ঋজুদার সঙ্গে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে
ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে গেছিস কখনও?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল আমাদের।
প্রতি সপ্তাহান্তে শনিবার রাতে ঋজুদার বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে আমাদের যে জমায়েত হয়, সেই জমায়েত জমে উঠতেই।
তিতির বলল, যাইনি, তবে জায়গাটা সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানি।
ভটকাই বলল, ‘ভ্রমণ’ পত্রিকাতে পড়েছি আমিও কৌশিক লাহিড়ীর লেখাতে।
তা পড়ে থাকতে পারিস, তবে আমিও জেনেছি অনেক কিছু ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ সম্বন্ধে একটি বই পড়েই, যেটি পড়লে মনে হবে তুমি নিজেই যেন চলে গেছ ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে।
কী বই?
ভটকাই প্রশ্ন করল।
‘একটু উষ্ণতার জন্যে’।
তিতির বলল।
ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ জায়গাটার কথাই যদি বলিস তো সেখানেও আমি বহুবার গেছি। তোদের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হবার আগে, রুদ্র, ঋজুদার বই লিখে লিখে আমাকে বিখ্যাত করে দেবার অনেকই আগে, সেখানে আমারই একটা ছোট্ট কটেজ ছিল। গভীর জঙ্গলের মধ্যে। এক স্কটসম্যানের কাছ থেকে কিনেছিলাম। তোদের ওই বইটাই, মানে, একটু উষ্ণতার জন্যেই ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ জায়গাটার সর্বনাশ করে দিয়েছে। তখন জায়গাটা যত নির্জন, যত সুন্দর, বাইরের জগতের কাছে যত অজানা ছিল, এখন সেটাই হয়ে উঠেছে একটা ট্যুরিস্ট স্পট।
তোমার যে ওখানে বাংলো ছিল, কই, আমাদের তো বলোনি কোনওদিন!
বলার অবকাশ বা প্রয়োজন হয়নি। কিছুদিন আগেও এক বাসন্তী পূর্ণিমাতে গেছিলাম।
বললে যে, বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছ?
তা তো দিয়েছিই। আমার বাড়িতে তো যাইনি। সোমনাথ আর শর্মিলার সঙ্গে গেছিলাম। ওদের বাড়িতেই উঠেছিলাম।
আমার কটেজের নাম দিয়েছিলাম ‘THE TOPPING HOUSE। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের স্টেটস-এর আইডাহোর কেচাম-এ গভীর জঙ্গলের মধ্যে Snake River-এর পাশে তাঁর যে কটেজ ছিল, যেখানে তিনি আত্মহত্যা করেন, সেই বাড়িরই নাম ছিল ‘THE TOPPING HOUSE’।
বাঃ। সেখানেই আমাদের একবার নিয়ে গেলে না!
কী করে নিয়ে যাব। তখন তো তোরা হামাগুড়ি দিচ্ছিস, নয়তো প্রাম-এ চড়ে বিকেলবেলা বেড়াতে যাচ্ছিস। সে কী আজকের কথা! তবে যাই হোক এবারে চল, দেখে আসবি। তিতিরও নিজের চোখে দেখে আসবে তার প্রিয় উপন্যাসের পটভূমি।
তা তো বুঝলাম, কিন্তু সেখানে তোমার এই হঠাৎ-যাওয়ার কারণটা কী? এখনও তো তা বোঝা গেল না কিন্তু।
ভটকাই বলল।
আমরা প্রত্যেকেই ঋজুদার দিকে নীরবে চেয়ে থাকলাম।
আমাদের শব্দহীন সম্মিলিত কেন-র উত্তরেই যেন ঋজুদা বলে উঠল, স্টিভ এডওয়ার্ডস এই নিয়ে গত রাত অবধি পাঁচবার ফোন করল মেলবোর্ন থেকে আমাকে।
স্টিভ এডওয়ার্ডস কে?
ওঃ।
একটু বিরক্তির সঙ্গেই বলল, ঋজুদা।
তারপর বলল, বন্ধুই বলতে পারিস। জঙ্গলের বন্ধু। জেঠুমণির খুব প্রিয়পাত্র ছিল। ওর বাবাকেও চিনতেন জেঠুমণি। নীলগিরি পাহাড়ের এক কফি প্ল্যান্টেশনের মালিক ছিলেন স্টিভ-এর বাবা টমাস এডওয়ার্ড। এক সময়ে অনেক শিকার করেছি মহীশূরের নীলগিরি পাহাড়ে একসঙ্গে। স্টিভ সত্তরের দশকে অস্ট্রেলিয়াতে গিয়ে সেটল করেছে। বিয়েও করেছে সেখানেই। ওর স্ত্রী জুলিকে নিয়ে একবার এসেওছিল এ দেশে। আমার কাছেও ছিল তিনদিন। জুলিদের পরিবার কানাডাতে থিতু ছিল। ওর মা, বাবা, এবং দাদা সব কানাডাতেই ছিলেন। অবিবাহিত দাদা, মা বাবার সঙ্গেই থাকতেন। জুলি, মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এইচ ডি করতে এসে স্টিভ-এর ‘প্রেম’-এ পড়ে। তারপরে বিয়ে। তারও পরে, থোড়-বড়ি-খাড়া খাড়া বড়ি-থোড়।
এবারে তোমাকে কেন ফোন করছে সেটা বলল। তুমি বড় OFF THE POINT কথা বলো আজকাল ঋজুদা। ঋজু বোসও কি বুড়ো হয়ে গেল?
ঋজুদার ওয়ান অ্যান্ড ওনলি লোকাল গার্ডেন মিস্টার ভটকাই বকে দিল ঋজুদাকে।
মনে মনে আমরা যে অখুশি হলাম তা নয়।
ঋজুদা বলল, জুলির অবিবাহিত এবং সমবয়সী মামাতো দাদা টেড গিলিগানকে গুলি করে মারে তারই বন্ধু ম্যাক টেইলর। ওরা নর্থ কানাডাতে ‘মুজ’ শিকারে গেছিল।
‘মুজ’টা কী জিনিস? মাউস-এর জাতভাই নাকি?
ভটকাই বলল।
আমি বললাম, একটু পড়াশুনো কর। পরীক্ষার নোটবই মুখস্থ করা ছাড়াও পড়ার যে অনেক কিছুই আছে তাতো জানিস না।
জিনিসটা কী? সোজা বাংলাতে বলল না, মাস্টারি না করে।
MOOSE হচ্ছে উত্তর আমেরিকা এবং কানাডারও একরকম বড় বড় শিংওয়ালা হরিণ, আমাদের সম্বরের মতো। বরফাবৃত এলাকাতে পাওয়া যায় তাদের। এক সময়ে, যখন শিকার বে-আইনি হয়ে যায়নি, MOOSE বহু কষ্ট সহ্য করেও শিকার করত শিকারিরা।
তিতির বলল, অ্যালগারনন ব্ল্যাকউড-এর লেখা মুজ শিকারের একটা রোমহর্ষক গল্প আছে। ঠিক বলেছিস।
ঋজুদা বলল। দারুণ গল্প। আধিভৌতিক।
খুনের উদ্দেশ্য কী ছিল?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
ওরা দুজনেই নাকি একই মেয়ের জন্যে পাগল ছিল। ডাকসাইটে সুন্দরী। কানাডার এক নম্বর মডেল ছিল সে। অথচ সেই মেয়ে, জেসমিন স্পিক’, তাদের দুজনের কারোকেই ভালবাসত না। বাসত অন্য আরেকটি ছেলেকে। সে ছেলেটি খুব ভাল পিয়ানো বাজাত। জাতে ফরাসি ছিল। এবং থাকতও কানাডার মনট্রিয়ালে। যাকে প্রায় সব দিক দিয়েই প্যারিসই বলা যায়। যেখানে রাতও দিন। প্যারিসের ছোট বোনটি যেন মনট্রিয়াল।
ঋজুদা আমাদের টেনশানে রেখে কিছুক্ষণ পাইপ খেয়ে বলল, ম্যাক টেইলর, জুলির দাদা টেডকে খুন করে ফেরারি হয়ে যায়। কানাডিয়ান পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজেও তাকে ধরতে পারেনি। তাদের দৃঢ় ধারণা ম্যাক টেইলর কানাডা ছেড়ে স্থলপথে বা জলপথে খুন করার পরে-পরেই অন্য কোনও দেশে চলে গেছিল।
সে কী? আটকাতে পারল না তাকে কানাডার মতো দেশের পুলিশও?
না। পারেনি।
তারপর বলল, জুলির এক কানাডিয়ান বান্ধবী ছিল। তার নাম জিন। টরন্টোরই। তারা জুলিদেরই মতো কানাডার টরন্টোতেই থাকত। মাত্র মাসখানেক আগে জিন ব্লুজনার ভারতে এসেছিল ছুটি কাটাতে। কুনুরে স্টিভ-এর বন্ধুর কাছে। সেই বন্ধুর কুমুরে কফি প্ল্যান্টেশন ছিল। যাকে জিন দেখেছিল, সে নাকি হুবহু ম্যাক টেইলর-এর মতো দেখতে।
কোথায় দেখেছিল?
তিতির জিজ্ঞেস করল।
দমদম এয়ারপোর্টে। জুলির বান্ধবী দিল্লি থেকে কলকাতাতে এসেছিল ইনল্যান্ড ফ্লাইট-এ কলকাতায় এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বন্ধুর সঙ্গে তিন দিন কাটিয়ে তারপর বাঙ্গালোর-এর ডাইরেক্ট ফ্লাইট নিয়ে তার যাবার কথা ছিল কুহূরে।
ম্যাক টেইলর-এর মতো দেখতে লোকটি কোথা থেকে এসে কোথায় যাচ্ছিল?
ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস-এর একটি হপিং ফ্লাইট আছে–রাঁচি, পাটনা হয়ে বেনারস যায়, তাতে করে। তাই তার রাঁচি যাবার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তুমি তো সব গুবলেট করে দিলে। আমাদেরই না রাঁচি যেতে হয় মাথার চিকিৎসার জন্যে। ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলো।
ভটকাই বলল, ঋজুদাকে।
লোকটি যে রাঁচিই যাচ্ছিল তার কোনও স্থিরতা ছিল না। ইট ওজ আ ওয়াইল্ড গেসস! পুরোটা শোনই আগে।
বলো।
আমরা সমস্বরে বললাম।
রাঁচি যাবার হয়তো কোনও স্থিরতা ছিল না, এমনকী লোকটি হয়তো ম্যাক টেইলরও নয়। হয়তো পুরোটাই জিন-এর ভুল। যাকে জিন-এর ম্যাক টেইলর বলে মনে হয়েছিল, তাকে একটি কালো ছিপছিপে ভারতীয় এয়ারহোস্টেস নাকি জিন-এর সামনেই বলেছিল, তুমি কি সোজা ‘THE GUNGE-এ যাচ্ছ রাঁচি হয়ে?
তাতে কী প্রমাণিত হয়? এখনও আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না।
এবারে তিতির বলল, ফৌজদারি আদালতের উকিলের জেরার মতো।
প্রমাণিত কিছুই হয় না। তবে তাতে এ কথা জিন-এর মনে হয়েছিল যে, ওই এয়ারহোস্টেস ‘THE GUNGE’-এরই বাসিন্দা। নইলে, সে জানবে কী করে যে, ডরোথি নামক এক মহিলার (ওই টেইলর সম্ভবত যার সঙ্গে থাকে অথবা বিয়ে করেছে) জ্বর হয়েছে এবং ডাক্তারেরা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া বলে সন্দেহ করছেন?
তিতির বলল, তাও না হয় বোঝা গেল কিন্তু ‘THE GUNGE’ মানেই একটু উষ্ণতার জন্যে’র ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ সেটা জানা যাচ্ছে কী করে! রবার্টগঞ্জ, ফ্রেজারগঞ্জ, হ্যাঁমিলটনগঞ্জ, হান্টারগঞ্জ, আরও কত গঞ্জই তো আছে।
তা আছে। তবু রাঁচির কথাটা যখন জিন নিজ কানেই শুনেছে তখন রাঁচির কাছের ‘THE GUNGE’ ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ হতেও-বা পারে। জিন নিজে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জের নামও শোনেনি। জিন-এর কাছ থেকে হোস্টেস আর লোকটির কথোপকথন শুনেই জুলি আমাকে লেখে। আমিই তাকে বলি যে, রাঁচির কাছে যখন এবং সাহেব-সুবো যখন সেখানে থাকে, তখন ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জও হতে পারে। তা ছাড়া সেখানে আমার কটেজ ছিল এক সময়ে, তাই আমি জানি যে, স্থানীয় মানুষেরা ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জকে বোঝাতে ‘THE GUNGE’-ই বলেন। যেমন, পাহাড়ের বাসিন্দারা দার্জিলিংকে বোঝাতে বলেন: ‘ডার্জ।
তুমি নিজে কি কখনও ম্যাককে দেখেছ? তোমাদের সঙ্গেও শিকার করেছে সে কখনও?
মানে, ম্যাক টেইলর?
না। তবে জুলি একটি ফোটো পাঠাচ্ছে আমাকে কুরিয়ার-এ। আজকাল-এর মধ্যেই এসে যাবে। ম্যাক আর তার দাদা টেড-এর ছবিকে দু’টুকরো করে কেটে নেগেটিভ করে নিয়ে ম্যাক-এর ছবি এনলার্জ করে পাঠাচ্ছে।
মোটে এক কপি?
তাই তো পাঠাচ্ছে। জুলি তো আর জানে না যে আমার সৈন্যদল-এর প্রত্যেকের জন্যেও পাঠাতে হবে? ফোটোটা আসুক, এলে না হয় আমরাই কপি, করে নেব। আজকাল তো কালার জেরক্স করা যায়। অসুবিধার কী? তারপর স্বগতোক্তির মতো বলল, জুলি তোদের কথা জানবেই বা কী করে!
আমি বললাম, যদি মনে করো ম্যাকক্লাস্কিতে যাবার পরে ফোটোর সঙ্গে ওই লোকটির, মানে, ম্যাক টেইলর-এর মিল খুঁজে পেলে, তা হলেই বা কী করবে?
শুধু মিল খুঁজে পেলেই হবে না। আরও নানা ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে যদি আমরা নিশ্চিত হই তবেই কানাডিয়ান পুলিশকে, মানে টরন্টোতে ফ্যাক্স বা ফোন করে দিতে হবে। তারপর যা করবার টরন্টোর পুলিশই করবে। জুলি ও স্টিভকেও জানিয়ে দেব। ওরাই বিহার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। অত ভাবনা আমাদের এখন ভেবে কী হবে! আগে যাওয়াই তো যাক।
আমরা সমস্বরে বললাম, তা ঠিক।
ঋজুদা বলল, তোমাদের জানিয়ে রাখলাম। অ্যাডভান্স নোটিস। তবে তোমাদের সেখানে করার কিছুই নেই। তোমরা বেড়াবে, ট্রেকিং করবে, খাবে-দাবে, জায়গাটা ভাল করে ঘুরে দেখবে। আমিই যা করার করব। যদি তোমাদের সাহায্য লাগে, তবে যখন যেমন তখন তেমন জানাব। তবে রুদ্র, তোর পিস্তলটা সঙ্গে নিয়ে নিস।
তিতির বলল, ম্যাককে জিন কি ব্যক্তিগতভাবে জানত? নইলে তাকে দেখে চিনল কী করে!
না, চিনত না। মানে, পরিচিতি ছিল না, তবে চেহারাটা ভালভাবেই চিনত।
কী করে?
ম্যাককে জিন চিনত শুধু ফোটোরই মাধ্যমে। জুলিদের বাড়িতে ওর দাদা ও তার বন্ধুদের ফোটো ও অনেক ভিডিও দেখেছিল। ম্যাকও নিজে কিন্তু জুলিকে কখনও দেখেনি। তাই তাকে দমদম এয়ারপোর্টে হঠাৎ দেখে জুলির সন্দেহ হওয়াতেই জুলি ম্যাক-এর কাছে গিয়ে বলেছিল, এক্সকিউজ মি। মে আই হ্যাভ আ লাইটার? আই হ্যাভ লস্ট মাইন।
লোকটি, যাকে জিন ম্যাক টেইলর বলে ভাবছিল, বলেছিল, সরি, আই ডোন্ট স্মোক। উ্য শু্যডন্ট স্মোক ইদার।
তারপরই জুলির বন্ধু গায়ে পড়ে বলেছিল, আই অ্যাম জিন সুইভার ফ্রম টরন্টো, কানাডা। হোয়্যার আর উ্য ফ্রম?
সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে, ইট ওজ ভেরি নাইস টু হ্যাভ মেট ঊ্য, বলেই হ্যান্ডশেক করে ম্যাক বলেছিল, হোয়াট ব্রিংস উ্য হিয়ার।
আই হ্যাভ কাম অন আ হলিডে টু সি ইন্ডিয়া। হাউ বাউট উ্য?
আই অ্যাম অন আ হলিডে অ্যাজ ওয়েল। আই অ্যাম গোয়িং টু দার্জিলিং।
পরে আমিও ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস এবং জেট এয়ারওয়েজ-এর টাইম-টেবল দেখেছি। দার্জিলিং মানে, বাগডোগরার ফ্লাইটের সময় এবং রাঁচির ফ্লাইটের ফ্লাইট সময় চেক করে, সময়ের অনেকই তফাত ছিল। তবে সেদিন কুয়াশার জন্যে জিন-এর ফ্লাইট দেরি করে আসে কলকাতাতে। যে সময়ে ম্যাক বাগডোগরার ফ্লাইট ধরার কথা বলেছিল, কুয়াশার কারণে হয়তো রাঁচি-বেনারস-পাটনার ফ্লাইটও সেদিন দেরিতে ছেড়েছিল। ম্যাক-এর কথাটা তাই মিথ্যে আবার নাও হতে পারে। হতেও পারে।
তারপর বলল, জুলির বন্ধু জিন প্রায় নিশ্চিত যে ওই লোকটিই ম্যাক টেইলর এবং সে তাকে মিথ্যে কথা বলেছে।
আমি বললাম, যদি ম্যাক টেইলর সত্যিই ভারতেই পালিয়ে এসে থাকে তা হলেও তার সঙ্গে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ-এর কী সম্পর্ক?
সম্পর্ক নেই। তবে পুরোটা শোনই না। তোরা অত অধৈর্য কেন? আমিও কমপক্ষে তাদের সমান বুদ্ধি ধরি। নয় কি? জিন-এর সঙ্গে যখন লোকটি, মানে, যাকে জিন, ম্যাক বলে সন্দেহ করছে, কথা বলছিল, সেই স্টুয়ার্ডেস যুবতী, যার গায়ের রং কালো, যে ছিপছিপে এবং যার পরনে স্টুয়ার্ডেস-এর পোশাক, সে ম্যাককে, থুড়ি, সেই লোকটিকে বলেছিল, আর ঊ্য গোয়িং স্ট্রেইট টু দ্যা গঞ্জ? ফ্লাইং টু রানচি বাই দিস ফ্লাইট?
লোকটি উত্তরে বলেছিল, নোপ! আই অ্যাম গোয়িং টু ডার্জ।
ডার্জ?
অবাক হয়ে বলেছিল সেই স্টুয়ার্ডেস মেয়েটি।
তারপরই বলেছিল, বাট উ্য ওয়্যার সাপোজড টু বি ব্যাক ফ্রম ডেলহি টুডে। আই মাস্ট টেল ট্য। ডরোথি ইজ এক্সপেক্টিং ঊ্য ভেরি মাচ। বিসাইডস, শি ইজ ডাউন উইথ ম্যালেরিয়া। ডক্টর ইজ সাসপেক্টিং ইট টু বি ম্যালিগন্যান্ট। ওন্ট উ্য গেট ব্যাক স্ট্রেইট টু দ্যা গঞ্জ?
এ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাক সেই এয়ার হোস্টেসটিকে হাত ধরে জিন-এর থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছিল।
তাড়াতাড়িতে জিনকে হাত তুলে আবারও বলেছিল, বাঈই। নাইস মিটিং উ্য।
তারপরেই বলেছিল, মে বি, সামড়ে আই উইল বি ইন কানাডা ফর হলিডেইং।
উ্য আর ওয়েলকাম।
জিন বলেছিল।
তারপরেই ঋজুদা উঠে পড়ে বলল, চল এবারে। পরে আবার এ সব কথা হবে। THE WALDORF’-এ টেবল বুক করা আছে। চাইনিজই খাবি বলেছিলি তো তোরা। এখন ওখানে CRAB FESTIVAL হচ্ছে। চল গিয়ে কাঁকড়ার বংশ ধ্বংস করি আমরা।
গদাধরদা বাড়ি যাওয়াতে আমাদের লস তো কিছু নেই। কী বলিস রে রুদ্র?
ভটকাই বলল।
তারপর বলল, এমন বৃষ্টি হচ্ছে রোজ। গদাধরদাই নেই। ভুনি-খিচুড়ি খাওয়াই হচ্ছে না আমাদের। খুব মিস করছি। কী বল?
আমি বললাম, তাই তো। তা আর বলতে!
গদাধরদার ছুটিটা আরও দিন পনেরো বাড়ানো যায় না ঋজুদা?
কেন?
ঋজুদা জিজ্ঞেস করল।
তা হলে একদিন তাজ বেঙ্গল, একদিন ওবেরয় গ্রান্ড, তার পরদিন পার্ক বা হিন্দুস্থান ইন্টার কন্টিনেন্টাল…
তিতির বলল।
ভটকাই গেয়ে উঠল, আহা! যদি জোটে রোজ এমনি বিনি পয়সার ভোজ।
.
ভোরবেলা হাওড়া-হাটিয়া এক্সেপ্রেস করে রাঁচি স্টেশনে নেমে প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরিয়েই কারপার্ক-এ গাড়িটা খুঁজে পেলাম। একটা সাদা টাটা-সুমো। খাকি পোশাক পরা একজন স্মার্ট ড্রাইভার ঋজুদাকে দেখেই স্যালুট করে এগিয়ে এল।
ঋজুদা আমাদের সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, এই হচ্ছে কিষুণ, মোহন বিশ্বাসের পার্সোনাল ড্রাইভার।
মোহন কেইসা হ্যায় কিষুণ?
মজেমে হ্যায়, হুজৌর। আপ ঠিক হ্যায় না?
