একুশে পা (Ekushey Paa) : 19
‘শুনুন— এইটা ঠিক আমি নই…’
তৃতীয় আর চতুর্থ গেমটার মাঝখানে মিঠুর দাদা সুহাসকে লক্ষ করেছিল ইমন। খেলার সময় সাধারণত তার কোনও দিকেই হুঁশ থাকে না। নেতাজি ইনডোরে হচ্ছে, ন্যাশন্যাল চ্যাম্পিয়নশিপ। সুহাসকে দেখবার পর তার শিরদাঁড়া দিয়ে কিরকম একটা গরম স্রোত নামতে লাগল। এরকম স্নায়ু-বিপর্যয় ইমনের কখনও হয় না। প্রথম দিকে টুর্নামেন্ট খেলতে নামলেই কান গরম, শিরদাঁড়ায় লাভাস্রোত। সে সময়গুলাতে ইমন নিজেকে বলত, ‘ছিঃ ইমন, তুমি না মানুষ! জানো কত মানুষ পৃথিবীর অজানা, রোমাঞ্চকর, বিপজ্জনক সব জায়গায় পৌঁছে গেছে। জানো না ক্যাপটেন স্কট, আমুন্ডসেনের কথা! শোনোনি এভারেস্ট জয়ের অবিশ্বাস্য ইতিহাস, কঙ্গো নদীর উৎসের খোঁজে লিভিংস্টোন, কিংবা ইউরি গ্যাগারিন, তেরিস কোভা, নীল আর্মস্ট্রং, এঁদের চেয়েও বাধা কী তোমার বেশি, বিপদ কি তোমার বেশি! কোন লজ্জায় তোমার কান লাল হয়, শিরদাঁড়া গরম হয়! দেখো ইমন দেখো, তুমি একজন প্রতিযোগী যে কোয়ার্টার ফাইন্যাল, সেমি ফাইন্যাল হয়ে ফাইন্যালে উঠে এসেছো, এখন তুমি আর ইমন নও, তুমি তোমার সমকক্ষ প্রতিযোগীদের সঙ্গে এক পর্যায়ে, এক উপত্যকায় অধিষ্ঠান করছ, যে সমস্ত দর্শক এসেছেন তাঁরা তোমার কুশলতা, তোমার স্টাইল দেখতে এসেছেন। তোমাকে নয়।’ এইরকম একটা সংলাপে নিজের সঙ্গে মগ্ন হয়ে সে আস্তে আস্তে নিজেকে সমস্ত স্নায়ু-বিপর্যয়ের ওপরে উঠিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে। সুহাসকে দেখে যখন তার আবার পিঠ গরম হতে শুরু করল, ইমন মনে মনে নিজেকে একটা কষে থাপ্পড় দিল। ওই ছেলেটি তোমার খেলা নষ্ট করে দেবে? এত ঠুনকো তোমার মনোযোগ ইমন? ছিঃ! মারো, তোমার অনবদ্য ফোরহ্যান্ডের মারগুলো দেখাও, স্ম্যাশ, স্কিল্! ইমন ডান পা এগিয়ে তার কঞ্চির মতো শরীরটাকে অপরূপ স্টাইলে নুইয়ে প্রায় মাটি থেকে বল তুলল। মায়া আশা করেনি সে এটা তুলতে পারবে। একেবারে অপ্রস্তুত। পয়েন্ট ইমনের। মায়ার সার্ভিস আবার কোণে পড়েছে বাঁ কোণে, ইমনের এবার সমস্ত শরীর লাট্টুর মতো ঘুরে যায়, ব্যাকহ্যান্ডে স্ম্যাশ। ইমনের পয়েন্ট। এবার ইমনের সার্ভিস মায়ার চেয়ে দুর্বল ছিল, ও সার্ভিসে এই এক বছরে প্রচুর প্র্যাকটিস করেছে। দেখা যাক। ইমনের পয়েন্ট। মায়া সারাক্ষণ টুক টুক করে লাফায়, শরীরে ছন্দ রাখে, বেগ রাখে। ইমন খেলার এই প্রাথমিক নিয়ম খুব একটা মানে না। তার শরীর একটা দীর্ঘায়িত স্থির-বিদ্যুৎ, সমস্ত শক্তি সংহত এবং প্রস্তুত রেখে স্থির-অস্থির। লিকলিকে হাত, নমনীয় কবজি। মায়া শুধু লাফাচ্ছেই, ঘাবড়ে গিয়ে তার মনোযোগ নষ্ট হয়ে গেছে। জিত ইমনের। ঘামে-ভেজা ইমন তার ঠাণ্ডা ভিজে শামলা হাত দিয়ে মায়ার হাত ধরেছে। মায়ার চোখ চকচক করছে। গত দুবারের চ্যাম্পিয়ন সে। হেরে গেল।
