি ।
–কিছুই জানো না । তোমার মায়ের পেটের ভাই, সে তোমার বিপরীত । অমিতকে দত্তক তো আর নেয়নি; এমনিই কোলে নিয়েছিল । আর তারপরেও বাচ্চা হবার জন্য আইভিএফ করাতে কলকাতা দৌড়োতো । কতবার যে সে আইভিএফ ফেল করল আর প্রতিবার লাখ খানেক করে গচ্চা গেল, তার কোনো হিসেব আছে ? ওই টাকায় ওরা অমিতকে ভালো স্কুলে পড়াতে পারত । ওই যে বলে না, দাঁত নেই, চলেছে বিষকামড় দিতে, রাঙাকাকার অবস্হা তেমনই । আইভিএফ করালে সে বাচ্চাটা রাঙাকাকার হতো না, অন্য কারোর হতো, তাতেও আপত্তি নেই, অবশ্য দেখতে-শুনতে ভালো হতো, ফর্সা ঢ্যাঙা ডোনারের বীজ নিলে ।
–আর গাঁজাটাজা খাস না তো ? কন্ঠস্বর নামিয়ে জানতে চেয়েছিলেন সুশান্ত, প্রশ্রয়দানকারী জেঠামশায়ের ভূমিকায় অভিনয় করার চেষ্টায় ।
দীর্ঘ চুলের ঝাপট বুক থেকে পিঠে উড়িয়ে, উঁচু গলায় ইতুর জবাব, ওঃ, তোমাকে জানানো হয়ে গেছে, তোমারও দেখছি এজেন্ট রয়েছে এ-বাড়িতে । তারপর যোগ করেছিল, কলেজে পড়ার সময়ে মারিহুয়ানা ফোঁকেনি, এমন ছাত্রছাত্রী তোমাদের জুরাসিক যুগে ছিল, তোমার ছেলেও হয়ত খায় বা খেয়েছে, জিগ্যেস করে দেখো । কলেজ তো বহুদিন ছেড়েচি, মৌজমস্তি করার টাকাকড়ি কোথায়, যে ওসবে ইনডালজ করব ? বিরক্তি ধরে গেছে জীবনে, কিচ্ছু ভাল্লাগে না । আমার আইডেনটিটি কী ? গ্যাসভরা ফানুস !
–কবে চলে গেছে অমিত ? সুশান্ত সরাসরি প্রশ্ন তুললেন, যে ভাবে উকিলরা সাক্ষীদের প্রশ্ন করে ।
–চার বছরের বেশি । কে জানে বেঁচে আছে কি না । অপমানে হয়ত আত্মহত্যা করে থাকবে । প্রায় ফুঁপিয়ে ফেলেছিল ইতু, সামলে নিল ।
সুশান্ত বললেন, মোবাইলটা নে, মন খারাপ হলে আমার সঙ্গে কথা বলিস । তোকে দেখতে যথেষ্ট ভালো ; কলেজে তোর ছেলে-বন্ধুরাই এককালে লাইন মারত বলে শুনেছি । তুই-ই কাউকে প্রশ্রয় দিসনি, এখন বুঝতে পারলুম যে তার কারণ অমিত বর্মণ ।
সুশান্তকে স্তম্ভিত করে ইতু বলল, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে দাও না, তোমার ওখানকার কারোর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিও, সুখে ঘর করব, কথা দিচ্ছি, সিরিয়াসলি বলছি, তুমি আমাকে কিডন্যাপ করিয়ে নাও, কবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে বল, সেই মতো অপেক্ষা করব । জীবনটা তো জীবনের মতন হয়ে উঠুক । একটা উদ্দেশ্য তো হোক বেঁচে থাকার । তুমি জানো , তথাকথিত এই একান্নবর্তী পরিবারে আমি সবচেয়ে বেশি বোল্ড, যা ভালো বুঝি তা-ই করি, সব্বাই কাওয়ার্ড, ইনক্লুডিং অমিত । মেজমাসির মেয়ে ফুলকিও বোল্ডনেস দেখালো । জানো তো ফুলকি বাচ্চা হবার পর ওর বরকে ডিভোর্স দিয়ে আবার সেই বরের কাছেই ফিরে গেছে, বাচ্চাও হয়েছে । আসলে পারপাস, জীবনের একটা পারপাস চাই, অভিমুখ চাই ।
–আমার দিয়ারার গাঁয়ের যে কোনো যুবক তোকে বিয়ে করতে চাইবে, সম্রাজ্ঞী বানিয়ে রাখবে, কিন্তু বিয়ে করতে পারে এমন কেউ তোর বয়সী তো নেই । ওখানে ছেলেদের ছোটোবেলাতেই বিয়ে হয়ে যায় ।
–তাতে কি । কম বয়সী বরও তো হয় অনেকের, কিংবা আমি কারোর দ্বিতীয় বউ হয়ে থাকব, সুখে-শান্তিতে তো থাকব, কারোর সংসারের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে, বেঁচে থাকার পারপাস তো হবে । আমার মাথার ভেতরে একজন ল্যাংটো ইতুকে তো শান্তি দিতে পারব । আমার কি সাধ-আহ্লাদ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা নেই ? প্রেমিককে চুমু খাওয়াও এরা সহ্য করতে পারে না, কেননা তাদের মতে সে প্রেমিক সম্ভবত বেজন্মা ।
–কী বলছিস জানিস ? আমার ছেলেকেও একই সঙ্গে গালাগাল দিচ্ছিস ।
–হ্যাঁ, এরা তো তা-ই মনে করে । তোমার ছেলের তো এ-বাড়িতে প্রবেশ নিষিদ্ধ । জানি না তুমি কেন আত্মসম্মান খোয়াবার জন্য যেচে এসেছ ।
–সকলের জন্য মাঝে-মাঝে মনকেমন করে রে ।
–এ-বাড়িতে আমি তো একজন শ্রদ্ধেয় চাকরানি, গ্লোরিফায়েড মেইড । সুশান্তকে উত্তরহীন বসে থাকতে দেখে ইতু বলল, দেখলে তো, সমাধান কারোর কাছে নেই, সবাই কেবল উপদেশ ঝাড়ে । তোমার বউকেই এরা আসতে দিতে চায় না এমন কনজারভেটিভের এঁটো-খাওয়া বংশ । কোন জগতে তুমি বাস করো গো ? এখনও মনকেমন টাইপ আবেগে ভোগো !
