এ যেন মোর পুনর্জনম
আমার জীবনে আমি কবি হওয়ার ইচ্ছাটা এক এক সময় এক এক রকম ভাবে মনের ভিতরে উপস্থিত হয়েছে। একেবারে ছোট বেলায় পাঠশালা শেষ হওয়ার পরে যখন পল্লীমঙ্গল ইস্কুলে কয়েক ক্লাস পড়াশোনা চলাকালীন কবি হওয়ার ইচ্ছাটা প্রথমে জন্মায় মনের ভিতর। পরবর্তীতে হঠাৎ করে আমার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। খুব সম্ভবত তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ি। সালটা ইংরেজি ১৯৯৮ সালের এপ্রিল মাস। আজ থেকে ২৪ বছর আগের সেই এপ্রিল মাস আমার শিক্ষা জীবনের শেষ মাস বা বছর। তখনো কল্পনাই করতে পারিনি যে ওই দিনগুলোই ছিল আমার জীবনের শেষ শিক্ষাজীবন। কথা ছিল কলকাতাতে আমার মামা আমাকে আবার পড়াশোনা শেখাবে। হ্যাঁ শিখিয়েছিল, শিখতে বাধ্য হয়েছিলাম কি করে দুমুঠো খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে সেই কাজে নিজেকে জোর করে লিপ্ত করে নেওয়ার অভ্যাসকে। দিন; সপ্তাহ; মাস; বছর ঘুরতে ঘুরতে কখন যেন নিজেরই ভেতরে কেউ জানিয়ে দিয়ে গেল তোমার আর পড়াশোনা হবে না।তবুও হঠাৎ হঠাৎ মাথার ভিতরে যেন ছাত্রজীবনের সেই স্বর্ণময় দিনগুলো বারবার ডাকছে এসো সুব্রত, এসো। তুমি কবিতা বলবে, তুমি অভিনয় করবে, তুমি এই স্কুলের নাম উজ্জ্বল করবে। কারন আমার সেই পল্লীমঙ্গল স্কুল দেখেছে আমার শৈশবের সেই পারদর্শিতা যা আজ এক অসম্ভাবনাময় অতীত। আমি ধরেই নিয়েছি আমার জীবনে সেই আনন্দের দিনগুলো আর কোনদিন ফিরে আসবেনা। তবুও সেই দিনগুলোর মায়া, সেই পুরস্কারপ্রাপ্তির লোভ, গুরুজনের আশীর্বাদ পাওয়ার লালসা আমাকে যেন তাড়া করে বেরিয়েছে দশকের পর দশক। কিন্তু সেই স্বপ্ন যে খুব দুষ্কর। এই শহরে যে একজন ন্যূনতম শ্রমিক ছাড়া আমার আর কোন পরিচয় নেই। নেই আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা, নেই আমার অর্থ বল, নেই আমার শারীরিক সৌন্দর্যতা। এতো প্রতিকূলতাকে ডিঙিয়ে আমার কবি হওয়ার স্বপ্ন কি কিভাবে বাস্তবায়িত করব ? আজ দুটি দশক পরে যখন হঠাৎ করে শৈশবের বন্ধুদের সাথে দেখা হবে দেখব তারা কত দূর এগিয়ে গেছে। আমি পড়ে আছি এক প্রান্তিক কিনারে। কি পরিচয় দেবো আমার শৈশবের সহপাঠী বন্ধুদের ? এরকমই একাধিক প্রশ্ন আমাকে বিবেকের মুখে ফেলে দিয়েছিলো বারবার। পেয়েছি বহুবার এই সমাজ হতে নানান রকম লাঞ্ছনা, অপবাদ এবং হয়েছি হিংসার শিকার। হঠাৎ করে কিভাবে যেন আবার আমার ভেতরের কবিসত্তা জেগে উঠলো। যদি শিক্ষিত সমাজের সামনে আমার কোন না কোন গুণের মাধ্যমে আমি সামাজিক মানুষ হয়ে উঠতে পারি