Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » একটু উষ্ণতার জন্য || Buddhadeb Guha » Page 9

একটু উষ্ণতার জন্য || Buddhadeb Guha

২১-২২. ভোরে ঘুম ভেঙে গেল

খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেল।

ছুটি তখনো অঘোরে ঘুমোচ্ছে।

আমি হাত মুখ ধোবার পর বাইরে এসে রোদে পায়চারি করছি, এমন সময় দেখি সেই ভোরে লাবুর মা গেট খুলে শিশির মাড়িয়ে খালি পায়ে বাড়ির দিকে আসছেন।

খালি পা, পরনে একটা দেঁহাতী তাঁতের শাড়ি; গায়ে সেই র‍্যাপার।

এখানে থাকতে থাকতে এবং নানারকম লোক ও সমস্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে ওঁর বোধহয় শীত ও গ্রীষ্মের বোধ ভোঁতা হয়ে গেছে। যেমন ভোঁতা হয়ে গেছে অন্য অনেক বোধ।

মাসীমা কাছে আসতেই ওকে শুধালাম, কি ব্যাপার মাসীমা? এই ভোরে?

দেখলাম মাসীমার দুচোখে জল টলটল করছে।

আমি রোদে চেয়ার দিলাম বসতে। উনি বসে পড়ে, আমার দিকে চেয়ে। রইলেন–প্রথমে কোনো কথা বললেন না।

তারপর হঠাৎ বললেন, শেষে তুমি আমার এই উপকার করলে?

আমি অবাক হয়ে গেলাম। বললাম, কি উপকার?

আমার ছেলেটাকে তুমিই ঐ বেদেগুলোর হাতে তুলে দিলে? আমি শুনলাম তুমি নাকি ওদের আস্তানায় রোজ যেতে; যেদিন লাবু পালিয়ে গেল, সেদিনও গেছিলে।

আমি বললাম, হ্যাঁ গেছিলাম, শুধু সেদিনই গেছিলাম, আগে কখনও যাইনি। কিন্তু আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। আপনি যা ভাবছেন, তা ঠিক নয়।

কেন জানি না, আমার বিস্তারিত সাফাই গাইতে ইচ্ছা করল না। মনে হল তার কোন দরকার নেই। আর তাছাড়া, যদি উনি অন্যায় করে কিছু ভাবেন তাহলে বলার কি থাকতে পারে?

এমন সময় ছুটি মুখ ধুয়ে বাইরে এল নাইটির উপর শাল জড়িয়ে।

আমি আলাপ করিয়ে দিলাম, বললাম, লাবুর মা, আমাদের মাসীমা।

লাবুর মা অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ছুটির দিকে।

ছুটি ওঁকে নমস্কার করল, হাত তুলে।

উনি এমন ভাবে ছুটির দিকে তাকিয়ে রইলেন যে আমার লজ্জা করতে লাগল। উনি কোনো কথা বললেন না ছুটির সঙ্গে। চোখ দিয়ে গিলতে লাগলেন ছুটিকে।

ছুটি লজ্জা পেল। বলল, আপনি বসুন, আমি চা নিয়ে আসি।

এতেও লাবুর মা কিছু বললেন না।

ছুটি চলে যেতেই আমার দিকে ফিরে বসে বললেন, বৌমা কবে এল বাবা? বাঃ বেশ শ্ৰী আছে ত আমার বৌমার। মুখে একটা আলগা সৌন্দর্য আছে। কিন্তু বাবা, সিঁদুর লাগায় না কেন বৌমা?

বললাম, উনি আপনার বৌমা নন।

মাসীমা নড়ে-চড়ে বসলেন, ওঁর চোখে-মুখে দারুণ একটা উৎসাহ উদ্দীপনা ফুটে উঠল।

মনে হল লাবু-হারানোর শোক উনি বেমালুম ভুলে গেছেন।

উনি বললেন, বৌমা নয় ত কে বাবা?

উনি আমার একজন বান্ধবী। মানে আমার একজন পাঠিকা।

পাঠিকা মানে?

মানে আমি যে-সব বই লিখি, সে সব বই উনি পড়তে ভালোবাসেন।

তুমি আবার বই লেখ নাকি বাবা? কিসের বই?

আমি বললাম, এমনিই বই; গল্প-টল্প। উপন্যাস।

ও-ও-ও। মাসীমা বললেন। কই? আমাকে কেউ বলেনি ত? তা কি করে লেখ? বানিয়ে বানিয়ে? না সত্যি ঘটনা? না কি কিছু সত্যি, কিছু বানিয়ে? তোমার এমন কজন পাঠিকা আছে বাবা?

আমি বুঝলাম, লাবুর মা গত অনেক বছর যেভাবে দিন কাটিয়েছেন তাতে বেঁচে থাকা ছাড়া, বেঁচে থাকার চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো কিছু জানা বা জানার অবকাশ তাঁর হয়নি। এটাই স্বাভাবিক। উনি যে এখন বই পড়বে–তা আমার বই কেন? অন্য কারো বইই পড়বেন তা আমি আশা করিনি। অথচ যখন ওর স্বামী বেঁচে ছিলেন উনি নিশ্চয়ই অন্য দশজন মহিলার মতই পড়াশুনো করতেন-দুপুরে ঘুমুবার আগে ত বটেই। নভেল, সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন, সিনেমাপত্রিকা। উনি নিজেও তখন একজন পাঠিকা ছিলেন। আমার নয়। কারণ তখন আমি হয়ত লেখা আরম্ভই করিনি।

আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।

মাসীমা বললেন, তা মেয়েটি কি আইবুড়ো? বিয়ে-থা হয়নি?

আমি বললাম, না। বিয়ে হয়নি।

উনি অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

বললেন, তোমাকে ত বাবা ভালো ছেলে বলেই জানতাম। তোমার যে স্বভাব-চরিত্রের দোষ আছে কখনও কারো কাছে শুনিনি ত। যে-মেয়ে, যে-কুমারী সোমত্থ মেয়ে অনাত্মীয় পুরুষের বাড়ি এই জঙ্গলে একা-একা নির্ভাবনায় রাত কাটায়, সে মেয়েও কম নয়। তোমাদের দুজনের মধ্যে কার বেশি দোষ তা বুঝতে পারছি না বাবা। তবে ব্যাপারটা মোটেই হেলাফেলার নয়।

আমি বললাম, মোটেই নয়। তবে দোষটা আমার। ওর নয়। কাজেই মাসীমা, আপনি ফিরে গিয়েই যা সকলের সঙ্গে আলোচনা করবেন তাতে দোষটা আমার ঘাড়েই দেবেন। ওর ঘাড়ে নয়।

লাবুর মা বললেন, পীরিত ত খুব দেখছি। তা বৌমা কি এসব জানে?

আমি বললাম, মাসীমা, এ সব কথা এখন থাক। লাবুর কথা বলুন।

ইতিমধ্যে ছুটি লালির হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে টোস্ট করিয়ে, সাতসকালে ফল কাটিয়ে নিয়ে এল। দেখলাম, ছুটি নাইটি ছেড়ে শাড়ি পরে এসেছে।

ছুটি সকালের ফুলের মত নিষ্পাপ হাসি হেসে বলল, মাসীমা, খান।

বলে, টেবলে ডিশগুলো নামিয়ে রাখতে লাগল। জিজ্ঞেস করল, মাসীমা, ক চামচ চিনি দেব আপনাকে?

মাসীমা অনেকক্ষণ অপলকে চেয়ে রইলেন ছুটির দিকে।

ওর মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা অবধি আঁতিপাঁতি করে দুশ্চরিত্রার লক্ষণ খুঁজতে লাগলেন।

ওঁর চোখে যেন এক্স-রের মেসিন লাগানো আছে। এ কথা আগে একবারও মনে হয় নি।

কিন্তু ওর মুখ দেখে মনে হল উনি হতাশ হলেন।

ছুটি তাকিয়ে ছিল ওঁর মুখের দিকে চিনির পাত্রে চামচ ডুবিয়ে।

লাবুর মা বললেন, আমি চা খেয়ে এসেছি মা। আমি কিছু খাব না।

ছুটি অবাক হয়ে ওঁর মুখের দিকে তাকাল, তারপর চকিতে একবার আমার মুখে তাকিয়ে আমার ও ওর কাপে চিনি ঢেলে তাড়াতাড়ি চা বানাতে লাগল।

ছুটি মুখ নামিয়ে ছিল। দেখলাম ও নীচের ঠোঁট কামড়ে আছে।

কথা ঘুরোবার জন্যে আমি বললাম, মাসীমা, লাবুর জন্যে চিন্তা করবেন না। ওর বেড়ানোর শখ মিটে গেলে ও আপনিই ফিরে আসবে। ওকে ত বেদেরা ধরে নিয়ে যায়নি। ও ত নিজের ইচ্ছাতেই গেছে। ছোটবেলা থেকে নিজের ইচ্ছা বা খুশীমত ও ত বেশি কিছু করতে পারেনি। এই একটা জিনিস না হয় করলই।

তুমি কি ধরনের লোক সে সম্বন্ধে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিলো না সুকুমার। এখন আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে তোমার প্ররোচনাতেই লাবু অসুস্থ শরীরে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

ছুটি হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল, সে প্ররোচনা দিয়ে ওঁর কি লাভ হত?

আমি ছুটির দিকে মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম, মাসীমা না-জেনে সাপের মাথায় পা ফেলেছেন– কামড় তাঁকে খেতেই হবে। এ সাপ আমার মত নির্জীব জল-চেঁড়া সাপ নয়, এ বিষ-কেউটে।

মাসীমা বললেন, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি না মা, তোমার ফোড়ন কাটার দরকার কি?

দেখলাম, আবহাওয়াটা সম্পূর্ণ আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাই হঠাৎ বললাম, মাসীমা, ছুটি এক্ষুনি রাঁচী যাবে–ওর তৈরী হতে হবে এক্ষুনি আমাকেও যেতে হবে ওকে তুলে দিতে আমরা তাই উঠব।

ট্যাক্সিতে যাবে বুঝি? মাসীমা তবুও অম্লানবদনে বললেন।

আমি একটু শক্ত গলায় বললাম, না; বাসে যাব।

আজ ত বাস যাবে না বাবা, কাল বাস চামার কাছে এ্যাক্সিডেন্ট করেছিল। কয়েকদিন বাস বন্ধ থাকবে।

ছুটি ও আমি দুজনেই আশ্চর্য হলাম কথাটা শুনে। এ খবরটা আমাদের কারোরই জানা ছিলো না।

আমি বললাম, তাহলে কারো গাড়ি ঠিক করব। কর্ণেল সাহেবের গাড়ি কি অন্য কারো গাড়ি।

মাসীমা বললেন অ।

ছুটি আমার চায়ের কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে মাসীমার দিকে তাকিয়ে বলল, না, আজ আমি যাব না ভাবছি। সুকুদার কাছে থাকতে আমার খুব ভালো লাগে। ভাবছি কদিন থেকে যাব।

ভাবছ? মাসীমা উৎকণ্ঠিত গলায় বললেন।

তারপর বললেন, আমি তাহলে উঠি বাবা সুকুমার। আসি মা।

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আচ্ছা মাসীমা, আসুন।

মাসীমা গেট দিয়ে বেরিয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতেই ছুটি বলল, আপনার এখানে এরকম কতজন মাসীমা-পিসীমা আছেন?