কোচ অমলদা বললেন, ‘আমি জানতাম ইমন এবার তোমার দিন।’
বেঙ্গলের খেলোয়াড়রা কুসুম ভার্গিজ, মিতা মির্ধা, অলককুসুম সান্যাল, আরও অনেকে খুব নাচানাচি করছে। ইমন তার পোশাক বদলে নিয়েছে। তাপ্পি দেওয়া ফেডেড জীনস, আলগা টপ। চুলগুলো একটু বেড়েছে। কাটেনি এখনও। একটা ব্যান্ড দিয়ে আটকানো ছিল এতক্ষণ। এখন খুলে ফেলেছে সেটা। খাওয়া-দাওয়া গল্প-স্বল্প শেষ হতে সাতটা। ইমন বেরিয়ে বড় বড় পায়ে হাঁটতে লাগল। গুমটি থেকে ট্রাম ধরাই তার পক্ষে সুবিধে। কার্জন পার্কের পেভমেন্টে উঠেছে, ‘ইমন! একটু দাঁড়াবে!’ সুহাস। ইমন দাঁড়িয়েছে। সুহাস বলল, ‘তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে পারলে ভাল হত।’
‘বলুন।’
‘এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি হয়?’
ইমন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সুহাস বলল, ‘আজকের সন্ধেটা আমাকে না হয় দিলে।’
‘হোস্টেলে ফিরতে হবে।’
‘যত তাড়াতাড়ি আমাদের কথা শেষ হবে, ততই তাড়াতাড়ি ফিরতে পারবে।’
‘কোথায় যাবেন?’
‘কোনও একটা রেস্তোরাঁয়। যেখানে বসে একটু কথা বলা যায়।’
‘আমি কিন্তু প্রচুর খেয়ে এসেছি।’
‘ঠিক আছে, আইসক্রিম-টিম যা-হোক নেওয়া যাবে।’
‘আইসক্রিম খাই না।’
‘অন্য কিছু। ওটা কোনও সমস্যা নয়। ইমন, আমি একজন ভদ্র যুবক।’
‘চলুন।’
সুহাস একটা ট্যাক্সি ডাকল। পার্ক স্ট্রিট। পার্ক হোটেল। ডিনারের জন্য টেবিল সাজানো হয়ে গেছে। কোণের একটা টেবিল কোনমতে পাওয়া গেল। সুহাস কিছু স্ন্যাক্স আর কফি অর্ডার দিতে সামান্য ভ্রূ কোঁচকালো বেয়ারার।
সুহাস বলল, ‘আমার ওপর, আমাদের ওপর এত রাগ করেছ কেন ইমন?’
‘রাগ? নাঃ!’
‘আমার অভিনন্দন নেবে না?’ সুহাস তার পকেট থেকে একটা ছোট বাক্স বার করল। তার ভেতরে একটা ঘড়ি, একেবারে হাল ফ্যাশনের, অতি সুন্দর অথচ বাহুল্যবর্জিত একটি কোয়ার্টজ ঘড়ি। সুহাস হাত বাড়িয়েছে, কিন্তু ইমন হাত বাড়াচ্ছে না।
সুহাস ভীষণ আহত হয়ে বলল, ‘আমার বা আমাদের বিরুদ্ধে তোমার কী কিছু বলার আছে ইমন?’
ইমন বলল, ‘আপনারা সেদিন যে প্রস্তাবটা নিয়ে গিয়েছিলেন সেটা তো আমরা গ্রহণ করিনি যে…’
সুহাসের মুখ-চোখ কালো হয়ে গেছে, রেস্তোরাঁর আধো অন্ধকারে সেটা ভালো বোঝা যাচ্ছে না। সে বলল, ‘এ উপহারটা তোমার খেলার একজন ভক্ত হিসেবে দেওয়া। প্রস্তাবটার সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু প্রস্তাবটা কেন ফেরাচ্ছ আমি জানতে পারব না? আমার অপরাধ কী?’
