১৭-১৮. বিকেলবেলা হেঁটে ফিরে
বিকেলবেলা হেঁটে ফিরে এসে ছুটিকে চিঠি লিখতে বসলাম।
ছুটি,
আজ বিকেলে একা একা হাঁটতে গেছিলাম জঙ্গলের পথে। জঙ্গলের পথে একা একা হাঁটার মত এমন আনন্দ আর কিছু নেই। সঙ্গে অন্য লোক থাকলে তার সঙ্গে কথা বলতে হয়, মনোযোগ নষ্ট হয়। মন ভরে, চোখ ভরে আমার প্রেমিকা, আমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত প্রেমিকাকে দেখা যায় না, তাকে প্রেম নিবেদন করা যায় না।
প্রকৃতিই আমার একমাত্র প্রেমিকা যে আমাকে শুধু আনন্দই দিয়েছে, দুঃখ দেয়নি কোনোরকম; তাই ত মাঝে মাঝে প্রকৃতির ছায়ায় এসে নিজের মনের যত রক্তাক্ত ক্ষত আছে সেগুলোকে সারিয়ে তুলি।
পথটা চলে গেছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে উঁচু নীচু। বিকেলের স্নান সোনা রোদ এসে তার সোনার আঙুল ছুঁইয়েছে বনের নরম কোমল সবুজ গায়ে। যেখানে যেখানে জঙ্গল ফাঁকা, সেখানে চোখ পৌঁছয় দূরের পাহাড়ে–উপত্যকা পেরিয়ে সবুজ ঢাল গড়িয়ে গিয়ে আবার উঁচু হয়ে পাহাড়ে মিশে গেছে।
এখানে ওখানে পায়ে-চলা শুকনো লাল মাটির পথ বুড়ো মানুষের উধাও ভাবনার মত নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে জঙ্গলের গভীরে।
ইচ্ছে করে, এই সমস্ত পথই যদি আমার জানা থাকত তাহলে কি ভালোই না হত। তাহলে সমস্ত গন্তব্যেই যাওয়া যেত নির্ভুল ঠিকানা চিনে। কিন্তু জীবনের ঝুঁড়ি পথগুলোর মতই জঙ্গলের কুঁড়ি পথগুলোও সব চেনা যায় না। জানা হয়ে ওঠে না। চোখে পড়ে কোনো ওঁরাও যুবতী লাল শাড়ি পরে মাথায় ঝাঁকা নিয়ে এসে পৌঁছেছে সঁড়ি পথ বেয়ে বড় রাস্তায়, কোথাও বা দেখা যায় কোনো বিবশ বৃদ্ধ সমস্ত নতুনত্বকে দ্বিখণ্ডিত করবে বলে কোন কঠিন সংস্কারের কালো কুৎসিত কুঠার হাতে অন্য কোনো সঁড়ি পথে মিলিয়ে যাচ্ছে বড় রাস্তা ছেড়ে।
কত কী ভাবনা ভীড় করে আসে মাথায়, কত কী ভাবনা দানা বাঁধে, গুঁড়িয়ে যায়; আবার দানা বেঁধে ওঠে। কত সুখস্মৃতি মনে পড়ে যায়, কত অতীতের আরক্ত কথা, ভাবনায় অজানা ভবিষ্যৎ কোনো হলুদ পাখির মত ডুবন্ত সূর্যকে ধাওয়া করে হারিয়ে যায় জঙ্গলের শরীরে তাকে ভালো করে দেখার আগে, বোঝার আগেই।
হাঁটতে হাঁটতে পথটা যেখানে একটা টিলার উপরে এসে উঠেছে সেখানে উঠে আসতেই সমস্ত কান, সমস্ত ইন্দ্রিয় দুঃখে ভরে গেল- চতুর্দিকের তিতিরের কান্নায়।
অনেকদিন আগে রমাপদ চৌধুরীর একটা গল্প পড়েছিলাম, নাম তিতির কান্নার মাঠ। তুমি কি গল্পটা পড়েছ? না পড়লে গল্পটা পড়ে নিও-রমাপদবাবুর কোনো-না-কোনো গল্প-সংগ্রহের বইয়ে এ গল্প নিশ্চয়ই স্থান পেয়েছে।
যখনি কোনো তিতির কান্নার মাঠে একা একা এমনি কোনো নির্জন ম্লান বিকেলে এসে দাঁড়াই, অমনি আমার ঐ গল্পটার কথা মনে পড়ে যায়। আমাদের প্রত্যেকের বুকের ভিতরেই একটা তিতির কান্নার মাঠ আছে সেখানে শুধুই বোবা প্রতিকারহীন প্রাত্যহিক কান্না– যে মাঠে দাঁড়িয়ে কেবলি ঝড়ের প্রদীপের মত উজ্জ্বল অথচ অনিশ্চিত জীবনকে ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু তিতির কান্নার মাঠ পেরিয়ে যেই টিলা ছাড়িয়ে নেমেছি, দেখি, সামনেই ডানদিকে একটি সবুজ মাঠ–কি সব ফসল লেগেছে তাতে- অসময়ে। রোদের সোনা, বনের সবুজ মিশে এক দারুণ ছবির সৃষ্টি হয়েছে। এই মাঠ দেখেই আবার বাঁচতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে প্রদীপটাকে দুহাতে আড়াল করেই আমাদের চলা উচিত, তামাদের বাঁচা উচিত।
বনের মধ্যে এলেই আমার নতুন করে মনে হয় এখানে দুঃখও আছে, আনন্দও আছে, মৃত্যুও আছে, জীবনও আছে, আশাও আছে, নিরাশাও আছে। প্রকৃতির মত করে আর কোনো প্রেমিকা আমাদের শেখাতে পারে না, এমনকি ছুটিও না, যে জীবনের চরম ও পরম মানে ও গন্তব্য হচ্ছে একটু উষ্ণতা, সমস্ত শীতার্ত মুহূর্ত সত্ত্বেও নীচতা, হীনতা, স্বার্থপরতা, ঈর্ষা সব সত্ত্বেও আমাদের প্রত্যেকেরই বেঁচে থাকা উচিত–বেঁচে থাকা উচিত এই জন্যেই যে প্রত্যেক তিতির কান্নার মাঠের পরেই একটি সবুজ-সোনার ঢাল থাকে।
মনে পড়ে যায় যে, জীবনে আনন্দ কখনও দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সুখও নয়; এই দুঃখ, এই একাকীত্ব, এই মনে মনে আত্মহননের অনুক্ষণ চিন্তা পেরিয়ে এলে কখনও হঠাৎ আনন্দের উষ্ণ হাতে হাত রাখা যায়।
কিন্তু শুধু কিছুক্ষণের জন্যেই।
তবু এত দুঃখ, এত গ্লানি, এত অনিশ্চয়তার মাঝে আনন্দই, একমাত্র আনন্দই নীরবে বিরাজ করে। সমস্ত কিছু ছাপিয়ে একমাত্র এক অমোঘ অনাবিল আনন্দই বাঁশী বাজায়।
হঠাৎ একটা অচেনা পাটি ডাক দিতে দিতে সে ডাক আমার সমস্ত মন, সমস্ত মনের কেন্দ্রবিন্দুকে চমকিয়ে দিয়ে জঙ্গলের মধ্যে হারিয়ে গেল। হারিয়ে যাবার আগে এ গাছে একবার ও-গাছে একবার বসে বসে তার ছোট্ট ঠোঁটে একরাশ আনন্দের আভাস বাতাসে বাতাসে ছড়িয়ে দিয়ে গেল।
আমার খুব ইচ্ছে করতে লাগল–তুমি যদি এখন আমার পাশে থাকতে।
তোমার ছিপছিপে তন্বী সুগন্ধি শরীর, তোমার কেয়াফুলের গন্ধভরা মন, তোমার ভেজা-ভেজা মিষ্টি নরম ঠোঁট, তোমার ফিঙেমত কালো উজ্জ্বল চোখ দুটি নিয়ে তুমি যদি আমার পাশে এই মুহূর্তে থাকতে। যদি থাকতে, তাহলে বিশ্বাস করো, কোনো কথা বলতাম না তোমার সঙ্গে। তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরতাম না। শুধু তোমার পাশে পাশে নিঃশব্দে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝে তোমার দিকে চাইতাম আর ভালো লাগায় মরে যেতাম।
আমি তখন নিশ্চয় করে জানতাম যে, আমি মিসেস কার্নি নই, প্যাট প্লাসকিন নই, আমি মিস্টার বয়েলস নই, এমনকি পরশপাথর খুঁজে বেড়ানো অশান্ত, অবুঝ কৈশোরের যন্ত্রণার লাবুও নই। অন্তরে বুঝতে পেতাম যে, আমি একা নই, আমার সমস্ত অস্তিত্ব সার্থক তোমার অস্তিত্বে।
তুমি যদি পাশে থাকতে, তবে তোমাকে কোনো স্থূলভাবে পেতে চাইতাম না, মনে মনে পাওয়া ছাড়া। তোমার শারীরিক অস্তিত্ব আমার মানসিক সত্তাকে এক দারুণ সুগন্ধি জৈবিক বনজ-গন্ধভরা পাওয়াতে ভরিয়ে দিত। বনের মত বনজ ও শারীরিক স্থূলতা আর কিছুতেই নেই, আবার বনের মত মনজ ও মানসিক সূক্ষ্মতাও আর কিছু নেই। যারা বনকে দু চোখ ভরে দেখেছে, দেখতে চেয়েছে, যারা হৃদয় ভরে বনকে পেয়েছে তারাই একথা স্বীকার করবে।
ছুটি, ও আমার জন্মজন্মের ভালোবাসার ছুটি, তুমি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছ, কিন্তু আমারও তোমাকে অনেক কিছু শেখাবার আছে।
আমি আইনজ্ঞ বলে তোমাকে জুরিসপ্রুডেন্স বা কনস্টিটুশ্যানাল আইন শেখাবার মত মূৰ্থ নই। কারণ আমার চেয়ে বড় আইনজ্ঞ, বড় ব্যারিস্টার লক্ষ লক্ষ আছে। পৃথিবীর সবচাইতে বড় ব্যারিস্টারের রাজত্বও হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টের বড় বড় খিলানওয়ালা থমথমে বাড়িগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ–সেই রাজত্বে কোনো গর্ব নেই; সে রাজত্ব লাবুর রাজাদের চেয়েও দরিদ্র।
আমি সে রাজত্বের রাজা নই। রাজা হতে চাইনি।
আমি আমার বনের রাজা, আমার মনের রাজা। এ রাজত্ব কোনো গম্বুজে-খিলানে, কোনো তকমাধারী আদালীর সেলামে সীমিত নয়–এ রাজত্ব দিগন্ত অবধি ছড়ানো আছে কত ফুল, কত পাখি, কত প্রজাপতি, কত কাচপোকা, কত পাহাড়, কত নদী, কত লতা, কত গাছ। এ রাজত্বের সীমানা অসীম।
আমার প্রজা হবে? আমার ছাত্রী হবে তুমি ছুটি?