আমি হাসলাম, বললাম, চটছ কেন? বেশির দরকার কি? একজনই যথেষ্ট। বহু বছরের মধ্যে আজই লাবুর মা প্রথম তাঁর প্রাত্যহিক কাজ থেকে ছুটি নেবেন। আজই এখানে যত বাড়ি আছে, বিশেষ করে বাঙালিদের বাড়ি, সব বাড়িতে ঘুরে ঘুরে উনি আমাকে এবং তোমাকে নিয়ে অনেক রসালো গল্প করবেন। আজ যদি বিকেলে স্টেশানে যাই, ত দেখবে স্টেশানের সকলে আমার দিকে এক নতুন চোখে তাকাচ্ছে। আমি লোকটা যে এতবড় বজ্জাত দুশ্চরিত্র তা তাঁরা জানতে পেরে আমার সঙ্গে যে সকলে এতখানি ঘনিষ্ঠতা ইতিমধেই করে ফেলেছেন এবং আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে ফেলেছেন তার জন্যে অনুশোচনা করবেন।

ছুটি বলল, যা বলেছেন।

তারপরই একটু চুপ করে থেকে বলল, আমি আপনার জীবনে শনির মত আবির্ভূত হয়েছি। আমার জন্যে আপনার কত অপমান সইতে হয়, আমাকে ঘিরে আপনার কত দ্বিধা, কত সংকোচ। কত হীনমন্যতা।

বললাম, এ কথা যদি তুমি বল ত আমার কিছু বলার নেই। তুমিও কি মাসীমার মত ঝগড়া করতে চাও আমার সঙ্গে।

ছুটি অভিমানী গলায় বলল, আমি ত ঝগড়াটিই। সকলের সঙ্গে ঝগড়া করাই ত আমার কাজ।

চা খেতে খেতে বললাম, সত্যিই তুমি থাকছ, না মাসীমাকে শোনানোর জন্যেই বললে।

হয়ত আপনাকে শোনানোর জন্যেও। না। কেন থাকব? আমি যখন মাসীমার বৌমা নই তখন এখানে থাকলে ত আপনার নামে কলঙ্ক রটবে চারদিকে।

আমি ছুটির হাতে হাত ছুঁইয়ে বললাম, এমন করে বলা তোমার অন্যায় ছুটি। খুবই অন্যায়। তুমি মিছিমিছি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছ।

তারপর বললাম, চল বেড়িয়ে আসি, আর দুপুরে কি খাবে বল। হাসানকে ডেকে বলে দাও।

ছুটি বলল, আপনি যা খাবেন, তাইই খাব। আপনি বসুন, আমি তৈরী হয়ে আসছি। আপনি তৈরী হবেন না?

তুমি যাও, আমার তৈরী হতে পাঁচ মিনিট লাগবে।

ছুটি চলে গেলে, বসে বসে ভাবছিলাম, সত্যিই পৃথিবীটা কেমন একটা নির্দয় জায়গা যেন। কোথাও কারো একটু সুখ দেখলে, কেউ একটু আনন্দে আছে জানলে সকলে যেন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়।

সমাজটা যেন একটা চাইনীজ চেকারের ছক। যার যার স্থান, যার যার রঙ সব ঠিক করে দেওয়া আছে। ছকে ছকে পা ফেলে ফেলে এক ছক থেকে আর এক ছকে যে রঙে সমাজ রাঙ্গিয়ে দিয়েছে আমাদের সেই রঙের একটা বল হয়ে গিয়ে এগোতে হবে। তাও এগনো বা পিছোনোতেও আমাদের নিজেদের কোনোই হাত নেই। সামাজিক পণ্ডিতরা আমাদের এক ছক থেকে উঠিয়ে নিয়ে অন্য ছকে বসাবে তবেই আমরা এগোতে পারব।

এতদিন ভাবতাম যে, ছুটি সমাজকে ভয় করে না। করে না যে, তার প্রমাণ ও বারে বারে দিয়েছে। এ জন্যে ওকে আমি সম্মান করি। যা অনেকে করতে চায়, সবসময় করার জন্যে আকুল হয়ে থাকে; কিন্তু বিদ্রোহী হবার সাহস রাখে না, সেই বিদ্রোহ অন্য কেউ সত্যি সত্যি করতে পারলে তাকে দেখে সম্মান নিশ্চয়ই করতে ইচ্ছা হয়।

কিন্তু মানুষের মন সজনেপাতার মত হালকা, ভারশূন্য। হাওয়া উঠলেই তাতে দোল লাগে। আর লাগে যে, তা ছুটিকে দেখেই বুঝতে পারছি। ও সমাজকে কখনও মানেনি, লোকভয়, লোকনিন্দা কখনও ভ্রূক্ষেপ করেনি, তবুও ওর মনও যে অশান্ত হয় ও যে মনে ব্যথা পায়, কেউ ওর এই স্বাধীনতাবোধ ও বিদ্রোহকে ছোট চোখে দেখলে, তা নিয়ে বিদ্রূপ করলে, তা পরিষ্কার বুঝতে পারি।

ওর জন্যে খারাপ লাগতে লাগল।

সমাজের মত ন্যক্কারজনক ঘৃণিত পরাধীনতার প্রতীক অন্য কিছু বোধহয় আমাদের জীবনে নেই, অথচ তবু সরল সত্য এইই যে, এখনও সমাজের মধ্যেই আমাদের প্রত্যেককে এমন কি ছুটিকেও বাস করতে হয়। রাস্তার লোকও অপমান করে যায় বিনা-এক্তিয়ারে। এই পরের ব্যাপারে নাক-গলানো নোংরা স্বভাব বোধহয় বাঙালির মত আর কারো নেই। এই সামাজিক বাজপাখিগুলো দিনরাত আকাশে উড়ে উড়ে তাদের নিজেদের বুকের শূন্যতায় ভরা চি-ই-চি-ই-ই-ই চীৎকার আকাশ বাতাস ভরিয়ে তোলে–আর তাদের শ্যেনদৃষ্টিতে উপর থেকে সবসময় নজর করে, ওদের চোখ এড়িয়ে কেউ সুখী হলো কিনা।

যেইনা কাউকে তেমন দেখে, অমনি হিংসায় জ্বলেপুড়ে ছোঁ মারে তাদের উপর–তাদের বিষাক্ত প্রাগৈতিহাসিক ডানার ঝাপটায় আর অন্ধ ঈর্ষাকাতর সংস্কারের নখে তাকে ছিন্নভিন্ন রক্তাক্ত করে দেয়।

পুরোনো দিনের শাশুড়িদের মত, তারা নিজেরা যেহেতু অল্পবয়সী জীবনে অনেকানেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়েছে, তাদের বউদের সেই বয়সে সেইসব বঞ্চনার শিকার হতে না দেখলেই তারা ক্ষুব্ধ, কুদ্ধ হয়, হিংসায় জ্বলে-পুড়ে ওঠে, বলে, কি? এত সাহস। আমরা হাহাকার করে মরলাম, প্রতি মুহূর্তে বুক-ভরা হাহাকার নিয়ে এই সমাজের জয়ের শ্লোগান দিলাম উচ্চগ্রামে আর তোমরা কিনা এই সমাজের মধ্যে বাস করেও সুখী হবে? জোর করে সুখ ছিনিয়ে নেবে ছকের বাইরে গিয়ে? বলে, না। সেটি হবে না।

ছুটি রাতের দুবিনুনী খোলোনি। একটা হলুদের উপর সাদা ফুলফুল ম্যাকসি পরেছে। পায়ে ব্যালেরীনা শু। হাতে নিয়েছে আমার একটা খড়ের-টুপী।

ছুটি দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, চলুন, আমি রেডি।

আমি উঠে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নিলাম। তারপর আমরা দুজনে চামার রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম।

দেখতে দেখতে সব বাড়ি ঘর পেরিয়ে এলাম। মিস্টার অ্যালেনের বাড়ি ছাড়িয়ে যেতেই চড়াইটা উঠতে হল। চড়াইটা পেরিয়ে অনেকখানি সোজা পথ। দূরে আবার একটা চড়াই।

শীতের সকালে চারদিকের মাটি, ঘাস, পাতা তখনো ভিজে ছিল। পথের ধুলোতেও একটা ভিজে ভিজে ভাব। চতুর্দিক থেকে একটা ঠাণ্ডা সোঁদা শীতের ভৈরবী গন্ধ বেরুচ্ছে। রোদের আঙুল এখানে ওখানে বনের গায়ে এসে পড়েছে। ধীরে ধীরে পাহাড়-ছাড়ানো সূর্যটা সমস্ত বনকে আলোয় ভরে দিচ্ছে। উষ্ণতার আনন্দে ভরে দিচ্ছে।

একটা পাপিয়া ডাকছে থেকে থেকে। বাঁ দিকের জঙ্গল থেকে ক্রমাগত কাঁহা, পিউ-কাঁহ, পিউ-কাঁহা? প্যাট এই পিউ-পাখিকে বলে ব্রেইন-ফিভার। এটাই বোধহয় পিউ-কাঁহার ইংরিজি নাম।

ছুটি টুপীটা হাতে নিয়ে আমার সামনে সামনে হেঁটে চলেছে।

দু বিনুনী করায় ওর গ্রীবাটা চুলে ঢাকা পড়েনি। কতগুলো ছোট ছোট অলক ওর সুন্দর মরালী গ্রীবায় কুঁকড়ে আছে।

ভারী মিষ্টি দেখাচ্ছে ছুটিকে।

ছুটি বলল, কোথায় যাবেন?

বললাম, চলোই না। যেতে যেতে তারপর ঠিক করা যাবে। যাওয়াটাই হচ্ছে আসল। বেরিয়ে পড়লে কি গন্তব্যের অভাব হয়।

ছুটি বলল, তা নয়। তবুও আমার এই গন্তব্যহীন হাঁটাহাঁটি ভালো লাগে না। কোনো গন্তব্য না থাকলে আমি কোথাওই যাই না। বনেও না, মনেও না।

বললাম, চল, তোমাকে একটা পোড়ো বাড়ি দেখিয়ে আনি।

ছুটি হাসল। যেন অনেকক্ষণ আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি বলে আমাকে একটা কনসোলেশান প্রাইজ দিল।

ছুটিকে হাসলে ভারী ভালো লাগে। দুষ্ট, মিষ্টি মিষ্টি, ওর হাসিটা প্রথমে চোখের মণিতে মৌটুসী পাখির শরীরের চঞ্চলতার মত দুলে ওঠে, তারপর সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়ে–ওর গালের টোলে গড়িয়ে যায়।

ছুটি হেসে বলল, এবারে আপনার কি হয়েছে বলুন ত? কাল স্টেশানে নামতেই যা দৃশ্য দেখালেন তা যেন জীবনে আর কখনও দেখতে না হয়। সারা রাত আমার কী যে ভয় করেছে কি বলব। ঠিক ভয় নয়, কেমন এক দারুন মন-খারাপ; আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না।

তারপর একটু থেমে বলল, সকালে যদি বা রোদ উঠল, মন ভালো লাগতে লাগল, হাজির করলেন মাসীমাকে। মাসীমা যদি বা দয়া করে চলে গেলেন, এখন চলেছেন পোড়া বাড়ি দেখতে। কিন্তু কেন?

আমি বললাম, পোড়ো বাড়ি দেখতে তোমার ভালো লাগে না! ভালো না লাগলে যাব না। চল এমনিই জঙ্গলের পথে হাঁটব।

আমার কিন্তু জানো, যে-কোনো পোড়া বাড়ি দেখলেই দারুণ লাগে। এই বাড়িগুলোর যে একটা অতীত ছিল, সে কথা মনে পড়ে যায়। হাওয়ার শিসের মধ্যে, পাখির ডাকের মধ্যে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া বাস্তু সাপের চলার মন্থরতার সঙ্গে আমার কেন জানি অনেক কিছু কল্পনা করতে ইচ্ছা হয়।

তারপর কি মনে হয় জানো?