শেষের কথাগুলোয় ইমনের মুখটা অনেক অনেক দিন পর আবার উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
ইমন বলল, ‘আপনার কোনও অপরাধ নেই। আমি বিয়ে-টিয়ের কথা ভাবি না। হয়ত কোনদিনই বিয়ে করব না।’
‘কেন কেন?’ সুহাস ঝুঁকে পড়েছে।
‘আপনি বুদ্ধিমান ছেলে, সেদিন আমার পরিবারের অবস্থা দেখে এসেও কেন জিজ্ঞেস করছেন? আমি চাকরি করছি, অপেক্ষা করছি আরও বেশি টাকার চাকরির জন্যে, বোধ হয় পেয়ে যাব। তখন আমার কাজ হবে মাকে ভাইকে শহরে নিয়ে এসে বাস করা। ভাইয়ের ঠিকমতো চিকিৎসা, পড়াশোনার ব্যবস্থা করা। ভাইকে তো সারা জীবনই দেখতে হবে আমায়!’
‘এর সঙ্গে বিয়ের বিরোধ কোথায়, ইমন? তুমি চাকরি করবে, একশবার মা-ভাইয়ের জন্যে খরচ করবে। ওঁদের দেখাশোনার দায়িত্বও নেবে।’
‘তা হয় না, আমার থাকা দরকার, ওদের কাছে থাকা দরকার, বিয়ে করলে অসুবিধে হবে।’
‘কিন্তু আমি… আমি তো তোমাকে ভালবাসি ইমন!’
ইমন অনেকক্ষণ পরে বলল, ‘আপনি কোন্ ইমনকে ভালবাসেন?’
‘এই তো তুমি, তোমাকে, আমার সামনে যেভাবে বসে রয়েছ।’
‘শুনুন, এইটা ঠিক আমি নই।’ সে থেমে থেমে বলল। ‘আমার চুলগুলো এভাবে কাটা কেন জানেন? যে কোনও নাপিত, ইঁট-পেতে বসা নাপিত এই ছাঁটটা কেটে দিতে পারে বলে। ছোট্ট থেকে বাবা আমাকে ছেলের মতো মানুষ করেছেন। এই যে আজকের ফ্যাশনের জীন্স্ আমি পরি, সে ফ্যাশনের জন্যে নয়… ছোট থেকে ছেলেদের পোশাক পরা আমার অভ্যাস বলে, তাছাড়াও…’ ইমন একটু থামল, তারপর বলল, ‘তাছাড়াও এতে খরচা বাঁচে।’
‘একটা আইসক্রিম নাও না ইমন, প্লিজ…’
‘আইসক্রিম আমি খেতে পারি না সুহাসদা, ভাই ভীষণ ভালবাসে।’
সুহাস মাথা নিচু করল। একটু পরে বলল, ‘আমি তো তোমাকে বলেই দিলাম, মা-ভাইকে তুমি সারা জীবনই দেখবে। আচ্ছা ধরো, বিয়ের পর যদি আমি তোমাদের পরিবারকে নিয়েই থাকি!’
‘তা কি হয়? তা ছাড়া আপনাদের সঙ্গে আমাদের কোনও মিল নেই। আমার মা … আমার মা দেখলেন তো হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন, বাবা জীবিত থাকলে কাজ হয়ত করতেন না, কিন্তু বাবাও খুব সামান্য কাজ করতেন ওই হাসপাতালেই। এইসব দিয়ে একটা গন্ডি তৈরি হয়ে যায়।’ ইমন খুব ধীরে ধীরে ভাবতে ভাবতে বলছিল, ‘যায় না! এখন ধরুন আমি, খেলার ক্ষমতাটা আছে বলে আমি তো, এই গণ্ডিটার বাইরে আসতে পেরেছি, বাইরের জগৎটাকেও দেখি, কিন্তু সামাজিক ভাবে যখন মিশতে যাই, আমি কুঁকড়ে যাই। সত্যি বলছি আমি কুঁকড়ে যাই।’ তার খোলা হাত দুটো জড়ো করে, ইমন কুঁকড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করল, ‘ভাববেন না কোনও কমপ্লেক্স থেকে, একটু কমপ্লেক্স হয়ত আছেই, কিন্তু আমি দেখি এক সমাজের মধ্যে নানান সামাজিক গণ্ডি। শুধু হ্যাভস/ হ্যাভ-নটস্দের নয়। উচ্চশিক্ষিত, মধ্য শিক্ষিত, বড় চাকুরে, ছোট চাকুরে, সরকারি চাকুরে, কমার্শিয়াল ফার্মের চাকুরে, সব আলাদা আলাদা সামাজিক গণ্ডি। আমি আমার মাকে কোনরকম অসম্মানের মধ্যে ফেলতে চাই না। এমন কোনও পরিস্থিতি যাতে মা কুঁকড়ে যাবে, নিজেকে ছোট মনে করবে।’