চলতা হ্যায়।
ভটকাই আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল, চলতি কা নাম গাড্ডি।
ছেলেটা বড় চ্যাংড়া। কোনও ক্লাস নেই। অথচ কী করি। আমিই তো খাল কেটে কুমির এনেছি। তাই, চুপ করেই রইলাম।
কিষুণ আমাদের প্রথমে স্টেশনের লাগোয়া সাউথ-ইস্টার্ন রেলওয়েজের হোটেলে নিয়ে গেল।
ঋজুদা বলল, এই দ্যাখ বিখ্যাত বি এন আর হোটেল।
লেখা আছে এস ই আর, আর তুমি বলছ বি এন আর। কেন?
আগে তো তাই নাম ছিল। বেঙ্গলনাগপুর রেলওয়ে লিমিটেড। ব্রিটিশ আমলে আলাদা কোম্পানি ছিল এই নামে। আজকের এই ঘিঞ্জি রাঁচি শহরই আগে হলিডে-রিসর্ট ছিল। শীতকালে এবং বর্ষাকালে কলকাতা থেকে কত মানুষে শুধু ছুটি কাটানোর জন্যেই এখানে এসে থাকতেন। মেমসাহেবরা পুশ-পুশে করে উঁচু-নিচু পথে বেড়িয়ে বেড়াতেন। বড় বড় টানা-রিকশও ছিল এখানে। নির্জন জায়গা তখন। বুড়ো-বুড়িরা, যুবক-যুবতীরা এই হোটেলের মধ্যের পথেই সকাল-সন্ধ্যা হেঁটে বেড়াতেন। খাওয়া-দাওয়াও তেমন ছিল। পুরীতেও ছিল এদের আরেকটা হোটেল। সেটারও খুব নাম ছিল। এখনও আছে হোটেলটা।
এস ই আর হোটেলের দুটি ঘরে আমরা প্রাতঃকৃত্য সেরে চান করে নিলাম। নিয়ে, ডাইনিং রুমে গিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে মোহন বিশ্বাসের পাঠানো এয়ার কন্ডিশনড টাটা-সুমোতে গিয়ে উঠলাম।
ঋজুদা স্বগতোক্তি করল। আমাদের দেশে সরকার যাহাই স্পর্শ করে তাহারই এমনি নগ্ন আর ভগ্ন দশা হয়। সে রাজ্য-সরকারই হোক, কি কেন্দ্রীয় সরকার। কেউই কাজ করে না, কারণ কাজ না করলেও চাকরি যায় না কারোই, প্রমোশনও পাওয়া যায়। তার ওপরে সোনায়-সোহাগা চুরি!
‘প্রতিভা যাহাকে স্পর্শ করে তাহাই…’
ভটকাই বলল।
আমরা হেসে উঠলাম।
আজকাল ভটকাই সঙ্গে থাকলে কথাবার্তা যা হওয়ার তা ওর আর ঋজুদার মধ্যেই হয়। আমি আর তিতির শুধু শুনিই। আমরা, যাকে বলে ‘গুড লিসনারস, বাধ্য হয়ে তাই হয়ে গেছি। এই জন্যেই করুণাসাগর বিদ্যাসাগর মশাই সারাজীবন পরের উপকার করার পরেও শেষ জীবনে বলেছিলেন, ‘ভুলেও পরের ভাল কোরো না। শেষ জীবনে এই তথাকথিত সমাজ’-এর ওপরে বিরক্ত হয়েই না তিনি সাঁওতালদের এক গ্রামে গিয়েছিলেন! ভটকাইকে দেখেই ‘সমাজ’-এর চেহারা কীরকম হতে পারে তা যেন আমরাও একটু একটু বুঝতে শিখছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা জায়গাতে এসে পড়লাম আমরা। ডানদিকে একটি প্রকাণ্ড আমবাগান। মানে আম্রকুঞ্জ। যাকে বলে, ছায়া-সুনিবিড়।
দেখে, তিতির বলল, কী সুন্দর!
হ্যাঁ। ওই দ্যাখ রাতুর রাজার লাল-রঙা বাড়ি তারই পেছনে।
আমি বললাম, শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জ এখন টেকো হয়ে গেছে, এবার থেকে ‘বসন্তোৎসব’ এখানে করলে মন্দ হয় না।
তিতির হেসে বলল, যা বলেছ রুদ্র।
রাতুর রাজার বাড়ি পেরিয়ে যেতেই আরও ফাঁকা হয়ে গেল পথ। নীল আকাশ লাল মাটি, সবুজ ধানক্ষেত, কালো কালো ল্যাটেরাইট পাথরের স্তূপ, গাঢ় সবুজ শালবন। আফ্রিকাতে যে কালো পাথরের স্তূপ দেখেছিলাম তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটিতে, আমি আর ঋজুদা, সেগুলো সব ব্যাসাল্ট-এর। আফ্রিকাতে পাথরের এইরকম স্তূপকে বলে ‘কোপি’। ইংরেজি বানান ‘KOPJE’। সিংহরা সুর্যাস্তবেলায় তার ওপর উঠে আড়মোড়া ভাঙে। গদ্দাম-গদ্দাম করে ডাক ছাড়ে। সিংহদের কথা যতই ভাবি, ততই দৃঢ়মূল হয় আমার ধারণা যে, সিংহগুলো যাচ্ছেতাই, ভীরু, কাপুরুষ। দল বেঁধে পেছন পেছন দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে একটি প্রাণীর ওপরে হামলে পড়ে তাকে মারে। তারপর কামড়াকামড়ি করে খায়। পুরুষগুলোও পুরুষনয়, স্ত্রী এবং একাধিক স্ত্রীর রোজগারে বসে বসে খায়। বাঘের মতো এমন মযার্দাজ্ঞানসম্পন্ন, একা, দার্শনিক, প্রকৃত-শিকারি প্রাণী পৃথিবীতে বিরল। আমাদের দেশের জঙ্গলের মধ্যে, দিনে কি রাতে, আলোছায়া যেমন রহস্য বোনে, আমাদের বাঘও সেই রহস্যের বাঘবন্দির কোর্টে সন্তর্পণে নিঃশব্দ থাবা ফেলে ফেলে কত দীর্ঘ সময়ের প্রতীক্ষা, তিতিক্ষা, চরম ধৈর্য দেখানোর পরে অনেকই বুদ্ধি খাঁটিয়ে একটি শিকার ধরে। একা বাঁচে, একা ভাবে। সম্পূর্ণ স্বয়ম্ভর প্রাণী। স্বাবলম্বন বাঘের কাছ থেকেই শিখতে হয়।
কতক্ষণ লাগবে?
তিতির বলল।
রাঁচি থেকে ঘণ্টা দেড়েক। সোজা লোহারডাগা-নেতারহাটের পথে বিজুপাড়া অবধি গিয়ে ডানদিকে ঘুরে যাব আমরা। তারপর চামাতে পৌঁছে বাঁদিকে ঘুরব ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জের দিকে।
সোজা রাস্তাটা বিজুপাড়া থেকে ডানদিকে ঘুরে কোথায় গেছে?
খিলাড়ি। এ সি সি-র সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আছে। অনেক লাইমস্টোন কোয়ারি কোম্পানিও আছে। বড় হাট বসে খিলাড়িতে। তবে আমরা তো খিলাড়ি যাব না। চামা নামের একটি ছোট্ট গ্রাম থেকে বাঁয়ে ঘুরে যাব।
ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে ট্রেনে করে আসা যায় না?
যাবে না কেন? গোমো থেকে যে লাইন পালাম্যুর মধ্যে দিয়ে উত্তরপ্রদেশের চৌপান অবধি চলে গেছে, সেই লাইনের ওপরই ছবির মতো ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ স্টেশন। আসলে, এই লাইন দিয়েই বিহার কোলফিল্ডস-এর কয়লা উত্তরভারতে যায়। প্যাসেঞ্জার ট্রেনের বিশেষ কদর ছিল না এখানে। চৌপান এক্সপ্রেস, গোমো থেকে বারকাকানা হয়ে আসে। সেখানেই ট্রেন বদল হয়। ব্রেকফাস্টেরও সময় পাওয়া যায়। তবে ম্যাকক্লাস্কিতে কখন পৌঁছবে ট্রেন, তার কোনওই স্থিরতা নেই। পথে খাবার-দাবারও বারকাকানার পরে বিশেষ কিছু পাওয়া যায় না। এমনকী চা-ও নয়। তবে এখন হয়তো পত্রাতুতে পাওয়া যায়।
কেন? ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জেই তো মিসেস কার্নির চা-সিঙাড়ার স্টল আছে না?
তিতির বলল।
মিসেস কার্নি গত হয়েছেন অনেকদিন। ভারী ভাল মহিলা ছিলেন। সদাহাস্যময়ী। ওঁর তো একটা গেস্ট হাউসও ছিল। এখনকার মিঃ ক্যামেরনের গেস্ট হাউস তো সেই পুরনো গেস্ট হাউসেরই হাতাতে।
তারপরই ঋজুদা হেসে বলল, ওঃ সরি। আমি তো ভুলেই গেছিলাম। এখানে ‘একটু উষ্ণতার জন্যে পড়া ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ–স্পেশালিস্ট আছেন একজন। তবে এ কথা ওই বইয়ে আছে কি না জানি না যে, চামা থেকে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জের পথটি ছিল রাঙা মাটির তখন।
তিতির বলল, আছে।
এখন পিচের হয়ে গেছে সেই পথ। আর এখন দ্রুতগামী ট্রেনও হয়েছে এখানে আসার। শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস। তবে গভীর রাতে থামে। তাও এক মিনিটের জন্যে। তবে শুনতে পাই আজকাল নাকি আগে বলে রাখলে এখানে ট্যাক্সি বা কুলিও পাওয়া যায়। আমার বাংলো যখন ছিল, তখন সত্যিই গণ্ডগ্রাম ছিল জায়গাটা। ছিল বলেই, ভাল লাগত অত।
আমরা কোথায় উঠব?
সোমনাথ অনেক করে বলেছিল ওর বাড়িতে উঠতে। তবে এই সময়ে ওর মা-বাবারও আসার কথা। আমাদের আসা-যাওয়ার, খাওয়া-দাওয়ার তো ঠিক থাকবে না। তাই মিস্টার ক্যামেরনের গেস্ট হাউসেই উঠব। যদিও জায়গাটা স্টেশনের কাছে এবং একেবারে ফাঁকা নয়, তবে আমরা বাড়িতে আর কতটুকুই বা থাকব। তা ছাড়া, হোটেল বলে, খাওয়া-দাওয়ারও কোনও অসুবিধে হবে না। সঙ্গে কিষুণ তো থাকবেই। আমাদের শনিবার রাতে ট্রেনে তুলে দিয়ে ও ফিরে যাবে ডালটনগঞ্জ। নইলে ভাবছি, একটা কাজ করতে পারি। গাড়ি এখানে রেখে দিয়ে, ও ট্রেনে করে ডালটনগঞ্জে চলে যাবে। চারদিন ছুটি কাটিয়ে শনিবার দুপুরের গাড়িতে ফিরে আসবে। ট্রেন ধরতে আমাদের বেরতে বেরতে তো ছ’টা হবে বিকেলে। গাড়ি তো ভটকাই ছাড়া আমরা সকলেই চালাতে পারি।
এবার ভটকাইও শিখে নাও। ড্রাইভিং না জানলে খুবই অসুবিধে। আমি বললাম।
তোরা কেউ যা জানিস না আমি সেটাই শিখছি আগে।
কী সেটা?
রাইডিং।
কোথায়?
আমরা সমস্বরে জিজ্ঞেস করলাম।
উলুবেড়েতে।
উলুবেড়েতে রাইডিং কোথায় শেখায়? সেখানে এখন মাঠই বা কোথায়? এ কি সত্যযুগ না কি?
মামাবাড়ির পাশে গঙ্গার ধারে ফুটবল খেলার মাঠে জুগনু ধোপার গাধাকে ফিট করেছি। অন্ধকার হয়ে গেলেই মাঠ ফাঁকা। তখন আমি গাধার দুকান পাকড়ে বসে রাইডিং-প্র্যাকটিস করি। বড়মামিই দুটি করে টাকা দিয়ে দেন জুগনুকে।
আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম।
আমি বললাম, তাই তোকে কোনও রবিবারেই পাই না আজকাল।
তিতির বলল দেখো, কোনওদিন না গাধার সওয়ার-হওয়া অবস্থাতেই গঙ্গাতে পড়ে যাও। সাবধানে যা করার কোরো।
আমি বললাম, জীবনানন্দ দাশের কবিতার সেই বিখ্যাত পঙক্তি আছে না?
কোন পঙক্তি?
অবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে।
তিতির আর ঋজুদা খুব জোরে হেসে উঠল।
ভটকাই গম্ভীর মুখে বলল, রাইডিং ইজ রাইডিং। ঘোড়া-গাধাতে তফাত কী? আসল হচ্ছে রিম। রিমটা আয়ত্ত করতে পারলেই হয়ে গেল।
ইস, তুই ক’দিন আগে যদি আসতিস এখানে।
ঋজুদা বলল।
কেন?
ভটকাই একটু উদ্বিগ্ন হয়ে বলল।
মিস্টার ক্যামেরনেরই তো ঘোড়ার স্টার্ড-ফার্ম ছিল ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে। কত ঘোড়া ছিল! দিব্যি এখানেই শিখতে পারতিস।
এখন নেই?
না। এখন বন্ধ করে দিয়েছেন। অথবা ঘোড়াগুলো তুই আসবি জেনেই ভাগলবা হয়েছে হয়তো আগেভাগেই।
আমি বললাম, আচ্ছা ঋজুদা, শনিবারেই যে ফিরে যাবে, তা আগে থেকেই ঠিক করলে কী করে? কী করে জানলে যে, শনিবারের মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।
কাজটা তো কঠিন কিছুই নয়। বিপজ্জনকও নয়। হলে, চারদিনেই হবে। নইলে কোনওদিনও হবে না। তাই রিটার্ন-টিকিট কেটেই এসেছি। এইবার সওয়াল-জবাব বন্ধ করে ছিন-ছিনারি দ্যাখ। বর্ষাতে ম্যাকক্লাস্কির সৌন্দর্যই আলাদা। বিজুপাড়া থেকে গাড়ি ডানদিকে মোড় নিলেই দেখতে পাবি। জঙ্গল, নদী, সবুজ ক্ষেত, ঝাঁটি-জঙ্গল। তারপর চামার মোড় থেকে বাঁদিকে ঢুকে গেলে তো কথাই নেই। শুনেছি যে, ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ নাকি এখনও সবুজ এবং আনস্পয়েন্ট আছে। বড় গাছ কাটা গেছে অনেক। তবে নতুন গাছ গজিয়েছেও। এখানে আসতে হয় দোলের আগে। তখন লালে লাল হয়ে থাকে দশদিক।
এখানে অনেক কমিউনিস্ট আছে বুঝি?
ভটকাই বলল।
আমরা হেসে উঠলাম।
পলাশ, শিমুল, অশোক। এই সব গাছেদের রাজনৈতিক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা তো বলতে পারব না।
ঋজুদা বলল।
ভটকাই এবার গাধার পিঠে রাইডিং-প্র্যাকটিস করার চেয়েও বেশি লজ্জা পেল।
চামার মোড়ে পৌঁছবার আগেই বাঁদিকে একটা পাহাড় দেখিয়ে ঋজুদা বলল, ওটা দেখে রাখ। দেখছিস, চুড়োতে একটা নাকের মতো আছে। এর নাম, ম্যাকক্লাস্কিজ নোজ, অর্থাৎ ম্যাকক্লাস্কির নাক।
জঙ্গল, বিজুপাড়ার পর থেকেই আছে। কিন্তু গাড়িটা চামার মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরতেই সত্যি আশ্চর্য সুন্দর জঙ্গল দু’দিকে। দু’দিকেই এত সুন্দর জঙ্গল আর উপত্যকা যে, চোখ ফেরানো যায় না।
এই হল ছোটানাগপুর প্ল্যাটো বা মালভূমি। রাঁচি, হাজারিবাগ, পালা–এই তিন জেলা ছিল আগে। এখন টুকরো টুকরো হয়ে জেলা বেড়ে গেছে। কোডারমা, যেমন আলাদা জেলা এখন। বর্ষাকালে সমুদ্রতীর অথবা এই ছোটনাগপুর মালভূমির তুলনা নেই। ভোর হতেই ট্রেন থেকেই দেখলি না দু’পাশের দৃশ্য?
সত্যি! দারুণ সুন্দর।
আমরা একই সঙ্গে বললাম। এখন আর কী দেখছিস। জঙ্গল তো শেষই করে ফেলা হল। যেমন রাজা তেমন প্রজা। বিরিসা মুণ্ডার দেশের মুণ্ডাদের একটা গান আছে:
ছোটানাগাপুরা হো ছোটানাগাপুরা।
সোনারূপান রূপালেকান ছোটানাগাপুরা হো ছোটানাগাপুরা।
তিতির বলল, এই গানটার এবং মুণ্ডাদের আরও অনেক গানের কথা পড়েছি ‘সাসানডিরি’ নামের একটা বইয়ে।
সাসানডিরি শব্দের মানে জানিস?
জানি বইকী। সাসানডিরি’ মানে, মুণ্ডা ভাষাতে, কবরস্থান। উপন্যাসটির শেষে একটি দারুণ দাবানলের বর্ণনা আছে। গায়ে কাঁটা দেয়। জঙ্গলের মধ্যে স্বপ্নে-পাওয়া সোনা আনতে গেছিল চাটান মুণ্ডা তার প্রেমিকা মুঙ্গরীর সঙ্গে। দু’জনেই ছাই হয়ে গেল। সেই সোনা পাহারা দিত এক সোনার সাপ।
মুণ্ডাদের মিথোলজিতে এই সব আছে বটে।
বিরিসা মুণ্ডা, উলগুলান, তাদের নানা প্রথা, তাদের গান, কত কী জেনেছি সাসানডিরি’ পড়ে।
তারপরেই তিতির বলল, রুদ্র, তুমিও তো ঋজুদার সঙ্গে কম জঙ্গলে ঘুরলে। তোমারও কিন্তু পড়াশুনো করে লেখা উচিত। শিক্ষিত আর অশিক্ষিতর মধ্যের বিভাজক হচ্ছে ঔৎসুক্য। যার ঔৎসুক্য নেই সে অশিক্ষিত। তোমার মতো এত জায়গা ঘোরার সুযোগ তো সকলের হয় না। এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করা উচিত তোমার।
ঠিকই বলেছ।
আমি বললাম।
সত্যিই ঠিক বলেছে তিতির। তা ছাড়া, তুই যদি তিতিরের প্রিয় সাসানডিরি’র লেখককে লিখে হারাতে পারিস, তা হলে আমার বিশেষ ভাল লাগবে।
সব বিষয়েই প্রতিযোগিতা কি ভাল? তুলনা?
ভটকাই বলল।
ঋজুদা বলল, গাধার সঙ্গে ঘোড়ার তুলনার কথা না তুলেই আমি বলব যে, প্রতিযোগিতা অবশ্যই ভাল। তুই জীবনে যা কিছুই করিস না কেন, সে জিনিস তোর চেয়ে ভাল করে আর কেউই করতে যেন না-পারে, এই জেদ-এর জন্ম দিতে হবে। শুধু তোরই নয়, তোদের প্রত্যেকেরই ভিতরে। এক নম্বর হয়েই যদি না বাঁচতে পারলি, তবে জীবনে বেঁচে থেকে কী লাভ? জীবনের যে ক্ষেত্রেই যাবি, সেইখানেই এক নম্বর হতে হবে। তোদের প্রত্যেককে মানুষ হতে হবে। মানুষের চেহারার ডামি হয়ে থাকলেই চলবে না।
এবার আমি সুযোগ পেয়ে ভটকাইকে বললাম, প্রতিভা যাহাকে স্পর্শ করে তাহাই…’
ঋজুদা হঠাৎ বাঁদিকে তাকিয়ে কিষুণকে গাড়ি থামাতে বলল।
কী হল?
তিতির বলল।
নাম, নেমে, এখান থেকে নীচের উপত্যকাটা দ্যাখ আর দ্যাখ ম্যাকক্লাস্কি’জ নোজ। কত উঁচু দেখেছিস পাহাড়টা! আর একেবারে মানুষের নাকেরই মতো চুড়োটা, তাই না?
ঠিক।
কেউ উঠেছে ওই উঁচু পাহাড়ের চুড়োয়?
ভটকাই জিজ্ঞেস করল।
জানি না। তবে পর্বতারোহী ছাড়া ওখানে ওঠা সম্ভব নয়। খালি হাতে যাওয়াটাও বিপজ্জনক। বাঘ, ভাল্লুক, সাপের আড্ডা ওই পাহাড়। এখন তো আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করলেই জেল।
যা বলেছ। পশু-পাখি মারলেই নির্ঘাত জেল। মানুষ মেরে বুক ফুলিয়ে ঘুরতে পার, অথবা লুকিয়ে, যেমন ম্যাক টেইলর লুকিয়ে বাঁচছে। কোথায় সুদূর কানাডা আর কোথায় রাঁচি-পালামুর জেলার বর্ডারের এই ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ।
তিতির বলল।
ঋজুদা বলল, এই দ্যাখ, আমলকী বন। চৈত্রর শেষে থোকা-থোকা আমলকী ঝুলে থাকে এই সব গাছের ডাল থেকে। গাছ থেকে পেড়ে খাবি, খেয়ে, এক গ্লাস জল খাবি, মনে হবে শরবত খাচ্ছিস। এমন মিষ্টি।
তারপর বলল, মন ভরেছে তো! এবার চল। চলো কিষুণ।
চালিয়ে হুজৌর।
হুজৌর শব্দটা দারুণ উচ্চারণ করে কিষুণ। কথাটা হুজুর নয়, হুজৌরই। বাঙালিরা খেজুড়ের মতো উচ্চারণ করে হুজৌরকে হুজুর বলে।
ভাবছিলাম, আমি।
হাতঘড়ি দেখে ঋজুদা বলল, আর পনেরো মিনিট। এসে গেলাম ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে।
‘দ্য গঞ্জ’ বলো। ভটকাই বলল।
আগেকার দিনে যখন নানা দেশি সাহেব আর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানে ভর্তি ছিল জায়গাটা, তারা গর্ব করে নবাগন্তুকদের বলত, ‘উ নো, উই হ্যাভ দ্যা ওয়াটার অ্যান্ড দ্যা এয়ার ইন দ্যা গঞ্জ। উই ডোন্ট নিড এনিথিং এলস। উ্য ক্যান ওয়াক উইথ ইওর ব্যাক স্ট্রেইট, ইভিন হোয়েন ঊ্য আর নাইনটি এইট, ইফ উ্য লিভ হিয়ার। দিস ইজ দ্য ট্রেইট অফ দ্যা গঞ্জ।
আমরা চুপ করে থাকলাম।
.
মিস্টার ক্যামেরনের গেস্ট হাউসটা স্টেশনের কাছেই। ট্রেনে যাঁরা আসবেন ম্যাকক্লাস্কি স্টেশনে তাঁদের খুব বেশিদূর আসতে হবে না। সামনে দিয়ে একটি পাহাড়ি নদী বয়ে গেছে। নদীটা ছোট্টই। তার পাশে উঁচু ডাঙার ওপরে গেস্ট হাউস।
টাটা সুমোটা গেট দিয়ে বাঁদিকে ঢুকল। দুটো মস্ত কৃষ্ণচূড়া গাছ। এক সারি ঘর। ডানলোপিলো আছে, গিজার আছে। সামনে টানা বারান্দা রাস্তার দিকে। সেই বারান্দাতে বসে থাকলেও বেশ সময় কেটে যায়। পথের একপাশে গেস্ট হাউস আর অন্য পাশে জঙ্গল। তার পরেই রেল লাইন। বাঁদিকে একটু গেলেই ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ স্টেশন।
মালপত্র নামিয়ে দিয়ে আমরা স্টেশনটি দেখতে গেলাম। স্টেশন দেখাও হবে, গাড়ির খোঁজও করা যাবে। কিষুণকে ছেড়ে দেওয়াই মনস্থ করেছে ঋজুদা। কিষুণ শনিবারই চলে আসবে দুপুরে। কোনও কারণে যদি আমরা যাওয়াটা পিছেই তবে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ স্টেশনের মাস্টারমশাইকে দিয়ে ডালটনগঞ্জে স্টেশনমাস্টারকে টক্কা-টরে টক্কা-টরে করে খবর দিয়ে দিলে উনি মোহন বিশ্বাসকে ফোন করে দেবেন কিষুণকে পাঠিয়ে দেবার জন্যে। ফোন পেয়েই মোহনবাবু কিষুণকে পাঠিয়ে দেবেন।
রাঁচিতে এস ই আর হোটেলে ফোন করে টিকিটেরও বন্দোবস্ত করে দেবেন। নইলে ডালটনগঞ্জ থেকে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস-এর টিকিটও করতে পারেন। অথবা রাঁচি থেকে প্লেনের টিকিট।
মানে? যদি ফিরে যাওয়ার দিন এগনো-পেছনো হয়। রিটার্ন টিকিট তো তুমি কেটেই এসেছ।
তিতির বলল।
ইয়েস।
ঋজুদা বলল।
মোহন বিশ্বাসকে সকলে ‘দ্য প্রিন্স অফ পালাম’ বলেন। পালা জেলা তো বটেই, রাঁচি থেকে নিয়ে একদিকে নেতারহাট, অন্যদিকে চাইবাসা, আর একদিকে ডালটনগঞ্জ হয়ে ঔরঙ্গা রোড, রাংকা আর আরও অন্যদিকে চান্দোয়াটোড়ি হয়ে চাতরা অথবা বাঘরা মোড় হয়ে সীমারিয়া টুটিলাওয়া হয়ে হাজারিবাগ পর্যন্ত প্রিন্স অফ পালামুর রাজত্ব বিস্তৃত। এই পুরো এলাকাতেই His wish is a com mand to all.
প্লাটফর্মটি উঁচু নয়, মাটিরই সমতলে। রেল লাইনের ওদিকেও জঙ্গল। তারই ফাঁকফোকর দিয়ে দু-একটি বাড়ি চোখে পড়ছে।
তিতির বলল, এইরকম প্লাটফর্ম আমি জীবনে দেখিনি।
তোমার জীবনটা তো বেশি লম্বা হয়নি এখনও মা!
ভটকাই বলল তিতিরকে।
মিসেস কার্নির দোকানের সিঙাড়া খাবি তোরা?
ব্রেকফাস্ট তো খেয়েছি দু’ঘণ্টাও হয়নি।
তা হোক। মিসেস কার্নি তো মারা গেছেন আজ বহুদিন হল। ভারী ভাল ছিলেন মহিলা, শেষ জীবনে গরিব হয়ে গেছিলেন খুব কিন্তু আত্মসম্মানজ্ঞান একটু টলেনি। অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সাহেবদের ভাল গুণ-এর অনেকই দেখেছি আমি, দোষেরই সঙ্গে। কিন্তু মিসেস কার্নি একজন মহীয়সী মহিলা ছিলেন। তোদের দুর্ভাগ্য যে, তোদের দেখাতে পারলাম না তাঁকে। এক একটা জায়গার সঙ্গে একেকজন মানুষের স্মৃতি এমন করে মিশে যায় যে, যাঁরাই তাঁকে চিনতেন, তাঁদেরই চোখে জায়গাটার চরিত্রই পাল্টে যায়, যদিও পথঘাট, পাহাড়-জঙ্গল বাড়ি বাংলো সব একইরকম থাকে।
এই সিঙাড়া আমি খাব না, এ নির্ঘাত ট্রাকের পোড়া-মবিলে ভাজা।
এই সিঙাড়াই সকলে চাঁদমুখ করে খাচ্ছে দেখছিস না! এ সব খাস না বলেই তো তোদের ইম্যুনিটি কমে যায়। তোরা কি সব আমেরিকান হয়ে গেলি না কি? বাতিকগ্রস্ত! এটা খাব না ওটা খাব না, মিনারাল ওয়াটার ছাড়া খাব না। যত্ত সব!
বলল ঋজুদা।
তারপর বলল, তোরা ওই গাছতলার সিমেন্টের বেঞ্চটাতে বোস। আমি গিয়ে দেখি, একটু কথাবার্তা বলি। ওইটাই তো এখন ম্যাকক্লাস্কির ক্লাব। গল্প-গাছা শুনেও আমাদের উদ্দেশ্য সফল হতে পারে।
একটি মুসলমান লোক, মাঝবয়সী, দোকানের মালিক, মিসেস কার্নি নাকি তাকেই দিয়ে গেছেন দোকানটা। তখন সে ছেলেমানুষ ছিল, মিসেস কার্নির ডানহাত। রুটির ফ্যাক্টরি ছিল। রুটি বানাতেন, কেক বানাতেন। ভারী মিষ্টি হাসি ছিল বুড়ির।
আমি বললাম, আমিও তোমার সঙ্গে যাই ঋজুদা ভিতরে?
চল। বলেই ভটকাইদের দিকে ফিরে বলল, তোরা ছিনছিনারি দ্যাখ। গরমাগরম ভেজে পাঠাচ্ছি সিঙাড়া। চা খাবি তো?
তিতির বলল, না।
ভটকাই বলল, ইয়েস।
ঋজুদার চেহারা গত পঁচিশ বছরে অনেকই পাল্টে গেছে যদিও তবুও মালিক তাঁকে চিনতে পেরে সেলাম করল।
ম্যায় তো বিলকুল বুঢ়ঢ়া বন চুকে হ্যায়, তুম পহচানে কেইসে হামে?…
ম্যায়ভি তো খুদই বুঢ়া বন গ্যায়ে সাহাব। আপকী ক্যা কসুর?
ইয়ে বাত তো সাহি হ্যায়।
তারপর ঋজুদা আমার সঙ্গে তার আলাপ করিয়ে দিয়ে বলল, এ মাজিদ। আর এ হল রুদ্র রায়, রাইটার।
তারপর বলল, ম্যাকক্লাস্কির চেহারা তো অনেকই পাল্টে গেছে। পুরনোদের মধ্যে কারা কারা আছেন আর নতুন এলেন কারা কারা?
পুরনো সাহেবদের মধ্যে অর্ধেক মরে গেছে আর অর্ধেক অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে। হলাণ্ডুয়া সাহেবকে মনে আছে? আপনার বাড়ির উল্টোদিকে, নালার পাশে ঝুপড়ি মতো জায়গাতে যে বাড়ি…
হ্যাঁ হ্যাঁ মনে থাকবে না! অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছেন বলতেন। তখনই তাঁর আশি বছর বয়স ছিল। বুড়ি ছিল পোলিশ।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হলাণ্ডুয়া, সাহেবের নাম ছিল?
ঋজুদা হেসে বলল, নারে। নাম ছিল হল্যান্ড। এরা ডাকত হল্যান্ডুয়া বলে। প্যাট গ্লাসকিনকে ডাকত, ল্যাংড়া লাসকিন। ব্রিগেডিয়ার স্টিভেন্সকে ডাকত, বিগাড়িও সাহাব বলে।
আমি হেসে বললাম, তাই?
ঋজুদা জিজ্ঞাসা করল মাজিদকে, কী ভাল হবে এখন?
আলুর চপ খান সাহাব। একেবারে গরম গরম ভেজেছি।
বেশ তাই দাও। আর বাইরে দু প্লেট পাঠাও। একজন চা খাবে। দুধ চিনির ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করে নিও।
ঠিক আছে।
তারপর মি. হল্যান্ডের সম্বন্ধে কী যেন বলছিলে তুমি? হল্যান্ডুয়া আর বুড়ি দু’জনেই মরে গেল ছ’মাসের মধ্যে। তাদেরই এক ভাতিজা এসেছেন দেশ থেকে। বেশ পয়সাওয়ালা লোক। বুর্থস ফার্ম-এর দিকে একটা ছোট বাড়ি কিনে থাকে। খেতি-জমি করে। কিংসসাহেবের ছোট শালী, যিনি হান্টারগঞ্জে থাকতেন, তাঁকে বিয়ে করছেন। নিজেদের ছেলেমেয়ে নেই।
পোপাষা মুরগিরা ডিম পাড়ে প্রচুর। আমি তো ওঁর কাছ থেকেই ডিম কিনি।
কী মুরগি?
রোড আইল্যান্ড, লেগ-হর্ন। বড়কা বড়কা ডিম হয়। সাহেবদের কাছে মুরগিও বিক্রি করেন। এখন যাঁরা থাকেন এখানে তাঁদের মধ্যে অনেকেই বাড়ির বাগানে মুরগির বার-বি-কিউ করেন। এখন এই ফ্যাশান হয়েছে। আগে সাহেবরা করত সাকলিং-পিগ-এর।
সেটা কী জিনিস?
আমি ঋজুদাকে বললাম।
ঋজুদা বলল, সাকলিং-পিগ।
ওঃ। আমি হেসে ফেললাম। দুগ্ধপোষ্য শুয়োরছানা। মনে ছিল না।
এখানে নাকি আজকাল ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া হচ্ছে খুব?
তা হচ্ছে। আগে ওসব ছিল না। সাহেবরা খুব সাফ-সুতরো থাকত। এখন। বেশিই আমাদেরই মতো রাঁচি জেলার লোক। বস্তিও হয়ে গেছে দু-তিনটে।
তারা কারা?
বাংলাদেশ-এর যুদ্ধের পরে পশ্চিম বাঙ্গাল দিয়ে বর্ডার পেরিয়ে আসা অনেক বিহারি মুসলমানরা। আমরা তো ছিলামই এখানে। কী করবে। তারাও মুরগি পুষছে, যা পারছে তাই করছে, খিলাড়ির খাদানে কাজ নিয়েছে। জবরদখল জমিতে আন্ডাবাচ্চা নিয়ে ঘিঞ্জি হয়ে থাকে। ক্রিশ্চানরা অনেক পরিষ্কার। আমরা তো সাহাব তা নয়। এই তো সেদিন ডরোথি মেমসাব প্রায় মরো মরো হয়েছিল। মান্দারের মিশনের হাসপাতালে গিয়ে কোনওক্রমে জান বাঁচে।
ডরোথি মেমসাব কে?
ওই যে বললাম না কিং সাহেবের ছোট শালী। তাকে অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা লিন্ডাল সাহাব বিয়ে করেছে।
লিন্ডাল সাহেবের বয়স কত হবে?
এই হবে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ। সাহাব-মেমসাহাবদের বয়স তো ঠিক ঠাহর করতে পারি না আমরা!
তারপরই বলল, লিন্ডাল সাহেব খুব ভাল শিকারি। নিজের বন্দুক রাইফেল নেই যদিও, মুংগতুরামের বেপাশি বন্দুক দিয়ে প্রায়ই শুয়োর ধড়কে দেয়।
তোমরা তো মুসলমান। শুয়োর খাওয়া তো তোমাদের হারাম।
ঋজুদা বলল।
তওবা, তওবা সাব। আমরা খাব কোন দুঃখে। কিন্তু আমরা না খেলে কী হয়? এখানের আদিবাসী কুলিনকামিন, ঠিকাদারবাবুরা বাঙালি আর বিহারিবাবুরা সবাই ‘ভিন্ডিলি’ না কী বলে, তাই বানিয়ে খায়।
আমি বললাম, ভিন্ডিলিটা কী ব্যাপার?
ঋজুদা বলল, ভিন্ডালুই হবে। সবই কি আর জিজ্ঞেস করতে হয়? ও তো আর তোর মতো লেখাপড়া-না জানা ইংরেজিনবিশ নয়! লিন্ডওয়ালকে লিন্ডাল বলে ওরা, ভিভালুকে ভিডিলি। তাতে কীই-বা এল গেল।
লিন্ডওয়াল সাহেব বুঝি অস্ট্রেলিয়াতে শিকার করতেন?
বলেন তো তাই। ওখানে ঘোড়ার মতো বড় একরকমের হরিণ আছে– আমাদের সম্বরের মতো। তাই মেরেছেন ওখানে অনেক।
তারপরই বলল, আমি দিয়ে আসি ওঁদের আলু-চপগুলো বাইরে। স্যালাড দেব কি?
ঋজুদা একটা অ্যালুমিনিয়ামের গামলাতে কেটে-রাখা শশা পেঁয়াজ টম্যাটো ইত্যাদির দিকে এক ঝলক তাকাল। আমি দেখলাম জল ছাড়ছে সেগুলো থেকে।
ঋজুদা বলল, লাগবে না।
চলে গেলে বলল, জানিস তো কাঁচা-পেঁয়াজের মতো ভাল জিনিস খুব কমই আছে। নিয়মিত পেঁয়াজ খেলে যক্ষ্মা হয় না, সর্দি কাশি হয় না, প্রচুর স্ফুর্তি ও কাজের ক্ষমতা পাওয়া যায়।
তাই ট্রাক-ড্রাইভারেরা অত খায়!
আমি বললাম।
শুধু তারাই কেন, যে-কোনও বন্দরের মুসলমান অবাঙালি কুলিরা দেখবি কত কাঁচা পেঁয়াজ খায়। তাদের গায়ে কত জোর। কত পরিশ্রম করতে পারে তারা! রসুনও ভাল।
তারপর বলল, তোর জানার কথা নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে বার্মাতে, এখনকার, মায়ানমারে যখন বেধড়ক মার খাচ্ছে ব্রিটিশরা, তখন জেনারেল উইংগেট বলে এক ইংরেজ জেনারেল বার্মার জঙ্গলে মারাত্মক সব কাণ্ড-মাণ্ড করেছিলেন। তাঁর সৈন্যদলকে বলা হত ‘উইংগেস্টস সার্কাস’। সেই উইংগেট নাকি শুধু কাঁচা পেঁয়াজ খেয়েই থাকতেন এমনই জনশ্রুতি আছে পৃথিবীর তাবৎ সৈন্যমহলে।
তাই?
আমি বললাম, অবাক হয়ে।
ঋজুদা বলল, ঠিক তাই।
তা যেমন ঠিক তেমন এও সকলেরই জানা উচিত যে পেঁয়াজ খাবার সময়েই ছাড়িয়ে নিয়ে খেতে হয়। আগে ছাড়িয়ে রাখলে রাজ্যের যত রোগের বীজাণুর বাসা হয়ে যায় তারা। অনেক আগে ছাড়িয়ে বা কেটে-রাখা পেঁয়াজ খেলে উপকারের চেয়ে অপকার অনেকই বেশি হয়।
তাই?
তাই তো। কিন্তু যেকর্মে এখানে আসা তার কিছু সূত্র কি পাওয়া গেল?
ঋজুদা বলল।
কীসের সূত্র?
আমি বললাম।
বুঝলি না?
না তো।
নাঃ। ভটকাইকেই দেখছি ডাবল-প্রমোশন দিয়ে তোর জায়গাতে আনতে হবে। ও আমার সঙ্গে থাকলে ঠিকই বুঝতে পারত কী বলতে চাইছি।
লজ্জায় আমার কান লাল হয়ে গেল।
বললাম, কী? ডরোথির স্বামী লিন্ডওয়ালই আসলে ম্যাক টেইলর?
আসলে কি না বুঝতে পারছি না এখনও, তবে গড়বড় একটা আছে।
কেন একথা বলছ?
বলছি, কারণ অষ্ট্রেলিয়াতে তো সম্বার অথবা সম্বরের মতো বড় কোনও জানোয়ার নেই, ক্যাঙারু ছাড়া।
ক্যাঙারুর বর্ণনাই বোধহয় ও দিল।
আমি বললাম, ও মানে?
মানে, মাজিদ।
ও কি আর মুজ-এর নাম শোনেনি?
মুজ-এর নাম ও কোথা থেকে শুনবে? উত্তর আমেরিকা আর কানাডার বরফাবৃত অঞ্চলের মুজ-এর কথা আর ক’জন জানে? অ্যালগারনন ব্ল্যাকউড-এর কথাই বা ক’জনে শুনেছে?
ইতিমধ্যে মাজিদ ফিরে এল তিতির আর ভটকাইকে গরম গরম আলুর চপ আর চা দিয়ে।
ঋজুদা বলল, বুঝলে, এবারে আমাদেরও দাও।
জি সাহাব।
ও আমাদের খাবারটা ঠিকঠাক করতে লাগল।
এখানের সংস্কৃতি ছিল পথেঘাটে যেখানেই অচেনা মানুষজন এবং শিশুদের সঙ্গেও দেখা হত, প্রত্যেকেই হাত তুলে বলত ‘সেলাম সাহাব’। আমি যখন এখানে নিয়মিত আসতাম জায়গাটা অন্যরকম ছিল। এই যাকেতাকে সেলাম করার মধ্যে যেমন একটা গোলামি গোলামি গন্ধ আছে, তেমন একটা নিয়মানুবর্তিতা এবং মান্যতাও তার সঙ্গে মিশে ছিল। যা নইলে, শৃঙ্খলাবোধ তৈরি হয় না। নীরদ সি চৌধুরী যে ইংরেজদের এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রশংসা করতেন তা এমনি এমনি নয়। উইনস্টন চার্চিল বলেছিলেন, ভারতীয়রা হচ্ছে Men of Straw, তাদের স্বাধীনতা দিলেও তারা তা রাখতে পারবে না। ভারত বিরাট রাষ্ট্র। তার বহু ভাষা, বহু ধর্ম, বহু সংস্কৃতি। তাই হয়তো এখানে মিলিটারি Coup হয়নি কিন্তু ইংরেজ, ফরাসি, জার্মান, বেলজিয়ানরা, যেসব ছোট-ঘোট উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিয়েছে সেইসব দেশ, সেইসব দেশের অবস্থা তো পড়িসই কাগজে। স্বাধীনতার যোগ্য নিজেদের পুরোপুরি না করতে পারলে সেই স্বাধীনতা খায় না মাথায় মাখে, তাই বুঝে উঠতে পারে না সেই দেশ। উগান্ডার মতো, আফগানিস্তানের মতো, জায়রের মতো। আমাদের দেশ কিন্তু মস্ত বড়। কিন্তু ভৌগোলিক বিরাটত্বই তো বিরাটত্বর একমাত্র মাপ নয়।
মাজিদ আমাদের এনে দিল আলুর চপ প্লেটে করে।
ঋজুদা বলল, আজ আপ-ট্রেন টাইমে আছে?
জি সাহাব। এখন পর্যন্ত তো আছে, পরে কত লেট করবে কে বলতে পারে।
ঋজুদা আমাকে বলল, তা হলে কিষুণকে তাড়াতাড়ি খাইয়ে নিয়ে তুই টাটা সুমোটা নিয়ে কিষুণকে স্টেশনে ছেড়ে যাস এসে। ও কী করবে এখানে বসে থেকে।
তারপর মাজিদকে বলল, আপাতত তুমি ড্রাইভারকেও এক প্লেট আলুর চপ আর গরম এক গ্লাস চা পাঠিয়ে দাও তো গাড়িতে কারোকে দিয়ে।
জি সাহাব।
আমি বললাম, তুমি যা ভাল মনে করবে কিযুণের ব্যাপারে তাই হবে।
কতদিন শিকার করি না। একদিন লিন্ডওয়াল সাহেবের সঙ্গে গেলে মন্দ হয় না।
মাজিদের দিকে ফিরে বলল, ঋজুদা।
আপ কভভি শিকার খেলথে থে সাহাব? ম্যায় তো কভূভি দিখা নেহি ম্যাকক্লাস্কিমে আপকো শিকার খেলথে হুয়ে।
ঋজুদা হাসল।
আমার ভয় হল থলে থেকে বেড়াল এই বেরিয়ে পড়ল বুঝি।
আমি ভাবলাম বলি যে, তুমি আর কতটুকু জেনেছ বাবা! ঋজু বোস-এর ‘খাল-খরিয়াৎ’, ‘রাহান-সাহান’-এর কথা আমাদের মতো তুমি জানবেই বা কোত্থেকে!
ঋজুদা আবার বলল, কী হে? মোটে দিন তিনেক তো থাকব। আজ সন্ধের পরে তো আর কোনও গাড়িও নেই।
কেন? শক্তিপুঞ্জ?
আমি বললাম।
শক্তিপুঞ্জের প্যাসেঞ্জার তো নামতে পারে না। মানে, চা খেতে নামতে পারে। এক মিনিট তো স্টপেজ তাও আবার মাঝ রাতে।
আমরা ক্যামেরনের গেস্ট হাউসেই উঠেছি। বুঝেছ মাজিদ, চলে এসো। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে তোমার লিন্ডাল সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে আসব। তারপর যদি একটু শিকার-টিকার হয়।
একটু চুপ করে থেকে বলল, এখন এখানে কিছু জানোয়ার আর আছে কি? দাশগুপ্ত সাহেব, রাণা সাহেবরা মিলে তো সবই শেষ করে দিয়েছেন।
সাহাব। গলা নামিয়ে বলল মাজিদ একটু আস্তে কথা বলুন। দেওয়ালেরও কান আছে।
তারপর বলল, না সাহাব। আছে। বড় বাঘ এপাশে নেই, তবে চামার রাস্তাতে আছে, ম্যাকক্লাস্কির নোজ-এর গুহাতে থাকে। তা ছাড়া বাঘ মেরে হজম করাও তো সহজ নয়। এপাশে লেপার্ড আছে, ভালুক, শুয়োর, কুটরা, জানোয়ারদের মধ্যে। আর পাখির মধ্যে তিত্বর, বটের আর মোরগা। কালিতিত্বরও আছে।
ঠিক আছে। এসো তো তুমি আজ। সন্ধের মুখে মুখে।
এখন সময়ে একজন মোটাসোটা ইংরেজ তরুণী প্লাটফর্মে এসে ঢুকলেন। ঋজুদাকে দেখেই বললেন, হ্যালো!
