Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ওতুলের প্রতিদ্বন্দ্বী || Bani Basu

ওতুলের প্রতিদ্বন্দ্বী || Bani Basu

ওতুল নিজেকে গুঁই বলে না, ইংরেজি বানান অনুযায়ী বলে গুইন। এতে ওতুলের। বাবার আপত্তি আছে যথেষ্ট, কিন্তু গুইন হিসেবে ছেলের দাপট অর্থাৎ সাফল্যে চমৎকৃত হয়ে তিনি এ বিষয়ে আর বিশেষ উচ্চবাচ্য করেন না। কেউ মি, গুইনকে ডাকতে এলে এখন তিনি বেশ গর্বের সঙ্গেই কবুল করেন এই মি. গুইন তাঁরই কুলপ্রদীপ, তিনি দেখছেন সে বাড়ি আছে কি না, ভারি ব্যস্ত মানুষ তো! ওতুল মস্তান নয় কিন্তু। সে নিজেকে বলে মস্তানের বাবা। অর্থাৎ তাদের এলাকার মস্তানরা—খেদা, ন্যাড়া, বীরু এরা ওতুলদার পরামর্শ ছাড়া এক পা চলে না। খেদা-ন্যাড়াদের কবজায় রেখে ওতুল পুরো এলাকাটাকেই কবজায় রেখেছে বলা চলে। এই প্রতিপত্তি অবশ্যই একদিনে হয়নি। এমনি এমনিও হয়নি। প্রথমত, ওতুলের শরীর স্বাস্থ্য ঠিক যে তুলনায় দশাসই, ঠিক সেই তুলনায় মোলায়েম তার গলার স্বর এবং আচার-ব্যবহার। যে পাবলিক রিলেশনস প্রতিভা তার বাপ ঠাকুরদা খদ্দের চরাতে চরাতে বহু জেনারেশন ধরে আয়ত্ত করেছেন, সেই দুর্লভ জনসংযোগক্ষমতা একরকম জন্মসূত্রেই তার হাতের আমলকী। অতি কৈশোর থেকে সে প্রথমে তার পাড়ার, তারপর তাদের এলাকার, তারপরে আরও বৃহৎ এলাকার যাবতীয় ঝগড়া-কাজিয়া মেটানো ইত্যাদি অভিভাবকগিরি করে এসেছে। অত্যন্ত সফলভাবে। প্রথম প্রথম পাড়ার বড়োরা তাকে জ্যাঠা ছেলে বিশেষণে বিশেষিত করতেন। পরে ঠিক তাঁরাই বলতে আরম্ভ করেন, ওতুল বড়ো বিচক্ষণ ছেলে। তাঁদের কারও ছেলে ঘোঁতন, কারও নাতি ট্যাঁপা, কারও মেয়ে কুঁচি এদের কেসগুলো ওতুল সমুদয় জট ছাড়িয়ে একেবারে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিত। সুতরাং প্রতিপত্তি ওতুলের হবে না তো কি সুবিকাশ সরখেলের হবে? এর ওপরে ওতুলের একটা সাংস্কৃতিক অ্যাঙ্গল আছে। সে সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট তো বটেই। উপরন্তু গান করতে পারে, বক্তৃতা করতে পারে, এমনকি কলমের জোরও তার আছে। বিশাল কালীপুজো এবং সরস্বতীপুজো হয় তাদের পাড়ায়। দুটি পুজোরই জাঁকজমক এবং পরবর্তী সাংস্কৃতিক উৎসবসূচি আপনার আমার চোখ ট্যারা করে দেবার মতো। বিশ ফুট কালীপ্রতিমা বিসর্জনের সময়ে ওতুল যখন তার প্রকাণ্ড সাদা কপাল তেল-সিঁদুরে চর্চিত করে, সিল্কের পাঞ্জাবির মধ্যে দিয়ে লাল, রোমশ বক্ষপট বিদ্যুচ্চমকের মতো দেখাতে দেখাতে শার্দুলবিকৃত ছন্দে চলে, এবং তাকে কেন্দ্র করে ঘেঁদা, ন্যাড়া, বীরু ও সম্প্রদায় প্রবল বিক্রমে স্ট্যাম্প-মারা বিসর্জনি নাচ নাচতে নাচতে তার সঙ্গ নেয়, তখন বিশফুটি কালীপ্রতিমাই পুজ্য ছিলেন, না হলুদ সিল্কের ওতুলকৃষ্ণই সত্যিকারের পুজ্যপাদ ছিল বোঝা শক্ত হয়ে ওঠে।