মোবাইলটা হাতে তুলে নিয়ে ইতু বলেছিল, সিমকার্ড কেনার টাকা দিয়ে যাও, আর মাঝে-মাঝে তোমার ওখান থেকেই রিচার্জ করিয়ে দিও । জানি এতে অনেক খেলা-টেলা থাকে, তাই করেই টাইমপাস করব, আমাদের বাড়ির কাজের বউয়েরও মোবাইল আছে যখন , আমি তো বললুম তোমাকে, আমি হলুম গ্লোরিফায়েড খাওয়াপরার মেয়ে, চব্বিশ ঘণ্টার।
সুশান্তর প্রায়-ফোকলা বড়জ্যাঠাইমা অবশ্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন, নিয়ে আয় না তোর বউকে, কি হয়েছে, আমরা তো সবাই তোর বউয়ের ভাষায় কথা বলতে পারি । মোবাইলে বড়জেঠিই সুশান্তর সঙ্গে প্রথম কথা বলা আরম্ভ করেছিলেন, তখন উনি জামশেদপুরে ছেলের কাছে, হাসপাতাল থেকে ফোন করতেন । বড়জ্যাঠাইমার বড়ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে বদলি নিয়ে বউ-ছেলে-মেয়েসহ চলে গেছে জামশেদপুর । বড়জ্যাঠাইমা গিয়েছিলেন কিন্তু ছেলের বাড়িতে ওঠেননি, ওনাকে ছেলের বউ ফ্ল্যাটের চৌকাঠ পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি । যে তিন মাস জামশেদপুরে ছিলেন সে তিন মাস ছেলে ওনাকে এক হাসপাতালের শীতাতপ আরামে ভর্তি করে দিয়েছিল ; প্রতিদিন সকাল বিকাল গিয়ে দেখা করত ; দুয়েকবার ছেলে-মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিল মার সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে তোলার জন্য । হাসপাতালের স্বাস্হ্যকর খাবার খেয়ে সুশান্তর জেঠির চেহারার খোলতাই হয়ে গিয়েছিল । ছেলের বউ চেয়েছিল যে তার বুড়ি বিধবা মা, একা, চোখে ভালো দেখতে পান না, থাকুন পাটনায় ছেলের বাড়িতে ; তাতে সুশান্তর বাবা-কাকা-জেঠারা রাজি হননি । এসব ঝুটঝামেলা এড়াতে বড়জ্যাঠাইমার ছেলে বদলি নিয়ে পালিয়েছে জামশেদপুর । ছোটোছেলে আমেরিকায় পড়তে গিয়ে আর ফেরেনি ; ওখানের চিনা মেয়েকে বিয়ে করে থেকে গেছে, দুই মেয়ের চিনাভাষায় নাম রেখেছে ।
সুশান্তর বাবা কখনও ফোন করেননি ওঁকে । ইতু ফোন করে জানিয়েছিল যে সুশান্তর মায়ের মোবাইলটার প্যাকিঙই খোলা হয়নি । যেখানে সুশান্ত রেখে গিয়েছিল ড্রইংরুমের সেই সাইড টেবিলেই ধুলোর ওপর পড়ে আছে । কাজের বউ সৌদামিনীও ঝাড়পোঁছ করার সময়ে তাতে হাত দেয় না ।
তারপর সুশান্ত ঘোষের বাবা মারা গেলেন । হয়ত উনিও ফোনটা ব্যবহার করেননি ।
.
পাঁচ
পুড়তে-থাকা কুঁড়েঘরগুলোর মাঝে দাঁড়িয়ে, এ কে সানতালিস রাইফেলটা হাতে নিয়ে, সিলভারব্যাক গোরিলার ঢঙে বুক চাপড়ে, রগ বয়ে যৌবন-প্রাপ্তির মস্তির রস ঝরানো যুবক হাতির মতন, অপুর, অশ্বমেধ ঘোষ-এর, কন্ঠস্বর থেকে যে চিৎকার বেরিয়ে এলো তাকে বৃংহনের সঙ্গেই তুলনা করা যায় । তার কারণ অপু ক্রোধেও গালাগাল দিতে পারে না, দিতে না-পারার অতিরিক্ত আক্ষেপে ক্রোধ মাথায় উঠে যায় ; সে-উক্তিগুলো ওর সাঙ্গপাঙ্গরাই করছিল ।