তিন
দক্ষিণের ঘরের মেঝেটা জায়গায় জায়গায় ফেটেফুটে গেলেও সাবেক কালের তৈরি। লালরঙের জেল্লায় চোখ ধাঁধিয়ে যায়। ঘেমে নেয়ে গেছি, তায় হোটেলের গুরুপাক ভোজন। চিত্র—বিচিত্র মাদুর বিছিয়ে চিৎপাত। বাইরে চোখ ঝলসানো রোদ। সবুজ সবুজ গাছ। নারকেল পাতার ঝিলিমিলি। কাকের খা—খা ডাক। মাথার ওপর সাবেক কালের হ্যান্ডপাখা চামচিকির মতো কিচিরমিচির করছে। অন্যদিন হলে নিমেষে ঘুমিয়ে পড়তুম, সেদিন ঘুম এল না।
মন! তোমার দিশা আজও পেলুম না। কী দেখলে তুমি কুকুরের মতো পটাপট ন্যাজ নাড়? সেই আদি অকৃত্রিম কামিনী—কাঞ্চন। এমন মধু আর কীসে আছে। এমন মৌতাত! ডানা তো ভ্রমরেরও আছে মাছিরও আছে। মাছি বিষ্ঠায় বসে, পচা ঘায়ে বসে। আর মৌমাছি! মৌমাছি বসে ফুলে। বেশির ভাগ মানুষেরই মন মাছির মতো। আমার মন হল সেই মাছি!
শুয়ে শুয়ে ভাবছি, রুমকি কেন হাসল। নীচের তলাটা অত নির্জন কেন? তাহলে কি রুমকি ছাড়া আজ আর কেউ নেই। ঘাগড়া পরা মেয়েটির কী চটক। সাধারণত দেখা যায় না অমন একটা মুখ। বেশ পোড় খাওয়া। দেহের বয়সের চেয়ে মুখের বয়স ও অভিজ্ঞতা অনেক বেশি। যে কারণে মুখটা ভীষণ আকর্ষণীয়। একবার আমার দিকে হেসে তাকিয়েছে, আমার মাথা ঘুরে গেছে। একটা পাগল ভেতরে হাহাকার করছে।
দিবানিদ্রা ছুটে গেল। মন কত বড়ো বদমাশ! আমাকে বোঝালে, দেখে আয়, লেটারবকসে কোনো চিঠি আছে কিনা! চিঠি আসার কোনো সম্ভাবনাই নেই। আমার মতো এক হতচ্ছাড়াকে কে চিঠি লিখবে! মন বললে, কেন রে, চাকরির দরখাস্ত ছেড়েছিস, একটা দুটো উত্তর তো আসতেও পারে। সেটা এখন দেখা খুব জরুরি।
বেশ কিছুক্ষণ লড়াই হল মনের সঙ্গে। মানুষের দুটো মন। এটা আমি বেশ বুঝতে পারি। খাঁচার ভেতর দুটো পাখি। একটা প্রবীণ, ধীর, শান্ত। সেই পাখি আদর্শ, সংস্কার এই সব দিয়ে তৈরি। অনেকটা পিতার মতো। বলে না কিছুই। তাকিয়ে থাকে, মুচকি মুচকি হাসে। আর একটা হল ছটফটে, চঞ্চল, লোভী। দেহ সেই মনটারই খিদমত খাটে। যা বলবে তাই করতে হবে, পরে পস্তাতে হবে।
‘বাঘা ভালকোর’ লড়াইয়ে শুদ্ধ মন, পবিত্র মন হেরে গেল। নীচে নামতেই হল। একপাশের সান—বাঁধানো উঠোনে রুমকি পেছন ফিরে বসে ঠুকঠুক করে কী ঠুকছে! আমাকে দেখতে পায়নি। এক মনে কাজ করছে। আমি একটু থমকে দাঁড়ালুম। দৃশ্যটা দেখার মতো। মেঝেতে গোল হয়ে ছড়িয়ে আছে লাল ঘাগরা। সুঠাম একটা শরীর। চওড়া পিঠ। ভারী খোঁপা। বেশিক্ষণ দাঁড়ানো ঠিক হবে না ভেবে সদরের দিকে এগিয়ে গেলুম। দরজার পাশে লেটারবকস। ফাঁকা। কোনো চিঠিপত্র নেই। কে একটা শুকনো পাতা, চৈত্রের ঝরাপাতা ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। প্রকৃতির চিঠি, যে চিঠি বলতে চায়—আমি ঝরে যাই, নতুন হব বলে, সবুজ হব বলে। একটা কবিকবি ভাব আমার মধ্যে আছেই আছে। সেটা আমি টের পাই, আর পাই বলেই এই সব মেয়েটেয়েদের দেখে মোহিত হওয়াটাকে আমি খুব খারাপ বলে মনে করি না। তাহলে কেন আমার এই দ্বিধা! আমি রুমকির সঙ্গে ভাব করবই করব। প্রেম জিনিসটা খারাপ নাকি! এই তো একটু আগেই রেডিয়োতে গান হচ্ছিল—শচীনদেব বর্মণ গাইছিলেন—প্রেম যমুনায় হয়তো বা কেউ ঢেউ দিল ঢেউ দিল রে। আকুল হিয়ার দুকূল বুঝি ভাঙল রে। আমার হিয়ার দুকূল ভেঙে দিয়েছে লাল ঘাগরা রুমকি। মানুষের এইরকম হয়। সব মানুষেরই হয়। মানুষকে ভগবান এই ভাবেই তৈরি করেছেন। হৃদয় একটা বহু তারবিশিষ্ট বাদ্যযন্ত্র। কোন সুরে কখন ঝংকার উঠবে মানুষ কি তা জানে!