তবে কোনো মানুষের পক্ষেই সব মানুষের মন রাখা সম্ভব নয়। জনপ্রিয়তার বত্রিশপাটি হো-হো হাসির মাঝে মধ্যে দু-একটা ফোকলা দাঁতের ফাঁকি থেকেই যায়। কিছু হিংসুটে মানুষ বিসর্জনি মিছিলে সিল্কের বুকখোলা পাঞ্জাবি-পরিহিত ওতুলকৃষ্ণকে পুতুলকৃষ্ণ, বিপুলকৃষ্ণ ইত্যাদি বিকৃত নামে ডেকে নিজেদের মধ্যে মজা পেয়ে থাকে। কিন্তু বেশিরভাগ ঝুলবারান্দা থেকেই সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত নারী-জনতা বাবা-মা, জ্যাঠা-কাকাদের চোখ এড়িয়ে ওতুলদার এই উদ্দণ্ড নৃত্যপর শ্রীচৈতন্যরূপ বা প্রভুপাদরূপ দেখে পুলকিত হয়ে ওঠে। এই সময়টায় জেগে এবং ঘুমিয়ে তারা কতরকম স্বপ্ন দেখে। সেসব কিশোরী তরুণীস্বপ্নের গোপনীয় ডিটেলের মধ্যে আমাদের না যাওয়াই ভালো।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা জলসার সময়ে ঘোষক বা ঘোষিকা অফ বম্বে ফেম থাকে, জনপ্রিয়তম লোকসংগীত গায়ক থাকে, নেচে নেচে গান-গাওয়া বিখ্যাত গায়িকা, সুন্দরী আবৃত্তিশিল্পী, সুকণ্ঠ শ্রুতিনাট্যনট ইত্যাদি যথেষ্ট পরিমাণে আমদানি হয়। সবচেয়ে বড়ো কথা পাড়ার উঠতি প্রতিভাদের ওতুল এই সময়টায় সুযোগ করে দেয়। সুচন্দ্রা সান্যাল যে অবিকল আশা ভোঁসলেকে নকল করতে পারে, ট্যাঁপা ওরফে অরুময়কে যে কুমার অরু নাম দিয়ে অনায়াসে নামকরা আধুনিক গাইয়েদের পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, ছোট্ট গেনি যে জাত-বাউলদের মতো নাচতে এবং গাইতে পারে এসব ওতুলকৃষ্ণরই আবিষ্কার। সুচন্দ্রা সিনেমায় চান্স পেল বলে, গেনি তো সেই কবেই চিচিংফাঁক-এ ঢুকে বসে আছে। কুমার অরু তরুণদের জন্যর জন্যে শিগগিরই অডিশন দেবে।