‘কিন্তু ইমন, আমি তো ছোট ভাবছি না! আর তোমাকেও তোমার সমস্তটা নিয়েই আমি ভালবাসি। তোমার এই ইমেজটা অবশ্যই আমার কাছে খুব, খুব প্রিয়। কিন্তু এর বাইরে যে অন্য ইমন আছে এটা তো আমি বুঝিই।’
‘শুনুন,’ ইমন বলল, ‘বলা সহজ, কিন্তু ভেতরে ভেতরে না-ভাবা সহজ নয়। আমার মা তো কখনও মাসির মতো করে কথা বলতে পারবেন না। মায়ের চিন্তাভাবনা-ব্যবহার সবই খুব গণ্ডিবদ্ধ। প্রতিদিন এই তফাতগুলো চোখে ঠেকবে। এনি ওয়ে, আমি বিয়ের কথা ভাবি না।’ ইমন হঠাৎ যেন তার ভেতরটা অনেকটা দেখানো হয়ে গেছে মনে করে কপাট বন্ধ করে দিল।
সুহাস বলল, খুব কাতর গলায় বলল, ‘আমি আর দিন সাতেকের মধ্যে পুনে চলে যাচ্ছি। ইমন আমি তোমায় চিঠি লিখব। ধরে নাও আমি তোমার বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু। ইমন্ন্ন্। এই ঘড়িটা…’
ইমন দাঁড়িয়ে উঠেছে। সুহাস বলল, ‘সামান্য উপহার, সমঝদারের কাছ থেকে, তুমি আরও কত পাবে, সেগুলো নেবে, আমারটা শুধু আমি বলেই…’
ইমন হঠাৎ হাতটা বাড়িয়ে ঘড়িটা নিল, নিজের ঘড়িটা ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে রেখে সুহাসেরটা পরল। স্মিত মুখে বলল, ‘ঠিক আছে?’
দুজনে বেরিয়ে এলো। সুহাসের পৌঁছে দেবার প্রস্তাব মৃদু হেসে উড়িয়ে দিল ইমন। ‘আমাকে? আমাকে পৌঁছে দিতে লাগে?’ সে তাড়াতাড়ি জেব্রা-ক্রসিংয়ের দিকে পা বাড়াল। হঠাৎ দেখলে বোঝা যায় না সে ছেলে কি মেয়ে। এমন কি তার হাঁটার ভঙ্গির মধ্যেও একটা দুলকি চাল। সে যেন একটা কিশোর ঘোড়া। তারুণ্যের প্রান্তে এসে এবার গতি দ্রুততর করবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। অনেককে যেন তার অনেক অনেক কথা দেওয়া আছে। তাকে এখনও অনেক দূর যেতে হবে, অনেক অনেক দূর।
আপাতত খুব ক্লান্ত লাগছে। হোস্টেলে ফিরে সে দু-চার লাফে সিঁড়ি টপকে দোতলায় উঠে গেল। তার রুম মেট অজন্তা সরকার বেডটা খালি করে দিয়ে চলে গেছে। সে একা একা উপভোগ করছে এই রুম। হাত থেকে ঘড়িটা খোলবার সময়ে সে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে হাসল। মা যদি জানতে পারে এই ঘড়ি তার পাণিপ্রার্থী, সেই উচ্চশিক্ষিত, উচ্চবিত্ত মহিলার, সুদর্শন, স্বাস্থ্যবান, সুপাত্র যুবকের দেওয়া মা কেঁদেকেটে অনর্থ বাধাবে। ওরা তাদের বাড়ি যাবার পর থেকেই মা কারণে অকারণে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদে। শহরে থাকতে এসে, বড় খেলোয়াড় হয়ে, ইমন তো এমনিতেই অনেক দূর চলে গেছে বলে ভাবে মা। তারপর ওই সমস্ত মার ভাষায় ‘সমন্ধ’! ইমন তার কৃতিত্ব, তার সঞ্জীবনী দায়িত্বশীল উপস্থিতি, তার টাকা রোজগারের ক্ষমতা সমস্ত নিয়ে মা আর ভাইয়ের রুগ্ন অভাবী পৃথিবীটা থেকে হুশ করে একদম উঠে যাবে।