–কি? মুখ ফিরিয়ে ছুটি বলল।

মনে হয় আমরা প্রত্যেকেই এক একটা পোড়ো-বাড়ি। এ জীবনে এই আমাদের প্রত্যেকের শেষ পরিণতি। আর এইই যদি শেষ পরিণতি হয় তাহলে শৈলেনকে বোকা ভাবি কি করে? একটা একটা করে ইট খসে যাওয়ার চেয়ে, বুকের মধ্যে পরতে পরতে ধুলোর আস্তরণ জমার চেয়ে, চোর-ডাকাতে মনের দরজা-জানালা এক এক করে খুলে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে, প্রচণ্ড জীবন্ত অবস্থায় নিজেকে নিবিয়ে দেওয়াই ত ভালো।

ছুটি কথা না বলে, হাঁটতে হাঁটতে মুখ ফিরিয়ে আবার তাকাল আমার দিকে।

আমি বললাম, সেদিন মিস্টার বয়েলস-এর বাড়ি থেকে ফেরার সময় প্যাট একটা খুব দামী কথা বলেছিল।

–কি কথা? ছুটি শুধোল।

–প্যাট বলছিল আই ওয়ান্ট টু ডাই উইথ আ ব্যাঙ্গ, এন্ড নট উইথ আ হুইমপার।

ছুটি অসহিষ্ণু গলায় বলল, আপনার কি ধারণা আত্মহত্যা করলেই লোকে সশব্দে মরে, অন্যভাবে সেই মৃত্যুবরণ করা যায় না? আপনি কি মনে করেন যে-সব লোক প্রতিমুহূর্তে মরে যাচ্ছে, ধীরে ধীরে, তিল তিল করে, কেউ হয়ত দারিদ্র্যে মরছে–আর্থিক দারিদ্র্য, কেউ চরম মানসিক দারিদ্র্য, তাদের প্রত্যেকেই আত্মহত্যা করে মরে যাওয়া উচিত?

–তা বলিনি। হয়ত স্বাভাবিক নিয়মে কামরাজের কথাটাই মানা উচিত। তামিলনাড়ুর কামরাজের কথা।

কামরাজের কথা আবার কি? ছুটি বলল।

আমি বললাম, পারকালম, অর্থাৎ ওয়েট এন্ড সী। মানে, দেখোই না কি হয়।

গরীব যে তার মনে মনে বিশ্বাস করা উচিত যে, একদিন সে হরিয়ানা লটারী জিততেও পারে, একদিন দেশে সত্যি সত্যিই সমাজতন্ত্র আসতেও পারে, যা নিছক গরিবী হঠানোর ফাঁকা বুলি নয়। যে মনে গরীব, তারও ভাবা উচিত একদিন তার মন ফুলে ফুলে ভরে যেতে পারে।

–সেটা ভাবা কি ভুল? ছুটি বলল।

ভুল অথবা ঠিক তা আমি জানি না। এই পারকালম-এ বিশ্বাস আমার নেই, সে কথাই বলছি।

–তাহলে আপনি বলতে চান যে আত্মহত্যা করাই জীবনে একমাত্র পথ?

–সে কথাও আমি বলিনি। তোমাকে কি করে বোঝাব জানি না। তারপর হঠাৎ বললাম, তুমি জানো আর্নেস্ট হেমিংওয়ে কেন আত্মহত্যা করেছিলেন?

–আমি কেন? কোন্ লোক কেন আত্মহত্যা করে সে নিজে ছাড়া আর কেউই তা জানতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি না। তবু শুনি, আপনি যখন জানেন বলছেন।

–আমি যতটুকু জানি, তাতে এইই মনে হয় যে, উনি মনে করতেন যে একজন মানুষ মরে যায়, কিন্তু কখনও সে হারে না। মানুষকে মেরে ফেলা যায়, ধ্বংস করে ফেলা যায়, কিন্তু তাকে হারিয়ে দেওয়া যায় না। আমি জানি না, যা বলতে চাইছি তা তুমি বুঝলে কিনা। ধরো, শৈলেনকে নয়নতারা মেরে ফেলল, কিন্তু শৈলেনকে হারাতে তো পারল না। বরং নিজেই চিরজীবনের মত হেরে রইল শৈলেনের কাছে। তারপর ধরো, আমি আরেকজন বিখ্যাত জীবিত লোকের কথাও জানি–তিনিও দারুণভাবে বিশ্বাস করেন আত্মহত্যায়।

–কি তিনি?

–তোমার প্রিয় ইটালিগান ফিল্মডিরেক্টর, মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি।

ছুটি একটু অবাক গলায় বলল, ওঁর কিসের দুঃখ? ওঁর মত সাকসেসফুল মানুষ কেন এমন নেগেটিভ ভাবনা ভাবেন?

বাইরে থেকে কোন্ মানুষকে আমরা বুঝতে পারি বল? এমন কোনো মানুষ আছে কি যার হাসির আড়ালে দুঃখ লুকোনো নেই?

ছুটি আমার কাছে সরে এল। আমার হাতের পাতা ওর হাতে নিল। তারপর আমার হাতটাকে দোলাতে দোলাতে বলল, বলুন না, আন্তোনিওনির কথা কি বলছিলেন?

–আন্তোনিওনিকে একজন ফিল্ম জানালিস্ট প্রশ্ন করেছিলেন, ওঁর ফিল্মের নায়ক-নায়িকাদের প্রায়ই আত্মহত্যা করতে দেখা যায় কেন? আত্মহত্যা কি আন্তোনিওনির প্রি-অকুপেশান?

মানুষের সমস্যাসঙ্কুল জীবনের অবসানের অনেকানেক পথের মধ্যে ওটাও একটা পথ মাত্র। খুব বীভৎস পথ, সন্দেহ নেই; কিন্তু অন্য দশটা পথের মতই একটা ন্যায্য পথ।

জীবন যদি ভগবানের দান হয়, তাহলে সেই জীবন থেকে আমাদের স্বেচ্ছায় বঞ্চিত করার অধিকারটুকুও ভগবানের দান বলেই স্বীকৃত হওয়া উচিত।

ছুটি আপনমনে বলে উঠল, আশ্চর্য! কেন মানুষ এত সহজে হেরে যেতে চায়? হেরেই যদি যাব ত আমরা মানুষ হয়ে জন্মালাম কেন?

ছুটির গলার স্বরে এক শান্ত অসহয়তা ঝরে পড়ল। আমার মনে হল এই স্বগতোক্তির মধ্যে ও যেন ওর নিজের জীবনের হার-জিতের কথাও বলছে।

আমরা তখন একটা আমলকী বনের তলা দিয়ে যাচ্ছিলাম। ততক্ষণে চারিদিকে ঝকঝকে রোদ উঠে গেছে। বনের পথে আলোছায়ার নানারকম সাদা কালো ছবি হয়েছে।

আমি ছুটিকে আমার কাছে টেনে নিলাম।

ছুটি অবাক হয়ে তাকালো আমার মুখের দিকে। আমি ছুটির গ্রীবায় চুমু খেলাম, তারপর ওকে বুকের কাছে টেনে নিলাম। ভালোলাগায় ছুটি চোখ বুজে ফেলল।

ছুটির বন্ধ চোখে, প্রথমে বাঁ চোখে, তারপর ডান চোখে আমি চুমু খেলাম, তারপর ছুটির শান্ত শ্বেতা কপালে।

ছুটিকে ছেড়ে দিতেই ছুটি চোখ মেলল। চোখ মেলেই আমার বুকে ঝাঁপিয়ে এসে আমার বুকে মুখে চোখে তার অজস্র ছেলেমানুষী সরল ভালোবাসায় চুমু খেতে লাগল। আমার কোমর দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে রইল, মনে হল কখনও বুঝি ও আমাকে ছাড়বে না।

ছুটির নরম ছিপছিপে শরীরকে আমার বুকের মধ্যে ধরে থাকলাম। ওর নরম অথচ ঋজু বুক হাওয়া লাগা আমলকীপাতার মতো থরথর করে কাঁপছিল।

ও আমার বুকের মধ্যে মুখ রেখে গরম নিঃশ্বাস ফেলে হঠাৎ বলে উঠল, আমার সঙ্গে কখনও আর এ নিয়ে আলোচনা করবেন না সুকুদা, আমার ভীষণ ভয় করে, আমার ভীষণ ভয় করে।

আমি বললাম, ভয় করে কেন ছুটি, কিসের জন্যে ভয় করে?

ছুটি বিড়বিড় করে বলল, আপনার জন্যে ভয় করে সুকুদা, আপনার জন্যে বড় ভয় করে।

আমি বললাম, পাগলী।

বললাম, দেখি আমার ছুটির সুন্দর মুখটা একবার দেখি?

ছুটি মুখ তুললো না আমার বুক থেকে।

আমি দুহাতের পাতার মধ্যে করে ওর মুখকে আমার বুক থেকে তুললাম।

দেখলাম, ওর দুগাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে।

ওর মুখকে আবার আমার বুকের মধ্যে নিয়ে আমি বিড়বিড় করে বললাম, ও আমার ছুটি, তুমি কখনও আমার সামনে কেঁদো না। তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার কষ্ট হয়, বিশ্বাস করো, ভীষণ কষ্ট হয়।

ছুটি হঠাৎ মুখ তুলে আমার চোখের দিকে তাকাল।

দেখলাম, তখনও ওর গাল বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে, কিন্তু মুখে একটা দারুণ হাসি।

আমার ছুটিই বুঝি শুধু এমন করে কাঁদতে কাঁদতে হাসতে জানে।

.

বাড়িটার নাম নাইটিঙ্গেল। বড় রাস্তা থেকে একটা পথ সোজা চলে গেছে গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। পথের দুপাশে মোরব্বা ক্ষেত। অনেকদিন আগে লাগানো ছড়ানো-ছিটানো বোগেনভেলিয়া। একটা কালভার্ট পড়ে পথে। নীচ দিয়ে লাল বুক দেখিয়ে গড়িয়ে গেছে একটা পাহাড়ী নালা, কালো পাথরগুলো প্রকৃতির বুকের অসংখ্য বোঁটার মত উঁচিয়ে আছে।

বাড়িটা একসময় দোতলা ছিল। দোতলার ছাদ ধ্বসে গেছে। কিন্তু একতলার ছাদটা আছে।

ছুটির হাত ধরে ভাঙ্গা ধূলিধূসরিত সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠেই চোখ জুড়িয়ে গেল।

প্যাটের কাছে শুনেছিলাম এ বাড়ি এক বৃদ্ধের ছিল। পঞ্চাশ বছর বয়সে উনি একজন উনিশ বছরের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। স্বাভাবিক কারণে ঐ অসীম নির্জনতার মধ্যে একমাত্র যা পেলে সে খুশি হত, তা সেই মহিলা তাঁর চেয়ে একত্রিশ বছরের বড় স্বামীর কাছ থেকে পেতেন না। স্বামীর সবরকম সাধ, চেষ্টা সত্ত্বেও পেতেন না।

কোনো হাততালি-চাওয়া বোকা বাঙালি মেয়ে হলে উনি হয়ত পতি-পরম-গুরু ভেবে তার বাকি জীবনটা এই পাহাড় বনের হাওয়ার মত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠাকুর পুজো করে তুলসীতলায় প্রদীপ দিয়ে সতী-সাধ্বীর মত কাটিয়ে দিতেন।

কিন্তু মেয়েটি স্কচ ছিলেন। ওরা কোনো নেতিবাচক জিনিসে বিশ্বাস করে না; করেনি কোনোদিন। তাই স্বামীকে একটি পুত্র সন্তান উপহার দেওয়ার পর নিজের জীবনকে ভালোবাসতেন বলে তিনি নিজের পথ বেছে নিয়ে চলে গেছিলেন একদিন। নিজের সুখের জন্যে।

জায়গাটা অত্যন্ত নির্জন বলে তরুণী স্ত্রীর সঙ্গে থাকবার উপযুক্ত ছিল; কিন্তু শেষ-প্রৌঢ়ত্বের গেটে বাত দাঁত-ব্যথা ইত্যাদি নিয়ে একা একা থাকার পক্ষে আদৌ উপযুক্ত ছিল না। তাই ভদ্রলোক এক সময়ে গঞ্জের ভিতরে আর একটি বাড়ি কিনে চলে যান। বহুদিন আগে ভদ্রলোক মারা গেছেন।

তারপর থেকে এই বাড়ি পোড়ো বাড়ি।

হু হু করে হাওয়া দিচ্ছিল একটা কনকনে। ছুটির ম্যাক্সি দুলে উঠছিল হাওয়ায়। ম্যাক্সির নীচে ওর সুন্দর লেসবসানো শায়ার প্রান্তে ওর সুগৌর গোড়ালি দেখা যাচ্ছিল।

ছুটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হল বহুদিন আগের সেই উনিশ বছরের বিদেশিনীকে যেন আমি আমার সামনে প্রত্যক্ষ করছি।

ওরা এ বারান্দায় বসে চা খেত, চাঁদনী রাতের গরমের দিনে মহুয়ার গন্ধভরা হাওয়ায় আর রাতচরা পাখির ডাকের মধ্যে ওরা এই দোতলার খোলামেলা ঘরে অনেক দারুণ খেলা খেলত।

সে-খেলায় ভদ্রলোক রোজই হেরে যেতেন আর চাঁদকে অভিশাপ দিতেন, নিজের কোমরের বাতকে অভিশাপ দিতেন, দেওয়ালের ক্যালেন্ডারকে অভিশাপ দিতেন। মনে মনে বলতেন, মানুষের সবচেয়ে বড় শত্রু সময়। সময়ের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে যা করার সবকিছু তার সঙ্গে সঙ্গেই থেকে করে নিতে হয়। বুঝতে পারতেন, সময় হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলে তখন কিছুতেই কিছু হয় না। কোনো পাওয়াই তখন পাওয়া নয়।

ছুটি বলল, দারুণ বাড়িটা, না?

আমি ঠাট্টার গলায় বললাম, তুমি নেবে? বল? নাও যদি ত তোমার জন্যে কিনে দি- তারপর মেরামত করে দেব। তুমি এ বাড়িতে থাকবে আর আমি প্রত্যেক পূর্ণিমার রাতে তোমার কাছে আসব-শুধু পূর্ণিমার রাতে।

মাসের বাদবাকী উনত্রিশ দিন তুমি আমার প্রতীক্ষায় থাকবে; আমি তোমার প্রতীক্ষায়। এখানে থাকতে যদি ত প্রতি পূর্ণিমাতে তোমাতে আমি, আমাতে তুমি পূর্ণ হতাম; আপ্লুত হতাম, পরিপূর্ণভাবে পরিপ্লুত হতাম। কি? বল? নেবে?

ছুটি খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।

বলল, এমন এমন সব কটমট ভাষা বলছেন, মানে বুঝতে পারছি না।

তারপর বলল, আপনি ভীষণ রোম্যান্টিক। আপনার মত রোম্যান্টিক পুরুষমানুষ আমি দেখিনি। তারপর আমার হাতে কাঁধ ছুঁইয়ে বলল, বিশ্বাস করুন, সত্যিই দেখিনি। এই জন্যেই ত আপনাকে এত ভালো লাগে।

আমি বললাম, আমার মধ্যের রোম্যান্টিক মানুষটা এমনিতে কুম্ভকর্ণর মত ঘুমোয়। যখন তুমি কাছে আস, সামনে দাঁড়াও, শুধু তখনি সে ঘুম ভেঙে উঠে পাগলামি শুরু করে। দোষই বল আর গুণই বল, সেটা তবে কার?

ছুটি হাসল। বলল, জানি না।

কিছুক্ষণ পর ছুটি বলল, বাড়ি যাবেন না?

–যেতে ইচ্ছে করছে না।

–এখানে থাকবেন?

–না। এখানে থাকব না বেশীক্ষণ। জায়গাটা অপয়া।

–কেন? অপয়া কেন?

–তোমার মত একজন মেয়ে এখানে থাকত, সে যার সঙ্গে থাকত তাকে ছেড়ে সে চলে গেছিল।

–তাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কারো কাছে ত পৌঁছেছিল। তাহলে আর অপয়া বলছেন কেন?

তারপর বলল, মাঝে মাঝে মনে হয়, যে-কোনো লোকের জীবনেই সমস্ত কিছু পয়মন্ততা আর অপয়মন্ততার যোগফল শূন্য। কি? ঠিক না?

আমি কথা বললাম না, ছুটিকে হাত ধরে নামাতে লাগলাম।

মাঝ-সিঁড়িতে এসে ছুটি বলল, সকুদা, আমাকে কোলে করে নামান না? পারবেন?

মাঝে মাঝে ওকে কী যে দুষ্টুমিতে পায়, ওই জানে।

আমি ছুটিকে পাঁজাকোলা করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলাম।

ওকে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিতেই ওর সুন্দর ধবধবে হাঁটু অবধি অনাবৃত হয়ে গেল। ওর হারের লকেটটা একদিকে ঝুলে রইল; দুলতে লাগল।

আমি ওকে তুলে নিয়ে ওর হাঁটুতে চুমু খেলাম।

ছুটি বলল, আঁউ–এই সুকুদা ভীষণ সুড়সুড়ি লাগছে।

ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে, আমরা কুয়োটার ধারে এসে দাঁড়ালাম। কুয়োটা অনেক গভীর। নীচে পাতা পড়ে আছে, ফুল পড়ে আছে। কতগুলো কটকটে ব্যাঙ পোড়া কাঠের মত ভেসে আছে জলে।

ছুটি মুখ নীচু করে কুয়োর মধ্যে মুখ নামিয়ে ডাকল, সুকুদা-আ-আ।

সুকুদা—সুকুদা—সুকুদা–সুকুদা করে অনেকক্ষণ কুয়োর মধ্যে থেকে প্রতিধ্বনি উঠল।

ছুটি আবার বলল, ভালোবাসি। ভালবাসি-ই-ই-ই-ই…..।

ভালোবাসি—ভালোবাসি—ভালোবাসি…আওয়াজটা কুয়োর মধ্যে, বনের মধ্যে, পাহাড়ের মধ্যে, আমার মাথার মধ্যে গুমগুমিয়ে ফিরতে লাগল।

কুয়োর পাড় ছেড়ে আমরা দুজন আবার ছাড়াছাড়ি হয়ে, একা একা, আমাদের দুজনের মনের মধ্যেই যে কুয়ো আছে, যা সকলের মনের মধ্যেই থাকে, সেই কুয়োর দিকে তাকাতে তাকাতে, মনের আঙুলে সেই কুয়োর পচা-পাতা, ঝরা-ফুল, কুৎসিত ব্যাঙগুলো সরাতে সরাতে জঙ্গলের ছায়া-ভরা পথে হাঁটতে লাগলাম।

অনেকক্ষণ পর ছুটি বলল, কী সুর বাজে আমার প্রাণে, আমিই জানি আমার মনই জানে..

–তুমি জান?

—জানি।

–গাইবে?

–এখন না।

–তবে কখন? আমি শুধোলাম।

যখন সময় হবে। ছুটি বলল।

আমি শুধোলাম, কিসের সময়?

–ও গান গাইবার সময়।

–এখন তবে কোন্ গান গাইবার সময়?

–ও গান গাসনে, গাসনে। হৃদয়ে যে কথা আছে সে আর জাগাস্ নে…

ওর ঐ কথা শুনে আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। ছুটি হঠাৎ বলল, আপনি রবীন্দ্রনাথের খুব ভক্ত। না?

বললাম, নিশ্চয়ই।

ছুটি বলল, কিসের জন্যে?

কারণ রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার বোস অথবা সুনীল গাঙ্গুলীর মত কোনো বিশেষ জেনারেশনের লেখক নন বলে।

–ত তিনি কোন জেনারেশনের?

–যাঁরা সব জেনারেশনের লেখক, তিনি তাঁদের দলের। কোনো বিশেষ জেনারেশনের সস্তা স্বীকৃতির শীলমোহরে তাঁর প্রয়োজনে নেই।

–তাই? বলে ছুটি আমার মুখের দিকে তাকাল।

তুমি রবীন্দ্রনাথ ভালো করে পড়েছে? আমি জিগ্যেস করলাম।

মিথ্যে বলব না। ভালো করে পড়িনি। ছুটি এই প্রথম কবুল করল।

–তাহলে পড়ে ফেলো, শীগগীরই। তারপরই না হয় এ নিয়ে আবার দুজনে আলোচনা করব। ছুটি যেন মজা পেল। বলল, বেশ।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির দিকে আসতে লাগলাম। আমরা যখন মিস্টার এ্যালেনের বাড়ির কাছে সেই উঁচু জায়গাটায় এসে পৌঁছেছি, ছুটিকে বললাম, কেন জানি না, আজ তোমাকে দারুণ, দারুণ আদর করতে ইচ্ছে করছে।

ছুটি দাঁড়িয়ে পড়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। বলল, অসভ্য।

ছুটির মুখে তাকিয়ে বুঝতে পেলাম আমি কি বলতে চেয়েছি তা ও বুঝেছে।

আমি বললাম, কি? করব না।

ছুটির মুখ একরাশ হঠাৎ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ও মুখ নামিয়ে নিল। বলল, না। আজ না। এখন না।

আমি বললাম, কেন না? না কেন?

কিন্তু মনে মনে আমি খুব আশ্বস্ত হলাম। কারণ আমার মধ্যের যাত্রা দলের বিবেকটা রমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে পর্যন্ত নানারকম গান গেয়ে গেয়ে আমাকে ছুটির কাছ থেকে দূরে আসতে বলছিল। সেই বিবেকটাকে অগ্রাহ্য করতে পেরেছি জেনে ভালো লাগল।

ছুটি কোনো জবাব দিল না।

আমি আবার বললাম, না কেন, তা বললে না?

ছুটি বলল, মনে মনে আমি এখনও তার জন্যে পুরোপুরি তৈরী নই সুকুদা। আমাকে একটু সময় দিন।

তুমি কাল ত তৈরী ছিলে। আজ কি হল?

জানি না। মনে হচ্ছে আমার যখন ভীষণ আদর খেতে ইচ্ছে করে, তখন আপনার একেবারেই করে না। তখন মনে মনে আপনি যেন কোথায় চলে যান। আর আপনার যখন আদর কমতে ইচ্ছে করে ততক্ষণে আমার মন সেই মুহূর্তের তীব্র ইচ্ছা থেকে সরে আসে। আমার ও আপনার মনের মধ্যে সীনক্রোনাইজেশানের বড় অভাব। এটা কিন্তু ভালো না। এটা অশুভ লক্ষণ।

আমি চুপ করে ছিলাম। চুপ করেই হাঁটছিলাম।

হঠাৎ ছুটি আমার হাতে হাত রেখে বলল, এই সুকুদা, রাগ করলেন?

আমি হাসলাম। বললাম, না, ছুটি, রাগ করব কেন?

ছুটি বলল, আশা করি আপনি আমাকে বুঝবেন। আপনার কাছ থেকে ত সব পাওয়াই পেয়েছি, শুধু এই পাওয়া ছাড়া। এ পাওয়াটা তোলা থাক কোনো বিশেষ দিন, কোনো বিশেষ মুহূর্তের জন্যে। যে মুহূর্তে আমি এবং আপনি দুজনেই আমাদের শরীরে এবং মনে একে অন্যের প্রতি বিন্দুমাত্র দ্বিধা বা সংকোচ না রেখে, দুজনে দুজনকে সম্পূর্ণ ও ধন্য করব। যা চাইবার বা পাবার সবই পেয়ে গেলে মনে হবে আর বুঝি কিছু পাওয়ার নেই আমাদের একে অন্যের কাছ থেকে।

একটু চুপ করে থেকে আবার বলল, কিছু বাকি থাক; হাতে থাক কিছু।

.

২২.

