সপ্তম পর্ব
ঠিক পনেরো বছর আগে মহারাজ যুধিষ্ঠির তখন হস্তিনাপুরের যুবরাজ পদে অভিসিক্ত। শ্রাবণী কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে মহা শিবরাত্রির উৎসব উপলক্ষে সম্রাট ধৃতরাষ্ট্রের ইচ্ছানুসারে তিনি মাতা রানী কুন্তী সহ তার চার ভাইদের নিয়ে বারণাবতে এসেছিলেন। পুরোচন তখন বারাণাবতের প্রশাসক দূর্যোধনের কথায় যুবরাজ যুধিষ্ঠিরদের বসবাসের জন্য এই স্থানেই লাক্ষা শণ মোম দ্বারা তিনি নির্মাণ করেছিলেন এই জতুগৃহ।
মহামন্ত্রী বিদুরের কাছ থেকে যুধিষ্ঠির জানতে পেরেছিলেন চতুর্দশী তিথির মধ্যরাতে পুরোচন এই গৃহে অগ্নিসংযোগ করবে। তাই পূর্ব থেকেই গৃহ অভ্যন্তর থেকে নদীর তীর পর্যন্ত এক সুড়ঙ্গপথ নির্মাণ করে রেখেছিলেন। চতূর্দশীর রাত্রে তিনি গৃহে পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন আর সেই পূজা উপলক্ষে পাঁচজন নিষাধ ও তাদের মাতাকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন তাদের গৃহে। অতিরিক্ত পান ভোজনের পর পঞ্চ নিষাধ ও তাদের মা সেই স্থানেই রাত্রিবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। গভীর রাতে পাণ্ডবরা নিজেরাই ঘরে অগ্নিসংযোগ করে সুড়ঙ্গ পথে সেই গৃহ থেকে বেড়িয়ে আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু অপ্রস্তুত পঞ্চ নিষাধ ও তাদের মা নিহত হয় অগ্নদগ্ধ অবস্থায়।
সেই দগ্ধ অবশিষ্ট দেখে সবাই এই সিদ্ধান্ত নেন জতুগৃহের অগ্নিতে পঞ্চ পাণ্ডব ও রানী কুন্তী নিহত হয়েছেন।
এই পর্যন্ত বলে প্রথম স্ত্রীলোকটি থামতেই দ্বিতীয় স্ত্রীলোকটি বললো আমরাই সেই পঞ্চ নিষাধের বিধবা। পনেরো বছর আমরা এই তিথিতে এখানে এসে তাদের উদ্দেশ্যে জলদান করি। আজও এখানে এসেছি তাদের উদ্দেশ্যে জলদান করার জন্য।
তৃতীয় স্ত্রীলোকটি বলতে শুরু করলো, আপনি বলছিলেন না মহারাজ যুধিষ্ঠির একজন ন্যায়নিষ্ঠ ধার্মিক সত্যবাদী প্রজাবৎসল সম্রাট? যদি তাই হয় তবে আপনারা বিচার করুন সেই সময় তিনি রাজ প্রতিনিধি হিসেবে বারাণাবতে এসেছিলেন। প্রতিটি প্রজার সুখ দূঃখ ভালো মন্দ দেখার দায়িত্ব তাঁর প্রতিই ন্যস্ত ছিলো। কিন্তু তিনি যখন জানতে পারেন এই গৃহটির নির্মাণ তাদের হত্যা করার জন্য দূর্যোধনের পরিকল্পনা তখন আত্মরক্ষার জন্য তিনি এক সুড়ঙ্গ নির্মাণ করেন আর পরিকল্পনা মাফিক গৃহে পূজা অর্চনা উপলক্ষে আমাদের স্বামী ও শশ্রুমাতাকে নিমন্ত্রণ করে এনে তাদের এমন পর্যাপ্ত পান ভোজন করান যে তারা সেই স্থান ত্যাগ করার মতো অবস্থায় ছিলো না। আর নিজেদের আত্মরক্ষা ও আত্মগোপন করার এই সুযোগটাই যুধিষ্ঠির গ্রহণ করলেন। গভীর রাতে নিজেরাই গৃহে অগ্নিসংযোগ করে সুড়ঙ্গ পথে পলায়ন করলেন।
কিন্তু আমাদের ঘুমন্ত স্বামীদের এবং শশ্রুমাতার আত্মরক্ষার কোন সুযোগই ছিল না। যুধিষ্ঠিরের ছলনায় ঘুমন্ত অবস্থায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে তারা মৃত্যুবরণ করে। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের এর চেয়ে আর কি বড় পাপ হতে পারে?
চতুর্থ স্ত্রীলোকটি বললো, থাক এসব কথা যা গত হয়ে গেছে তা আর বলে কি লাভ? আমাদের বৈধব্যদশা কি পরিবর্তন হবে? আর এ বিষয়ে এঁদেরই বা কি করণীয় আছে?
পঞ্চম স্ত্রীলোকটি বললো, শুনুন মহাশয় আপনারা মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে যতই মহান বলুন না কেন আমাদের কাছে তিনি একজন স্বার্থপর অধার্মিক সুপরিকল্পিত হত্যাকারী মাত্র। যিনি নিজের জীবন রক্ষা করার জন্য নিরীহ প্রজাদের হত্যা করেও কোন অনুশোচনায় বিদ্ধ হন নি। পরবর্তীতে আমরা জেনেছি পাঞ্চাল দূহিতা দ্রৌপদীর কথা দ্যুতক্রিড়ার কথা কুরুক্ষেত্রের কথা এর সব কিছুর জন্য একমাত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির দায়ী। মহারাজ যুধিষ্ঠির একজন লোভী স্বার্থপর অসংযমী অধার্মিক মানুষ। আমাদের কাছে তিনি ক্ষমার অযোগ্য। আপনি বলছিলেন না বিস্তৃত জানলে আমরা যাতে ন্যায় পাই তার ব্যবস্থা করবেন, এখন বলুন কি ন্যায় আমরা পেতে পারি?
যুধিষ্ঠির ও শ্রীকৃষ্ণ এতক্ষণ নিঃশব্দে ওদের কথা শুনছিলেন। হঠাৎই যুধিষ্ঠির নতজানু হয়ে দুই হাত জোড় করে বললেন, মাত আমিই সেই হতভাগ্য যুধিষ্ঠির, আপনাদের বক্তব্য সর্বাংশে সত্য। যুবরাজ হিসেবে সেদিন আমি আমার রাজধর্ম পালন করিনি। নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য যে তৎপরতা আমি দেখিয়ে ছিলাম তার বিন্দুমাত্র প্রজা রক্ষার্থে করি নি, সত্যি আমি হস্তিনাপুরের অযোগ্য সম্রাট। আপনারা যে শাস্তিই দিন না কেন আমি নতমস্তকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
সূচিপতনের শব্দও তখন শোনা যাচ্ছে। পাঁচজন বিধবাই তখন ভয়ে থরথর কাঁপছে, সম্রাটের সামনে তারা তখন নতজানু! বারবার ক্ষমা ভিক্ষা করছে।
যুধিষ্ঠির বললেন মাতা আপনারা সঠিক কথাই বলেছেন আপনারা কেন ক্ষমা চাইছেন? ক্ষমা আমি চাইছি আমার পাপের শাস্তি আপনারা দিন।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন মহারাজ যুধিষ্ঠির আমি এদের ন্যায় দেব বলে কথা দিয়েছি আপনি এদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেবেন আশা করি। যুধিষ্ঠির বললেন কোন কিছুর বিনিময়েই এদের প্রতি অবিচারের ন্যায় হতে পারে না। তবে এই মূহুর্ত থেকে আমি আর হস্তিনাপুরের সম্রাট নই। এই পাঁচ জন বিধবা স্ত্রীলোকের সেবায় এখানেই জীবন অতিবাহিত করবো যদি তাতেও আমার পাপের ভার কিঞ্চিৎ লঘু হয়।
পাঁচ দিন অতীত শ্রীকৃষ্ণ ও যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুর রাজপ্রাসাদে অনুপস্থিত। সর্বত্র দূত প্রেরণ করে অর্জুন জানতে পারলেন তাদের এই গোপন অভিযানের কথা। দ্রুতগতির রথে তিনি উপস্থিত হলেন বারণাবতে। বিধবা স্ত্রীলোকদের সম্মুখে যুধিষ্ঠিরকে নতজানু অবস্থায় দেখে তিনি বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই কোন গভীর সমস্যা উপস্থিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে সম্যক জ্ঞাত হয়ে তিনি বললেন সখা তুমি তো বারবার আমাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেছ। এখন তুমিই এই অবস্থা থেকে আমাদের উদ্ধার করো।
শ্রীকৃষ্ণ বিধবা স্ত্রীলোকদের উদ্দেশ্যে বললেন, মাতা পনেরো বছর কাল অতীত। পাণ্ডবরা বহু ক্লেশ সহ্য করে তাদের সাম্রাজ্য ফিরে পেয়েছেন। দেশে শান্তির আবহাওয়া বিরাজমান এখন আপনারা যদি অনুতপ্ত মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে ক্ষমা করে তাঁকে রাজধর্ম পালন করার অনুমতি দেন তবে সবকিছু মঙ্গলময় হয়।
নিষাধ বধূরা করজোড়ে শ্রীকৃষ্ণকে বললো হে দ্বারকাধীশ আপনার দর্শনেই আমাদের সব কষ্ট দূরীভূত হয়েছে। আমাদের স্বামী ও শশ্রুমাতা যাতে সদগতি প্রাপ্ত হয় সেই প্রার্থনা জানাই। মহারাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি আমাদের আর কোন ক্ষোভ নেই। আমরা যা বলেছি তা রাজদ্রোহের সমান কিন্তু সেসব আমাদের মানষিক কষ্ট থেকেই বলা।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন মাতা আপনারা যদি আমাকে আমার কথা রক্ষা করতে সুযোগ দেন তবে আমার নির্ণয়ের সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন আশা করি।
নিষাধ পত্নীরা বললো হে দ্বারকাধীশ আমরা সর্বদা আপনার নির্ণয়ের সাথে সহমত।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন মহারাজ যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছানুসারে বারণাবতের প্রশাসক হিসেবে আপনাদের নিয়োগ করা হলো। অনার্য নিষাধ গোত্রীয় হলেও আপনাদের নিখুঁত পর্যালোচনা ও অসীম জ্ঞানকে শ্রদ্ধা করছি। মহারথী অর্জুন শাষন কার্যে আপনাদের সহযোগিতা করবেন।, অনুতপ্ত মহারাজ যুধিষ্ঠির সকল পাপ মুক্ত হোন। হস্তিনাপুরের প্রজা কল্যাণের জন্য এখনই তাঁর রাজধানীতে ফিরে যাওয়া আবশ্যক,মঙ্গল হোক সকলের।
অতঃপর অন্য এক যুধিষ্ঠিরকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন হস্তিনাপুরের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
আমার কথা কাহিনীটি সম্পূর্ণ কল্পনা প্রসুত এর সাথে মহাভারতীয় কাহিনীর কোন সংযোগ নেই। আপনারা ধৈর্য ধরে এই লেখা পড়েছেন এতেই আমি কৃতার্থ। ধন্যবাদ সকলকে।