এই মরশুমটাতে এনতার প্রেমও হয়। পাড়ার কিশোরী-তরুণীরা পুজোয় বাবার বোনাস ভাঙানো মহার্ঘতম শাড়িটি পরে। রঙে-চঙে সুন্দরতম হয়ে ওঠার চেষ্টা করে, তারপর পরম অবহেলায় আয়রন-করা চুল দুলিয়ে, পিন-করা আঁচল উড়িয়ে ওতুলদা, ন্যাড়াদা, বীরুদাদের ঝাপটা দিয়ে দিয়ে চলে যায়। মতামতের আদানপ্রদান হয়, জলসার নানা কাজের ভার পায় এরা, আর্টিস্টদের মনোরঞ্জন, খাবারদাবার এগিয়ে দেওয়া, অটোগ্রাফের খাতা দফায় দফায় সই করানো, পেল্লায় দায়িত্ব সেসব। এবং এইসব চলতে চলতে আঙুলে আঙুল ঠেকে, কাঁধে কাঁধ। শাড়ির আঁচল খসে, কোমরের রুমাল থেকে উৎকট সুগন্ধ বার হতে থাকে। পাটভাঙা কাগজের পোশাকের মতো কড়কড়ে পাজামা-পাঞ্জাবি, পেখমধরা, ঘাড়ে কেয়ারি চুল, দু আঙুলের ফাঁকে পৌরুষব্যঞ্জক সিগারেট। ওতুলদা তখন আড়চোখে কার দিকে চাইল রে? রূপার দিকে। ধ্যাত, ও তো সোমালির দিকে। টিঙ্কু কিছু বলছে না। মুখ টিপে টিপে হাসছে। সে, একমাত্র সে-ই জানে ওতুলদা, ন্যাড়াদা, ইত্যাদি কার দিকে চাইল। কার দিকে আর চাইবে? এমন ফিগার, এমন ঠোঁট, এমন কাজলপরা চোখ আর এ শহরে দুটো আছে নাকি? টিঙ্কু আয়নার নিজেকে যতই দেখে ততই নিজে নিজেই মস্ত হয়ে যায়। তাই বলে কি আর পাড়ার সব। ছেলে মেয়েগুলির পাড়ায় মধ্যেই বিলিব্যবস্থা হয়ে যায়? তা হয় না। তা হবারও নয়। এসব হল মরশুমি প্রেম। নতুন শীতের হাওয়ার কারিকুরি। কার সঙ্গে বিয়ে হল? না ন্যাড়া-গুণ্ডার সঙ্গে। মিসেস ন্যাড়া গুণ্ডা! ছ্যাঃ। মেয়েরা আজকাল আগের মতো রাম-বোকা আর নেই।

অনেকদিন খালি পড়েছিল শম্ভ উকিলের জরদগব বাড়িটা। অতবড়ো বাড়িটায় দটি মাত্র মানুষ। খালি পড়ে থাকা ছাড়া একে আর কী বলে? শম্ভ উকিল মারা যাবার পর একতলা বাড়িটাতে রইল সুষ্ঠু শম্ভ উকিলের আইবুড়ো বোন ধিঙ্গি দুগগা, বা দুগগা দিদি, আগেকার দিনে হলে যাকে ইন্দির ঠাকরুনের মতো দুগগা ঠাকরুন বলে ডাকা হত। তো এই দুগগা ওতুলের সঙ্গে লড়ে গেল। অনেকদিনের নজর ছিল ওতুলের বাড়িটার ওপর। অনায়াসে একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র খোলা যায়। বিঘেখানেক জমির ওপর একটেরে একতলা। চার পাঁচখানা বড়োসড়ো ঘর। লাইব্রেরি, ইনডোর গেমস, আচ্ছা ও অফিসঘর, সব এক ছাতের তলায় হতে পারবে। ভোলা জমিটা সাফসুফ করে ব্যাডমিন্টন কোর্ট, ব্যায়ামগায়, পাড়ার ছেলেমেয়েদের নিয়ে ড্রিল-টিল, দরকারমতো জলসার আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা সবই এক জায়গায় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কত সুবিধে বলো তো? শম্ভ উকিলের ক্যানসারের যন্ত্রণা যতই বেড়ে ওঠে, ওতুলকৃষ্ণদের হৃদয়ও ততই আশা উদবেল হয়ে উঠতে থাকে। ঠাকুরপুকুরে নিয়ে যাওয়া, শেষমেশ হিন্দুসৎকারের গাড়ি, ঠোঙাভরতি খই-পয়সা, সাদা পদ্মের রিদ সবই ওরা করল। পাড়ায় বিরাট করে শোকসভা হল। কনডোলেন্স। শম্ভ উকিল যে কত বড়ো মহামানব ছিলেন, শ্রীঅরবিন্দ, বিবেকানন্দ, চিত্তরঞ্জনের মতো গুপ্তযোগী, দেশপ্রাণ, মহাপ্রাণ সেসব কথা জ্বালাময়ী ভাষায় ওতুল সবাইকে বুঝিয়ে দিল। অনেকেরই চোখে জল। কারও রুমাল ভিজে সপসপ করছে, কেউ থাকতে না পেরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলছে, খালি দুগগা মুখ বেঁকিয়ে, পানের পিক ফেলে বললে, ঢ-অ-অ-:ং। বক্তিমে শুনে আর হেঁসে বাঁচিনে। সুতরাং দুগগার হাত থেকে শম্ভু উকিলের বাড়িটা চটপট উদ্ধার করা আর হয়ে উঠল না। শম্ভ উকিলকেও মরণোত্তর পল্লিরত্ন, কি দানবীর উপাধি দেওয়া গেল না।

