ছাব্বিশ
শানু—আমি বলি গ্রেট শানু। মদের ঘোরে আমাকে একদিন বললে, ‘দোস্ত বড়োলোক হতে চাও?
বললুম, ‘ইচ্ছে করে। অনেক বড়োলোক অনেক ভাবে আমাকে হেনস্থা করেছে। আধপেটা, উপোস আমার কাছে কিছুই না। গা—সহা ব্যাপার। তবে হ্যাঁ, সৎপথে বড়োলোক হতে চাই।’
—হবে না ইয়ার, সোনার পাথরবাটি হয় না। সৎপথে ডাল, রোটি খাও, হরিকে গুণ গাও। বড়োলোক হতে হলে ছোটোলোক হতে হবে। দুনম্বর না করলে এক নম্বর হওয়া যায় না। আন্ডারস্ট্যান্ড?
—তা হলে থাক।
—আমিও সেই কথাই বলি। আমার কত আছে জানো?
—না, আমি কী করে জানব?
—দেখে কী মনে হয়?
—কিস্যু নেই।
—ভুল, ভুল, তোমার ধারণা ভুল। বাইরেটা আমার লোফারের মতো, ভেতরে আমি সম্রাট। সামনের ওই মার্কেট কমপ্লেক্সটা আমার। অবশ্যই বেনামে। আমার তিনটে মদের দোকান। দুটো লাক্সারি বাস দূরপাল্লার ভাড়া খাটে। দুবাইতে আমার ঘাঁটি আছে। বুঝে নাও কত টাকা। কিন্তু চালচলনে অহংকারী বড়োলোক হতে পারিনি। ঘেন্না করে ঘেন্না। অন্য লোককে, আমার চামচাদের স্কচ খাওয়াই, নিজে খাই বাংলা। খাটিয়ায় শুই, খাটে শুলে ঘুম আসে না। পান্তা—পেঁয়াজ আমার কাছে বিরিয়ানির চেয়ে মনপসন্দ। শোনো, আমার একটা প্ল্যান আছে, তোমাদের এই ছাপাই কাপড়ের কারখানাটাকে আমি ইন্টারন্যাশানাল করব।
—মানে?
—মানে গাঁইয়া কারবার চলবে না, একেবারে মডার্ন। কম্পিউটার ডিজাইন। অফসেট প্রিন্টিং, টাই অ্যান্ড ডাই। বেশির ভাগটাই এক্সপোর্ট।
—সে সব কীভাবে হবে?
—সে ভাবনা আমার। টাকায় হবে। এক্সপার্ট আসবে। কাপড় আসবে সরাসরি মিল থেকে। রেডিমেড গার্মেন্টসও তৈরি হবে।
—তারপর আমাদের কী থাকবে?
—আমাদের মানে?
—মানে, আমার আর রুমকির?
—এই আমাদের মধ্যে আমি নেই, তাই না?
—তুমিই তো সব করছ, তোমার মধ্যে আমরা থাকব তো! বড়োরা ছোটোকে গিলে হজম করে ফেলে।
—কথাটা তুমি কিছু খারাপ বলোনি। ইচ্ছে করলে আমি তা করতে পারি। আবার এও বলতে পারি, তোমাদের পাশে আমি আমারটা খুলে তোমাদেরটা বারোটা বাজিয়ে দিতে পারি, তবে তা করব না। কেন করব না বলো তো?
—তুমি মহৎ, তুমি আমাদের ভালোবাস।
—তোমার মাথা! শোনো, সত্যি কথাটা পরিষ্কার করে বলা ভালো, তোমাকে নয়—ভালোবাসি রুমকিকে। প্রথমে ভালবাসতুম না।
শানুর কথা ক্রমশ জড়িয়ে আসছে। সোজা হয়ে বসতে পারছে না, এলিয়ে পড়ছে। চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে এসেছে। ফর্সা রং, মুখটা টকটকে লাল। ঠোঁটে সিগারেট। লাইটার দিয়ে ধরাবার চেষ্টা করছে, হাত কাঁপছে। শেষে সিগারেটটা দূর করে ছুঁড়ে ফেলে দিল। বাতাসে শীতের কামড়। আরও একটু আধশোয়া হয়ে শানু বললে, ‘প্রথমে আমি ভালোবাসিনি। ভালোবাসা কাকে বলে আমার জানা ছিল না। আমাকে কেউ ভালোবাসত না, আমিও কারওকে ভালোবাসতুম না। শয়তান ভালোবাসে না, প্রেম ভগবানের, প্রেম শ্রীকৃষ্ণের। তা হলে?’