তোমার হাত ধরে বনে বনে ঘুরে তোমাকে কত কি শেখাব আমি, কত পাখির নাম, কত ঘাস ফুলের নাম, কত কাচপোকার নাম। আমি তোমার মত নোটবই মুখস্থ করে তুমি যেমন ছাত্রদের পড়াতে তেমন করে পড়াব না, আমি তোমাকে বনের গালচেয় পা ফেলে ফেলে, পাখীর গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে, সূর্য ওঠা এবং সূর্য ডোবার ঘড়ির দিকে চোখ রেখে পড়াব।
আমার ছাত্রী হলে তুমি জানবে, একদিন নিশ্চয়ই জানবে যে বইয়ের মধ্যে কোনদিনও কিছু লেখা থাকে না, লেখা যায় না। শাশ্বত যা চিরস্থায়ী যা তীব্র অনুভূতিতে মেশা জারজ জীবনযন্ত্রণায় সত্য, সেই সব চিরকালীন জানা শুধু আছে বনের মধ্যে, তোমার আমার মনের মধ্যে।
তোমার সুন্দর লতানো নারী শরীর, আমার স্বয়ম্বর ঋজু পুরুষ শরীর, তোমার শারীরিক আর্তি, আমার শারীরিক আর্তি, তোমার মনের দুঃখ এবং আনন্দ মেশা গোঙানী, আমার মনের মন্টাজ এ সমস্তই আমাদের প্রকৃতিই দিয়েছে। প্রকৃতির চেয়ে বড় এনসাইক্লোপিডিয়া কখনও কোনো দেশে হবে না। এর মধ্যেই সব প্রশ্ন, জীবনের সব উত্তর, এর মধ্যেই জ্বালা, এর মধ্যেই নিবৃত্তি, এর মধ্যেই উদ্দাম অশান্তি, আবার এর মধ্যেই সমাধি।
কি ছুটি? তুমি আমার পড়ুয়া হবে?
দ্যাখো কি বলব বলে কাগজ-কলম নিয়ে বসেছিলাম, আর কি বলতে বসেছি।
তোমাকে আজ চিঠি লেখার প্রধান কারণ ছিল তোমাকে জানানো যে, রমা এসেছিল আমার কাছে সবান্ধবে।
তোমাকে একটা কথা বলার দরকার যে, রমার এবারের ব্যবহার আমাকে অবাক করেছে।
ও আমার কাছে এসেছিল সাদা পতাকা উড়িয়ে, সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, বুঝতে পারছি না, আমার কি করা উচিত।
তুমি তোমার চিঠিতে তোমার স্বপ্নের কথা লিখেছিলে। আমারও চিঠি পড়ে খুব অবাক লেগেছে। তাহলে বোধহয় এখনও টেলিপ্যাথী বলে কিছু আছে।
তোমাকে মিথ্যা বলব না, কারণ আমি বিশ্বাস করি না যে মিথ্যাকে বা ভানকে আশ্রয় করে জীবনে কিছু পাওয়া যায়। পাওয়া যে যায় না, তা নয়, কিন্তু তা নিতান্তই মেকী, স্বল্পস্থায়ী; তাতে আনন্দ নেই। যে-কোনো গভীর আনন্দই গভীর দুঃখ থেকে জন্মায়। গভীরতা না থাকলে দুঃখ বা সুখ কোনোদিনই তেমন করে নিজেকে আচ্ছন্ন করে না বলেই মনে হয়। আশ্লেষে আচ্ছন্নতার মধ্যেই যদি না বাঁচলাম, জীবনকে সুখে বা দুঃখে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে ধরেই যদি না বাঁচলাম, তবে জীবন ত একটা সাড়ে-ছ-আনার নীলামি অভিজ্ঞতায় দাঁড়ায়। জীবন ত তা নয়। আমার তোমার কারো জীবনই ত তা নয়।
রমা আমাকে বলল, আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসিনি, নাকি ভালোবাসতে পারিনি। এ কথাটা আমাকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। সত্যিই কি তাই? তাই-ই যদি হয়, তাহলে ত কারো কাছেই আমার কিছু পাবার নেই।
রমা তোমার সম্বন্ধে কতগুলো কথা বলেছে। সে কথাগুলো খারাপ নয়, তোমার চারিত্রিক গভীরতা সম্বন্ধে ওর যা অনুমান তাই-ই বলেছে। আজকালকার অল্পবয়সী মেয়েদের সম্বন্ধে ও জেনারালাইজ করে বলেছে। সে-কথা কি, তোমাকে নাই-ই-বা বললাম। রমাই ঠিক না তুমিই ঠিক একদিন তা জানা যাবে হয়ত, এও হয়ত জানা যাবে যে, তোমরা দুজনেই ঠিক, কেবল আমিই বেঠিক।
তুমি যে কথা স্বপ্নে শুনেছ, সে কথা অবচেতনে আমি তোমাকে যে বলিনি তা নয়। রমাকে দেখে আমার কষ্ট হয়েছিল। বারবার মনে হচ্ছিল, তবে কি আমিই ভুল করলাম? আমার প্রতি ওর উদাসীনতা, ওর খারাপ ব্যবহার, ওর শীতলতা সবই কি ওর উষ্ণ ভালোবাসারই এক অভিমানী প্রকাশ? তাও কি সম্ভব? আমিই কি ওর সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলাম?
আবার ভাবলাম, অসম্ভবই বা কি? সব মানুষ ত একরকম নয়। নয় তাদের অভিব্যক্তির প্রকাশ, তাদের মনের স্বরূপ। ভাবলাম, রমা যে-ভাবে আজ নিজেকে প্রতিভাত করেছে তা যদি সত্যি হয়, তাহলে রমার প্রতি আমি কি অবিচার করব না? অন্যায় করব না? তার প্রতি অন্যায় করে, তার সত্যিকারের ভালোবাসা পদদলিত করে আমি যদি তোমাকে নিয়ে সুখী হতে যাই তাহলে কি আমি সুখী হব?
অন্যকে দুঃখ দিয়ে কি কখনও সুখী হওয়া যায়? সত্যিকারের সুখী হওয়া যায়?
আমি জানি, তুমি কি বলবে। তুমি বলবে যে, অন্য কাউকে দুঃখী না করে এ পৃথিবীতে কেউই কখনও সুখী হয়নি। সুখী হতে হলে জীবনে একটা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গী থাকা চাই। তুমি বলবে যে, সুখ কেউই কাউকে হাত বাড়িয়ে দেয় না। আজকের দিনে দাঁতে-দাঁত চেপে শক্ত হাতে নিজের সুখ নিজেকেই কেড়ে নিতে হয় অন্যের অনিচ্ছুক হাত থেকে। যে তা না করে, সে মরে।
আমি জানি, আমার এ চিঠি পড়ে তুমি কি ভাববে; কি করবে।
তুমি বিশ্বাস করো, তুমি অন্য-কেউ হলে এ কথা অকপটে তাকে লিখতে পারতাম না। সে আমাকে ভুল বুঝত, ভাবত, লোকটা কি রকম? লোকটার কোনো মতিস্থির নেই, কোনো চারিত্রিক দৃঢ়তা নেই, লোকটা নিজের সিদ্ধান্তের পাশে নিজে পিস্তল হাতে দাঁড়াতে পারে না সেই সিদ্ধান্তকে বাঁচাবার জন্যে? কিন্তু আমি জানি, তুমি তা ভাববে না।
কারণ, তোমার বয়স অল্প হলেও তোমার মনের গভীরতা তোমার দুগুণ বয়সী মেয়েদেরও নেই। তুমি আমার যথার্থ বন্ধু। তোমার মন এবং আমার মনের সমতা আছে। বলেই তোমাকে আমার এই বহুরূপী মনের সব কথা বলা যায়, সব রঙ দেখানো যায়–কারণ আমি বুঝেছি যে তুমি এই অনেক রঙের আপাত-বিরোধিতার মধ্যেও আমার আসল মনকে চিনতে পেরেছ। চিনতে চেয়েছে।
আমার মনে বরং এই ভয়ই হয়েছে যে তোমাকে সত্যি কথা না বললে, আমার মনে কি হচ্ছে তা না জানালে তোমার প্রতি আমি মিথ্যাচারী হব। সে অপরাধ তুমি নিশ্চয়ই ক্ষমা করবে না।
আমি এও জানি যে, তুমি আমাকে ভালোবেসে তোমার অল্পবয়সী জীবনে কতখানি ঝুঁকি নিয়েছ, কতখানি স্বার্থত্যাগ করেছ, এই পরশ্রীকাতর পরনিন্দায় মুখর সমাজে তুমি নিজেকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছ এবং যা করেছ সব আমারই জন্যে। সমাজে তোমার কোনো স্বীকৃতি নেই, হবে না (রমা যদি ডাইভোর্স না দেয়) তা জেনেও, শুধু আমার জন্যেই তুমি তোমার সব দাবী ত্যাগ করেছ।
এ যে আমার কতবড় প্রাপ্তি, কত বড় গর্ব তা তোমাকে মুখে কোনোদিনও না বললেও তুমি নিশ্চয়ই আমার চোখের ভাষায় তা অন্তরে নিরন্তর বুঝেছ।
এই প্রাপ্তির মধ্যে অনেক দায়িত্বও আছে। তোমার প্রতি আমারও অনেক দায়িত্ব জন্মে গেছে। সে দায়িত্ব তুমি কখনও চাপাওনি, কিন্তু সম্পর্কের নিকটতায় সে দায়িত্ব স্বাভাবিক কারণে আপনা থেকেই আমার উপর বর্তেছে। হয়ত আমি দায়িত্বজ্ঞানহীন নই বলেও সে দায়িত্ব আপনা থেকে এসেছে।
তুমি সামান্য কটা টাকার জন্যে এই প্রবাসে চাকরী করবে, একথা আমার ভাবতেই খারাপ লাগে। তুমি জানো যে তুমি সারা মাস কষ্ট করে যা রোজগার করো আমি কোর্টে দিনে যদি একবার মাত্রও দাঁড়াই তাহলেই তার চারগুণ রোজগার করি।
তবে? তুমি যদি আমার প্রিয়জন হও, তুমি যদি স্বীকার করো যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তুমি আমাকে ভালোবাস, তাহলে আমাকে তোমার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব থেকে কেন বঞ্চিত করো? আমার কী তা না করতে পেরে কষ্ট হয় না? তুমি কি আমার দিকটা কখনও ভেবে দেখোনি? ভালোবাসার জনের জন্যে কিছু করার, করতে পারার মত সুখ আর কি আছে? তুমি কি এ সুখ থেকে আমাকে বঞ্চিত করতে চাও?