দুগগা রক্ষিত আবার আরেকটি কম্মো করলে। একঘর ভাড়াটে এনে বসালে। ওতুল কত করে বোঝালে আজকালকার দিনে সব আইন ভাড়াটেদের পক্ষে। ভাড়া-বসানো আর খাল-কেটে কুমির আনার মধ্যে কোনোই তফাত নেই। ওই ভাড়াটে দুগগাদিদি শেষ পর্যন্ত ওঠাতে পারবে না। এই বাজারে লাখ-লাখ টাকার জমি দুগগাদিদির হাতছাড়া হয়ে যাবে। দুগগা রক্ষিতের ওই কথা, তোদের গভভে যাওয়ার চেয়ে বরং ভাড়াটেতেই গিলুক। তোরা আমাকে দূর করে দিবি। ছুঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুবি। তাস পিটে, টাসা পিটে হল্লা করে নরক গুলজার করে তুলবি। তার চেয়ে ভদ্দরলোক তার পুত-পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকুক। নিজের ঠেয়ে নিজের মতো। অকালকুণ্ডর দল, তোদের তাতে কী? দাদা নেই, আমার এখন নিজের খরচ-খর্চা নিজেরই চালাতে হবে। বুঝলি? যা এবার পালা। ওতুল যাদের দাঁতে কাঁকরের মতো ফুটে থাকে সন্দেহ নেই দুগগা রক্ষিত তাদেরই একজন।

ভাড়া তো হল। ঝাঁকড়া চুল, মোটা চশমা পরা ধারালো চেহারার এক যুবক, তার পেছন পেছন মেরুদণ্ড সিধে এক-বিনুনি-করা এক রোগা যুবতি এবং দুটি প্রায় এক সাইজের ভারী-ভুরি বাচ্চা এক টেম্পো মাল নিয়ে এসে নামল। দু-চার দিনের মধ্যেই শুনতে পাওয়া গেল—এ ভদ্রলোক যে সে নয়। উদীয়মান কবি আর্যশরণ ঘোষ। কবি আর্য ঘোবের আবার প্রধান বৈশিষ্ট্য সে নাকি লড়াকু মানুষ। শুধু পদ্যই লেখে না, নানারকম সমাজসেবামূলক কাজকম্মো করে থাকে। যুবতিটি তার স্ত্রী নয়, বোন। আর্য ঘোষ আসবার কয়েক মাসের মধ্যেই শম্ভ উকিলের বাড়ির সংলগ্ন জমির চেহারা ফিরতে লাগল। ওরা নাকি ফুল ভালোবাসে। মাথাভরতি ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল নিয়ে আর্যশরণ আর তার বোন যখন চুবড়ির মতো ডালিয়া আর চন্দ্রমল্লিকার দেখাশোনা করে, পাঁচ রকমের জবা আর সাতরকমের গোলাপ গাছে সার দেয়, তখন কাছাকাছির ঝুলবারান্দায় উঁকিঝুঁকি চলে। রূপা বলে, ফ্যানটা, বল টিঙ্কু? টিঙ্কু বলে, কোনগুলো? ডালিয়া না ক্রিসেনথিমাম না গ্ল্যাডিয়োলাস? রূপা মুচকি হেসে বলে, তোর মাথা। টিঙ্কু বলে, আই সি। দুজনেই দুজনকে বোঝার মজায় হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকে যায়।