আমিও বললুম, ‘তা হলে?’
—তা হলে কী, জবাব দাও!
—আমি কী বলব শানু, এটা তো তোমার ব্যাপার।
—না, এটা সকলের ব্যাপার। সমাজের সমস্যা। প্রেম নয়, দেহ। রুমকিকে আমি চাই, কয়েক রাত্তিরের জন্যে। তারপর গলা টিপে মেরে খালের জলে।
—সে কী, এই যে বললে, তুমি ভালো হয়ে গেছ?
—আরে, এটা দেখি রামছাগল! তিন বছর আগে আমি এই ছিলুম। আর আজ? আজ কী?
—আজ কী?
—আরে, এটা একটা আস্ত গাড়োল। প্রশ্ন করলে প্রশ্নটাই ফিরিয়ে দেয়। এখন আমি প্রেমিক। আমি রুমকিকে ভালোবাসি। তুমি বিয়ে করলেও রুমকি আমার বউ। সে আমার কাছে থাকে, আমার হৃদয়ের বুকপকেটে। পায়ে কী আছে?
—পায়ে কী আছে মানে?
—পায়ে কী পরে আছে?
—চটি।
—খুলে আমার দু—গালে মারো পটাপট।
—কেন?
—পরস্ত্রীকে ভালোবাসার অপরাধে। আর নিঃস্বার্থ নয়, স্বার্থ। ভালোবাসি বলেই আমার সব কিছু দিয়ে যাব। আর একটা অনুরোধ, মরার সময় রুমকি যেন আমার কপালে তার ঠান্ডা হাতটা রাখে, আমি ‘আ’ বলে চলে যাব।
—তোমার মৃত্যু! কে যায় আগে, কে যায় পরে।
—বড়ো জোর আর একটা মাস। লিভারে ক্যানসার।
—ক্যানসার! যার লিভারে ক্যানসার সে বোতল বোতল মদ খাচ্ছে?
—অ্যায় চোপ। মদের মহিমা তুমি কী জানো ছোকরা? যে মরবে তার আবার অত বাছবিচার কীসের? আরও, আরও খাবো, পারলে কালই মরব। কোল পেতে আছেন আমার মা। কোন মা? গর্ভধারিণী। আরে না, জগজ্জননী। তোমার বিশ্বজোড়া কোল পাতা মা, আমি বসে আছি সেই কোলে।
শানুর গানের গলা যে এত ভালো জানা ছিল না। একটা লাইনই গাইছে বারে বারে, ‘তোমার বিশ্বজোড়া কোল পাতা মা, আমি বসে আছি সেই কোলে।’
রাত নামছে। অমাবস্যার অন্ধকার। আকাশে কে ছড়িয়ে দিয়েছে মুঠো মুঠো তারা। রুমকি রান্নায় ব্যস্ত। এপাশ ওপাশ ছোটাছুটি করছে। যখন সে আমার বউ হয়নি তখন আমার দৃষ্টি ছিল একরকম। এখন অন্যরকম। তখন ছিল আকর্ষণ। একটা দেহ। আমার কামনা বাসনায় সিক্ত। এখন সমর্পণ। নির্ভরতা। আত্মার আত্মীয়। অংশে অংশ মিলে বিপুল এক পূর্ণতা। ছিলাম শূন্য, হয়েছি পূর্ণ। সে তো এখন! আগে? আগে আমার সঙ্গে শানুর তো কোনো তফাত ছিল না। শানু প্রকাশ করে, আমি করি না। আমি সাধু নই, শয়তান। শানুই সাধু। কেন? সে মনমুখ এক করতে পেরেছে।
পৃথিবীতে এই পুরুষ জাতটাই মহা সর্বনাশের। মেয়েদের উচিত নয় এদের বিশ্বাস করা। মেয়েদের টেনে পাঁকে নামায় পুরুষরাই। প্রেম করে বিয়ে করে না। করলেও অত্যাচার করে। মেরেও ফেলতে পারে।
কিছু একটা চাপিয়েছে, সময় লাগবে হতে। সেই ফাঁকে রুমকি এসেছে।
সবাই বলছে, রুমকি সন্তানসম্ভবা। চেহারায় তাই সুন্দর একটা ঢল নেমেছে। বর্ষার শেষে টলটলে দিঘির মতো। আমরা দুজনে এই নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছি না। হতেই পারে। হওয়াটাই স্বাভাবিক।
রুমকি আমার একেবারে পাশটিতে এসে বসল। এই সময়টায় মেয়েদের খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। সারারাত আমার বুকের কাছে কেমন শুয়ে থাকে নিশ্চিন্ত আরামে। ব্রহ্মচারী হলে ভগবানকে পাওয়া যায় চটপট, আর গৃহী হলে পাওয়া যায় প্রেম। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে আছে প্রার্থনা, ভার্যাং মনোরমাং দেহি মনোবৃত্ত্যনুসারিণীম। হে দেবি। মনোবৃত্তির অনুসারিণী মনোরমা ভার্যা দাও।
রুমকি বললে, ‘শীতটা এখনও ঠিক তেমন পড়ছে না।’
—ওই দিনচারেক। মানুষের গরমে শীত তেমন পড়ে না আর।
—শোনো, একটা কথা কদিন ধরে ভাবছি।
—কী কথা?