ঋজুদা বলল, হ্যালো।
তারপর বলল, গোয়িং ব্যাক টু ডে?
ইয়া!
বলেই মেমসাহেব একটি দেহাতি ছেলের সঙ্গে লাইনের ওপারে চলে গেলেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ঋজুদাকে, কে উনি?
মিস এলিসন ব্লান্ট। উনি ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উপরে একটা থিসিস-এর জন্যে।
তুমি চিনলে কী করে?
কলকাতাতে সেদিন আমাকেও ইন্টারভু করলেন যে।
কেন?
যেহেতু আমার একসময়ে যাতায়াত ছিল ওখানে।
তারপরে বলল মাজিদ মিঞাকে, একটা খবর পাঠিয়ে দিয়ে তোমার লিন্ডিল সাহেবের কাছে যে, আমরা যাব। এখানের সব বাসিন্দাই তো সন্ধে সাতটাতে ‘সাপার’ খেয়ে শুয়ে পড়ে। আগে না জানিয়ে গেলে…।
তা ঠিক। মাজিদ বলল।
ঋজুদা বলল, তারপরে দোকান থেকে বেরিয়ে গাছতলার বেঞ্চে বসে-থাকা ভটকাই আর তিতিরের দিকে যেতে যেতে বলল, বারকাকানা থেকে ডালটনগঞ্জ-এর ট্রেন আসতে আসতে তো দুপুর গড়িয়ে যাবে। চল, চা, আলুর-চপ খাওয়া তো হল, চাট্টি নদী দেখিয়ে নিয়ে আসি তোদের।
সেটা কোথায়?
সেটা ম্যাকক্লাস্কির একেবারে অন্য প্রান্তে। সেদিকে বাড়িঘর লোকজন খুবই কম। তবে জাগৃতি-বিহার আর ব্রিগেডিয়ার রামদাস-এর নতুন বাড়িতে ওদিকের ভোলই পাল্টে গেছে। তবে চাট্টি নদীতে যেতে আরও দূরে যেতে হবে ডানদিকে। শেষকালে কিছুটা হাঁটতেও হতে পারে।
ভটকাই বলল, মহাপ্রস্থানের পথে বা অমরনাথে যেতে কিছুটা হাঁটতে তো হবেই। কষ্ট না করলে কি আর কেষ্ট মেলে? তবে একটা জিনিসেরই অভাব। পড়ল।
কীসের?
একটা কুকুরের। যুধিষ্ঠিরের পায়ে পায়ে একটা কুকুর গেছিল না? তা ঋজুদা, তুমি কি সারমেয়হীন যাবে?
তিতির ফিক করে হেসে উঠল।
হাসলে যে বড়।
হাসব না? তুমি এমন এমন বাংলা শব্দ বলছ যে, মানেই বুঝি না।
তিতির বলল, বাংলা হলেও না হয় বোঝা যেত। এ যে সংস্কৃত শব্দ।
ইয়েস। এই সংস্কৃত আরবি, ফারসি ছেড়ে শুধু ইংরেজিনবিশ হওয়াতেই তো আজ আমাদের এই অবস্থা!
এনাফ ইজ এনাফ।
ঋজুদা ভটকাইকে থামিয়ে দিল।
তারপর স্টেশনের গেট পেরিয়ে গাড়ির দিকে এগোতে এগোতে বলল, আজকে কিষুণকে পাঠানো যাবে না।
কেন?
চল, আমরা চাট্টি নদী থেকে ঘুরে আসি। তারপর দুপুরের খাওয়ার পরে রুদ্র তোর একবার রাঁচি যেতে হবে। দেড় ঘণ্টা লাগবে। একটা কাজ দেব।
ভটকাই বলতে গেছিল, আমি যাব না?
কিন্তু সামান্য আগেই ঋজুদার বকুনি খেয়ে চেপে গেল।
তিতির বলল, ওই মেম সাহেবটি কে ঋজুদা?
মিস এলিসন ব্লান্ট এসেছেন ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ-এর অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ওপরে। কাজ করবার জন্যে লন্ডন থেকে।
ভটকাই বলল, আজকাল তরুণী অথ মোটা মেমসাহেব দেখাই যায় না?
আমরা হেসে ফেললাম ওর কথায়।
পি এইচ ডি করছেন কি?
তিতির জিজ্ঞেস করল।
পি এইচ ডি করছেন এই বিষয়ে। তবে তিনি তো অলরেডি ডক্টর ব্লান্ট। বেশ রলি-পলি গাবলু-গুবলু মহিলা। বয়স বেশি নয়। ইংল্যান্ডের সাউদাম্পটন ইউনিভার্সিটির জিওগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে আছেন।
চল এবারে গাড়িতে ওঠ।
ঋজুদা সামনে, আমরা তিনজনে পেছনে।
দারুণ লাগছে জায়গাটা। মনে হয়, গোয়া বা পুরনো চন্দননগরে চলে এসেছি। ছোট কটেজ, প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা বাংলো লাল-মাটি পথের দু’পাশে। এক একটি বাংলোর হাতাই হবে দশ-পনেরো বিঘা করে। কত যে গাছ, কতরকমের, তা বলার নয়। ভারী শান্ত, সুন্দর ছবির মতো জায়গাটা। আমরা ডানদিকে মস্ত প্রায় একশো বিঘা এলাকার বুথ’স ফার্ম ছাড়িয়ে ডানদিকে জাগৃতি-বিহারের সুন্দর বাংলোটি ছাড়িয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল রামদাস-এর দারুণ বাড়িটাকে বাঁদিকে রেখে চাট্টি নদীর দিকে এগোলাম ডানদিক দিয়ে। বেশ অনেকখানি পথ গিয়ে দাঁড়াবার কথা বলল, ঋজুদা।
না থেমে, কিষুণ বলল, তকলিফ হোগা হুজৌর। সুমো ইতমিনানসে পৌঁছ যায়েগা নদ্দীতক৷ আপলোগ মজেমে বৈঠিয়ে।
আরও কিছুক্ষণ এবড়ো-খেবড়ো পথ বেয়ে গিয়ে যেখানে পৌঁছলাম সে জায়গাটা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। বিরাট বিরাট পাথরের চাঙর, নীচ দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। সাদা বালির চর। দুপারেই জঙ্গল। চড়ুইভাতি করার আদর্শ জায়গা।
বাঃ। কালকে এখানেই পিকনিক করলে হয়।
করলেই হয়। লিন্ডওয়াল এবং মিসেস লিন্ডওয়ালকেও নেমন্তন্ন করা যায়। মেনুটা তোরা ঠিক করে ফেল। কিন্তু রান্না করবে কে? তোরা তো সব ওয়ার্থলেস।
ওয়ার্থ যাচাই না করেই যদি আমাদের বাতিল কর, তা হলে আর কী বলি!
ভটকাই বলল।
তুই রাঁধবি?
পরীক্ষা করেই দেখ।
তবে তাই হোক। তুই কি চুলও কাটতে পারিস?
আমি বললাম।
মানে?
না। গাধার সঙ্গে তোর যখন অমন নিবিড় সম্পর্ক, তুই আমাদের লন্ড্রিম্যান হতেই পারিস। তদুপরি কুক। বাকি থাকল হাজামগিরি। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম।
হাজামৎ মানে কী?
তিতির প্রশ্ন করল।
নাপিত।
ঋজুদা বলল।
তাই?
হ্যাঁ। তা হলে তোর ভূমিকাটা আমাদের দলে একেবারে স্থায়ী হতে পারে আর কী। কোনও সময়েই তোকে দল থেকে বাদ দেওয়ার উপায়ই আর থাকবে না।
তিতির বলল, সবই ভাল ভটকাই কিন্তু তুমি গাধার পিঠে রাইডিং প্র্যাকটিসটা করে কাজটা ভাল করনি।
কেন?
আমার বারবারই জীবনানন্দর সেই পঙক্তিটিই মনে পড়ে যাচ্ছে।
কোন পঙক্তি?
আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে।
আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম তিতিরের কথাতে।
ভটকাই অন্যদিকে মুখ করে, মুখটাকে উটের মতো উঁচু করে, শূন্যে চেয়ে রইল।
এখানে তো সিনেমার শুটিং হওয়া উচিত।
হয়ই তো। এই তো কিছুদিন আগেই ‘বনফুল’ বলে একটা ছবির শুটিং করলেন শমিত ভঞ্জ। পল্লবী, ইন্দ্রাণী, রবি রায়, চিন্ময়বাবু কমেডিয়ান সব এসে তো সোমনাথের বাড়িতেই ডেরা করেছিলেন।
তাই?
তা তুমি একটা স্ক্রিপ্ট যদি লিখে দাও তো আমরাও ম্যাকক্লাস্কির পটভূমিতে একটা ছবি করতে পারি।
ওসব আমার কর্ম নয়। লেখক মিস্টার রুদ্র রায় তো আছেনই।
ভটকাই বলল, একটা সুন্দর জায়গাতে এসেছি। একটু আনন্দ করব তা নয়। কী যে ভ্যাজর-ভ্যাজর শুরু করলে তোমরা। তার চেয়ে আমি বরং ওইদিকটাতে একটু ঘুরে আসি।
যাচ্ছিস যা। তবে সাবধানে যাস। ওইদিকেই ভরদুপুরে একটা ভালুকে গ্রুপ সাহেবের পশ্চাৎদেশের দেড় কিলো মাংস খাবলে নিয়েছিল।
ঋজুদা বলল।
দেড় কিলো?
হ্যাঁ। সবুজ টেরিলিনের ট্রাউজারের কাপড়সুদ্ধ।
টেরিলিনও খেল ভালুক? পেট খারাপ হয়নি?
তিতির ভালুকের জন্যে রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ভালুক মানে Sloth Bear, তো মাংস খায় না।
তবে মাংস খাবলে নিলই বা কেন?
আমি বললাম।
মাংসের জন্যে খাবলায়নি। হয়তো কাপড়ের কোনও দোকানি অথবা ভটকাই-এর মতো কোনও দর্জি তাকে একটা সবুজ টেরিলিনের ট্রাউজার বানিয়ে দিতে গররাজি হয়েছিল। কে কী করে, কেন করে, কখন করে, তা কে বলতে পারে!
তবে কাল এখানে চড়ুইভাতি হচ্ছে তো?
তিতির বলল।
তোমরা করলেই হবে। তা হলে কিষুণকে রেখেই দেওয়া যাক।
ও খুব ভাল লিট্টি বানায়। এক রাতে খাওয়া যাবে। তা ছাড়া ও থাকলে আমাদের নানা উপকারে আসবে। এদিকারই মানুষ তো!
লিট্টিটা কী জিনিস ঋজুকাকা?
তিতির জিজ্ঞেস করল।
সে এক জিনিস। ছাতু দিয়ে বানায়। গোল গোল। কচুরির মতো। কিন্তু ক্রিকেট বলের মতো সলিড। বানাতে বহতই মেহনত লাগে। পার লিট্টি এক পো করে বিশুদ্ধ গাওয়া ঘি লাগে। খেতে কিন্তু অমৃত। ঝাল-লঙ্কার আচার এবং রাবড়ি বা রসমালাই দিয়ে খেতে হয়। খাওয়ার সময়ে সুখে মরে যেতে ইচ্ছে করে কিন্তু পরদিন খাওয়ার সময়েও দুখে…
তিতির বলল, মানে কী হল?
ভটকাই বলল, খুকি। সব কথার মানে হয় না। কিছু কিছু খুকি চিরদিন খুকিই থাকে।
তা হলে চল এবারে ফেরা যাক।
গাড়িতে বসে ঋজুদা কিষুণকে বলল, আমাদের গেস্ট হাউসে না গিয়ে কিষুণ তুমি একবার স্টেশনে গিয়ে মাজিদ মিঞাকে জিজ্ঞেস করে আসবে তার লিন্ডিল সাহেব মদ খায় কি না? গেলে, রাঁচিতে যখন রুদ্র অন্য কাজে যাবেই, তখন আনিয়ে নেব ওকে দিয়ে সাহেবের জন্যে। আরও জিজ্ঞেস কোরো সাহেব কী খান?
মতলব নেহি সমঝা হুজৌর।
মতলব ক্যা? বহত কিসিমকি দারু হোতা না হ্যায়। পুছনা, উন কি পসন্দ ক্যা হ্যায়, সমঝা না?
জি হুজৌর। ম্যায় আভভি পুছকর আতা।
গেস্ট হাউসে পৌঁছে আমরা নেমে যাবার পরে কিষুণ চলে গেল স্টেশনে। কিযুণের খাওয়ার কথাও বলে দিল ঋজুদা ক্যামেরনের লোককে। তারপর বারান্দাতে চেয়ারে বসে ভটকাইকে বলল, আমার চামড়ার হ্যান্ডব্যাগটা আন তো ঘর থেকে ভটু।
আমি আর তিতির মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। ভটকাই এতই প্রিয় হয়ে গেল ঋজুদার যে, ভটকাই থেকে আদরে একেবারে ভিটু’ হয়ে গেছে!
ভটকাই গদগদ মুখে ঋজুদার ঘরে গিয়ে ঋজুদার কালো ক্রোকোডাইল-লেদারের ব্রিফকেসটা নিয়ে এল ঘর থেকে। এই ব্যাগটা নামনি আসামের গারো পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে যাওয়া জিজিরাম নদীর একটি বুড়ো ‘ঘড়িয়াল’ কুমিরের চামড়া দিয়ে বানানো। কলকাতার গভর্নমেন্ট প্লেস ইস্ট-এর আর্মেনিয়ান ট্যাক্সিডারমিস্ট মিস্টার ফ্লেভিয়ান-এর দোকান, কাৰ্থবাটসন অ্যান্ড হারপার-এর ম্যানেজার হালদারবাবু যত্ন করে বানিয়ে দিয়েছিলেন। ভটকাই আজকে ‘ভটু’ হতে পারে কিন্তু এসব খবর সে জানবে কোত্থেকে! ও তো দুদিনের বৈরাগী, তাই ভাতকে বলে ‘অন্ন’। এসব জানে একমাত্র রুদ্র রায়ই।
ভাবছিলাম, আমি।
ব্যাগটা খুলে, ডিজিটাল ডাইরিটা বের করে, আমার হাতে দিয়ে বলল, ‘H’ বার কর তো।
বার করলাম।
এবার বের কর Ronald Harper
বের করে বললাম, করেছি। পু
রো ঠিকানা ও ফ্যাক্স নাম্বার বের করে ফেল।
করলাম।
ভাল করে রেখে দে তোর কাছে।
এ কোথাকার ফ্যাক্স নাম্বার?
আমি জিজ্ঞেস করলাম।
সিডনির ফ্যাক্স নাম্বার। অস্ট্রেলিয়ার। ঠিকানাটা বুঝি দেখলি না?
পাওয়ার অফ অবসার্ভেশান বেটার কর আরও।
তাই। রোনান্ডও আমার এক বন্ধু। রোনাল্ড, স্টিভ-এরও বন্ধু।
স্টিভ ওয়া?
এবার তিতির বলল।
আজ্ঞে না স্টিভ হলেই কি ওয়া হতে হবে? তোকেও দেখি ভটুর রোগে ধরল! শচীন হলেই কি তেণ্ডুলকার হতেই হবে? শচীন শাসমল, শচীন আঢ্য, বা শচীন তলাপাত্ররা কি কেঁদে মরবে তা হলে? স্টিভ এডওয়ার্ড। স্টিভ নিউজিল্যান্ডে তার দিদির কাছে গেছে। তিনদিনের জন্যে। তাই এই নোটটা লিখে দিচ্ছি তুই রোনাল্ডকে একটা ফ্যাক্স করে দিয়ে উত্তরের জন্যে অপেক্ষা করবি। উত্তর না পেলে, আই এস ডি বুথ-এ বলে আসবি যে, কাল ভোরেই তুই আবার যাবি উত্তরটা নিয়ে আসতে। উত্তর অবশ্যই আসবে। বলেই, ঋজুদা স্ক্রিবলিং প্যাড বের করে তার পকেটের ক্রস বল পয়েন্ট পেনটা তুলে নিয়ে লিখল, DEAR RON,
PLEASE CONTACT STEVE AT NEWZEALAND RIGHT NOW AND PLEASE ASK HIM ABOUT THE WEAPONS MAC TAILOR USED MOST. PLEASE ALSO ASK HIM WHETHER ANY PARTIC ULAR WEAPON WAS USED BY MAC FOR SHOOTING MOOSES.
PLEASE TREAT THIS AS VERY IMPORTANT AND REQUEST HIM TO FAX BACK THE INFORMATION IMMEDIATELY AT THE FAX NUMBER QUOTED ABOVE. PLEASE CONVEY TO HIM THAT I HAVE REACHED THE GUNJE THIS MORNING, AND AM TRYING TO GET IN TOUCH WITH HIS SHOOTING PAL.
REGARDS TO YOU AND STEVE.
YOURS WRIJU BOSE
C/O. MR. CAMERON’S GUEST
HOUSE MCCLUSKIEGUNGE. DT. RANCHI.
Message-টা লিখে কাগজটা আমার হাতে দিল ঋজুদা।
এই কাগজ ফ্যাক্স মেশিনে নেবে তো?
তিতির সন্দেহের গলাতে বলল।
আমার এই প্যাডটা ফ্যাক্স-এর কাগজ দিয়েই তৈরি।
এতগুলো please লিখলে কত টাকা বেশি লেগে যাবে। please গুলো বাদ দিলে হয় না?
ভটকাই বলল।
Text থেকে please বাদ দেওয়া ধড় থেকে মুণ্ডু বাদ দেওয়ারই মতো অপরাধ। ভদ্রতার বালাই তো স্বাধীন হয়ে যাবার পরে আর রাখিনি আমরা!
তিতির বলল, আমার বাবা প্রায়ই বলেন এ কথা।
সেটা ঠিক যেমন, তেমন অন্য কথাও ভাবার আছে। তুই ইংল্যান্ডের যে কোনও কাউন্টিতে এখনও যদি পথ পেরুবার জন্যে পথের ধারে এসে দাঁড়াস, দ্রুত-ছুটে-যাওয়া গাড়ির সারি ভ্যাকুয়াম ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়বে নিজেদের থেকেই, কোনও পুলিশ বা ট্রাফিক সিগন্যাল ছাড়াই। তুই জেব্রাক্রসিং দিয়ে পথ পেরিয়ে গেলে তারপরেই আবার চলতে শুরু করবে সব গাড়ি। যে-কোনও প্রকৃত স্বাধীন ও সভ্য দেশে ব্যক্তির দাম আছে। প্রত্যেকটি পথচারী মানুষকেও মানুষ’ বলে মান্য করা হয় সেখানে। ভদ্রতা সভ্যতা Please! Thank you! Excuse Me! এসব ওখানকার জীবনযাত্রার অঙ্গ। কিন্তু তোরা মনে কর চৌরঙ্গি বা ডালহৌসি দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিস তখন তোরা Excuse me please বলতে থাকলে বা কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেলে sorry বলবার জন্যে দাঁড়ালে লোকে তোদের পাগল তো ভাববেই, পা মাড়িয়ে দিয়ে ধাক্কা মেরে চলেও যাবে, তা ছাড়া তোরও এক পাও এগুনো হবে না।
যস্মিন দেশে যদাচারঃ বুঝলি না! আমাদের জনসংখ্যার বুজরুকিতেই সব ধান খেয়ে গেল, একটা সমস্যার সমাধান করলেই তো আরেকটা সমস্যা এসে ঘাড়ের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
ভটকাই বলল।
ঋজুদা বলল, তোর হবে ভটু। আজকের দিনের সবচেয়ে লাভজনক যে পেশা, বিনা-লগ্নির পেশা, যা শুধু বক্তৃতাবাজিরই পেশা, সেই রাজনীতিতেই নেমে যা।
এমন সময় কিষুণ ফিরে এল।
ঋজুদা বলল, কেয়া বোলা মাজিদনে?
বোলিন কি, যো লিন্ডিল সাব পিতে হ্যায়।
ক্যা পিতে হ্যায়। পুছাতা?
নেহি তো হুজৌর।
ঠিক হ্যায়। তুম যা কর আরাম করো ওর কিচেনমে যা কর বোল দো ক্যায়া খায়েগা তুমনে। যো দিল চাহতা হ্যায় ওহি খাও।
বহত আচ্ছা হুজৌর।
কিষুণ চলে গেলে তিতির ঋজুদাকে বলল, এতবার হুজৌর হুজৌর করে কেন? অতি-ভক্তি চোরের লক্ষণ।
এটা ঠিক বললি না। এটা সহবৎ-এর ব্যাপার। ও যে আমাকে বা তোদের সম্মান দিয়ে কথা বলছে তাতে তো ও নিজেও সম্মানিত হচ্ছে। রাজা সবারে দেন মান, সে মান আপনি ফিরে পান’ ওটা শুধু রাজার বেলাই প্রযোজ্য নয়, সকলের বেলাতেই প্রযোজ্য। ওড়িশাতে সাধারণ মানুষ কথায় কথায় বলে আইজ্ঞাঁ, আইজ্ঞাঁ’, যারা একটু লেখাপড়া শিখেছে তারা বলে স্যর’, ‘স্যর। আবার অন্যত্র বলে, জি! জি! তুই যদি খুব বেশি সম্মানের যোগ্য হোস তবে বলবে স্যার! স্যার! স্যার! স্যার! জি! জি! জি! জি! চারবার।
আমরা সকলেই হেসে উঠলাম ঋজুদার কথা শুনে।
এতগুলো স্যার বা জি যারা বলে তারা নির্ঘাত চোর।
তিতির বলল।
ঋজুদা বলল, সেটা মন্দ বলিসনি।
ঋজুদা প্যাড থেকে আরেকটা স্লিপ ছিঁড়ে নিয়ে কী দু-তিনটে নাম লিখল। তারপর আমাকে বলল, এটা রেখে দে। যখন রাঁচি যাবি তখন মেইন রোড-এর ওপরে যে বড় দোকানটা আছে সেখান থেকে এগুলো কিনবি। কিষুণকেও বলে দেব। সে চেনে। মোহনের অ্যাকাউন্ট আছে ওই দোকানে। দোকানি আমাকেও চেনে। তবে টাকা না দিতে চাইলেও জোর করে দিবি।
পয়সা লাগবে না?