সেবার কালীপুজোয় ফাংশনে সভাপতি করা হল আর্যশরণ ঘোষকে। ওতুলই করল। ওতুল বড়ো উদার চরিত্রের ছেলে। একথা বলতেই হবে। সে গুণের আদর করতে জানে। তা সেই সভার সভাপতির ভাষণ, এলাকাকে কাঁপিয়ে দিল। সে কি কবিতা, না জ্বলন্ত ফুলঝুরির মতো শব্দঝুরি, সে কি উপদেশ না অনুপ্রেরণা পাড়ার লোক ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারল না। কিন্তু তারা একেবারে বোল্ড হয়ে গেল। এমন অপরূপ করে যে কেউ শক্তিপুজোর ব্যাখ্যা করতে পারে, এমন কাব্যময় ভাষায় অনর্গল বলে যেতে পারে কাউকে মুহূর্তের জন্যেও বার না করে, বলবার সময় কারুর চেহারা যে এমন প্রদীপ্ত মশালের মতো হয়ে উঠতে পারে, এলাকার লোকের অভিজ্ঞতার মধ্যে এসব ছিল না। সেবার কালীপুজোর যা হবার হয়ে গিয়েছিল। সরস্বতীপুজো হল একেবারে অন্যরকম। স্থানীয় আর্টিস্ট সুকেশ মিত্তিরকে দিয়ে কাগজের প্রতিমা হল। বাসন্তী রঙের মণ্ডপ হল। পলাশ গাঁদায় ছেয়ে গেল বেদি। আলপনা হল মনে রাখবার মতো। পুস্পাঞ্জলি দিতে এল দফায় দফায় সবাই। সরোদ, সেতার, বাছা বাছা গান, এবং সন্তুর ছাড়া আর কিছু বাজল না, তা-ও মৃদুস্বরে। শ্বেতপদ্মাসনা দেবী স্তোত্র গানের মধ্যে দিয়ে শান্তভাবে ঘটবিসর্জন হয়ে গেল। সবার মনে হল এমন পুজো আর কখনও হয়নি, আবার হবে কি?

পাড়ার সাংস্কৃতিক কমিটির চেয়ারম্যান ওতুলকৃষ্ণ। তাই বলে স্থায়ী নয়। একেবারে গণতান্ত্রিক উপায়ে, সবাইকার মতামত নিয়ে ব্যাপারটা হয়, তবু জানা কথাই ওতুলই প্রেসিডেন্ট হবে। এবার আশ্চর্যের বিষয়, পাড়ার কিছু মাতববর ব্যক্তি বললেন, আর্যকে করা হোক না কেন? ছেলেটার এলেম আছে। ততোধিক আশ্চর্যের বিষয়, ন্যাড়া, মস্তান ন্যাড়া, ওতুলদার ডান হাত ন্যাড়া, যাকে বেপাড়ায় ন্যাড়া গুণ্ডা বলে উল্লেখ করা হয়, সেই ন্যাড়া এতে সায় দিল, সত্যিই তো। ওতুলদা কদ্দিক সামলাবে? তবে হ্যাঁ, ঝামেলা পোয়াতে হয় সেক্রেটারিকে, আর্যদা না হয় সেক্রেটারি হোক, ওতুলদা যেমন প্রেসিডেন্ট ছিল প্রেসিডেন্ট থাক। সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি পাস হয়ে গেল। ক্লাবের খাতা-পত্তর, বিল বই, অডিট রিপোর্ট, সুভেনির এভরিথিং চলে গেল আর্যশরণের খপ্পরে।

সমস্ত ঘটনাটার পর ন্যাড়াকে ডেকে রক্তচক্ষে ওতুল বলল, এর পর ফের ওতুলদা আজকে একটু মাল খাওয়াও বলিস, বলতে আসিস।

ন্যাড়া অবাক হয়ে বলল, যাচ্চলে, তুমিই তো প্রেসিডেন্ট, মানে সবেবসব নইলে। আর্যদা খালি খেটে মরবে। আসলে কি জানো, পাবলিক যা চায় মাঝেমধ্যে তা দিতে হয়, নইলে শালা ডেমোক্র্যাসিও মচকে যাবে, পাবলিকও খচে যাবে। রূপা-টিঙ্কুরাও আর্যদাকে চাইছে। দাই না চান্স একবার মাইরি।

মাসখানেকের মধ্যে খাতা-তহবিল সব মিলিয়ে-টিলিয়ে আর্যশরণ একদিন ওতুলকৃষ্ণকে ডেকে পাঠাল। বেশ সুগন্ধি চা খেতে খেতে, খাওয়াতে খাওয়াতে বলল, আচ্ছা ওতুল, তুমি কী করো?

কী করি? মানে? দেখতে পান না কী করি আর কী না করি?