—একই বাড়িতে বাবা—মায়ের সঙ্গে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না।
—অনেক সাহায্য, অনেক উপদেশ তো পাওয়া যাচ্ছে।
—সে সব এমন কিছু নয়। মাঝে মাঝে উপদেশের ঠেলায় জীবন বেরিয়ে যায়। আমি বলি কী, আমরা অন্য কোথাও চলে যাই।
—নিজেদের বাড়ি ছেড়ে যাবে কোথায়?
—শানু বলছিল, বদলাবদলি।
—বদলাবদলি মানে?
—একটু ভেতরদিকে একটা বাগানবাড়ি আছে। সেইটার সঙ্গে এটাকে বদলে নেওয়া যায়। ওরা এখানে একটা মার্কেট করবে।
—শানু কীভাবে ঢুকেছে দেখছ? এতকাল তোমার দিকে নজর ছিল, এইবার ব্যাবসা আর বাড়ি। তিনটেই ছিনিয়ে নিতে চাইছে। বুঝেছি, পথের মানুষকে আবার পথেই নামতে হবে। আমার শ্মশানই ভালো। যাই বলুক, শানু তোমাকে ছাড়বে না। টাকার কুমির, দলবল আছে। ওর কাছে আমি ছারপোকা। টিপে মেরে ফেলবে। খুনও হয়ে যেতে পারি। তুমি শানুকেই কেন বিয়ে করলে না! আমি তো একটা অপদার্থ। বসে বসে কেবল ভাবি। আমি বাক্যবীর, শানু কর্মবীর। শোনো, তোমাদের চক্রান্তটা ধরে ফেলেছি। তুমি আর শানু যত চেষ্টাই করো এই বাড়ি থেকে আমাকে হটাতে পারবে না। এই বাড়ি আমার কাছে তীর্থ। আচ্ছা, তোমার পেটে কার বাচ্চা? আমার না শানুর?
রুমকির পাশ থেকে এক ঝটকায় নিজেকে তুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালুম। রাত হয়েছে। লোক চলাচল কমে এসেছে। ভেতরটা ঈর্ষায় পুড়ে যাচ্ছে। খাটের ওপর রুমকি বসে আছে স্থির হয়ে। চোখ দুটো পাথরের মতো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কাছে যাই, ক্ষমা চাই। এই আমার প্রথম আঘাত। এক আঘাতেই সব চুরমার। আমার নোংরা মন আমি দেখিয়ে ফেলেছি। একবার উলঙ্গ হলে আর ঢাকাঢুকির কী অর্থ?
তবু ঘরে ফিরে গেলুম। রুমকির কাঁধে হাত রেখে ডাকলুম, ‘রুমকি!’ হাতটা ধীরে নামিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটা ঘোরে রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল। সমস্ত বাড়ি নিস্তব্ধ। পাড়া নিস্তব্ধ। বিরাট একটা ঝড় আসার আগে যেমন হয়। ঘরের একপাশে পাট পাট করে সাজিয়ে রাখা সদ্য ছাপা শাড়ি। রঙের গন্ধ।
আবার আমি একা! এখন আমি কী করব?
হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল ছাঁত করে। একটা পোড়া—পোড়া গন্ধ আসছে নাকে। পাশটা খালি, রুমকি নেই—উঠে গেছে। রাত এখন কটা? ভোর হয়ে গেল কি? বেরিয়ে এলুম মশারির ভেতর থেকে। বেশ একটা উত্তাপের আঁচ গায়ে লাগছে। যজ্ঞবাড়ির ভিয়েন বসল নাকি?
—রুমকি।
সাড়া নেই। বাথরুমের দরজা বন্ধ। ভেতরে আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। সর্বনাশ।
—রুমকি?
সাড়া নেই, আগুনের সাঁই সাঁই শব্দ। দরজাটা ঝলসে কাঠকয়লার মতো হয়ে যাচ্ছে। চুলের মতো সরু আগুনের রেখা হিল হিল করে উঠছে এখানে ওখানে।
—রুমকি?
দরজাটায় ধাক্কা মারতেই সপাটে খুলে পড়ে গেল। আগুনের জিভ বেরিয়ে এল লকলক করে। রুমকি পুড়ছে। ঝলসে কালো হয়ে গেছে। বেঁকে গেছে ধনুকের মতো।
ঝাঁপাতে গিয়েও ঝাঁপাতে পারলুম না। আগুনের ভয়। আবিষ্কার করলুম, প্রেমের চেয়ে মানুষের আত্মরক্ষার তাগিদ প্রবল। বাঁচার আকাঙ্ক্ষায় আমি সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিক থেকে পিছিয়ে আসছি। বাথরুমের ভেতরটা পুড়ে ছারখার। গনগনে আগুন।
আমার রুমকি পুড়ে কাঠকয়লা। প্রেমের চেয়ে ভয় বড়ো। রান্নাঘরে আধবালতি মাত্র জল। কলে এখন জল নেই। আসবে সেই ভোরে। এ আগুনের আমি কিছু করতে পারব না। রুমকি তো মরেই গেল, আমি বরং স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকি।
ওদিকে সে জ্বলছে, আমার প্রেম। আর রাতশেষের ফিকে অন্ধকারে রাস্তায় ছুটছে ভীরু পলাতক।
—তুই যাবি কোথায়?
—কেন, শানুর কাছে। আমার চেয়ে সাহসী। দশ—বিশটা মানুষ খতম করেছে।
—সে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী।
—এখন আর কোনো দ্বন্দ্ব নেই। সে চলে গেছে।
—শানুর বাড়ির সামনে ছোটোখাটো একটা জটলা। ভোরের দিকে আলোয় একদল কালো কালো মূর্তি।
—শানু কোথায়—? শানু?
—রাত দুটো চল্লিশ মিনিটে শানু মারা গেছে।
—শানুও মারা গেল। কপালে ঠান্ডা হাত রেখেছিল?
—কে রেখেছিল?
—আমার বউ রুমকি।
—এ পাগলটা কোত্থেকে এল?
—আচ্ছা, ওরা কি দুজনে একসঙ্গেই গেল?
—আরে এই, এটা পাগলামি করার জায়গা নয়।
—কে, কে? মেরে তাড়া না!
—আরে এটা সেই ভেণ্ডিটা।
কে একজন ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। সবাই খাট, ফুল, মিছিলের কথা বলছে, দোকানপাট বন্ধের কথা বলছে। রুমকি কি জানত শানু চলে যাচ্ছে? শানু কি জানত রুমকি চলে যাচ্ছে?
—আর দাঁড়িয়ে আছ কেন? এবার তোমাকে কে বাঁচাবে? থানা, পুলিশ, পোস্টমর্টেম? কত টাকা আছে? খাওয়াতে হবে! ওই বাড়িতে আর থাকতে পারবে? সর্বত্র তার স্মৃতি ছড়ালে। ওই পোড়া দেহটাকে জড়িয়ে ধরতে পারবে—পারবে ধরতে? বেঁচে থাকার অনেক দায়। দেহযন্ত্রে বন্ধ খাঁচায়, পঞ্চভূতে তোমায় নাচায়। সবাই তো চলে গেল, তুমি কেন পড়ে আছ? তুমিও যাও। চলে যাও—যা পাওয়া গেল সে তো দেখলে। এক ছটাক সুখ তো তিন ছটাক দুঃখ। পালাও। জীবন মানেই যন্ত্রণা, তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া। মৃত্যুই হল শীতল শান্তি। কে বলেছে আগুন দগ্ধ করে? দহনেই মুক্তি, দহনেই শান্তি। নিজেকে আহুতি দাও। যেতেই যখন হবে এখুনি যাও। ওদের একা ছেড়ো না, তুমিও সঙ্গে যাও।