শীতের প্রকোপ প্রায় কমে এসেছে। তবে শীত এখনও থাকবে বহুদিন।

কাল শেষ রাতে বসন্তের দূতী কোকিল কোথা থেকে খবর পেয়েছিল জানি না যে, শীতের দিন শেষ, সে অসময়ে পুলকভরে ডাক দিয়ে দিয়ে মাথার মধ্যে বসন্তের সব ভাবনাগুলো ফিরিয়ে এনেছে।

বাড়ির বাঁপাশে যে তুত গাছটা আছে তাতে তুতের ফল দেখা দিয়েছে। পেয়ারা ফলে শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন আগে। বোগেনভেলিয়াদের ডালে ডালে পাতা দেখা যায় না; এখন শুধু ফুল।

সকাল বিকেল রাত সমস্যক্ষণ কোকিলরা পালা করে ডাকে। কিছুদিন বাদে ওঁরা ওদের সারহুল উৎসব। সন্ধ্যে হতে না হতেই মাদলের আওয়াজ শোনা যায় দোলানী সুরের গানের সঙ্গে। আগে-ফোঁটা কিছু মহুয়ার মিষ্টি গন্ধ ভাসে হাওয়ায়।

শাল বনে বনে থোকা থোকা হলুদ-মেশানো সাদা ফুল এসেছে। হাওয়া সব সময়ে সে গন্ধে ভারী হয়ে থাকে।

কোকিল-ডাকা শুরু হবার পর থেকেই শীতটা রণপা চড়ে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে যেন। পথের পাশে পাশে জারহুলের হালকা বেগুনী আর ফুলদাওয়াইর ঝিমধরা লাল চোখে পড়ে। পুটুসের যে কতরকম রং তা কি বলব। গাঢ় লাল, কমলা, হলুদ, বেগুনী, কালো;সবরকম।

ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকেরা পথের দুপাশের অনেকখানি জায়গা জুড়ে ঘাস-পাতা সব আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। যাতে দাবানল লাগলে এপাশের আগুন ওপাশে না ছড়িয়ে পড়ে।

গরম বেশি পড়লে দাবানল লাগবেই। শুকনো পাতায় পাতায় পাথরে পাথরে ঘষা লেগে প্রকৃতির অদৃশ্য ইঙ্গিতে বনের বুকে হঠাৎ করে আগুন জ্বলে উঠবে। তারপর সেই আগুন ছড়িয়ে যাবে দিকে দিকে। দূর থেকে পাহাড়ে পাহাড়ে আলোর মালা দুলতে দেখা যাবে। শুয়োর খরগোশ ভালুক সজারুরা তাড়াতাড়ি পাহাড় বেয়ে নেমে আসবে নীচের ঠাণ্ডা নালার খোলে।

সে-সব দিনের এখনও দেরী আছে। এখনও গরম পড়েনি আদৌ। শীত কমে গেছে এখানে; এ পর্যন্তই।

এ জায়গাটা সেদিক দিয়ে একটা আশ্চর্য জায়গা। গরম বলতে তেমন কখনোই পড়ে এখানে। মে মাসেও রাতে চাদর গায়ে দিয়ে শুতে হয়–সকাল আটটা পর্যন্ত। এবং সূর্য ডোবার পরই প্রখর গ্রীষ্মেও বেশ একটা শীত শীত ভাব থাকে।

মাঝে একদিন স্টেশনে গেছিলাম। ছুটির ব্যাপারে যতখানি কৌতূহল দেখাবেন ওঁরা ভেবেছিলাম ততখানি কৌতূহল দেখলাম না।

হয়ত আমার উপর দয়াপরবশ হয়েই ওঁরা তা দেখালেন না। একজন শুধু একথা-সেকথার পর শুধোলেন, আপনার সেই আত্মীয়া চলে গেছেন?

আমি বললাম, একদিন পরেই চলে গেছেন।

আত্মীয়ার কথাটার আভিধানিক মানে যা তাতে ছুটি আমার আত্মীয়া নয়। কিন্তু যে আত্মার কাছে থাকে, সবসময় আছে, সে ত আত্মীয়াই। তার চেয়ে বড় আত্মীয়া আর কে হতে পারে?

মাঝে মাঝে মনে হয়, আজকের জীবনে অনেক অনেক পুরানো শব্দ আর বর্তমানে যথার্থ অর্ধবাহী নেই, নতুন কোন অভিধানের খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

মাস্টারমশাই বললেন, কথাটা শুনেছেন। বললাম, কি কথা? শৈলেন তার পোস্ট-অফিস সেভিংস এ্যাকাউন্টে যত টাকা ছিল, তার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা, ডিউটি করতে করতে মারা যাওয়ার জন্যে কমপেনসেশান সবই নয়নতারাকে লিখে দিয়ে গেছে।

বললাম, আত্মহত্যা করলেও কি পাওয়া যায় ক্ষতিপূরণ?

না। তা পাওয়া যায় না। তবে, রেলের বড়কর্তারা এবং আমরা সকলেই বলেছি যে, এটা অ্যাকসিডেন্ট। আত্মহত্যা নয়। সত্যিই হয়ত অ্যাকসিডেন্ট। কে বলতে পারে? হয়ত শৈলেন অন্যমনস্কভাবে তখন লাইন পেরোতে গেছিল। এমন হঠাৎ অ্যাকসিডেন্ট কি ভাবে ঘটে তা কি কেউ বলতে পারে?

বললাম, তা ঠিক। তারপর বললাম, আপনারা সকলে মিলে তাহলে নয়নতারাকে অনেকগুলো টাকা পাইয়ে দিলেন?

মাস্টারমশাই উপরে হাত তুলে বললেন, আমরা নিমিত্ত মাত্র, যা করার সব তিনিই করেন। আমরা কে? তারপর বললেন, আমরা কি ছাই জানি যে শৈলেনটা সব কিছু নয়নতারাকে লিখে দিয়ে যাবে?

নয়নতারা এখন কোথায়?

এখন এখানেই, তবে শীগগীরি চলে যাবে। এ নয়নতারাকে দেখলে আপনি চিনতে পারবেন না। কোথায় গেছে তার রংঢং। সবসময়ই শুকনো মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিন দুপুরে ত শৈলেনের কোয়ার্টারের চাবি নিয়ে গিয়ে ওর ঘরে একা বসেছিল। শৈলেনের ড্রয়ারে নাকি ওর একটা ছবি ছিল। ছনি দেখে নাকি অনেক কান্নাকাটি করেছিল ও।

তারপর মাস্টারমশাই এক টিপ নস্যি নিয়ে বললেন, কি জানি বাবা, বুঝি না বাপু। এতই যদি ঢং দেখাবি ত আগেও ত একটু দেখালে পারতিস?

আমি চুপ করে থাকলাম।

ভাবছিলাম, হয়ত নয়নতারা তা দেখাতে পারত। কিন্তু আমরা কখন কি করি, কেন করি, তা কি আমরা জানি? জীবনের কোন্ ঘটনা কেমন করে, কখন যে আমাদের মনের গোপন তারে কিভাবে নাড়া দিয়ে যায়, তা সবসময় আমরা নিজেরাই কি জানতে পাই?

একথা সে-কথার পর বেলা হতে আমি স্টেশন থেকে উঠে চলে এসেছিলাম।

আজকে সকাল থেকে আকাশ মেঘলা করে আছে। দুপুরের দিকে বৃষ্টি হতে পারে।

এখানের লোকেরা বলেন যে গরম পড়লেই, অথবা শীত যতখানি থাকার তার চেয়ে কমে গেলেই এখানে বৃষ্টি হয় এবং তাপমাত্রা কমে যায়। বন্দোবস্তটা ভালো। একেবারে প্রাকৃতিক এয়ারকণ্ডিশনিং প্ল্যান্ট বসানো আছে।

গাছতলায় বসে চিঠি লিখছি, এমন সময় মালু একটা চিঠি নিয়ে এল পোস্ট-অফিস থেকে। চিঠিটা ছুটির। তবে এত ভারী চিঠি এর আগে ও কখনও লেখেনি আমাকে।

আমি মনে মনে রোজই এ চিঠির প্রত্যাশা করছিলাম। ছুটি কি লিখবে আমি জানি না, তবে কিছু যে লিখবে তা জানতামই। এ চিঠিটা পাবার জন্যে মন অত্যন্ত আকুল হয়ে ছিল! ভীত হয়ে যে ছিল না, তাও বলব না।

তাড়াতাড়ি চিঠিটা খুললাম। খুব বড় চিঠি। চিঠিটা খুলেই পড়তে লাগলাম।

রাঁচী
২০/২

সুকুদা, এখানে ফিরেই আপনার চিঠি পেলাম। চিঠি পেয়ে বেশ যে চমকে গেছিলাম তা বলাই বাহুল্য। চমক অনেক কিছুতেই লাগে, তবে এই চিঠির চমক ম্যালাক্সিগঞ্জে আপনার সঙ্গে এক রাত ও একদিন কাটিয়ে আসার আনন্দর ঠিক পরই বড় ধাক্কা দিল।

আপনি বোধহয় ঠিকই বলেছিলেন সেদিন সকালে। আমাদের প্রত্যেকের বুকের মধ্যেই বোধহয় একটি করে পোড়ো বাড়ি থাকে। যখন মনের মধ্যে হাওয়া ওঠে, তখনই আমরা তার শিস শুনতে পাই। তার আগে নয়।

শুধু আপনার চিঠিটা হলেও না হয় হত। আপনার চিঠি পেয়ে সব ভাবনা ভেবে শেষ করার আগেই রমাদির কাছ থেকেও একটা চিঠি পেলাম। দুটো চিঠির বক্তব্য পাশাপাশি রেখে খুব চমকে উঠলাম।

আপনি যে এত ভালো অভিনেতা তা আমার জানা ছিলো না। আমি, এই একজন সামান্য সহায়-সম্বলহীন অথচ সরল মেয়ে জীবনের কোনো ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেই অভিনয় করিনি কখনও কারো সঙ্গে।

যারা করে বলে বুঝতে পেরেছি তাদের মনে মনে ঘৃণা করে এসেছি। তাই আপনি একজন অভিনেতা জানলে (যত উঁচুদরের অভিনেতাই হন না কেন) আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাকে এতদূর গড়াতে দিতাম না।

আমার সবচেয়ে বড় দোষ হচ্ছে, আমি যার সঙ্গে মিশি তার সঙ্গে আগল খুলে মিশি। যাকে ভালোবাসি, তাকে কিছুমাত্র বাকি না রেখেই ভালোবাসি। কাউকে স্বীকার করতে আমার অনেক সময় লেগে যায়; কিন্তু কেউ স্বীকৃত হলে তাকে আর পর ভাবি না। তখন মনের মধ্যের ভালো লাগা, ভালোবাসা, বিশ্বাসের সমস্ত ফুলগুলির সমস্ত পাঁপড়ি খুলে তার দিকে ধাবিত হই।

এখন জানছি, সেটা ভুল; সেটা মস্ত ভুল। কখনও যে অন্য কাউকে নিজের মনের ঘর ছেড়ে, তার মনের ঘরে গিয়ে কিছু পৌঁছে দিতে নেই উপযাচকের মত, তা আজ আমার মত করে আর কেউই জানে না।

তেমন করে কিছু দিলে, যে তা পায়, সে বোধহয় সেই দানের মূল্য বোঝে না। জানি না, উপমাটা ভালো হল কিনা। আপনি লেখক মানুষ, হয়ত আমার উপমা দেখে হাসবেন। কিন্তু এখন আমার মনে হয় যে, বুদ্ধিমান মানুষ মাত্রেরই উচিত তার নিজের মনের ঘরের মধ্যে বন্দী হয়ে থাকা। বড়জোর, মনের বারান্দা অবধি আসা চলতে পারে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে জীবনের মিশ্র অনুভূতিগুলো যাচাই করা চলতে পারে, বড়জোর অন্য কাউকে বারান্দা থেকে হাত বাড়িয়ে কিছু দেওয়া বা তার কাছ থেকে নেওয়া চলতে পারে। কিন্তু কখনও বারান্দা থেকে নেমে নিজের মনের আব্রু নিজের মনের আলপনার পরিধি ছেড়ে কিছু পাওয়ার বা দেওয়ার জন্যে পথে বেরুতে নেই।

মেয়েদের ত নয়ই। পথে-বেরুনো মেয়েদের যত সহজে স্বার্থপর পুরুষমানুষরা ছোট করতে পারে অবলীলায়, যত সহজে অপমান করতে পারে, তেমন অন্যদের পারে না কখনও।