তাহলে হয়তোবা আমার সহপাঠী বন্ধুদের পাশে আমি দাঁড়াতে পারবো মাথা উঁচু করে। যারা আমাকে চোর বলে প্রাণে মারতে এসেছিল তারাও হয়তো একদিন আমাকে সম্মান করতে পারে। আমার যে সকল আত্মীয়রা আমার নাম শুনলেই দূরে পালায় হয়তো কোনদিন সেই আত্মীয়রাও আমাকে নিয়ে গর্ব করতে পারে। দেখিনা চেষ্টা করে আমার পাড়া-মহল্লার কাছে আমি একজন ব্যতিক্রমী গুণধারী ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠতে পারি কিনা। তুলে নিলাম কলম আবার। লিখতে থাকি পরস্পর জীবনের সব ঘটনার অনুভব আমার কবিতার পাতায়। লিখতে থাকি অনুভূতির সকল অধ্যায় আমার কবিতার রচনায়। হয়তো কোন একদিন কেউ আমাকে কবি বলে ডাকতেও পারে। আমি তো এটুকুই চেয়েছিলাম এত বড় পৃথিবীর বুকে কেউ আমাকে একদিন কবি বলে ডাকুক। ভেবেছিলাম আমার এই আশা আমি বেঁচে থাকাকালীন কোনদিনও মিটবে না। যদিও মেটে তবে তা মৃত্যুর পরে। কিন্তু আমার সেই স্বপ্নের প্রত্যাশা অনেকটাই আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে। আমি আজ একজন সফল কবি না হতে পারলেও এত বড় পৃথিবীতে কেউ কেউ আমাকে কবি বলে ডেকেছেন বা সম্মান করেছেন। আমার নিজের লেখা অনেকগুলো বই নেই, নেই আমার অগাধ শব্দভাণ্ডারের জ্ঞান। আমি কোন নেতা বা বিশিষ্টজনের তাবেদারী করে আমার কবিতা রচনা করি না বা করতে পারিও না। এরপরেও যে আমার কবিতাকে ভালোবেসে কেবলমাত্র আমার কবিসত্তার পরিচয়কে ভালোবেসেই আমার সাথে কেউ আমাকে দেখা করতে ইচ্ছে প্রকাশ করবেন এযে আমার পরম সৌভাগ্য। এবং তিনি যদি নিজেও একজন কবি হয়ে একজন কবি আমার মত একজন কবিকে দেখতে আসছেন। আমি জীবিতকালে এমন দিন দেখে যেতে পারবো আমি কোনোদিন ভাবিনি বিশ্বাস করুন, যা গত পরশুদিন বাস্তবে পরিণত হল। যেখানে বর্তমান সময়ে কেউ কারো সাথে দাঁড়িয়ে দু’দন্ড কথা বলে না। যেখানে আত্মীয় আত্মীয়ের বাড়িতে যায় না। যেখানে শুধু স্বার্থের দড়ি ধরে টানাটানি হয় দিনরাত। এমন সময় দাঁড়িয়েও একজন বাঙালি সাহিত্য অনুরাগী আমার কবিতাকে ভালোবেসে, আমার এই অগোছানো জীবনের মধ্য থেকে তিনি কিছু হয়তো দেখতে পেয়েছিলেন। তাই আমার জন্য উপহার সহ তিনি আমার বাড়িতে এসেছিলেন। তিনি নিজেও বর্তমান সময়ের একজন সাহিত্য অনুরাগী তথা কবি শ্রদ্ধেয় বিজয় মিস্ত্রী মহাশয়। আমার বাড়িতে এসে শ্রদ্ধেয় বিজয় মিস্ত্রি মহাশয় কতটা আনন্দিত বা খুশি হয়েছেন আমি জানিনা, তবে আমি একজন কবি হিসেবে আমাকে কেউ এভাবে বাড়িতে এসে সম্মানিত করায় আমি নিজেকে নিজে ধন্য মনে করছি। ধন্য আমার কবিতা, ধন্য আমার মানব জীবন।