আমার ইচ্ছা, তুমি এ চাকরী ছেড়ে দাও। কোলকাতায় ফিরে চল আমার সঙ্গে। তোমাকে প্রতি মাসে আমি এক হাজার করে টাকা দেব। তুমি আমার পার্সোনাল সেক্রেটারীর কাজ করবে, আমার লেখা ফেয়ার করে দেবে, ফ্যান-মেইলের উত্তর দেবে, প্রকাশকদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, লেখার প্রুফ দেখে দেবে।
তোমার আত্মসম্মানজ্ঞান অত্যন্ত তীব্র, আর কেউ না জানুক আমি তা জানি, তাই তোমাকে বিনা-পরিশ্রমে টাকাটা দিতে চাই না। তাতে তোমারও সম্মান থাকবে আমার আনন্দ হবে; স্বস্তি হবে।
কি বলো ছুটি? কোলকাতা যাবে ত? আমার চিঠি পড়ে তুমি কি ভাবছ জানি না। কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। রমার এই হঠাৎ-আসায় আমার মন বড় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কেবলই ভয় করছে, ওর প্রতি আমি অবিচার করলাম না ত?
কারো প্রতিই আমি অন্যায় করতে চাই না ছুটি–তুমিও নিশ্চয়ই চাও না যে, আমি অন্যায় করি কারো প্রতি। তাই তোমার কাছে একটু সময় চাইছি। আশা করি আমাকে এই সময় তুমি দেবে। আশা করি, তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না। যদি মনে করো আমার এই ভাবনাটাও অন্যায়, তাহলে তোমার কাছে আগেই ক্ষমা চাইছি।
ইতি তোমার সুকুদা।
চিঠিটা লিখে ফেলতে পেরে অনেকটা হালকা বোধ করলাম।
রমা চলে যাবার পর থেকে এবং ছুটির চিঠি পাবার পর থেকই এ চিঠিটা লিখব লিখব করে লেখা হয়নি।
আমি নিজেকে সত্যিই বুঝতে পারি না।
যারা নিজেদের সম্পূর্ণভাবে বুঝতে পারে, বুঝে ফেলেছে, তাদের আমি ঈর্ষা করি।
বোধহয় আমার মন অত্যন্ত নরম বলেই এত কষ্ট পাই, এত দ্বিধা এত দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে ছটফট করি। লোকে বলে, পুরুষমানুষদের মন শক্ত হওয়া দরকার। কিন্তু শক্ত হওয়া দরকার তা জানার মধ্যে এবং শক্ত করার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান আছে। আর শক্ত করতে হলেও গোড়াটা যথেষ্ট শক্ত কিনা তাও যাচাই করে নেওয়া দরকার। সংশয়ের চোরাবালির উপরে শক্ত মনের কংক্রীটের ইমারত গড়লে তা যে-কোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে। সেই বাইরের শক্তি দুর্বলতারই নামান্তর।
আসলে আমি জীবনে এত স্বল্পসংখ্যক মানুষের উপর নির্ভর করে বাঁচতে চেয়েছি ব্যক্তিগত জীবনে যে, সেটাই আমার কাল হয়েছে।
রমাকে, এবং কিছুদিন হল ছুটিকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে জানিনি। অনেক জনকে জানায় আমি বিশ্বাস করিনি। জীবনটা এত ছোট, অবকাশের সময় এত কম যে, বেশী লোকের মধ্যে, বেশী লোকের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিলে কোনো সম্পর্ককেই গভীরভাবে উপভোগ বা উপলব্ধি করা যায় না বলেই সব সময় মনে হয়েছে।
আমার যা মনে হয় তা যে অন্য সকলেরও মনে হতে হবে তার কোনো মানে নেই। আমি কেবল আমার নিজের অনুভূতির কথাই বলতে পারি। নিজেকেই জানতে পারলাম না, অন্যকে কেমন করে জানব?
বেশ ছিলাম, মনে মনে রমাকে সম্পূর্ণভাবে বিসর্জন দিয়ে, মনে মনে ছুটিকে তার নতুন সিংহাসনে বসিয়ে মহা আনন্দে ছিলাম। এমন সময় হঠাৎ রমা এসে সব গোলমাল করে দিল। আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি সম্পর্কই যেন হীরের টুকরোর মত। কোনদিক থেকে, কোন্ কোণ থেকে আলো পড়লে মনের সম্পর্কের কোন্ কোণে কোন্ রঙ কখন ঝিলমিলিয়ে ওঠে তা বোঝা শক্ত।
রমাকে এতদিন একই আলোয়, একই কোণ থেকে দেখে তার মনের রঙ সম্বন্ধে একটা মোটামুটি ধারণা করে ফেলেছিলাম। এবং সে ধারণা যে অভ্রান্ত সে কথাও মনে মনে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলাম। হঠাৎ রমা নিজেকে এক অন্য কোণ থেকে প্রকাশ করে আমার পুরোনো জীবনটাকে বাতিল করে দিয়ে এবং নতুন জানাটাকেও নির্দ্বিধায় মানবার সুযোগ ও সময় না দিয়েই চলে গেল।
আমাকে এক নিদারুণ সমস্যার মধ্যে ফেলে গেল।
একবার রমার মুখ অন্যবার ছুটির মুখ আমার মনে বারে বারে ফিরতে থাকে এখন।
রমার মুখের দিকে যখন তাকাই, তখন চোখে পড়ে আদরিণী, গর্বিত এক আত্মবিশ্বাসী দাম্ভিক মুখ–সে মুখ আমার অনেক অবহেলায় বুঝি আজ কঠিন হয়ে গেছে।
ছুটির মুখের দিকে চাইলে দেখি, অল্পবয়সের অপাপবিদ্ধ সরলতায় ভরা ভালোবাসায় জরজর তরুণ এক খুশীর মুখ, সে মুখের মালিক স্বর্ণলতার মত আমার মনের গাছকে পরম নির্ভরতায় জড়িয়ে আছে। ও কখনও কল্পনা করতে পারেনি, ভাবতে পারেনি যে, আমার মনে ওর সম্বন্ধে এখনো কোনো দ্বিধা আছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছা করছিল।
কি করে এই সমস্যার সমাধান কার আমি জানি না।
হয়ত রমাও আমার জীবনে সত্য ছিল এবং সত্য আছে এবং ছুটিও আমার জীবনে সত্য। কিন্তু সত্য বলে কোনো সত্যকে জানলেও একাধিক সত্যকে একই সঙ্গে গ্রহণ করার ক্ষমতা বা উপায় ত আমাদের নেই।
তাই আমার একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতেই হবে, আমাকে জানতে হবে, কোন্ সত্যটা দুই সত্যের মধ্যে বড় সত্য। কোন্ সত্যের জন্য অন্য সত্যকে বিসর্জন দেওয়া চলতে পারে।
আমি জানি না, কবে কি করে এই গবেষণা সফল হবে।
চিঠিটা শেষ করে জানালার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলাম।
বাইরে ফিরে আলো, ঝোপঝাড়, ঝুপড়ি ঝুপড়ি অন্ধকার। আকাশময় ঝকঝকে তারা। দূরের পথ দিয়ে কয়লা বোঝাই একটা ট্রাক চামার দিকে যাচ্ছে। ফাস্ট গীয়ারের গোঙানী শোনা যাচ্ছে, গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে দেখা যাচ্ছে টেইল-লাইটের লাল আলো।
হঠাৎ চোখে পড়ল, হাতে লণ্ঠন ঝুলিয়ে কে যেন গেট খুলে বাড়ির দিকে আসছে। তাড়াতাড়ি বাইরের আলো জ্বালিয়ে, দরজা খুলে দেখি, মাস্টারমশাই।
এই পরোপকারী আপনভোলা লোকটি শীতে গ্রীষ্মে যারই যখন অসুখ করে তক্ষুনি রাত-বিরেতে হোমিওপ্যাথি বাক্স বগলে করে বেরিয়ে পড়েন। কোনো আবেদনেই তাঁর না নেই। এখানের কত লোক যে তাঁর ভরসায়ই থাকেন, তার ইয়ত্তা নেই।
মাস্টারমশাই বললেন, সাবুর খুব জ্বর–তাই একবার দেখে গেলাম। তারপর বললেন, বুঝলেন মশাই, আমার কিন্তু অবস্থা ভাল বলে মনে হল না। আমি এ দায়িত্ব একা নিতে চাই না। তাই আপনার কাছে এলাম।
আমি শুধোলাম কত জ্বর।
জ্বর অনেক। কিন্তু শুধু তার জন্যেই নয়, বলছে, ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা–আমার ভয় হচ্ছে হয়ত বা মেনেনজাইটিস।
তাহলে কি হবে? আমি বললাম।
আপনি একবার চলুন। প্যাট সাহেবকে বলে কর্নেল সাহেবের গাড়ি করে যাতে ওকে মান্দারের হাসপাতালে এক্ষুনি নিয়ে যাওয়া যায় তার বন্দোবস্ত করতে হবে।
আমি মোটা কোটটা গায়ে চাপিয়ে মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম।
প্যাটকে ডাকতেই প্যাট আলো জ্বালিয়ে বাইরে এল। আমাদের বলল, তোমরা লাবুদের বাড়ি চলে যাও, আমি এক্ষুনি কর্নেল সাহেবের বাড়ি যাচ্ছি–ওঁর গাড়ির বন্দোবস্ত করতে।
প্যাটকে ডেকে নিয়ে কি কি করা উচিত তা ওকে বললাম।
মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে যখন লাবুদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছলাম তখন দেখি বাড়ির বাইরের মাঠে তিন-চারটে খরগোশ কান-উচিয়ে শুঁটিক্ষেতের মধ্যে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
আলো দেখে ও আমাদের গলার আওয়াজ শুনে পালালো বটে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার এসে ক্ষেত সাবাড় করবে বলে মনে হল।
মাস্টারমশাই বললেন, সহায় যখন থাকে না মানুষের, তখন খরগোশের মত প্রাণীও কতখানি ক্ষতি করতে পারে। এদের শুটিক্ষেত নষ্ট করা কি কম ক্ষতির? খরগোস, শুয়োর, সজারু, ভালুক, এদের জ্বালায় ক্ষেতখামার করার উপায় আছে?