এতদিন পরে, এতকথার পরে এতদিন এতরাত এত উদার উন্মুক্ত সহজীয়া সাহসী ভালোবাসার চোখ গেল, চোখ গেল অভিনয়ের পর আপনার এই দ্বিধা ও সংকোচময় চিঠি আপনার সম্বন্ধে আমার ধারণাটাকে অনেক বদলে দিয়েছে।

রূঢ় কথা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না। আপনাকে কখনও দূরের বলে জানিনি, জানতে চাইনি; কিন্তু আজ আপনাকে দূরের-না-ভাবা মূর্খামি হবে।

আমার মনে হয়, আমরা নিজেরা যে কোনো মানুষই ঘরের আয়নার সামনে দাঁড়ালেই সম্পূর্ণ হই না। আমাদের নিজেদের, প্রত্যেকের বেলায়ই, আমরা কি, তার প্রমাণ পাই।

অন্য দশজন পুরুষ ও নারী আমাদের কি চোখে দেখে তার উপরে।

দশজন বলতে সমাজকে বলছি না। দশজন মানে, চেনা-পরিচিত ঘনিষ্ঠ গোষ্ঠীর কয়েকজন। তাদের চোখে, তাদের ভাবনায়, তাদের মূল্যায়নে আমরা কি এবং কতখানি তার উপর আমাদের সকলেরই সম্পূর্ণতা নির্ভর করে।

আমি যদি কখনও আপনার পরিপূরক হয়ে থাকি, যদি কখনও আমাতে আপনি সম্পূর্ণতা বোধ করে থাকেন তাহলে আপনি হয়ত ভুল করেছেন।

এখন থেকে আপনি আমাকে আপনার আয়নার একটি চুর-হওয়া টুকরো ছাড়া আর কিছু মনে করবেন না। আর এও বলছি যে, খালি পায়ে অনবধানে কখনও হাঁটবেন না যেন। পায়ে কাচ ফুটতে পারে।

রমাদি লিখেছেন যে আমার হ্যাংলামি দেখে উনি বিস্মিত। আমার হ্যাংলামি ও সস্তা স্বভাবের জন্যেই নাকি আপনার এ অধঃপতন।

রমাদি যে আপনাকে এতখানি ভালোবাসেন এ কথাটা আমার জানা ছিলো না। আপনিও যে রমাদিকে এতখানি ভালোবাসেন তাও আমার জানা ছিলো না।

আপনারা দুজনের কেউই বোধহয় একথাটা জানতেন না। লোকমুখে শুনেছি যে, ভুলেও স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াকে বিশ্বাস করতে নেই। এই মেঘ, এই রোদ্দুর। পরে তারা আবার এক হয়ে যায়; যে মধ্যে থাকে সেই বেচারীই তখন দুজনেরই চোখের বিষ হয়ে দাঁড়ায়।

এখন মনে হচ্ছে যে, কথাটা সত্যি। রমাদি আরো অনেক কিছু লিখেছেন। সেটা আমার উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ। সেটা আমি গায়ে মাখিনি। অন্য যা কিছু লিখেছেন তাও গায়ে মাখতাম না; যদি না আপনার চিঠির সুরে রমাদির সঙ্গে পুনর্মিলনের আভাস থাকত।

রমাদিকে অনেক কথা লিখতে পারতাম। কিন্তু তাঁর চিঠির জবাব আমি দেব না। আমি অনেক কিছু অবজ্ঞা করতে শিখেছি নিজের মনের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার জন্যে। তাই এই চিঠিকেও অবজ্ঞাই করব। তবে একটা কথা মনে হয় তাঁর সম্বন্ধে। যে-মহিলা তাঁর স্বামীর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা দেখে এতখানি ক্রুদ্ধ ও কাণ্ডজ্ঞানরহিত হন তাঁর নিজের স্বামীকে চোখে-চোখে রাখা তাঁর উচিত ছিল। উচিত ছিল, তাঁর মনকে ধীরে ধীরে নিজের কাছ থেকে দূর না সরিয়ে দেওয়া।

বিবাহিত পুরুষদের দেখে আমার কেবলি মনে হয় তাঁদের স্ত্রীরা তাঁদের অনেক ব্যাপারেই ঠকান; বিশেষ করে সেক্স-এর ব্যাপারে। যত সেক্স-স্টার্ভড পুরুষ-মানুষ দেখি, অন্য কোনো দেশে বোধহয় এত নেই। সেক্স ছাড়াও অন্য নানা ব্যাপারেও বিয়ের পর প্রতিটি মেয়েই বোধহয় মনে করেন যে আমার স্বামী আমাকে ছেড়ে যাবেন কোথায়? অথচ একবারও তাঁদের মনে হয় না যে, জীবনের কোনো সম্পর্কই চিরদিনের নয়। সব সম্পর্কই বাঁচিয়ে রাখতে হলে, ফুলের গাছের মত তাতে জল দিতে হয়; যত্ন করতে হয়। স্বামীকে প্রতিনিয়ত নিজের মন এবং শরীরের নতুনত্বে অবশ করে রাখতে হয়।

একথাটা হয়ত স্বামীদের বেলাতেও প্রযোজ্য।

শুকিয়ে-যাওয়া আপনাকে এই বোকা পাঠিকা-মেয়েটি যখন নতুন সবুজ কুঁড়িতে ভরে দিয়েছে, ঠিক এমন সময় আপনার স্ত্রীর এই নোংরা আক্রমণ এবং স্বামী-সোহাগিনীর থার্ড-রেট যাত্রা আমার পক্ষে অসহ্য।

দোষটা কার বেশি এখন বুঝতে পারছি না। এই পুরো ব্যাপারটার জন্যে, আমার জীবনের এক বিশেষ ও বিশিষ্ট অংশকে এমনি করে হেলাফেলায় নষ্ট হয়ে যাবার জন্যে আপনাকেই দোষী করতে ইচ্ছা করে।

কিন্তু দোষী আপনাদের কাউকেই করব না। সব দোষ আমার। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি, আপনারা জোড়ে, সুখে-শান্তিতে চিরদিন ঘরকন্না করুন।

আপনাকে কিন্তু আমি একজন বুদ্ধিমান ধারালো মনের পুরুষমানুষ বলে ভেবেছিলাম। আমরা বোকা-সোসা পাঠিকারা প্রিয় লেখকদের সম্বন্ধে ওরকমই ধারণা করে নিই। এখন বুঝতে পারছি, আপনি রীতিমত ভোঁতা।

একটা কথা বলব আপনাকে, কিছু মনে করবেন না।

প্রেম-টেম আপনার মত লোকের জন্যে নয়। রাতে বেলডাঙার কুমড়োর মত গোলগাল ফর্সা স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থেকে, পরদিন সকালে অন্য মেয়ের সঙ্গে প্রেম করা আপনাদের মানায় না।

প্রেম মানেই গভীরতা, জ্বালা, যন্ত্রণা! প্রেম মানেই সাহস।

প্রেম ব্যাপারটা, বিশেষ করে আমি প্রেম বলতে যা বুঝি, তা আপনার জন্যে নয়। আপনার প্র্যাকটিসও ছেড়ে দেওয়া উচিত। লেখাও ছেড়ে দিতে পারেন। আপনার বিশেষ-কেউ হবার প্রয়োজন বা যোগ্যতা নেই। দশটা-পাঁচটা অফিস করুন, তারপর সাজ-গোজ করে স্ত্রীকে নিয়ে পার্টিতে বা ক্লাবে বা হোটেলে যান। সবাই যা করে, তাই করুন। কারণ আপনি অন্য সবার থেকে আলাদা নন।

যদি আপনি বিশিষ্ট না হন, আপনার জীবনে যদি ধার না থাকে, সত্যিকারের চাওয়া-পাওয়া বোধ না থাকে, সত্যিকারের বিশ্বাস-অবিশ্বাস না থাকে, এবং সেই চাওয়া বা বিশ্বাসের পাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহস না থাকে, তাহলে আপনার লেখা ঢাউস-ঢাউস উন্যোসগুলো জোলো দুধের মত স্বাদগন্ধবর্ণহীন হতে বাধ্য। শুধু আমার মত কিছু বোকা পাঠিকা পড়ে বলেই, পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয় বলেই, কিছু ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে-ওঠা-প্রকাশক বই চায় বলেই যদি আপনার লিখতে হয়, তাহলে লেখক হিসেবেও আপনার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে বুঝতে হবে।

সুকুদা, এত কথা বলছি, কারণ আমার বলার অধিকার আছে বলে। একদিন আপনাকে আমি ভালবাসতাম– কতখানি যে ভালোবাসতাম তা হয়ত কোনোদিন আপনি বুঝতে পারবেন; যদি আপনি মানুষ হন। ভালোবাসতাম বলেই এত কথা বলছি।

আপমাকে দেখতে পাই কি না-ই পাই, আপনার কাছে থাকি কি না-ই থাকি, আপনার লেখা যেন পড়তে পাই। আর লেখা যদি লেখার মত না-ই হয় সেই পাতা-ভরানো পকেট-ভরানো লেখা কখনও লিখবেন না।

আমাকে কথা দিতে হবে যে, লিখবেন না। লেখার মত কিছু থাকলে তবেই লিখবেন।

যেদিন লেখক হিসেবেও আপনাকে আর ভালো লাগবে না সেদিন জানবেন আপনার ছুটির মনে আপনি চিরদিনের মত মৃত। আমার এই অনুরোধ রাখবেন সুকুদা। আপনাকে ঘিরে আমার অনেক আশা ছিল, অনেক কল্পনা; অনেক সাধ–অন্তত এই সাধটুকু আমার পূর্ণ করবেন আপনি।

ছোটবেলা থেকে আমি অনেকরকম মানসিক কষ্ট পেয়েছি। এ আমার কাছে কিছু নতুন নয়। তবে আপনাকে নিয়ে এত সব স্বপ্ন দেখে ফেলেছিলাম, নিজেকে এমন করে কল্পনার রঙীন আকাশে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম যে, এখন নিজেকে গুটিয়ে আনতে মনের বিভিন্ন খাঁজে-খোঁজে বড় ব্যথা লাগছে।

আপনি ত জানেন, আমি আপনার কাছে কিছুই দাবী করিনি শুধুমাত্র আপনার ভালোবাসা ছাড়া। সামাজিক মর্যাদা চাইনি, ঘর চাইনি, ছেলেমেয়ে চাইনি, আর্থিক ব্যাপারে আপনার উপর নির্ভর করতে চাইনি।

আমার এই চাওয়ার ব্যাপারে আমি খুবই আধুনিকা ছিলাম। কিন্তু দেখছি, আপনি সেই সেকেলেই রয়ে গেছেন।

আমি সত্যিই মনে মনে বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম যে আমি আর আপনি দুজনে মিলে এই সমাজের মুখে থুথু দেব–সবইকে দেখিয়ে দেব কি করে বাঁচার মত বাঁচতে হয় লড়াই করে কি করে বাঁচতে হয়। নিজেদের স্বাধীনতা নিজেদের আনন্দকে নিষ্কণ্টক করতে গিয়ে আমরা কোনো লোক বা মতের সঙ্গে ইচ্ছাবিরুদ্ধ সন্ধি যে করিনি, তা আমরা সকলকে দেখিয়ে দেব ভেবেছিলাম।

সুকুদা, ভালোবাসা কাকে বলে আমি কখনও জানিনি। সম্পর্ক কথাটার মানে কি, তাও বুঝি আমি জানতাম না। আপনার লেখা পড়ে, আমার যৌবনের প্রথম দিনগুলোতে ভালোবাসা সম্বন্ধে একটা স্বচ্ছ ধারণা ধীরে ধীরে আমার মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। তারপর দেখা হল আপনার সঙ্গে। আমার প্রিয় লেখককে চোখের সামনে আমার কাছে পেয়ে পুলকিত হয়ে উঠলাম। পুরুষমানুষ সম্বন্ধে আমার অল্পবয়সী মনের মধ্যে যে একটা আদর্শ ধারণা ছিল সেই ধারণার সঙ্গে আপনাকে মিলিয়ে দেখলাম; হুবহু মিলে যাচ্ছে।