লাগবে না। মোহন যদি জানে যে, আমি ওর রাজত্বে এসেও কোনও জিনিসের দাম দিয়েছি, তাহলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দেবে।
ঠিক আছে।
ভটকাই বলল, ভাই হো তো অ্যায়সা।
.
এমনিতে দুপুরে কখনওই ঘুমোই না কিন্তু আজ গভীর ঘুমে ছিলাম।
রাতে ট্রেনে ভাল ঘুম হয় না। সে থার্ড ক্লাস স্লিপারেই তোক কি ফার্স্ট ক্লাস এ-সি-তে। দুপুরে খাওয়াটাও বেশি হয়ে গেছিল। অড়হর ডালটা বিহারিরা বড় ভাল বানায়। খুশবুদার চাল। বড় বড় টুকরো করে বেগুন ভাজা, বড় লঙ্কা ভাজা, ডিমের কারি এবং পুদিনার চাটনি। শেষে দই।
ভটকাই আর আমি এক ঘরে। এক পাশের ঘরে তিতির আর অন্য পাশের ঘরে ঋজুদা। ভটকাই ঘুমন্ত আমাকে এমনই এক ঠেলা দিল যে খাট থেকে পড়েই যাচ্ছিলাম। সে বলল, তিনটে বেজে গেছে। ঋজুদা দুবার দেখে গেছে যে, তুই কুম্ভকর্ণর মতো ঘুমোচ্ছিস। এত ঘুমকাতুরে হলে তোকে পরের বার আর আনবে বলেছে।
কাঁচা ঘুম ভেঙে উঠে আমি বাথরুমে গিয়ে চোখমুখে জল দিয়েই বললাম, যাচ্ছি। কিষুণ কোথায়?
সে তো গাড়ি নিয়ে দুয়ারে প্রস্তুত। কিন্তু তোকে তো একা ছেড়ে দেওয়া যায় না। তুই যা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয়েছিস আজকাল। তাই আমাকেও যেতে বলেছে তোর সঙ্গে।
তাহলে তিতির কী দোষ করল?
সে তো নেচেই আছে।
আমরা যখন বারান্দা পেরিয়ে গাড়ির দিকে যাচ্ছি দেখি ঋজুদা তার ঘরের সামনের ইজিচেয়ারে বসে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে পাইপ খাচ্ছে বারান্দার থামে পা তুলে দিয়ে।
আমাকে দেখে বলল, ওদেরও নিয়ে যাচ্ছিস নাকি? তা যা। তবে রাঁচিতে কাজ সেরেই চলে আসবি। যেতে আসতে তিন ঘণ্টা লাগবে। তোদের ফিরতে ফিরতে কম করে সাড়ে ছ’টা তো হবেই। তবে চিন্তার কিছু নেই। মিসেস কার্নির মাজিদ এসে খবর দিয়ে গেল একটু আগে যে মিঃ লিন্ডওয়াল আমাদের সকলকে রাতে ডিনারে ডেকেছেন। সাড়ে সাতটার সময় পৌঁছতে হবে। তার আগে তোরা ফিরলেই হবে। ফিরেও চানটান করে সাজুগুজু করে নিতে পারবি। যা, আর দেরি করিস না।
বুঝলাম যে ঋজুদা ভটকাইকে কিছুই বলেনি। ঋজুদার হাজারিবাগী বন্ধু গোপালদার ভাষাতে যাকে ‘তিড়ি’ মারা বলে তাই মেরেছে ভটকাই আমাকে। মহা খতরনাক হয়ে উঠছে ছেলেটা দিনে দিনে।
গাড়ি ছেড়ে দিল কিষুণ।
বললাম, খানা ঠিক থা? ঠিকসে খায়া তো?
জি মালিক। ডাটকে খায়া। জারা জলদি নিকালনেসে ঠিক থা। আতে আতে সাম হো যায়েগা। আজকাল সব্বে জংলি জাগেমে সামকো বাদ ডাকেইতি হোতা হ্যায়।
ভটকাই বলল, ঘেবড়িও না ভাইয়া, এই বাবুর কাছে কড়াক-পিং হ্যায়। হামলোক পুরি দুনিয়ামে ডাকাত শায়েস্তা করতা হ্যায়। উ সব ভয় হামলোগকো নেহি হ্যায়।
কিষুণ হাঁ করে ভটকাই-এর হিন্দি শুনছিল আর তিতির মুখ টিপে হাসছিল।
পকেট থেকে ঋজুদার দেওয়া ফ্যাক্স করবার চিঠিটা আরেকবার পড়লাম আমি। নাম্বারটাও দেখলাম। (613) 93282219 Ronald 13/110 Arden St. North Melbourn, 3051 Victorial Australia.
আর অন্য স্লিপে লেখা আছে One Bacardi Rum, One Black dog Whisky, One Gilby’s Gin.
সময় সবচেয়ে বেশি লাগল রাঁচি শহরের দশ কিমি আগে থেকে শহরে ঢুকতে। কিষুণ বলল, টাউন বাড়তে বাড়তে কোই রোজ বিজুপাড়াতক হি পৌঁছ যায়েগা।
বিজুপাড়া হচ্ছে সেই মোড়, যেখান থেকে আমরা রাঁচি থেকে ডানদিকে ঢুকেছিলাম। কিষুণই বলল, বিজুপাড়া রানচি সে বিশ মিল ওর ম্যাকলাসকি বিজুপাড়া সে পন্দরা মিল।
বিজুপাড়ার পরেই মান্দার। এখানে মিশনারিদের হাসপাতাল আছে, চার্চ আছে। এই হাসপাতালেই তাহলে ডরোথি মেমসাহেবের ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া চিকিৎসা হয়েছিল।
বড় হাট বসে এখানে। না?
তিতির জিজ্ঞেস করল কিষুণকে।
জী হাঁ। মালকিন।
তুমি জানলে কী করে?
আমি জিজ্ঞেস করলাম তিতিরকে।
‘কোয়েলের কাছে’ উপন্যাসটি শেষ হয়েছে এই মান্দারেই এসে। বাস দাঁড়িয়ে আছে হাটের পাশে। লাতেহার থেকে বাসে চড়েছিল লাল সাহেব। অরণ্যর স্বর্গ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে কলকাতার নরকে। একটা ওঁরাও ছেলে একটা ওঁরাও মেয়েকে একটি কবিতা বলছে ফিসফিস করে।
হালফিল-এর মেয়েরা প্রজাপতির মতো নরম!
ঈসস। হাত ছুঁইয়ে দেখ, প্রজাপতির মতো নরম! ভটকাই হঠাৎ চিৎকার করে উঠে বলল, উঃ। আর পারা যায় না, আর পারা যায় না। হালফিল-এর মেয়েরা সব কাঁকড়া বিছে! প্রজাপতির মতো নরম না আরও কিছু!
.
ঋজুদা বলেছিল ঠিকই। ফিরতে ফিরতে আমাদের সোয়া ছ’টা হল। সবে অন্ধকার নেমেছে। তবে চাসা থেকে ম্যাকক্লাস্কির পথে কিযুণের টাটা-সুষমা ঢোকামাত্র আমি কোমরের সঙ্গে বাঁধা হোলস্টারের বোতাম খুলে পিস্তলটাকে বের করে ম্যাগাজিনটা আর চেম্বারটা দেখে নিয়ে আবার ম্যাগাজিনটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে পিস্তলটাকে হোলস্টারে ঠেলে দিলাম। তবে বোতামটা আর বন্ধ করলাম না। যাতে প্রয়োজনে, এক লহমাতে হোলস্টার থেকে টেনে বের করা যায়। আমাদের দেশে এখন জান বাঁচানোর জন্যে পিস্তল রিভলভার বা অন্য কোনও আগ্নেয়াস্ত্রই রাখা যায় না। তা ব্যবহার করা, ব্যবহার না করার চেয়েও বিপজ্জনক। বিপদে পড়ে, লাইসেন্স যাদের আছে তারাই। চোরাই পিস্তল দিয়ে দিনে দুজন মানুষকে খুন করে বেড়ালেও তার কোনও দায়িত্ব নেই। ধরা আর কজন খুনি পড়ে এখানে! আইন যারা মানে, সব আইনই, তাদেরই সমূহ বিপদ!
ক্যামেরনের গেস্ট হাউসে আমরা যখন পৌঁছলাম তখন ঋজুদা বলল, ফ্যাক্স-এর উত্তর পেলি?
হ্যাঁ।
কী লিখেছে স্টিভ।
স্টিভকে ধরতে পারেনি তোমার বন্ধু রণ। এই দেখ।
FOR WRIJU BOSE, RANCHI/BIHAR/INDIA
DEAR WRIJU
SORRY! STEVE IS OUT FISHING. SPOKE TO HIS SISTER AND MOTHER. HE WILL SEND YOU A REPLY TOMORROW AT THE NUMBER GIVEN
LOVE!
TAKE CARE.
RON
নোটটা পড়ে ঋজুদা বলল, আই এস ডি-র বুথ-এ বলে এসেছিস?
হ্যাঁ। বলেছি, কিষুণকে পাঠাব আটটার মধ্যে। বাজার থেকে মাছ কিনে ফ্যাক্স মেসেজটা নিয়ে দশটার মধ্যে ফিরে আসতে পারবে, যাতে চাট্টি নদীতে পিকনিকে যেতে পারি আমরা।
পিকনিকে কেউ মাছ খায় শুনিনি তো!
ছোট মাছ ভাজা খাব। বড় মাছ যা পাবে তা ফ্রিজ-এ রাখতে বলব। মিস্টার লিন্ডওয়ালরা আমাদের খাওয়ালে আমাদেরও তো ওঁদের খাওয়াতে হবে একদিন। কিষুণকে মিষ্টিও নিয়ে আসতে বলেছি। এখানে তো ভাল মিষ্টি পাওয়া যায় না।
বাবাঃ। বুদ্ধি দেখি বেড়ে গেছে ম্যাকক্লাস্কিতে এসে।
ঋজুদা বলল, আমাকে।
আমি উঁচু বল পেয়েই স্ম্যাশ করলাম।
বললাম, বুদ্ধি বলে আমার কি আর কিছু আছে!
থাকবে না কেন? বুদ্ধি সকলেরই থাকে। তোর সুবুদ্ধি আর ভটকাই-এর কুবুদ্ধি।
আর তিতিরের?
তিতির তোদের দুজনের বুদ্ধির খটাখটি দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেছে।
তবে আমরা সকলেই বুদ্ধিজীবী তো!
তা তো নিশ্চয়ই! লেখাপড়া শিখলেই বুদ্ধিজীবী! তা সে মানুষ গাঁটকাটাই হোক কি মিথ্যাচারী, কি পরান্নপ্রত্যাশী। বুদ্ধিজীবীরাই আজ সবচেয়ে অসৎ, ধান্দাবাজ, নীচ, নীতিহীন। বুদ্ধিজীবী শব্দটার মানেই বদলে গেছে আমার কাছে।
তারপরই বলল, যা, তোরা চান-টান করে তৈরি হয়ে নে। আমরা ঠিক সাতটা কুড়িতে বেরোব। বোতলগুলো গাড়িতেই থাক কিযুণের জিম্মাতে।
তাই আছে।
ঠিক আছে। আমি চান করতে গেলাম।
হ্যাঁ। আমরাও যাচ্ছি।
.
লেভেল ক্রসিং-এর গেট বন্ধ ছিল। একটা প্রায় আধ কিমি লম্বা মালগাড়ি এল। সম্ভবত কয়লা নিয়ে আসছে। ধানবাদ বা রানীগঞ্জ এর খাদান থেকে। ওয়াগন যাচ্ছে তো যাচ্ছেই ঘটঘটর করে। শেষ নেই।
ভটকাই বলে উঠল, এ যে দেখছি সগর রাজা রে!
আমি আর ঋজুদা হেসে উঠলাম।
তিতির বলল, সে কে?
অ্যাই তো মেমসাহেব! ইংরেজিতে তুবড়ি ফোঁটাও। ফ্রেঞ্চ, জার্মান, অনর্গল বলতে পার, আর সগর রাজা যে কে, তাই জানো না। সগর রাজার ষাট হাজার ছেলে ছিল। এই ট্রেনটারও মনে হচ্ছে ষাট হাজার ওয়াগন।
আমরা গিয়ে পৌঁছলাম লিন্ডওয়ালদের ‘The Ucalypta’ বাংলোতে সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশে।
গেট পেরিয়ে দুপাশের গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে অনেকখানি গিয়ে বাংলোটা। চোদ্দ-পনেরো বিঘা জমি আছে মনে হয়। এখনও ফায়ার-প্লেস জ্বলে বেশি শীত পড়লে। রান্নাঘরের আর বসার ঘরের মাথার ওপরে ধুয়ো বেরবার জন্যে চারকোনা আকৃতির ইট-সিমেন্টের গম্বুজ মতো। ছবিতে ইংল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডের বাড়িতে যেমন দেখা যায়। বারান্দাটা বেশ চওড়া। বড় বড় চেয়ার পাতা আছে। ঝুলছে পোড়ামাটির ছোট ছোট টবও, বারান্দার কাঠের কাঠামো থেকে। তিন-চার ধাপ সিঁড়ি বেয়ে বারান্দাতে উঠতে হয়। সাহেব আর মেমসাহেব আমাদের অভ্যর্থনা করলেন বারান্দাতে দাঁড়িয়ে। তারপর নিয়ে গিয়ে বিরাট লিভিংরুমে বসালেন।
ঋজুদা আমাকে বলল, কী রে রুদ্র। পোঁটলাটা আন।
আমি বললাম, পোঁটলা মানে?
আঃ মানে, প্রেজেন্ট-টা।
ও।
বলে গাড়িতে গিয়ে, রাঁচি থেকে কেনা জিনিসগুলো-ভরা প্লাস্টিকের ব্যাগটা নিয়ে এলাম।
ঋজুদা বলল, কিষুণকে বল, মাজিদকে নামিয়ে দিয়ে, ফিরে যাবে। খেয়েদেয়ে সাড়ে ন’টা নাগাদ যেন এখানে আবার আসে।
আমরা হেঁটে যেতে পারি না ফেরার সময়ে? সারাদিন তো বসাই বলতে গেলে।
তিতির বলল।
তাই ভাল। তাই বলে দে কিষুণকে। টর্চ এনেছিস কেউ?
টর্চ কী হবে? দ্যাখো না কেমন চাঁদ উঠেছে।
তিতিরই বলল।
ঋজুদা বলল, বাংলাতে কিন্তু আর কোনও কথাবার্তা নয়। সেটা অভদ্রতা হবে। কোনও ভাষা কেউ না জানলে সেই মানুষের সামনে সেই ভাষাতে কথা বলাটা চরম অভদ্রতা। আর ভটকাই, তুই যে বোবা ও কালা আমি ওদের জানিয়ে দেব। তুই বেঁচে গেলি। ইংরেজি বলতে হবে না। তুই হিন্দিটা বলতে পারলেও হত।
হিন্দি তো দারুণ শিখে গেছি। তুমি শোনেননি, তাই বলছ।
তিতির হেসে বলল, আমরা শুনেছি।
কখন?
যখন কিষুণের সঙ্গে বলছিলে।
কেমন? ভাল নয়।
আমি বললাম, গাধার পিঠে রাইডিং-এর মতো।
ভটকাই গুম মেরে গেল। তা দেখে বড় আহ্লাদ হল আমার।
বোবারা কিন্তু কালাও হয়।
ভটকাই ঋজুদাকে মনে করিয়ে দিল।
সেটা তুই মনে রাখিস, তাহলেই হবে।
বিরাট বসবার ঘরের দেওয়ালে একটা মস্ত বড় বাঘের চামড়া টাঙানো আছে। ভাল্লুকের মাথা। শম্বরের শিং। চিতল হরিণের মাথা। মাউন্ট করা। বহু পুরনো। নিশ্চয়ই মিসেস লিন্ডওয়ালের পৈতৃক সম্পত্তি হবে। ১৯৭২ থেকে শিকার বে-আইনি হয়ে গেছে। বে-আইনি শিকারের ট্রফি কেউ টাঙিয়ে রাখে না।
মিস্টার লিন্ডওয়ালের বয়স চল্লিশ মতো হবে। বেশ শক্ত সমর্থ সুপুরুষ। লম্বা। প্রায় ছ’ফিটেরও বেশি। ফ্ল্যানেলের কালো একটা ট্রাউজার-এর ওপরে বিস্কিট-রঙা টুইডের কোট। আর মিসেস লিন্ডওয়াল তো পরমা সুন্দরী। তাঁর বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হবে।
ঋজুদা, আমাদের সকলের সঙ্গে একে একে তাঁকে আলাপ করিয়ে দিলেন।
ভটকাই-এর নাম শুনে, মিঃ লিন্ডওয়াল বুঝতে না পেরে বললেন, ভোডকা।
তিতির বলল, নো, নো। ভটকাই।
ঋজুদা ওঁকে তারপর বলল, গঞ্জে এসে সেটল করেন সাধারণত রিটায়ার্ড মানুষেরাই। সেই তুলনায় আপনি তো একেবারে ছেলেমানুষ। দ্বিতীয়ত এখানের আশিভাগ মানুষ যখন অস্ট্রেলিয়াতে চলে গেলেন এ দেশ ছেড়ে তখন আপনি অস্ট্রেলিয়া থেকেই এদেশে এলেন এইটা জেনেই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে খুব ইচ্ছা হল। তা ছাড়া শিকারের কমন-ইন্টারেস্টও আরেকটা কারণ।
মিঃ লিন্ডওয়ালের ফাস্ট নেম কেনেথ আর মিসেস-এর ডরোথি।
কেনেথ হেসে বললেন উই আর অনারড। আপনার কথা আর একজন লেখকের কথা, এখানে আসার পর থেকে অনেকই শুনেছি বড়লোক-গরিবলোক অনেকেরই মুখে। তবে সেই লেখকই এই জায়গাটাকে ট্যুরিস্ট-স্পট বানিয়ে ফেলে এর সর্বনাশ করেছেন।
এখনও সর্বনাশ হয়নি কিন্তু। আশ্চর্য! আমিও তো বহুদিন পরে এলাম। ভিতরে ভিতরে জঙ্গল কাটা হয়েছে অবশ্যই, সেই আগের মতো নিবিড় বনাঞ্চলে মোড়া পাহাড়-উপত্যকা আর নেই। তবু এখনও সবুজ আছে, শান্তি আছে। এই বা কম কী?
তা ঠিক।
ঋজুদা মিসেস লিন্ডওয়ালের দিকে তাকাল। সিল্কের একটা সাদা ব্লাউজ আর কালো সিল্কের মধ্যে কাঁথার কাজের লাল ফুল তোলা একটা স্কার্টে তাঁকে পরীর মতো দেখাচ্ছিল।
তারপর বলল, আপনাকে আমি বলতে পারি যে, আপনার দিদিই বেশি সুন্দরী ছিলেন না আপনিই, তা বিচার করতে বসলে কাকে যে বেশি নম্বর দিতে হবে তা নিয়ে বিতর্ক উঠতেই পারে।
ডরোথি খুশি হয়ে বললেন, আপনি আমার দিদিকে চিনতেন?
বিলক্ষণ চিনতাম। মিসেস কিংকে কে না চিনত এখানে? ওরকম ডিগনিফায়েড সুন্দরী খুব কমই দেখেছি। আর কী ভাল কেক বানাতেন। একবার মনে আছে, আমার জন্মদিনে এখানে ছিলাম। আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব এসেছিলেন। তাঁরাই গিয়ে মিসেস কিং-এর কাছে বার্থডে কেক-এর অর্ডার করে এল গিয়ে। অত সুন্দর ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক কলকাতার স্কাইরুম বা তাজবেঙ্গলের পেশিপও করতে পারবে না। মনে আছে প্রতিদিন, প্রবল বর্ষার সময়টুকু ছাড়া, মিসেস কিং হেঁটে যেতেন আমার বাংলোর সামনে দিয়ে বিকেলে। কোথায় যেতেন তা বলতে পারব না। আমি আমার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে তাঁকে উইশ’ করতাম। উনি ‘উইশ-ব্যাক’ করতেন। মিস্টার কিংকেই বরং দেখিনি কোনওদিন। কারণ উনি বিশেষ বেরতেনই না এবং আমিও কারও বাড়িতেই যেতাম না। মিসেস কিং-এর সঙ্গে হাঁটতে বেরিয়েও দেখা হত। এখানের বাংলো বিক্রি করে দেওয়ার অনেকদিন পরে কলকাতাতে বসেই একদিন প্যাট গ্লাসকিন-এর চিঠিতে যখন জানলাম যে উনি মারা গেছেন, ভীষণই দুঃখ পেয়েছিলাম।
ডরোথি বললেন, আমার জামাইবাবু তো মারা গেলেন তার পরপরই।
সে খবরও পেয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে গঞ্জ-এর সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গেছিল।
এই প্যাকেটে কী আছে?
কেনেথ জিজ্ঞেস করলেন।
Some Booze, ঋজুদা বলল।
দিস ইজ নট ডান।
কেনেথ বললেন।
ইউ হার্ডলি নো আস।
কিন্তু আমাদেরও তো না-চিনেই নেমন্তন্ন করলেন ডিনারে। তা ছাড়া আমি আপনার বেটার-হাফকে তো চিনিই!
আপনার কথা আলাদা।
কেন?
ইউ আর আ সেলিব্রিটি।
কীসের জন্যে?
ফর ইওর ভার্সেটাইলিটি।
সো ইজ ইওর ওয়াইফ।
ফর হোয়াট?
ফর হার বিউটি।
সকলেই একসঙ্গে হেসে উঠলাম ও উঠলেন। কিন্তু হাসতে আরম্ভ করেই ভটকাই-এর মনে পড়ে গেল যে, ও কথাও বলতে পারে না, শুনতেও পায় না। তাই মাঝপথেই হাসি থামিয়ে ও একখানা মুখ যা করল, তা দেখে মনে হল ঢাকা আয়ুর্বেদিক ঔষধালয়ের সারিবাদি-সালসাই বুঝি আধ গেলাস গিলেছে এক চুমুকে।।
কেনেথ বললেন ঋজুদাকে, হোয়াটস ইওর ড্রিঙ্ক?
আপনি যা খাবেন তাই খাব। আমার নিয়মিত খাবার অভ্যেস নেই।
আমাদের তিনজনের চোখ কপালে উঠে গেল। ঋজুদা কখনই এসব খায় না। কেউ খেলে, অবশ্য বাধাও দেয় না। দুএকবার জঙ্গলে বিপদে-আপদে কনিয়াক খেতে দেখেছি আর বাঘমুন্ডার বাঘিনীটি যখন ঋজুদাকে আহত করে নন্দিনী নালার পাশে, তখন অংগুলের বিমলবাবুর দেওয়া স্কচ-হুঁইস্কি খেয়েছিল, স্ট্রেইট ফ্রম দ্যা বটল, ওষুধ হিসেবে, শক কাটাবার জন্যে, যাতে ঘুমিয়ে না পড়ে সে জন্যে।
কেনেথ বললেন, আমি কনটেসা রাম খাই। ডরোথিও তাই খায়। এখানে তো সবকিছু পাওয়া যায় না। রাঁচির এক আর্মি অফিসার আছেন তিনিই মিলিটারি কোটা থেকে তুলে রাখেন সস্তাতে, মাসে একবার রাঁচি গেলে নিয়ে আসি।
ঋজুদা বলল, আমি আপনারা কী খান তা না জেনে আন্দাজেই বাকার্ডি হোয়াইট রাম, গিলবীর্জ জিন আর ব্ল্যাকডগ হুইস্কি নিয়ে এসেছি। ব্ল্যাকডগ তো আজকাল এখানেই হচ্ছে।
বাঃ বাঃ করেছেন কী? এসব তো খুবই দামি জিনিস। এমন অপাত্রে দান। হাতে করে এনেছেনই যখন তাহলে আপনি হুইস্কিই খান।
না, না। এ সবই আপনাদেরই জন্যে। আমি, আপনারা যা খাবেন তাই খাব।
কেনেথ উঠে গেলেন লিভিং রুমের এক কোনাতে। সেখানেই তাঁর সেলার এবং ছোট্ট বার। ডরোথি ভিতরের খাবার ঘর থেকে বরফ নিয়ে এলেন। আর লেবুর স্লাইস। ডালমুট-এর একটি প্যাকেট খুলে বড় প্লেটে রাখলেন, তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললেন, নাউ টেল মি ইয়াং ওয়ানস, হোয়াট আর ইওর ড্রিঙ্কস?
এনিথিং সফট।
তিতির বলল।
এখানে তো থাম্পসআপ বা কোক ভাল পাওয়া যায় না। ওসব আজকাল জালও হয় শুনি। তোমাদের অরেঞ্জ স্কোয়াশ বা লেমন স্কোয়াশ-এর সঙ্গে ঠাণ্ডা জল আর বরফ দিয়ে শরবত করে দিই?
ফাইন।
তিতির বলল।
তোমাদের বরফ দেব তো? না কি গান গাও কেউ?
হ্যাঁ, বরফ দিতে পারেন সকলকেই।
আমি বললাম।
ভটকাই সেই যে ইংরেজি বলতে হবে, সেই ভয়ে হাঁ হয়ে রয়েছে তো রয়েছেই। এমন করেই হাঁ করে আছে যে মুখে মশা ঢুকে যায়।
আইস ফর ড্য? মিঃ বোস?
ইয়েস প্লিজ! প্লেন্টি।
সকলের পানীয় যখন দেওয়া শেষ হল তখন ডরোথি বললেন, আমি একবার কিচেনে গিয়ে অবস্থাটা দেখে আসি। তোমরা গল্প করো। আমি এই এলাম বলে।
তিতির দাঁড়িয়ে উঠে বলল, ডু ইউ নিড এনি হেল্প মিসেস লিন্ডওয়াল?
থ্যাঙ্কস আ লট। কোনও দরকার নেই। আমার একজন মেইড আছে সাহায্য করার জন্যে। তোমরা গল্প করো।
মাজিদ বলছিল আপনার শিকারের খুব শখ আছে।
ছিল। একসময়ে।
তারপরেই বলল, আমাদের নেবার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রামদাস-এর বাড়িটা এখন দেখলে তার আগের রূপ ভাবতেও পারবেন না। একেবারেই অন্যরকম ছিল। খামারবাড়ি যেমন হওয়া উচিত আর কী। এটা ছিল দাশগুপ্তর বাড়ি। ওঁরও শিকারের শখ ছিল। বাড়িটার সঙ্গে পেছনের জঙ্গলের সীমানার তো কোনও ঝগড়া ছিল না। শুয়োর, লেপার্ড, ভালুক সবই আসত।
আমার বাংলো থেকেও তো একদিন মালীর কুকুর নিয়ে গেল লেপার্ডে। পেছনের নালাতে ছিল ধেড়ে ধেড়ে শেয়ালের আড্ডা। রাতের বেলা বাংলোর হাতাতে ঢুকে এসে কামড়াকামড়ি করে পেয়ারা খেত।
ঋজুদা বলল।
সত্যি। এখানের গোরুরা, কুকুরেরা, শেয়ালেরা সকলেই পেয়ারা খায়। পরিবেশের সঙ্গে মানুষ এবং প্রাণী কী দারুণ মানিয়ে নেয় ভাবলেও ভাল লাগে।
এবারে বলুন শুনি শিকারের কথা। কী কী শিকার করেছেন আপনি অস্ট্রেলিয়াতে? এখানেই বা কী মারলেন? শুনেছি, আপনার নিজের ওয়েপন নেই?
না। এখানে নেই। তবে ওখানে ছিলই। অনেকই ওয়েপন ছিল আমার। যেমন সব স্পোর্টসম্যানেরই থাকে।
অস্ট্রেলিয়াতে কি শিকার-প্রাণী তেমন কিছু আছে?
আমি পূর্ব আফ্রিকাতেও সাফারি করেছি। উত্তর আমেরিকাতেও পারমিট নিয়ে। মুজ মেরেছি।
তাই? উত্তর আমেরিকাতেও? তা অস্ট্রেলিয়া তো শুনেছি ভীষণই সুন্দর জায়গা। দ্যা গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ–আরও কত কী আছে দেখবার। না?
হ্যাঁ। তাই ভাবি মাঝে মাঝে। কার ভাগ্য কার জীবন যে কবে কোথায় টেনে আনে কে বলতে পারে! ডরোথির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল অস্ট্রেলিয়াতেই। এখানের মানে গঞ্জ-এর মিস্টার অ্যান্ড মিসেস কাব্রাল সিডনিতে সেটল করেছেন।
আরে! চেনেন না কি তাঁদের। আমি তো মিস্টার কাব্রাল-এর মেয়ের কাছ থেকেই গঞ্জ-এর বাংলোটা কিনি। আমাকে বিক্রি করার পরই তো ওঁরা অস্ট্রেলিয়াতে চলে গেলেন। তাঁর স্বামী মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। নামটা মনে করতে পারছি না।
ওর নাম জোসেফ।
হ্যাঁ। হ্যাঁ। মনে পড়েছে।
তারপর?
তারপর আর কী? আমি তো অস্ট্রেলিয়ার বাসিন্দা নই, আমিও গেছিলাম সেখানে বেড়াতেই। ডরোথির সঙ্গে কাব্রোলদের বাড়িরই এক পার্টিতে দেখা হল। তারপরই আমার জীবনের এই নতুন অধ্যায়।
তারপর একটু চুপ করে রইলেন তিনি। এমন সময়ে ডরোথি এসে ঘরে ঢুকলেন।
কেনেথ বললেন, ডরোথির সঙ্গে প্রেমে পড়লাম প্রথম দর্শনেই। যাকে বলে, হেড ওভার হিলস। কিন্তু ডরোথি ফেলল আমাকে বিপদে। সে বলল, দিদি-জামাইবাবুর কোনও ছেলেমেয়ে ছিল না আমার বাবা-মায়েরও আর কোনও সন্তানই ছিল না। সকলেরই যা-কিছু স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল তা আমাকেই তাঁরা দিয়ে গেছিলেন। তার মূল্য টাকাতে বেশি নয়। কিন্তু সেন্টিমেন্টে অনেকই। আমি বললাম, আমি একজন ভাস্কর। পশ্চিমী দেশে বা নিদেনপক্ষে অস্ট্রেলিয়াতে। থাকলেও আমি যা উপার্জন করতে পারব তা যথেষ্ট আমাদের দুজনের পক্ষে। তোমাকে রানির মতো রাখতে পারব। কিন্তু…
কিন্তু কী?
কিন্তু ডরোথি বলল আমেরিকার বা অস্ট্রেলিয়ার সংস্কৃতির সঙ্গে আমার খাপ খায় না। তোমরা সবসময়ই ওপরের দিকে চেয়ে আছ। আমার দেশ ভারতবর্ষ। ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে যাও তো দেখবে নির্জনে অমন কাজের পরিবেশ কোথাওই নেই। তোমাকেও আমি ভারতীয় দর্শনে প্রভাবিত করব।
বাঃ।
ঋজুদা বলল, একটা টাক শব্দ করে গ্লাসটা শেষ করে, সাইড টেবল-এ নামিয়ে রেখে।
আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম ঋজুদার দিকে। কেনেথ ও ডরোথিও একটু অবাক হলেন, কারণ তাঁদের গ্লাস-এর এক-তৃতীয়াংশও খালি হয়নি তখনও।
কেনেথ উঠে বললেন, লেট মি ফিল উওর গ্লাস।
ঋজুদা বলল, নো নট নাউ। একসঙ্গেই নেব। তোমরাও বটমস আপ করো তাড়াতাড়ি। তারপরে।
আমি বুঝলাম পেট থেকে কথা বের করার জন্যে ঋজুদা ওঁদের বেশি মদ্যপান করাতে চায়। ওঁরাই যদি মাতাল হয়ে যান, মানে, যাঁরা রোজ এসব ছাইভস্ম খান, তাহলে তো ঋজুদাকে কাঁধে করে বয়ে ক্যামেরনের গেস্ট হাউসে নিয়ে যেতে হবে আমাদের।
আমরা তিনজনেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম।
কেনেথ ও ডরোথি ঋজুদাকে কোম্পানি দেবার জন্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওঁদের গ্লাস শেষ করলেন। ডরোথি বললেন, ওয়েল, ইফ আই গেট ড্রাঙ্ক, ড্য ওন্ট হ্যাভ এনি ডিনার। মাইন্ড উ্য।
ডাজনট ম্যাটার।
ঋজুদা বলল।
হঠাৎ ডরোথি তিতিরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা সকলেই পর্ক খাও তো?
ঋজুদা কথা কেড়ে বলল, শুয়োর তো রামচন্দ্রও খেতেন। শুয়োর কে না খায়।
ভাবলাম, এক গ্লাস খেয়েই কথা কাড়তে শুরু করল, এর পরে আর কী কাড়বে কে জানে।
বোবা ও কালা ভটকাই আপত্তি জানাতে চাইল খাওয়ার ব্যাপারে কিন্তু কী করে আপত্তি করবে ভেবে পেল না।
আমি ওর অবস্থাটা খুবই উপভোগ করছিলাম। তিতিরই ওকে শেষমেশ বাঁচাল। বলল, ভটকাই-এর জন্যে ডিমের যদি কিছু একটা করে দিতে বলেন। মেইডকে…
নিশ্চয়ই! বাই অল মীনস। তা ছাড়া, চিকেন বাটার-মশালাও আছে। পর্ক-এর ভিণ্ডালু করেছি।
ঋজুদা বলল, বাঃ।
ওরে রুদ্র। জমে যাবে আজ।
আমার লজ্জা করতে লাগল। আমরাই বুঝে গেলাম যে ঋজুদার নেশা হয়ে গেছে, তাহলে ওঁরা কী মনে করছেন!
‘ধূর্ত’ শব্দটা খারাপ অর্থেই ব্যবহৃত হয় কিন্তু আজ রাতে ঋজুদা যেভাবে কেনেথকে ফাঁসাবার জন্যে ধাপে ধাপে এগোচ্ছে তা দেখে ঋজুদা সম্বন্ধে আর কোন শব্দ ব্যবহার করব তা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হল, কেনেথ বড় সরল আর ভাল মানুষ। সে যদি সত্যিই খুন করে থাকে স্টিভ এডওয়ার্ড-এর বন্ধুকে, কী করে করল সেই জানে। সত্যি সত্যি খুন তো নাও করে থাকতে পারে। স্টিভের কথাই যে ধ্রুব সত্যি তা ঋজুদা জানল কী করে! স্টিভেরও অন্য কোনও কারণে কেনেথের বা ম্যাক-এর ওপরে যে কোনও বিদ্বেষ নেই তাই বা জানল কী করে।
নানা কথা বলতে বলতে কেনেথ অনেকগুলো রাম খেয়ে ফেললেন। ঋজুদাও সমানে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলল।
তিতির আমাকে আস্তে আস্তে ফিসফিস করে বলল রুদ্র তুমি কি হেঁটে গিয়ে কিমুণকে গাড়িটা নিয়ে আসতে বলবে? এরপরে কী হবে জানি না। রাত সাড়ে নটা বাজতে চলল। বাইরে তো নিশুতি রাত।
আমি বললাম, পাকালাম। তামিলনাড়ুর কামরাজ নাদার-এর মতো। পাকালাম একটি তামিল শব্দ। মানে হল, wait and see! এই শব্দটি প্রয়োজনে আমি আর তিতির দুজনেই ব্যবহার করি।
নানা কথার তোড়ে, হাসির বানে, শিকারের স্মৃতিচারণের মধ্যে দিয়ে কেনেথ যে কখন ঋজুদার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেললেন তা তিনি বুঝলেন না। গল্প করলেন উত্তর কানাডাতে মুজ মারার। বললেন, তাঁর সবচেয়ে প্রিয় রাইফেল ছিল হল্যান্ড অ্যান্ড হল্যান্ডের তৈরি পয়েন্ট থ্রি সেভেন্টি ফাইভ ম্যাগনাম। ডাবল ব্যারেল। কিন্তু মুজ-এর মতো বড় জানোয়ার, আফ্রিকাতে সিংহ, আমেরিকাতে জাগুয়ার বা বাইসন মারতে উনি ব্যবহার করতেন পয়েন্ট ফোর ফিফটি ফোর হান্ড্রেড ডি বি বি এল জেফরি নাম্বার টু।
ঋজুদা বলল, আমারও একটা করে আছে। জেফরির এ রাইফেলটা দিয়েই সুন্দরবনে এবং অন্যত্রও মানুষখেকো মেরেছি।
আমি হেসে বললাম, গত শীতে বাঘমুন্ডার বাঘিনী ম্যানইটারটা কী দিয়ে মেরেছিলে তাও বলো।
ঋজুদা হেসে উঠল।
কেনেথ আর ডরোথি হাসির কারণ না বুঝে বোকার মতো চেয়ে থাকলেন। মাতাল হলে মানুষকে বেশি বোকা লাগে।
গত বছর মেরেছেন?
হ্যাঁ। ম্যানইটার ডিক্লেয়ার্ড হয়েছিল তো। ওড়িশাতে।
আবারও কখনও গেলে আমাকে খবর দিয়ো কিন্তু।
ঋজুদা বলল, শ্যওর। ইটস আ ডিল।
ঋজুদার চোখ-মুখের ভাব যেন কেমন হয়ে গেছে। চোখদুটো লাল। কীরকম চোখে যেন তাকাচ্ছে ডরোথির দিকে। ডরোথি নিজেও অনেক মদ খেয়েছেন বলেই বোধহয় তা বুঝতে পারছেন না।
ভটকাই প্রায় আমার কানে কানে বলল, যতই সুন্দরী তোক আমার সেশ্যেলস-এর বউদির মতো নয়।
আমি হেসে ফেললাম।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে দশটা বাজল। দারুণ ভাল ক্যারামেল কাস্টার্ড বানিয়েছিলেন ডরোথি।
ঋজুদা জিভ দিয়ে বলল, নো ওয়ান্ডার। কার বোন তা দেখতে হবে তো।
আপনারা কদিন আছেন?
আমরা কালই চলে যাচ্ছি।
ঘরের মধ্যে বোমা ফাটিয়ে বলল, ঋজুদা।
আমি ভাবছিলাম, এই জন্যেই বাবা বলেন, মদ খাওয়া খুবই খারাপ।
ইসস। কালকেই? এক-দুদিন থাকলে এদের জন্যে একটু কেক করে পাঠাতাম।
পরের বার হবে। আমাদের একটু ডালটনগঞ্জে যেতে হবে। সেখানে আমার ছোট ভাইয়ের মতো, মোহন বিশ্বাসের শরীর খুবই খারাপ। ব্লাড সুগার ভীষণ হাই হয়ে গেছে। এদিকে এলামই যখন, তখন দেখেই যাই একটু।
ভটকাই-এর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল বোবা এবারে কথা বলবেই। পৃথিবীর কোনও শক্তিই তাকে আটকাতে পারবে না।
আমি আর তিতির বুঝলাম ওর মাথাতে চাট্টি নদীর পিকনিক ঘুরছে। কিন্তু ঋজুদা কী করে, কেন করে, কখন করে, অন্য আনপ্রেডিকটেবল মানুষদেরই মতো তা শুধু সে-ই জানে!
ডাইনিং রুম থেকে লিভিং রুম-এ এসে ঋজুদা বলল, এরপরে একটু ড্রামুই অথবা কনিয়াক অথবা কোয়াস্ত্র হলে একেবারে জমে যেত।
ওসব কী জিনিস, খায় না মাথায় মাখে, আমাদের কারোরই জানা ছিল না।
কেনেথ আর ডরোথি খুবই লজ্জিত হলেন। বললেন সরি। আমার কাছে যে কিছুই নেই। দাঁড়াও! টাকাপয়সা সব আনাই। ইন্ডিয়ান সিটিজেন হয়ে নিই, তারপর তোমাদের আলাদা করে ডাকব তখন কলকাতা থেকে।
এই যে আমার কার্ড।
ঋজুদা পার্স খুলে কার্ড বের করে দিল।
অথচ কারোকেই সচরাচর দেয় না।
কেনেথ ডরোথিকে দেখিয়ে বলল, এখানে ওই আমার কার্ড।
তারপর বলল, পরের বার বন্দুক নিয়ে এসো শীতে। তখন কুলথি আর অড়হর ডাল খেতে আসে শম্বর, আর এখন থাকলে কালই শুয়োর মারতে পারতে মকাই-এর ক্ষেতে।
ডরোথি বলল, তুমি কার কাছে কী বলছ। মায়ের কাছে মাসির গল্প। ঋজু বোস জানেন না এমন কোনও খবর নেই ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জের।
হঠাৎই ঋজুদা উঠে পড়ে একে একে দুজনের হাত ধরে বলল, ওয়েল ইট ওজ, ভেরি ভেরি নাইস মিটিং ঊ্য টু। কাম অ্যান্ড ভিজিট মি অ্যাট ক্যাল। আই হ্যাভ আ স্পেশাস ফ্ল্যাট ইন আ নাইস নোকালিটি। উ্য মে পুট আপ উইথ মি, ইফ জ্য উইশ। আই উইল ফিল অনার্ড।
‘পুট আপ’ মানে, ওঠা বুঝলাম। কোথায় উঠেছেন? ইংরেজি হবে ‘হোয়ার হ্যাভ উ্য পুট আপ’ বুঝলাম। ভাল করে কান খুলে শুনলে যাঁরা ইংরেজি ভাল জানেন, শুধু ইংরেজিটাই কেন, যে-কোনও ভাষাই, শিখে নেওয়া যায় একটু একটু করে। তবে শেখার ইচ্ছেটা থাকা চাই।
ওঁরা বড় রাস্তা অবধি আমাদের পৌঁছে দিলেন দুজনে। তারপরে ‘গুডনাইট’! ‘গুডনাইট’! করে আমরা রওনা হলাম। ঋজুদা ডরোথির ধবধবে নরম ডান হাতটা নিজের হাতে নিয়ে সামনে ঝুঁকে তাঁর হাতের পাতাতে একটা আলতো চুমু খেল। ইংরেজি সিনেমাতে যেমন দেখা যায় আর কী! আজ একেবারে সাহেব হয়ে গেছে ঋজুদা।
একই অঙ্গে কত রূপ।
ভাবছিলাম, ঋজুদার সত্যিই অনেকই রূপ। যেখানে যেমন মানায়।
তিতির বলল, এত রাত হয়ে গেল, ডাকাতি করবে না তো কেউ?
কেনেথ কথাটা শুনে বললেন, এখানের মানুষেরা খুবই ভাল। কৃতজ্ঞও। গরিব, তাই ছিনতাই-টিনতাই করে মাঝে মাঝে। মানে মাগিং আর কী।
শিখলাম, ছিনতাই-এর ইংরেজি মাগিং।
তারপর বললেন, ঋজু বোসকে ওরা কিছু বলবে না। ঋজু বোস আর সেই লেখকই তো এই অজপাড়াগাঁকে মান দিয়েছেন।
শেষবার গুডনাইট বলে আমরা পথে পা বাড়ালাম।
নিশুতি রাত। শিশিরে পথের ধুলো ভিজে গেছে। রাত পাখিরাও আজ ঘুমোতে চলে গেছে মনে হয়। দুপাশের গাছ-গাছালি থেকে সুন্দর এক মিশ্র গন্ধ বেরোচ্ছে।
ঋজুদা সোজা পা ফেলে হেঁটে যেতে লাগল। আমাদের আগে আগে। পা একটুও টলল না।
কী লোকরে বাবা!
তিতির বলল, ফিসফিস করে।
একটিও কথা বলল না আমাদের সঙ্গে ঋজুদা।
তার মুড দেখে আমরাও কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেললাম। বেশ ঠাণ্ডা। কে যেন বরফের সাঁড়াশি দিয়ে কান দুটো ছিঁড়ে নিচ্ছে।
কুয়াশার জন্যে চাঁদের আলো উপভোগ করা যাচ্ছে না।
একটু পরেই ঋজুদা কী একটা গান গাইতে লাগল। বারে বারে। প্রথমে গুনগুন করে। তারপর আস্তে আস্তে গানটা জোর হতে লাগল। এবারে বোঝা যেতে লাগল কথাগুলো। সেই নিঝুম শীতের রাতে গাছগাছালির মধ্যের জঙ্গলে লাল মাটির পথে আর শিশির ঝরানো আকাশে গানটার অনুরণন উঠতে লাগল। ঋজুদা আমাদের অনেক সময় গাইতে বলেছে কিন্তু নিজে কখনও এমন করে গান গায়নি একা একা। আমরা উৎকর্ণ হয়ে শুনতে শুনতে চলতে লাগলাম ঋজুদার একটু পেছন পেছন। কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে।
Show me the way to go home
I am tired,
And I want to go to bed
Show me
I had a little drink about an hour ago
Which has gone right to my head
Show me the way to go home
I want to go to bed.
তিতির আমাকে হাত ধরে কাছে টেনে বলল, অ্যাই রুদ্র! এই গানটাই তো আছে Pat Glaskin-এর গলাতে একটু উষ্ণতার জন্যে উপন্যাসের শেষে।
তার মানে?
তার মানে, ঋজুদা বইটা পড়েছে।
আমি বললাম, তোমার নেশা হয়ে গেছে এতজন মাতালের সঙ্গে থেকে। খেয়েদেয়ে কাজ নেই ঋজুদার! তোমার ওই ন্যাকা-বোকা বুদ্ধদেব গুহকে দু চোখে দেখতে পারে না ঋজুদা।
পরদিন উঠতে উঠতে একটু দেরিই হল। ঋজুদা এখনও ওঠেনি। আমি তিতির আর ভটকাইকে বললাম, তোরা থাক। কাল রাতে কী ব্যাপার হল কিছুই বোঝা গেল না। আমি ফ্যাক্স মেসেজটা নিয়ে আসতে একাই যাচ্ছি। কিষুণ অবশ্য থাকবেই সঙ্গে। এখন তো সাড়ে ছটা বাজে। আটটার মধ্যেই রাঁচি পৌঁছে যাব। ঋজুদার বন্ধু স্টিভ যদি ফ্যাক্সটা পাঠিয়ে থাকে তবে আমি আটটাতে পৌঁছেই সেটা পাব। না পেলেও কিছু করার নেই। ফিরে আসব।
চা খেতে খেতে তিতির দুঃখ করছিল যে, এত সুন্দর জায়গা ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ অথচ ভাল করে ঘুরে দেখার আগেই চলে যেতে হবে।
আমি বললাম, ঋজুদা আস্তে আস্তে অনেকই বদলে যাচ্ছে, গেছে, দেখছি। আগের মতো আর নেই।
ভটকাই আরেক কাপ চা ঢেলে দু চামচ চিনি আর তিন চামচ দুধ দিয়ে গুলে শরবত করে চা-টা তারিয়ে তারিয়ে খেতে খেতে বলল, আমাদের দিকে না তাকিয়ে, নীচের নদীর দিকে তাকিয়ে, বৎস বদলেরই আরেক নাম হচ্ছে জীবন। চলতে চলতে বদলে যাওয়াই মানুষের ধর্ম, বাঁক-নেওয়া, চর-ফেলা, পাড়-ভাঙা। নদী আর জীবন একই।
বাবাঃ।
তিতির বলল।
ও রুদ্র! এসব কী শুনছি। ভটকাই কলম ধরলে তো তোমার ঋজুদাকে ভাঙিয়ে লেখালেখি সব শেষ।
আমি আমার ঠাকুমা যেমন করে বলতেন, তেমন করে বললাম, হায়। হায়। সক্কালবেলায়।
ভটকাই বলল, রাঁচি যখন যাচ্ছিসই একটু রাবড়ি নিয়ে আসিস তো। আনতে বলতাম জিলিপিই কিন্তু রাঁচি থেকে আসতে আসতে তারা তো ফ্রিজে রাখা চষি-পিঠে হয়ে যাবে।
যথা আজ্ঞা।
আমি বললাম।
তারপর বেরিয়ে পড়লাম এ কথা বলে যে, ঋজুদাকে তুলিস না। হ্যাঁঙ্গওভার হয়েছে বোধহয়। অভ্যেস তো নেই।
পথে যে পড়ে মাথা ফাটেনি এই তো যথেষ্ট। কী যেন গানটা! আই হ্যাড আ ড্রিঙ্ক অ্যাবাউট অ্যান আওয়ার এগো হুইচ হ্যাঁজ গান টু মাই হেড/ শো মি দ্য ওয়ে টু গো হোম / আই ওয়ান্ট টু গো টু বেড।
ভটকাই বলল।
আমি চলে যেতে যেতে শুনলাম তিতির বলছে, বাবা মুখস্থ করে ফেলেছে যে! গান ‘রাইট টু মাই হেড।
আমার স্মৃতিশক্তি কখনও কখনও বেগ-চিরা হয়ে যায়।
সেটা কী?
মানে বেগে মগজে প্রবেশ করে এবং যা করে, তা চিরদিন থেকে যায়।
.
কিষুণ গাড়ি চালাচ্ছিল। সঙ্গে তিতিরও এল। সকালের হৈমন্তী প্রকৃতি। তখনও রাতের শিশির পুরোপুরি বাষ্প হয়ে উড়ে যায়নি। ঝকমক করছে রোদ ক্লোরোফিল-উজ্জ্বল জঙ্গলে। যেখান থেকে ঋজুদা গাড়ি থেকে নামিয়ে আমাদের ‘ম্যাকলাস্কিজ নোজ’ দেখিয়েছিল তার অনেকখানি নীচে একটি বিস্তীর্ণ জঙ্গলময় উপত্যকা। তার মধ্যিখানে ছোট্ট একটি গ্রাম। তিতির ফিসফিস করে বলেছিল বাসারিয়া।
কী করে জানলে?
‘একটু উষ্ণতার জন্যে’ পড়ে।
ভাবছিলাম, কলকাতাতে ফিরে পড়ে ফেলব বইটা। যদিও লেখক আমার সঙ্গে শত্রুতা করছেন। তবে জানেন তো না যে আমিও ঋজু বোস-এর চেলা, আমার নাম রুদ্র রায়–তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।
তারপরই মনে হল যে, আজই তো আমাদের ম্যাকক্লাস্কি ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা। অথচ তেমন কথা তো ছিল না। পুরো ব্যাপারটিরই কোনও মাথা-মুণ্ডুই বুঝতে পারছি না। এখন দেখা যাক ঋজুদার বন্ধু স্টিভ এডওয়ার্ড নিউজিল্যান্ডে সিডনির বন্ধু রোনাল্ডার পাঠানো ফ্যাক্স আদৌ পেল কি না এবং পেলেও উত্তর দিল কি না!
রাঁচিতে যখন ঢুকছে কিযুণের টাটা-সুমো, ও বলল, রাবড়িটা আগে নিয়ে নিই। তারপরে ফিরে আই এস ডি বুথ হয়ে একেবারে টিকিয়া-উড়ান চালিয়ে ফিরে যাব।
বেশ।
.
রাবড়ি এক কেজি নিলাম। যদিও ভটকাই বলবে, এ তো আমি একাই সাবড়ে দেব। তুই এত হাড়কিপটে যে পরের টাকা খরচ করতেও তোর বুক ফেটে যায়। নিজের টাকা হলে যে কী করতিস!
রাবড়ি নিয়ে বড় রাস্তাতেই রাতু বাসস্ট্যান্ডের কাছে আই এস ডি-র বুথে নামতেই সাতসকালেই মুখে-পান-ভরা আতরের খুশবু ছড়ানো সবুজ-খদ্দরের পাঞ্জাবি পরা যুবকটি বললেন, আ গ্যয়া। লিজিয়ে।
কিতনা দেনা পড়ে গা?
আরে সাব কুছো নেহি। কাল তো বহত রুপেয় লেহি লিয়া।
ইয়ে গাড়ি ডাল্টনগঞ্জকি মোহনবাবুকি হ্যায় উ মেরি পতা নেহি থা। আপলোগ লওট যানেকি বাদ বগলওয়ালা পানকি দুকানিনে মুঝে বাতায়া। ঔর স্রিফ দোহি তো লাইন হ্যায়। ছোড়িয়ে।
ভাবছিলাম, ঋজুদার এই অদেখা ছোট ভাই মোহনবাবু’টিকে একবার দেখা দরকার। তিনি যে দেড়শ কিমি পথ দিয়ে যাওয়া আসা করেন তার দু পাশের সবাই এক নামে তাঁকে চেনে এবং খাতির করে। এমন তো আজকালকার দিনে দেখা যায় না।
দেখলাম সত্যি দু লাইনের ফ্যাক্স মেসেজ।
DEAR WRIJU,
THANK’S A LOT. HE HAD MANY WEAPONS BUT USED .375 MAGNUM DBBL HOLLAND & HOLLAND AND .450-400 JEFFRY NO. 2. FOR BIG GAMES. JEFFRY WAS HIS FAVOURITE!
TAKE CARE
STEVE.
সুক্রিয়া! বহুত সুক্রিয়া। বলে, আমি উত্তেজিত হয়ে গাড়িতে ওঠার আগে ভাবলাম, নিজেই একটা Fax করে দি Steve-কে এ কথা জানিয়ে যে, আপনার MAC TAILOR ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে Kenneth Lindwal সেজে বহাল তবিয়তে বাস করছে।
তারপরে ভাবলাম, সেটা হয়তো বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে করাটা, ঋজুদাকে জিজ্ঞেস না করে! ঋজুদা যদি বলে, তবে আবারও ফিরে আসব। মিঃ ক্যামেরনের ফোনটা খারাপ। তবু কিষুণকে বলে, ফিরে গিয়ে আরেকবার চেষ্টা করে দেখব ভাবলাম। টেলিফোনে আর সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে তফাত তো খুব নেই। এঁদের যখন-তখন ইচ্ছামৃত্যু, তেমন যখন-তখন আবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা। পকেট থেকে টেলিফোনের বইটা বের করে সি-তে খুঁজতেই বেরিয়ে পড়ল Cameron D. R. P.O. Macluskigung, Ranchi, Bihar, Pin: 829208 Phone: 06531-6340.
সবুজ-পাঞ্জাবি ভদ্রলোককে বললাম, একবার লাগান তো। ফোনটা খারাপ ছিল, ভাল হল কি না! সংখ্যা শুনে বলে বলে উনি বোতাম টিপলেন। বললেন, লিজিয়ে! রিং তো হো রাহ্যাঁ হ্যায়।
হো রাহা হ্যায়?
বলে আনন্দে নেচে আমি এগিয়ে গেলাম। ফোনটা বাজছিল।
হাল্লো বলে কানফাটানো চিৎকার করে কেউ একজন ধরল। বলল, গেস্ট হাউস। ঋজুদাকে চাইলাম। ঋজুদা এসে ধরতেই Fax-টা পড়ে শোনালাম ঋজুদাকে।
ঋজুদা বলল, সে তো জানাই ছিল।
কী করব? তোমার বন্ধু স্টিভ এডওয়ার্ডসকে কি ফ্যাক্স পাঠিয়ে দেব কেনেথ লিন্ডওয়াল-এর কথা জানিয়ে দিয়ে?
কী বললি?
ঋজুদা রীতিমত ধমকে বলল আমাকে।
কে জানে কী হল? এখনও কি কালকের নেশা কাটেনি? এমন করে তো কখনও বকেনি ঋজুদা আমাকে।
বলছিলাম, খবরটা কি পাঠিয়ে দেব?
তোমার কিছু করতে হবে না রুদ্রদা৷ তুমি দয়া করে ফিরে এসো। তুমি মস্ত গোয়েন্দা হয়ে গেছ।
তারপরই তিক্ততার সঙ্গে বলল, তোরা নিজেরাই একটা ডিটেকটিভ ফার্ম খুলে ফেল। তোরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ হয়ে গেছিস। আমার সঙ্গে তোদের আর কোথাওই যাওয়ার দরকার নেই। এবার থেকে আমি সব জায়গাতে একাই যাব। প্রয়োজনে তিতিরকে নেব শুধু।
ঠিক আছে। ছাড়ছি। আসছি আমি।
তাই এসো।
ঋজুদা বলল।
.
ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জে গিয়ে পৌঁছতে পৌঁছতে আমার প্রায় দশটা হল। গিয়ে দেখি, ঋজুদারা দুজনে চানটান করে তৈরি হয়ে বারান্দাতে বসে আছে। যেরকম চেয়ারের ভাঁজ করা হাতল লম্বা করে দিলে ‘পাতোল’ হয়ে যায় পা তুলে বসার জন্যে, সেইরকম একটা চেয়ারে পা তুলে দিয়ে বসে ঋজুদা পাইপ খাচ্ছে। দেখে মনে হল সকলের ব্রেকফাস্টও হয়ে গেছে। গত রাতে শুধু ভটকাই বোবা ছিল। আজ মনে হচ্ছে ঋজুদাও বোবা।
রাবড়িটা কিষুণকে খাওয়ার ঘরের ফ্রিজ-এ ভোলার বন্দোবস্ত করতে বলে বললাম, তুম নাস্তা কর লেও কিষুণ। ইতিমধ্যে গেস্ট হাউসের বাবুর্চি দৌড়ে এসে বলল, ছোটা-হাজরি লাগা দু’ সাব?
‘ছোটা-হাজরি’ শব্দ দুটো শুনে ব্রিটিশরাজ-এর কথা মনে পড়ে গেল। এখনও গঞ্জের পুরনো মানুষেরা ওই সব শব্দ ব্যবহার করে দেখছি। মিস্টার ক্যামেরন এখানে ঘোড়ার প্রজনন-এর জন্যে অনেকখানি জায়গা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। সে ব্যবসা চলল না কিন্তু জায়গাটির প্রেমে পড়াতে বাঁধা পড়ে গেছেন নাকি। তাঁর সঙ্গেও এ যাত্রা দেখা হল না। শুনেছি কালো অ্যাংলো।
আমি বললাম, আমি কিছু জানি না। তুমি বড়াসাবকে জিজ্ঞেস করে এসো। কেন? ওঁরা নাস্তা করেননি এখনও।
না তো। আপনার ইন্তেজারিতেই তো আছেন।
তাই?
জি হুজৌর।
আমি বারান্দাতে গিয়ে পৌঁছাতেই তিতির বলল, ব্রেকফাস্ট দিতে বলি ঋজুদা?
বল। রুদ্র তো এসেই গেছে।
আমি কোনও কথা না বলে ফ্যাক্স মেসেজটা ঋজুদার হাতে তুলে দিলাম।
ঋজুদা বলল, ব্রেকফাস্ট করে আমরা স্টেশনে যাব। তাড়াতাড়ি চান করে নে তুই। স্টেশনে আমাদের ছেড়ে দিয়ে কিষুণ গাড়ি নিয়ে, বাই রোড এগিয়ে যাবে। ওপথে বিজুপাড়া থেকে সমান রাস্তা ক্ষেতি-জমিন-টাঁড়-বেহড়-এর মধ্যে মধ্যে গেছে। কুরু থেকে রাস্তা ডানদিকে ঘুরেছে চান্দোয়া-টোড়ির দিকে। সে পথে জঙ্গল ও ঘাট আছে। আমঝারীয়ার বাংলো আছে দেখার মতো। যাকগে, যেতে যেতে এসব বলব এখন। আমরা এগোচ্ছি। তুই কাক-চান করে আয়। রাতে ভাল করে চান করিস মোহনের ওখানে। পরশু তোদের বেতলা ন্যাশনাল পার্ক-এ নিয়ে যাব। কোয়েলের কাছে। তারপর বেতলা হয়ে, কেঁড় হয়ে গাড়র কাছের পাকা ব্রিজ দিয়ে কোয়েল পেরিয়ে, মীরচাইয়া ফলস-এর পাশ দিয়ে নিয়ে যাব মারুমার-এ।
তিতির চেয়ারটা ঠেলে উঠতে উঠতে বলল, ‘কোজাগর’-এর ‘ভালুমার’-এর কাছে?
ভালুমার বলে কোনও জায়গা নেই। যেমন রুমান্ডি বলেও কোনও জায়গা। নেই। ওসব তোর ফেভারিট লেখকের লোক-ঠকানোর ধান্দা। তবে মারুমার-এর সঙ্গে ভালুমার-এর মিল যেমন আছে অনেকই, তেমন রুমান্ডির সঙ্গে কুমান্ডির।
তুমি পড়েছ? ‘কোয়েলের কাছে’ বা ‘কোজাগর’?
ওসব ট্রাশ লেখকের বাজে লেখা পড়ার সময় আমার নেই।
ওরা ডাইনিং রুমের দিকে হেঁটে যেতে যেতে তিতির বলল, আমি শুনলাম আমার ঘরে ঢুকতে ঢুকতে, কাল রাতে তুমি একটি গান গাইছিলে সেই গানটি, প্যাট গ্লাসকিন-এর মুখে আছে ‘একটু উষ্ণতার জন্যে’র শেষে।
তাতে কী? সেই গানটা কি তোর লেখকের পার্সোনাল প্রপার্টি? প্যাট গ্লাসকিনকে আমিও চিনতাম। আমারও কি বাংলো ছিল না এখানে? প্যাটের মুখে ওই গানটি আমি বহুবার শুনেছি।
তিতির চুপ করে গেল।
ওরা খাওয়া শুরু করতে করতে আমি গিয়ে বসলাম। ঋজুদা বলল, তোদের ট্রেনে করে নিয়ে যাচ্ছি ডালটনগঞ্জ কারণ এই পথটা দেখার মতো। ফেরার সময় তো কিযুণের সঙ্গেই গাড়িতে রাঁচি এসে ট্রেন ধরব, তখন গাড়ির পথ দেখতে পাবি। এইসব জায়গাতে দিনের বেলা ঘুরে বেড়াতে হয় পায়ে হেঁটে, কি গাড়িতে, কি ট্রেনে, বসন্তকালে। আহা কী রূপ তখন। ভারতের বসন্তবনের যা রূপ তেমন রূপ পৃথিবীর আর কোনও জঙ্গলেরই নেই।
কোন কোন স্টেশন পড়বে পথে?
কত স্টেশন। এই লাইনের, মানে গোমোবারকাকানা-বারকাকানা-চৌপান রুটের স্টেশনগুলির নাম এত সুন্দর, সব আদিবাসী নাম, যে তা বলার নয়।
যেমন?
যেমন মহুয়া-মিলন, চান্দোয়া, টোড়ি, খিলাড়ি, রিচুঘুটা, হেহেগাড়া, হেন্দেগির, চিপাদোহর, লাতেহার, আরও কত বলব!
বাঃ।
ভটকাই উত্তেজিত হয়ে বলল।
কেচকী জায়গাটা কোথায় ঋজুদা?
কাল দেখাব। সেখানে কোয়েল আর ঔরঙ্গা এসে মিলেছে। ছোট্ট বাংলো আছে। একটা। তিতিরের ফেভারিট লেখকের কল্যাণে বন থেকেও শান্তি চলে গেছে। কেচকী থেকেও। সবসময়ে কলকাতার কিচির-মিচির-পার্টিরা এসে পিকনিক করছে।
রাবড়ি আনিসনি? পরোটার সঙ্গে কেমন জমত বলত?
ভটকাই বলল!
এনেছি।
এনেছিস। কোথায়?
ফ্রিজে আছে।
বের করতে বল, বের করতে বল। কিষুণকেও দিতে বলিস।
ঋজুদা বলল।
পাতলা পাতলা পরোটা, মুচমুচে করে ভাজা, বেগুন ভাজা, মেটে চচ্চড়ি, লেবু আর বড়কা বড়কা লঙ্কার আচার আর রাবড়ি–একেবারে জমে যাবে।
হ্যাঁ। ভাল করে খেয়ে নে। নো লাঞ্চ আজকে। রাতে মোহনের কাছে ডিনার। কী খাবি? মিষ্টি পোলাউ আর মুরগির মাংস, না বিরিয়ানি, না লিট্টি? ফোন তো ঠিকই হয়ে গেছে। মোহনকে ফোন করে দিচ্ছি।
লিট্টিটা আবার কেন? কাল রাতে তো শুয়োরের ভিণ্ডালু না গিন্ডালু খেলে। লিট্টি আবার কীসের মাংসে তৈরি হয়? সজারু না শেয়াল?
না, না লিট্টি ছাতু দিয়ে তৈরি হয়। তবে ডেলিকেসি। খেয়ে দেখতে পারিস। গাওয়া ঘিতে চুবিয়ে চুবিয়ে খেতে হয়, সঙ্গে আলুর ঝাল-তরকারি, লেবুর আচার আর ডালটনগঞ্জের জেলহাতার ঝুমরুর দোকানের রাবড়ি।
আঃ, আঃ, আঃ: আর বোলো না। আনন্দে আমি মরেই যাব। মহুয়া-মিলনে, রিচুঘুটা, হেহেগাড়া তারপর আবার রাবড়ি।
তারপরই ভটকাই বলল, চল রুদ্র। আমি আর তুই একটা মিষ্টি আর নোন্তার দোকান খুলি। ঋজুদা তো আজকাল খুনি ধরে ধরে ছেড়ে দিচ্ছে। আমার মেজমামা যেমন মিরগেল মাছ ধরে আর ছাড়ে। বলে, আহা কেষ্টর জীব। তাই আমাদের গোয়েন্দাগিরি আর অ্যাডভেঞ্চারের ভবিষ্যৎ খুবই খারাপ।
ভাবলাম, এখুনি দেবে ঋজুদা ভটকাইকে।
কিন্তু ঋজুদা ঠাণ্ডা গলাতে টোস্ট-এ মাখন লাগাবারই মতো স্নেহ মাখিয়ে বলল, জানি যে, তোরা খুবই অবাক হয়েছিস। তবে ওসব নিয়ে এখানে আর কোনও আলোচনা নয়। ট্রেনে ডালটনগঞ্জ যেতে যেতে সব বলব।
তারপর বলল, তোরা কী খাবি ভেবে বল। মানে, রাতে। সেই মতো ফোন করে দেব মোহনকে। আর ব্রেকফাস্ট সেরে মালপত্রগুলো গাড়িতে তোল কিযুণের সঙ্গে। কিষুণকে রাবড়ি পাঠালি? না, নিজেই সব মেরে দিলি। কীরে ভটকাই?
এই তো পাঠাচ্ছি। খায় সবাই, বদনাম হয় শুধু আমার। মকবুল মিঞা জলদি আও। ড্রাইভারবাবুর জন্যে রাবড়ি লে যাও।
কী খাবি বলবি তো তিতির।
লিট্টি। লিট্টি। লিট্টি। ভটকাই বলল, আগে কখনও খাইনি।
ঋজুদা ফোন করতে গেল অফিস ঘরে। তারপরই ঋজুদার গলা শুনতে পেলাম।
হ্যাঁ। কে? মোহন? নেই? কোথায় গেল? রাংকাতে? সে কী, এই তো শুনলাম শরীর খুব খারাপ। ব্লাডসুগার খুব বেড়েছে? কথা না শুনলে জোর করো। তোমরা আছ কী করতে। আচ্ছা নিমাই, একটু রমেনদাকে দাও তো।
বলো, রমেনদা কেমন আছ? না, না কলকাতা থেকে নয়, ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ থেকে বলছি। হ্যাঁ। একটু কাজে এসেছিলাম। বাবলু কেমন আছ? শোনো, আমরা ট্রেনে ডালটনগঞ্জ পৌঁছচ্ছি। আজই। চারজন। আপ চৌপান এক্সপ্রেস-এ। সেটা এগারোটা নাগাদ আসবে এখানে। স্টেশনে একটা গাড়ি পাঠিয়ো।
কে? হ্যাঁ আছে তো৷ কিষুণ গাড়ি নিয়েই যাচ্ছে। আমরা ট্রেনে যাব। ও যদি ট্রেনের আগে পৌঁছয় তো ওকেই পাঠাতে পার। নইলে অন্য কোনও ড্রাইভারকে পাঠিয়ো।
আর শোনো, রাতে আমার সৈন্যদল লিটি খেতে চায়। জুম্মান আছে তো?
নেই? কাল আসবে?
তো লালটু পাণ্ডে আর গিরধারীদেরই বোলো। কাল জুম্মান এসে না হয় পোলাও-মাংসই খাওয়াবে। ঠিক আছে। মোহন রাতেই তো ফিরবে? তবে আর কী? ভাগ্যকে খবর দিয়ে একটা। আরে! ভাগ্য কটা আছে ওখানে? অধিকাংশই। তো হতভাগ্য। পেট্রল পাম্পের মালিক ভাগ্যধর দাস।
ঠিক আছে। ছাড়ছি।
.
আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে কিষুণ গাড়ি নিয়ে চলে গেল।
ট্রেনটা প্রায় আধঘণ্টা লেট ছিল। আমাদের দেখেই মাজিদ দৌড়ে এল। চা খাব নাকি জিজ্ঞেস করল। টোড়ির স্টেশন মাস্টার কোনও কাজে এসেছিলেন এখানে। তিনি ঋজুদাকে চিনতেন। তিনি এসে অনেক গল্প-টল্প করলেন। পুরনো দিনের কথা। উনি নাকি আগে চিপাদোহরের এ এস এম ছিলেন।
ট্রেনে যারা এল বারকাকানা বা খিলাড়ি থেকে, তাদের কেউই টিকিট কেটেছে বলে মনে হল না। তবে দু-একজন দয়াপরবশ হয়ে গেট-এ দাঁড়ানো চেকারকে কাটা, মুলোটা, এক জোড়া ডিম এসব হাতে গুঁজে দিয়ে যাচ্ছে দেখলাম।
ঋজুদা বলল, কথাতেই বলে না, ‘Charity begins at home এই যে আইন–মানার অভ্যেস, জীবনের সবক্ষেত্রেই একদিন অজান্তেই ছড়িয়ে যাবে। ওদের মধ্যে যারা বড়লোকও হবে, তারাও সেলসট্যাক্স দেবে না, ইনকামট্যাক্স দেবে না, রাস্তাতে ট্রাফিক সিগন্যাল মানবে না। অনিয়মানুবর্তিতাতে একবার অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তা মজ্জায় মজ্জায় সেঁধিয়ে যাবে।
তুমি শুধু এদের দোষ দিচ্ছ কেন ঋজুদা? হাওড়া-শিয়ালদাতে লোকাল ট্রেনে করে যত লক্ষ লক্ষ যাত্রী যাওয়া-আসা করে প্রতিদিনই তাদের মধ্যে কতজন টিকিট কাটে? এরা তো খুবই গরিব, অশিক্ষিত।
আমি তো শহুরেদের সমর্থন করছি না। নীরদ সি চৌধুরি কি এমনি এমনি ব্রিটিশরাজের প্রশস্তি করেছেন। ইংরেজ আমলে কিন্তু আইনশৃঙ্খলার এমন অবস্থা ছিল না। শুনেছি, কারও নাকি সাহসই ছিল না টিকিট না-কেটে যাওয়ার। কলকাতার বা মফস্বলের পথেও কী রিকশ আর কী ঠেলাগাড়ি বা সাইকেল কারোরই উপায় ছিল না আলো ছাড়া সন্ধের পরে পথে বেরবার। গত সপ্তাহে শান্তিনিকেতনে গেছিলাম একটা কাজে। পূর্বপল্লী থেকে অ্যান্ড্রুজপল্লীতে মোহরদির বাড়ি যাব বলে বেরিয়ে কত বার যে সাইকেল রিকশ আর সাইকেলে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি তা কী বলব। না আছে পথে কোনও আলো, না আছে যানবাহনে। দেখবার কেউই নেই। অথচ সেটা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একটা জায়গা। রতনপল্লীর দিকে তো আরও ভয়াবহ অবস্থা।
তারপরে বলল, আসলে স্বাধীনতার মধ্যে যে, কিছু কিছু স্বেচ্ছারোপিত পরাধীনতাও মেশানো থাকে, এইটে আমাদের রাজারা এবং প্রজারাও না-জানাতে আমাদের দেশের সঙ্গে স্বাধীন আফগানিস্তান বা জায়রে বা কঙ্গোর আজও যে খুব একটা তফাত হয়েছে তা বলতে পারি না। এর চেয়ে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে।
আমরা একটা ফার্স্ট ক্লাস কামরাতে উঠেছি টিকিট কেটে কিন্তু পয়সাই নষ্ট হয়েছে তাতে। সেই কামরাতে ছাগল-মুরগি, লাউ কি কুমড়োর সঙ্গে করে হাটুরেও উঠেছে, ভিখারি, ধানের বস্তা নিয়ে ব্যাপারি। ছাগল ডাকছে ব্যাঁ-এ-এ, মুরগি ডাকছে, কঁক, সর্দি হওয়া শিশু কাশছে খক্-খ। আর অন্য সকলেই অবিরত বকবক করছে। কেউ কেউ হাতে খৈনি মারছে। কেউ বিড়ি খাচ্ছে।
তিতির নাক কোঁচকাচ্ছিল। মুখে বলল, কী বিচ্ছিরি গন্ধ। এদের নামিয়ে দাও গাড়ি থেকে।
ঋজুদা একটু হাসল। বলল, এই একটা কামরা থেকে নামালেই তো সমস্যার সমাধান হবে না। এদের তো চিরদিন আমরা মাটিতেই নামিয়ে রেখেছি, মানুষ বলে তো গণ্য করিনি। সাহেবরা বলেছে ‘ডার্টি নিগার’, আর আমাদের হেলিকপ্টার থেকে-নামা দুগ্ধ-ফেননিভ পোশাক পরা সব দলেরি নেতারা এদের বড় দরদভরা গলাতে ডেকেছে: ভাইয়ো ঔর ব্যহেনো’ বলে। কিন্তু তোরই মতো এদের পাশে বসতে নাক সিঁটকেছে। বসেছে যে, তা নয়, বসেছে। খেয়েছেও পাশে বসে। কিন্তু শুধু নির্বাচনেরই আগে। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষদের প্রতি বিদেশি ইংরেজদের যে ঘৃণা ছিল তাতে কোনও ভেজাল ছিল না। কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষের নেতাদের দেশের সাধারণ মানুষদের প্রতি যে দরদ তার সবটাই ভেজাল। এরা সব ভোটেরই কাঙাল, গদির ভিখারি।
শেষের দিকে ঋজুদার গলাটা ভারী হয়ে এল। মুখটা ঘুরিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।
আমরাও সবাই চুপ করে গেলাম।
ঋজুদা তারপর বলল, বুঝলি তিতির, এই হচ্ছে আসল ভারতবর্ষ। এদের ঘৃণা করে ভালবাসতে শেখ। এদের নামিয়ে দিয়েছি বলেই আমরাও নেমে এসেছি এত নীচে। পল রোবসন-এর গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটা শুনেছিস কি তোরা!
কোন গান?
আমি বললাম।
We are in the same boat brother,
If you tip the one end
You are going to rock the other
We are in the same boat brother.
আমরা আবার চুপ করে গেলাম। যতবারই ঋজুদার সঙ্গে বেরই, সাধারণ গরিব মানুষদের প্রতি ঋজুদার যে গভীর ভালবাসা ও মমত্ববোধ তা যেন নতুন করে প্রতিবারই জানতে পারি। জেনে, ঋজুদার জন্যে গর্বে বুক ফুলে ওঠে। গদাধরদার প্রতি, কিযুণের প্রতি, মাজিদ-এর প্রতি তার যে ভালবাসা, সেটা লোক-দেখানো আদৌ নয়।
ট্রেনে ওঠার সময়ে মাজিদের হাতে একটা একশো টাকার নোট দিয়েছিল ঋজুদা।
মাজিদ অবাক হয়ে বলল, ঈ ক্যা? ঈ ক্যা হ্যায় সাহাব! আপ তো হামকো চায়েভি পিলানে নেহি দিয়া ইককাপ। উস রোজভি জাদা পয়সা দেকর গ্যায়া। কার্নি মেমসাবকি লিয়ে আপ কেয়া কিয়েথে আর কেয়া নেহি কিয়েথে, উ সবহি তো হামলোগোকি ইয়াদ হ্যায়।
ঋজুদা কপট ধমক দিয়ে বলেছিল, বকোয়াস মত করো। বদমাশ। আজ জুম্মাবার হ্যায়। রাতমে মোর্গা বানাও ঘরমে।
গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে বাঁশি বাজিয়ে। মাজিদ আর টোড়ির মাস্টারবাবু যতক্ষণ আমাদের দেখা যায়, ততক্ষণ হাত নেড়েছে ও নেড়েছেন সমানে। তারপর ট্রেনটা একটা বাঁক নিয়ে জঙ্গলে ঢুকে যেতেই আর দেখা যায়নি ওঁদের।
এখন ট্রেনের গতিটা কমে এসেছে।
ঋজুদা বলল, মহুয়া-মিলন-এ পৌঁছে গেলাম। কী সুন্দর নাম, না?
তারপর তিতিরকে বলল, তুই তো তোর ফেভারিট লেখকের ওপর অথরিটি–এই মহুয়া-মিলনের পটভূমিতে লেখা তাঁর একটা উপন্যাস আছে। নাম বাসনাকুসুম। পড়েছিস কি?
তিতির হেসে বলল, কার যে বেশি ফেভারিট তা তো বুঝতে পারছি না। তুমি তো আমার চেয়েও অনেকই বেশি পড়েছ তাঁর বই দেখছি।
ঋজুদা পাইপ ভরা শেষ হলে রনসন-এর লাইটার দিয়ে আগুন দিয়ে বলল, শত্রুর সমস্ত গুণাগুণ সম্বন্ধে আপ-টু-ডেট জ্ঞান না থাকলে তাকে বধ করব কী করে! তার দোষের খবর না রাখলেও চলে কিন্তু গুণের খবর রাখতে হয় বইকী! পারলে, পড়িস বইটা। ইন্টারেস্টিং রিডিং। কিন্তু গভীরতা আছে।
নামটা ভারী সুন্দর কিন্তু, না? বাসনাকুসুম।
হ্যাঁ।
ঋজুদা বলল।
ভটকাই অনেকক্ষণ থেকেই উসখুস করছিল। আর থাকতে না পেরে বলেই ফেলল, লিন্ডওয়ালের কী করবে ঋজুদা?
কী করব?
স্টিভ ওয়ার ফ্যাক্স যা বলছে… তাতে তো কোনও সন্দেহই থাকছে না যে–
স্টিভ এডওয়ার্ড, ওয়া নয়।
ওই হল, যা বলছে, তাতে তো কোনও সন্দেহই থাকছে না আর যে, কেনেথ লিন্ডওয়ালই ম্যাক টেইলর।
তা ঠিক। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বোকাও তা বুঝবে। তা ছাড়া স্টিভ-এর ফ্যাক্স আসার আগে কাল রাতেই আমি ম্যাকের উল্টোপাল্টা কথা শুনেই বুঝেছিলাম।
তা সত্ত্বেও তুমি তোমার বন্ধু স্টিভকে জানাবে না?
জানাব বইকী!
জানাবে?
অবাক হয়ে বলল, ভটকাই।
আমি আর তিতিরও একটু অবাক হয়েই চুপ করে রইলাম।
ঋজুদা বলল, জানাব যে, ম্যাক টেইলর ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ-এ যে থাকে না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত।
কবে জানাবে?
আজই। ডালটনগঞ্জ থেকেই জানাব। মোহনের ফ্যাক্স থেকে।
কিন্তু এমন করা কি ঠিক হবে?
ঠিক জানি না। হয়তো হবে। হয়তো হবে না। আমার কাছে যা ঠিক তা অন্যের কাছে ঠিক না হতেও পারে।
তারপরই আমাদের সকলকে উদ্দেশ করেই বলল, তোরা অরুন্ধতী রায়ের নাম শুনেছিস?
ভটকাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকল।
তিতির বলল গড অফ স্মল থিংগস।
আমি বললাম, বুকার প্রাইজ পেয়েছে যে বইটি?
বইটা পড়েছিস?
নাঃ। বড্ড দাম। আমার ভারী একটা দোষ আছে। দাগ না দিয়ে বই পড়তে পারি না। সেই জন্যে লাইব্রেরি থেকেও আনতে পারি না বই।
তিতির বলল, আমি পড়েছি।
অরুন্ধতী এখন মেধা পাটকর-এর সঙ্গে নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে নেমেছেন। কাগজে দেখে থাকবি হয়তো।
দেখেছি।
ইংরেজিটা একেবারে ওর নিজস্ব। দেখার চোখ, বলার ভাষা, সবই নিজস্ব। নর্মদা বাঁচাও প্রসঙ্গে ও একটা বই লিখেছে, বইটির নাম: ‘The Greater Common Good’।
তার সঙ্গে ম্যাক টেইলর-এর কী সম্পর্ক?
ভটকাই ফুট কাটল।
ঋজুদা বলল, ম্যাককে ধরিয়ে দিলে, যদি সে খুন নাও করে থাকত তবেও তার জন্যে ইলেকট্রিক চেয়ার বরাদ্দ হত হয়তো। নয়তো যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর। কিন্তু টেড গিলিগান মানুষটা কেমন ছিল? ম্যাক সত্যিই তাকে খুন করেছিল কি না? খুন করলে, কেন খুন করেছিল? এসব তো আমরা জানি না। অন্য কোনও কুচক্রী মানুষ নিজে খুন করে খুনের দায়টা ম্যাক-এর ওপরে চাপিয়েও দিতে পারে। তা ছাড়া আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও খুন করেনি। যে খুনি সে সারাজীবন সন্দেহের জীবন কাটাবে। সে কখনও অচেনা, অজানা, কলকাতা থেকে-আসা আমাদের শিকারের কথা আলোচনা করার জন্যে কার্নি মেমসাহেবের বেয়ারা মাজিদ-এর কথাতেই আমাদের নেমন্তন্ন করত না। যদি শিকারে গিয়েই ও টেডকে খুন করে থাকত তবে সমস্ত বাকি জীবন ও শিকারের প্রসঙ্গই এড়িয়ে চলত। তবে মানুষ হিসেবে ও খুবই অসাবধানী। খুনিরা গুনে গুনে ড্রিঙ্ক করে, কখনও বেসামাল হয় না, নিজের চার ধারে একটা দুর্ভেদ্য দেওয়াল তুলে বাস করে সারাজীবন।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, এই গঞ্জেই আমার কটেজ যখন ছিল, তখন এক বাঙালি ভদ্রলোক তাঁর বেলজিয়ান স্ত্রীকে নিয়ে এখানে থাকতেন। তাঁর বাড়ির ঘরটরও ভাড়া দিতেন ট্যুরিস্টদের। তাঁর আচরণ, কথাবার্তা আমার কাছে খুবই রহস্যময় মনে হত। কিছুদিন পরেই যেমন ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন, তেমনই ধূমকেতুরই মতন উধাও হয়ে গেলেন। তিনি যে খুনিই বা অন্য কোনও অপরাধী এমন সন্দেহই দৃঢ় হয়েছিল।
তিতির বলল, ঋজুকা, তোমার কথা মানলাম কিন্তু অন্য দিক দিয়েও ভেবে দেখো। ভুল তো তুমিও করতে পার।
পারি বইকী। হয়তো কেন? মনে করো ভুল করেছি। ইচ্ছে করেই করেছি। কিন্তু করেছি, For a Greater Common Good.
মানে বুঝলাম না।
কালকে কেনেথকে বা ম্যাককে দেখে আমার এত সুখী মনে হল ওদের দম্পতি হিসেবে যে, ওদের এই নীড় এখন ভেঙে দিলে অরেঞ্জ মিনিভেট পাখির নীড় ভাঙার মতোই পাপ হতো আমার। টেড গিলিগানকে আমি চিনি না। স্টিভকেও এক-দুবার কানাডাতে শিকারে গিয়েই দেখেছি। শিকারিরা একে অন্যকে বলেন, ‘হি ইজ মাই শুটিং প্যাল। কেউ তোর শুটিং প্যাল হলেই যে তুই তার নাড়িনক্ষত্র জানবি এমন কোনও কথা নেই। আমার তো কেনেথকে অনেক বেশি শিক্ষিত, রুচিসম্পন্ন, ভদ্র এবং যাকে বলে, আঃ, কী যেন বলে রে, বাংলাটা বল না রুদ্র…
কীসের বাংলা?
Refined-এর।
পরিশীলিত।
ঠিক। পরিশীলিত বলে মনে হল। তা ছাড়া ও একজন ভাস্করও! সে কথা তো স্টিভ আমাকে বলেইনি। সেই তুলনাতে টেড গিলিগান, মানে যে খুন হয়েছিল, সে অত্যন্তই রুক্ষ প্রকৃতির মানুষ। এমন ধরনের শিকারি, যারা রক্ত আর মাংস লোলুপ, যারা মদ্যপ, যাদের কোনও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নেই, যাদের জীবনের একমাত্র কৃতিত্ব, একমাত্র প্রার্থনা, ট্রফির মাপ। কে কত বড় শিংএর Moose মেরেছে, কে কত বড় সিংহ মেরেছে, বা কত বড় দাঁতি হাতি… এই তাদের একমাত্র অর্জন’ জীবনের। কেনেথ সে ধরনের মানুষই নয়। তা ছাড়া আরও একটা কথা, এই ভাস্কর এখন এমন এক মূর্তি গড়তে শুরু করেছে, যে মূর্তি কথা বলবে, হাসবে, গাইবে, খেলবে। এই সৃষ্টির তন্ময়তার মধ্যে কোনও শিল্পীকে বিরক্ত করা কি উচিত?
মানে?
ভটকাই বলল।
মানে,… তিতির তুই কিছু বুঝেছিস?
তিতির মুখ নিচু করে বলল, আমার মনে হচ্ছিল। এখন তোমার কথাতে বুঝছি যে ঠিকই মনে হয়েছিল।
কী বলছ কী তোমরা? কিছুই তো বুঝছি না।
ভটকাই মহাবিরক্ত হয়ে বলল।
সব কথা সকলের না বুঝলেও চলবে।
তিতির বলল, ডরোথি মা হবে।
সে কী? তুমি কী করে জানলে ঋজুদা? পুরুষ হয়ে?
এমনভাবেই বলল কথাটা ভটকাই যে, আমরা সকলেই হেসে উঠলাম। মনে হল, ও যেন বলতে চাইছে যে, ঋজুদা নিজেই যদি সেই অনাগত সন্তানের বাবা না হয়, তবে এই সত্য তার জানারই কথা নয়।
ঋজুদা হাসতে হাসতেই বলল, ভটকু, ভাল গোয়েন্দা হতে হলে সবচেয়ে আগে যা দরকার তা একজোড়া তীক্ষ্ণ চোখ এবং the most uncommon of all qualities…
সেটা কী?
তিতির বলল, Common sense, বুঝেছ। সাধারণ বুদ্ধি। ঋজুদা বলল, ওদের সুখের সংসার, ওদের দুজনের দুজনের প্রতি ভালবাসা গভীর, আমার মন ভরে দিয়েছে। তা ছাড়া দুজনেই কী সুন্দর। যেন, মেড ফর ইচ আদার।
উইলস-এর কমপিটিশানে নাম দেয় না কেন? দিলে গাড়িটা ওরা নির্ঘাত পেতে পারত।
ভটকাই বলল। তারপর না হয় আমাকে দিয়ে দিত।
ঋজুদা বলল, একজন অত্যন্ত সজ্জন মানুষও কোনও ক্ষণিক উত্তেজনায়, কোনও অন্যায় দেখে, নিজেকে বা অন্যকে সাঙ্ঘাতিক বিপদ থেকে বাঁচাতে খুন করতে পারে। পৃথিবীর ফৌজদারি আইনে ঘুণ ধরে গেছে। আইন কানুন সব আমূল বদলে দেওয়া উচিত। পয়সা থাকলেই নব্বইভাগ ক্ষেত্রে অপরাধী পার পেয়ে যায়।
আমি বললাম, এত জায়গাতে আমরা গেছি, মানুষখেকো বাঘ, কি গুণ্ডা হাতি মারতে, কত খুনের কিনারা করতে, কিন্তু এইরকম সমাপ্তি আর কখনওই হয়নি, না ঋজুদা?
ঠিকই বলেছিস রুদ্র।
মারা বা ধরা যত না কঠিন, ছাড়া তার চেয়ে অনেকই বেশি কঠিন।
তিতির বলল।
বাঃ। চমৎকার বলেছিস।
ভটকাই বলল, ইস৷ কোনও মানে হয়। একটা দিন থেকে গেলে মিসেস লিন্ডওয়াল কত কেক-টেক খাওয়াতেন আমাদের।
আমি বললাম, দুঃখ কীসের মিস্টার ভটকু? কেক তো অনেকই খেয়েছিস, লিট্টি কখনও খেয়েছিস? ছাতুর লিট্টি, খাঁটি গাওয়া ঘিতে ডুবিয়ে ডুবিয়ে? আজ রাতেই খাবি।
তিতির বলল, জিনেট্যাক বা র্যানট্যাক আছে তো?
ঋজুদা বলল, সব আছে। প্রিন্স অফ পালাম মোহন বিশ্বাসের কাছে বাঘের দুধ চাইলে তাই পাবি।
ফাইন।
ঋজুদা বলল, আমি জানি যে, তোদের সকলের মনেই অনেক প্রশ্ন রয়ে গেল। কোনওই চিন্তা নেই। হাতে অনেকই সময় আছে। তিনদিন। তোদের সব প্রশ্নেরই উত্তর দেব। এখন যে জন্যে ট্রেনে করে আসা তাই কর। দু ধারের দৃশ্য দেখতে দেখতে চল, কথা না বলে।
ট্রেনের গতি আবার আস্তে হয়ে গেল।
ঋজুদা বলল, টোড়ি সামনে। আজ বড় হাট লাগে এখানে। আমাদের সহযাত্রীদের অনেকেই নেমে যাবে এখানে। এবারে হাত-পা ছড়িয়ে বসতে পারবি তোরা।
গাড়ির গতি আরও আস্তে হয়ে এল।