সেই শুকনো পাতার প্রকৃতির বাণী হাতে নিয়ে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালুম। রুমকি একমনে ঠুকঠুক করছে। একটা কিছু বলতে চাইলুম, গলা দিয়ে স্বর বেরলো না। দুবারের চেষ্টায় যা বেরলো, সেটা একটা অদ্ভুত শব্দ। সেরকম শব্দ জন্তুজানোয়ারের গলা দিয়েই বেরোয়। রুমকি চমকে ফিরে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে আমি বোকার মতো বললুম, ‘চিঠি নেই এই পাতাটা ছিল।’
রুমকি বললে, ‘কোথায় ছিল?’
‘ওই যে লেটারবকসে। তুমি কী করছ?’
রুমকি একটা চটি তুলে দেখাল, ‘স্ট্র্যাপটা ছিঁড়ে গেছে তাই পেরেক ঠুকছি।’
‘হয়েছে?’
‘হচ্ছে না কিছুতেই। ভেতরদিকে তো! হাতুড়ি আটকে যাচ্ছে।’
‘কই দেখি! জীবনে এমন কাজ নেই যা আমি করিনি।’
‘ছিঃ, আমার জুতোয় আপনি হাত দেবেন?’
‘তাতে কী হয়েছে! হাত ধুয়ে ফেললেই হল।’
‘না, তা হয় না, আমি ঠিক পারব।’
‘সরো তো।’
তখন আমার এত প্রবল আবেগ, রুমকিকে এক ঠেলা মেরে সরিয়ে দিলুম। সে একপাশে কাত হয়ে পড়ে গেল। পড়ে যেতে যেতে বললে, ‘বাবা, আপনার শরীরে কী অসম্ভব জোর।’
জরির কাজ করা সুন্দর দু—পাটি চটি। মেয়েদের ব্যবহার করা কোনো জিনিসে এই প্রথম হাত দিচ্ছি। সারা শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। ছোট্ট হাতুড়ি। কয়েকটা কাঁটা পেরেক। খুবই কঠিন কাজ। স্ট্র্যাপটাকে চামড়ার ফাঁকে ঢুকিয়ে ভেতরদিক থেকে ঠুকতে হবে। এ যেন জীবনমরণ সমস্যা। একটা মেয়ের মন জয় করার সওয়াল। এই কাজেও ঠাকুরকে ডেকে বসলুম—দেখো ঠাকুর যেন পারি! মানুষ কী চিজ! পাপেও ভগবান, পুণ্যেও ভগবান। যে চোর, সে চুরি করার সময় ভগবানকে ডাকবে। দেখো ভগবান, যেন ধরা না পড়ি। বারাঙ্গনা দাঁড়িয়ে আছে, ডাকছে, ভগবান একজন মালদার বাবু জুটিয়ে দাও। এ যেন সেইরকম।
ঠাকুর বোধহয় আমার কথা শুনলেন। দুটো পেরেক কুটকুট করে লাগিয়ে দিলুম। স্ট্র্যাপটা টেনে দেখলুম, বেশ লেগেছে। রুমকিকে বললুম, ‘পরে দেখো, আঙুলে লাগছে কিনা!’