আমি বললাম, কেন? হরিণ শম্বর আসে না?
উনি বললেন, এখানের যত হরিণের শম্বর ছিল, সব সাহেবদের আর ওরা ওদের পেটে। হাড় চুষেছে, মাস খেয়েছে, চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজিয়েছে।
আমরা দরজা ধাক্কা দিতেই লাবুর বড় ভাই ডাবু দরজা খুলে দিল, মুখে কিছু বলল না। ভিতরের ঘরে আমি আগের দিন ঢুকিনি–এই প্রথম ঢুকলাম।
সমস্ত ঘরেটায় দারিদ্র্য যেন দাঁত বের করে আছে। মনে হচ্ছে সবকিছু গ্রাস করে ফেলবে, ফেলেছে।
লাবুর মা লাবুর পাশে বসে আছেন সোজা একটি উজ্জ্বল প্রদীপ শিখার মত। মাথার কাছে কেরোসিনের একটা কুপী জ্বলছে। কুপীটা ওঁর কাছে ম্লান হয়ে গেছে।
আমি গিয়ে লাবুর মাথার কাছে দাঁড়ালাম। লাবুর চোখ বন্ধ। ও কোন কথা বলল না। বাইরের ঘরে বেঁধে রাখা বাছুরটা জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বাইরের ঝিঁঝির ডাকের মধ্যে, শিশির পড়ার ফিসফিস শব্দের মধ্যে এবং ঘরের নিস্তব্ধতার মধ্যে ঐ গরুর দীর্ঘশ্বাস কেমন অলক্ষুণে শোনাল।
জঙ্গল থেকে একটা হুতুমপেঁচা দূরগুম দূরগুম করে ডেকে উঠল। অকারণেই বুকটা ছমছম করে উঠল।
আমি লাবুর মার মুখের দিকে তাকালাম।
সে মুখে কোন বৈকল্য নেই। যাঁরা অনেক দুঃখের মধ্যে দিয়ে গেছেন, যাঁদের যেতে হয়, তাঁদের কাছে দুঃখের নতুন কোন ভয়াবহতা বোধহয় থাকে না। আনন্দের মত দুঃখেরও একটা উদ্বেলিত প্রকাশ দেখা যায়, কিন্তু এঁদের জীবনে সুখ বা দুঃখের কোন বহিঃপ্রকাশ নেই। সমস্ত তরল অনুভূতিগুলো অন্তঃসলিলা হয়ে গেছে। আনন্দেও তাঁরা পাথর, দুঃখেও।
লাবু হঠাৎ বিড় বিড় করে কি বলে উঠল, বলল চাঁদের পাহাড়, বলল সাদা ঘোড়া, বলল পাখিটা।
বলেই, থেমে গেল।
আমি বললাম, আমাকে একটা খবর দিলেন না কেন? কবে থেকে জ্বর?
লাবুর মা বলল, খবর দেব কি বাবা–ঐ বেদেগুলোর জন্যেই এমন হল।
মাস্টারমশাই বললেন, বেদে কোথায়?
লাবুর মা বললেন, বেদেদের একটা দল এসে ইটিটিকারীর জঙ্গলে আস্তানা গেড়েছে যে। ছেলের রোজ সেখানে না গেলে নয়। ওখানে গিয়ে কি খায়, কি করে জানি না। ঐ নোংরা লোকগুলোর কাছে কেন যে ও যায় তাও জানি না।
দ্যাখো ত কোথা থেকে কি অসুখ বাধিয়ে এল। আমার আর ভালো লাগে না। একজন ত অনেক দিন আগেই ড্যাং ড্যাং করে চলে গেছেন– রেখে গেছেন আমার জন্যে যত চিন্তা, যত রাজ্যের কষ্ট। ভগবান আমাকে যে কেন নেন না তা ভগবানই জানেন। গত জন্মে যে কি পাপ করেছিলাম, জানি না বাবা। সত্যিই আমি এই সংসার আর টানতে পারি না। বড় ক্লান্ত লাগে আজকাল।
আমরা বসে থাকতে থাকতেই কর্ণেল সাহেবের এ্যাম্বাসাডর গাড়ি এল।
তাঁর ড্রাইভার, তিনি নিজে এবং প্যাট ভিতরে এল।
লাবুকে ভালো করে গরম জামাকাপড় পরিয়ে কম্বল-ঢেকে গাড়ির পিছনের সীটে তোলা হল।
লাবুর মা বললেন, আমিও যাব।
প্যাট একটুক্ষণ কি ভেবে বলল, বেশ ত! চলুন।
উনি একটা ছেঁড়া-নীলরঙা র্যাপার গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে এলেন।
আমি ওর দিকে তাকিয়েছিলাম।
উনি হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে স্নান হাসলেন, বললেন, কি দেখছ বাবা? এসব কিছু নয়। এ সবের জন্যে কোনো কষ্ট নেই আমার আমার শীত করে না আজকাল। কষ্ট শুধু এই ছেলেগুলোর জন্যে। ওদের ত এরকমভাবে মানুষ হবার কথা ছিল না।
আমিও গাড়িতে উঠে বসলাম। কিন্তু প্যাট এবং কর্ণেল সাহেব আমাকে বকাবকি করে নামিয়ে দিলেন।
প্যাট আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, তুমি ত যা করার করেছ। তোমার যাওয়ার কি দরকার? সঙ্গে গেলে কি বেশি ভালোবাসা দেখান হবে? যা করার আমরা করব। তোমার টাকাটা খুব উপকারে লাগবে।
তারপর বলল, আমি টাকা দিয়ে করতে পারি না, গতরে করি যা পারি। তুমি টাকা দিয়ে পারো, করো। দুই-ই করা। দুই-ই সমান করা। কোনটা কোনটার চেয়ে খাট নয়। যাও, বাড়ি যাও।
লাবুর মা বললেন, বাবা যাও, তুমি বাড়ি যাও। আমার লাবু তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তোমার কথা সবসময় বলে ও। তোমার দেওয়া চাইনীজ চেকারটা নিয়ে আমরা মায়ে-বেটাতে অবসর হলেই বসি। ও কি বলে জানো? আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা, পৃথিবীতে তুমি ফার্স্ট আর সুকুদা সেকেন্ড।
আমি ওকে শুধোই, কিসের ফার্স্ট সেকেন্ড রে?
লাবু বলে, আমাকে ভালোবাসার।
সকলেই হেসে উঠল মাসীমার কথা শুনে।
আমি বললাম, মাসীমা এখন নয়, সব গল্প পরে শুনব; তাড়াতাড়ি রওনা হয়ে যান। ওরা চলে গেলে আমি ফিরে এলাম মাস্টারমশাইকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে।
লাবুর কথা ভাবছিলাম।
ছেলেটা ভুল বকছিল। ওর মুখটা মনে পড়ছিল। এক মাথা রুক্ষ চুল, বোঁজা চোখ, লাল ঠোঁটও বিড় বিড় করে বলে উঠেছিল, চাঁদের পাহাড়।
সাদা ঘোড়া।
পাখিটা।
লাবু কোন্ পাখির কথা বলছিল কে জানে?
মাঝে মাঝে বড় ইচ্ছা করে জীবনটাকে ব্যাক গীয়ারে ফেলে আবার লাবুর বয়সে ফিরে যাই, তারপর আবার চাঁদের পাহাড়, সাদা ঘোড়া এবং পাখিদের জগতে নির্বিকার দ্বিধাহীনতায় প্রবেশ করি।
এই মন নিয়ে, আর এ জীবনে কখনও লাবুর জগতে পৌঁছতে পারব না। সেখানে আমাদের প্রবেশ নিষেধ হয়ে গেছে।
কেন জানি না, আমার মন বলছিল, লাবু ঠিক ভালো হয়ে উঠবে।
ওর সঙ্গে যে আমার কথা হয়েছে একদিন ও আর আমি হাত ধরাধরি করে চাঁদের পাহাড়ে যাব।
.
১৮.
আমার অবকাশের স্বাধীনতার দিন ফুরিয়ে আসছে। শীগগিরি কোলকাতা ফিরতে হবে। ফিরে গিয়ে ধড়াচূড়া পরে সারাদিন দুপায়ে দাঁড়িয়ে আবার সওয়াল করতে হবে।
জজসাহেবদের মুখের দিকে তাকিয়ে আইনের পোকা বাছতে হবে। বুঝতে হবে, কোনদিন কোন জজসাহেবের স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে সকালে।
এসব অকথ্য ও অলিখিত কথা মুখে দেখে বুঝে নিয়ে তাঁদের মেজাজ বুঝে সওয়াল করতে হবে।
আসলে এটাই স্বাভাবিক।
জজসাহেব হলেও তাঁরাও আমাদেরই মত মানুষ। জজীয়তির কোট চাপালেই সেই মানুষটা কিছু বদলে যান না তাঁরা সেই কালো গাউনের নীচে সাদামাটা মানুষই থেকে যান। সেটাই একমাত্র ভরসার কারণ।
যেদিন জজসাহেবের মেজাজ খারাপ থাকবে, সেদিন জজসাহেব কিছু শুনতে চাইবেন না, কিছুক্ষণ শুনেই বিরক্ত হয়ে হাত নেড়ে বলবেন, লিসন মিস্টার বোস, আই হ্যাড বীন খু দা বেঞ্চ এন্ড দা বার ফর আ কনসিডারেব টাইম। টেল আস, ইফ উ হ্যাভ এনীথিং নিউ টু টেল।
সেদিনও হাসতে হাসতে এমন মুখ করে পুরোনো কথাগুলোই এমনভাবে বলতে হবে, যেন একেবারেই নতুন শোনায়।
আসলে নতুন কথা কিছু নেই বলার মত, নতুন করে হয়ত বলার আছে। নতুন কথা বলা, মক্কেলরা কৌসুলিরা এবং জজসাহেবরাও বোধহয় কেউই পছন্দ করেন না।
বঙ্কিমচন্দ্র বলে গেছিলেন, আইন? সে ত তামাশামাত্র। বড়লোকেরাই পয়সা খরচ করিয়া সে তামাশা দেখিতে পারে। অথচ তিনি নিজে হাকিম ছিলেন। কথাটা আজকেও পুরোপুরি সত্যি।
ঘোঘো ঘোষ এখন জজসাহেব। দুঃখের কথা এই যে এখন থেকে রোজ ঘোযোকে ইওর লর্ডশিপ বলে সম্বোধন করে ওর সমস্ত লম্ফঝম্প ওর সমস্ত স্থূল পণ্ডিতম্মন্যতাকে নীরবে হাসিমুখে সহ্য করতে হবে। বলতে হবে, মাই লর্ড, আই কোয়াইট সী ইওর পয়েন্ট, মোস্ট পোবাবলি, আই হ্যাভন বীন এবল টু মেক মাইসেলফ ক্লিয়ার টু ইউ। তা করতে হবে, কারণ নইলে মক্কেল হেরে গেলে আমিও হেরে যাব। তাই, মক্কেলকে জেতাতে, ঘোঘোর কাছে আমার মাথানীচু করে দাঁড়াতেই হবে।
পয়সা রোজগার করতে হলে মাথানীচু করতেই হয়। সত্যি সত্যিই হোক কি অভিনয় করেই হোক, যে যত বেশি রোজগার করে তার মাথা তত বেশি নোয়াতে হয়–যা বাইরে থেকে দেখা যায় না।
আমাদের মাথা কারো পায়ে শারীরিকভাবে নোয়াতে হয় না, নিজের আদর্শ ও আত্মাভিমানকে ছোট করে নিজেকে নীচু করতে হয়। সেটা একটা দারুণ কষ্টকর অভিজ্ঞতা। যার আত্মাভিমান যত বেশি, তাকে এই কষ্টটা তত বেশি করে বাজে। অভিনয়ের ছলে মাথা নোয়াতেও বাজে। অথচ মাথা না নুইয়ে এ দুনিয়ার বাঁচাই মুস্কিল।
কোলকাতায় ফেরার কথা আমি ভাবতে চাই না। ভাবলেই মন খারাপ হয়ে যায়।
অথচ এখানের ঘন নীল আকাশ, রোদ্দুরে স্নিগ্ধ-শান্তিতে শুয়ে-থাকা পাহাড়বন, চরে বেড়ানো গরু মোষের গলার ঘণ্টার ঢুর ঢুর মন্থর আওয়াজ, কোনো ছোট পাখির চিক গলার ডাক, সব আমাকে মনে পড়িয়ে দেয় যে কোলকাতাটাই নির্মম সত্যি, এই জগৎটাই মিথ্যা।
একজন পাকা একেপিস্টের মত বারে বারেই দায়িত্ব ছেড়ে, টেনসা ছেড়ে, গলার জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে আমি জঙ্গলে পালিয়ে আসি। কিন্তু কে যেন আমাকে ধরে আবার খোঁয়াড়ে পুরে দেয়, গলায় দড়ি বেঁধে টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে আবার জোয়ালে জুড়ে দেয়।
যে তা করে, সে কে?
সে ত আমার বুকের মধ্যেই বাস করে, সে ত আমারই মনের একটা হিসাবী স্কুল অংশ। যার কাছ থেকে আমার এ জন্মে নিস্তার নেই।
সেদিন শেষ দুপুরবেলা জঙ্গলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। দুপুরের ঝকমকে রোদে বনপাহাড় হাসছিল।
দুপুরের শীতের বনের গায়ের একটা বিশেষ গন্ধ আছে। বিয়ের পর রমার গায়ে যেরকম গন্ধ পেতাম। মনে হত, একটা অনাঘ্রাত, অনাস্বাদিত স্নিগ্ধ উজ্জ্বল পৃথিবী শুধু আমার–শুধু আমার জন্যে প্রতীক্ষা করছে।
এই দুপুরের নিস্তব্ধ, গুনগুন, কাচ-পোকা-ওড়া জঙ্গলে এলে সেইসব পুরোনো, শব্দ-স্পর্শ-ঘ্রাণ সবকিছু মনে পড়ে যায়। কেন জানি না, লতায় পাতায়, ঝরা-ফুলে, উড়ে-যাওয়া পাখির ডানায় চুমু খেতে ইচ্ছা করে সমস্ত দুপুরের বনকে ছুটির কবোষ্ণ বুকের মত আমার মুঠোর মধ্যে ধরে থাকতে ইচ্ছা করে–একান্ত মালিকানায়। এই আশ্চর্য সবুজ শালীন সৌন্দর্যের ভাগ আমার অন্য কাউকেই দিতে ইচ্ছে করে না। ভীষণ স্বার্থপরের মত আমার একারই করে রাখতে ইচ্ছা করে। সারাজীবন, সারাজীবন।
হাঁটতে হাঁটতে কখন যে অনবধানে লাবুর সেই ডেরায় পৌঁছে গেছিলাম জানি না।
ওখানে পৌঁছতেই লাবুর কথা মনে পড়ল। লাবু এখনও মান্দারে। আমি মাঝে একদিন গিয়ে দেখে এসেছিলাম ওকে। এখন ভালো আছে। আরও দিন চারেক লাগবে ভালো হয়ে উঠতে।
লাবুর অসুখে আমি যে কিছু করতে পেরেছি তার জন্যে আমার খুব আনন্দ হয়। কষ্ট করে, রাত দুটো অবধি লাইব্রেরীতে বসে পরদিন সারাবেলা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে যে মেহনতের রোজগার সেই মেহনতের টাকা কোনো যোগ্য কাজে লাগলে মন ভরে ওঠে।
মিস্টার বয়েলসকে আমি মাসে পঞ্চাশ টাকা করে মাসোহারা দিচ্ছি প্যাটের মাধ্যমে। এতে আমার যে কী আনন্দ হয় তা কি বলব। আমি জানি, উনি বেশিদিন বাঁচবেন না–তাই একজন মৃত্যুপথযাত্রীকে হাসিমুখে রওয়ানা করানোর মধ্যে একটা দারুণ গায়ে কাঁটা-দেওয়া আনন্দ পাই।
এ যুগে জম্মেও আমি খুবই সেকেলে রয়ে গেছি। আমি ভগবানে গভীরভাবে বিশ্বাস করি। তাঁর উপর কোনোরকম ভরসা রাখি না বা তাঁর কাছে কিছু চাই না, কিন্তু আমাদের উপরে যে একজন অবিসংবাদী কেউ আছেনই তা নিশ্চয় করে বুঝতে পারি। তাঁর কাছে হাততালি পাবার জন্যে কিছুই করি না, পরজম্মের সুখের ইনসিওরেন্সের প্রিমিয়ামের জন্যেও নয়। কারো জন্যে স্বার্থ ছাড়া কিছু করতে বড় ভালো লাগে, তাই করি।
আমার বন্ধুরা বলে, তুই বড় সেকেলে রয়ে গেছিস, আজকাল কেউ ভগবানে বিশ্বাস করে?
আমার বক্তব্য কিন্তু ওদের কখনও বুঝিয়ে বলিনি। ওরা কি করে জানবে, তারা-ভরা আকাশের নীচে গভীর জঙ্গলের মধ্যে মাচায় বসে হঠাৎ কোনো তারা-খসে যাওয়া দেখলে কেমন মনে হয়। সেই সব অন্ধকার রাতের স্তব্ধতার মধ্যে বসে সমস্ত ব্ৰহ্মাণ্ডকে প্রত্যক্ষ করে চারপাশের এই পণ্ডিতপ্রবর মানুষদের পোকার চেয়ে একটুও বড় বলে মনে হয় না, মনে হয় না যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর সত্যতার সঙ্গে ভগবানের অস্তিত্ব চিরসত্যর কোনো সংঘাত নেই।
একসময় হাঁটতে হাঁটতে এসে লাবুর গুহার উপরে উঠে এলাম।
পাথরটা সরিয়ে ভিতরে ঢুকলাম, যেমন করে ঢুকেছিলাম লাবুর সঙ্গে, প্রথম দিনে।
ভিতরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম।
উপরের পাথরটা সরাতেই আলোয় ভরে গেল গুহাটা।
দেখি সাদা পাথরের উপর কাঠ কয়লা দিয়ে লাবু লিখেছে–এক, মা। দুই, সুকুদা।
তারপরই আমার নামটা কেটে দিয়ে তার পাশে লিখেছে, নুড়ানি। তারপর তিন নম্বর দিয়ে আমার নাম লিখেছে।
গুহাটার মধ্যে এক কোনায় একটা মেয়েদের লালরঙা চুল বাঁধা ফিতে, একটা ভাঙ্গা ছোট আয়না এবং হলুদ-রঙা কাঁচা কাঠের একটা মেয়েদের চুল আঁচড়াবার কাঁকই পড়ে আছে।
ফিতেটা তুলে ধরে দেখলাম, ফিতেটা নতুন নয়, ব্যবহার করে করে নোংরা এবং দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। কাঁকইতে কতগুলো সোনালি রঙা লম্বা চুল লেগে আছে।
লাবুর চুল বাদামী, সোনালী নয়; এত লম্বাও নয়। এ নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের চুল।
ব্যাপারটা কি বোঝবার চেষ্টা করছি, এমন সময় দূর থেকে একটা আওয়াজ শোনা গেল। শম্বর বা বড় হরিণ দ্রুত দৌড়ে এলে যেমন আওয়াজটা হয় খুরের, তেমন আওয়াজ।
উপরের ফুটো দিয়ে জঙ্গলের যেদিক থেকে আওয়াজটা আসছিল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আওয়াজটা একেবারে কাছে এসে গেল, এসে থেমে গেল।
স্বাক হয়ে দেখলাম, বড় বড় লোমওয়ালা একটা সাদা টাট্টু ঘোড়ার উপর একটি রুক্ষ বেদেনী মেয়ে বসে আছে।
তার বয়স বেশি নয়-বড় জোর চোদ্দ পনেরো। গায়ের রঙ ঘন তামাটে-দুদিকে দুই বিনুনী-সোনালি চুলে ভরা, একটা হলুদ রঙের জামা এবং ক্ষয়েরী ঘাঘরা পরা। ঘোড়াটার পিঠে মেয়েটি একইদিকে দুপা দিয়ে বসেছিল।
ঘোড়াটা দাঁড়িয়ে পড়ে কান নাড়ছিল।
দুপুরের রোদ তার বড় বড় লোমওয়ালা সাদা শরীরে পিছলে যাচ্ছিল। ঘোড়াটা নাক দিয়ে একবার ঘোঁত ঘোঁত্ করে শব্দ করল। ঐ শব্দে ভয় পেয়ে আশেপাশের শালের চারায় বসে থাকা একদল টুই পাখি একসঙ্গে পিটী-টুই পিটী-টুই করে উড়ে গিয়েই কতগুলি সবুজ পুঁটকির মত সবুজতর জঙ্গলের পটভূমিতে হারিয়ে গেল।
হঠাৎ মেয়েটি ডাকল, ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায়, লাব্বু; লাব্বু।
আমি কিছু বলার আগেই মেয়েটা তড়াক করে লাফিয়ে নেমে, ঘোড়াটাকে একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে গুহার দিকে দৌড়ে এল। দৌড়াবার সময় ওকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছিল।
ঘাঘরাটা ফুলে উঠে দুলতে লাগল। আর ওর সোনালি বেণী দুটো ওর পেছনে সমান্তরালভাবে উড়তে লাগল।
খালি পায়ে মেয়েটা পাথর টপকে টপকে পাহাড়ি ছাগলের মত এগিয়ে আসতে লাগল।
কাছে আসতেই দেখলাম, মেয়েটার হাতে কাঁচা শালপাতায় মোড়া কি যেন আছে। হয়ত কোনো খাবার-টাবার হবে।
যখন খুব কাছে এসেছে ও, তখন আমি হামাগুড়ি দিয়ে গুহার বাইরে এলাম কারণ তা হলে গুহার মধ্যে ও চলে এসে লাবুকে না দেখে আমাকে দেখলে নিশ্চয়ই ভয় পেত।
আমি বেরিয়ে গুহার উপরে উঠতেই মেয়েটা ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াল।
পরক্ষণেই ভয়ে বিস্ময়ে হাতের জিনিসটাকে ফেলে দিয়ে ও আবার ঘাঘরা উড়িয়ে তার বাদামী সুন্দর পায়ের আভাস দিয়ে বেণী দুলিয়ে দ্রুত দৌড়ে গিয়ে ঘোড়ায় উঠল।
তারপর দুপা একদিকে দিয়ে বসে ও সেই অবাক জঙ্গলে এত জোরে সাদা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল যে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
সেই ঝকঝকে রোদ্দুরের মধ্যে তার সাদা ঘোড়ায় চড়ে চলে যাওয়াটা একটা রূপালি চমকের মত আমার চোখে লেগে রইল।
ও চলে গেলে বুঝলাম যে, এইই নুড়ানী– যে লাবুর ভালোবাসার লিস্টে আমাকে পরাভূত করে আমার নামের উপরে বর্তমানে অবস্থান করছে।
ইটিটিকারীর জঙ্গল কোন্ দিকে, কতদূরে; তা আমি জানি না। এই বেদেরা কি ভাষা বলে তাও আমি জানি না। মেয়েটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে ডাকছিল লাব্বু; লাব্বু করে লাবুকে। বেদেদের ভাষা নিশ্চয়ই হিন্দীও নয়, বাংলাও নয়। তবে লাবু এবং মেয়েটি যে ভাষায় দুজনে দুজনের মনে পৌঁছেছে, সেটা কোনো ভাষাবিদের এক্তিয়ারে নয়; সেটা চোখের ভাষা। অথবা হৃদয়ের।
লাবু ভালো হয়ে উঠলে লাবুর সঙ্গেই একদিন এই বেদেদের আস্তানায় যাওয়া যাবে।
কচি শালপাতায় মুড়িয়ে মেয়েটি লাবুর জন্যে কি এনেছিল দূর থেকে তা বোঝা গেল না।
আমি নেমে গিয়ে শালপাতার আবরণ ভেদ করে আবিষ্কার করলাম।
দেখি খুব মোটা একটা রুটি। এরকম রুটি আমরা খাই না। দেখতে অনেকটা পাটনাই বাটরখানী রুটির মত। আর সঙ্গে একটা ঝলসানো তিতির।
এই ঠাণ্ডায়, কোনো খাবারই নষ্ট হয় না। তাই আমি লাবুর রাজপ্রাসাদ ভালো করে বন্ধ করে ফেরার সময় লাবুদের বাড়ি গিয়ে লাবুর ভাই ডাবুকে ওগুলো দিলাম, বললাম তুমি খেও। আর লাবু এলেই লাবুকে বলল যে, আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে আসব। ওর সঙ্গে কথা আছে আমার।
আর কিছু বলা গেল না। লাবু যখন আমার নাম এখনও ওর ভালোবাসার লিস্টে রেখেছে, তখন ওর প্রতি এমন বিশ্বাসঘাতকতা করা আমার উচিত হবে না ভাবলাম।
ফেরবার সময় কেবলি মেয়েটির নামটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল। নুড়ানী; নুড়ানী।
লাবুর জন্যেও যে এই বনে পাহাড়ে মুড়ানীর মত একজন বেদেনী সমব্যথী থাকতে পারে তা আজ ঐ গুহায় না গেলে তা বিশ্বাস করতাম না, বিশ্বাস করতে চাইতামও না।
লাবুদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুদূর আসার পর হুঁশ হল যে পথ হারিয়ে ফেলেছি জঙ্গলে।
একটা বড় বেগুন গাছের নীচে এসে আমার ডানদিকে মোড় নেবার কথা ছিল, কিন্তু অন্যমনস্কতার জন্যে তা নিতে ভুলে যাওয়ায় এখন একেবারে অচেনা এক বনে এসে পড়েছি।
সূর্যের দিকে চেয়ে কোন দিকে গেলে চামার বড় রাস্তায় গিয়ে উঠব তার একটা আন্দাজ করে নিয়ে এগোতে লাগলাম আস্তে আস্তে। এখনও বেলা আছে অনেক। ঘাবড়াবার মত কিছু হয়নি।
বেশ অনেকক্ষণ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটার পর হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা বাড়ি। রঙ-চটা শ্যাওলাধরা জরাজীর্ণ একটা বাড়ি।
বাড়িটা ডালপালার আড়ালে ছিল বলে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম না। বাড়িটার পিছন দিকটা দেখা যাচ্ছিল।
আরো একটু এগোতেই হঠাৎ চিনতে পারলাম বাড়িটাকে। মিস্টার বয়েলসের বাড়ি। আমি পিছন দিক থেকে আসার জন্যে প্রথমে বুঝতে পারি নি। বাড়িটার কাছে এসেও তাতে কোন প্রাণের আভাস দেখতে পেলাম না, গতবারেরই মতন।
কিন্তু কিচেনটা পেরিয়ে আসার পর হঠাৎ কানে গেল কে যেন তীক্ষ্ণ অথচ ঘুম ঘুম গলায় কার সঙ্গে কথা বলছে।
বাড়িটার দৈর্ঘ্য পেরিয়ে সামনের বারান্দার পাশে এসেই চমকে গেলাম।
আমি রাবার-সোলের জুতো পরে হাঁটছিলাম বাড়ির আশেপাশে শুকনো পাতাও ছিলো না–তাই আমার পায়ের শব্দ বোধহয় কারুরই কানে যায়নি।
চমকে গেলাম এই জন্যে যে, বৃদ্ধ অনর্গল একা একা বৃদ্ধা লুসির সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছেন।
লুসি মিস্টার বয়েলসের সেই ক্ষয়ে-যাওয়া ইজিচেয়ারের পাশে তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে। মিস্টার বয়েলস ও লুসি, দুজনের চোখই বিকেলের স্নান জঙ্গলের দিকে। ওদের কাছে শুধু আমার অস্তিত্ব কেন, ওঁদের পিঠের পিছনে যে প্রাণবন্ত সজীব সশব্দ সুন্দর সবুজ পৃথিবীটা আছে সে সম্বন্ধে ওঁরা কেউই যেন সচেতন নন। অথবা সচেতনভাবে অচেতন। দুজনের চোখই দিনশেষের ক্ষয়িষ্ণু গোধুলির পুবের আকাশে। যেদিকে সূর্য নেই।
বৃদ্ধর কোলের উপর ছোট একটা বই, বৃদ্ধ পড়ছিলেন, যেন লুসিকে শোনাবার জন্যেই
We brought nothing into this world, and it is certain we can carry nothing out. The Lord gave and the Lord hath taken away; blessed be the name of the Lord
বৃদ্ধ এই অবধি পড়ে থেমে গেলেন, তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলেন।
আমার পা সরছিল না। ঐ কথাগুলোর তীক্ষ্ণ গভীরতা, ঐ পরিবেশে মৃত্যুপথযাত্রী এক বৃদ্ধ মানুষ এবং বৃদ্ধা বোবা কুকুরীর করুণ অসহায় অস্তিত্বর সামনে দাঁড়িয়ে-থাকা আমাকে যেন কি এক ব্যথাতুর তীব্র বোধে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমি স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
বৃদ্ধ আবার পড়তে লাগলেন,
Man that is born of a woman hath but a short time to live, and is full of Misery. He cometh up and is cut down like a flower, he fleeth as it were a shadow, and never continueth in one stay. In the midst of life we are in death…
এই অবধি পড়া হতেই লুসি হঠাৎ পাশ ফিরে তাকাল, তাকিয়েই আমাকে দেখতে পেয়ে ক্ষীণ ভুক ভুক স্বরে ডেকে উঠল।
মিস্টার বয়েলস মুখটা ঘোরালেন। মনে হল, মুখটা ঘোরাতে যেন তাঁর অনেকক্ষণ সময় লাগল। উনি বললেন, ও, ইটস য়ু। কাম, কাম-ইন মাই গুড ইয়াং ফ্রেণ্ড।
আমি বারান্দায় উঠে রেলিং-এ ভর দিয়ে দাঁড়ালাম, বললাম, এটা কি বই? কি পড়ছিলেন আপনি?
মিস্টার বয়েলস বললেন, এটা বাইবেল।
কি পড়ছিলেন আপনি?
পড়ছিলাম, দ্য অর্ডার ফর দা ব্যেরিয়াল অফ দা ডেড।
কেন জানি না, হঠাৎ আমার গা শিউরে উঠল।
কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই মিস্টার বয়েলস বললেন, তোমার জন্যে একটু চা করি।
আমি না, না করে ওঠার সঙ্গে উনি বললেন, আমিও খাব, তোমার একার জন্যে কষ্ট ত করছি না। এই সময়ই ত চিরদিন চা খাই।
বাইবেলটাকে চেয়ারের উপরে রেখে উনি খুব আস্তে আস্তে পা ফেলে ফেলে ভিতরে গেলেন। লুসিও ওঁর সঙ্গে সঙ্গে গেল।
বইটা তুলে নিয়ে দেখলাম, পেজ-মার্ক দেওয়া আছে জায়গাটাতে। সত্যিই একটা আলাদা চ্যাপটার–দা অর্ডার ফর দা ব্যেরিয়াল অফ দা ডেড।
বইটির পাতা উল্টে পড়তে পড়তে দেখলাম, কতগুলো জায়গায় আন্ডারলাইন করা আছে।
আমি ভিতরে গিয়ে মিস্টার বয়েলসকে সাহায্য করলাম। চায়ের সেই ক্যানেস্তারাকাটা ট্রেটাকে নিয়ে বারান্দায় এলাম।
তারপর ভিতর থেকে একটা চেয়ারও নিয়ে এলাম। চা বানালাম। মিস্টার বয়েলসকে দিয়ে, নিজে নিলাম।
চা খেতে খেতে বললাম, আপনি এসব পড়ছেন কেন? তাড়া কিসের? তাছাড়া যে মারা যায় তার জন্যে ত এসব নয়। যাঁরা তাঁকে কবর দেবেন, তাঁদেরই বলবার ও গাইবার জন্যে।
মিস্টার বয়েলস হাসলেন।
সেই বিকেলে তাঁর হাসি অদ্ভুত দেখাল।
উনি বললেন, কাল রাতে একটা দারুণ স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, যমদূত একটা কালো আলখাল্লা পরে হাতে একটা দাবার ছক নিয়ে এসে বলছে, আমার সঙ্গে দাবা খেলতে হবে তোমায়।
আমি তাকে জিগ্যেস করলাম, খেলে কি হবে?
সে বলল, খেলে কিছু হবে না। কিসেই বা কি হয়? সমস্ত জীবনটাই যেমন মিছিমিছি খেলা খেললে, তেমনই খেলবে।
এত খেলা ত খেললে সারা জীবন, দারুণ সীরিয়াসলি খেললে। খেলে কি হল? কিছুতেই কিছু হয় না, তবু ত সকলে খেলে এবং এমনভাবে খেলে যেন খেলাটাই জীবনের সবচেয়ে বড় কাজ–খেলার সার্থকতা বা বিফলতার মধ্যেই মানুষের অমরত্ব। সব বাজে, সব খেলা মিছিমিছি; এবার এসো শুরু করি।
আমি অবাক গলায় বললাম, আশ্চর্য! ঠিক এরকম একটা ঘটনা বার্গম্যানের একটা ফিলমে দেখেছিলাম– সমুদ্রের পাড়ে একটা পাথরের উপর বসে ফিলমের নায়ক মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলছে।
কোথায় দেখেছিলেন? মিস্টার বয়েলস শুধোলেন।
আমি বললাম, অনেকদিন আগে কোলকাতায় দেখেছিলাম, বার্গম্যানের ছবি, একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে।
তারপর বললাম, যাই হোক আপনি কি করলেন? খেললেন?
হ্যাঁ। খেলোম। বললেন, মিস্টার বয়েলস।
তারপরই বললেন, এবং হেরে গেলাম।
হেরে যেতেই, যমদূত ছক গুটিয়ে উঠে পড়ে বলল আমার এবার যেতে হবে, অনেক খেলা খেলতে হবে–মিছিমিছি। তৈরী থেকো; ফিরে আসছি। হাতে সময় বেশি নেই আমার।
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকলাম। কথা বললাম না কোনো। তারপর বললাম, আপনি তাহলে ভাবছেন আপনার এখুনি যেতে হবে।
এক্ষুনি অথবা যখনি ডাক আসে। মিস্টার বয়েলস বললেন।
আমি বললাম, সত্যি করে বলুন ত, আপনার এই নির্লিপ্ত কি সত্যি? সত্যিই কি আপনি মরলে সুখী হন? মৃত্যু সম্বন্ধে আপনি সত্যিই কি এমন উদাসীন?
উনি বললেন, সুখী নিশ্চয়ই হই, কিন্তু আমাকে যতখানি নির্লিপ্ত দেখছ ততখানি আমি নই।
আমার এখুনি রওয়ানা হতে হবে বলেই বোধ হয় গন্তব্যর কথা মনে হচ্ছে। গন্তব্য কি সত্যিই আছে কোনো?-না, শুধুই মিথ্যে সান্ত্বনা–আর্থ টু আর্থ, এ্যাশেস টু অ্যাশেস, ডাস্ট টু ডাস্ট; উইথ শিওর এন্ড সার্টেন হোপ অফ দা রেসারেকসান টু এটানাল লাইফ।
কেন জানি না, মিস্টার বোস, এই শেষ প্রহরে আমার মন কেবলই বলছে বারে বারেই বলছে; সব মিথ্যা কথা। রেসারেকসান বলে কিছুই নেই, আমাদের প্রত্যেকের, আমার তোমার, আমাদের একটাই এবং একইমাত্র জীবন।
আমার মোম গলে গেছে। তোমার মোম এখনও নতুন। তাই তুমিই ফুরিয়ে যাবার আগে একটা কথা তোমাকে বলে যাচ্ছি। এই জীবনে কখনও ভুলেও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কিছু কোরো না। যা মন থেকে, হৃদয় থেকে করতে না চাও তা কখনও কোরো না। কারো কথাই শুনো না, বিবেকের না, সমাজের না, এমনকি বাইবেলেরও না।
আর একটা কথা; জীবনে যা নিজের বিদ্যা, বুদ্ধি এবং বোধ দ্বারা বিবেচনা করে করেছ, করে ফেলেছ; কখনও তা নিয়ে আপশোস কোরো না। যাই করো না কেন, যা করেছ, তার জন্যে কারো কাছে ক্ষমা চেও না; নিজেকে অভিশাপ দিও না। যা করেছ, তা ঠিকই করেছ বলে মনে কোরো। সব সময় মনে কোরো।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম।
তারপর বললাম, আপনি আপনার এই ফুরিয়ে-যাওয়ার বাবদে এতই নিশ্চিত জেনে একটা কথা জিগগ্যেস করতে খুব ইচ্ছা করছে আপনাকে। জবাব দেবেন?
বল, বল; বলে ফেল নির্দ্বিধায়। মিস্টার বয়েলস বললেন।
আমি শুধোলাম, জীবনের শেষ সীমায় এসে আমাদের এই জীবনটাকে আপনার কেমন মনে হচ্ছে? এই অভিজ্ঞতাকে জীবনেরই আর অন্য কোনও অভিজ্ঞতার সঙ্গে তুলনা করা যায় কি? সেরকম কোনো তুলনা কি মনে আসে জীবনের শেষে এসে?
মিস্টার বয়েলস আশ্চর্য হয়ে আমার দিকে তাকালেন।
তারপর ধীরে ধীরে বললেন, একথা আমিও অনেকবার ভেবেছি। মনে মনে এ প্রশ্ন নিয়ে অনেক নাড়া-চাড়াও করেছি, কিন্তু কখনও কেউ এমন করে জিগগেস করেনি বলে জবাব দেওয়া হয়নি। ভাবনাটাও বোধহয় দানা বাঁধেনি।
জানো, বোধহয় ঠিক ভাবে বলতে পারব না। তবে আমার যা মনে হয়েছে, বলছি। আমার সঙ্গে কি অন্য কারো সঙ্গে তোমার অভিজ্ঞতার মিল নাও থাকতে পারে। তবে আমার কথা সেদিনই মিলিয়ে দেখতে পারবে যেদিন তুমি আমার আজকের অবস্থায় পৌঁছবে। তার আগে আমার কথা যাচাই করার সুযোগ পাবে না কোনো।
এই অবধি বলে উনি থেমে গেলেন।
চায়ের কাপটা কাঁপা কাঁপা হাতে নামিয়ে রেখে বললেন, আমার মনে হয় কি জানো যে, জীবন একটা সমুদ্রের মত–বিশাল, দিগন্তবিস্তৃত–আবর্তময়। এ এক মত্ততায় ভরা ঢেউয়ের সমুদ্র ঢেউ, তারপর ঢেউ তারপর আরো ঢেউ। এখানে অনেক ফেনা, ডুবে-যাওয়া; পাথরে আছড়ে-পড়া আবার আশ্চর্য-নীল-শান্তও কখনও কখনও। সত্যিই জীবন একটা দারুণ গোলমেলে নোনা-স্বাদে ভরা দুরন্ত অভিজ্ঞতা। আর আমরা, আমরা এই টুকরো টুকরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানুষ সেই সমুদ্রের বুকে-ওড়া ছোট নরম সাদা সী-গালেদের মত। আমরা সমুদ্রকে ভয় পাই; আবার ভয় পাই না। আমরা ছোট অথচ তবু বারে বারে সমুদ্রে ছোঁ মারি। কখনও মাছ পাই; কখনও বা পাই না, কখনও বা সমুদ্রপারের গুহার নীড়ে ফিরতে পারি; কখনও বা ঝড়ে-পড়ে জলে পড়ি ডানা-ভেঙ্গে।
অথচ তবুও, আমরা সী-গালেদের মতই। তাই উষ্ণ হোক, শীতল হোক, মাতাল হোক, শান্ত হোক, সমুদ্রই আমাদের জীবন–এই জীবনের জন্যেই আমাদের আকুতি, কান্না; আমাদের সমস্ত প্রার্থনা। এই জীবনকেই আমাদের ঘৃণা, আমাদের ভালোবাসা, এর মধ্যেই বার বার ছোঁ-মেরে নামা, বারবার কাছে এসেই আবার দূরে উড়ে যাওয়া।
আমার মনে হয় না যে, এক-জীবনে জীবনের এই অতল সুনীল তলে কি আছে তা কেউ বুঝে যেতে পারে। বোঝা শেষ না বলেই বোধহয়, সমুদ্রের নোনা-স্বাদ, হু-হু হাওয়া ছেড়ে অন্য অজানা গন্তব্যে যেতে, যাবার সময় ভারী ভয় করে। মনে ভয় হয় যাবার দিনে, যে এই বুঝি শেষ–আর বুঝি কখনও ফেরা হবে না।
তখন কেবল সেই শেষের দিনেই বার বার মনে হয়, তবে কেন এ সমুদ্রে মনের সুখে অবগাহন চান করলাম না, কেন যা চেয়েছিলাম তাকে তেমন করে চাইলাম না, যা চাইনি তাকে তেমন করে লাথি মারলাম না। কেন মিথ্যে রেসারেকশানের মোহে পড়ে এই জীবন, এই একটাই রহস্যময় সুন্দর ও বীভৎস জীবনকে ফ্রি-স্টাইল সাঁতারে উপভোগ করতে করতে পাড়ি দিলাম না। সারা জীবন কিসের ভয়, কিসের সঙ্কোচ, কিসের দ্বিধা নিয়ে, কোন্ মিথ্যা পুণ্যের লোভে নিজেকে এমন করে ঠকালাম?
এই অবধি বলে, মিস্টার বয়েলস আমার দিকে তাকালেন।
উনি হাঁপাচ্ছিলেন।
একটু পর উনি বললেন, কি জানি ঠিক বললাম কিনা। ভয় হচ্ছে, বানিয়ে বললাম না ত? বানিয়ে বললাম?
আরো অনেকক্ষণ আমি ওখানে বসে রইলাম।
একটা ভয়াবহ বিষণ্ণতা আমাকে সর্বতোভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার ভীষণ ভয় করতে লাগল, এই বুঝি কালো-আলখাল্লা-পরা যমদৃত ফিরে এসে আমাকেও দাবা খেলতে বলে।
মৃত্যুর শমন যার উপর জারী হয়ে গেছে, তেমন কারো মুখোমুখি বসে থাকা বড় অস্বস্তিকর। আমার জীবনের পরম, শেষ ও অমোঘ সত্যকে সামনাসামনি দেখতে আমার ভীষণ ভয় করছিল।
আমি কেন ভুল করে এখানে এসে পড়লাম এই বিকেলে কেবল তাই-ই ভাবছিলাম।
মিস্টার বয়েলস, বারান্দার এক কোনায় রাখা কানা-উঁচু থালায় লুসিকে গরম চা ঢেলে দিলেন। লুসি আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে চকিয়ে সেই চা খেতে লাগল তার কুৎসিত জিভটা বের করে।
আমি বললাম, আমি এবার উঠব।
মিস্টার বয়েলস বললেন, এসো। ব্যাঙ্ক ঊ্য ফর কামিং। প্যাটকে বোলো আমার জন্যে যেন কোলকাতার চ্যারিটেবল ট্রাস্ট-এ তদ্বির না করে। মনে হয়, আরো কারো চ্যারিটিরই আমার দরকার হবে না।
আমি যখন উঠে আসছি, তখন উনি তাঁর শীর্ণ রগ-উঁচু, হাড় বের-করা ঠাণ্ডা হাতে আমার হাত ধরে বললেন, থ্যাঙ্ক উ্য মাই বয়, থ্যাঙ্ক উ ফর এভরীথিং উ্য হ্যাড ডান ফর মী। আই ওনলি উইশ, আই ওয়্যার ডেড আ লং এগো। থ্যাঙ্ক উ্য ফর দা লিটল ওয়ার্মথ এট দা কোন্ডেস্ট আওয়ার।
আমি হেঁটে আসছিলাম মিস্টার বয়েলস-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে।
সূর্য ডুবে গেছে।
পশ্চিমাকাশে একটা ম্লান আলোর আভা ঝুলে রয়েছে শুধু।
পাখিরা ডাক দিতে দিতে যে যার নীড়ে ফিরেছে গরু মোষেরা গলার ঘণ্টা দুলিয়ে পায়ে পায়ে ধুলো উড়িয়ে ফিরে গেছে ওঁরাও রাখাল ছেলেদের সঙ্গে যে যার গ্রামে। এখন উষ্ণতা শেষ হয়ে গেছে। এখন শীত।
শীতের বেলা এখন থেকে।
দূর থেকে চামার লাল মাটির পথটা দেখা যাচ্ছিল। মধ্যে একফালি টীড়। পাটকিলে টাঁড়ের শেষে ফ্যাকাশে লাল পথটা একটা অতিকায় সরীসৃপের মত শুয়ে আছে নির্জীব।
হঠাৎ ঐখানে এক মুহূর্তের জন্যে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম! কে যেন আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল। একটি দিনের মৃত্যু ও একটি রাতের জন্মের ক্ষণিক পরিসরে আমি মস্তিষ্কের মধ্যে এক সুপ্ত সমুদ্রের জলোচ্ছাস শুনতে পেলাম।
এখন সব পাখি থেমে গেছে। স্তব্ধ প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করছে প্রতিকৃতির সমস্ত শরীর। এই মুহূর্তটুকু পেরিয়ে গেলেই ঝিঁঝিরা ডেকে উঠবে, রাতচরা পাখির বুকের মধ্যে চমকে চমকে চাবুকের মত ডেকে বেড়াবে পাহারতলিতে। শুধু এই আশ্চর্য ক্ষণটিতে; সমস্ত জীবন স্তব্ধ, অনিশ্চিত।
হঠাৎ এই উষ্ণতা ও শীতার্ততার মধ্যবর্তী শূন্য মুহূর্তে আমার মস্তিষ্কের সমস্ত কোষগুলি ককিয়ে কেঁদে উঠে আমাকে বলল, একটা দিন মরে গেল, একটা ফুল ঝরে গেল। বলে উঠল, সুকুমার বোস, যতদিন বাঁচো, দারুণভাবে বাঁচো, বাঁচার মত বাঁচো, বেঁচে থাকো, প্রতিটি মুহূর্ত বাঁচো; হাঁটার জন্যেই শ্লথপায়ে হেঁটো না–কোনো এক বা একাধিক গন্তব্য খুঁজে নিয়ে সেদিকে প্রাণপণ দৌড়োও। বেলা ফুরিয়ে আসছে, সন্ধ্যে হয়ে আসছে : তাড়াতাড়ি দৌড়োও।
হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, পরমুহূর্তেই আমি দৌড়চ্ছি–অন্য দিকে, বিপরীত দিকে–যে দিকে মৃত্যু নেই, মিস্টার বয়েলস-এর মত কোটরগত-চক্ষু–ভয়াবহ যমদূতের দাবা-খেলার সঙ্গীরা কেউ নেই–যেদিকে অন্ধকার নেই।
দৌড়তে দৌড়তে দেখতে পেলাম। দূ–রে আলো দেখা যাচ্ছে।
কোনো সাহেববাড়ির আলো। দেখলাম একটা আলোকিত বাড়ি—বুকের মধ্যে অনুভব করলাম, সেখানে ঘরের মধ্যে উষ্ণতা, ঘরের মধ্যে ভালোবাসা; একজন প্রেমিক পুরুষ, একজন প্রেমিকা নারী; সেখানে জীবন।
বাইরে শীত। বাইরে অন্ধকার।
আমি জোরে সেদিকে, উষ্ণতার দিকে দৌড়ে চললাম।