উভয় সংকট
চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এল। প্রবল বাতাসে গাছপালা আন্দোলিত হলে মনের ভিতরটা কেমন কেঁপে উঠল। খুব সম্ভব ভারী একটা ঝড় আসবে। দীননাথ পত্নী সুধারাণীকে চীৎকার করে ডেকে বললেন, “তারাতারি ঘরে চলে এসো। বাইরের কাজ ফেলে রেখে দাও। দেখতে পাচ্ছ না কেমন ঝড় উঠেছে?”
দীননাথ তড়িঘড়ি করে ঘরের জানালাগুলো বন্ধ করতে ব্যস্ত। এমন সময় তার টেলিফোনটি বেজে উঠল। তিনি সব জানালাগুলো বন্ধ না করেই রিসিভারটি কানে নিয়ে কথা শুনার চেষ্টা করলেন। একদিকে তিনি হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছেন। আর অন্যদিকে খোলা জানালার ভিতর দিয়ে শনশন করে বাতাস এসে পুরো ঘরটিকেই উড়িয়ে নিতে চাইছে। তিনি বললেন, “কে বিরাজ… বাড়ীতে আসবে ?….. কবে?” লাইনটি কেটে যাওয়ায় ভাল করে আর কিছু বুঝতে পারলেন না।
সুধারাণী তাড়াতাড়ি করে ঘরে এসে জানালা বন্ধ করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কার ফোন ?”
— মনে হয় বিরাজ ফোন করেছিল। বাড়ীতে আসার জন্য কিছু বলতে চাইছে।কিন্তু বাতাসের শব্দে আর কিছু বোঝা গেল না। কথা শেষ না হতেই ফোন কেটে গেল।
বিরাজ তাদের একমাত্র সন্তান। ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে খড়গপুরে এক বেসরকারী কম্পানিতে চাকরী পেয়েছে। নববর্ষের ছুটিতে সে প্রতিবার গ্রামের বাড়ীতে আসে। হয়তো সে বাড়ীতে আসার জন্যই ফোন করেছিল। ছেলে এখন স্বাবলম্বী হয়েছে। এক সুপাত্রীর সঙ্গে তার বিয়েটা করিয়ে দিতে পারলে দীননাথ এই গুরুদায়িত্ব থেকে উদ্ধার পেয়ে যান। এই শুভ কাজের জন্য তিনি পাশের গ্রামের এক বন্ধুর মেয়েকে মনে মনে একরকম পছন্দ করেই রেখেছেন। মেয়েটি দেখতে যেমন সুন্দরী, তেমনি নম্র ও ভদ্র। গৃহকর্মেও সিদ্ধহস্তা । ছেলে বাড়িতে এলে বন্ধুকে এই প্রস্তাবে রাজী করানোই হবে প্রথম কাজ । বাকী সব ঠাকুরের ইচ্ছা ।
সেইদিনের ঝড়ঝাপটা শেষ হতে কম পক্ষেও ছয় থেকে সাত ঘন্টা লেগে গেল। অন্য দিনের মতো বিরাজ সেদিন আর বিকেল বেলায় বাড়ীতে ফিরতে পারল না। আর যখন ফিরল, তখন রাত দশটা পার হয়ে গেছে। বাড়াতে এসে ‘মা’ বলে দরজায় আঘাত করতেই মা চমকে উঠে বলল, “ওগো শুনছ, বিরাজের গলার আওয়াজ বলে মনে হল না?”
— তাই তো! এতো রাত্রে বিরাজের আগমন !
পুনরায় দরজায় আঘাত শুনা গেলে মা বলে উঠলেন, “কে বিরাজ?”
বিরাজ উত্তর করল, “হ্যাঁ মা, আমি বিরাজ। তাড়াতাড়ি দরজা খোল। আমার সমস্ত শরীর বৃষ্টিতে ভিজে গেছে।”
এবার ছেলের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট শোনা গেল। দরজা খুলে মা বিরাজকে সিক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাড়াতাড়ি ভিতরে আসতে বললেন। কিন্তু বিরাজ দরজা খোলা পেয়েও তৎক্ষণাৎ ঘরে ঢুকার চেষ্টা না করে তার বাম দিকে স্থির দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
মা বললেন, “কি হয়েছে, ওভাবে এখনও বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস যে? সঙ্গে কেউ এসেছে বুঝি? ভিতরেই নিয়ে আয় না।”
— মা, তার মানে —
কি আমতা আমতা করছিস? এখনও কি সেই ছোট খোকা রয়েছিস?
— মা আমার সঙ্গে এক বান্ধবী এসেছে।
বান্ধবী! সে কিরে, এতো রাত্রিতে হঠাৎ বান্ধবী ?
—মা তুমি ভুল বুঝো না। আমরা ঝড়ে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। যখন ঝড় থেমে গেল তখন তাদের বাড়ী যাবার আর কোন উপায় ছিল না। উপায় না দেখে আমি তাকে সঙ্গে করে এনেছি। আজই আমাদের প্রথম দেখা। নামটি তার “পূজা”।
সুধারাণী দুজনকেই ঘরে তুলে নিলেন বটে, কিন্তু মনের মধ্যে অতি সুক্ষ্ম সংশয় বাসা বেঁধে গেল। এতরাত্রে মেয়েটির উপস্থিতির খবর তাদের বাড়ীতে পৌঁছানোর কোন উপায় রইল না।
পরদিন সকালে আর এক কান্ড বেঁধে গেল। বাড়ীতে একদল প্রতিবেশীর ভীড় দেখা দিল। রাত্রেই রাষ্ট্র হয়ে গেছে যে বিরাজ বিয়ে করে বউ এনে ঘরে তুলেছে। তাই সকলে নতুন বৌকে দেখার জন্য সকাল সকাল বাড়ীতে এসে হাজির। এবার পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে বোস পরিবারকে রীতিমতো হিমশিম্ খেতে হয়েছে।
অতঃপর মায়ের কথায় বিরাজ পূজাকে তাদের বাড়ী পৌঁছিয়ে দিতে গেল। পূজা অতিশয় মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে। বিদায় মুহূর্তে সুধারাণী মনে মনে স্থির করে নিল যে মেয়েটিকে এই ঘরের বউ করে আনবে। তার কাছে সবথেকে পছন্দের ব্যাপারটি হলো যে এই বিপদের সময়ে সে তার ছেলেকে সচ্চরিত্রবান বলে বিশ্বাস করতে পেরেছে। আজকালের যুগে নতুন কাউকে বিশ্বাস করাটা যে বড়ই কঠিন। পূজা মেয়েটা যে অতিশয় স্বাবলম্বী সেটা তার একাকী শহরে গিয়ে অধ্যাপীকার পদে ইন্টারভিউ দেবার ঘটনা থেকেই জানা যায়।
অন্যদিকে সেইদিন দীননাথের বাল্যবন্ধু দামোদর সেন তার একমাত্র মেয়ে মহুয়ার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে তার বাড়ীতে হাজির। ছেলের আগমনের বার্তা পেয়ে তিনি এর আগেও বছর বাড়ীতে এসেছেন। তবে এবারের উদ্দেশ্যটা একেবারে ভিন্ন। বিবাহযোগ্যা কন্যার জন্য সৎপাত্র খুঁজে পাওয়া যেমন ভীষণ কঠিন, আবার খুঁজে পেলেও বিয়ে নিষ্পন্ন করাটা তার থেকেও বড় কঠিন। যাদের অভিজ্ঞতা এ বিষয়ে অতি অল্প তাদের অবস্থা অনেকটা সাঁতার না জেনে নদীতে ঝাপ দেবার মতো। হয়তো ডুবে মরবে, নয়তো ভেসে কোন চড়ে গিয়ে ঠেকবে।
সন্ধ্যা হয়ে এলে বিরাজ বাড়ীতে এসে পৌঁছাল। ছেলের পায়ের শব্দ কানে আসতেই মা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাবা বিরাজ, পূজাকে ভাল ভাবে বাড়ীতে রেখে এসেছিস তো?”
— হ্যাঁ মা।
কেমন দেখলি তাদের বাড়ী ঘর?
— বেশ ভাল।
আর বাড়ীর লোকজন?
—সে বাবা মার অতি আদরের মেয়ে। বাবা অবসর প্রাপ্ত কলেজের অধ্যক্ষ। দাদা বৌদিকে নিয়ে বিদেশে সেটলড্। দু’বছরের মাথায় একবার করে দেশে ফিরেন। প্রথমে আমাকে দেখে একটু সংশয় প্রকাশ করলেও পরবর্তীতে সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। তারপর আমার প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ। আমাকে না খাইয়ে আসতেই দেয়নি।
হ্যারে বাবা, মেয়েটিকে তোর কেমন লেগেছে? মানে বিয়ের জন্য তাকে তোর পছন্দ হলে একটা প্রস্তাব দিয়ে দেখা যেত।
এতক্ষণ দীননাথ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন। ‘বিয়ের প্রস্তাব’ কথাটি কানে বাজতেই দুজনের একেবারে সামনে এসে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ আছে, একখানা ভাল প্রস্তাব আছে। আমার বাল্যবন্ধু দামোদর সেনের একমাত্র কন্যা ‘মহুয়া’।
এইতো আজই এসে এই সুখবরটি আমার কাছে বলে গেল। বিরাজকে তাদের ভীষণ পছন্দ। শুধু তাই নয়, রীতিমতো কন্যাকে দেখার জন্য আমাদের নিমন্ত্রণও দিয়ে গেছেন। তোমাদের যদি মত হয় পরশু রবিবার দিন আমরা গিয়ে মেয়েটাকে দেখে আসি। আমাদের এ অঞ্চলে মহুয়ার মতো খাঁটি মেয়ে দ্বিতীয়টি আর নেই।”
সুধারাণী স্বামীর কথা শুনে বললেন, “প্রস্তাব যখন এসেছে তাহলে দেখেই আসা যাক। আমি ভাবছি একটু অন্যরকম। দামোদর বাবু আমাদের অতি পরিচিত। যদি মহুয়াকে বিরাজের পছন্দ না হয় তা হলে ব্যাপারটা কিভাবে সামাল দেবে?”
দীননাথ বললেন, “মেয়েটি ভারী মিষ্টি। অপছন্দের কিছু নেই। তাছাড়া আমাকেও বেশ সম্মান করে। শুধু বিরাজের সম্মতিটাই বাকি।”
সুধারাণী বললেন, “তোমরা যে যাই বল, পূজা মেয়েটির চমক কিন্তু আমার প্রাণে লেগেছে। কার অমন স্পর্দ্ধা যে এ পাড়ায় তার গুণের পাশে দাঁড়ায়।”
বাবা ও মা যে ভাবে আলাদা পথের যাত্রী মনে হচ্ছে তাতে বিরাজ বেচারা মুখ না খুলে পারল না। সে বলে উঠল, “দুজনকেই যেমন তোমাদের পছন্দ তাহলে তো দেখছি দুজনকেই এবাড়ীতে নিয়ে আসতে হয়। কি বল তোমরা?”
ছেলের কথায় একগাল হেসে সুধারাণী দীননাথকে বললেন, “তুমি তাহলে শীঘ্রই খবর দিয়ে দাও যে আমরা আগামী পরশু সেন বাড়ী যাচ্ছি। তারপর নয় কোন একটা বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছান যাবে।”
নির্দিষ্ট দিনটিতে দীননাথ পত্নী সুধারাণী ও পুত্র বিরাজকে সঙ্গে করে অতি উৎসাহের সঙ্গে বাল্যবন্ধু দামোদরের কন্যা মহুয়াকে দেখার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। সেই বাড়ীতে পা রাখার পূর্বেই তিনি বেশ কয়েকজন লোকের উপস্থিতির আভাস পেলেন। ইতিপূর্বে তিনি যতবার এখানে এসেছেন এমন কোলাহল কখনই লক্ষ্য করেন নি। দামোদর বাবু লজ্জিত ভাবে জানালেন যে তার পত্নী মালতীর অল্পবুদ্ধির ফলস্বরূপ তাদেরকে এক অবাঞ্ছিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে। গতমাসে তার পত্নী যখন বাপের বাড়ী যায়, তখন তার বান্ধবীর ছেলে মহুয়ার কথা জানতে পায়। মালতী স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ না করেই আগামী ররিবার দিন তাদেরকে এখানে আসতে বলে দেয়। সেই পাত্রপক্ষই অগ্রীম এসে পড়াতে আপ্যায়নের সামান্য ব্যাঘাত ঘটে। এটা নিয়েই দামোদরবাবু সংশয়ে আছেন।
দীননাথবাবু বললেন, “দামোদর মশাই, আমাদের নিয়ে আপনি অযথা ভাববেন না। আমরা আপনার কাছের লোক। এই উভয় সংকটে আপনার একটু খানি সাহায্যে আসতে পারলে আমরা ধন্য হই। অতিথি আপ্যায়নের দায়িত্বটুকু আমাদের উপর ছেড়ে দিন। ও আমরা ঠিক দেখে নিতে পারব। আপনার মেয়ে আমারও মেয়ে। তার ভাগ্যে যদি এই আগত ছেলেই লিখা থাকে, তবে তাই যেন হয়। আমাদের এ ব্যাপারে এক ফোঁটা আপত্তিও নেই। আমি হাসিমুখে এই কন্যাদানে আপনার সমসাথী হব ।”
এই মর্মস্পর্শী কথাগুলি দামোদরমশাইকে যে আত্মতৃপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে তাতে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকতে পারে না। নতুন সম্পর্কের আনন্দে সকলেই আহ্লাদিত হয় বটে, কিন্তু পুরনো সম্পর্ককে কিভাবে বিনা আচে টিকিয়ে রাখতে হয় তা দীননাথবাবুর থেকেই শিক্ষণীয়। তিনি দীননাথবাবুর হাত ধরে বললেন , ” এতদিন তোমাকে শুধু একজন ভাল বন্ধু হিসেবেই জেনেছি,আজ তোমাকে একজন বড় মনের মানুষ হিসেবেই জানার সুযোগ পেলাম ।”