Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উৎকণ্ঠা স্তম্ভ || Rajshekhar Basu

উৎকণ্ঠা স্তম্ভ || Rajshekhar Basu

বিলিতী খবরের কাগজে যাকে অ্যাগনি কলম বলা হয় তাতে এক শ্রেণীর ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বহুকাল থেকে ছাপা হয়ে আসছে। ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আগে বাঙলা কাগজে সে রকম বিজ্ঞাপন কদাচিৎ দেখা যেত, কিন্তু আজকাল ক্রমেই বাড়ছে। হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ’ শীর্ষক স্তম্ভে তার অনেক উদাহরণ পাবেন। ইংরেজীতে যা আগনি কলম, বাঙলায় তারই নাম উৎকণ্ঠা স্তম্ভ।

কয়েক মাস আগে দৈনিক যুগানন্দ পত্রের উৎকণ্ঠা স্তম্ভে উপরি উপরি দ; দিন এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গিয়েছিল।

বাবা পানু, যেখানেই থাক এখনই চলে এস, টাকার দরকার হয় তো জানিও। তোমার মা নেই, বড়ো বাপ আর পিসীমাকে এমন কষ্ট দেওয়া কি উচিত? তুমি যাকে চাও তার সঙ্গেই যাতে তোমার। বিয়ে হয় তার ব্যবস্থা আমি করব। কিচ্ছু ভেবো না, শীঘ্র ফিরে। এস। তোমার পিসীমা।

চার দিন পরে উক্ত কাগজে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল–

এই পেনে, পাজী হতভাগা শওর, যদি ফিরে আসিস তবে জতিয়ে লাট করে দেব। আমার দেরাজ থেকে তুই সাত শ টাকা চুরি করে পালিয়েছিস, শুনতে পাই বিপিন নন্দীর ধিঙ্গী মেয়ে লেত্তি তোর সঙ্গে গেছে। তুই ভেবেছিস কি? তোকে ফেরাবার জন্যে সাধাসাধি করব? তেমন বাপই আমি নই। তোকে ত্যাজ্যপত্র করলুম, তোর চাইতে ঢের ভাল ভাল ছেলের আমি জন্ম দেব, তার জন্যে ঘটক লাগিয়েছি।–তোর আগেকার বাপ।

সাত দিন পরে এই বিজ্ঞাপন দেখা গেল

পানু-দা, চিঠিতে লিখে গেছ তিন দিন পরেই ফিরবে, কিন্তু আজও দেখা নেই। গেছ বেশ করেছ, কিন্তু আমার মফ চেন আর রোচ নিয়ে গেছ কেন? তুমি যে চোর তা ভাবতেই পারি নি। এখন তোমাকে চিনেছি, চেহারাটাই চটকদার, তা ছাড়া অন্য গুণ কিছুই নেই। অল্প দিনের মধ্যে বিদায় হয়েছ ভালই, কিন্তু আর ফিরে এসো না। ভেবেছ আমার বুক ভেঙে যাবে, তোমাকে ফেরাবার জন্য সাধাসাধি করব? সে রকম ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে আমি নই, নিজের পথ বেছে নিতে পারব।–লেত্তি।

উৎকণ্ঠা স্তম্ভের এই সব বিজ্ঞাপন পড়ে পাঠকবর্গ বিশেষত যাদের ফুরসত আছে, মহা উৎকণ্ঠায় পড়ল। অনেকে আহরি নিদ্রা ত্যাগ করে গবেষণা করতে লাগল, ব্যাপারটা কি। একজন বিচক্ষণ সিনেমার ঘণ বললেন, বুঝেছ না, এ হচ্ছে একটা ফিল্মের বিজ্ঞাপন, প্রথমটা শুধু পবলিকের মনে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তার পর খোলসা করে জানাবে আর বড় বড় পোস্টার সাঁটবে। আর একজন প্রবীণ সিনেমা রসিক বললেন, হুকু চৌধুরী যে নতুন ছবিটা বানাচ্ছে—মুঠো মুঠো প্রেম, নিশ্চয় তারই বিজ্ঞাপন। আর একজন বললেন, তোমরা কিছুই বোেঝ না, এ হচ্ছে চা-এর বিজ্ঞাপন, দু দিন পরেই লিখবে–আমার নাম চা, আমাকে নিয়মিত পান করুন, তা হলেই সংসারে শান্তি বিরাজ করবে। আর একজন বললেন, চা নয়, এ হচ্ছে বনস্পতির বিজ্ঞাপন। বুড়োর দল কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত মানলেন না। তাঁদের মতে এ হচ্ছে মামলী পারিবারিক কেলেঙ্কারির ব্যাপার, সিনেমা দেখে আর উপন্যাস পড়ে সমাজের যে অধঃপতন হয়েছে তারই লক্ষণ।

কয়েক দিন পরেই উৎকণ্ঠা স্তম্ভে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল—

লেত্তি দেবী, আপনার মনের বল দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার ভাল নাম লতিকা কি ললিতা তা জানি না, আমাকেও আপনি চিনবেন না, তব, সাহস করে অনুরোধ করছি, আপনার ব্যর্থ অতীতকে পদাঘাতে দরে নিক্ষেপ করুন, প্রেমের বীর্ষে অশঙ্কিনী হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ান, আমরা দুজনে স্বর্ণময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতে অগ্রসর হব। আমি আপনার অযোগ্য সাথী নই, এই গ্যারান্টি দিতে পারি। আরও অনেক কিছু লিখতুম, কিন্তু কাগজওয়ালারা ডাকাত, এক লাইনের রেট পাঁচ সিকে নেয়, সেজন্যে এখানেই থামতে হল। উত্তরের আশায় উৎকণ্ঠিত হয়ে রইলুম, আপনার ঠিকানা পেলে মনের কথা সবিস্তারে লিখব। কৃষ্ণধন কুণ্ডু (বয়স ২৬), এঞ্জিনিয়ার, গণেশ কটন মিল, পারেল, বম্বে।

দু দিন পরে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল–

শ্রীমান পানুর পিতা মহাশয়, আপনার বিজ্ঞাপন দৃষ্টে জানিলাম আপনি আবার বিবাহ করিবেন, সে কারণে ঘটক লাগাইয়াছেন। যদি ইতিমধ্যে অন্য কাহারও সঙ্গে পাকা কথা না হইয়া থাকে তবে আমার প্রস্তাবটি বিবেচনা করিবেন। আমি এখানকার ফিমেল জেলের সুপারইনটেনডেন্ট, বয়স চল্লিশের কম, হাজার দশেক টাকা পজি আছে। চাকরি আর ভাল লাগে না, বড়ই অপ্রীতিকর, সেজন্য সংসার ধম করিতে চাই। যদি আমার পাণিগ্রহণে সম্মত থাকেন তবে সত্বর জানাইবেন, কারণ আরও দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্ত চলিতেছে। ডকটর মিস সত্যভামা ব্যানার্জি, পি-এইচ-ডি, ফিমেল জেল, চুন্দ্রিগড়।

এর পর উৎকণ্ঠা স্তম্ভে আর কোনও বিজ্ঞাপন দেখা গেল না, কিন্তু ব্যাপারটি অনেক দূর গড়িয়েছিল। বিশ্বস্ত সূত্রে যা জানা গেছে তাই সংক্ষেপে বলছি।

বিপিন নন্দীর মেয়ে লেত্তি (ভাল নাম লজ্জাবতী) কৃষ্ণধন কুণ্ডুকে বিয়ে করেছে। পানু অর্থাৎ প্রাণতোষের বড়ো বাপ মনোতোষ ভটচাজ ডকটর সত্যভামাকে বিয়ে করেছেন। অগত্যা পানুর পিসীমা কাশী চলে গেছেন।

বোম্বাই থেকে পানু তার বাপকে চিঠি লিখেছে–

পুজনীয় বাবা, তোমার টাকার জন্যে ভেবো না, যা নিয়েছিলাম সুদ সুদ্ধ ফেরত দেব। আমি মোটেই কুপুত্তুর নই, ফেলনা বংশধর নই, তোমার বংশ আমি উজ্জ্বল করেছি। আমার নাম এখন প্রাণতোষ নয়, সুন্দরকুমার। নয়নসমুখ ফিল্ম কম্পানিতে জয়েন করেছি, বেশ ভাল রোজগার। এখানে আমার খুব নাম, সবাই বলে সুন্দরকুমারের মতন খসরত অ্যাক্টর দেখা যায় না। শুনলে অবাক হবে, বিখ্যাত স্টার মিস গুলাবা ভেরেন্দী আমাকে বিবাহ করেছেন। তাঁর কত টাকা আছে জান? পাঁচ লাখ বাহান্ন হাজার, তা ছাড়া তিনটে মোটর কার। আগামী রবিবার বন্ধে মেলে আমি সস্ত্রীক কলকাতায় পৌঁছবে। আমাদের জন্যে দোতলার বড় ঘরটা সাহেবী স্টাইলে সাজিয়ে রেখো, ফুলদানিতে এক গোছা রজনীগন্ধা যেন থাকে। ভয় নেই, বেশী দিন থাকব না, হপ্তা খানেক পরেই বোম্বাই ফিরে আসব।

মনোতোষ ভটচাজের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ডকটর সত্যভামা বললেন, তা ছেলেটা আসছে আসুক না, তুমি গালাগাল মন্দ দিও না বাপ। পনি, আমাদের বাহাদুর ছেলে।

কৃষ্ণধন কুণ্ডু ছুটি নিয়ে তার বউ লেত্তির সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল। পানু সস্ত্রীক বাড়ি আসছে শুনে লেত্তি চুপ করে থাকতে পারল না, মনোতোষ ভটচাজের বাড়িতে উপস্থিত হল। পাড়ার আরও অনেকে এল, সিনেমা স্টার গুলাবাকে দেখবার জন্যে। কিন্তু পানকে একলা দেখে সবাই নিরাশ হয়ে গেল।

মনোতোষ বললেন, একা এলি যে? তোর বউ কোন চুলোয় গেল?

মাথা চুলকে পান বলল, সে আসতে পারল না বাবা। হঠাৎ মস্কো থেকে একটা তার এল, তাই এক মাসের জন্যে সোবিএত রাষ্ট্রে কলচরাল টুর করতে গেছে।

লেত্তি বলল, সব মিছে কথা। আমরা সদ্য বোম্বাই থেকে এসেছি, সেখানকার সব খবর জানি। গোবা ভেরেন্দী তোমাকে বিয়ে করবে কোন দুঃখে? দু বছর আগে নবাবজাদা সোভানুল্লার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তাঁকে তালাক দিয়ে গলাবা সম্প্রতি লগনচাঁদ বজাজকে বিয়ে করেছে। তুমি তো গ্রান্ট রোডে একটা ইরানী হোটেলে বয়-এর কাজ করতে, চুরি করেছিলে তাই তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

মনোতোষ গর্জন করে বললেন, দূর হ জোচ্চোর ভ্যাগাবন্ড, নয়তো জুতিয়ে লাট করে দেব।

সত্যভামা বললেন, আহা, ছেলেটাকে এখনি তাড়াচ্ছ কেন, আগে একটু জিরক। বাবা পানু ভেবো না, তোমার একটা হিল্লে আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। আমার ফ্রেণ্ড মিষ্টার হায়দর মুস্তাফা কলকাতায় এসেছেন। দক্ষিণ বর্মীয় মৌলমিন শহরে তাঁর বিরাট পোলট্রি ফার্ম আছে, আমি তাঁকে বললেই তোমাকে তার ম্যানেজার করে দেবেন। তুমি তৈরী হয়ে নাও, পরশু তিনি রওনা হবেন, তাঁর সঙ্গেই তুমি যাবে। টাকার জন্যে ভেবো না, আমি তোমার জাহাজ ভাড়া আর কিছু, হাত খরচ দেব।

অতঃপর সকলের উৎকণ্ঠার অবসান হল। তবে পানুর হিল্লে এখনও পাকাপাকি লাগে নি। সাত দিন পরেই সে মুস্তাফা সাহেবের কিছু টাকা চুরি করে সিংগাপুরে পালিয়ে গেল। সেখানে পিপলস চায়না হোটেলে একটা কাজ যোগাড় করেছে, খদ্দেরদের খাবার পরিবেশন করতে হয়। হোটেলের মালিক মিস ফুক-সান তাকে সুনজরে দেখেন। পানুর আশা আছে, ভাল করে খোশামোদ করতে পারলে মিস ফুক-সান তাকে পোষ্য পতির পদে প্রমোশন দেবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *