এরই নাম জীবন
“সেদিন দেখা হয়েছিল সকাল বেলা
তুমি খাটে শুয়ে চলেছ গলায় ফুলের মালা।
এক ঝলক দেখলাম তোমার মুখখানি
তোমাকে ভালোবাসি কখনো বলতে পারিনি।”—-
কতদিন পর তাও এইভাবে দেখলাম
তোমাকে শেষ বিদায় জানালাম।
আমি এম-কমের ছাত্র আর তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে।এক ট্রেনে নিজেদের অজান্তেই যাতায়াত।আমি জানতাম তুমি শিয়ালদা থেকে কোন ট্রেনে ফিরবে।সেই বিকাল চারটে থেকে অপেক্ষা করতাম শিয়ালদহ স্টেশনে।ঐ এক ঝলক দেখা।আর ঐ একটু মিচকি হাসি।আমি বি-বি-এ করি।তুমি ইঞ্জিনিয়ারিং করে কোথায় হারিয়ে গেলে!!
আজ বত্রিশেও অবিবাহিত আমি।অনেক কষ্টে আজ তোমার ঠিকানা পেয়ে তোমার পাড়ায় এসেছিলাম।
লোকমুখে শুনলাম ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময় কাউকে ভালো লেগেছিল।অনেক খুঁজেছিল তাকে।বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ ও দিচ্ছিল।
আমার মনে উঁকি দেয় আমি নয়ত।মনটা খুশিতে ভরে গেছিল।পর মুহূর্তে ভাবি আমার মনে কিসের খুশি??
সে তো আর নেই।
ওই দূর থেকে ভেসে আসছে “বল হরি হরিবোল”।আমি ছুটছিলাম যারা কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছিল।মনের অজান্তেই ওদের পিছু পিছু চলে যায় নিশান ঘাটে।ওকে মাটিতে শুয়ে রেখে ঘি মাখানো হচ্ছে।
আচ্ছা ওর কপালে ও মাথায় জ্বলজ্বল করছে সিঁদুর।কিন্তু ও তো আমার জন্য অপেক্ষা করেছিল তাহলে ওদের পাড়ার লোকজন ঐ কিসব আলোচনা করছিল।তারজন্য এতদূর শববাহিনীর সাথে পা মিলিয়ে চলে এসেছি।
তাহলে আমি হয়তো কল্পনায় ভেবে নিয়েছিলাম।
ঠিক আছে যখন এসেই গেছি।পুরো কাজটা দেখে ফিরব।যার জন্য বিকাল চারটে থেকে সন্ধ্যা ছটা অবধি অপেক্ষা করতাম।তারপর সে তো লেডিস কম্পার্টমেন্টে এক ঝলক হাসি দিয়ে উঠে যেত,আমি জেনারেলে উঠে যেতাম।ব্যারাকপুরে নেমে দুজনের পথ দুদিকে।ব্যাস পরদিনের অপেক্ষা।
একজন বলল আপনি কি বুলাদির বাপের বাড়ি না শ্বশুরবাড়ির লোক?
সেইদিন বুঝলাম ওর নাম বুলা।হয়ত বাড়ির নাম।
আমি বললাম ওর ছোটবেলার বন্ধু।
ওর বর মুখে আগুন দিল।বাচ্চার বয়স তিন বছর।বাচ্চাটা কি কাঁদছিল।আমি গিয়ে কান্না থামায়।আর আশ্চর্য ও আমার কোল থেকে নামছিল না।ততক্ষণে সবাই জেনে গেছে আমি বুলার ছোটবেলার বন্ধু।
বুলাকে চুল্লিতে ঢোকানো হচ্ছে।আমি বাচ্চাটাকে একটু আড়ালে নিয়ে যায়।জানতে পারি ওর নাম সূর্যতোরণ।মার নাম সূর্যতপা ও বাবার নাম রাকেশ ।ওরা মামাবাড়ি থাকে।মার অসুখ করেছিল তাই ভগবান আমার মাকে নিয়ে গেছে।এক ফাঁকে ছেলেটির বাবা বলে আপনার কাছে আছে আমি নিশ্চিন্তে আছি।
আমি বলি আরে রাকেশদা ঠিক আছে।
রাকেশ বলে তোমার নাম বুলার কাছে শুনিনি তো।
আমি অপূর্ব।
তারপর থেকে দোস্ত (বুলার ছেলে)রোজ ফোন করে।রাকেশদা ফোন করে বলে আমায় বুলার কাজে যেতে।শ্মশানযাত্রীদের যেতেই হয়।আমি অফিস কামাই করে বুলার পারলৌকিক কাজে যায়।আমি বাচ্চাটার সাথে ছোট বড় খেলনা গাড়ি নিয়ে খেলতে থাকি।আজ যে সাহস দেখাচ্ছি,এরকম যদি সাহস আগে দেখাতে পারতাম তাহলে দোস্ত আমার ছেলে হতো।
হঠাৎ খেলতে খেলতে একটি ডায়েরি দেয় বাচ্চাটি।তাতে মার জীবনী লেখা।আরে আমার কথাও লেখা।কলেজ থেকে ফেরার সময় দেখার কথা।আমি খুব বোকা।বুলাকে শুধু লুকিয়ে দেখতাম।আমি ভালোবাসতেই জানি না।আমি খুব ভীত যে ছিলাম।
তারপর কার পদশব্দ শুনে ডায়েরিটা রেখে দিই।এরপর টেপরেকর্ডে শোনায়
বুলার গান “কোন সে আলোর স্বপ্ন নিয়ে যেন আমায়….”কি অপূর্ব গলা।মনে হচ্ছিল সব গান চুপ করে শুনি।
আমিও বুলার পরিবারের একজন হয়ে গেছি।
রাকেশদা অফিস ট্যুরে বাইরে গেলে আমাদের বাড়িতে দোস্ত থাকে।আমার মা ও বাবা একজন খেলার সাথী পান।
আজ কয়েক মাস হলো আমার বিয়ে হয়েছে
হানিমুন থেকে ফিরে শুনি রাকেশদারা বেড়াতে গেছে রোটাং পাস।ওখান থেকে দোস্তর সঙ্গে অনেক কথা হয়।
হঠাৎ অফিসে কাজ করছি আমার মায়ের ফোন বৌমা পড়ে গেছে সিড়ি থেকে।বাচ্চা এসেছিল।সেটা নষ্ট হয়।ডাক্তার বলেন মনে হচ্ছে জরায়ু এমনভাবে আঘাত পেয়েছে মা হত পারবে না।বিয়ের সাতমাসের মাথায় এই সংবাদ।এই সব কারণেই সবার মন খারাপ।
বেশ কয়েকদিন দোস্তের সাথে কথা হয়নি।হঠাৎ একটা ফোন হিমাচল প্রদেশের পুলিশের!!
দোস্ত শুধু বেঁচে আছে,বাবা দাদু ,দিদা দুর্ঘটনায় শেষ।
হ্যাঁ দোস্ত এখন আমাদের ছেলে।ওর মা পড়াচ্ছে তার ছেলেকে।কালকে যে ক্লাস টেস্ট।