আমার ছোটবেলা থেকে মনে হত পুরুষমানুষের সবচেয়ে বড় সার্থকতা তার কাজের ক্ষেত্রে, ঘরের মধ্যে বা বিছানায় নয়। যে পুরুষমানুষ দক্ষ, পরিশ্রমী, যে তার কাজের ক্ষেত্রে সম্মান পেয়েছে, সে তার জীবনের সবচেয়ে বড় পরীক্ষায়ই কৃতকার্য হয়েছে।

যে পুরুষমানুষ তার কাজের চেয়ে তার প্রেমিকাকে বা স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসে, সে যথার্থ পুরুষ কিনা সে বিষয়ে আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল।

কাজের ক্ষেত্রের পরেই তার ব্যক্তিগত জীবন। সে জীবনে প্রেম তার সবচেয়ে বড় উপাদান। যে-পুরুষের জীবনে কোনো মেয়ের সত্যিকারের ভালোবাসা নেই, সে স্ত্রীরই হোক বা প্রেমিকারই হোক, সে যতই দক্ষ হোক না কেন, সে একদিন না একদিন হেরে যেতে বাধ্য।

আমি অনেককে দেখে বুঝতে পারতাম যে আপনারা, পুরুষেরা মোটরগাড়ির ব্যাটারীর মত। আমরা আপনাকে প্রতিদিন পুনরুজ্জীবিত করি–যাতে পরদিন আপনারা আবার নতুন উদ্যমে, উৎসাহে ও উদ্দীপনায় কর্মক্ষেত্রে জয়মাল্য পান।

আপনাকে দেখে আমার কষ্ট হত, কান্না পেত। চোখের সামনে দেখতে পেতাম একটা খুব বেশি ভোল্টর ব্যাটারী একেবারে ফুরিয়ে গেছে, ফুরিয়ে যাচ্ছে–যাকে পুনরুজ্জীবিত করার কেউই নেই।

আমি জানি না, আপনি আমার একথা মানবেন কিনা। এতক্ষণ শুধু আপনার কথাই বললাম। এবার আমার কথা বলি।

একথা সত্যি যে আপনার উপর আমি ভীষণভাবে নির্ভর করেছিলাম, স্বর্ণলতার মত আপনাকে আঁকড়ে ছিলাম মনে মনে আমার সব নরম কল্পনায়। কিন্তু যা হবার তা হয়েছে।

আমার জন্যে ভাববেন না।

কখনও কারো দয়া আমি চাইনি, করুণা চাইনি কারো–যা নিজের অধিকার অর্জন না করা যায়, এ জীবনে যা শুধু দয়া বা করুণা বা ভিক্ষার বা ছল বা চাতুরীর ধন, তা কখনও থাকে না। তা পেলেও তাকে ধরে রাখা যায় না। তাই আপনার কাছ থেকে কোনোরকম দয়া বা করুণা আমি চাই না।

মাঝে মাঝে মনে হয়, আপনার হেমিংওয়ে বা আন্তোনিওনি বা আপনার অন্যান্য আত্মহত্যার উকিলরা বোধহয় তাঁদের সওয়ালে নির্ভুল। মনে হয় সত্যিই ত! জীবন যদি ভগবানের দান হয় তবে তা নিজের ইচ্ছেমত শেষ করার অধিকারটুকুও কেন ভগবানের দান বলে স্বীকৃতি হবে না?

আপনার কাছ থেকে আসার পর লাইব্রেরী থেকে এনে এক এক করে রবীন্দ্রনাথের সব লেখা পড়তে আরম্ভ করেছি।

কালকেই হঠাৎ দেখা বলে একটা কবিতা পড়ছিলাম।

পুরনো প্রেমিক-প্রেমিকার দেখা হয়ে গেছে রেলগাড়ির কামরায়; হঠাৎ। প্রেমিকা তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে উল্টোদিকের বার্থে বসে। কথা হলো না। কোনো কিছু বলা হলো না একে অন্যকে। গাড়ি থেকে নামবার আগে মেয়েটি তার প্রেমিকের কাছে উঠে এসে ফিসফিস করে শুধোলো।

আমার গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি? ছেলেটি বলল, রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে। বলেই ভাবল, কি জানি, বানিয়ে বলল না ত?

সুকুদা, কবিতাটা খুব ভালো। কিন্তু জীবনে কি তা হয়? রাতের কোনো তারাই কি দিনের আলোর গভীরে থাকে? থাকেও যদি, তাহলে আমার লাভ কি যদি নাই-ই দেখতে পেলাম? নাই-ই চিনতে পেলাম? তাহলে থাকল কি না থাকল তাতে আমার কি আসে যায়?

অনেক টুকরো টুকরো কথা, অনেক স্মৃতি মনে পড়ে। মনে পড়ে, যেদিন আপনার সঙ্গে প্রথম আলাপ হয়েছিল সেদিনের কথা। সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ে সেই শেষ রবিবারের কথা- যেদিন আপনার মালাক্সিগঞ্জে সেই পোড়া বাড়িটা দেখতে গেছিলাম।

হয়ত এসব কথা, এইসব হাসির টুকরো, আপনার আমার দিকে সেই আশ্চর্য চোখে চেয়ে থাকা এসবই মনে পড়বে। বার বার; যতদিন বাঁচব।

আপনি আমাকে যত তাড়াতাড়ি ভুলে যাবেন ততই আপনার পক্ষে মঙ্গল।

আশা করব, আপনি সুখী হবেন নতুন করে রমাদিকে নিয়ে। আপনারা দুজনেই নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন যে, ছুটি আর কখনও আপনাদের সুখ ও শান্তি বিঘ্নিত করবে না।

ইতি— আপনার ছুটি।

ছুটির চিঠি পড়া শেষ করে বসে বসে ভাবছিলাম।

গত কয়েক মাসে আমার মরুভূমির মত জীবন বেশ একটা আশ্চর্য নিটোল ওয়েসিসের মত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

মনের মধ্যের অনেক রুক্ষ অশ্বারোহী বেদুইন ডাকাতদের সঙ্গে যুদ্ধ করে বুকফাটা তৃষ্ণায় অনেক হেঁটে, অনেক হামাগুড়ি দিয়ে অবশেষে তৃষ্ণার জলের দেখা পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম : এবারে শুধুই খেজুর পাতার ঝিরঝিরে হাওয়া, নীল জলে ছোট-ছোট সুখের ঢেউ আর ঠাণ্ডা হায়ায় ভরা শান্তি; সুনিবিড় শান্তি।

অথচ আমার ওয়েসিসের কাছাকাছি পৌঁছেও আবার কোন্ মরীচিকা আমাকে ভুল পথে টেনে নিয়ে গেল?

রমা যখন ভালো হয়, যখন ও হয় ও হতে চায়, তখন ওর মত ভালো কেউই নয়। কিন্তু ও কখন ভালো হবে তা সম্পূর্ণ ওর মর্জির উপরে নির্ভর করে।

বাৎসরিক হিসাব করলে দেখা যাবে বারো মাসের বছরে ও হয়ত সারা বছরের মধ্যে একমাস ওর ভালো মুড থাকে। বাকি এগারো মাসই অফ-মুডে। তাই যতবারই ওর ক্ষণিক ভাললাতে চমৎকৃত হয়ে ওকে আমি মনে মনে অবলম্বন করতে আরম্ভ করি, ও পরক্ষণেই আবার ওর খারাপত্বে ফিরে যায়।

এর আগেও বহুবার আমি ওকে ক্ষমা করেছি, নিজেকে বুঝিয়েছি, বুঝিয়েছি যে ও খেয়ালী সবাই একরকম হয় না; এবং এভাবে নিজেকে অনেক নীচু করে অনেক হার ও ত্যাগ স্বীকার করে ঘরের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা করেছি বহুবার, কিন্তু কখনও সেই শান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

আমার নিজেকে মারতে ইচ্ছে করছিল। ভাবছিলাম কেন ছুটিকে ঐ চিঠিটা লিখতে গেলাম। বেচারী কি ভাবল আমাকে? ভাবল, আমি বুঝি ওর সঙ্গে নেহাৎ একটু ভালোবাসা ভালোবাসা খেললাম। অন্য অনেক সস্তা পুরুষের মত।

অথচ আমি মনে মনে জানি যে, যে-রমা আমার সঙ্গে সন্ধি করে গেল সেই-রমাই বিনা-প্ররোচনায় কালই হয়ত যুদ্ধের আঁধি ওড়াবে। আমাকে অন্ধ করে দেবে আবার।

ছুটির হাত ধরে জঙ্গলের পথে পথে হেঁটে আমি নতুন করে জীবনের মানে, বেঁচে থাকার মানে, সুখের মানে আবিষ্কার করার চেষ্টায় ঘুরছিলাম, এমন সময় রমা এসে সব গোলমাল করে দিল।

বারে বারে বুঝতে পারি, আমার মন বড় নরম। এই মন শক্ত করে কোনো কিছু কখনও আঁকড়ে ধরতে শেখেনি। যা-কিছু ধরেছে, আলতো করে দ্বিধাগ্রস্ততায়; তাই অন্যমনস্ক হলেই, অসাবধানী হলেই, হাতের মুঠি বারেবারে আলগা হয়ে গেছে–যা মুঠি ভরে ছিল, তা খোয়া গেছে। তেমন করে ঘৃণাভরে এ মন কিছু ছুঁড়ে ফেলতেও শেখেনি।

দোষ হয়ত রমারও নয়, ছুটিরও নয়; দোষ হয়ত আমার নিজের।

জীবনে সত্যি করে কি চেয়েছি, তাই-ই বোধহয় আমি এখনও বুঝে বা জেনে উঠতে পারিনি।

সুখের ও দুঃখের সমস্ত সংজ্ঞাগুলো কেমন ধোঁয়া-ধোঁয়া হয়ে আছে এখনও। ধোঁয়া হয়ে মনের দিগন্তরেখার উপর ভারী হয়ে আছে।

আশ্চর্য! এত বছরেও কি চেয়েছি আর কি চাইনি তা তেমন করে বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে আর কবে বুঝব? মিস্টার বয়েলস-এর মত আমরা সবাই-ই কি যমদূতের সঙ্গে দাবা খেলার দিনই হঠাৎ করে জানতে পাব যে এই দারুণ জীবনটা একেবারেই নষ্ট করে গেলাম? যাকে পাবার তাকে তেমন করে পেলাম না–যা চাইবার তা তেমন করে চাইলাম না। যদি তাই-ই হবে, তাহলে এই উদ্দেশ্যহীন, এলোমেলো প্রশ্বাস নেওয়া ও নিঃশ্বাস ফেলার মানে কি? কাজ করার মানে কি? এই জীবনকে প্রলম্বিত করার জন্যে খাওয়া-দাওয়ার প্রয়োজন কি? জীবন সম্বন্ধে এত হৈহট্টগোলের দরকার কি?

ভাবছিলাম, আমার মনে এই মুহূর্তে যে-ভাবনা ঝড় তুলেছে সে-ভাবনা কি সকলের মনেই ঝড় তোলে? না আমিই অন্যরকম? আমি একাই ব্যতিক্রম?

পেঁপে গাছে একটা দাঁড়কাক বসে লালটাগরা দেখিয়ে হাঁ করে খা-খা খা খা করে ডাকছিল। একটা হলুদ প্রজাপতি উড়ছিল পেয়ারাগাছের ছায়ায়। দূর থেকে ব্রেইন-ফিভার পাখি ডাকছিল ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে। পিউ কাঁহা, পিউ-কাঁহা, পিউ-কাঁহা।

সেই মুহূর্তে, সেই অবশ মনে ও বিবশ শরীরে বসে হঠাৎ ছুটির জন্যে, ছুটির কথা মনে পড়ে, আমার সমস্ত ভিতরটা হু-হু করে উঠল গরমের দুপুরের হাওয়ার মত। আমার কেঁদে কেঁদে বলতে ইচ্ছা করল; ছুটি ও ছুটি, তোমাকে আমি ভালোবাসি ছুটি; তোমাকে আমি ভীষণ ভালবাসি। বলতে ইচ্ছে করল, আমি বড় নরম ছুটি, আমাকে তুমি জোর দাও, আমাকে হাত ধরে তুমি আমার সুখের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরে নিয়ে চল। সে ঘরে আমি চিরদিন নিজেকে বন্দী করে রাখব। তোমার মুখোমুখী।

তুমি এমন কিছু কর, যাতে তোমাকে আর কখনও না হারাতে হয়। আমি তোমার উপর সব ব্যাপারে নির্ভর করব। আমার সুখ, আমার সম্পদ, আমার শান্তি সবকিছু ব্যাপারে; শুধু আমাকে তুমি এমন করে ত্যাগ করো না তুটি। আমার জীবনে তুমি ভগবানের আশীবাদী ফুলের মত এসেছিলে; তুমি সেই আশীর্বাদ হয়ে চিরদিন আমার কাছে থেকো।

আমাকে ভুল বুঝো না, আমাকে ছেড়ে যেও না।

তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই ছুটি, তোমার উপর আমি কতখানি নির্ভর করে আছি তুমি জানে না, তুমি জানো না তোমার উপর আমার বাঁচা-মরা নির্ভর করছে। আমি কিছু কখনও কেড়ে নিতে শিখিনি ছুটি, কাউকে আঘাত দিয়ে নিজের সুখ ছিনিয়ে নিতে শিখিনি। তুমি আমাকে ভুল বুঝো না, তুমি আমার সমস্ত দোষ সত্ত্বেও আমাকে এমন করে অভিমানে ত্যাগ কোরো না।

ছুটি, আমি তোমার কাছে আমার জীবন ভিক্ষা চাইছি।

আজকে এই মুহূর্তে তুমি আমার জীবনে না থাকলে আমার জীবনের কোনো মানে নেই, আমার কর্মক্ষেত্রে সার্থক হওয়ার কোনো তাগিদ নেই। কিছুই করার মত উৎসাহ আর আমার অবশিষ্ট থাকবে না ছুটি। তুমি যদি না থাকো।

আমি আমার একার জন্যে কখনও নিজেকে ভালো করতে বা সফল করতে চাইনি। কোনো পুরুষই হয়ত তা চায় না। কারণ কোনো পুরুষেরই তার নিজের জন্যে তেমন কিছুরই প্রয়োজন নেই। সহজেই সে নিজেকে খাইয়ে-পরিয়ে রাখতে পারে।

আমরা যা-কিছু করি, যা-কিছু করতে চাই, তা অন্যের জন্যে, ভালোবাসার জনের জন্যে, ভালোবাসার সন্তানের জন্যে। তুমি যদি আমাকে এমন করে এই অবস্থায় বিসর্জন দাও, তাহলে আমার চলা থেমে যাবে। কারণ, আমার নিজের কোনো গন্তব্য নেই।

তোমার কাছে আমি নতজানু হয়ে ভিক্ষা চাইছি ছুটি– একটু উষ্ণতা ভিক্ষা চাইছি।

আমার শরীর, আমার মন, আমার সমস্ত সত্তা বড়ই শীতার্ত। আমি সবসময়, বহুদিন হল সমস্ত সময় আমার ভিতরে একটা টোকা-খাওয়া টাকা-কেম্নোর মত কুঁকড়ে আছি। আমাকে তুমি তোমার সুন্দর সহজ ভালোবাসার উষ্ণতার আঙুলে আমার এই শীতার্ত কুঠুরী থেকে মুক্ত করো, আমাকে উদার উষ্ণতার রোদে তোমার হাত ধরে তোমার যেখানে খুশি সেখানে নিয়ে চল।

কোনো প্রশ্ন করব না আমি, কোনোরকম জেরা করব না তোমাকে। তুমি আমাকে এই শীতের দিন থেকে বাঁচাও। আমার লক্ষ্মী সোনা, আমার জন্মজন্মের ছুটি, তুমি আমাকে এমন করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিও না অবহেলায়। তোমার কাছে আমি আমার প্রাণ ভিক্ষা চাইছি। ভিক্ষা চাইছি আমার জীবন।

কতক্ষণ ওখানে বসেছিলাম হুঁশ ছিলো না।

লালি এসে যখন চান করার কথা বলে গেল তখন খেয়াল হলো।

যে কথা ভাবা যায়, যে কথা নিয়ে মনের মধ্যে তোলপাড় করা যায়, সেই সব নগ্ন বুভুক্ষু ভিখারীকে অন্য কারো সামনে আনা যায় না। আনতে লজ্জা করে। আত্মম্ভরিতায়, মিথ্যা হাস্যকর গর্বে আটকায়। সব ভাবনা দেখানো গেলে, দেখাতে পারলে, দুঃখ পেত না কেউই এমন করে, যেমন করে সকলেই পায়, সকলের প্রিয়জনের কাছে। তক্ষুনি ছুটিকে চিঠি লিখতে বসলাম। লিখলাম।

কঙ্কা
ম্যাকলাস্কিগঞ্জ

ছুটি,

তোমার চিঠি এইমাত্র পেলাম।

তোমার কাছে একটু সময় চেয়েছিলাম মাত্র। সেই সময়-চাওয়া চিঠি পড়ে এত কথা লিখবে তুমি, তা বুঝতে পারিনি।

রমার চিঠির বক্তব্য বা শালীনতার দায়িত্ব আমার নয়। আমার ধারণা ছিল তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী এবং লোকভয় বা সমালোচনার ভয় তোমার নেই। কেউ অন্যায় করে তোমাকে কিছু বললে, তা তুমি ন্যায়ত অবহেলা করতে পারে বলেই আমার বিশ্বাস ছিল।

তুমি যে-ধরনের চিঠি লিখেছ, তার পরে তোমাকে আমার কিছু বলার নেই।

তুমি যদি সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাও, আমাকে আমার বক্তব্য জানানোর সুযোগ না দিয়ে, তাহলে আমিই বা কেন তোমাকে আমার বক্তব্য জানাতে যাব?

তুমি যেমন কারো দয়া চাও না, আমিও তেমনই কারো দয়া চাই না। তাতে আমার যা হবে তা হবে। তুমি নিজে যা ভালো বোঝ তাইই করবে।

তোমার সঙ্গে শীগগীরই একবার দেখা করব। দুচার দিনের মধ্যে। আশাকরি এই সময়টুকু তুমি আমাকে দেবে। তুমি যদি মনে করো যে, দুচার দিন সময়ও তুমি আমাকে দিতে রাজী নও, তাহলে তোমার মন যা চায় তাইই কোরো।

আমার না হয় তুমি ছাড়া কেউই নেই, কিন্তু তোমার ত এ্যাডমায়ারারের অভাব নেই। রাঁচীতেও রুদ্র-টুদ্র তোমার কত বন্ধুই ত আছে। তুমিও ভেবো না যে, আমি তোমার বক্তব্য বুঝতে পারি না।

হঠাৎ যদি এতদিনের সম্পর্ক নষ্ট করতে চাও তার জন্যে কোনো ছুতোর দরকার কি? তোমার লজ্জা কিসের? চুলের আশ্রয়ই বা নেওয়ার দরকার কি? তুমি ত পরাধীন নও?

তোমার একমাত্র দোষ এই যে, তুমি নিজেকে বড় বেশি বুদ্ধিমতী বলে মনে করো। নিজে যা ভাব তাইই ঠিক, অন্য কারো কথাই কথা নয় তোমার কাছে।

তুমি চাও, তোমাকে সকলে বুঝুক, ভুল-না-বুঝুক। কিন্তু তুমি নিজের সম্বন্ধে এতই কনফিডেন্ট যে, অন্যকে ভুল বুঝতে তোমার একটুও সময় লাগে না।

রাঁচীতে আমি তোমাকে একলা চাই একদিন।

তোমার অগণিত বন্ধুবান্ধব এ্যাডমায়ারারেরা যেন সেদিন তোমার কাছে না থাকে। তুমি যেমন মনে করো আমার উপর তোমার দাবী আছে, আমাকে যা খুশি তাই বলার অধিকার আছে, আমিও তাই মনে করি। অন্তত সেদিন সেই দাবী নিয়েই যাব তোমার কাছে। আমি তখন তোমার ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেব।

ইতি– সুকুমার বোস।

মালু পেয়ারা গাছের তলা খুঁড়ছিল।

ওকে তক্ষুনি ডেকে বললাম, চিঠিটা দৌড়ে গিয়ে ডাকে দিয়ে আসতে। যাতে এগারটার গাড়ি ধরতে পারে।

চিঠি পোস্ট করতে দিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে, আমি চান করতে গেলাম। বাথরুমে ঢুকেছি প্রায় দশ মিনিট, গায়ে জলও ঢেলেছি এমন সময় আমার মাথার মধ্যে একশ দাঁড়কাক একসঙ্গে ডেকে উঠল।

বিদ্যুৎচমকের মত আমার মনে পড়ল আমি একটু আগেই নিজের পায়ে নিজে কুড়ল মেরেছি।

মনে হল, যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে বহুদিন লেগেছিল তা ভাঙা হয়ে গেছে কয়েক মিনিট আগের একটি হঠকারী চিঠিতে।

আমার অনেক অনেক পাতাভরানো লেখা পড়ে একদিন যে আমার মনের কাছে এসেছিল, তাকে এক পাতার একটি চিঠিতে আমিই আবার মনের বহুদূরে পাঠিয়ে দিয়েছি। একজন ভালোবাসার জনের অভিমানকে আমি ভুল বুঝে, সেই নরম অভিমানের উত্তর দিয়েছি নোংরা কর্কশ রাগে।

যত তাড়াতাড়ি পারি বাথরুম থেকে বেরিয়ে ছাড়া-পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়েই পায়ে চটি গলিয়ে আমি দৌড়ে গেলাম পাকদণ্ডী পথ দিয়ে পোস্ট-অফিসের দিকে।

অত জোরে আমার অসুখের পর আমি কখনও দৌড়য়নি। কিছুদূর যেতেই আমার বুকে হাঁফ ধরতে লাগল। অনেকখানি পথ। উঁচুনীচু পাহাড়ি পাকদণ্ডীতে।

পোস্ট-অফিস তখনও বেশ দূর। কিন্তু সেই ঝর্ণাটার কাছেই দেখা হয়ে গেল মালুর সঙ্গে। সে ফিরছিল।

আমাকে দেখে অবাক হয়ে ও তাড়াতাড়ি বলল, চিঠি সে ফেলে দিয়েছে। শুধু তাইই নয়, চিঠির থলি নিয়ে ট্রেনও চলে গেছে।

মালু আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল অবাক চোখে।

একটা কর্তব্যকর্ম সুষ্ঠুভাবে করে আসার পরও এমন ভর্ৎসনার চোখে আমি কেন ওর দিকে চেয়ে রইলাম ও বোধহয় বুঝতে পারল না।

মালু আর আমি দুজনে পাশাপাশি আস্তে আস্তে হেঁটে ফিরে আসতে লাগলাম।

যখন সেই মহুয়াতলায় টাঁড়ে এসে পৌঁছলাম, তখন আমার ছুটির কথা মনে হল বারেবারে।

প্রথম শীতে যখন এ মাঠ হলুদ হয়েছিল, ছুটি নরম সকালের রোদে আমার বুক ঘেঁষে দাঁড়িয়ে অস্ফুটে বলেছিল,

সুখ নেইকো মনে,
নাকছাবিটা হারিয়ে গেছে হলুদ বনে বনে।….

ভাবছিলাম, ছুটি কি আর কখনও আমার সঙ্গে, আর কোনো শীতে এই মাঠ কিংবা অন্য কোনো হলুদ মাঠ পেরোবে? আমার হাতে হাত রেখে, ও কি আমার বুক ঘেঁষে পরম স্বস্তিতে, শান্ত ভালোলাগায় আর কোনোদিনও দাঁড়াবে?

আমার এ অভিশপ্ত জীবনে?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress