পর্ব – ১
ইট পাটকেল চুন সুরকির কাছে নিজে দাঁড়িয়ে মিস্ত্রি খাটাচ্ছিলেন রুদ্রপ্রসাদ। নির্দেশ দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেননি, মনের মধ্যে দুরন্ত এক ছটফটানি। …অথচ দালান কোঠা বানানো নয়, দেউল মন্দির নির্মাণ নয়। ভিটেবাড়ি থেকে অনেকটা দূরে আমবাগানের ধারে মাত্র হাত কয়েক জমি ঘিরিয়ে নিচ্ছেন জাফরি কাটা নিচু পাঁচিল দিয়ে। ভবিষ্যতে নাকি জয়পুর থেকে শ্বেতপাথরের জাফরি আনিয়ে লাগাবেন ওখানে, এ সংকল্প প্রকাশ করেছেন মিস্ত্রির কাছে। মিস্ত্রির কাছেই শুধু, আর কারও কাছে নয়। অথচ একান্ত কাছেই আর এক মানুষ আছে একই ভারে ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে। তার কাছে বলা চলত।
কিন্তু কাছেই আছে বলে কি কাছাকাছি আছে? রুদ্রপ্রসাদের সঙ্গে হৃদয়ের লেনদেন তার কতটুকু? মিস্ত্রিকে বলে রাখার উদ্দেশ্য, হয়তো ভবিষ্যতের সেই খেতপাথরের জাফরি বসানোর কাজ আদায় রাখতে।
রুদ্রপ্রসাদের এই কাজটা সম্পর্কে আড়ালেও কেউ কোনও মন্তব্য করতে সাহস করছে না। কে বলতে পারে সে মন্তব্য কোনও অসতর্কতায় রুদ্রপ্রসাদের কানে গিয়ে উঠবে কিনা। দেয়ালেরও কান আছে, এবং কখনও কখনও কানওলা লোকেদেরও গোপন রসনা আছে।
এমনিতেই কেউ কখনও রুদ্রপ্রসাদের কোনও কাজের আড়ালেও সমালোচনা করবার সাহস পায় না, এখন তো আরওই ভয়ংকর হয়ে আছেন তিনি। এমনিতেই তো তিনি আত্মজন পরিজন, এমনকী প্রিয়জনদের কাছেও আতঙ্ককর। তার উপর এই ভয়াবহ ঘটনার পরিস্থিতি।
রুদ্রপ্রসাদ যদি এখন হঠাৎ তাঁর পিতাপিতামহের এই বিশাল প্রাচীন প্রাসাদখানায় আগুন লাগাতে বসতেন, তা হলেও বোধহয় স্তম্ভিত জনেরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে দেখত। বাধা দিতে আসতে পারত না।
রুদ্রপ্রসাদের আপাততর এই খেয়ালটাকে তাঁর পরিচিত জনেরা ভগবানের আশীর্বাদ বলেই মনে করছে। যদি এইরকম একটা কাজে মনটা অন্যমনস্ক হয়ে দুরন্ত ছটফটানিটা কিছু স্তিমিত হয়ে আসে। যদি সেই ভয়ংকর প্রতিশোধের স্পৃহাটা কমে যায়, অপরাধীকে চরম দণ্ডদানের প্রতিজ্ঞাটা কিছুটা শিথিল হয়ে আসে।
ভাবছে। তবু কাঁটা হয়েই আছে সবাই। ওই বজ্রগর্ভ মেঘটার দিকে তাকিয়ে।
বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন মানুষের জীবনে নাকি শোকেরও প্রয়োজন আছে। শোক হৃদয়কে নম্র করে, মনকে পবিত্র করে, জীবনের অনেক কিছুর মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটিয়ে, একটা শান্ত সমাহিত উদাস উদার জীবনদর্শন এনে দেয়।
কিন্তু রুদ্রপ্রসাদকে দেখলে বিজ্ঞজনেরা তাঁদের মতবাদকে সংবরণ করবেন। পুত্রশোকের তুল্য তো শোক নেই?
আবার সে পুত্র যদি একমাত্র পুত্র হয়?
তার মতো দুঃখী সর্বহারা আর কে আছে।
অথচ রুদ্রপ্রসাদ?
নাঃ, তাঁর বহিরঙ্গে সেই সর্বহারার ছাপ কোথাও নেই। আজও তাঁর সেই টকটকে রং, দীর্ঘোত দেহ, কৃষ্ণ কেশদামের চিকন পারিপাট্য, চাড়া দেওয়া গোঁফের সুক্ষ্মগ্র যেন কোনও তীক্ষ্ণ অস্ত্রের মতো উদ্যত। সেই বাহান্ন ইঞ্চি বহরের কোমল কাঁচি ধুতির চুনট করা কোঁচার আগায় ফুলের বাহারের নীচে চকচকে বার্নিশকরা পাম্প শু, আর মিহি আদ্দির লম্বা ঝুল কস্কা কাজ চুড়িদার পাঞ্জাবির গিলে করা হাতার আগায় হারের বোতাম। বুক পকেটে সোনার চেনে গাঁথা ঘড়ি আর পাটকরা রুমাল। কোনও কিছুরই ব্যতিক্রম নেই। এই দুপুরবেলাও পোশাকের পাট ভাঁজ চোস্ত।
বাড়তির মধ্যে টকটকে মুখের রং আরও টকটকে। যেন ভিতর থেকে একটা চাপা আগুন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাইছে। রোদ লেগে? তাই বা বলা যায় কী করে? মাথার উপর ছাতা ধরে রয়েছে তো দুদুটো লোক। প্রকাণ্ড ছাতা, ভারী আর মস্ত লম্বা বাঁট। একজনের সাধ্য নয় ধরে রাখতে পারে। আরও দুটো লোক দুপাশে দাঁড়িয়ে সমানে পাখা চালিয়ে যাচ্ছে। রেশমি ঝালর দেওয়া স্পেশাল তালপাতার পাখা। এ অঞ্চলে অতবড় তালপাতা মেলে না, অন্য কোথাও থেকে আনানো। অবশ্য এ বংশের জন্যে বরাবরই এমন সব জোগান আসে।
বিলাসিতার অভ্যাসে অনুষ্ঠানের ত্রুটি নেই। অদূরে কাকচক্ষু পুকুরের জলের মধ্যে ডাবের কাঁদি ভিজছে, রুদ্রপ্রসাদের তৃষ্ণার অপেক্ষায়। কাছাকাছি পাতা রয়েছে একখানা ভারী আরামকেদারা, তার উপর তালপাতার ঘন বুনন শীতলপাটি ঢাকা কেদারা গরম হয়ে উঠবার ভয়ে। কেদারার পায়ের কাছে একটা বার্নিশকরা জলচৌকি, তার উপর রুপোর গড়গড়া ফারশি আলবোলা সমেত।
কিছুক্ষণ আগে এগুলো একবার ব্যবহার হয়েছে, আবার কোন মহামুহূর্তে দরকার হবে জানা নেই। তাই তটস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিবারণ যাদব আর বেচু। বেচু রুদ্রপ্রসাদের খাসখিদমদগার, এসব আয়োজন তারই অবদান। রাজাবাবুর কখন কী দরকার বেচুর মুখস্থ। আর কখন কী দরকারের ইচ্ছে হতে পারে সেটাও বেচুর অন্তরস্থ।
বেচুকে ডাকবার জন্যে কখনও কথা খরচ করতে হয় না রুদ্রপ্রসাদকে, সামান্য একটু গলাখাঁকারি দিলেই যথেষ্ট। অবশ্য চুনোপুঁটি শামুক গুগলিদের ডাক দেবার জন্যে, কারও নাম মনে রাখবার মতো খেলো দায় রুদ্রপ্রসাদের নেই। কে আছিস? বলে একটা হাঁক দেওয়াটাই যথেষ্ট মনে করেন। হয়তো যথেষ্টই। তিন দিক থেকে তিনজন ছুটে আসে।
বাতাসে বার্তা আসছে রাজাবাবুত্বের দিন শেষ হয়ে আসছে, জলে স্থলে আকাশে অন্তরীক্ষে চলছে কানাকানি ফিসফিসানি।…থাকবে না…থাকবে না থাকবে না এসব রাজাগিরি…বাবুগিরি।…অনেক কাল গরিবের রক্তশোষণ করে এসেছ তোমরা, গরিবের মাথায় পা দিয়ে হেঁটেছ, প্রজাপালন করেছ যদি চার আনা সংখ্যা তো–প্রজাপীড়ন করে এসেছ বাকি বারো আনার। এবার–দিন বদলের পালা, দিন ফুরনের খেলা।
বাতাস ঘর বুঝে ঢোকে না, খোলা দরজা জানলা পেলেই হল। জাফরি ঘুলঘুলি ফোকর ফুটো তারাও বঞ্চিত হয় না। অতএব সবাই টের পাচ্ছে বাতাসের বয়ে আনা এই বার্তা। তবু বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্নও আছে বইকী! কেউ কেউ আশায় উদ্বেল হচ্ছে, বলছে, ঠিক হয়েছে। সাতপুরুষের সঞ্চিত পাপের ঋণ শোধ করো এবার। বাসুকীর মাথা ভারী হয়ে উঠেছে। ফণা বদলাচ্ছে সে।
কেউ কেউ অবিশ্বাসের হাসি হেসে তাচ্ছিল্যের গলায় বলছে, আরও কিছুনয়? হলেই হল? যুদ্ধ নয়, বিপ্লব নয়, কোথাকার কার কলমের একটা খোঁচায় চিরস্বত্বের সত্যটা লোপ পেয়ে যাবে? এ কি মামদোবাজি নাকি? ছাড়ান দাও ও কথায়।
স্বত্বের সত্যটা যাদের কাছে পরম বিশ্বাসের অবলম্বন, তারা আছে এই শেষোক্তদের দলে। কাজেই তাদের দিনযাপনের জীবনে এখনও নড়চড় হয়নি কিছু। ইতিহাসের শিক্ষা এদের উপর ছায়াপাত করতে পারে না, দেয়ালের লিখন পড়তে জানে না এরা।
তাই উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে ওরা অভ্যস্ত বিলাসের দাসত্ব চালিয়ে চলেছে। তাই রুদ্রপ্রসাদের এখনও রুপোর বাটিতে পঞ্চাশ ব্যঞ্জন, রুপোর থালায় সুবাস সুরভিত মিহি চালের অন্ন।
এখনও নিজের পুকুরের সদ্য তোলা টাটকা মাছের মুড়ো, ঘরের গোরুর দুধের সরতোলা গাওয়া ঘি, ঘন ক্ষীরের বাটিতে বাবুপাকের মণ্ডার জোড়া। ফল খাবার তব্বিৎকত, আম খাবার বিধি কত। লোহার বঁটি ছুরিতে ছাড়ানো চলবেনা আম,কষ ধরবে। আম ছাড়াতে আসে বাঁশের চাঁচের ছুরি।…মর্তমান কলা আসবে প্রায় অমর্ত্য লোক থেকে। আঙুর আনারস ডালিম বেদানা এসবের জন্যে চিবানোর কষ্ট করতে নারাজ তাঁরা, তাই এঁদের সামনে ধরা হয় পাথরের গ্লাস ভর্তি করে এদের তনুনিংড়ানো রস।
বিলাসিতার আতিশয্য এঁদের প্রতি পদক্ষেপে। অশনে বসনে,শয়নে ভোজনে,শখে, খেয়ালে নেশায় প্রমোদে। মহাকালের খাতায় যে প্রতিনিয়ত লেখা হয়ে চলেছে এই অপরিমিত অপচয়ের হিসেব, সে হিসেব দেখবার খেয়াল আসেনি কারুর।
কবে কোন নিঃস্ব পূর্বপুরুষ বড়লোক হবার জেদি প্রতিজ্ঞায় শুরু করেছিল দৌড়, সেই দৌড়ের উন্মাদ নেশায় ছুটে চলেছে তার উত্তরপুরুষেরা। যেন রেসের ঘোড়া। জানে না কেন ছুটছি, কোন লক্ষ্যে, আর বাজিটা জিতছে কে! জানে শুধু ছুটতে হবে। পার্শ্ববর্তী ছুটন্তদের ওভারটেক করে ছুটতে হবে। পায়ের তলায় যদি ঘাসপাতারা পেষাই হয়ে আর্তনাদ করে ওঠে, আর্তনাদ করতে করতে অবশেষে একদিন নীরব হয়ে যায়, এরা তা টেরও পায় না। জানে, এ পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র সত্য।
জানে এ ধরণীভূমি আমারই ভোগের জন্যে।
অবশ্য এঁদের অগাধ প্রাচুর্যের সামান্য অংশ থেকে জনহিতকর কাজও কিছু কিছু হয় বইকী! তা তার কতটুক মানবিকতাবোধ, আর কতটুকু অপর প্রতিপক্ষকে টেক্কা মারার চেষ্টায়, সেটা বিবেচ্য। অন্তত রুদ্রপ্রসাদ যখন এই দেবীপুর মৌজায় হঠাৎ দু দুটো প্রাথমিক স্কুল খুলে দিয়ে ধন্য ধন্য রব তুলিয়েছেন, তখন সরমা বলেছিলেন, একসঙ্গে দুদুটো ইস্কুল খোলার কি এত দরকার ছিল? সতীশ সরকার ছেলেদের জন্যে একটা ইস্কুল খুলেছেন, আমাদের এখান থেকে ভালমতো একটা মেয়ে-ইস্কুল খুললেই তো ভাল ছিল। তেমন জমজমাটি করতে পারলে, বিনি-মাইনেয় পড়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে–তাতেও সতীশ সরকারের উপর মাথাটা উঁচু হত।
রুদ্রপ্রসাদ ব্যঙ্গ হাসি হেসে বলেছিলেন, ভুল হয়ে গেছে। এবার থেকে সকল কর্মের আগে তোমার পরামর্শ নিতে ছুটে আসতে হবে মনে হচ্ছে।
সরমাও সুন্দরী, সরমাও ব্যক্তিত্বময়ী, তবু ওই দীর্ঘোন্নত দেহী কান্তিময় দৃপ্ত পুরুষটির কাছে তাঁকে নিষ্প্রভই দেখায়। বিশেষ করে ওই ব্যঙ্গ হাসি। ওঁর সামনে চুপ হয়ে যান তিনি।
এখনকার কথা তো আলাদা।
এখন তো তিনি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেছেন। আকস্মিক প্রচণ্ড শোকের আঘাতে বিধ্বস্ত স্তব্ধ এই মৃতমূর্তির দিকে তাকালে সহানুভূতি আসে না রুদ্রপ্রসাদের, আসে ঘৃণাবোধ।
যে-কোনও অবস্থাতেই কাবু হয়ে পড়াটা রুদ্রপ্রসাদের মতে ঘৃণ্য ব্যাপার। আমি শোকগ্রস্ত অতএব আমি আমার অভ্যস্ত আহার বিহার আরাম আয়েস ত্যাগ করে, মুহ্যমান হয়ে পড়ে থাকব, এর থেকে খেলোমি আর কী আছে? ওসব করুক যদু-মধুরাম-শ্যামেরা। রুদ্রপ্রসাদের জন্যে ওসব নয়। তাই সরমার জন্যে তাঁর সমবেদনাবোধ নেই, আছে অবজ্ঞা, ঘৃণা।
অবশ্য অবজ্ঞা আর কবে না ছিল? প্রতি পদেই তো প্রকাশ পেয়ে আসছে সেটা তাঁদের এই আঠারো বছরের বিবাহিত জীবনে।
রুদ্রপ্রসাদের বাবা শক্তিপ্রসাদ নাকি অকস্মাৎ মৃত্যুর শিকার স্ত্রীর সদ্যমৃত দেহটাকে পরিজনের হেফাজতে ফেলে দিয়ে নিজে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সঙ্গে বাঘ শিকার করতে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ম্যাজিস্ট্রেটকে কথা দেওয়া আছে বলে। এ গল্প শুনে কিশোরী সরমা বিবর্ণ হয়ে গেল দেখে রুদ্রপ্রসাদ হেসে উঠে বলেছিলেন, মরদ কা বাত হাতি কা দাঁত বুঝলে। ও বোঝবার ক্ষমতা তোমার মতো বোষ্টমবাড়ির মেয়ের নেই।
সরমা শিকার জিনিসটাকে ঘৃণা করেন, তাই রুদ্রপ্রসাদ ব্যঙ্গ করে বলেন, বোষ্টমবাড়ির মেয়ে। সত্যি বোষ্টমবাড়ির মেয়ে হলে কি আর এবাড়িতে দেউড়ি পার হয়ে আসবার সৌভাগ্য হত সরমার?
তা লোকে তো সৌভাগ্যই বলে। বিয়ের সময় সরমার ভাগ্যকে ধন্য ধন্যই করেছে। সরমাও অবশ্য দীনদুঃখীর ঘরের মেয়ে নয়, রীতিমত সম্পন্ন অবস্থা তাদের। সরমার বাবা অনাদি সান্যাল মালদার নামকরা ব্যবসায়ী। মধুর ব্যবসায় তো ও অঞ্চলে প্রায় একচেটিয়া অধিকার।
তবু কীসে আর কীসে? কোথায় দেবীপুর মৌজার জমিদার শক্তিপ্রসাদ লাহিড়ী, আর কোথায় মালদহের ব্যবসায়ী অনাদি সান্যাল। অনেক জন্মের ভাগ্যি ছিল সরমার। তাই এমন আকাশের চাঁদ এসে ধরা দিল। তা ছাড়া রূপ? বিবাহবাসরে পরমাসুন্দরী বলে খ্যাত সরমা বরের পাশে জেল্লা হারালো।
কিন্তু সরমা এখনও মাঝে মাঝে ভাবেন আঠারো বছর আগের সেই সকালটাকে যদি ফিরিয়ে আনা যেত। সেই সকালটার ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে তখন।…প্রাচীন এক মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বছর বারোর একটা মেয়ে পাকা গিন্নির মতো তার ছোটভাইটাকে শাসন করছিল, হটহটিয়ে মা কালীর মন্দিরে উঠে গেলি যে বড়? প্ৰেথম পৈঠেটায় পা দেবার আগে পৈঠের ধুলো মাথায় দিয়ে তবে পৈঠে উঠতে হয় এও জানিস না মুখ?
ভাইটা দিদির থেকে বছর চারেকের ছোট, আর তখনও দিব্যজ্ঞান হয়নি। তাই বলে উঠেছিল, কী হয় এমনি উঠলে? যত লোকের পায়ের ধুলো–
মেয়েটা বকে দিয়েছিল, এই চোপ। আবার মুখে মুখে তক্ক? তক্ক করবি না বলে দিচ্ছি। যা শেখাবো শিখবি। ব্যস!
মুখটা কী উত্তর দিত কে জানে, দেওয়া হল না। হঠাৎ পিছন থেকে একটা দরাজ গলা শাবাশ দিয়ে উঠল মেয়েটাকে। শাবাশ! এই তো চাই। এইটিই তো খুঁজে বেড়াচ্ছি! বড় জাহাজের হাল ধরতে পারবে।
মেয়েটা চকিতে পিছু ফিরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
কে এই অগ্নিবর্ণ পুরুষ!
সেই দরাজ গলা আবার প্রশ্নে ধ্বনিত হল, দেখেই ধরা পড়ছে এটি ভাই। তা আর কজন ভাইবোন তোমরা?
আর কেউ নেই। আমি আর এ
ঠিক ঠিক জবাব দিল মেয়েটা।
ভদ্রলোকটা গোরার মতন দেখতে হলেও বাঙালি তো বটে। বলা যায় রাজার মতন।
ভাল ভাল। নাম কী তোমার?
সরমা।
বেশ! তোমাকেই খুঁজছিলাম আমি মা জননী।
আমাকে! আমায় চেনেন আপনি?…
সন্দেহ নেই মেয়েটা নির্ভীক। তাই ভাই তো ওই টকটকে ধবধবে দশাসই মানুষটাকে দেখেই দিদির পিছনে আশ্রয় নিয়েছে।
রাজার মতন লোকটা মৃদু হেসে বলে ওঠেন, চিনতাম না, এইমাত্র চিনলাম। বাবার নাম কী?
শ্রীঅনাদিনাথ সান্যাল।
সান্যাল! আহা! একেই বলে যোগাযোগ। একেবারে পালটি ঘর। তা বাড়িটা কোথায়?
ওই তো ওইখানে দেখা যাচ্ছে। লাল রঙের বাড়িটা
চলো তোমায় পৌঁছে দিই।
মেয়েটা হঠাৎ হেসে উঠে বলে ফেলেছিল, আমাদের বাড়িতে আবার আমায় কী পৌঁছে দেবেন আপনি? আপনি যদি যেতে চান, আমিই রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।
অমোঘ নিয়তি!
আচ্ছা—
দেবীপুরের শক্তিপ্ৰসাদ লাহিড়ীর হঠাৎ মালদহের পূর্বাসা কালীকে দেখতে আসবার কী দরকার পড়েছিল?
এখনও ভাবেন সরমা।
এখনও যেন চোখের সামনে দেখতে পান শক্তিপ্ৰসাদ নামের অহংকারী মানুষটা ব্যবসা ব্যাপারি মানুষ অনাদি সান্যালের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলে উঠলেন,কই, ডাকো তো তোমার বাবামশাইকে।
এ স্বরে কৌতুক ছিল। যেন মশাই শব্দটা এক্ষেত্রে হাস্যকর। এ কৌতুক ওই বারো বছরের মেয়েটাও ধরে ফেলেছিল। চট করে বলে ফেলেছিল, ভিতরে ঢুকবেন না বুঝি?
ঢুকব। পরে। আজ নয়।
ভিতরে গিয়ে বাপকে ডেকে এনেছিল দ্বাদশী সরমা। আর বাবার হতচকিত মুখ আর অতি বিনীত ভাব দেখে রাগে গা জ্বলে গিয়েছিল তার। এত কীসের? উনি বড়লোক আছেন তো থাকুন না। এত ভিখিরি ভিখিরি ভাব দেখাতে হবে কেন?
কিন্তু সে কেনর প্রশ্ন তখন কে করছে অনাদি সান্যালকে? অনাদি তো তখন হাঁ করে তাকিয়ে বলছে, আপনার কথা তো ঠিক বুঝতে পারছি না।
বুঝবে কী করে?
দেবীপুর মৌজার জমিদারকে চেনে অনাদি সান্যাল। মালদহ জেলায় তাঁর অনেক সম্পত্তি আছে। কখনও কখনও আসেন মহাল পরিদর্শন করতে। কাছে থেকে না হলেও দেখেছে অনাদি। কিন্তু তিনি যদি হঠাৎ অনাদির দরজায় এসে বলে বসেন, আমার ঘরের মালক্ষ্মীটিকে আপনার ঘরে আর কতকাল আটকে রাখবেন মশাই? অনেকদিন তো হল, এবার ছেড়ে দিন?
তা হলে বেচারি অনাদি সান্যাল চক্ষে সরষে ফুল দেখবে না?
বলবে না, আ–আপনার কথা তো ঠিক বুঝতে পারছি না।
নাঃ। মাথাটা আপনার বড় মোটা দেখছি। আমার একটি বিবাহযোগ্য পুত্র আছে, আর আপনার এই মেয়েটিও বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে–এবার আশা করি বুঝতে পারছেন?
তবু অনাদি সান্যালের ভয় ঘোচনি। হাতজোড় করে বলেছিলেন, এ কী আদেশ করছেন? এই গরিব অনাদি সান্যালের মেয়ে যাবে আপনার ঘরে? এ যে অসম্ভব মনে হচ্ছে।
শক্তিপ্ৰসাদ হা হা করে হেসে বলেছিলেন, শুধু ধানচালের হিসেবই করেছেন বুঝি সারা জীবন? শাস্ত্র-টাস্ত্র জানেন না? শাস্ত্রে আছে স্ত্রীরত্নং দুম্বুলাদপি। বুঝলেন? যাক ওই কথা হয়ে থাকল। এবার একটা শুভদিন দেখে খবর পাঠাচ্ছি।
বাপ এসে দাঁড়াবার পরই বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছিল সরমা। কিন্তু ততক্ষণেই তার যা বোঝবার তা বোঝা হয়ে গেছে।
ঘরের মধ্যে বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে শুরু করেছিল সে। ওইটুকু মেয়ে, তবু তার মনে হয়েছিল, ওই প্রবলপরাক্রম মানুষটা যেন হঠাৎ কোথা থেকে দৈত্যের মতো এসে পড়ে সরমাকে শিকড় ছিঁড়ে উপড়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কারুর ক্ষমতা নেই ওকে রুখবার।
মা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, বুঝলাম অনেক জন্মের ভাগ্যি, কিন্তু জমিদার বাড়িতে মেয়ে দেওয়া মানেই তো জন্মের শোধ দেওয়া।
অনাদি সান্যাল বোঝতে চেষ্টা করেছিল, তা কেন? এখানে ওনার অনেক জমিদারি রয়েছে, আসবেন যাবেন
উনি আসবেন যাবেন, আমার রমু কি আসবে যাবে? এলে আমার বাড়িতে থাকতে আসবে? আমার হাতের রান্না খেতে আসবে?
কেঁদে ফেলেছিল মা।
সরমার বলে উঠতে ইচ্ছে হয়েছিল, তোমাদের মেয়ে তোমাদের ইচ্ছে না হলেও বিয়ে দেবে? এ কি মগের মুল্লুক নাকি?
কিন্তু বিয়ের কথায় কথা কওয়াটা নাকি নির্লজ্জতা, তাই চুপ থাকতে হয়েছিল তাকে।
সেই যে চুপ, সেই থেকেই চুপচাপ হয়ে গেল। কথার ভট্টাচার্য মেয়েটা। মা বলত, কথার ভট্টাচার্য, বাবা বলত, হরবোলা। পাড়ার লোকে বলত, কলচালানি। সে অভ্যাসটা চলে গেল। মাকে আর মেয়েকে শ্বশুরঘর পাঠাবার সময় বলতে হল না, বড্ড বেশি কথা তোমার মা, দেখো যেন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে এত কথা কোয়ো না। নিন্দে হবে।
বরাবরই তো ভাবত এ কথা। আর কিছু না হোক, এইটা শিক্ষা দিতে হবে।
সরমার সখী সামন্তিরা বলেছিল, বড়লোকের বাড়িতে বে হবার নামেই সরির কী ঠ্যাকার হয়েছে দেকচিস? আমাদের সঙ্গে আর ভাল করে কতাই বলছে না।
একজন বলেছিল শুধু, না রে! ওর পেরাণে ভয় ধরেচে, তাই।
বকিসনে। ওর আবার পেরাণে ভয়! ও কি ভয়ডর পাবার মেয়ে?
চন্দন বলেছিল, দিদি তুই নাকি এরপর আমাদের ভুলে যাবি?
দিদি বাঘিনীর মতো বলে উঠেছিল, কে বলেছে এ কথা?
চন্দন ভয়ে ভয়ে বলেছে, মাসি বলছিল মাকে।
সরমা কড়া গলায় বলেছিল, যাবই তো ভুলে। কেন যাব না? সেইজন্যেই তো বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাবা রাজার বেয়াই হবেন, কত মান্যিগন্যি।
বাবা তো ইচ্ছে করে বলেননি দিদি।
দিদি ক্রুদ্ধ গলায় বলেছিল, না, ইচ্ছে করে নয়। কেন? বলতে পারা যেত না, আমার মেয়ে আমার যেখানে খুশি বিয়ে দেব। তোমাদের কথায় নাকি?
তা হলে রেগে যেত না তোর শ্বশুর?
রেগে যেত তো কী হত? আমরা কি ওঁর পেরজা?
চন্দন হঠাৎ হি হি করে হেসে বলে উঠেছিল, এখন তো এই কথা বলছিস। মা বলেছে এর পরে তুই-ই হয়তো গরিব বলে ঘেন্না করবি আমাদের।
সরমা তীব্র গলায় বলেছিল, করবই তো ঘেন্না। পরে কেন? এখনই করছি। বাবার যা ভিখিরি ভিখিরি ভাব। …দেখলিনে সেদিনকে? কী অহংকার তেনার? বাবা অতবার বললেন, কিছুতে আমাদের বাড়িতে ঢোকা হল না। আবার কোথা থেকে তক্ষুনি ওনার টমটম গাড়ি এসে হাজির হল। কালীমন্দির থেকে রাজাবাবু এতখানি পথ হেঁটে এসেছেন দেখে, লোকজনেরা ভিরমি যাচ্ছিল, সেই বাড়িতে যেতে হচ্ছে আমায়।
চন্দন বলেছিল, মজাই তো বাবা। তোর তো শাশুড়ি নেই বলছে। রাজবাড়ির গিন্নি হয়ে গিয়ে বসবি। রুপোর বাসনে ভাত খাবি। দাসীরা চুল বেঁধে দেবে, পা টিপে দেবে।
সরমা লাল লাল মুখে বলেছিল, পাকা পাকা গিন্নিদের কাছে বসে বসে খুব যে কথা শিখেছিস দেখছি। খবরদার আর আমার কাছে বলতে আসবিনে এ সব।
তা আর বলবার সময়ই বা পেয়েছে কোথায় বেচারা?
শক্তিপ্রসাদের তো দেরি সইছিল না।
আসল কথা, সবই খেয়ালের ব্যাপার। যেই মনে হল, একে আমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া চাই, সেই অধৈর্য অবস্থা। অধৈর্যটা আরও ঘটাপটা করার জন্যে।
শক্তিপ্রসাদের একমাত্র পুত্র, তার বিয়েতে ঘটা হবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু শক্তিপ্রসাদের পরিকল্পনা ছিল আকাশছোঁয়া। তাই রুদ্রপ্রসাদের বিয়ের ঘটাটা এ অঞ্চলের ইতিহাসে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল।
হাতি ঘোড়া চতুর্দোলা বাঈ-নাচ, মাসখানেক ধরে বেপরোয়া যজ্ঞি, বউকে হিরে-মুক্তোয় মুড়ে নিয়ে আসা ছাড়াও প্রধান যেটা সকলকে কৌতূহলে মুখর করে তুলেছিল, সেটা হচ্ছে সাহেব-মেমের র্যালা।
সাহেবরা আর তাঁদের বিবিরা নাকি বাঙালির বিয়ে দেখতে উৎসাহী। দিন তিনেক ধরে তাঁরা থাকলেন, খেলেন, নাচলেন, পান করলেন, ফাংশানের ফটো তুললেন রাশি রাশি, এবং সকলে মিলে নববধুকে শুধু একটি সোনার ব্যান্ড রিস্টওয়াচ উপহার দিয়ে গেলেন।
তাতেই মোহিত শক্তিপ্রসাদ।
দেশের চারদিকে যখন বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে বহুবিধ তোলপাড় চলছে, এবং শাসকরাও প্রাণপণ করছে–শাসন কাকে বলে তা দেখাবার জন্যে, তখন–অর্থাৎ সেই পটভূমিকায় সেই উৎপীড়ক ম্যাজিস্ট্রেট কালেক্টর পুলিশ সুপার কমিশনার ইত্যাদিকে পরিবারবর্গ সহ এত আদর আপ্যায়ন, সকলেই যে খুব ভাল চক্ষে দেখেছিল তা নয়। কিন্তু অধিকাংশেরই উদ্বেগের থেকে উৎসাহ বেশি, বিরক্তির থেকে কৌতূহল।
কজন আর জাগ্রত? বেশির ভাগই তো ঘুমন্ত।
এ উৎসবে অনাদি সান্যাল আসেননি অবশ্য, তাঁর স্ত্রীও নয়। জামাইবাড়িতে খাওয়া চলে না। চন্দন এসে থেকেছিল মাসখানেক। আমোদ-আহ্লাদ করানো হয়েছিল তাকে যথেষ্ট, শুধু দিদির সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল দুর্লভ। কোথায় সে, কোথায় দিদি। দৈবাতের দেখা।
যাবার আগের দিন একটু সময় নিয়ে দেখা করতে দেওয়া হল। দিদি বলল, খুব আমোদ-আহ্লাদ করলি তো?
চন্দন মুখ নিচু করে বলল, করেছি।
তারপর হঠাৎ প্রায় ডুকরে কেঁদে বলে উঠল, এই বাড়িতে তোকে থাকতে হবে দিদি? তুই নিশ্চয় মরে যাবি।
বারো বছরের দিদি শক্ত গলায় বলল, সে কী রে! এত সুখ এত টাকা এত গয়না এত আদর, মরব কী বল?
চন্দন বলল, তোকে আমার গপ্পোর বন্দিনী রাজকন্যার মতন লাগছে।
তবে আর কী করব বল! বাবাকে গিয়ে বলিস কথাটা।
চন্দন বলেছিল, বাবা তো এত ঘটা শুনে আহ্লাদে ভাসবেন।
আর মা?
মা কাঁদবেন। কিন্তু সে তো আদে। তোর এত সব হয়েছে, এই ভাববেন আর কাঁদবেন।
সরমা নিশ্বাস ফেলে বলেছিল, তোর কী সুখ! বেটাছেলে হয়ে জন্মেছিস!
আর বিশেষ আসেনি চন্দন।
কিছু বছর পরে আর একটা ঘটার যজ্ঞি হয়েছিল, শক্তিপ্রসাদের শ্রাদ্ধে। তখন এসেছিল, জামাইবাবুর ব্যবহার তার ভাল লাগেনি। চলে গিয়েছিল পড়ার ক্ষতির ছুতো করে। আর এসেছিল ভাগ্নের অন্নপ্রাশনে মুখে ভাত দিতে। একদিনের জন্যে।
সরমা রয়ে গেছেন।
একটানা, একাসনে।
কিন্তু সেটা এঁদের দোষ নয়, দোষ সরমারই।
তিনি যদি মা বাপের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছুক না হন, কে কী করবে? ও অঞ্চলে মহাল দেখতে যাবার সময় দু-একবার তো নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সরমাকে, লোকজন দাসীবৃন্দ দিয়ে মা বাপের সঙ্গে দেখা করতেও পাঠানো হয়েছিল, কিন্তু আর যেতে চাননি রানি সরমা দেবী।
হ্যাঁ তাঁর স্পেশাল পালকিতে, ওই পরিচয়ই সাঁটা থাকে। বাপের বাড়ির দরজায় গিয়ে নেমেছিলেন সে পালকি থেকে, পাড়া কেঁটিয়ে দেখতে এসেছিল সবাই।
এটা অবশ্য শক্তিপ্রসাদ থাকতে। কেন কে জানে শক্তিপ্রসাদের যেন কোথায় কোনখানে একটা অপরাধবোধ ছিল। তাই জিজ্ঞেস করে পাঠাতেন। বাপের বাড়ির দেশে লোক যাচ্ছে, মা ভবানী যেতে ইচ্ছুক কিনা।
মা ভবানী দাসীদের বকলমে এখানের নানা ধরনের দায়দায়িত্ব কাজ কর্তব্যের ফিরিস্তি দেখিয়ে সময়ের অভাবের কথা জানাতেন।
শক্তিপ্রসাদ গত হলেন। বলতে গেলে অকালেই।
অপরিমিত পানাসক্তির প্রতিফলস্বরূপ, যন্ত্রণাদায়ক সেই মৃত্যুর যন্ত্রণা সাহেব ডাক্তারেরাও লাঘব করতে পারল না।
আটচল্লিশ বছর বয়েসের জীবনটায় নিজেকে হাউয়ের মতো জ্বলিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে যখন মরে বাঁচলেন শক্তিপ্ৰসাদ একমাত্র সন্তান রুদ্রপ্রসাদ তখন পঁচিশ বছরের যুবা, উদ্ধত অবিনীত বেপরোয়া।
বাপের নির্দেশে আঠারো বছর বয়েসে বিয়ে করেছিল বটে, এবং তখনও বাপ সম্পর্কে সমীহ ছিল কিছুটা, কিন্তু কে জানে–মনস্তত্ত্বের কোন নিগুঢ় তত্ত্বে বিয়ের পরই হঠাৎ বড় বেশি লায়েক হয়ে উঠল সে।
এমনিতে অবশ্য এ রকম ধনীঘরের ছেলেদের কিশোর বয়েস থেকেই স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারের অনেকখানিটা ছাড়পত্র থাকে। কর্মচারীদের উপর প্রভুত্ব, প্রজাদের উপর শাসন-পীড়ন, কিছু কিছু নেশাসক্ত হয়ে ওঠা। এসবের অধিকার পেয়ে যেত তারা ওই অল্প বয়েসেই। শুধু বাপ-ঠাকুরদাকে ভয় করে চললেই হল।
বিয়ের পর রুদ্রপ্রসাদ হঠাৎ সেই ভয়টাকেই ত্যাগ করে বসল। মুখের উপর মন্তব্য করে বসল, এই অসম বিয়েটা শক্তিপ্রসাদের বিরাট একটা বোকামি। ..এমনকী রোগযন্ত্রণার শিকার শয্যাশায়ী লোকটাকে একদিন বলে বসল, সুন্দরী মেয়েটাকে হঠাৎ যদি এত চোখে লেগে গিয়েছিল তো, নিজেই বিয়ে করে ফেললে পারতেন! আমার উপর চাপানো কেন?
অশক্ত শক্তিপ্রসাদ চমকে উঠে থরথরিয়ে কেঁপে বললেন, কী বললি?
সাধারণত এঁদের ঘরে ছেলেমেয়েকেও তুই টুই করে কথা বলার নিয়ম নেই, কিন্তু ছেলের এই নির্লজ্জ প্রশ্নে ধৈর্য হারিয়েছিলেন সেদিন।
বললেন, কী বললি? আমার মুখের উপর এই কথা বলতে পারলি তুই?
নির্ভীক রুদ্রপ্রসাদ মৃদু হেসে বলল, ঠিকই তো বলেছি। সেটাই ভাল হত। সেবাটেবা করবার একটা লোক পেতেন।
এটা বাহুল্য কথা।
ভদ্র চিত্ত সরমা শ্বশুরের খাস ভৃত্যকে পেরিয়ে যতটা সেবা সম্ভব তা করে চলেছে। …হয়তো বা উগ্র যৌবন সদ্য যুবক রুদ্রপ্রসাদের সেটাই ছিল উম্মার কারণ। অথবা তা নয়, শক্তিপ্ৰসাদ ভাবলেন সেটা। ক্ষুব্ধ জ্বলন্ত গলায় বলে উঠলেন, কেন? পুত্রবধূর কাছে সেবার প্রত্যাশা থাকে না মানুষের?
পুত্রবধূর কাছে আর কতটুকু পাওয়া যায়? বলে আরও মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে চলে গিয়েছিল রুদ্র।
কিন্তু দোষই বা দেওয়া যায় কী করে ছেলেকে? বাপের উপর অশ্রদ্ধ হবার মতো চরিত্র কি শক্তিপ্রসাদের? আর এখন বাপের সেই জীবনের পরিণামও দেখছে।
আশ্চর্য! বাপের সেই পরিণাম তো দেখল, দেখেছিল রুদ্রপ্রসাদ? তবু সেই জ্বলার পথটাই বেছে নিল কেন সে? কেন সেই সুরা শিকার আর অপরিমিত বিলাসের শ্যাওলাধরা পিছল পথেই উৎসাহ তার?
শুধু একটু তফাত আছে রুদ্রপ্রসাদের, বাপের চরিত্রর সঙ্গে। শক্তিপ্রসাদের মতো নারীদেহে অত অতি আসক্তি নেই তার। তার ধারণায় ওটা যেন খানিকটা খেলোমি। যেন ঘৃণ্য প্রাণীর কাছে দুর্বলতা প্রকাশ।
মেয়ে জাতটাকে সে অবজ্ঞার চোখেই দেখে থাকে।
হয়তো মায়ের সম্পর্কে শ্রদ্ধাহীনতাই এই মূল উৎস।
না, রুদ্রপ্রসাদের মায়ের নামে অন্যায় কোনও দোষ দেবার নেই, অতি সতী সাধ্বী পতিব্রতা মহিলা ছিলেন তিনি, আর সেইটাই ছিল রুদ্রপ্রসাদের বিরক্তি আর অবজ্ঞার কারণ। বহু নারীভোগী স্বামীর দৈবাৎ একদিনের কৃপা লাভে কৃতার্থ, আর সেই কৃপার প্রত্যাশায় আকুল অপেক্ষা, এ দৃশ্য বালক বয়েস থেকেই পীড়া দিত রুদ্রপ্রসাদকে। ঘৃণা এনে দিত মনের মধ্যে।
মেয়েদের সম্পর্কে অবজ্ঞা অবহেলাই হয়তো রুদ্রপ্রসাদকে এদিক থেকে কতকটা বাঁচিয়েছে।
কিন্তু তার পরিবর্তে?
তার পরিবর্তে আছে নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা। সকল মানুষের প্রতিই তাচ্ছিল্যবোধ। এ বংশের লোক অবশ্য সাধারণ মানুষকে মানুষ বলে গণ্যই করে না, তবে সাহেব সুবো, কেষ্ট বিষ্ণু ইত্যাদির প্রতি তাদের সসম্মান ভঙ্গি ছিল। রুদ্রপ্রসাদের তাও নেই। রুদ্রপ্রসাদের ভঙ্গিতে কেবলমাত্র আমিত্বের প্রকাশ। যেন পৃথিবীটারই অধীশ্বর তিনি।
.
মিস্ত্রির কাজ শেষ হয়ে গেছে, ওরা গেছে পুকুরে হাত-পা ধুতে। রুদ্রপ্রসাদ ফিরে দাঁড়িয়ে পিছন দিকে রাখা বৃহৎ আরাম কেদারাটার দিকে তাকালেন। সঙ্গে সঙ্গেই যাদব তার উপর বিছানো ভিজে শীতলপাটিখানা তুলে নিল, এবং যারা ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে ছিল, তারা আস্তে আস্তে এক পা এক পা করে নড়তে থাকল। ঠিক বুঝতে পারছে না তো গতিবিধিটা কোন দিক ঘেঁষে হবে। বুঝতে না পেরে একটু এদিক ওদিক করে ফেললেই তো প্রচণ্ড ধমক খেতে হবে।
সেই ধমকের কথা চিন্তা করলেই তো পেটের পিলে চমকে যায় ওদের।
সসাগরা ধরণীর অধীশ্বরের ভঙ্গিতেই রুদ্রপ্রসাদ এসে সেই চওড়া হাতা আরাম কেদারাটায় এসে বসলেন। দূর থেকে তাকিয়ে দেখলেন নতুন জাফরি পাঁচিলটার দিকে পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে।
ততক্ষণে বেচু পুষ্করিণীতে ডোবানো ডাবের কাঁদি তুলে নিয়ে এসে ডাবকাটা কাটারিখানা বাগিয়ে ধরেছে, নিবারণের হাতে পাথরের গ্লাসের গোছা।
ডাব খাবেন তো বড়জোর গোটা তিনচার, কিন্তু তাই বলে তো গুনে গুনে ডাব আর গ্লাস আনা যায় না। দীন দুঃখীর ঘরের কারবার নাকি?
রুদ্রপ্রসাদ ওদের দিকে তাকিয়ে হাতটা নাড়লেন। অর্থাৎ একটা কিছু লাগবে না। কিন্তু কোনটা লাগবে না? মুখ শুকিয়ে গেল নিবারণের্যাদবের এবং পাশাধরা আরও দুজনের।
পাখা লাগবে না?
ওদের উপস্থিতি লাগবে না?
না কি ডাবই লাগবে না?
কার কী দোষ ঘটল? যে এতক্ষণ এই গরমের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার পর ডাবকে প্রত্যাখ্যান করবেন রাজাবাবু? একজন অস্ফুটে বলতে যাচ্ছিল ছায়া পুকুরে ডোবানো ছিল–বেচু চোখ টিপল।
বেচু বুঝতে পেরেছে কোনটা লাগবে না। কারণ, বেচু সর্বদা রাজাবাবুর মেজাজের নাড়ি ধরে বসে থাকে। বেচুও হাত নেড়ে জানাল গ্লাস লাগবে না।
হতচকিত হল যাদব। গ্লাস লাগবে না।
আর পাঁচজনের মতো ডাবে মুখ দিয়ে খাবেন নাকি রাজাবাবু?
তা তাই খাবেন।
ওঁদের তো আর খেয়ালের মা বাপ নেই। নতুনত্ব করতে চান। অথবা এই গরম তাপের মধ্যে ডাবের জল ঢালাঢলি করতে চান না।
এখন বেলা গড়িয়ে গেছে, কিন্তু আকাশ এখনও জ্বলছে। …বেচু কাছে এসে তটস্থ হয়ে ডাবের মুখ কেটে এগিয়ে দেয়, রুদ্রপ্রসাদ দুহাতে বাগিয়ে ধরে মুখে তোলেন।…
একাসনে পাঁচ পাঁচটি কচি ডাবের জল গলাধঃকরণ করে রুদ্রপ্রসাদ একটা আঃ শব্দ উচ্চারণ করে কেদারার হাতার উপর পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বোজেন। এতক্ষণ যে লোক তাঁর ধুতির কোঁচার আগাটা হাতে করে ধরে ছিল, সে বেচুর মুখের দিকে তাকায়। বেচু ইশারায় তাকে বলে, কোঁচাটা কেদারার হাতার ধারে তুলে দিয়ে চলে যেতে।
সকলকেই ইশারা করে আপাতত চোখের সামনে থেকে সরে যেতে।
আরও একটা সূক্ষ্ম ইশারা হয়, ডাবের কাঁদি সম্পর্কে।… তারাও তো কম পিপাসার্ত নয়, চোখের সামনে ডাবের কাঁদি, খাবে না? কে তার হিসেব রাখতে যাচ্ছে?
বেচুর আরও ইশারায় জানাল, বেচুর জন্যে যেন অন্তত দুটো থাকে। এবং মিস্ত্রি দুটোকেও যেন একটা একটা দেওয়া হয়। বাবুর তো খেয়াল, হয়তো হঠাৎ চোখ খুলে জিজ্ঞেস করে উঠবেন আনোয়ার আর মণি মিঞা ডাব খেয়েছে কিনা।
কিছুক্ষণ পরে চোখ খুললেন রুদ্রপ্রসাদ, বৈশাখের পড়ন্তবেলার শরীর জুড়নো বাতাসের আবির্ভাব টের পাওয়া যাচ্ছে এক একবার।
রুদ্রপ্রসাদ কি হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
তাই চোখ খুলে একটু অবাক হয়ে তাকালেন। এটা কোন পরিস্থিতি? তিনি এভাবে গাছের তলায় শুয়ে। শিকার করতে বেরিয়েছিলেন?
এক পলকের বিভ্রান্তি।
পরক্ষণেই ঘুম ভেঙে ওঠা বাঘের মতোই গর্জে উঠলেন, ব্ৰজেন এসেছিল?
ব্ৰজেন বর্তমান নায়েবের নাম।
নায়েবকে বরাবর নায়েবমশাই বলাটাই চালু ছিল, শক্তিপ্ৰসাদও ব্রজেনের বাপ তেজেন বাড়রিকে নায়েবমশাই বলতেন। যে মশাটা বলার মধ্যে মশা ছারপোকা ভাবই ফুটে উঠত। রুদ্রপ্রসাদ ব্রজেনকে তাও বলেন না। সোজাসুজি ব্ৰজেন।
বেচু আস্তে মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে এখেনে তো আসেন নাই।
ওঃ। তা কোথায় আসবেন? কাছারি বাড়ির দালান দেয়ালগুলোকে খবরটা জানাবেন তিনি?
বেচুর মুখে আসছিল, খবর থাকলে কি আর না আসতেন তিনি?
কিন্তু জিভকে সামলে নিল।
বলল, কাউকে পাটাবো কাঁচারি ঘরে?
হ্যাঁ পাঠাবি। হারামজাদাকে গলায় গামছা দিয়ে ধরে আনতে বলবি।
এখুনি বলচি—
ছুটে যায় বেচু। অদূরে গাছতলায় গা গড়িয়ে বসে থাকা লোকগুলোকে জানিয়ে আসে হুকুমটা।
তারপর আবার এখানে এসে হাত কচলে যা বলে, তার অর্থ হচ্ছে রাজাবাবু কি এখনও এই বাগানের ধারে পড়ে থাকবেন? বাড়ির মধ্যে গিয়ে টানা পাখার নীচে বসতেন। হুকুম হলে পালকিটাকে এদিকে নিয়ে আসা হয়।
রুদ্রপ্রসাদ আর একবার পরিস্থিতিটার দিকে তাকালেন। বাতাস আরও জোর বইছে। বৈশাখ অপরাহের মাদকতাময় এলোমেলো বাতাস। …রুদ্রপ্রসাদ কি কখনও ঠিক এ ধরনের পরিস্থিতির মধ্যে থেকেছেন? এমন মুক্ত আকাশের নীচে ঝলকে ঝলকে গায়ে এসে পড়া মধুর মনোরম বাতাস চারদিকে ঘনসন্নিবদ্ধ সবুজের ছায়া।
কিন্তু এ সবে কি রুদ্রপ্রসাদের হঠাৎ মনের পরিবর্তন ঘটে গেল? রুদ্রপ্রসাদের দৃষ্টিতে কি ক্ষমাসুন্দর কোমলতার ছায়া দেখা দিল?
পাগল!
রুদ্রপ্রসাদ শুধু এই অনাস্বাদিত আরামটুকু উপভোগ করে নিলেন একটু।
তারপর আগুন ঝরা কণ্ঠে বললেন, জানিয়ে দিগে আর তিনটে দিন সময় পাবে ব্ৰজেন, তারপর তার ঘরবাড়ি জ্বলবে। বুঝতে পারলি? জানিয়ে দিবি অপদার্থ বাঁদর ব্রজেনের ঘর জ্বালাতে লোকের অভাব হবে না।
উঠে দাঁড়ালেন।
দাঁড়াবার আগেই অবশ্য বেচু পায়ের জুতো ঠিক করে দিয়েছিল। দাঁড়িয়ে উঠে কয়েক পা পায়চারি করে এসে দাঁড়ালেন ওই সদ্য নির্মিত ঘেরটার কাছে। জাফরির পাঁচিল না হলে যেটাকে একটা চৌবাচ্চা বলে মনে হতে পারত।
কিন্তু সত্যি কী বানানো হল এটা?
মণি মিঞা তার খুড়ো আনোয়ারকে বলেছে, ওভেনে খোকা রাজাবাবুর কবর বানাবে রাজাবাবু।
আনোয়ার মাথা নেড়েছে, লাশ জ্বলে হাওয়ায় তার ছাই উড়ে মিশে গ্যালো, কবরটা হবে কী দে?
নামের চেহ্নর কবর হয় না? হেঁদুরা তাই করে?
খোদা জানে! হবেও বা।
কিন্তু ওরা পুকুর ধারে ডাব খেতে খেতে বলছিল, এ আর কিছু না, ভুজুঙ্গ গয়লার ছেলেটাকে ধরে এনে জ্যান্ত গোর দেবে ওখেনটায়। শুনছিস তো ফেরারি ছোঁড়াটার জন্যি হুলিয়া বেইরেচে। নায়েবমশায় তো চোকে সর্ষি ফুল দেকতে নেগেচে। ওনার উপরই তো হুকুম আচে ছোঁড়াকে খুঁজে বার করার।
বলছিস?
বলচিই তো। খোকা রাজাবাবুর মিত্যুস্থানে সেই হতচ্ছাড়া ছোঁড়াটারে জীয়ন্ত গোর দিলে, তবে যদি রাজাবাবুর ক্রোধ মেটে।
কিন্তু ছোঁড়াটার আর দোষ কী বল? …কুকুরটা যদি তেড়ে এসে ঝাঁইপে পড়ে, ও কী করবে?
হুঁ! খুব যে বুদ্ধির কতা বলতেচিস! বলি সে কতা তো তুই বুজবি আমি বুজবো, রাজাবাবু বুজবে? রাজরাজড়ারা কখনও নেয্য কতা বোজে? তা ছাড়া, ঘটনাটা ভেবে দ্যাক? একমাত্তর ছেলে, চাঁদের মতন ছেলে, এক পলোকে কপ্পরের মতন উবি গ্যালো! কি না কুকুরের কামড়ে। নগর রাজার সব সুদুষে জ্বাইলে দ্যায়নি এই ঢের। কুকুরটাকে য্যাখন গাচের সঙ্গে বেঁদে রেকে ফটাফট গুলি মারতে লাগল, তাখন ওনার মুখ চোকের চ্যায়ারা দেখেছিলি? চোক দে য্যান আগুন ঝরতেছেনো।
কুকুরটারে ধরে আনতে পারার দরুন বিন্না সদ্দার নাকি অনেক বকশিশ পেয়েছে?
তা সে আর আশ্চয্যি কী? ভুজুঙ্গর বেটাটাকে খুঁজি আনার জন্য তো পাঁচশো টাকা বকশিশ কবলেচে।
তাই তো শুনচি।
ভয় হচ্চে ভুজুঙ্গর গেয়াতি খুড়ো ওই অঙ্গনটাকে। চশমখোর বুড়ো ট্যাকার লালসে না ভাইপোর ছেলেটারে খুঁজে পেতে নে এসে ধইরে দ্যায়।
তা যা বলছিস! সেটা ওই পিচেশ বুড়ো পারে। ভুজুর সাতে তো আদায় কাঁচকলায়।
বাপকা বেটা হত ছেলেটা–নিবারণ বলে, খোকা রাজাবাবুর কতা বলতেচি–এই অ্যাতো টুকুন বয়েস থেকে কী তেজ, কী দাপট! চাবুক হাতে নিয়ে ভেন্ন বেড়াতে বেরুতোনি।
ওই তো! ওই চাবুকই কাল হল।
বশে বাতি দিতে রইলনি কেউ। শিবরাত্তিরের সলতেটুকুন গেল।
কী যে বলিস! রাজাবাবুর কি বয়েস পেইরে গ্যাচে? কী চ্যায়ারা। মন করলি এখনও দশ বে করতি পারে, বিশটা ব্যাটা হতি পারে।
তবে খোকা রাজাবাবুরে কি ভুলতি পারবে? আমরা চাকর নফর, এত অত্যেচার সয়েছি, তবু মনে করলিই বুকের মদ্যি হাঁকোড় পাঁকোড় করি উঠতিচে।
নগরে বাজারে বিগত পাঁচদিন যাবৎ আর কোনও কথা নেই। আর কোনও আলোচনা নেই। আতঙ্কের ঘরে বাস এখন প্রতিটি মানুষের। কে জানে, কখন কার মাথার উপর বাজ ভেঙে পড়ে। কখন কার ভুজুঙ্গ গয়লার মতো অবস্থা ঘটে। কোন দোষে যে কী হয় কে বলতে পারে।
তা ভুজঙ্গর অবস্থা ভয়াবহ বইকী!
কাছারি বাড়ির পাইক বটাইয়ের হাতে রোজ বিশ ঘা করে কোঁড়ার বরাদ্দ তার। পাঁচ দিন যাবৎ চলছে এই ব্যবস্থা। পিছমোড়া অবস্থায় একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রেখে চাবুক আস্ফালন করতে করতে বটাই বলে, বলবিনে তো–সেই হারামজাদা নচ্ছার ছোঁড়ারে কোতায় লুকিয়ে রেকেচিস।
প্রথম দু দিন ভুজঙ্গ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলেছিল, আমি জানিনে ভাই, আমি তারে তদবদি চোকেই দেকি নাই। ভয়ে ডরে এক বস্তে কোতায় যে ছুট মেরেচে ভগমান জানে।…
বলেছে, আমারে ছেড়ে দাও ভাই, আমি তারে খুঁজেপেতে দেকি। ধরে এনে পায়ে ফেলে দেব। রাজাবাবুর যা বিচার হয়, মাতা পেতে নেব।
বটাই হিংস্র হাসি হেসে বলেছে, বিচের যা হবে, তা তুইও জানচিস আমিও জানচি। আদখানা শরীর মাটিতে পুঁতে রেখে ডালকুত্তা দে খাওয়াবে।
ভুজঙ্গ বটাইয়ের সাবেককালের শত্রু নয়, এমনিতে অসম্ভাবও কিছু ছিল না, থাকার প্রশ্নই বা কোথায়? নিত্য সকালে কাছারি বাড়িতে দুধের জোগান দিতে আসত ভুজঙ্গ, কাছারি বাড়ির নায়েব গোমস্তা আমলা কর্মচারীদের চা পানির বাবদ! এই তো সম্পর্ক! পাইক বটাইয়ের সঙ্গে কোনওদিন চোখখাচোখি হয়েছে, কোনওদিন হয়নি, কোনওদিন বা একটা কথা হয়েছে, এই পর্যন্ত। কিন্তু আজ জমিদারের আদেশের বলে বটাইয়ের হাতে চাবুক ওঠায়, বটাইয়ের ভিতরকার হিংস্র পশুটা দাঁত খিঁচিয়ে জেগে উঠেছে। যেমন হয়। ক্ষমতার আসনে বসতে পারলেই তো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ভিতরের পশুবৃত্তিগুলো। সভ্যতা বিদায় নেয়, বিদায় নেয় মানবিকতাবোধ, লজ্জা চক্ষুলজ্জা শালীনতা। আর চাবুকটাই তো ক্ষমতার প্রতীক।
তাই চিরকালের প্রতিবেশী বটাই ভুজঙ্গর সামনে চাবুক আস্ফালন করে বলে, বলবিনে তো কোতায় আছে ছেলে?
দিন তিনেকের পর থেকে আর হাউমাউ করেনি ভুজঙ্গ, দাঁতে দাঁত চেপে কাঠের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আর বটাই দাঁত খিঁচিয়ে বলে, বললি না তো? তবে এই নে এক ঘা! এক, এক…দুই দুই দুই তিন। অ্যাকনো ভেবে দ্যা ভেমো গয়লা। ভেবে দ্যা অ্যাকবার য্যাখোন বাঘে ছুঁয়েচে, ধরে নে– তোর বেটার মরণ হয়েই গ্যাচে। মিচে কেন নিজের জেবনটা দিবি। …তিন..চার…চার… অ্যাকননা চিন্তা কর ভুজুঙ্গ! ঘরে তোর আরও পাঁচটা কাচ্চাবাচ্চা, সোমত্ত পরিবার, গার্জিন বলতে কেউ নাই, তুই মলে তামাম সংসারটাই ভেসে যাবে। …চার চার… পাঁচ পাঁচ… ছয়… সাত, বুদ্ধি দোষে সব্বষো খোয়াচ্চিস ভুজুঙ্গ, বলি, স্বয়োং রাজাবাবু পুত্রশোকে জ্বলবে, আর তুই বেটা কিরমি কীট, তুই কিনা ফিচলেমি করে সে শোক এড়িয়ে জিতে যাবি? ওনার সেই চাঁদপারা ছেলের কাছে তোর ওই কেলেকিষ্টি পুঁয়ে পাওয়া ছেলেটা? …দশ…দশ…এগারো…বারো…তোদের হল গে শ্যালকুকুরের ঝাড়, অ্যাকটা যাবে বিশটা হবে। অ্যাকটার জন্যি সবংশে নিধন হবি…বলে দে কোতায় লুকিয়ে রেকেচিস?…তবু মুকে তালাচাবি নাগিয়ে রেখেচিস? তবে যমের দোরে যা। ..সতেরো..আঠারো…উনিশ বিশ!…আর এই নে একটা ফাউ।…
চাবুকটা ফেলে হাঁপাতে থাকে বটাই! ভুজঙ্গর ভয়াবহ নীরব চেহারাটার দিকে তাকাতে পারে না। …প্রথম যে দুদিন লোকটা কাঁদাকাটা করেছিল, তার মধ্যে যেন একটা রস পাওয়া যাচ্ছিল, মারের সুখটা পাওয়া যাচ্ছিল ষোলো আনা। এটা কী? এতে বটাইয়ের মনের মধ্যে যেন একটা পরাজিত পরাজিত ভাব জন্মাচ্ছে।
প্রথম দুতিন দিন লোকটা খেতেও চায়নি, কিন্তু না খেয়ে মরে শাস্তি এড়িয়ে পালিয়ে গেলে তো চলবে না, তাই তাকে জোর করে অন্তত একবারও খাওয়ানো হচ্ছিল।…কিন্তু এখন আর জোর করতে হচ্ছে না, নিঃশব্দে দুবেলা খেয়ে নিচ্ছে।
মতলবটা কী ওর?
নায়েব ব্ৰজেন বাড়রি বলে, বলতে পারিস বটাই হতভাগাটার মতলোবখানা কী? ছেলেটারে হাপিস করে রেকে দিয়ে নিশ্চিন্ত মনে কাঁচারির অন্ন ধ্বংসাবে?
বটাই দুহাত উলটে বলে, তাই বা কদিন ধসাবে নায়েবমশাই? চাবুকের ঘায়ে চামড়া ফেটে ফেটে তো ঘা দ্যাখা দেছে। ওই ঘা বিষিয়ে গেলে পচ ধরলেই তো ফর্সা!
চুলোয় যাক ভুজঙ্গ। এখোন তোদের নায়েবমশার উপর কী হুকুমটা হয়েছে শুনেছিস তো? তিনদিনের মধ্যে সেই হাড়বজ্জাত বদমাইশ ছোঁড়াটাকে খুঁজে বার করতে না পারলে নায়েবের ঘরবাড়ি জ্বলবে।
বটাই দেখছে হাতি এখন হাবড়ে পড়েছে। বটাইয়ের মনের মধ্যে পুলকের শিহরন। সে শিহরন গোপন করে বটাই অনায়াসে বলে, রাজাবাবুর কোপে পড়লে ঘরবাড়ি জ্বলবে এ আর বাহুল্য কি নায়েবমশায়? ওনারা হচ্ছে গে শনি ঠাকুরের ঠাকুন্দা। তা ঘর জ্বালানোর দিষ্টান্ত তো আর আপনার অজানা নয়? আপনার তো তবু অ্যাকটা গেলে আরও দুঅ্যাকটা থাকবে। লোকেদের তো সব্বস্ব যায়।
কী? কী বললি?
রাগে ব্ৰজেন বাড়রির হাত পা কেঁপে ওঠে, একটা গেলে আর দুএকটা থাকবে মানে?
মানে কি আর আপনি জানচো না?
বটাই চোরা হাসি হেসে বলে, তলে তলে দালানকোটা তো কম করেন নাই? একো একো ছেলের নামে একো একো বাড়ি।
কে! কে বলেছে এ কথা? অ্যাঁ! আসপদ্দা যে বড্ড বেড়েচে দেকছি। এই বলে রাখছি বটাই, ফের যদি ছোট মুখে বড় কথা কইবি তো–
থেমে যায় ব্ৰজেন।
বলতে যাচ্ছিল জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেব সামলে নিল।
দিনকাল ক্রমশই খারাপ হয়ে আসছে।
আসল যা পৃষ্ঠবল, সাহেব সুবো, ম্যাজিস্ট্রেট, এস ডি ও, বড় দারোগা, ছোট দারোগা সবাই তো বিদায় নিল। লালমুখো গোরাদের জায়গায় একে একে আসছে ভেতো বাঙালি! তবে আর ভরসা কী? এই দুর্দিন কাটিয়ে আবার কি সুদিনের মুখ দেখতে পাবে ব্ৰজেনরা? বলে কিনা কোথাও নাকি রাজরাজড়া বলে আর কিছু থাকবে না। থাকবে না এই রাজাবাবুরাও। তা হলে দেওয়ানজি ম্যানেজারজি, নায়েব, গোমস্তা সবাই খতম। আর কোনও মহিমা থাকবে না।
সেই ভয়ংকর দুর্দিনের কথা ভেবে রাগে মাথা জ্বালা করে ব্রজেনের স্বদেশিওলাদের উপর। তারা যদি এই কাণ্ডটি না করে বেড়াত এইটি তো ঘটত না। আরে বাবা, যারা রাজার জাত, যারা রাজত্ব করলে মানায়, তারা রাজত্ব করবে না, করবি তোরা? কদিন ম্যাও সামলাবি? বাপ বাপ বলে ছেড়ে দিতে পথ পাবিনে।
সেই অদুর ভবিষ্যতের কল্পনায় মনের মধ্যে উজ্জ্বল আশার ছবি। কিন্তু নিতান্ত বর্তমানকেও তো অস্বীকার করা যায় না। অতএব ব্রজেনকেই এখন মুখ সামলাতে হয়।
ওঃ! একবার যদি ভুজঙ্গর বেটা সেই গোবিন্দটাকে পেত ব্ৰজেন! রাজাবাবুর জন্যে তুলে রাখতে পারত কিনা সন্দেহ। নিজেই জলবিছুটি লাগিয়ে খতম করে দিত। গয়লার ঘরের ছেলে হয়ে কুকুর পোষার শখ কেন রে তোর? কেন? কেন রে লক্ষ্মীছাড়া? তা পুষবি তো পোষ, একটা মানুষের মতন কুকুর পোষ, তা না একখানা খেকি কুকুর! তাকে সঙ্গে নিয়ে বাহার দিয়ে বেড়াতে বেরোনো হয়েছে! ওঃ! কবে চিরতরে তোর বেড়ানো ঘুচবে! কবে তুই খোকারাজাবাবুর জুতোর ধুলো সাফ করতে সেই সেখেনে যাবি।
সন্ধ্যা আসন্ন দেখে পালকি চাপলেন রুদ্রপ্রসাদ। বাড়ি থেকে অবশ্য খুব বেশি দূর নয় এই আমবাগানের ধারটা। তবু হাঁটার কথা তো ওঠে না। আমবাগানের ছায়া নাকি শরীর স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। তাই সেকালের পূর্বপুরুষরা বসত বাড়ির কাছাকাছি আমবাগান রাখতেন। বড়মানুষের বড় বাগান, ছোটমানুষের ছোট বাগান। …লাহিড়ীবাবুদের এই বাগানে যাবতীয় সেরা আমের ফসল। …দীপ্তিপ্রসাদ আম খেতে ভালবাসতো! আমের সময় সব সেরা আমের বাছাই আম ঝোড়া ভর্তি করে তার সামনে রাখা হত, সে দালানে রুপোর জলচৌকির উপর বাগিয়ে বসে বলত ওইটা কাট। ওইটা কাট।
প্রকাণ্ড রুপোর বগি থালায় কাটা আমের স্তূপ জমা হত, দীপ্তিপ্রসাদ যতটা ইচ্ছে খেত বাকিটা ছুঁড়ে ছুঁড়ে উঠোন তাক করে ফেলে দিত।
সরমা দুঃখের গলায় বলতেন, আহা হা ফেলে দিচ্ছিস কেন খোবন সোনা? তুই না খাস, আর কেউ খাবে।
খাবে। আবদার পেয়েছে।
বলে হি হি করে হেসে আরও ছুড়ত।
সরমা আহত গলায় বলতেন, আচ্ছা–উঠোনটাও তো নোংরা হচ্ছে।
চকমিলানো বাড়ি, যে দিকের দালানেই বসুক, উঠোনটাকে পাবে। ইচ্ছে করে যতটা সম্ভব ছুঁড়ে সারা উঠোনটাই নোংরা করার চেষ্টা করত।
দীপ্তিপ্রসাদ সতেজে বলত, হোক না নোংরা! এত এত লোজন আছে কী করতে? খালি গাদা গাদা খেতে আর মাইনে নিতে?…
বলেই হয়তো বা তড়াক করে উঠে পড়ে দশ ধাপ সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে সেই ফেলে দেওয়া আমগুলোকে পা দিয়ে চটকে চটকে যতখানিটা পারে নোংরা করে তুলত। আর তারপর তার মিহি রিনরিনে গলায় ঠিক বাপের মতো ভঙ্গিতে বলে উঠত, এই কে আছিস! পা ধোবার জল দে।
শুধু কি ওই একটা তুচ্ছ ব্যাপার?
দেবদূতের মতো আকৃতি সেই বালক, যাকে শিশু বললেও চলে, তার মধ্যে মাঝে মাঝেই ফুটে উঠতে দেখা যেত কী নির্মম নিষ্ঠুরতা। কী অকারণ নৃশংসতা।
প্রাসাদের বিরাট চৌহদ্দির মধ্যেই তার খেলা, তাই সে খেলার অনেক সংবাদই সরমার গোচরে এসে যেত বইকী! সরমা দেখতেন, তাঁর ছেলের একটি প্রিয় খেলা হচ্ছে–একটা ছাগলকে খুঁটিতে বেঁধে, তার গায়ে আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়া। ছাগলটা যত দাপাদাপি করত যত আর্তনাদ করত, ততই উল্লাস দীপ্তিপ্রসাদের। হাততালি দিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ত।
তার এ খেলার খিদমদগার হচ্ছে নকুড় কয়ালের ছেলে ন্যাড়া। নকুড়ের কাজ মায়ের মন্দিরে পশু বলি দেওয়া। নকুড়ের ঘরের দেয়ালে চকচকে যে খাঁড়াখানা টাঙানো আছে, আজন্ম সেটাই দেখতে দেখতেই হয়তো ন্যাড়ার মধ্যেও আছে বীভৎস নৃশংসতার প্রতি একটা আকর্ষণ।
কোন সূত্রে যে ন্যাড়া রাজপুত্তুরের খেলার সঙ্গী হল, এটাই রহস্য। এ ধরনের খিদমদগার আবিষ্কারের একটি সহজাত ক্ষমতা ছিল দীপ্তিপ্রসাদের। ন্যাড়াই শিখিয়েছিল তামাক খাবার কলকে পুড়িয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া যায়। ছাগলছানাকে তো বটে, ইচ্ছে হলে মানুষকেও।
হাঁসের পায়ে দড়ি বেঁধে তার মাথা নিচু করে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা, চড়াই পাখি ধরে ধরে তাদের একটা করে পা কেটে দেওয়া, এসব খেলায় ন্যাড়াই দীপ্তিপ্রসাদের গুরু এবং অন্তরঙ্গ বন্ধু।
আরও একটি নিজস্ব খেলা ছিল দীপ্তিপ্রসাদের, কাছারি বাড়ি কাছারি বাড়ি খেলা।
প্রতিদিন সকালে বুড়ো সহিস কাসেম আলি খোকারাজাবাবুকে একটা টাটু ঘোড়ায় চাপিয়ে, ঘোড়ায় চড়ার তালিম দিতে নিয়ে বেরোত। দশ বছর বয়েস হলেই রাজকুমারদের অনেক কিছুতেই তালিম শুরু।
কাসিম খোকাবাবুকে জায়গাজমি চেনাত, নগরবাজারের দ্রষ্টব্য দেখাত, আর খোকারাজাবাবুই যে ভবিষ্যতে এই সমস্ত মাঠঘাট বাড়ি বাগান দিঘি মন্দির পাঠশালা নাটশালা সব কিছুর মালিক হবে, এই পরম সত্যের বীজটি তার চিত্তে রোপণ করত।
এ সত্যটা যে ওদের চন্দ্র সূর্যের মতোই নিশ্চিত সত্য ছিল। চোদ্দ পুরুষের বিষয়সম্পত্তি শত শত পুরুষে বর্তাবে, এ ছাড়া আর কী ভাবা যায়? আর কী ভাবতে পারে কাসেম আলির মতো মানুষরা?
আর কাছারি বাড়িটা?
জিজ্ঞেস করে উঠেছিল একদিন দীপ্তিপ্রসাদ।
কাসেম আলি মেহেদি রঙে রাঙানো দাড়িতে হাত বুলিয়ে একগাল হেসে বলেছিল, সে আর বলতে? ওডাই তো আসল! ওভেনে থেকেই তো রাজ্যিডার শাসন কাজ।
কাছারি বাড়িটার প্রতি দীপ্তির উৎসাহ প্রবল। প্রায় রোজই ফেরার সময় বলে উঠত, কাছারি বাড়ি দেখব।
এই দেখা থেকেই খেলা।
ছোট ছোট মেয়েরা তাদের উপরওলাদের দেখাদেখি হাঁড়িকুড়ি নিয়ে খেলে, দীপ্তিপ্রসাদও যে কাছারি বাড়ির খেলা খেলবে তার আশ্চর্য কি।
অতএব খোকারাজাবাবু বাপের স্টাইলে তাকিয়ায় কনুই দিয়ে বসে হাঁক দেয়, হারামজাদারা গেল কোথায়? বেচা! নাকে খত দিতে দিতে আয়।
তবে কাছারি বাড়ি খেলার উপকরণ জোগাড়ে একটু অসুবিধে। কারণ, উপকরণটা হচ্ছে মানুষ। অন্তত দুদুটো মানুষ তো দরকার। একটাকে খুঁটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রোদে দাঁড় করিয়ে রেখে আর একজন তার উপর চাবুক চালাবে। অবশ্য চাবুকের অভাব নেই, অনেকগুলো চাবুক আছে তার।
দীপ্তিপ্রসাদের ভূমিকা তখন নায়েবমশাইয়ের। চাবুকের ঘা গুনতো সে, এক। দুই ব্যাটা বজ্জাত। ফের কখনও মুখে মুখে জবাব দিবি?
সবটাই খেলা, শুধু চাবুকটা সত্য।
কাজেই এ খেলায় সহযোগিতা করবার লোক দুষ্প্রাপ্য হত। ভুজঙ্গর ছেলে গোবিন্দকে ডাকলে, সে মলিন মুখে বলত, ঘরে যে বেস্তর কাজ রাজাদাদাবাবু। খড় কুচোতে হবে, বাচুর বাঁদতে হবে—
বাড়ির দাসীদের যে সব ছেলেপুলেগুলো রাজবাড়ির ভাত খেয়ে মানুষ হচ্ছে, তারা মায়ের তাড়নায় আসতে বাধ্য হত বটে, একদিন বই দুদিন খেলতে চাইত না। আর দীপ্তিপ্রসাদের দুর্দান্ত প্রকৃতিতে তো বাধা পেলে আরও বেড়ে ওঠা–তাই বাপের কাছে নালিশ জানাতে রাজাবাব, ননীর ছেলে মানদার ছেলে বসুমতীর বুনপো, হরিদাসীর নাতি কেউ আমার সঙ্গে খেলতে চায় না। এত ডাকি
লোকজনের দেখাদেখি রাজাবাবুই বলত, কদাচ বাবা নয়।
সরমা চেষ্টা করেছিলেন, ডাকটার পরিবর্তন করাতে, বলেছিলেন রাজ্যিসুষ্ঠু সকলের কাছ থেকেই তো ও ডাক শোনা যাচ্ছে রাজাবাবু। রাজাবাবু! ছেলের মুখে বাবা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে না?
রুদ্রপ্রসাদ কথাটা নস্যাৎ করে দিয়েছিলেন।
হেসে বলেছিলেন, বাবা ডাকও, ডাকিয়ে ছাড়ি সবাইকে।
ছেলের মুখে নালিশ শুনে ছিটকে উঠেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ, তোমার সঙ্গে খেলে না? কারা?
বললাম তো! মানদা হরিদাসী ননীটনির ছেলেরা।
রুদ্রপ্রসাদ বিস্মিত! ওই দাসীদের ছেলেরা? তা তুমি ওদের সঙ্গে খেলতে যাবে কেন?
বায়াতবে আমিকাদের সঙ্গে খেলব?
রুদ্রপ্রসাদ একটু থমকেছিলেন।
তাই তো! সমবয়েসি কোথায় ওর।
রুদ্রপ্রসাদও একমাত্র সন্তান ছিলেন বাপের, কিন্তু তিন পিসি ছিলেন তাঁর, বিধবা পতিপরিত্যক্তা এবং সস্বামী। …সর্বসাকুল্যে তাঁদের তিনজনের অবদান ছিল দশটি। কাজেই রুদ্রপ্রসাদের ভাগ্যে সঙ্গীহীনতা ছিল না। সেই সঙ্গীরাও ছিল বেশ বশংবদ। তা ছাড়াও, বাড়িতে আশ্রিত-অনাশিতের সংখ্যাও তত ছিল তখন অসংখ্য। সমবয়েসি না হলেও অসমবয়েসি ছেলেমেয়েও ছিল। বাড়ি ভর্তি।
কিন্তু এ যুগে আশ্রিতের সংখ্যা কম। রাজবাড়ির বদান্যতার অভাবে নয়, যুগের মানসিকতায় শুধু আশ্রিত হিসেবে থাকতে বিশেষ রাজি হয় না কেউ, বাদে পতিপুত্রহীনা অসহায়ারা, অথবা রুণ স্থবির জরাগ্রস্ত বৃদ্ধ আত্মীয়রা। যাদের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র আবিষ্কার করতে হলে মাথা ঘামাতে হয়, রুদ্রপ্রসাদ তাদের সকলকে চেনেনও না।
একটু থমকে রুদ্রপ্রসাদ অতঃপর ছেলেকে বলেছিলেন, আচ্ছা তোমায় না হয় এবার স্কুলে ভর্তি করে দেব। খেলার সঙ্গী পাবে।
দশ বছর বয়েস পার করে ফেলেও ঠিকমতো শিক্ষাব্যবস্থা হয়নি দীপ্তিপ্রসাদের। দিনে বার তিনেক মাস্টার আসে বটে, কিন্তু পড়া কতদুর কী হয় রুদ্রপ্রসাদ কি আর তার খবর রাখতে যাবেন?
লাহিড়ীদের প্রতিষ্ঠিত যে বিদ্যালয় আছে তাতে নিজের ছেলেকে ভর্তি করা সম্পর্কে দ্বিধা ছিল। অথচ এ যুগে শুধু বড়লোকের ছেলে হয়ে থাকাটাও যে সমীচীন নয়, তাও বুঝতেন। সেদিন ছেলের নিঃসঙ্গতা অনুভব করে মনঃস্থির করলেন। ভাবলেন, মিটে গেল সমস্যা।
অতঃপর ভাবলেন, যে পাজি ছুঁচো কেঁচো কেমো ছেলেগুলো রাজকুমারের সঙ্গে খেলতে চায় না, তাদের আচ্ছা করে শিক্ষা দিয়ে দেবেন।
বললেন, ডাকাও তো তাদের। দেখি সেই হারামজাদারা কেমন। তুমি খেলতে ডাকো, তবু তারা খেলতে চায় না। শুনে তাজ্জব হয়ে যাচ্ছি আমি। …এই কে আছিস ওখানে?
এতক্ষণ সুরমা চুপ করে ছিলেন, এখন মুখ খুললেন। বললেন, ছেলেগুলোকে ডাকিয়ে আর কী হবে?না হয় চাবকে তাদের ছালচামড়া ছাড়িয়ে নেওয়া হবে, কিংবা জুতিয়ে মুখ ছিঁড়ে দেওয়া হবে, তবু খেলতে রাজি হওয়া শক্ত।
রুদ্রপ্রসাদ ভুরু কুঁচকে বললেন, এর অর্থ…।
অর্থ আর কি। ছেলের ঝোঁক কাছারি বাড়ি, কাছারি বাড়ি খেলা। আর সে খেলার মানে কী তা খোকন নিজেই বলুক। ইস্কুলের বন্ধুরাই কি সে খেলা খেলতে চাইবে?
কিন্তু খোকন কি এতে ভয় পেয়েছিল? পেয়েছিল লজ্জা?
আদৌ না।
বুক টান করে বলেছিল, আহা, রাজাবাবু জানেন না নাকি কাছারি বাড়িতে কী হয়–একজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে পাইক দিয়ে জলবিচুটি লাগাতে হয়, চাবুক মেরে ছাল তুলতে হয়। হয় না রাজাবাবু? তা কেউ প্রজাও হতে চায় না, কেউ পাইকও হতে চায় না।
শুনে রুদ্রপ্রসাদ প্রথমটা হা হা করে হেসে উঠেছিলেন। বিশেষ একটি রাজসই হাসি আছে এঁদের, ইচ্ছা মতো ব্যবহার করেন।
সেই হাসি হেসে বলে উঠলেন, ব্যাটা বাপদাদার নাম রাখবে। বোষ্টমবাড়ির বাতাস লাগিয়ে বসেনি। তা এই খেলাটাই তোমার পছন্দ?
দেবদূতের মতো মুখের মুক্তোর সারি দাঁতে মধুর হাসি হেসে ঘাড় কাত করেছিল দীপ্তিপ্রসাদ।
রুদ্রপ্রসাদ আহ্লাদের গলায় বলেছিলেন, তা ভাল। কিন্তু প্রজা হতে রাজি না হওয়ার মানে না হয় বুঝলাম, কিন্তু পাইক হতে অরাজি কেন? ওতে তো হাতের সুখের মজা।
দীপ্তিপ্রসাদ বলে, সেই তো। আমারই তো ইচ্ছে করে পাইক হতে। কিন্তু পাইকরা তো ছোটলোক। আমি কী করে ছোটলোক হব?
রুদ্রপ্রসাদ আর একবার হেসে ওঠেন, শাবাশ। বংশের মান-মর্যাদা বজায়ের আর ভাবনা নেই আমার!
কটাক্ষপাত করলেন একবার সরমার দিকে।
সরমা যে এ বংশের উপযুক্ত বধূ নয়, সেটা প্রত্যক্ষ পরোক্ষে বলেই থাকেন রুদ্রপ্রসাদ। এবং ছেলেকে তার মায়ের ওই বোষ্টম জনোচিতঅহিংস মনোভাব থেকে মুক্ত রাখবার জন্যে বিশেষ চেষ্টা রাখেন। অনেকটা যেন স্ত্রীর প্রতি প্রতিপক্ষের মনোভাব তাঁর।
প্রথম থেকেই এই মনোভাব রুদ্রপ্রসাদের।
একদা সরমা নামের সেই ছোট্ট মেয়েটা যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে এসে ঢুকেছিল, এবং শ্বশুরের প্রশ্রয়ে গৃহিণীহীন গৃহে গৃহিণী, তখন থেকেই আঠারো বছরের উদ্ধত যুবা রুদ্রপ্রসাদের মধ্যে ওই দেখতে ছোট অথচ ভিতরে মজবুত মেয়েটা সম্পর্কে ওই প্রতিপক্ষ ভাবটাই পোষণ করে এসেছে। নেহাত কিছু গরিব ঘরের মেয়ে নয় সরমা, কিন্তু জমিদার-টমিদারের বংশ তো নয়। ব্যবসায়ী শ্বশুরকে রুদ্রপ্রসাদ মুদিমাকাল বলেই গণ্য করে। তা তাদের ঘরের মেয়েটা যদি পতিগৃহের এই বিলাস বৈভব ঐশ্বর্য আতিশয্য দেখে অভিভূত হত, ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ হত, আর স্বামীর রূপ গুণ তেজ দাপটের মহিমায় বিগলিত হয়ে কত কৃতার্থচিত্ত হয়ে স্বামীর নেকনজরের আশায় পায়ের কাছে পড়ে থাকত, তা হলে হয়তো রুদ্রপ্রসাদের অহমিকা চরিতার্থ হয়ে একটু সন্তোষ আসত।
কিন্তু এ মেয়ে সেদিক দিয়ে গেল না।
রাজবাড়ির গৃহিণীর সিংহাসনটায় অবলীলায় বসল, ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞতার বালাইমাত্ৰ অনুভব করেছে এমন মনে হল না, এবং পতির প্রণয় লাভের আশায় বিন্দুমাত্র চেষ্টার চিহ্ন দেখাল না। যেন রুদ্রপ্রসাদেরই নাগালের বাইরে রয়ে গেল সে। ভাবভঙ্গি দেখে মাঝে মাঝে এমনও মনে হয়েছে, (কৃতার্থ হওয়া তো দুরের কথা) পতিগৃহটাই যেন সরমার যোগ্য নয়।
একে অবজ্ঞা করেই বা সুখ কোথা?
সে অবজ্ঞা তো সরমা গায়েই মাখে না। যেন আপন মহিমার জ্যোতির্মণ্ডলে অবস্থিত সে। অথচ অপছন্দ দেখিয়ে ত্যাগ করার চিন্তাও বাতুলতা। রুদ্রপ্রসাদের মায়ের মৃত্যুর পর থেকে প্রকৃত গৃহিণী বলে তো ছিল না কেউ। বলতে গেলে বারোভূতের সংসারই চলছিল। পিসিরা ছিলেন বটে, তবে তাঁরা আপন আপন স্বার্থরক্ষায় যতটা যত্নবতী ছিলেন, এ সংসার সম্পর্কে ততটা নয়। প্রতিষ্ঠিত দেবমন্দির গৃহ-বিগ্রহ বারো মাসে বাহান্ন পার্বণ, দোল দুর্গোৎসব। প্রতি অমাবস্যায় রক্ষাকালী পূজা, বছর বছর বাণরাজার গড়ে ভোগরাগ পাঠানো, গ্রামের প্রান্তে শ্মশানধারে যমরাজ জননীর আটপৌরে সংস্করণ যমগোদার মার ঢিবিতে শনিবারে শনিবারে সিধে পাঠানো, এ সব নানা বিচিত্র ধর্মকার্য ব্যতীতও, অতিথিশালা, কুটুম্বশালা ইত্যাদির তত্ত্বাবধানে কোনও কিছুতেই ছিল না শৃঙ্খলা সুব্যবস্থা।
অতিথি ফকির কুটুম কাটুম গুরু পুরোহিত সকলের মধ্যে থেকেই সর্বদা উঠত চাপা অসন্তোষের অভিযোগ। অথচ রাজবাড়ির ভাঁড়ারে সর্বদাই টান।
একা সরমা কেমন করে কে জানে সব কিছুতে এনেছে শৃঙ্খলা। পিসিমাকুল বাদে সকলের মধ্যেই আনতে পেরেছে মোটামুটি সন্তোষ, আর ভাঁড়ারকে সর্বদা লক্ষ্মীর ভাঁড়ারের চেহারা দিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। মোটের মাথায় পিসিদের আমলের চেহারাটা যে ফিরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে সরমা, সেটা রুদ্রপ্রসাদ তার বাবার জীবিতাবস্থাতেই দেখেছেন। কাজেই চট করে বিশেষ কিছু করা যায়নি। একমাত্র ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ অবজ্ঞা করা ছাড়া। তাতেও সুখ ছিল না।
সুখের স্বাদ পেলেন, ছেলে একটু বড় হয়ে উঠতে। সরমার সঙ্গে অলক্ষিত যুদ্ধে নামলেন ওই শিশুটিকে হাতিয়ার করে।
ব্যস তবে আর কি! ওটাই তো কাম্য।
কিছুতেই দুঃখ দিতে পারা যায় না, এমন মেয়েমানুষকে নিয়ে পুরুষের যন্ত্রণা বইকী! ব্যঙ্গ বিদ্রূপ গায়ে মাখে না, স্বামীর সোহাগের ধার ধারে না, স্বামীর ভালবাসার অভাবে অশ্রু বিসর্জন করে না, এ কী অন্যায়। …আর ওইটা করে না বলেই কিছুতেই তাকে অবহেলা করে ভুলে থাকা যায় না। তাকে কীভাবে পেড়ে ফেলা যায়, তার চিন্তায় থাকতেন।
কিন্তু পেড়ে ফেলার উপায় কী?
যদিও অন্য নারীতে আসক্তি নেই, তবু বৈঠকখানা বাড়ি থেকে অন্দরে আসতে শুরু করলেন গভীর রাত্রে। শক্তিপ্ৰসাদ তখনও বেঁচে রোগশয্যায় পড়ে।
এই বিলম্বের খবর টের পেলে শক্তিপ্রসাদ অনুযোগ করতে গিয়ে থেমে গেছেন। অনুভব করেছেন, ছেলে আর তাঁকে রেয়াৎ করে কথা বলবেনা। বাপের কীর্তির ইতিহাসের উল্লেখ করবে মুখের উপরই।
তাই পুত্রবধূকে শেখাতে চেষ্টা করেছেন তিনি অভিযোগ অনুযোগের পথ ধরতে।
ধরেনি সুরমা। জেগে থেকেছে, বসে থেকেছে, ব্যস। রুদ্রপ্রসাদ নিস্তরঙ্গ দিঘিতে ঢিল ফেলেছেন, বৈঠকখানা বাড়িতে আমার খাবারটা পাঠানো হল কেন?
সরমার শান্ত কণ্ঠ, রাত হয়ে যাচ্ছিল, খাবার সময় পার হয়ে গেলে আপনার অসুখ করতে পারে, তাই
আবার একটা ঢিল–পূজ্যপাদ শ্বশুরঠাকুরকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো হয়েছে তো তার আগে?
হয়েছে। অসুস্থ মানুষের তো আরও নিয়ম দরকার।
কথার উত্তরও তো দেয়। দিতে ছাড়ে না তো।
স্বামী রাত করে বাড়ি ফিরলে স্ত্রীলোকের দুঃখ অভিমান হয়। তোমার ভগবান কি তোমার মধ্যে সেটুকু মনপ্রাণও দেননি?
সুরমা বিস্মিত দুটি দীর্ঘপক্ষ চোখ তুলে তাকিয়েছে, সে কী? বাড়ি ফেরা কি, আপনি তো বাড়িতেই ছিলেন।
বার বাড়িতে ছিলাম। অন্দরমহলে আসিনি।
সরমার নম্ৰ কণ্ঠ, আপনার কত কাজ, কত দায়িত্ব। এখন তো আপনাকেই সব দেখাশুনো করতে হয়।
এই এখনটা অবশ্য শক্তিপ্রসাদের শক্তিহীনতার অবস্থা।
রুদ্রপ্রসাদ তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছেন, আমি আবার কী দেখাশুনো করতে যাব। এ বংশের কেউ কখনও মুদিমাকালের মতো বিষয়সম্পত্তির হিসেব দেখতে বসেনা। নায়েব গোমস্তা আমলা কর্মচারীরা তবে আছে কী করতে?
সরমা শুধু বলে, ওঃ!
তুমি বুঝি ভাবো তোমার শ্বশুরঠাকুর দেখতেন এই সব?
সেটাই তো ভাবা সম্ভব।
হু। …তা হলে আর ভাবনা ছিল না। আমোদ ফুর্তি ছাড়া আর কিছু জানতেন নাকি উনি?
সরমা স্থির গলায় বলেছে, উনি আপনার গুরুজন! বাবা।
বাবাই হোক আর ঠাকুরদাই হোক, আমি যা বলি হক কথা বলি। ঠাকুরদা লোকটা শুনেছি অন্য রকম ছিল। মানে ন্যাদামারা ধরনের। ধর্মকর্ম করত, পেরজাদের সুখ-দুঃখু দেখতে বসত। তাদের জন্যে দিঘি পুকুর বানিয়ে দিত। তাঁর পুত্ত্বরটি কিন্তু একেবারে অন্য মাল বুঝলে?
আমার বুঝে কী হবে?
আমি বাপ কা বেটা হব সেটাই বোঝাবার জন্যে বলে রাখছি।
এমন ক্ষেত্রে সরমা হয়তো বলে ফেলেছে, কেন? আপনি তো আপনার ঠাকুরদার মতোও হতে পারেন।
হুঃ। কী দায়? হতভাগা ঘোটলোক চাষিভুষো প্রজাগুলোর দুঃখের শেষ আছে নাকি? ও দেখতে গেলে নিজেদের আর বাঁচতে হয় না। ভগবান যাকে সুখভোগ করতে দিয়েছে সে তা করবে। যে হতভাগাদের দুঃখুভোগ করতে দিয়েছে, তারা তা করবে ব্যস। ভগবানের ওপর কলম চালাতে যাব নাকি?
সদ্য তরুণী সরমা স্বামীর ওই বলিষ্ঠ সুন্দর কনকবর্ণ দেহ আর পাথরে কোঁদা মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে থেকেছে।
এই তো! এইটাই তো বিরক্তিকর।
গভীর রাত্রির টগবগে রক্ত যেন ঠাণ্ডা মারিয়ে দেয় ওই মেয়ে। নইলে সুন্দরী তো সেও কম নয়। বিয়ের সময় যে ছিল সদ্য জাগা পাপড়ির মতো, ক্রমশই তো সে শতদল মেলছে। …অন্য সময় তো দেখা যায় আলোর মতো জ্বলছে। অতিরিক্ত কিছু লজ্জাভার নেই সরমার। পুজোমণ্ডপে দেবমন্দিরে, উৎসব অনুষ্ঠানে স্বচ্ছন্দভঙ্গিতে দেখতে পাওয়া যায় তাকে।
কথার মাধ্যমে অবশ্য একজন দাসী থাকে, কিন্তু মুখ লম্বা ঘোমটায় ঢাকা নয়। প্রথম প্রথম পিসি-মাসি জাতীয়েরা পুরনো দাসীদের সঙ্গে একত্র হয়ে, নতুন বউরানির এই লজ্জার ত্রুটি নিয়ে আলোচনা চালাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু জমাতে পারেননি। এত ভদ্র মানুষটাকে নিয়ে বেশি কিছু করা যায় না।
তা সেই স্বল্প অবগুণ্ঠনে আবৃত মুখ তো দেখেছে সদ্য যুবক রুদ্রপ্রসাদ। আকর্ষণ অনুভব না করে পারেনি। কিন্তু শয়নমহলের এই ঝাড়লণ্ঠনে উজ্জ্বল আলোর নীচেয় সাটিনের শয্যায় উপবিষ্ট বধূকে যেন তার নিষ্প্রভ নিস্তেজ লাগে।
হয়তো তখন অন্য ঘাট থেকে ঢিল ছুঁড়েছে রুদ্রপ্রসাদ।
রাত্রে শয়নমহলে স্বামীর জন্যে তো শুনেছি মেয়েমানুষরা খুব সেজেগুজে অপেক্ষা করে, তোমার সেসব দেখি না যে
এ সময় হয়তো একটু মধুর হাসি হেসে মুখ নামিয়েছে সরমা, কেন, না সেজে কি খারাপ দেখাচ্ছে?
খারাপ? না, তা অবশ্য নয়।
যৌবনের রক্ত কাজ করে।
ধরা দিতে হয় সরমাকে।
কিন্তু তখন কি তাতে বিতৃষ্ণা বোধ করেছে সরমা?
তাও তো করেনি। শুধু ভেবেছে, একটু যদি মায়া মমতাওলা হত মানুষটা। একটু হৃদয়বান।
কিন্তু আস্তে আস্তে সেদিন গত হয়েছে।
উত্তরোত্তর মানুষটার হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতা দেখতে দেখতে ওই যদিটা নিয়ে আর প্রত্যাশার পাত্র ধরে থাকেনি সরমা।
অতঃপর রুদ্রপ্রসাদের ওই ছেলেকে হাতিয়ার করে লড়াইয়ে নামা।
ছেলেকে নিষ্ঠুরতার শিক্ষা দেওয়া, হিংস্রতার শিক্ষা দেওয়া, শ্রদ্ধাহীন রুচিহীন উদ্ধত বর্বর করে তোলা, এই সাধনা রুদ্রপ্রসাদের।
প্রতিনিয়ত লক্ষ্যে পড়ে এতেই মর্মান্তিক দুঃখ সরমার, অতএব রুদ্রপ্রসাদের এতেই একান্ত উল্লাস।
নিতান্ত শিশু দীপ্তিপ্রসাদকে উৎসাহ দিয়েছেন রুদ্রপ্রসাদ ভৃত্যকুলকে লাথি মারতে।
মার মার, এক লাথি মার। …লাথি মেরে মুখ ভেঙে দাও ওর। নাক থ্যাবড়া করে দাও।
শিশু দীপ্তি খলখলিয়ে হেসে পিতৃনির্দেশ পালন করেছে। এবং কৃতাৰ্থমন্য ভৃত্যকুল নাক-মুখ-মাথা পেতে দিয়ে বলেছে, আরও মারো বাবু বাহাদুর, আরও মারো।
কোনও কোনও সময় সরমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছে। বলেছে, ছেলেকে এটা কী শিক্ষা দিচ্ছেন আপনি? কী চরিত্র হবে ওর?
ব্যঙ্গহাসি হেসে উঠেছেন রুদ্রপ্রসাদ, ওঃ! মাস্টারমশাইয়ের অমনি টনক নড়ে গেছে? দু বছরের একটা শিশুর চরিত্র নিয়ে মাথা ঘামাতে বসলেন নীতিরত্নমশাই।
শিক্ষার গোড়া তো শিশুকালেই।
সরমা আহত গলায় বলেছে, চন্দনগাছ পুঁতলে চন্দন পাওয়া যায়, বিষগাছ পুঁতলে বিষ।
ওঃ। পণ্ডিতমশাই জ্ঞান দিতে বসলেন। সিংহের শাবককে সিংহই হতে হয়, বুঝলে?
বুঝলাম।
বলে চুপ করে গেছে সরমা।
আর এইটাতেই আরও আক্রোশ জমে উঠেছে রুদ্রপ্রসাদের ভিতরে। কোথায় যেন হেরে যাচ্ছেন তিনি। অপরাধবোধ থেকেই আসে অত্যাচারের স্পৃহা, হীনম্মন্যতা থেকেই আসে প্রতিপক্ষের প্রতি নিষ্ঠুরতা।
দিনে দিনে ছেলের চরিত্রের নীচতা-ক্রুরতা বেপরোয়া হিংস্রতার প্রবণতা দেখে দেখে যত হতাশ হয়েছেন, নিরুপায় ক্ষোভে ছটফট করেছেন, ততই রুদ্রপ্রসাদ ছেলেকে সেই দিকে ঠেলে দিয়েছেন, প্রশ্রয় দিয়ে উৎসাহ দিয়ে।
তাই সেদিন ছেলেকে শাবাশ দিয়ে বললেন, ভাল ভাল।
কিন্তু তোমার খেলুড়িরা না হয় প্রজা সাজতে অরাজি হতে পারে, কিন্তু পাইক সাজতে অরাজি কেন?
দীপ্তিপ্রসাদ মহোৎসাহে বলেছে, সেই তো! আমিও তো তাই বলি। মুখ বেটারা বোঝে না। বলে কি, অক্তমানসোর মানুষের শরীলে চাবুক মারতে পারবুনি।
হি হি, ওরা রক্ত-মাংসকে বলে অক্তমানসসা, হি হি শরীরকে বলে শরীল। ননীর ছেলে খ্যাঁদাটা? সে আবার প্রাণকে বলে পেরাণ, বন্ধুকে বলে বন্দু। বলে কিনা বন্দুর শরীলে চাবুক নাগাবো কী গো? হি হি, বলে, ভেবেই পরাণডা কেমন করতেছে।
সরমা স্বভাবছাড়া তীক্ষ্ণ স্বরে বলেছেন, ঠিকই। মানুষের মতোই কথা বলে।
রুদ্রপ্রসাদ প্রায় ধমকে উঠেছেন, মানুষের সংজ্ঞা সকলের পক্ষে সমান নয় হে রানিবউ। বোষ্টমবাড়ির গন্ধটা আর গা থেকে মুছে ফেলতে পারলে না!
অহরহ এমনি ঘাত-প্রতিঘাত চলেছে।
কিন্তু এ সব তো গত কথা।
দীপ্তিপ্রসাদ নামের সেই ছটফটে টগবগে উজ্জ্বল মূর্তি ছেলেটা তো পৃথিবীর কোথাও নেই আর।
স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা সরমা সেই শিশুর জন্ম মুহূর্তটি থেকে প্রতিটি দিনের ছবি মনে করে ভাবছিলেন, আমার কি আরও চেষ্টা করা উচিত ছিল না? আমি কি কর্তব্যের ত্রুটি করিনি?
আমি যে তার মনের মধ্যে সুকুমার বৃত্তির বিকাশ ঘটাতে পারিনি, সেটা তো আমারই অক্ষমতা।
রুদ্রপ্রসাদ নামের অহমিকা-অন্ধ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য মানুষ পরিণাম চিন্তাহীন একটা মূঢ় খেলায় উন্মত্ত হয়ে সেই ফুলের স্তবকটাকে খুঁটি করে দাবার চাল চালতে বসেছিল, আমি তাকে নিবৃত্ত করতে পারিনি। সেও আমার অক্ষমতা। …আমি আমার স্বামীপুত্র কারও মনেই প্রভাব বিস্তার করতে পারিনি, অথচ
হ্যাঁ, অথচ বলে অনেক কথাই ভেবে ফেলতে পারেন সরমা, হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ে অনেকগুলো মুখ। …সরমার অনুগত ভক্তের সংখ্যা তো কম নয়। তারা সরমাকে দেবীজ্ঞানে পুজো করে। রাজা জ্ঞানে সালিশ মানতে আসে, নালিশ জানাতে আসে। নিজ নিজ জীবনের সুখ দুঃখের কথা নিবেদন করতে আসে,পরামর্শ নিয়ে জীবনের মোড় বদলে ফেলতে চায়। ফেলেছেও কতজন।
ছোট পিসশাশুড়ি নীরদাসুন্দরী মুখ বাঁকিয়ে বলেন, ওই যে বউগিন্নির এজলাস বসেছে। এখন নালিশ হবে, সওয়াল হবে, বিচার হবে, রায় বেরোবে। এত র্যালা। মেয়েছেলে মেয়েছেলের মতন থাক, তা নয়। মদানি। সোয়ামির সঙ্গে তো যোজন দূর। তা প্রাণে একটু হুতোশ দেখিনে!…
মেজ পিসি মানদাসুন্দরী বলে, যোজন দূর আর হবে না কেন? কীসে পুরুষের মনকে আকর্ষণ করা যায় তার জ্ঞেয়ান আছে? না সাজ না সজ্জে! গায়ে একখান গয়না উঠতে দেখবে না কেউ। জানিনে কীসের এত তেজ! তোর মতন রূপসী এ বাড়িতে ঢের এয়েছে। আমরা তো আজকের না! রূপের গরবে মনে করিস সাজ নাগবে না, চেষ্টা নাগবে না। কই পারচিস সোয়ামিকে বাঁদতে? এক মহালে সোয়ামি, এক মহালে তুই। অ্যাকটা ব্যাটা হতেই আড়ো আড়ো ছাড়ো ছাড়ো। দিনমানে যদি দ্যাকা হল তো, তক্ক আর খটাখটি! একটু গায়ে পড়া ভাব নেই।
নীরদা একটা নিশ্বাস ফেলে বলেন, তাই বা বলি কি মেজদিদি। বাইরের মেয়েমানুষ নিয়ে উন্মত্ত হতেও তো দেকিনে রুদ্দোরকে। এ বংশের ধারাই উলটে দেবে রুদ্দোর! আসলে পরিবার বলে ভিতরে ভিতরে সমেহাটি আচে। সবাই কপালে করে। কপালনইলে আর সেই ঘরের মেয়ে এই ঘরে পড়ে? আর আমাদের দ্যাকো? তোকে নয় ভগোমান মেরেচে, আমার? আমার কথা ভাব?
আঠারো বছর ধরে এই ঘরে রয়েছে সরমা, তবু এঁরা ওই অসম বিয়েটার অসঙ্গতির দুঃখ ভুলতে পারেন না। কিন্তু পরিবারের আরও সব আশ্রিত, অনাশ্রিত, দাসদাসী চাকর নফর? গ্রামের গরিব চাষিভুযো, কামার, কুমোর, বাগদি বাউরি দীনদরিদ্ররা? যারা জীবনভর হাড়ভাঙা খেটে দুবেলা পেটভরে খেতে পায় না। যাদের চালে খড় জোটে না, পরনে গামছা জোটে না, দুখানা মেটে হাঁড়ি কলসি ছাড়া সংসারে আর কোনও উপকরণ থাকে না। তারা সরমার এই এ সংসারে আসার ঘটনাকে ভগবানের আশীর্বাদ বলে মনে করে।…।
বলে, আজা আজড়ার ঘরের বেটি হলি কি আর গরিবের দুক্ষু বুজতো?
সেই দুক্ষু বোজাতে এসে হাজির হয় তারা আনিমার দরবারে।
সরমা তাদের জীবনের সমস্যার কথা মন দিয়ে শোনেন। শোনেন অভিযোগ-অনুযোগ, মানসিক দ্বন্দ্বের কথা।
বিগলিত ওরা বলে, এই আপনি মা জনোনী এই অবাগাদেরকে মনিষ্যি বলে জ্ঞেয়ান কর, অবাগাদের সুক দুক্ষুর কতা কান দে শোন। আর কেউ আমাদেরকে মনিষ্যি জ্ঞেয়ান করে? তিজগতের ওঁচা বলে ঘিন্না করে। বাবুদের বাড়ির উটোনে কখনও বোসতে হুকুম খেইচি? পালেপাব্বণে খেইচি বটে চেরডাকাল, মিচে কতা বোলবো না, ঢেলে মেপেই খেইচি? কিন্তুক ওই দূর দূর ছেই ছেই। উই পুকুর পাড়ে কি আগানেবাগানে খেতে বইসেচে, কুকুর শ্যালের মতন ব্যাভার করেছে। আর অ্যখোন আপুনি ভিতর বাড়িতে ঢুকতে দেচ্চো, বোসতে দেচ্চো, গীরিম্মি নাগলে জল গুড় দেচ্চো, যাবার কালে আঁচল পুরে জলপানি দেচ্চো। সাক্ষেৎ ভগবতী ভেন্ন আর কী বোলবো আপনারে।
সরমা বলেন, ওই সব বলবি না বাছা, এটুকু আবার কে না করে রে?
করেনি মা, করেনি। জেবনভোর দেকচি তো?
মানদা নীরদাও কোনও এক এক সময় মন্তব্য করতে ছাড়েন না অপোচয়ে কুবিরের ভাঁড়ারও শুন্যি হয়ে যায় রানিবউমা। ওই আকালকেঁড়ে আলক্ষ্মীর গুষ্টিদের যদি তুমি নিত্যি ভোজ দিতে থাকো, তো পরিণেমটি কী হবে ভেবে দেকেচ?
সরমা অবাক হয়ে বলেছেন, ভোজ?
তা ও হতভাগাদের কাছে ওই চিড়ে, মুড়ি, মুড়কি, ফেনিই ভোজ।
সরমা শান্ত নরম গলায় বলেছেন, ওদের কাছে তা হতে পারে পিসিমা, এ সংসারের কাছে তো নয়? এ বাড়ির এক রাত্তিরের ঝাড়লণ্ঠনের রোশনাইয়ের খরচে, ওদের এক মাসের জলপানি হয়ে যায়।
পিসিমাদের আর কথা জোগায়নি।
গালে হাত দিয়ে বলেছেন, অবাক কতা!কীসের সঙ্গে কীসের তোলোনা! এ বাড়ির রোশনাই নিবিয়ে ওই অকালকুষ্মণ্ডোগুলোকে জলপানি গেলাতে হবে? একো একোটার সঙ্গে পঙ্গপালের মতন একো একোটা দল। শ্যালকুকুরের ঝাড়। দেকলে গা ঘিনঘিন করে। তুমি আবার ওদের ভিতর বাড়িতে প্রেবেশ অদিকার দিয়েচো! বিদেয় হলে গোবর জল ছড়া দিইয়ে মরি।
একদা সরমা নামের ছোট্ট বউটা এহেন সব অযৌক্তিক কথাতেও চুপ করে থাকত। এখন সব সময় তা থাকে না। হয়তো বলে ফেলে, কেন পিসিমা আপনারা তো উঠোনে নামেন না।
নেই বা নাবলুম! বলি ওদের পায়ের ধুলাগুলো তো হাওয়া বাতাসে উড়ে বেড়ায়। চৌদ্দপুরুষে কখনও ওরা এই ভিতর চৌহদ্দিতে ঢুকেচে?
সরমা হেসে বলেছেন, এতে যদি আপনাদের অসুবিধে লাগে তো আপনাদের বাড়ির বউকেই বারবাড়ির দাওয়ায় গিয়ে বসতে হয় পিসিমা। ওদের মুখ তো চাইতে হবে।
দুগগা! দুগগা! আমাদের আবার অসুবিধে। …ও কতা ছাড়ান দ্যাও। তবে এই লক্কীছাড়া লক্কীছাড়িদের মুক কেন চাইতে হবে, এত মানসম্মানী দেওয়া হবে কেন, তাই শুদোচ্চি। পিথিমীর কোন উবগারে লাগবে ওরা যে, তাই ওদের মুক চাইতেই হবে?
সরমা একটা হতাশ নিশ্বাস ফেলে বলেন, পৃথিবীর উপকারে যদি কেউ লাগে তো ওরাই লাগে পিসিমা। ওদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা খাটুনির বদলেই রাজাদের রাজাগিরি।
কী জানি মা। বুজি না কী বলতে চাই তুমি। বই কেতাব পডুয়ে মেয়ে তোমরা, তোমাদের কতা বুজি এমন সাদ্যি নেই। তবে এইটি বুজি, বাবুরা যদি কলা ঠেকাতে, তো কার জমিতে দাঁড়িয়ে মাতার ঘাম পায়ে ফেলতিস তোরা?
সরমা গম্ভীর গলায় বলেন, পৃথিবীর জমিতে দাঁড়িয়ে পিসিমা।
আর কথা বাড়ান না।
কিন্তু নিজের পদ্ধতি ছাড়েনও না।
সেইটাই তো আরও অবাক কথা। একদার রাজকুমারী দুই বোন অবাক হয়ে ভাবেন, মান-অভিমান নেই, লজ্জা নেই, রাগ-অপমান বোধ নেই, এ কেমন মেয়েমানুষ!
কবে যেন কে নীরদাকে একা একটা আস্ত কাঁঠাল খাওয়ার প্রতি কটাক্ষপাত করেছিল, সে বছরে আর কাঁঠালই খাননি নীরদা। পরের বছর বড়দি সারদা ছিল। তাই সাধ্যসাধনা করে খাইয়েছিল। একেই বলে মেয়েমানুষের মান সম্মান, তেজ অহংকার। তা না লোকে একধার থেকে বলে যাচ্ছে, আর তুমি অপরদিক থেকে সেই কাজ করে যাচ্চ! হুঁ! তলে তলে কম ধিক্কার তো দিচ্ছিও না।
আশ্চর্য! সত্যি এতেও মান-অভিমান দেখা যায় না সরমার। সরমা যথারীতি–তার চকমিলানো বাড়ির দালানের সামনের দাওয়ায় তার এজলাস বসায়। মানে বসিয়েছে এই সেদিনও। যেদিনটা ছিল দীপ্তিপ্রসাদের মৃত্যুর আগের দিন। …তখনও আকাশ নির্মল নীল। তখনও বাতাসে জীবনী রস, জলে তৃষ্ণাহারক শক্তি।…
অন্তত এখন তাই মনে হচ্ছে।
মনে হচ্ছে, তখনও সব ছিল। ছিল আনন্দ, ছিল বেঁচে থাকার মানে।
কিন্তু তখন বেঁচে থাকার যেটুকু মানে অনুভব করেছে সরমা, সে তো সপ্তাহের ওই একটা দিন। হাটবার হাটফেরত এসে হাজির হয়েছে বেশিরভাগ লোক। মেয়ে-পুরুষ। গ্রাম ঝেটিয়ে হাটে আসে, আর যেতে-আসতে পথে পড়ে এই বাবুদের বাড়ির পথ। তাই এই দিনেই সুবিধে।
সরমার মনে হত, ওদের কৃতাৰ্থমন্য মুখ, ভক্তিবিগলিত দৃষ্টি, আর জনে জনে উঁচু দাওয়ায় বসে থাকা সরমার পায়ের নীচে উঠোনে সাষ্টাঙ্গ হয়ে ভক্তি দেওয়া, এটার মধ্যেই যেন জীবনের মানে আবদ্ধ ছিল সরমার।
দীপ্তিপ্রসাদ নামের একটুকরো দীপ্তির সন্ধান তো মিলত না সেখানে। অথচ আজ সেইটুকুর অভাবে সব কিছু ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে।…
সেদিন তা হয়নি। …মনে পড়ছে—
ধুলো কাদামাখা পা পুকুরে ধুয়ে নিয়ে এসে বসে, এক ডেলা করে গুড় চিবোচ্ছিল ওরা, ওটা শেষ হলে আবার গিয়ে পুকুর থেকে জল খেয়ে আসবে। শুধু রঘু কামারের বউ বিনোদবালা তখনই পুকুর থেকে শুধু একপেট জল খেয়ে এসেছিল। ওর দাঁতে পোকা, গুড় খেলে ত্রাহি ত্রাহি ডাক হয়।
অতএব তখন আপাতত বিনোদবালার নালিশ পেশ করা চলছে। আর সবাই যে ওর কথা মন দিয়ে শুনছে তা নয়। যে যার নিজের ধান্দায় আছে, কেউ কেউ আবার জানেও বিনোদবালার বক্তব্য কী।