রুমকি বসে ছিল, উঠে দাঁড়াল। একটা পুরুষালি ভাব। তেমন লজ্জা বা ন্যাকামো নেই। আমার সামনেই ঘাগরাটা টেনে তুলে চটিতে পা গলাল। আমি লোভীর মতো তাকিয়ে আছি। বিশ—বাইশ বছরের একটা স্বাস্থ্যবান মেয়ের পা। ফর্সা ধবধবে। গোল ভরাট। মনে মনে ভগবানকেই বলছি—এ কী দেখালে ঈশ্বর! আবার বলছি, উঃ কী বরাত! এই হল বরাতের নমুনা। শৈশবে অনাথ, পরের আশ্রয়ে মানুষ। যতরকম নির্যাতন আছে সবই ভোগ করেছি। এখনও জানি না আমার ভবিষ্যৎ কী! এইটাই নাকি আমার বরাত! এক তরুণীর পদযুগলের কিয়দংশ দর্শনে সম্মোহিত!
রুমকি বাঁধানো উঠোনে একপাক ঘুরে এসে বললে, ‘ঠিক আছে।’
‘তোমাদের নীচটা আজ এমন নিস্তব্ধ লাগছে কেন? সবাই ঘুমোচ্ছেন বুঝি?’
‘বাড়িতে আজ কেউ নেই। আমি একা।’
বুকটা ধড়াস করে উঠল। সর্বনাশ। এইবার যদি কিছু হয়! ভেতরে চামচিকি লাট খাচ্ছে। হরেকরকমের ইচ্ছে ঘুরপাক খাচ্ছে। যে—সব ইচ্ছেকে লোকে বলে প্রেম। আমাকে ঘাবড়াতে দেখে রুমকি বললে, ‘কী হল, চুপ হয়ে গেলেন! চলুন আমাদের ঘরে একটা জিনিস খেতে দোবো।’
দোতলার মতো একতলাতেও তিনখানা ঘর। একটা ঘর বেশ বড়ো। সেই ঘরে মস্ত এক খাট। পরিপাটি বিছানা। জানলার কাছে টেবিল। তিনপাশে তিনটে চেয়ার। আর একপাশে দেয়াল ঘেঁষে একটা বেঞ্চি। রামের ছবি, মহাবীরের ছবি। মহাত্মা গান্ধীর ছবি। শ্রীকৃষ্ণের ছবি। চারপাশ পরিষ্কার তকতকে। বেশ সুন্দর একটা গন্ধ।
‘এই ঘরে মা আর আমি থাকি।’
‘তুমি কী পড়ছ?’
‘বি. এ।’
‘পাশের ঘরে?’
‘বাবা থাকেন। ব্যবসার সব কাগজপত্র থাকে।’
‘আর একটা ঘর?’
‘খাওয়ার ঘর। চলুন আপনাকে একটা জিনিস খাওয়াবো।’
মাঝারি মাপের ঘর, ছবির মতো সাজানো, পরিষ্কার। দেয়ালে অনেক তাক। পরপর সাজানো নানা মাপের বয়াম। কৌটো। ‘তোমার মা খুব পরিষ্কার।’
‘মা পরিষ্কার ছিলেন, তবে এখন আর পারেন না, কোমরে হাঁটুতে বাত। এখন আমিই সব করি।’
কথা বলতে বলতে রুমকি একটা টুলে উঠে পড়ল। আঙুলের ওপর ভর দিয়ে শরীরটাকে আরও উঁচু করে একেবারে ওপরের তাক থেকে দু—হাতে ধরে একটা বড়ো জার নামাচ্ছে। ভয় হল, যদি টাল খেয়ে পড়ে যায়! এগিয়ে গিয়ে দু—হাতে তার শরীরের নীচের দিকটা জড়িয়ে ধরলুম। আমার কোনো বদমতলব ছিল না। শুধু ভয় আর আতঙ্ক ছিল, যেন পড়ে না যায়। জড়িয়ে ধরার পরক্ষণেই মনে হল, এইবার এই চটিজোড়া আমার মুখে পড়বে। মনে হলেও আমি তখন অসহায়। অদ্ভুত একটা আবেশ। আমার শরীরে নিটোল একটা স্পর্শ। লাল ঘাগরার অন্তরালে এ কোন জিনিস। সমস্ত ভয়, জড়তা, সংস্কার, আদর্শ ভেসে গেল। আমার প্রবৃত্তি তখন প্রবল। আমি আদর করতে শুরু করেছি। আমি উন্মাদের মতো হয়ে গেছি।
রুমকির হাত থেকে জারটা ভীষণ শব্দ করে মেঝেতে পড়ে গেল। চারপাশে ছিটকে পড়ল কোষাকোষা আমের আচার। কাচের একটা টুকরো ছিটকে এসে আমার পায়ে ঢুকে গেল। ভীষণ শব্দে রুমকি ব্যালেন্স হারাচ্ছিল। আমি তাকে কোলে করে টুল থেকে নামিয়ে যেখানে কাচ নেই সেই জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলুম। আমার পায়ের তলায় আর একটুকরো কাচ ফুটে গেল।