ইমন শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল, ‘এবার কী? এর পর? সেকি মাকে ওই গর্ত থেকে টেনে তুলতে পারবে কোনদিন? আর্থিক দিক থেকে হয়তো পারল। কিন্তু সারা জীবৎকাল, বিশেষত বাবার মৃত্যুর পর থেকে যে লড়াই দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অসম্মানের বিরুদ্ধে, ক্রমশ ক্রমশ বস্তিবাসীর জীবনের দিকে নেমে যাওয়ার বিরুদ্ধে এ সমস্ত তার ছাপ ফেলে গেছে মায়ের ওপর। মা কি নিজেকে কোনদিন রানাঘাট হাসপাতালের আনট্রেইন্ড আয়া ছাড়া আর কিছু, কিংবা আয়া হয়েও একজন সম্মানিত নাগরিক হিসেবে নিজেকে ভাবতে পারবে? সম্ভব, মাকে মুক্তি দেওয়া? মুক্তিটা একটা একদিনের ঘটনা তো নয়, একটা চালু পদ্ধতি। ইমন খেলতে খেলতে নানান মানুষের সংস্পর্শে এসে, কলকাতায় হোস্টেলে থাকার দরুন, ভাল কলেজে পড়াশুনোর সুযোগ পাওয়ার দরুন আস্তে আস্তে মুক্তি নামক বস্তুটার কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছে। তবুও তো তার লজ্জা পুরোপুরি যায়নি। সে নিজের সম্পর্কে নীরব থেকেছে বরাবর, বন্ধু করেনি কাউকেই, পরিচয় দিতে বাধ্য হলে বলেছে মা নার্স। এটাও তো সত্যকে লুকিয়ে যাওয়া লজ্জায়। এত সুযোগ পেয়েও ইমন যে মুক্তি পুরোপুরি পেল না, তার দুঃস্থ মা, অবিরাম ওই একই সঙ্গে বন্দী থেকে, কোনও সুযোগ না পেয়ে কী করে সামাজিক হীনম্মন্যতার এই গণ্ডি পেরোবে? সে নিজের জন্য প্রতিজ্ঞা করতে পারে, এমন কি ভাইটিকেও সে বন্দিত্ব থেকে খালাস করে আনবার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু মা? মা যে তার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় বদ্ধ, আপাদমস্তক জারিত, সেই অভিজ্ঞতার সঙ্গে তার বাবা জড়িত, মায়ের জীবনের দুই-তৃতীয়াংশ জড়িত, সে আপ্রাণ চেষ্টা করবে। কিন্তু মা কি পারবে?
আরও কত দূর যেতে হবে তাকে, কত্ত কত দূর! অনেক পাহাড় পার হয়েও সে যদি দেখে আরও পাহাড়, আরও পথ! সেসব পার হয়েও, যদি থাকে আরো আরো! এই সময়ে, ঘুমোবার ঠিক আগের মুহূর্তে ইমনের হঠাৎ ভগবানের কথা মনে পড়ল। এটা তার ছোটবেলার অভ্যাস। এখন মনে হল ভগবান? ভগবান কেন বলে সে? বাবার যখন করোনারি থ্রম্বোসিস হল, সে বলেছিল ভগবান! ভগবান! বাঁচাও! যখন টুর্নামেন্ট খেলতে যায়। বলে ভগবান, হে ভগবান! যেন… পরীক্ষার পড়া এবারে ভাল তৈরি ছিল না, সে মনে মনে ভগবানকে ডেকে পরীক্ষা দিতে গেছে। প্রশ্নপত্র পাবার আগেও ভগবান!! এ কিন্তু মায়ের কুলুঙ্গিতে লক্ষ্মী নয়, তাদের হোস্টেলে ক্রুসবিদ্ধ যিশু নয়, কি মিঠুদের বাড়িতে রামকৃষ্ণের ভাস্কর্য নয়। অন্য কিছু? কে এ? কিছু পাওয়ার জন্যে, বিপদের সময়ে একে ডাকা। সব সময়ে সে ডাক শোনা হয় তার প্রমাণ নেই। বাবা যেমন মারা গেল, আগের বারে ন্যাশন্যাল চ্যাম্পিয়নশিপটা যেমন সে জিততে পারেনি, এবারে পারল। তবু এখন নিশ্বাস যখন গাঢ় হয়ে আসছে, নিজের একটা ব্যবচ্ছেদ করবার পর, দারুণ কঠিন মনঃসংযোগ ও কুশলতার খেলায় জেতবার পর, নিজের ভেতরের কথাগুলো জীবনে সর্বপ্রথম দ্বিতীয় ব্যক্তির কাছে প্রকাশ করবার পর, এখন ঘুমের মুহূর্তে তার প্রতিটি নিশ্বাস ছন্দে ছন্দে কেন যে বলতে লাগল ভগবান, ভগবান। এটা একটা রহস্য, এটার কিনারা সে করতে পারবে না। কোন দূর অতীতের অভ্যাসের সঙ্গে এই সব আবছা ভাবে বুঝি জড়িত, এটা বুঝতে বুঝতেই ইমন ঘুমিয়ে পড়ল।