এগজ্যাক্টলি। দেখতে পাই। ওতুল, আজকালকার দিনে কেউ আশা করতে পারে না একটা মানুষ দিবারাত্র আর পাঁচজনের জন্যে বিনামাশুলে খেটে যাবে। দিস ইজ টু মাচ। তুমি ন্যাড়া, খেদা, বীরু এবং আরও যারা ক্লাবের বিভিন্ন কাজ সারাবছর ধরে করে যাও, অথচ যাদের কোনো আয় নেই, তাদের একটা লিস্ট করে ফেলা যাক। জনা ছয় সাতের বেশি হবে না বোধহয়। আমার প্রস্তাব তাদের প্রত্যেককে ক্লাবের হোলটাইমার হিসাবে কিছু মাসোহারা দেবার ব্যবস্থা করা যাক।

ওতুল বলল, দে দ্দেখুন আর্যদা, এটা আমাদের অপমান করা। ন্যাড়া বীরুদের অপমান করা। আমরা যেটা করছি সেটাকে বলে মানবসেবা, কথাটা শুনেছেন?

আর্যদা প্রশান্তমুখে বললেন, শুধু মাসোহারা নয়, পুজো বাবদ সুভেনির ইত্যাদির জন্য যে যত বিজ্ঞাপন আনবে তার কিছুটা পার্সেন্টেজও কমিশন হিসাবে তোমাদের দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হোক। হিসেবের খাতায় যে বিরাট বিরাট গরমিলগুলো রয়েছে সেগুলোকে তোমাদের প্রাপ্য বকেয়া বলে অ্যাডজাস্ট করে নেওয়া হবে। তাহলেই হল। নইলে এইসব খাতাপত্তর, সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত টাকার থেকে ট্যাক্স নিয়ে তৈরি তহবিল, এসব প্রহসন হয়ে যায় ওতুল।

আর্যশরণের পরের চালটা এল আরও সংঘাতিক। সে কালীপুজোর প্রস্তুতিপর্বে বলল, বিশ ফুট প্রতিমা করে প্রতিবছর বিসর্জনের সময় ওভারহেড তারকাটা সে বড়ো বিশ্রী। দশ ফুট প্রতিমা আরও অনেক সুন্দর হবে। কুমোরটুলির নারায়ণচন্দ্র পালকে দিয়ে করাও, অপূর্ব শ্যামামূর্তি করে দেবেন। আর রাস্তা আটক করে লরি, টেম্পো, ট্যাক্সি, প্রাইভেট কার, রিকশা এদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় কোরো না। মানুষকে এভাবে প্রেশারাইজ করা ঠিক না। ভয়ে কেউ কিছু বলতে পারে না। কিন্তু আমি জানি গতবছর মুদির দোকানের তারাশংকরকে সাড়ে চার হাজার টাকা চাঁদা দিতে বলেছিলে বলে সে বেচারির স্ট্রোক হয়ে যায়। এগুলো ঠিক না।

কালীপুজোর রাতে একটি জমজমাট কারণসভা বসত। সেটাও এবার বসল না।

ওতুল যেমন উদারতায় বশিষ্ঠ, তেমনি বুদ্ধিতেও আবার সত্যি-বৃহস্পতি। সে সাপের লেজে পা পড়ার অপেক্ষাটিতেই ছিল। খ্যাঁদা, বীরু, ন্যাড়ার সঙ্গে তার গোপন বৈঠকগুলো ঘনঘনই বসতে লাগল।

টিক্কর বাবা রতনমণি ঘটক, রূপার বাবা সারদাচরণ সরকারকে ডেকে বললেন, সারদা, এসব কি শুনছি?

সারদাচরণ বললেন, শুনেছ? তুমিও শুনেছ তাহলে? ছোকরা ভদ্দরলোকের মতন থাকে… রতনমণি বললেন, শুনব না মানে? পরস্ত্রী ফুসলিয়ে এনে বোন সাজিয়ে সবার চোখের ওপর বাস করবে, আর শুনব না?

কী কেচ্ছা, কী কেলেঙ্কারি, শেষকালে কি সেই লিভিংটুগেদার না কী বলে, সেসব ব্যভিচার এইখানে, এই পাড়াতেই আরম্ভ হল?

সুচন্দ্রার মা একদিন শম্ভ উকিলের বাড়ির ভেতর গিয়ে কখানা শোবার ঘর দেখে এলেন। রিপোর্ট হল, একটা ডবল বেড়। আর একখানা তক্তপোশ। বেশ লম্বা চওড়া, ইচ্ছে করলে দুজনেও শোয়া যায়।

এক রবিবার সকালে হতভম্ব আর্যশরণ দেখল তার বাড়ির সামনের বাগান তছনছ করতে করতে এগিয়ে আসছে বেশ বড়োসড়ো একটা মারমুখী জনতা। তাদের মুখে অসন্তোষ, ঘৃণা, জিভে অকথ্য গালাগাল। একেবারে সামনে কিছু প্রৌঢ়, গুটিকয় বৃদ্ধ। তাঁরা বললেন, তাঁদের চক্ষুলজ্জা মানসম্ভম ইত্যাদি অনেক কিছুর বালাই আছে। হঠকারিতা তাঁরা প্রাণ গেলেও করতে পারেন না। তাঁরা তাকে কিছুই বলবেন না। শুধু এই ভদ্রলোকের পাড়া ছেড়ে আর্যশরণ অন্যত্র উঠে যাক। যেসব জায়গায় এসব চলে, যাক না সেখানে। সাতদিনের মধ্যে যদি না যায়, তাহলে পরিণামের জন্যে তাঁরা দায়ী থাকবেন না। ছেলেপুলে নিয়ে ভদ্রপাড়ায় ঘর করেন কি না সকলে। ছেলেদের এডুকেশন, মেয়েদের বিয়ে সবই তো তাঁদের ভাবতে হবে। জনতার মধ্যে ওতুল, কিংবা তার শাকরেদরা লক্ষণীয়ভাবে অনুপস্থিত ছিল।

আর্যশরণ ঘটনার ল্যাজামুড়ো কিছুই বুঝতে পারছিল না। কিন্তু দুগগা এ পাড়ারই মেয়ে। সে ঠিকঠাক বুঝেছিল। ভাঙাবাড়ির ন্যাড়া ছাতে উঠে সে পরিত্রাহি চেঁচিয়ে বলতে লাগল, জানিস, অলপ্পেয়েরা গীতুকে গীতুর শ্বশুরবাড়ি থেকে যতুকের জন্যে পুড়িয়ে মারতে চেষ্টা করেছিল, ওর বাপ-জ্যাঠা অনেক কষ্টে উদ্ধার করে এনেছে, জানিস রাস্তায় দু-দুবার অ্যাসিড-বালব ছুড়েছে, ফসকে গেছে তাই। আর্য ওর পিসির দ্যাওর, যদি বিপদের সময়ে মেয়েটাকে আশ্রয় দিয়ে থাকে তো বেশ করেছে, খুব করেছে, ডাইভোর্স মামলা হয়ে গেলে যদি ওকে বিয়ে করে তো বেশ করবে, খুব করবে। আমার বাড়ির মানুষ, সে কী রকম আমি জানি না তোরা জানবি ঘোড়ার ডিমের দল? এক্ষুনি এখান থেকে বিদায় হ, আমার সম্পত্তির ক্ষেতি করিছিস, আমি শম্ভ উকিলের বোন, হরিহর উকিলের বেটি, তোদের নামে মামলা রুজু করব। ক্ষেতিপূরণ দিতে তোদের ইয়ে বেরিয়ে যাবে।

জনতা আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেল। দুগগা তখনও চেঁচিয়ে চলেছে, এসব ওই ওতুল হতচ্ছাড়ার কাণ্ড। কালীপুজোর ফন্ড নিয়ে সোমবচ্ছর নেশাভাঙের ব্যবস্থা চলছিল। আর্য সেটি বন্ধ করেছে কি না…।

পরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। কোনো জনতাকে মারমুখী করে তুললে, সে যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় তো আরেকটি লক্ষ্য সে বেছে নেবেই। শক্তিটার খরচ হওয়া চাই তো! জনতার মধ্যে শুধু সারদা-রতনুমণির মতো প্রৌঢ়ই ছিল না, বেশ কিছু তাগড়া জোয়ানও ছিল যারা কুৎসা শোনবার আগে আর্যশরণের ভক্ত হয়ে পড়েছিল। এরা ফিরে গিয়ে চাঁদমারি করে ওতুলকে। আর্য এবং তার বউদির ভাইঝি গীতা মাঝে পড়ে না থামালে ওতুলকে হাসপাতালে যেতে হত? আপাতত সে শুধু নাক-আউট হয়ে ছাড়া পেল।

কিন্তু আর্যশরণ দুগগাদিদির শত অনুরোধেও, পাড়ার মাতববরদের হাজার ক্ষমাপ্রার্থনাতেও ও পাড়ায় আর রইল না। বলল, গীতার ছোটো ছোটো ছেলে দটির পক্ষে অভিজ্ঞতাটা বড়ো মারাত্মক হয়েছে। গীতাও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। একদিন সকালে শম্ভু উকিলের শূন্য বাড়ি যেমন হঠাৎ ভরে উঠেছিল চায়ের গন্ধে, ফুলের শোভায়, উৎসুক যুবক-যুবতিদের কলকণ্ঠে, বাচ্চাদের খেলার আওয়াজে, আর একদিন সকালে তেমনি আবার পূর্ণ বাড়ি শূন্য হয়ে গেল। বাগানময় শুধু সটান শুয়ে রইল কিছু মরশুমি ফুলগাছের মৃতদেহ। পা দিয়ে মাড়িয়ে যাওয়া থ্যাঁতলানো টম্যাটো আর বেগুন। ঘরগুলোর মধ্যে দু-চারটে ছেড়া পাতা, ফেলে যাওয়া ক্ষয়টে অ্যালুমিনিয়মের ঢাকনি, খালি শিশি বোতল, ফাটা বল আর ডাঁই করা খবরের কাগজ।

অনেক অনেক দিন হয়ে গেছে। প্রতিভাবান ওতুল তার পাড়াতে আবার আগের প্রতিষ্ঠা ফিরে পেয়েছে। যদিও কালীপুজোর সমারোহের দিন আর কখনোই সেভাবে ফেরেনি। ন্যাড়া, খ্যাঁদা এখন সোজাসুজিই রাজনৈতিক নেতাদের মাসলম্যান। বীরু একটা বহুতলের কেয়ারটেকার। ওতুল তার বাবার গয়নার দোকানে নিয়মিত বেরোচ্ছে। বেশ জমাট প্রতিপত্তিঅলা ভব্যিযুক্ত ধনী ভদ্রলোক। বাবার আমলের রাক্ষুসে তেলখাওয়া অ্যামবাসাডরটাকে বিদায় করে সে একটা ঝাঁ চকচকে তন্বী মারুতী-ভ্যান কিনেছে। ধবধবে সাদা। বর্ধমানের ভেতর দিকে গাঁয়ের চাষবাস দেখতে গিয়েছিল, ফেরবার সময় কাইতির কাছাকাছি একটা মাঠে দেখল প্রচুর ভিড় জমেছে এবং ভিড়ের মধ্যে থেকে ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে সাদা সুতোর ছড়াছড়ি এক পরিচিত চেহারার ভদ্রলোক মোটা ফ্রেমের মধ্যে অন্যমনস্ক চোখ নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। গাড়ি থামিয়ে ওতুল তার গিলে করা পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নেমে এল। সে ভারি উদার স্বভাবের মানুষ।

আর্যদা না? কেমন আছেন?

হাসি মুখে ভদ্রলোক বললেন, আরে চেনা-চেনা লাগছে খুব, প্লেস করতে পারছি না তো ঠিক…..।

আমি ওতুল! সদর বকশির ওতুলকৃষ্ণ গুইন।

ওতুল! ওতুলকৃষ্ণ? ওহো, সেই লাইব্রেরি করতে তেত্রিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন না? বড়ো বড়ো চোখ করে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন আর্যশরণ। আত্মগত বলতে থাকেন, টাকার অ্যামাউন্টটাই বড়ো কথা নয় ওতুলবাবু, দেবার ইচ্ছের মূল্যটা টাকার মূল্যের থেকে অনেক বেশি। আমি আজকের পথনাটকে এটাকেই আমার থিম করেছিলাম। গ্রামের লোকে বেশ নিল কিন্তু! ভারি এনজয় করল, দেখি আবার আমার ট্রপের ছেলেমেয়েগুলো কোথায় গেল… আসছি।

ওতুল দেখল, আর্যশরণ ঘোষ তাকে এবং তার সঙ্গে জড়িত সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত ঘটনাবলি বেমালুম ভুলে গেছেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress