১৩-১৪. মাঝরাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি
কাল মাঝরাতে প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি হয়ে গেল। এই শীতের মধ্যে যে শিলাবৃষ্টি হতে পারে এবং হলে যে কতখানি ঠাণ্ডা পড়তে পারে তা ধারণার বাইরে ছিল।
সকালে সূর্যের মুখ দেখা গেল না। ঘরের বাইরেও যাওয়ার উপায় ছিলো না। দরজা জানলা বন্ধ করে বসেই প্রায় এক কেটলি চা খেলাম। তাতেও গা-গরম হল বলে মনে হল না। বাড়িতে বসে থাকলে শীত আরো বেশি লাগে। তাই ভালো করে গরম জামাকাপড় জুতো-মোজা এবং টুপি চাপিয়ে হাঁটতে বেরিয়ে পড়লাম।
বাইরে একটা কনকনে হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে কান কেটে নিয়ে যাবে। নাক-মুখের যেটুকু অংশ আ-ঢাকা আছে সেটুকু অংশ মনে হচ্ছে অসাড়। এখন সাতটা বেজেছে কিন্তু এখনও মুখ থেকে সমানে ধোঁয়া বেরুচ্ছে কথা বললেই।
বাইরে বেরিয়েই মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।
ঝরা-পাতা ঝরা-ফুলে সমস্ত পথ প্রান্তর পাহাড়তলি ছেয়ে গেছে। ছেয়ে গেছে পাখির কোমল পালকে। গোলাপ-ফুলের সমস্ত সৌন্দর্য মাটিতে ঝরে গেছে-যা রয়েছে, তা কঙ্কালসার কাঁটা। সমস্ত প্রকৃতি এক বিষাদ-বিধুর বিধবার সাজে সেজেছে।
এই স্তব্ধ ঝড়ের পরে শীতার্ত শান্তির মধ্যেও তিতিরগুলোর গলা শোনা যাচ্ছে চতুর্দিক থেকে। তিতিরদের ভাষা জানা নেই আমার, জানলে, বলতে পারতাম, ওরা সুখের না দুঃখের কথা বলছে।
প্যাটের বাড়ির পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছি, তখন হঠাৎ প্যাটের গলা শুনলাম–ভীষণ উৎসাহী খুশির গলা।
প্যাট ক্রাচে ভর দিয়ে ওর সিঁড়ির উপর একটা উইন্ড-চিটার গায়ে দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। বলল, গুড মর্নিং মিস্টার বোস।
আমি মুখ তুলে বললাম, ভেরী গুড মর্নিং ইনডিড।
প্যাট সিঁড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নেমে এল, বলল, কোথায় চললে?
এই, একটু হাঁটতে বেরিয়েছি।
কোনো বিশেষ কোথাও?
আমি হেসে বললাম, না। ঘরে বসে থাকতে পারছিলাম না ঠাণ্ডায়। দিনের বেলায় ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালাতেও ইচ্ছা করে না। তাই বেরিয়ে পড়লাম।
প্যাট বলল, তোমার যদি বিশেষ কোথাও যাবার না থাকে তাহলে চল আমার সঙ্গে মিস্টার বয়েলসকে দেখে আসি।
মিস্টার বয়েলস্ কে? আমি বললাম।
মিঃ বয়েলস ভীষণ একাকী এক বৃদ্ধ।
ভদ্রলোকের দুই মেয়ে। মেয়েদের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়েছিলেন। তারপর জামাইরা সে সম্পত্তি বেচে দিয়ে একজন ক্যানাডায় এবং অন্যজন অস্ট্রেলিয়ায় চলে গেছে। শুনেছিলাম মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি অ্যাফেশনেট হয় কিন্তু এই বিপত্নীক অসহায় বৃদ্ধকে দেখে সে কথা আমার মনে হয় না। টাকা-পয়সা দিয়ে সাহায্য করা দূরের কথা, সব সময় মনে করে ক্রিসমাসে একটা কার্ডও পাঠায় না তারা বাবাকে। অথচ এই বাবাই তাদের কোলকাতার লা-মার্টিনিয়ারে, লরেটোয় পড়িয়েছিলেন, ভাল বিয়ে দিয়েছিলেন, সমস্ত সম্পত্তি মেয়েদের তাঁর জীবদ্দশাতেই সমানভাবে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। সেই সৎকর্মেরই এই পরিণতি। সত্যিই, ভাবলে অবাক হতে হয়।
কি করে চলে মিস্টার বয়েলস-এর?
চলেই না, বলতে পারো, হাওয়া খেয়ে থাকেন।
ভাবলেও খারাপ লাগে।
এ জায়গাটা সেদিক দিয়ে অভিশপ্ত। এখানে অনেক অসহায় সম্বলহীন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা দেখতে পাবে, তাদের দেখে আমি যে বিয়ে-থা করিনি, তোমরা যাকে সংসার করা বলল, তা করিনি বলে, নিজেকে খুব বুদ্ধিমান বলে মনে হয়।
সংসারের জন্যে অনেক কিছু করলে মানুষ স্বাভাবিক কারণে সংসারের কাছে কিছু আশাও করে। এবং মনে হয়, সে আশা করাটা অন্যায়ও নয়। শেষের দিনে যদি এই-ই ঘটে, যখন মানুষ একটু সঙ্গ চায়, একটু সহানুভূতি চায়, তখন যদি তার অশক্ত হাতে তাকে এমন করে বাঁচার জন্যে, নিছক বাঁচার জন্যেই লড়াই করতে হয়, তাহলে এই সংসার-সংসার মিথ্যে পুতুল-খেলা খেলে লাভ কি বল?
একটু থেমে প্যাট বলল, কাল রাতে ঝড় উঠতেই আমার মিস্টার বয়েলস-এর কথা মনে হল, মনে হল, হয়ত গিয়ে দেখব এই দারুণ ঠাণ্ডায় মরে কুঁকড়ে আছেন মিস্টার বয়েলস। বুঝলে মিস্টার বোস, মিস্টার বয়েলসের তুলনায় আমি সুস্থ, যদিও আমার চলাফেরার জন্যে এই ক্রাচের উপর নির্ভর করতে হয়। আমার তবু একজোড়া ক্রাচ আছে, যে-দুটোকে আমি এমন ঠাণ্ডা দিনে বুকের কাছে চেপে ধরে আমার চতুর্দিকের স্বার্থপর পৃথিবীর মুখে লাথি মেরে মেরে ঘৃণার সঙ্গে আমার একটা পা মাটিতে ফেলে ফেলে আমি হাঁটতে পারি।
কিন্তু এই বয়েলসদের তাও নেই। আঁকড়ে ধরার মত কিছুমাত্র আর এদের অবশিষ্ট নেই এ-পৃথিবীতে। অথচ এদের সব কিছুই থাকার কথা ছিল। তোমার কি মনে হয় মিস্টার বোস, এ-সংসারে আমাদের আপনার বলতে কেউই নেই? কেউই থাকে না?
আমি জবাব দিলাম না। কোটের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে আমি নিঃশব্দে ওর পাশে পাশে হাঁটছিলাম।
প্যাট ওর সাঁতরাগাছির ওলের মত মুখটি ঘুরিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে আবার শুধোল, কি? উত্তর দিচ্ছে না যে?
আমি বললাম, উত্তর একটা জিভের ডগায় আসছে, কিন্তু সেটা ঠিক উত্তর কি না জানি। কারণ আমার আমাদের জীবন সম্বন্ধে এখনও অনেক দেখার বাকি, জানার বাকি, নিজেকে জানারও অনেক বাকি।
আমার কি মনে হয় জানো প্যাট, আমার, তোমার আমাদের সকলের জীবনই একটা চলমান অভিজ্ঞতা–এতে কোনো জানাই, কোনো মতই স্থিতিশীল নয়। আজ যা নির্ভুল বলে জানছি, কাল সেটাকেই চরম ভুল বলে মনে হয়। আজ যেটাকে চমকপ্রদ বুদ্ধিমত্তা বলে ভাবছি, কালই জানব যে সেটা একটা পরম নির্বুদ্ধিতা। তাই কোনো ব্যাপারে কিছু বলার আগে, বলতে ভয় হয় আজকাল।
প্যাট দাঁড়িয়ে পড়ে উইন্ড-চিটারের পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরালো, বলল, তুমি আমার প্রশ্নটা এড়িয়ে গেলে।
আমি হাসলাম, বললাম, উত্তর–মানে আমার উত্তর যদি শুনতেই চাও ত বলছি। আমার কি মনে হয় জানো প্যাট, আমাদের জীবনে, এই সংসারে আপনার বলতে, নিজের বলতে শুধু একটিই জিনিস আছে। একটি মাত্র জড়পদার্থ।
তার মানে? প্যাট বলল।
বললাম, সে জিনিসটি হচ্ছে বাথরুমের আয়না এবং সে আয়নায় প্রতিফলিত তোমার সত্যিকারের ব্যথাতুর মুখ। ঐটুকুই।
এই সংসারে নিজের বলতে কেউই নেই প্যাট। কেউ কেউ আপনার হয়, আপনার হতে চায়; ক্ষণকালের জন্যে, কিছুদিনের জন্যে। তুমি যদি সমস্ত জীবনটাকে ছোট করে হাতের মধ্যে তুলে ধরে একটা বলের মত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখো ত দেখবে যে, তুমি ছাড়া, তোমার আয়নার মুখ ছাড়া, তোমার আপনার বলতে আর কেউই নেই; সত্যিই কেউ নেই।
প্যাট বলল, বাথরুমের আয়না কেন? ঘরের আয়না না কেন?
আমি হেসে বললাম, ঘরের আয়নার সামনে তোমার নিরবচ্ছিন্ন অবকাশ ও গোপনীয়তা ত নেই। হঠাৎ টেলিফোন বেজে উঠবে, তোমার স্ত্রী (যদি থাকতেন) তোমার ছেলেমেয়ে, তোমার মা-বাবা হঠাৎ পর্দা ঠেলে ঘরে ঢুকবেন। আর যেই তাঁরা ঢুকবেন, অমনি তোমার অভিনয় শুরু করতে হবে। তুমি আর তোমার নিজের মধ্যে থাকবে না।
প্যাট বলল, এ আবার কি কথা? তুমি কি বলতে চাও, আমাদের জীবনের সমস্ত সম্পর্কই অভিনয়ের? সত্যি সম্পর্ক বলতে কি কিছুই নেই?
সত্যি সম্পর্ক আছে। আমি বললাম, যেমন আমার এবং তোমার সম্পর্ক। এ-সম্পর্কে কোনো প্রত্যাশা নেই কারো। আমি তোমার পাশের বাড়িতে অল্প কদিনের জন্যে এসেছি। আমাকে তোমার এবং তোমাকে আমার ভালোও লাগতে পারে, খারাপও লাগতে পারে, কিন্তু যেমনই লাগুক সেই সত্যি অনুভূতিটুকুকে গোপন করার কিছুই নেই।
তোমার যদি আমাকে খারাপ লাগে, আমার সঙ্গে তুমি কথা না বলতে চাও, সকালে বিকালে উইশ না করতে চাও দেখা হলে, নাও করতে পারো। এবং তা না করলে আমারও কিছু লাভ বা ক্ষতি নেই। কিন্তু সাংসারিক সব সম্পর্কই ত অন্য রকম।
মাঝে মাঝে আমার কি মনে হয় জানো, এই সংসার একটা দারুণ অর্কেস্ট্রা। কোনো বুড়ো, মান্ধাতার আমলের প্রস্তরীভূত সামাজিক প্রতিভূ একজন কনডাকটরের মতো তার হাতের ছড়ি ওঠায় নামায় এবং তুমি যে বাজনাই বাজাও না কেন, তোমাকে সকলের সঙ্গে একই সুরে, একই লয়ে, একই মাত্রায় বাজাতে হবে।
তোমার ভালো লাগুক, কি নাই-ই লাগুক। তোমার তার ছিঁড়ে গেলে তাড়াতাড়ি তার বেঁধে নিতে হবে, হাত শ্লথ হয়ে এলে তবুও অন্যদের সঙ্গে একই সঙ্গে বাজাতে হবে। যদি তুমি থেমে যাও, না বাজাও; সমস্ত অর্কেস্ট্রা তখনই থেমে যাবে।
যদি তুমি থেমে যাও, সেই পলিতকেশ কনডাকটর এবং তোমার এতদিনের সঙ্গীরা, তোমার সঙ্গে এক সুরে এক লয়ে বাজানো বহু বছরের সঙ্গীরা সবাই বাজনা থামিয়ে তোমার দিকে তাকাবে। সবাই বলবে, ছিঃ ছিঃ। সবাই বলবে, কি খারাপ! সবাই বলবে, কি দুশ্চরিত্রতা, কি বিদ্রোহ।
তুমি অমনি আবার বাজনা তুলে নেবে, আবার বাজাবে সেই একই সুরে, একই লয়ে–তুমি আবার সেই মেষপালের একজন হয়ে যাবে–তোমার ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, তোমার সুখ-দুঃখ, স্বকীয়তা, তোমার নিজের শরীর, নিজের মন আবার নতুন করে বাঁধা দেবে সেই সামাজিক জনগণের স্টিমরোলার রায়ের কাছে। একজন সস্তা বেশ্যার মত তুমি নিজেকে বিক্রি করবে। কারণ সমস্তরকম উপায়ের উৎসমুখে বাস করেও তুমি নিরুপায়।
প্যাট বোধ হয় আমার কাছ থেকে ওর সহজ ও ক্যাজুয়াল প্রশ্নের এমন একটা ডিসটার্বিং উত্তর আশা করেনি।
তাই ও অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সো হোয়াট? তোমার গাটস্ থাকলে তুমি বিদ্রোহ করবে। বিদ্রোহ করতে ভয় কিসের?
আমি বললাম, ভয় তোমাদেরই। ভয় সকলকে। ভয় কাকে নয়? তোমরা মানে সংসারের তোমরা। নিজেরা যা চিরদিন করতে চেয়েছ। চিরদিন বাঁধন-ছিড়ে পালিয়ে এসে নিজের শরীর ও মনের নৌকোয় নিজের খুশির পালে ইচ্ছার হাওয়া লাগিয়ে নিজের জীবনের দরিয়ায় ভেসে পড়তে চেয়েছ, কিন্তু সাহসে কুলোয়নি যে চড়ুই-পাখি তোমাদের; সেই তোমরাই একজন পুরুষ কি একজন নারী সেই সাহস দেখালেই ছিঃ ছিঃ করে উঠবে, তোমরাই তার ঘাড়ে পড়ে জংলী কুকুরের পালের মত তাকে ছিন্নভিন্ন পদদলিত করবে।
কি? করবে না? তুমি করোনি? আমি করিনি? এ পর্যন্ত কখনও কি করিনি আমরা? ভেবে দেখো ত?
তাই-ই বলছিলাম প্যাট, পারা যাবে না কেন? কিন্তু এমন যে করতে চায় সেই বিদ্রোহীর মেরুদণ্ডে যথেষ্ট জোর থাকা দরকার। তোমার আমার মত শ্যাওলা-ধরা মরচে পড়া সামাজিক জয়গান-গাওয়া মেরুদণ্ডে সে জোর নেই।
প্যাট কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, ওয়েল, আই থিঙ্ক উ্য আর রাইট। বড় রাস্তা ছেড়ে একটা ভাঙা পলেস্তারা-খসা খয়েরী হয়ে-যাওয়া, গায়ে ঘাস ও অশ্বত্থের চারা-গজানো পুরোন বাড়ির পাশ দিয়ে আমরা একটা পায়ে চলা পথে ঢুকে পড়লাম।
পথটা উঁচু নীচু–বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। দুধারে ঘন শালের জঙ্গল–সে জঙ্গলে যেন গত রাতে হাতীর দল মত্ততা করে গেছে। কোথাও মাটি দেখা যায় না–ঝরা-পাতা ফুল আর কুটোয় ভরে আছে সমস্ত জমি। এক দারুণ গালিচা যেন কেউ অদৃশ্য হাতে পেতে দিয়েছে। সে গালিচার রঙের বর্ণনা করি এমন ভাষা আমার নেই। সবুজ লাল এবং হলুদের যে কত বিচিত্র নরম ও তীব্র রেশ হতে পারে তা এই গালিচা না দেখলে বোঝা যাবে না।
পা ফেললে এখানে কোনো শব্দ হয় না। পাতার নরম আর্দ্র গালচেয় পা পড়ে। ভুরভুর করে আতরের মত বনজগন্ধ ওঠে।
এখনও হু হু করে হাওয়া বইছে, ভেজা জঙ্গল–পাহাড়ের প্রভাতী গন্ধ বয়ে–সেই পরিষ্কার, নির্মল শীতল হাওয়া ফুসফুসের হয়ত হৃদয়েরও যা কিছু কালিমা সব সঙ্গে সঙ্গে মুছে নিচ্ছে।
কিছুদূর এগিয়ে যেতেই একটা বাঁকের মুখে দেখা হল লাবুর সঙ্গে।
এই শীতেও লাবুর খালি পা, গায়ে একটা প্রাপ্তবয়স্কদের ছেঁড়া কোট, পরনে সেই গুটিয়ে-পরা প্রাপ্তবয়স্ক লোকের ফুলপ্যান্ট।
বুকের কাছে কি একটা জিনিস দুহাতে সযত্নে ধরে লাবু এদিকে আসছিল। আমাদের ও দেখতে পায়নি।
কাছাকাছি আসতেই মুখ তুলে আমাদের দেখেই লাবু যেন খুব ভয় পেল, পথ ছেড়ে জঙ্গলে দৌড়ে যেতে চাইল যেন ওর পা।
আমি ডাকলাম, লাবু।
লাবু থমকে দাঁড়াল।
আমরা এগিয়ে যেতেই লাবু দুহাত তুলে দেখাল ওর হাতের জিনিস।
একটি নেতিয়ে-পড়া হলদেকালোয় মেশা হলুদ-বসন্ত পাখি।
পাখিটাকে দেখে মনে হচ্ছে না যে পাখিটা বেঁচে আছে। ঘাড়টা একপাশে হেলানো–অমন সুন্দর রেশমী-নরম তেল-চকচকে উজ্জ্বল পালকগুলো যা স্বাভাবিক অবস্থায় গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকে সেগুলো ভিজে গিয়ে চতুর্দিকে এলোমেলো হয়ে গেছে। পালকের ফাঁকে ফাঁকে ওর নরম কোমল বুক দেখা যাচ্ছে।
লাবু বলল, বেঁচে আছে। দেখুন, বুকটা এখনও গরম। ধরে দেখুন।
আমি বললাম, তুমি কি করবে এটাকে নিয়ে?
লাবুর কটা চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠল।
ও বলল, বাঁচাবো কাল ঝড়ে ও ঠাণ্ডায় ও মাটিতে পড়েছিল, ও মরে যাচ্ছিল, আমি দেখতে পেয়ে কুড়িয়ে আনলাম। আমি ওকে ঠিক বাঁচাব, দেখবেন।
বাঁচিয়ে কি করবে? পুষবে?
লাবু হাসল, ওর দাঁতভাঙা রুক্ষ আন্তরিক হাসি। বলল, ধ্যাৎ।
ওকে তাহলে বাঁচিয়ে লাভ কি?
ওকে বাঁচিয়ে, তারপর ওকে উড়িয়ে দেব।
তারপরই বলল, খাঁচার মধ্যে বাঁচা কি বাঁচা নাকি?
প্যাট আর একটা সিগারেট ধরিয়েছে ততক্ষণে।
প্যাট কৌতূহলী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, বাঁচিয়ে তোমার লাভ?
লাভ? বলে লাবু অনেকক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থাকল প্যাটের মুখের দিকে।
ওর চোখ দেখে মনে হল ওর জীবনে লাভ-ক্ষতির হিসেবটা এখনও ওর সমস্ত কাজ ও অকাজকে আমাদের যে-ভাবে করেছে, সেভাবে আচ্ছন্ন করেনি।
একটু ভেবে বলল, কিসের লাভ? এমনিই বাঁচাব। ভাল লাগে; তাই। তারপর বলল, বাঁচাতে, কাউকে বাঁচাতে আমার দারুণ লাগে।
লাবু আর কথা না বলে আমাদের পাশ কাটিয়ে যেমন আপনভোলা হয়ে হাঁটছিল তেমন আপনভোলা হয়ে চলে গেল।
আরো কিছুদূর যাবার পর একটা টিলার একেবারে নীচে একটা ছোট্ট কটেজ চোখে পড়ল।
এককালে কটেজের গায়ের রং বোধ হল লাল ছিল, এখন জলে, রোদে, বাসি-পচা-ফ্যাকাসে পাতার মত হয়ে গেছে। ছাদটা টালির; এখানের সব বাড়িরই যেমন। বাইরে একটা ছোট্ট বারান্দা, কাঠের রেলিং দেওয়া।
বাড়িটার সমস্ত পরিবেশে, বাড়িটার এই হিমে রোদ-না-ওঠা সকালে অসহায় অসংলগ্নভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গীর মধ্যে কেমন একটা গা-ছমছম অজাগতিক ভাব ছিল।
ঝরা-পাতা, ঝরা ফুল মাড়িয়ে আমরা বারান্দায় উঠে দরজার কাছে দাঁড়ালাম।
বারান্দার এক কোণায় একটা ভাঙা কাঠের ইজি-চেয়ার। বসতে বসতে যেন কাঠের চেয়ারটা ক্ষয়ে গেছে। এককালে সবুজ রং ছিল চেয়ারটার, এখন শুধু একটা সবুজের অস্পষ্ট আভা এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে।
এ বাড়ির কোথাও কোনো রং নেই–সমস্ত বাড়িটাই কেমন ম্যাটমেটে পাংশুটে। প্যাট ওর তীক্ষ্ণ ভাঙা গলায় ডাকল, মিস্টার বয়েলস, মিস্টার বয়েলস, আর ঊ্য ইন? ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না।
প্যাট আবার ডাকল গলা চড়িয়ে, মিস্টার বয়েলস, আর উ্য ইন? তবুও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। যতিহীন ঝোড়ো হাওয়াটা শালের বনে, টালির ছাদের খাঁজে খাঁজে হুইসেল বাজিয়ে ভূতের বাঁশির মত বেজে যেতে লাগল।
প্যাট এবার দরজায় ধাক্কা দিল। পরক্ষণেই ধাক্কা দেওয়া বন্ধ করল, পাছে দরজাটা ভেঙে যায়। পাতলা কাঠের টুকরো জোড়া দিয়ে দিয়ে দরজাটা বানানো বাইরে থেকে হাওয়া ঢুকছে সী সী করে। কাঠের ফাঁক দিয়ে ভিতরে দেখার চেষ্টা করলাম, কিছুই দেখা গেল না।
প্যাট এবার প্রায় চিৎকার করে ডাকল, মিস্টার বয়েলস, ফর গডস্ সেক, প্লিজ ওপেন।
এমন সময় পাহাড়ের গা বেয়ে একজন দেঁহাতী লোককে নেমে আসতে দেখা গেল।
প্যাট ওকে দেখে হিন্দিতে জিগ্যেস করল, সাব কা কা হো গ্যায়া?
লোকটি নিরুত্তাপ গলায় বলল, বুখার হ্যায়।
কবসে?
তিন চার রোজসে।
লোকটা আর বাক্যালাপে উৎসাহ না দেখিয়ে বাড়ির পেছনে গিয়ে কি প্রক্রিয়ায় কোন দরজা খুলে ভিতরে ঢুকল জানি না। কিন্তু দেখলাম, ঢুকল। তারপর সে-ই এসে ছিটকিনি খুলে সামনের দরজা খুলে ফেলল।
প্যাট আমাকে বলল, প্লিজ কাম ইন।
প্যাটের সঙ্গে সেই প্রায়ান্ধকার বাড়িতে ঢুকে পড়লাম।
বাইরে একটা বসবার ঘর। ভাঙা-চোরা কতগুলো ফার্নিচার–একটা রোঁয়া-ওঠা অপরিষ্কার পাটের কার্পেট।
সেই ঘর পেরিয়ে ভিতরের ঘরে ঢুকলাম। ঢুকেই আঁতকে উঠলাম। মানুষের মুখ যে এমন হয় আমার তা জানা ছিলো না; দেখা ছিলো না। ইংরিজি অভিধানে এমাসিয়েটেড বলে একটা কথা আছে। সঠিক বাংলা প্রতিশব্দ কি হওয়া উচিত তা আমি জানি না।
তবে, সেই প্রথম, কথাটার মানে বুঝতে পারলাম।
দেখলাম, একজন কঙ্কালসার বৃদ্ধ। তাঁর অস্থিচর্মসার মুখ দেখা যাচ্ছে কম্বলের আড়ালে, এবং তিনি যে বালিশ মাথায় দিয়ে শুয়ে আছেন সেই বালিশেই আর একজন ঝাঁকড়া চুলের মাথাওয়ালা ছোটখাট মহিলা শুয়ে আছেন।
পাশের মানুষটি কে বুঝতে পারলাম না কারণ প্যাট বলেছিল মিসেস বয়েলস অনেকদিন আগেই মারা গেছেন।
প্যাট কাছে গিয়ে ওর ক্রাচে ভর করে দাঁড়িয়ে ডাকল, মিস্টার বয়েলস, মিস্টার বয়েলস।
বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা কোনো সাড়া দিলেন না। প্যাট কপালে হাত ছুঁইয়ে দেখল, জ্বর আছে কি নেই।
তারপর এ ঘরের লাগোয়া খাবার ঘর ও রান্নাঘরে এসে প্যাট সেই লোকটিকে, যে আমাদের দরজা খুলে দিয়েছিল তাকে শুধোল, জ্বর ত এখন নেই? সাহেব কখন শেষ খেয়েছিলেন? কবে খেয়েছিলেন?
লোকটি বলল, পরশু দিন।
তার পরে?
বলে প্যাট চোখ বড় বড় করে তাকাল ওর দিকে।
ও বলল, তার পরে আমি আসার সময় পাইনি। আমাকে ত করে খেতে হয়। সেদিন রোজ আমি যেমন বাইরে থেকে পিছনের দরজা বন্ধ করে চলে যাই, তেমনই চলে গেছিলাম। কাল রাতের ঝড়-বৃষ্টির পর এই আবার আসছি খোঁজ নিতে।
প্যাট একবার আমার মুখের দিকে তাকাল। তারপর খাওয়ার ঘর ও রান্নাঘর হাতড়ে হাতড়ে সমস্ত আনাচকানাচ খুঁজেও কিছু খাওয়ার জিনিস খুঁজে পেল না। তারপর হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলল, হ্যাভ উ্য ইউর পার্স অন উ্য?
আমি বললাম, আছে, পার্স সঙ্গে আছে। কেন, কি চাও?
প্যাট বলল, তোমার কাছে দশটা টাকা ধার চাই।
আমি কথা না বলে দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। প্যাট টাকাটা নিয়ে, পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে একটা ফর্দ লিখতে বসলো। ফর্দ লেখা শেষ করে সেই লোকটিকে দিয়ে বলল, শীগগির মুদির দোকান থেকে এই জিনিসগুলো নিয়ে আসতে। প্যাট আরও একটা ছোট চিঠি লিখে দিল ওর বাড়ির মালির কাছে–ওর ঘরে একটি বোতলের তলায় পুরোন দেশী ব্রান্ডির সামান্য তলানী অবশিষ্ট আছে। সেই ব্রান্ডিটা দিয়ে দিতে বলে লিখল।
লোকটি চলে গেল।
প্যাট রান্নাঘরের কোণা থেকে একটা কুড়ল তুলে নিয়ে আমাকে বলল, তুমি ওদের দেখো। যদি উঠে পড়ে এর মধ্যে তাহলে আমার নাম কোরো। আমি এক্ষুনি একটু কাঠ কেটে নিয়ে আসছি। যা হোক কিছু রান্না করে খাওয়াতে হবে মিস্টার বয়েলসকে ও কুকুরটাকে। এই ঠাণ্ডায় না খেয়ে থাকায় ওদের দুজনেরই কোমার মত হয়েছে। খিদে এবং শীতে দুজনেই এমন কুঁকড়ে গেছে।
আমি বললাম, কুকুর মানে? কুকুর কোথায়?
প্যাট বলল, মিস্টার বয়েলসরে পাশে ওঁর কুকুর লুসি শুয়ে আছে। ককারস্প্যানিয়েল। অন্ধকারে তুমি কি মানুষ বলে ভুল করলে নাকি?
আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি ত তখন থেকে তাই-ই ভাবছি যে, মিস্টার বয়েলসের পাশে শুয়ে থাকা সাদা চুলের বৃদ্ধাটি কে?
প্যাট একটু হাসল-শব্দ না করে, তারপর বলল, এক্ষুনি আসছি।
ঐ ঘরের মধ্যে বসে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগছিল। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম।
প্যাট কাছেই জঙ্গলের মধ্যে ঝড়ে-পড়া কাঠ কাটছিল। ওর কুড়ল চালানোর শব্দ হতেই আমার হুঁস হল যে আমার ওকে পাঠানো উচিত হয়নি। ও ওর এক-পা নিয়ে কাঠ কাটবে কি করে? কিন্তু আমি শব্দ পেলাম যে ও কাঠ কাটছে।
দৌড়ে গিয়ে ওর হাত থেকে কুড়লটা কেড়ে নিতেই ও হাসল, বলল, অল রাইট, লেটস্ ডু ইট টুগেদার, বলে ও এক পায়ে দাঁড়িয়ে কাঠগুলোকে পা দিয়ে চেপে ধরতে লাগল, আমি কুড়ল চালাতে লাগলাম। দেখতে দেখতে, বেশ অনেকক্ষণ জ্বালানোর মত কাঠ জড়ো হয়ে গেল।
চারিদিকে শুকনো বলে কোন কিছু ছিলো না যে, তাড়াতাড়ি আগুন করবার জন্যে আনা যায়।
সূর্য তখনো ওঠেনি। আকাশ ও চতুর্দিকের ভেজা সুগন্ধি শীতার্ত প্রকৃতির দিকে চেয়ে মনে হল সূর্য আর কোনদিনও উঠবে না।
আমি যখন প্রথম কিস্তির কাঠগুলো বয়ে আনছি, এবং প্যাট আমার পাশে পাশে হাঁটছে তখন হঠাৎ খোলা দরজা দিয়ে একটা সাদা কিন্তু কালচে হয়ে-যাওয়া ককারস্প্যানিয়েলকে আসতে দেখা গেল আমাদের দিকে।
কুকুরটা দৌড়ে আসছিল না। কেমন নেশাগ্রস্তর মত হেলতে দুলতে আসছিল।
কুকুরটা এগিয়ে কাছে এসেই প্যাটকে দেখে অনেক কষ্টে একবার লেজ নাড়ল, তারপর একবার ঘেউঘেউ করে ডেকে ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু ডাকের বদলে যে শব্দটা তার মুখ থেকে বেরোল সেটাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ডাকটা বড় করুণ। এক অবলা জীবের অশেষ সহ্যশক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে জান্তব যন্ত্রণার সে এক করুণ অভিব্যক্তি।
প্যাট কুকুরটাকে অনেকক্ষণ আদর করল।
আমি, প্যাট ও কুকরটা একসঙ্গে পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকলাম।
আমি যখন কাঠগুলো ঢেলে রাখছি, তখন মিস্টার বয়েলস যেন জীবনের অন্য পার থেকে ক্ষীণ দুর্বল, অথচ তীক্ষ্ণ গলায় শুধোলেন, হুজ দ্যাট?
প্যান্ট জোরে উত্তর দিল, ইটস মী, মিস্টার বয়েলস, ইটস মী, প্যাট গ্লাসকিন।
পরক্ষণেই প্যাট বলল, আমরা একটু কাজ করছি, এক্ষুনি যাচ্ছি ও ঘরে। সঙ্গে আমার এক প্রতিবেশী আছে, নিয়ে যাচ্ছি।
তারপর উনুনে কাঠ সাজাতে-সাজাতে প্যাট বলল, এখন ও ঘরে গেলেই কথা বলতে চাইবে বুড়ো। আগে আগুন করি, ঘরেও ফায়ার প্লেসে আগুন করব, কিছু খাবার বানাই, তারপর বুড়োকে খাইয়ে-দাইয়ে কথা বলব। এখন ওঁর কথা বলার মত অবস্থা নেই।
তারপর অনেকক্ষণ আমরা কাজ করতে লাগলাম।
কখন যে সেই লোকটি প্যাটের লিস্ট অনুযায়ী সব রসদ এনে হাজির করল, কখন যে প্যাট উনুন ধরিয়ে, লোকটিকে দিয়ে শোবার ঘরের ফায়ার-প্লেসে আগুন জ্বালিয়ে ডালের স্যুপ, টোস্ট এবং আলু ও ডিম দিয়ে একটা কারিমত বানিয়ে ফেলল বুঝতেই পারলাম না। দ্রুতগতিতে কাজ করতে করতে প্যাট ফিসফিস করে আমার সঙ্গে কথা বলছিল।
বলছিল, দ্যাখো, এরকম করেও মানুষ বেঁচে থাকে, মানুষের প্রাণ বড় শক্ত। শুয়োরের প্রাণের চেয়েও শক্ত। মানুষের বাঁচার সাধ বড় লজ্জাকর।
আমি বললাম, তুমি কি এই অবস্থায় থাকলে বাঁচতে চাইতে না প্যাট!
প্যাট দেওয়ালে হেলান দিয়ে ওর ক্রাচ দুটো রেখে একটা টুলের ওপর বসে টেবিলের উপর ছুরি দিয়ে পেঁয়াজ কাটছিল।
হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে বলল, খুব ভালো লোককেই প্রশ্নটা করেছ বোস কারণ আমারও একদিন এ অবস্থা হতে বাধ্য। মিস্টার বয়েলসের তাও মেয়েরা ছিল, এক সময় স্ত্রীও ছিল, তবুও আজকে তার এই অবস্থা। কিন্তু আমার ত আজও কেউ নেই, সেদিনও কেউ থাকবে না। তবে একটা কথা তোমাকে বলছি বোস, তুমি জেনে রেখো যে, আমি নিজেকে এই অবস্থাতে পৌঁছতে দেব না। দেখবে, তার আগেই কোন-না-কোন উপায়ে আমি পালাব এই নিষ্ঠুর শীতার্ত জগৎ থেকে। তোমাকে বলেছি, আমি আমার জীবনকে ভালোবাসি। ডেসপাইট অফ এভরিথিং আমি আমার জীবনকে ভালোবাসি। কিন্তু এরকম জীবনকে নয়।
যতদিন এই গায়ের উইন্ড-চিটারের মত, আমার বুকের ভিতরের মনের উইন্ড-চিটারটা অক্ষত থাকবে, ততদিনই আমি বাঁচব। আমি কাউকে আমাকে করুণা করতে দেব না, কোন কিছুর জন্যেই নয়। আই উইল কি মাই ওওন বাকেট উইদাউট দা হেল্প অব আদারস্। তুমি দেখো। যদি তখনও তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকে, তবে তখন দেখো। জেনো, আমি এরকম কুঁই কুঁই করে কখনো বাঁচবো না। মরবও না। আই ওয়ান্ট টু ডাই উইথ আ ব্যাং, নট উইথ আ হুইমপার। আমি সশব্দে সমস্ত অনুভূতির তীব্রতার মধ্যে বাঁচতে চাই, মরার সময়েও সচকিত শব্দতার মধ্যে মরতে চাই। বিলিভ মি, আমাকে বিশ্বাস করো বোস।
প্যাটের মুখে একটা আশ্চর্য হাসি দেখলাম। সে রকম হাসি টলস্টয়ের গল্পের নায়করাই শুধু হাসতে পারে বলেই জানতাম।
আমার সামনে এক-পা ঝুলিয়ে বসে থাকা এই সাদার মধ্যে কালো ছিট-ছিট মুখের প্যাটও যে অমন দুর্জ্ঞেয় হাসি হাসতে পারে তা আমার জানা ছিলো না।
প্যাটকে এই গত এক ঘণ্টা দেখে সত্যিই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। ও ওর শারীরিক অক্ষমতা সত্ত্বেও কত কর্মক্ষম কত চটপটে–কথায়-বাতায় ওর নিজের প্রতি সম্মানজ্ঞান, ওর জীবনের প্রতি ভালোবাসা দেখে মনে হচ্ছিল যে, আমাদের ধারে-কাছের, চেনা-পরিচিত প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই কত কি শেখার আছে। প্রত্যেককে খতিয়ে দেখলে, খুঁটিয়ে দেখলে তাদের সম্মান-অসম্মানজ্ঞান, স্বার্থপরতা-স্বার্থহীনতা, সততা-অসততা কত প্রাঞ্জলভাবে চোখের সামনে ফুটে ওঠে। ইচ্ছে হয়, ইচ্ছে করে আমার চোখের-দেখা, কাছের মানুষদের সবাইকে ভালোবাসতে, বা শ্রদ্ধা করতে,–কিন্তু দুঃখের বিষয় বেশির ভাগ মানুষই মনুষ্যত্বহীন। মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে শোভিত জীব বিশেষ। দুঃখটা সেখানেই।
কলাই করা চলটা-ওঠা ডিশে করে সুপ ঢেলে নিয়ে, অন্য ডিশে টোস্ট ও কারি সাজিয়ে, প্যাট যখন ক্যানেস্তারার টিন-কাটা-ট্রেতে করে সব ও-ঘরে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত হল তখন মিস্টার বয়েলস আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন।
প্যাট ওঁকে জাগিয়ে, খাটের পাশে বসে সব আস্তে আস্তে খাওয়াল। কুকুরটা খাটেই মিস্টার বয়েলসের পাশে গুঁড়িসুড়ি হয়ে চোখ বুজে বসে ছিল। প্যাট ডাকল, লুসি, লুসি।
লুসি চোখ খুলে খাটের উপরই দাঁড়িয়ে পড়ল। প্যাট লুসিকে নিয়ে গিয়ে ঘরের কোণায় ওকেও গরম ডালের সঙ্গে মিশিয়ে খাবার দিল।
লুসি লম্বা জিভ বের করে চাক্ চাক্ শব্দ করে খেতে লাগল। মিস্টার বয়েলসরে খাওয়া শেষ হতে সময় লাগল। খাওয়া শেষ হলে প্যাট গরম জলের সঙ্গে ব্রান্ডি মিশিয়ে ওঁকে খেতে দিল।
মিস্টার বয়েলস ব্রান্ডির গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললেন–এত বড় ভোজ আজ কিসের জন্যে? তারপরই দেওয়ালে টাঙানো রাঁচির একটা জুতোর কোম্পানির ক্যালেন্ডারের দিকে চেয়ে বৃদ্ধ উত্তেজনায় কেঁপে উঠলেন। বললেন, বাই জোভ, টু-ডে ইজ মাই বার্থডে! হোয়াট আ কো-ইনসিডেন্স।
আমরা সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম।
প্যাট বলল, মেনি মেনি হ্যাপী রিটার্ন অব দা ডে।
কথাটা শুনেই বৃদ্ধ কেমন মুষড়ে গেলেন-বললেন, ফর গডস সেক, ডোন্ট সে দ্যাট টু মী। ঐ সব আমার চেয়ে ভাগ্যবান লোকদের জন্যে। তার চেয়ে তোমরা উইশ কোরো, আমাকে যেন পরের জন্মদিন আর দেখতে না হয়।
প্যাট একটা সিগারেট ধরিয়ে মিস্টার বয়েলসের দিকে এগিয়ে দিল।
খেয়ে-দেয়ে সিগারেট মুখে দিয়ে মিস্টার বয়েলস বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠলেন। দাঁড়িয়ে উঠে দেওয়াল থেকে গ্রেট-কোটটা পেড়ে নিয়ে গায়ে দিলেন। তারপরই বললেন, ওয়েল, হাউ বাউট ইউ জেন্টেলমেন, ওন্ট ইউ হ্যাভ এনিথিং টু ড্রিঙ্ক?
প্যাট বলল, আমরা চা ভিজিয়েছি। চা খাব পুরো এক কেটলি। বলেন ত চায়ের সঙ্গে ব্র্যান্ডি মিশিয়েও নিতে পারি। আজকের মত ঠাণ্ডা দিন বোধহয় এ বছর আর পড়বে না।
মিস্টার বয়েলস প্যাটের কথা শেষ হবার আগেই বললেন, আর সেই জন্যেই বোধহয় আমার জন্মদিন আজই পড়েছে।
মিস্টার বয়েলস যেন বরফে ঢাকা পাহাড়তলির ওপার থেকে কথা বলছিলেন, তাঁর গলার ও গালের চামড়া শকুনির গলার মত ঝুলে ছিল। গালের হাড় দুটো উঁচু হয়ে ছিল। কোটরগত দুটি এককালীন-তীক্ষ্ণ চোখ ঘোলা রক্তব্যহীন হয়ে উঠেছিল।
উনি বলছিলেন, ওয়েল, মিস্টার বোস, আপনার কথা আমি শুনেছি প্যাটের কাছে। আশা করি এখন আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ। জানেন, আমি এখনও শুধু প্যাটের জন্যে বেঁচে আছি। প্যাট যে আমার জন্যে কি করে তা আপনাকে বোঝাতে পারব না। আমার ছেলে নেই, কেউ নেই, আমার টাকা-পয়সাও নেই। প্যাটের আমার প্রতি ব্যবহারের বদলে আমি যে কিছু করব সে সামর্থ্যও আমার নেই। তবে মানুষের হৃদয়ের দানের যদি কোন দাম থাকে, মানুষ যদি সে দামের বিন্দুমাত্র মর্যাদাও দেয়, তাহলে আমি বলব, প্যাটকে আমি অনেক কিছু দিয়েছি। সব সময় দিই।
বলেই বৃদ্ধ গলার ক্রশ মুঠো করে ধরে বললেন, মানুষের প্রার্থনার যদি কোন দাম থাকে, তাহলে প্যাট একদিন খুব সুখী হবে, আপনি দেখবেন, মিস্টার বোস।
প্যাট হেসে বলল, আমি কি এখনও অসুখী? আমার সব সময়ই সুখ–আপনি আমার জন্যে প্রার্থনা করুন আর নাই করুন।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পড়ল, দেখি দশটা বেজে গেছে। আমার চোখের দিকে চেয়ে প্যাট বলল, ইয়েস, উই থিঙ্ক, উই শ্যাল মেক আ মুভ নাউ।
বৃদ্ধকে প্যাট কথাটা জোরে বলল, বৃদ্ধ বুঝতে পেরে বললেন, হ্যাঁ, যেতে ত হবেই-তোমরা ত সারাদিন এই বুড়োমানুষ এবং একটা বুড়ি কুকুরের কাছে বসে থাকবে না। বুঝলে, তোমরা আমার ছেলের মত। আমার ছেলে থাকলেও ত তারা আমার জন্যে এত করত না।
আমি ওঠার সময় বললাম, আমি কি আপনার জন্যে কিছু করতে পারি মিস্টার বয়েলস?
বৃদ্ধ চমকে উঠলেন, বললেন, ও থ্যাঙ্ক ঊ্য। থ্যাঙ্ক ঊ্য ভেরী মাচ। কিন্তু আমার জন্যে আর কি করবে বল? আমার জন্যে কিছু করার দিন শেষ হয়ে গেছে। বাট, ওয়েল; ইয়েস। ঊ্য ক্যান ডু মী আ ফেভার?
আমি ওঁর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে বললাম, কি? সেটা কি?
বৃদ্ধের বিষাদময় লোলচর্ম মুখে এক দারুণ কৌতুকের হাসি ফুটে উঠল। বৃদ্ধ বললেন, প্যাট যখন আমার কবর খুঁড়বে, তখন প্যাটকে একটু সাহায্য করো। মাই সোল উইল ফিল অনারড। আমার আত্মা আনন্দিত হবে।
আমি উত্তর দিলাম না কোনো। কিন্তু বৃদ্ধের মুখে সেই আশ্চর্য বরফ-গলা হাসিটি অনেকক্ষণ ঝুলে রইল, ওঁর মুখের ঝুলে থাকা চামড়ার মত।
আমরা বেরিয়ে এলাম।
আমাদের পিছনে পিছনে লুসি এল অনেকখানি ভেজা পথ মাড়িয়ে। খেয়ে-দেয়ে লুসির গায়ে জোর হয়েছিল।
কিছুটা গিয়ে প্যাট ঘুরে দাঁড়ালো, বললো, গো ব্যাক, ইউ বিচ।
প্যাটের মুখে কি যেন এক ঘৃণা ফুটে উঠল, অবাক ঘৃণা।
প্যাট বলল, গো ব্যাক লুসি, নাউ অফফ ইউ গো।
লুসি কথা বলতে পারে না আমাদের ভাষায়, কিন্তু ওর এলোমেলো শনের নুড়ির মত চুলে ভরা মুখের মধ্যে থেকে দুটি চোখ তুলে সে প্যাটের দিকে এক দারুণ কৃতজ্ঞার চোখে চেয়ে রইল।
প্যাট বলল, আই উইল কি ইউ গার্ল। ইউ বেটার গো নাউ।
প্যাটের চোখ মুখ এক হিংস্র ঘৃণায় ভরে গেল, কেন বুঝলাম না।
লুসি মুখ নামিয়ে পাতা-ঝরানো পথ বেয়ে ফিরে গেল। প্যাট আমার পাশে পাশে হাঁটছিল।
আমি বললাম, তুমি মাঝে মাঝে বড় অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিষ্ঠুর হয়ে ওঠো। কেন? তোমাকে যত দেখছি, তত তোমাকে বুঝতে আমার অসুবিধা হচ্ছে।
তুমি এরকম কেন?
প্যাট হাসল, হেসে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, আমাকে বোঝা অত সহজ নয়। তুমি কি মনে করো, তুমি লেখক বলে একেবারে সবজান্তা হয়ে গেছ?
আমি একটু চুপ করে থাকলাম, তারপর বললাম, তুমি লুসির উপর এমন হঠাৎ চটে উঠলে কেন?
প্যাট ক্যাজুয়ালি বলল, আই কান্ট স্ট্যান্ড দা স্মেল অফ আ বিচ। বিশ্বাস করো, মেয়েদের আমি সহ্য করতে পারি না, সে মানুষই হোক, কি কুকুরই হোক।
আমি হাসলাম, বললাম, তোমার ঘর তাহলে পিন-আপ ছবিতে মুড়ে রেখেছ কেন?
প্যাট বলল, ওদের দূর থেকে ভালো লাগে, ওদের ছবি দেখতে ভালো লাগে, কিন্তু কোনো মেয়ে কাছে এলে আমার গা-বমি-বমি করে। আই হেট দেম ফ্রম দা কোর অফ মাই হার্ট।
.
১৪.
প্রথম বিকেলে সেদিন স্টেশানে গেছিলাম।
বহুদিন মাস্টারমশাই, গাঙ্গুলীবাবু, সাহাবাবুদের সঙ্গে দেখা হয় না। একটু গল্পগুজব করা গেল।
বিকেলের স্টেশান একটা বেড়াবার জায়গা।
শেষ বিকেলের প্যাসেঞ্জার এসে প্লাটফর্মে দাঁড়ায়। লোক ওঠে-নামে, ফেরিওয়ালার গলার স্বরে সরব হয়ে ওঠে কিছুক্ষণের জন্যে নির্জন প্লাটফর্ম।
ফুল-ফুল স্কার্ট পরে, ফুল-ফুল কাপড়ের টুপি পরে মিসেস কার্নি তাঁর স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুটফুটে পুতুলের মত হাত নেড়ে নেড়ে অনর্গল কথা বলেন।
আলুর চপ ও সিঙ্গাড়া ভাজার গন্ধ আসে, ভাঁড়ের চায়ের সোঁদা সোঁদা গন্ধ তার সঙ্গে মিশে যায়।
শৈলেনের সঙ্গে দেখা হল। ওর আজ ডিউটি নেই। প্যান্টের উপর একটা পাঞ্জাবি পরেছে, তারপর একটা খয়েরি র্যাপার চাপিয়েছে।
স্টেশান ঘরের সামনের বেঞ্চে বসে সিগারেট খাচ্ছিল শৈলেন। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসুন; আসুন দাদা। আপনাকে অনেকদিন দেখি না।
আমি হেসে বললাম, দেখতে চাও না, তাই দেখ না। ও বলল, দেখতে চাই বলেই হয়ত দেখতে পাই না। শৈলেন আমাকে একটু একা পেয়েই বড় বড় চোখে বলল, আমার এই সাদামাটা লাইফের এক দারুণ চ্যাপটারের মধ্যে দিয়ে পাস করছি দাদা। এখন রাজধানী এক্সপ্রেসের মত সময়টাকে সাঁ সাঁ করে নির্বিঘ্নে পাস করিয়ে দিতে পারলেই হয়। আপনার কি মনে হয়? কোনো খারাপ লোক কি লাইফ থেকে আমার সুখের ফিস-প্লেটগুলো সরিয়ে নেবে?
আমি ওর কথার ধরন দেখে হেসে ফেললাম।
ও বোকা বোকা মুখ করে আমার দিকে তাকাল।
প্রেমে পড়লে সব লোকই বোকা হয়ে যায়, এবং সবচেয়ে মজার কথা এই যে, সে-যে বোকা-বোকা ভাব করে তা সে নিজেও তখন বুঝতে পারে এবং বুঝতে পেরে যতই নিজেকে চালাক প্রতিপন্ন করতে চায়, ততই সেই চেষ্টার বোকামিটা বেশি করে চোখে পড়ে।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় টেনে নিয়ে গিয়ে হঠাৎ র্যাপারের মধ্যে দিয়ে হাত চালিয়ে পাঞ্জাবির বুক পকেট থেকে একটা মেটে-রঙা খাম বের করেই ছবিটা আমাকে দেখাল শৈলেন।
বিকেলের সোনার আলোয় নয়নতারাকে দেখলাম।
কালের মধ্যে খুব মিষ্টি বুদ্ধিমতী মুখ, রীতিমত ভালো ফিগার। নয়নতারার ছবির মুখ দেখে কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না যে সেই চিঠি ওর নিজের লেখা। কেন জানি না, কিছুতেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হলো না।
আমি শুধোলাম, এ ছবি তোমাকে কি নয়নতারাই পাঠিয়েছে?
শৈলেন বলল, আরে দাদা, না। তাহলে ত হতই।
যখন এখানে ছিল, তখনই ওর সম্বন্ধের জন্যে ওর গুরুজনেরা ডজনখানেক এমন পাসপোর্ট সাইজের ছবি করে পাঠিয়েছিল। তখন ত আর তারা জানতো না যে, এ-জম্মের মত নয়নতারার সম্বন্ধ আমার সঙ্গেই হয়ে আছে। একেই বলে নির্বন্ধ। জানেন দাদা, জীবনে এই একটি পরের দ্রব্য না বলে নিয়েছি। ছবিটা ওর কাকিমার বাড়ি থেকে হাতিয়ে এনেছি। লোকে ত বলেই, নাথিং ইজ আনফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার, কি বলেন?
আমি বললাম, তাই ত।
শৈলেন বলল, কি বলব দাদা, এই ছবিটা বুকের কাছে থাকলে আমার শীত লাগে না। আমি শীতের রাতে খালি গায়ে এই ছবি বুকে করে তামাম লাপরা-হেসালঙ-কঙ্কার পথে পথে ঘুরে বেড়াতে পারি।
পরক্ষণেই শৈলেন বলল, আপনি আমার পাগলামি দেখে হাসছেন, না? আমি খুব এমোশানাল, না?
একটু চুপ করে থেকে বললাম, শুধু তুমি কেন? সমস্ত মানুষই কম-বেশি এমোশানাল। তবে তোমার মত সরল মানুষদের এমোশন বেশি। যারা ঘা-খাওয়ালোক, বা যারা জীবনের আঁকা-বাঁকা পথে চলতে চলতে তাদের মনটাকে অন্য রকম করে ফেলেছে তাদের এমোশন কম। আমরা প্রত্যেকেই বোধ হয় অনেক পরত ভঙ্গুর ভাবাবেগ নিয়ে জন্মাই, বড় হই; হয়ত সেটাই স্বাভাবিক। তারপর এই জীবনের ছায়াময় রুক্ষ পথে চলতে চলতে, বাড়তি-পোশাকের মত, এক এক করে এমোশনের এক এক পরতকে পথে ফেলে যেতে থাকি।
আমার তোমাকে দেখে মনে হয় শৈলেন যে, তুমি নিজে এখনও কাউকে কোনো দুঃখ দাওনি, এবং অন্য কেউও তোমার সুন্দর সরল মনটাকে বিদ্ধ করেনি। এরকম মন নিয়ে যদি চিরদিন বাঁচতে পারো, তবে বুঝবে, কিছু একটা করলে।
এটা কি একটা কিছু করা হল দাদা? মানুষের মন, আমার মন, আপনার মন ত নৌকোর পালের মতই হাওয়া লাগলেই ফুলে ওঠে, দুলে ওঠে, হাওয়া না লাগলেই চুপসে যায়, কুঁকড়ে গুটোয়। এতে আমার বিশেষত্ব কি?
আছে বিশেষত্ব। আমি বললাম।
তোমার আমার চারপাশের লোকদের যদি তেমন করে লক্ষ্য কর, ত দেখবে যে, তাদের বেশির ভাগের মনই স্যাফোরাইজড। তাদের মনে কোন সংকোচন প্রসারণ নেই। তাদের মনের পাল যেমন ছিল তেমনিই থাকে, হাওয়া লাগলেও ফোলে না, দোলে না, হাওয়া না লাগলেও চুপসোয় না, কুঁকড়ে গুটোয় না। তারা তাদের মনকে জীবনের সঙ্গে কন্ডিশানড করে নিয়েছে। এয়ার কন্ডিশনড় ঘরের মত। সেখানে শীতে-গ্রীষ্মে একই তাপ।
তারা কি সুখী হয় দাদা? শৈলেন বলল। তারা কি অমন করে সুখী হতে পারে?
আমি হেসে ফেললাম, বললাম, সুখের ত কোনো বিশেষ চেহারা নেই শৈলেন। প্রত্যেকের সুখ আলাদা-আলাদা রকম। আসলে আমাকে যদি শুধোও ত আমি বলব, সুখের নিজস্ব কোনো চেহারাই নেই, সুখ যে কোনো তরল পদার্থের মত–যে মানুষের মনের যেমন আয়তন, যেমন পরিধি, যেমন ঘনতা, সুখ ঠিক সেই আকার ধারণ করে। কাজেই যারা এমোশনকে জীবন থেকে বাড়তি পোশাকের মত ফেলে দিয়েছে তারা তাদের মত সুখী, আবার তুমিও তোমার মত সুখী। মনে হয়, জীবনে সুখ বলতে কে কি মনে করে তার উপরই সব কিছু নির্ভর করে। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে আমরা সকলেই সুখী এবং সকলেই দুঃখী।
আমরা দুজনেই ট্রেনটার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিলাম।
প্লাটফর্মের সামনের শালের জঙ্গল আসন্ন সন্ধ্যার পাখিদের কলকাকলিতে ভরে গেছিল। মানুষের গলার নানারকম সুর ছাপিয়ে সেই একটানা কলরোল, দূরের নদীর স্রোতের মত আমাদের কানে এসে লাগছিল। আমরা দুজনেই চুপ করে ছিলাম। আমি এবং শৈলেন। চুপ করে নিজেদের, প্রত্যেকের বুকের ভিতরে যে-পাখিরা এই শীতের সন্ধ্যেবেলায় ডাকে, তাদের ক্ষীণ শীতার্ত স্বর শুনছিলাম।
শেষ-বিকেলের প্যাসেঞ্জার প্লাটফর্ম ছেড়ে ধীরে ধীরে একসময় চলে গেল।
শৈলেন কখন যে চলে গেছিল, যাবার সময় নিশ্চয়ই বলে গেছিল, হয়ত নমস্কার জানিয়েও গেছিল; আমার মনে নেই।
পিছনের পথ দিয়ে যখন বাড়িতে এসে উঠলাম ছোট গেট খুলে, তখন সবে অন্ধকার হয়েছে। মুরগির-ঘর কাঠ-রাখার ঘরের পাশ দিয়ে আসার সময় হঠাৎ রমার গলা শুনলাম বাড়ির ভিতর থেকে।
প্রথমে বিশ্বাস হল না।
তারপর বাড়ির পাশে আসতেই দেখি বাড়ির সামনে একটা ঘন বেগুনি রঙা মার্সিডিস গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, গাড়িটায় সাদা কাপড়ের সিট কভার লাগানো।
বসবার ঘরের আলো জ্বলছিল। ওরা গোল হয়ে বসেছিল। রমা, সীতেশ, সীতেশের স্ত্রী ডলি এবং আর একজন মহিলা।
আমি ঘরে ঢুকতেই সীতেশ আমাকে আপ্যায়ন জানিয়ে বলল, এই যে! অতিথিরা কখন এসে বসে আছে আর গৃহস্বামীর পাত্তা নেই। আমরা তোমার বিনা অনুমতিতেই কফি-টফি খাচ্ছি। আশা করি তাড়িয়ে দেবে না। আমরা কালই লাঞ্চের পর চলে যাব।
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রমা বলল, তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, এই যে আমার বান্ধবী মাধুরী সেন। মিস্টান সেন, মানে ওঁর স্বামী গ্যাডার অ্যান্ড রবসন কোম্পানিতে আছেন–হি ইজ ভেরী হাই-আপ দেয়ার।
সীতেশের স্ত্রী ডলিই প্রথমে আমার স্বাস্থ্য সম্বন্ধে শুধোলো, বলল, তারপর? শরীর এখন কেমন? শুনলাম এখন একেবারে সুস্থ-নর্মাল লাইফ লিড করছেন–তাই, নর্মাল লাইফ যাতে পুরোপুরি নর্মাল হয় সেই জন্যেই রমাকে নিয়ে এলাম সঙ্গে করে। কি? খুশি ত? বলে রমার দিকে চকিতে তাকাল।
এরকম পরিবেশে আমি চিরদিনই বোকা হয়ে যাই, মুখে কথা জোগায় না। আমি তাই জবাব দিলাম না কোনো।
বললাম, আপনারা বসুন, আমি বাবুর্চিকে খবর পাঠাই, দোকানেও পাঠাতে হবে একবার মালুকে। পাঁচ মিনিট। আমি এক্ষুনি আসছি।
সীতেশ বলল, বাবাঃ দায়ে পড়ে বেশ সংসারী হয়েছিস ত।
ওদের উচ্চগ্রামের কথা বাজছিল কানে। ভাঁড়ারঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম।
মিসেস সেন, যাঁর নাম মাধুরী, তিনি বললেন, তোমার স্বামীর সম্বন্ধে যে ধারণা করেছিলাম তা কিন্তু ভেঙে গেল ভাই।
সীতেশ চিরদিনই সপ্রতিভ, সীতেশ কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ভেঙে গেল মানে কি? কল্পনার তুলনায় ভালো লাগল, না খারাপ লাগল?
মাধুরী বলেন, তা বলব কেন? মানুষটিকে যেমন ভেবেছিলাম তেমন উনি নন।
আমি ফিরে এসে ওদের সঙ্গে বসলাম।
রমা খুব সেজেগুজে আছে। দেখে ভালোই লাগছে। মেয়েরা সেজে না-থাকলেই আমার খারাপ লাগে, তবে আমার ভালো-লাগা মন্দলাগা নিয়ে মাথা ঘামানো রমা বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে। তবু যেন ও আমার স্ত্রী নয়, ও যেন কোনো স্বল্প-পরিচিত দূরের কোনো মহিলা তেমন ভাবেই ও আমার সামনে বসেছিল।
রমা নিরুত্তাপ গলায় কিছু বলতে হয় তাই বলল, তুমি বেশ মোটা হয়ে গেছ। আরও মোটা হলে আনকুথ দেখাবে।
আমি জবাব দিলাম না।
সীতেশ আমার দিকে তাকিয়েছিল।
আলোর মধ্যে বসে সীতেশের দিকে চেয়ে আমার মনে হল স্যাংচুয়ারীর মধ্যে, যেখানে কোনোরকম শিকার করাই বারণ, সেখানে আমার সঙ্গে হঠাৎ কোনো দাঁতাল শুয়োরের দেখা হয়ে গেছে। আমাকে বিনা প্রতিবাদে নিরস্ত্র অবস্থায় শুয়োরের লম্ফ-ঝম্ফ আস্ফালন সব সহ্য করতে হচ্ছে; অথচ কিছুই করার নেই।
সীতেশ বলল, তারপর? তুই এখানে কি মধু পেয়েছিস রে? প্রফেশান কি ছেড়ে দিবি? ভাল হয়ে গিয়েও তোর কোলকাতা যাবার নামটি নেই?
রমা হঠাৎ বলল, ও-ও তোমাকে বলা হয়নি, মিস্টার ঘোষ হাইকোর্টে এলিভেটেড হয়েছেন হাইকোর্টের জজ হয়ে গেছেন গত সপ্তাহে।
এমনভাবে রমা কথাটা বলল, যেন হাইকোর্টে কি হচ্ছে না হচ্ছে সব খবর ওর নখদর্পণে, যেন ও-ই গত কয়েক বছর ধরে হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার।
তারপর বলল, এখন তুমি ফিরলে তোমার প্র্যাকটিস আরো ভাল হবে। কারণ হাবুল সেন ছাড়া তোমার লেভেলে আর কোনো কমপিটিটর রইল না তোমার। তুমি ফী বাড়াবে না?
আমি জবাব দিলাম না। এসব কথার জবাব হয় না।
সীতেশের স্ত্রী বলল, রমা বলেছে, আপনি ফিরে গেলেই ক্যালকাটা ক্লাবে একটা দারুণ পার্টি দেবে। ফীসটা না হয় সেই দিন থেকেই বাড়াবেন। কত মোহর করবেন?
আমার ঠাস করে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছা করল মহিলার ফোলা ফোলা ফর্সা গালে।
কিন্তু তবুও চুপ করেই রইলাম।
সীতেশ কথা ঘুরিয়ে বলল, বাইরেটা এখন কি যে প্লেজেন্ট তা কি বলব। মনে আছে ডলি, গতবার যখন কন্টিনেন্ট থেকে ফিরছিলাম আমি আর তুমি, তখন আজকের দিনে, গত বছরের ঠিক এই দিনে, এই সময় প্যান-অ্যামের ফ্লাইট ধরছি। ওঃ হোয়াট আ ওয়ান্ডারফুল টাইম উই হ্যাড-–না, ডার্লিং?
পরক্ষণেই সীতেশ তার ডার্লিং-এর অপেক্ষা না করেই আমাকে বলল, এখানে সোডা পাওয়া যাবে? বোতলটা বের করি?
আমি বললাম, না। সোডা পাওয়া যায় না।
কি হরিবল্ জায়গা। তুই কি করে এখানে আছিস বল্ ত একা একা? তোর ঐ কি চামা না ঝামা, তার মোড় থেকে এই বাড়ি অবধি এটা কি একটা রাস্তা? মাই ফুট।
আমি বললাম, হুইস্কি জল দিয়েই খেতে হবে। জল ত রয়েইছে টেবিলে। তেষ্টা কি জোর পেয়েছে?
সীতেশ বাহাদুরীর হাসি হেসে বলল, তা সানডাউন যখন হয়ে গেছে, একটা সানডাউনারের সময় ত হয়েই গেছে।
বলেই, ও উঠে গিয়ে হুইস্কির বোতল এনে জলের সঙ্গে মিশিয়ে পরপর দুটো বড় হুইস্কি খেল। কুইক ওয়ানস্। তারপর বলল, একটু বেড়িয়ে আসি। আই উইল গো ফর আ স্ট্রল। কে যাবে আমার সঙ্গে?
রমা বলল, পাঁচ বছরের আদুরে মেয়ের মত, আমি যাব।
রমার দিকে তাকিয়ে মিসেস সেন বললেন, আমার খুব টায়ার্ড লাগছে, আমি যাব না।
ডলি বলল, আমিও যাব না।
সীতেশের মুখ দেখে মনে হল, ও এই-ই চাইছিল।
সীতেশ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তবে আর দেরি কেন? চল রমা, একটু হেঁটেই আসি। সারাদিন গাড়ি চালিয়ে পা ধরে গেছে। দা ড্রাইভ ওয়াজ ভেরী টায়ারিং। বলেই সীতেশ উঠে পড়ল, টেবিলের উপর-রাখা টর্চটা তুলে নিয়ে দরজা খুলল।
রমা হ্যাঙ্গার থেকে ওর ওভারকোটটা তুলে নিয়ে হ্যান্ডব্যাগটা উঠিয়ে নিয়ে বলল, চল।
ওরা দুজনে বেরিয়ে গেল।
আমার জন্যে রেখে গেল একটি গোলগাল ব্যক্তিত্বহীন সুগন্ধি জড়পদার্থ এবং আর একজন আকাট বড়লোকের আড়ষ্টকাঠ স্ত্রী।
ডলি আলোর নীচে বসে মুখ নীচু করে নেইলপালিশের রঙ তুলছিল লোশান দিয়ে। ডলির চেহারাতে কোনো খুঁত ছিল না। ধবধবে গায়ের রঙ, নাক, চোখ, মুখ এবং যেখানে যা যতটুকু থাকার তা। এবং সেই খুঁতহীনতাই ওর চেহারার একমাত্র খুঁত ছিল বলে আমার মনে হত। স্বামী-সোহাগিনী, দোকানে চুল-বাঁধা, ভোজ রাজে শাড়ি-কেনা এবং সাতরামদাসে গয়না কেনাই যাদের হোল্টাইম অকুপেশান, তেমন অনেক ইনসিপিড মেয়ে-বউ আমার দেখা ছিল। এদের উপর আমার কোনো রাগ ছিল না। কিন্তু, করুণা ছিল চিরদিনের। এদের আশ্চর্য সুযোগ ও অফুরন্ত সময়-ভরা জীবনকে এরা কি অবহেলায় নষ্ট করতে পারে তা দেখে এদের উপর একটা ঘৃণামিশ্রিত করুণা জাগত।
কোনো কথাই বলার নেই, বলা চলে না; এরকম মেয়েদের সঙ্গে।
হঠাৎ মিসেস সেন বললেন, আপনার লেখার আমি একজন দারুণ ভক্ত।
আমি মুখ তুলে বললাম, আপনি আমার কি কি বই পড়েছেন?
বই? বলে মিসেস সেন থেমে গেলেন। তারপর থেমে থেমে ভেবে তিন-চারটে বইয়ের নাম বললেন।
আমি একটি বইয়ের নাম করে বললাম, এই বইয়ের কোন্ চরিত্র আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?
ভদ্রমহিলা চুপ করে থেকে বললেন, সত্যি কথা বলছি আপনার সম্বন্ধে, মানে সুকুমার বোস লেখক সম্বন্ধে আমার ইন্টারেস্ট হয়েছে হালে এবং আপনার নাম শুনেই এবং আপনি যে আমাদের রমার হাজবেন্ড তা জেনেই আপনার সব বই কিনে ফেলেছি। কিন্তু জানেন, এত ঝামেলা যাচ্ছে, যে একটাও এখনও পড়া হয়নি। ফিরে গিয়েই সব পড়ে ফেলব।
আমি নির্লজ্জের মত বললাম, মিস্টার সেন পড়েছেন?
ও? বলে মিসেস সেন চোখ নাচালেন, বলতে চাইলেন, আমার কি আস্পর্ধা। সাহেবী মার্কেনটাইল ফার্মের এত বড় একজন অফিসারের কি বাংলা বই পড়ার সময় আছে?–তাও সুকুমার বোসের মত এত স্বল্পপরিচিত ও নতুন লেখকের লেখা?
মিসেস সেন মুখে বললেন, ও পড়ে। পড়ে না, বললে মিথ্যে কথা বলতে হয়। তবে বাংলা বই নয়।
ইংরাজি বই পড়েন বুঝি? বাঃ খুব ভাল ত!
হ্যাঁ। –হ্যারল্ড রবিনস ওঁর খুব ফেভারিট–উনি কি বলেন জানেন? কিছু মনে করবেন না ত, শুনে?
বললাম, না। বলুনই না।
উনি বলেন, বাংলা সাহিত্যে আজকাল কিছুই লেখা হচ্ছে না–যা হচ্ছে সব ট্রাশ,–ম্যাদামারা। ঐসব পড়ে সময় নষ্ট করার সময় নেই ওঁর। বোঝেনই ত। অত বড় কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজারের কত রকম ঝামেলা। বেচারী। সব সময়ই ত কনফারেন্স করছে। ফোন করেও একটু কথা বলতে পারি না। তবে হ্যাঁ, বাংলা বই বলতে কি পড়েন উনি জানেন?
কি?
পঞ্জিকা। গুপ্তপ্রেসের পঞ্জিকা। খুব রেলিশ করে পড়েন বিজ্ঞাপনগুলো।
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম।
এই জেনারেশনের ম্যাদামারা বাংলা-সাহিত্যের একজন ম্যাদামারা লেখক হবার যে কী যন্ত্রণা, তার যে ন্যক্কারজনক অস্বস্তি তা এই স্বল্পখ্যাত সাহিত্যিক সুকুমার বোস হাড়ে হাড়ে জানতে পেল।
আমার স্ত্রীর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সঙ্গিনী যদি মিসেস সেন হন এবং সীতেশ হয় তাহলে আমার কিছু বলার নেই।
কিন্তু রমা কখনও এমন ছিলো না আগে। অলস অবকাশ, ও প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা লোকের হাতে, বিশেষ করে মেয়েদের হাতে পড়লে তাদের মাথার ঠিক থাকে না।
ডলি বলল, এখানে গীজার আছে বাথরুমে?
আমি বললাম, গীজার নেই, ক্যানেস্তারা করে জল গরম করে দেবে। কেন? চান করবেন?
হ্যাঁ। একটু চান করে ফ্রেশ হওয়া যেত।
লালি বাইরে কাঠের আগুন করে ক্যানেস্তারায় জল বসিয়েই রেখেছিল। ওকে দুই বাথরুমেই জল দিতে বললাম।
ওঁরা উঠে ফ্রেশ হতে গেলেন।
মহিলারা চলে গেলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হতে দেরি হয়েছিল।
রমা আর সীতেশ বেরিয়ে ফিরেছিল প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে।
এখানে রাতে বাঘ না বেরোলেও হায়না, শিয়াল, নেকড়ে, শুয়োর ইত্যাদি মাঝে মাঝে বেরোয় বিশেষ করে কঙ্কার এদিকে, যেদিকে এখনও জঙ্গল আছে।
ওদের জন্যে বেশ চিন্তা হচ্ছিল। দুজনেই নতুন এ জায়গাতে। তারপর ঘুটঘুটে অন্ধকার। শেষে পথ হারিয়ে না ফেলে।
কিন্তু সীতেশ পথ হারায়নি। রমাও নয়।
ওরা যখন ফিরল, দেখলাম রমার চুল এলোমেলো, কপালের টিপ সরে গেছে। ওরা এসেই সমস্বরে বলল, বাবাঃ, যা বিপদে পড়েছিলাম, পথ ভুলে সেই কোথায় গিয়ে পড়েছিলাম।
আমি বললাম, স্বাভাবিক। এখানে পথ ভোলা খুবই স্বাভাবিক।
রমা আমার চোখের দিকে একবার চাইল, বোঝবার চেষ্টা করল আমি ওকে সন্দেহ করছি কি না। কিন্তু আমার চোখে হিংসা অথবা সন্দেহ কিছুই ছিল না। আমার চোখ এবং মন এখন রমার সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাস। রমা সম্বন্ধে আমার একমাত্র বক্তব্য এই যে, ও যেন আর একটু আত্মসম্মানজ্ঞানের পরিচয় দেয়। নিজেকে এত সহজে এমন সস্তায় ছোট না করে। এছাড়া ওর কাছে আমার আজ আর চাইবার কিছুই নেই।
ডলির মুখ দেখে মনে হল না, ও কিছু বোঝে বলে। বুঝলেও বোধহয় ডলির কিছু মনে করা সম্ভব ছিল না। কারণ পৃথিবীতে স্বামী ছাড়া নিজের বলতে যাদের আর কিছুই কেউই থাকে না, ডলি সেই ধরনের মেয়ে। স্বামী যা-ই করুক তার বিরুদ্ধাচরণ করার সাহস বা শিক্ষা তার ছিল না।
খাওয়া-দাওয়ার পর ডলি বলল, আমরা মেয়েরা সবাই একঘরে শোব।
মিসেস সেন বললেন, আমার কিন্তু ভয় করবে মেয়েরা একা একা শুলে। কি রকম জায়গা বাবা, মনে হচ্ছে কোন্ অন্ধকূপে এসে পৌঁছেচি।
আমি বললাম, তাহলে সীতেশও ঐ ঘরে থাকুক, মেয়েদের পাহারা দিক।
সীতেশ বলল, আই অ্যাম এ গেম–খুব রাজি।
হঠাৎ ডলি বলল, তোমরা অত্যন্ত ইনকনসিডারেট। রমা কতদিন পরে এল, কতদিন পরে সুকুমারের সঙ্গে দেখা হল আর ওরা বুঝি আলাদা আলাদা শোবে!
ব্যাপারটায় আমার খুব অস্বস্তি লাগছিল।
সীতেশ দারুণ উৎসাহ দেখিয়ে বলল, আরে তাই-ই ত! সকলেই ভুলে মেরে দিয়েছি। আজ যে এমন হ্যাপী-রি-ইউনিয়নের দিন তা আমার একেবারে খেয়াল ছিল না।
শেষকালে রমা আমার ঘরেই এল। মানে আমার পাশের ঘরে।
ওদিকের ঘরে ডলি আর মিসেস সেন শুল। মধ্যের দরজা খুলে রেখে শুল সীতেশ।
সমস্ত বাড়ির বাতি নিবিয়ে দেওয়া হয়েছিল। টেবল-ল্যাম্পটা জ্বলছিল। যাতে আমার অতিথিরা ভয় না পান।
আমি আমার ঘরে শোওয়ার বন্দোবস্ত করছিলাম আমার, এমন সময় রমা চাপা গলায় বলল, ঢং করো না। ওরা জানলে কি ভাববে? এ ঘরে এসে আমার পাশের খাটে শোও।
আমার কথাটা শুনে হাসি পেল, কিন্তু হাসলাম না।
আসলে, আজ সন্ধ্যেবেলা থেকেই আমার মনে হচ্ছিল আমরা সকলে, মানে রমা, সীতেশ এবং আমি–আমরা একটা দারুণ নাটক মঞ্চস্থ করব বলে ঠিক করে রিহার্সাল একেবারে না দিয়ে, আজই সন্ধ্যায় নাটকটিকে মঞ্চস্থ করেছি।
ফলে, অভিনয় কারোই ভাল হচ্ছে না। প্রমপটারও নেই কেউ যে, পিছন থেকে প্রমপট করবে। তাই আমরা সবাই ছেঁড়া ছেঁড়া সংলাপ বলছি। সবচে মজার কথা এই যে, আমরা তিনজনই অভিনেতা অভিনেত্রী এবং এই তিনজনই দর্শক। কার অভিনয় কেমন হচ্ছে সেটুকুও বুঝতে পাচ্ছি না আমরা। সকলেই একটা অসহায় অবস্থায় অবস্থান করছি। কখন কার মুখে আলো পড়ছে অজানা জায়গা থেকে তা বুঝতে পারছি না, কখন বেরিয়ে যাওয়া উচিত উইংস থেকে, কখন ঢোকা উচিত উইংস-এ কিছুই আগে থাকতে ঠিক করা নেই।
মনে হচ্ছে, এমন আধুনিক নাটক কোলকাতার মুক্তাঙ্গনেও কোনো নাট্যগোষ্ঠী এর আগে মঞ্চস্থ করেননি।
বাইরে ফিস ফিস করে শিশির পড়ছে। ঝিঁঝি ডাকছে একটানা।
ও-ঘরে ডলি আর মাধুরী পুটুর পুটুর করে কি সব মেয়েলী গল্প করছে।
সীতেশের গলা শোনা যাচ্ছে না। ও বোধহয় এখন গ্রীনরুমে মেক-আপ ধুতে গেছে।
হঠাৎ পিছনের নালা থেকে শিয়াল ডেকে উঠলো–একসঙ্গে অনেকগুলো–হুয়া হুয়া–হুক্কা হুয়া–কৈসে হুয়া?
ও-ঘর থেকে মাধুরী চেঁচিয়ে বলল, রমা ঘুমিয়ে পড়েছিস?
রমা আয়নার সামনে বসে ক্রিম লাগাচ্ছিল মুখে। বলল, কেন? ভয় করছে?
মাধুরী বলল, না। কি রোম্যান্টিক জায়গা রে! সুইড ড্রিমস্।
রমা চাপা গলায় আমাকে বলল, সত্যি। অবাক লাগে। তুমি কি আর চেঞ্জে আসার জায়গা পেলে না? কোনো ভদ্রলোক এরকম জায়গায় থাকে?
আমি খাটের ফ্রেমে বসেছিলাম। বললাম, আমি ত ভদ্রলোক নই।
সত্যি। রেসপেকটেবল লোকদের নিয়ে এরকম শ্যাবী জায়গায় আসতে লজ্জা করে।
তুমি এলে কেন? আমি ত আসতে বলিনি।
তুমি বলোনি জানি, কিন্তু লোকে কি বলে?
কি বলে?
বলে, আমি রমার দিকে চেয়ে রইলাম। ভাবলাম, ছুটির কথা উঠবে এখুনি। এবং উঠলে প্রসঙ্গটা অত্যন্ত অপ্রিয় হবে। কিন্তু রমা ওদিকে গেল না। মনে হল, রমা ইদানীং আমাকে কিছু স্বাধীনতা মঞ্জুর করে নিজে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। রমা হয়ত জানে না, যে-সুকুমার বোসকে ও আগে জানত, সে সুকুমার বোস মরে গেছে। ও নিজে হাতে তাকে একদিন মেরে ফেলেছে।
সে আর কখনও বেঁচে উঠবে না।
রমা বলল, লোকে কি বলে? স্বামী এই জঙ্গলে একা পড়ে আছে আর স্ত্রী আরামে দিন কাটাচ্ছে শহরে। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর কি কোনো কর্তব্য নেই?
লোকে এসব বলে নাকি? আমি বললাম। লোকের কথা শোনো কেন? তুমি ত লোকের কথা নিয়ে কখনও মাথা ঘামাওনি। ঘামানো উচিতও নয়। আমি ত ঘামাই না।
রমা ক্রিম মাখা থামিয়ে আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
বলল, এখন শরীর একেবারে ভালো? পুরোপুরি সুস্থ?
হ্যাঁ। বললাম আমি।
তুমি কি কাজকর্ম একেবারে ছেড়ে দেবে?
মাঝে মাঝে সেরকম ইচ্ছা হয়; কিন্তু উপায় নেই।
উপায় নেই কেন? আমার জন্যে? আমি তোমার কিসের তোয়াক্কা করি? তুমি কি মনে কর আমি তোমার মুখাপেক্ষী? ইচ্ছা করলে তোমার দুগুণ রোজগার করতে পারি আমি–আমার সে কোয়ালিফিকেশান আছে। করি না; তাই। সেটা অন্য কথা।
আমি জবাব দিলাম না।
রমা বলল, কি? জবাব দিচ্ছ না যে?
আমি বললাম, তোমার জন্যে বা অন্য কারো জন্যে নয়, আমি আমার কাজকে ভালোবাসি সে জন্যে। ফিরে একসময় যাবই। তবে ছেদ যখন পড়েছে তখন আরো এক-দেড় মাস কাটিয়ে তারপরই যাব। গিয়ে শুধু কাজ করব। মাথা তুলে আর কোনোদিকে চাইবও না।
রমা বলল, তাই-ই ত উচিত। তুমি নিশ্চয়ই আমাকে লেট-ডাউন করবে না।
কিসের লেট-ডাউনের কথা বলছ তুমি?
মানে একজন সাকসেসফুল ব্যারিস্টারের স্ত্রী হিসেবে আমাকে সকলে জানে–তোমার পরিচয়েই আমার পরিচয়–যদিও আমার নিজেরও একটা পরিচয় আছে–তবুও–আশা করি তুমি হাইকোর্টে যাওয়া ছেড়ে দিয়ে আমার মাথা হেঁট করাবে না সকলের কাছে।
আমি কাজ ছাড়লে তোমার মাথা হেঁট হবে কেন?
কারণ সমাজে মিসেস বোস বলে আমার একটা পরিচয় আছে। এই ত সেদিন মিঃ গুহর পার্টিতে মিসেস গুহ আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন–হিয়ার ইজ মিসেস সুকুমার বোস। তোমাদের হাইকোর্ট পাড়ার যত ঘাঘু লোক সব ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে রইল।
সে তুমি সুন্দরী বলে।
না। সেটাই সব নয়। আমি তোমার স্ত্রী বলেও।
তাই বুঝি? হবেও হয়ত বা, আমি বললাম।
তারপর বললাম, দ্যাখো রমা, আমি তোমাকে ঠিক বুঝতে পারি না। আমার প্রতি তোমার কোনো ফিলিংস নেই তা যেমন তুমিও জানো, আমিও জানি, তবু তুমি আমার স্ত্রী বলে সর্বসমক্ষে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হও কেন? আমরা কি দুজনে এই সম্পর্কের প্রতি কখনোই সিনসিয়র হতে পারি না? আর তা না যদি পারি…।
রমা কথার মধ্যে বাধা দিয়ে বলল, তুমি কি কোনো নতুন পাঠশালায় ভর্তি হয়েছ নাকি। আজকাল অনেক কথা বলতে শিখেছ দেখছি?
তারপর বলল, জিজ্ঞেস করছ, তাই-ই বলছি, তোমার স্ত্রী বলে পরিচিত হয়ে যে আনন্দিত হই, সেটা সামাজিক কারণে। তোমার সঙ্গে আমার ঘরের মধ্যে যে রিলেশানই থাকুক না কেন–সমাজের লোক তা জানবে কেন? তাদের তা জানতে দেবই বা কেন? এ সব কথা তুমি বুঝবে না।
পরক্ষণেই রমা বলল, আমার কিছু টাকা লাগবে।
টাকা ত আমার এখানে নেই। জানো ত পোস্টাফিস থেকে প্রতি মাসে টাকা তুলি এখান থেকে।
তা আমি জানি। চেক দাও।
ড্রয়ার খুলে আমি একটা চেক সই করে দিলাম। বললাম, ফিগার বসিয়ে নিও।
তারপর বললাম, টাকা দিয়ে কি করবে? তোমার সংসারের টাকা মনোজ প্রতি মাসে পৌঁছে দেয় না?
তা দেয়। এটা সংসারের জন্যে নয়। এটা আমার পাসোনাল ব্যাপার। একজনকে আমি একটা জিনিস দেব।
ঠিক আছে। আমি বললাম। কি জন্যে দরকার আমাকে বলার দরকার নেই।
থ্যাঙ্ক ঊ্য! বলে খুব খুশি খুশি মুখে রমা তাকাল আমার দিকে। তারপরই এসে, আমি যে খাটের ফ্রেমে বসেছিলাম তার পাশের খাটে শুয়ে পড়ল। বলল, লাইট-টাইট তুমি নিবিয়ে দিও।
আমি কিছু বলার আগেই রমা ফিস ফিস করে বলল, তোমার কাছে ত ওসব কিছু নেই। আমি আসার সময় নিয়ে এসেছি। আমার হ্যান্ডব্যাগে আছে। তারপরই হঠাৎ বিনা ভূমিকায় বলল, তাড়াতাড়ি করো, আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।
আমি যেমন বসেছিলাম, বসেই রইলাম। কোনো কথা বললাম না।
রমা ভুরু কুঁচকে বলল, কি? ইচ্ছা কি? আমার এসব ভালো লাগে না। আমার বলা কর্তব্য, তাই-ই বললাম; আমি কিন্তু এক্ষুনি ঘুমোব।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, না। থ্যাঙ্ক উ্য।
বলতে ইচ্ছে হল, ইটস্ ভেরী কাইন্ড অফ উ্য।
কিন্তু বললাম না।
ও-ঘর থেকে আসবার আগে, আলো নিবিয়ে রমার গায়ে কম্বলটা ভালো করে টেনে, গলার কাছে গুঁজে দিয়ে আমার ঘরে এলাম।
শোবার আগে বললাম, কাল সকালে কি খাবে বল? ব্রেকফাস্টে? হাসান খুব ভালো লিভারকারী বানায় ব্রেকফাস্টের জন্যে। আমার যা ভালো লাগে তা ত তোমার ভালো লাগে না, তাই তোমার পছন্দমত মেনু বলে দিও–যা তোমার ভালো লাগে। এখানে সবই পাওয়া যায়।
ঠিক আছে। কালকে ওসব কথা হবে। আমার ঠাণ্ডা লেগে গেছে। বাইরে বেশ ঠাণ্ডা ছিল। তারপর বলল, ঘুমোলাম, বুঝলে?
আমি বললাম, রুণ কেমন আছে? ওকে নিয়ে এলে না কেন?
আহা। কি যে বলো, ওর স্কুল নেই? তাছাড়া ছোটরা এরকম বড়দের সঙ্গে ট্যাং ট্যাং করে সব জায়গায় যায় নাকি? ছোটরা সঙ্গে থাকলে অ্যাডালটরাও এনজয় করতে পারে না, ছোটদেরও খারাপ লাগে।
তা বলে, বাচ্চারা মা কি বাবার সঙ্গে কোথাও যাবে না?
যাবে না কেন? এরকম ট্রিপে নিয়ে আসা যায় না।
আমি বললাম, রুণকে অনেকদিন দেখি না।
আমিও দেখি না।
কেন? তুমিও দেখো না কেন? শুধোলাম আমি।
সময় কোথায়? একটা না একটা ঝামেলা লেগেই আছে। আজ পার্টি, কাল সেমিনার, তার পর দিন ফ্লাওয়ার শো ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি একটা ইকেবানার স্কুল খুলব ভাবছি কিংবা মেয়েদের চুল বাঁধার দোকান। আমার টাকা দরকার।
বিলেত থেকে ডাক্তারি পড়ে এসে চুল-বাঁধার দোকান? আস্তে বললাম আমি।
তাতে কি? অনেক টাকা আছে এই ব্যবসায়। সেদিন আমার এক সিন্ধী বান্ধবী বলছিল কি জানো? বলছিল, লুক, মানি ইজ মাই ফাস্ট হাজব্যান্ড। টাকাই হচ্ছে সব। স্বামী বল পুত্র বল টাকার কাছে কেউ কিছু না।
আমি চুপ করে রইলাম।
রমা বলল, কথা বলছ না কেন? কথাটা কি মনঃপূত হলো না?
আমি বললাম, ঘুম পেয়েছে। তুমিও ঘুমোও।
রমা বলল, বুঝেছি। ঘুমোলাম। কাল ভোরে নটার আগে আমাকে তুলো না কিন্তু।
বললাম, আচ্ছা।