Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উপসংহার – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

উপসংহার – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

সেদিন দুপুরবেলা ব্যোমকেশ আমাকে তাঁহার প্ল্যান প্রকাশ করিয়া বলিল।

প্ল্যান শুনিয়া বিশেষ আশাপ্ৰদ বোধ হইল না; এ যেন অজ্ঞাত পুকুরে মাছের আশায় ছিপ ফেলা‌, চারে মাছ আসিবে কিনা কোনও স্থিরতা নাই।

আমার মন্তব্য শুনিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সে তো বটেই‌, অন্ধকারে ঢ়িল ফেলছি‌, লাগবে কিনা জানি না। যদি না লাগে তখন অন্য উপায় বার করতে হবে।’

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কমিশনার সাহেবের মত আছে?’

‘আছে।’

‘আমাকে কিছু করতে হবে?’

‘স্রেফ মুখ বুজে থাকতে হবে‌, আর কিছু নয়। আমি এখনই বেরিয়ে যাব; কারণ মরতে হলে আজই মরতে হয়, একটা দেশলায়ের বাক্স আর ক’দিন চলে? তুমি ইচ্ছে করলে কাল সকালে শ্রীরামপুরে গিয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির লাস দর্শন করতে পার।’

‘ইতিমধ্যে এখানে যদি কেউ তোমার খোঁজ করে‌, তাকে কি বলব?’

‘বলবে‌, আমি গোপনীয় কাজে কলকাতার বাইরে গিয়েছি‌, কবে ফিরব ঠিক নেই।’

‘বীরেনবাবু আজ বিকেলে আসতে পারেন‌, তাঁকেও ঐ কথাই বলব?

কিয়ৎকাল ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া থাকিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, তাঁকেও ঐ কথাই বলবে। মোট কথা‌, এ সম্বন্ধে কোনও কথাই কইবে না।’

‘বেশ–মনে মনে একটু বিস্মিত হইলাম। বীরেনবাবু পুলিসের লোক‌, বিশেষত এ ব্যাপারে তিনিই এক প্রকার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী; তবু তাঁহার নিকট হইতেও গোপন করিতে হইবে কেন?

আমার অনুচ্চারিত প্রশ্ন যেন বুঝিতে পারিয়াই ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বীরেনবাবুকে না বলার কোনও বিশেষ কারণ নেই‌, মামুলি সতর্কতা। বর্তমানে তুমি আমি আর কমিশনার সাহেব ছাড়া এ প্ল্যানের কথা আর কেউ জানে না‌, অবশ্য কাল আরও কেউ কেউ জানতে পারবে। কিন্তু যতক্ষণ পারা যায় কথাটা চেপে রাখাই বাঞ্ছনীয়। চাণক্য পণ্ডিত বলেছেন‌, মন্ত্রগুপ্তিই হচ্ছে কূটনীতির মুখবন্ধ; অতএব তুমি দৃঢ়ভাবে মুখ বন্ধ করে থাকবে।’

ব্যোমকেশ প্রস্থান করিবার আধঘণ্টা পরে বীরেনবাবু ফোন করিলেন।

‘ব্যোমকেশবাবু কোথায়?’

‘তিনি কলকাতার বাইরে গেছেন।’

‘কোথায় গেছেন?’

‘জানি না।’

‘কখন ফিরবেন?’

‘কিছুই ঠিক নেই। তিন চার দিন দেরি হতে পারে।’

‘তিন চার দিন। আজ সকালে আপনারা আমার বাসায় গিয়েছিলেন কেন?

ন্যাকা সাজিয়া বলিলাম‌, ‘তা জানি না।’

তারের অপর প্রান্তে বীরেনবাবু একটা অসন্তোষ-সূচক শব্দ করিলেন‌, ‘আপনি যে কিছুই জানেন না দেখছি। ব্যোমকেশবাবু কোন কাজে গেছেন তাও জানেন না?’

‘না।‘

বীরেনবাবু সশব্দে তার কাটিয়া দিলেন।

ক্ৰমে চারিটা বাজিল। পুঁটিরামকে চা তৈয়ার করিবার হুকুম দিয়া‌, এবার কি করিব ভাবিতেছি‌, এমন সময় দ্বারে মৃদু টোকা পড়িল।

উঠিয়া দ্বার খুলিয়া দেখিলাম‌, আমাদের পূর্বদিনের দগ্ধানন ব্যোমকেশবাবু। তাঁহার হাতে একটি সংবাদপত্র।

তিনি বলিলেন‌, ‘ব্যোমকেশবাবু বেরিয়েছেন নাকি?’

‘হ্যাঁ। আসুন।’

তাঁহার বিশেষ কোনও প্রয়োজন ছিল না‌, পূর্বদিনের আমন্ত্রণ স্মরণ করিয়া গল্পগুজব করিতে আসিয়াছিলেন। আমিও একলা বৈকালটা কি করিয়া কাটাইবি ভাবিয়া পাইতেছিলাম না‌, বোসজা মহাশয়কে পাইয়া আনন্দিত হইলাম।

বোসজা আসন পরিগ্ৰহ করিয়া বলিলেন‌, ‘আজ কাগজে একটা মজার বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে‌, সেইটে আপনাদের দেখাতে এনেছিলুম। হয়তো আপনাদের চোখে পড়েনি—’ কাগজটা খুলিয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিলেন‌, ‘দেখেছেন কি?’

সেই বিজ্ঞাপন। বড় দ্বিধায় পড়িলাম। মিথ্যা কথা বিশ্বাসযোগ্য করিয়া বলিতে পারি না‌, বলিতে গেলেই ধরা পড়িয়া যাই। অথচ ব্যোমকেশ চাণক্য-বাক্য উদ্ধৃত করিয়া মুখ বন্ধ রাখিতে উপদেশ দিয়া গিয়াছে। এইরূপ সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় পড়িয়া কি বলিব ভাবিতেছি‌, এমন সময় বোসজা মৃদুকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন‌, ‘পড়েছেন‌, অথচ ব্যোমকেশবাবু কোনও কথা প্রকাশ করতে মানা করে গেছেন–না?’

আমি চুপ করিয়া রহিলাম।

তিনি বলিলেন‌, ‘সম্প্রতি দেশলায়ের কাঠি নিয়ে একটা মহা গণ্ডগোল বেধে গেছে। এই সেদিন দেবকুমারবাবুর মোকদ্দমা শেষ হল‌, তাতেও দেশলাই; আবার দেখছি দেশলাইয়ের বাক্সের বিজ্ঞাপন—মূল্য এক লক্ষ টাকা। সাধারণ লোকের মধ্যে স্বভাবতই সন্দেহ হয়‌, দুটোর মধ্যে কোনও যোগ আছে।’ বলিয়া সপ্রশ্ন চক্ষে আমার পানে চাহিলেন।

আমি এবারও নীরব হইয়া রহিলাম! কথা কহিতে সাহস হইল না‌, কি জানি আবার হয়তো বেফাঁস কিছু বলিয়া ফেলিব।

তিনি বলিলেন‌, ‘যাক ও কথা‌, আপনি হয়তো মনে করবেন। আমি আপনাদের গোপনীয় কথা বার করবার চেষ্টা করছি।’ বলিয়া অন্য প্রসঙ্গ উত্থাপন করিলেন। আমি হাঁফ ছাড়িয়া বাঁচিলাম।

পুঁটিরাম চা দিয়া গেল। চায়ের সঙ্গে ক্রিকেট‌, রাজনীতি‌, সাহিত্য‌, নানাবিধ আলোচনা হইল। দেখিলাম লোকটি বেশ মিশুক ও সদালাপী—অনেক বিষয়ে খবর রাখেন।

এক সময় জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘আচ্ছা‌, আপনার কি করা হয়? কিছু মনে করবেন না‌, আমাদের দেশে প্রশ্নটা অশিষ্ট নয়।’

তিনি একটু চুপ করিয়া বলিলেন‌, ‘সরকারী চাকরি করি।’

‘সরকারী চাকরি?’

‘হাঁ। তবে সাধারণ চাকরের মত দশটা চারটে অফিস করতে হয় না। চাকরিটা একটু বিচিত্র রকমের।’

‘ও—কি করতে হয়?’ প্রশ্নটা ভদ্ররীতিসম্মত নয় বুঝিতেছিলাম‌, তবে কৌতুহল দমন করিতে পারিলাম না।

তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, ‘রাজ্য শাসন করবার জন্যে গভর্নমেন্টকে প্রকাশ্যে ছাড়াও অনেক কাজ করতে হয়‌, অনেক খবর রাখতে হয়; নিজের চাকরদের ওপর নজর রাখতে হয়। আমার কাজ অনেকটা ঐ ধরনের।’

বিস্মিতকণ্ঠে বলিলাম‌, ‘সি আই ডি পুলিস?’

তিনি মৃদু হাসিলেন‌, ‘পুলিসের ওপরও পুলিস থাকতে পারে তো। আপনাদের এই বাসাটি দিব্যি নিরিবিলি‌, মেসের মধ্যে থেকেও মেসের ঝামেলা ভোগ করতে হয় না। কতদিন এখানে আছেন??

কথা পাল্টাইয়া লইলেন দেখিয়া আমিও আর কিছু জিজ্ঞাসা করিতে পারিলাম না; বলিলাম‌, ‘আমি আছি বছর আষ্টেক‌, ব্যোমকেশ তার আগে থেকে আছে।’

তারপর আরো কিছুক্ষণ সাধারণভাবে কথাবার্তা হইল। তাঁহার মুখের এরূপ অবস্থা কি করিয়া হইল জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন‌, কয়েক বছর আগে ল্যাবরেটরিতে কাজ করিতে করিতে হঠাৎ অ্যাসিডের শিশি ভাঙিয়া মুখে পড়িয়া যায়। সেই অবধি মুখের অবস্থা এইরূপ হইয়া গিয়াছে।

অতঃপর তিনি উঠিলেন। দ্বারের দিকে যাইতে যাইতে হঠাৎ ফিরিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন‌, ‘দারোগা বীরেনবাবুর সঙ্গে আপনাদের জানাশোনা আছে। কেমন লোক বলতে পারেন?’

‘কেমন লোক? তাঁর সঙ্গে আমাদের কাজের সূত্রে আলাপ। তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে তো কিছু জানি না।‘

‘তাঁকে খুব লোভী বলে মনে হয় কি?’

‘মাফ করবেন ব্যোমকেশবাবু্‌, তাঁর সম্বন্ধে আমি কিছুই বলতে পারি না।’

‘ও-আচ্ছা। আজ চললুম।’ তিনি প্ৰস্থান করিলেন। কিন্তু তাঁহার কথাগুলো আমার মনে কাঁটার মত বিঁধিয়া রহিল। বীরেনবাবুর চরিত্র সম্বন্ধে ইনি অনুসন্ধিৎসু কেন? বীরেনবাবু কি লোভী? পুলিসের কর্মচারী সাধারণত অর্থগৃধ্নু হয় শুনিয়াছি। তবে বীরেনবাবু সম্বন্ধে কখনও কোনো কানাঘুষাও শুনি নাই। তবে এ প্রশ্নের তাৎপর্য কি? এবং গভর্নমেন্টের এই গোপন ভৃত্যটি কোন মতলবে আমাকে এই প্রশ্ন করিলেন?

পরদিন সকালে শয্যাত্যাগ করিয়াই খবরের কাগজ খুলিলাম। যাহা প্রত্যাশা করিয়াছিলাম তাহা বাহির হইয়াছে। বিজ্ঞাপন পৃষ্ঠার শুরুতেই রহিয়াছে—

“গতকল্য বৈকালে সাড়ে পাঁচটার সময় শ্রীরামপুর স্টেশনের ওয়েটিং রুমে এক অজ্ঞাত ভদ্রলোক যুবকের লাস পাওয়া গিয়াছে। মৃতদেহে কোথাও ক্ষতচিহ্ন নাই। মৃত্যুর কারণ এখনও অজ্ঞাত। মৃতের বয়স আন্দাজ ত্রিশ বৎসর‌, সুশ্ৰী চেহারা‌, গোঁফ দাড়ি কামানো। পরিধানে বাদামী রংয়ের গরম পাঞ্জাবি ও সাদা শাল ছিল। যুবক কলিকাতা হইতে ৪-৫৩ মিঃ লোকাল ট্রেনে শ্রীরামপুরে আসিয়াছিল; পকেটে টিকিট পাওয়া গিয়াছে। যদি কেহ লাস সনাক্ত করিতে পারেন, শ্রীরামপুর হাসপাতালে অনুসন্ধান করুন।“

তাড়াতাড়ি মুখ-হাত ধুইয়া কিছু জলযোগ করিয়া শ্রীরামপুরের উদ্দেশ্যে বাহির হইলাম। দ্বিতলে নামিয়া একতলার সিঁড়িতে পদার্পণ করিতে যাইব‌, পিছু ডাক পড়িল‌, ‘অজিতবাবু্‌, সক্কাল না হতে কোথায় চলেছেন?’

দেখিলাম‌, ব্যোমকেশবাবু নিজের ঘরের দরজায় দাঁড়াইয়া আছেন। আজ আর মিথ্যা কথা বলিতে বাধিল না‌, বেশ সড়ৎ করিয়া বাহির হইয়া আসিল–’যাচ্ছি ডায়মন্ড হারবারে–এক বন্ধুর বাড়ি। ব্যোমকেশ কবে ফিরবে কিছু তো ঠিক নেই‌, দুদিন ঘুরে আসি।’

‘তা বেশ। আজকের খবরের কাগজ পড়েছেন?’

‘কালকেতু’খানা বগলে করিয়া লইয়াছিলাম‌, বলিলাম‌, না‌, গাড়িতে পড়তে পড়তে যাব।’ বলিয়া নামিয়া গেলাম।

রাস্তায় নামিয়া শিয়ালদহের দিকে কিছুদূর হাঁটিয়া গেলাম‌, তারপর সেখান হইতে ট্রাম ধরিয়া হাওড়া অভিমুখে রওনা হইলাম। নূতন মিথ্যা কথা বলিতে আরম্ভ করিলে একটু অসুবিধা এই হয় যে ধরা পড়িবার লজ্জাট সর্বদা মনে জাগারুক থাকে। ক্রমশ পরিপক্ক হইয়া উঠিলে বোধকরি ও দুর্বলতা কাটিয়া যায়।

যা হোক‌, হাওড়ায় ট্রেনে চাপিয়া বেলা সাড়ে ন’টা আন্দাজ শ্রীরামপুর পৌঁছিলাম।

হাসপাতালের সম্মুখে একটি ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিলেন‌, তাঁহাকে লাসের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করিয়া অদূরে একটি ছোট কুঠরী নির্দেশ করিয়া দিলেন। কুঠরীটি মূল হাসপাতাল হইতে পৃথক‌, সম্মুখে একজন পুলিস প্রহরী দাঁড়াইয়া আছে।

কাচ ও তার নির্মিত ক্ষুদ্র ঘরটির সম্মুখে গিয়া আমার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিলাম; ভিতরে প্রবেশ করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হইল না। দেখিলাম‌, ঘরের মাঝখানে শানের মত লম্বা বেদীর উপরে ব্যোমকেশ শূইয়া আছে—তাহার পা হইতে গলা পর্যন্ত একটা কাপড় দিয়া ঢাকা। মুখখানা মৃত্যুর কাঠিন্যে স্থির।

আমি তাহার পাশে দাঁড়াইয়া মৃদুস্বরে বলিলাম‌, আবুহোসেন জাগো।’

ব্যোমকেশ চক্ষু খুলিল।

‘কতক্ষণ এইভাবে অবস্থান করছ?’

‘প্রায় দুঘণ্টা। একটা সিগারেট পেলে বড় ভাল হত।’

‘অসম্ভব। মৃত ব্যক্তি পিণ্ডি খেতে পারে শুনেছি‌, কিন্তু সিগারেট খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ।’

‘ঠিক জানো? মনুসংহিতায় কোনও বিধান নেই?’

‘না। তারপর‌, ক’জন লোক দেখতে এল?’

‘মাত্র তিনজন। স্থানীয় লোক‌, নিতান্তই লোফার ক্লাশের।’

‘তবে?’

‘এখনও হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। আজ সারাদিন আছে।–কালকেও অন্তত সকালবেলাটা পাওয়া যাবে।’

‘দুদিন ধরে এইখানে পড়ে থাকবে? মনে কর যদি বিজ্ঞাপনটা তাঁর চোখে না পড়ে? ‘

‘চোখে পড়তে বাধ্য। তিনি এখন অনবরত বিজ্ঞাপন অন্বেষণ করছেন।’

‘তা বটে! যা হোক‌, এখন আমি কি করব বল দেখি।’

‘তুমি এই ঘরের কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে বসে থাক‌, যারা আসছে তাদের ওপরে লক্ষ্য রাখ। অবশ্য পুলিস নজর রেখেছে; যিনি এই হতভাগ্যকে পরিদর্শন করতে আসছেন তাঁরই পিছনে গুপ্তচর লাগছে। কিন্তু অধিকন্তু ন দোষায়। তুমি যদি কোনো চেনা লোক দেখতে পাও‌, তখনি এসে আমাকে খবর দেবে। আমার মুশকিল হয়েছে চোখ খুলতে পারছি না‌, কাজেই যাঁরা এখানে পায়ের ধুলো দিচ্ছেন তাঁদের শ্ৰীমুখ দর্শন করা হচ্ছে না। মড়া যদি মিটমিট করে তাকাতে আরম্ভ করে তাহলে বিষম হৈ চৈ পড়ে যাবে কিনা।’

‘বেশ। আমি কাছাকাছি রইলুম। পুলিস আবার হাঙ্গামা করবে না তো?’

‘দ্বারের প্রহরীকে চুপি চুপি নিজের পরিচয় দিয়ে যেও‌, তাহলে আর হাঙ্গামা হবে না। তিনি একটি বর্ণচোরা আম; দেখতে পুলিস কনেস্টবল বটে। কিন্তু আসলে একজন সি আই ডি দারোগা।‘

বাহিরে আসিয়া ছদ্মবেশী প্রহরীকে আত্মপরিচয় দিলাম; তিনি অদূরে একটি মোতির ঝাড় দেখাইয়া দিলেন। মোতির ঝাড়টি এমন জায়গায় অবস্থিত যে তাহার আড়ালে লুকাইয়া বসিলে ব্যোমকেশের কুঠরীর দ্বার পরিষ্কার দেখা যায়‌, অথচ বাহির হইতে ঝোপের ভিতরে কিছু আছে কিনা বোঝা যায় না।

ঝোপের মধ্যে গিয়া বসিলাম। চারিদিক ঘেরা থাকিলেও মাথার উপর খোলা; দিব্য আরামে রোদ পোহাইতে পোহাইতে সিগারেট ধরাইলাম।

ক্ৰমে বেলা যত বাড়িতে লাগিল‌, দৰ্শন-অভিলাষী লোকের সংখ্যাও একটি দুইটি করিয়া বাড়িয়া চলিল। উৎসুকভাবে তাঁহাদের পর্যবেক্ষণ করিতে লাগিলাম। সকলেই অপরিচিত‌, চেহারা দেখিয়া বোধ হইল‌, অধিকাংশই বেকার লোক একটা নূতন ধরনের মজা পাইয়াছে।

ক্রমে এগারোটা বাজিল‌, মাথার উপর সূর্যদেব প্রখর হইয়া উঠিতে লাগিলেন। র‍্যাপারটা মাথায় চাপা দিয়া বসিয়া রহিলাম। একটা নৈরাশ্যের ভাব ধীরে ধীরে মনের মধ্যে প্রবল হইয়া উঠিতে লাগিল। যে-ব্যক্তি দেশলাই চুরি করিয়াছে‌, সে শ্রীরামপুরে একজন অজ্ঞাত ব্যক্তির লাস দেখিতে আসিবে কেন? আর‌, যদি বা আসে‌, এতগুলো লোকের মধ্যে তাহাকে দেশলাই-চোর বলিয়া চিনিয়া লওয়া যাইবে কিরূপে? সত্য‌, সকলের পিছনেই পুলিস লাগিবে‌, কিন্তু তাঁহাতেই বা কি সুবিধা হইতে পারে? মনে হইল‌, ব্যোমকেশ বৃথা পণ্ডশ্ৰম করিয়া মরিতেছে।

ব্যোমকেশের ঘরের দিকে চাহিয়া এই সব কথা ভাবিতেছিলাম‌, হঠাৎ চমক ভাঙিয়া গেল। একটি লোক দ্রুতপদে আসিয়া কুঠরীতে প্রবেশ করিল; বোধহয় পাঁচ সেকেন্ড। পরেই আবার বাহির হইয়া আসিল–প্রহরীর প্রশ্নে একবার মাথা নাড়িয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেল।

লোকটি আমাদের মেসের নূতন ব্যোমকেশবাবু। তাঁহাকে দেখিয়া এতই স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিলাম যে তিনি চলিয়া যাইবার পরও কিয়ৎকাল বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে বসিয়া রহিলাম তারপর ধড়মড় করিয়া উঠিয়া সেই ঘরের অভিমুখে ছুটিলাম।

ব্যোমকেশ বোধকরি আমার পদশব্দ শুনিয়া আবার মড়ার মত পড়িয়া ছিল‌, আমি তাহার কাছে গিয়া উত্তেজিত স্বরে বলিলাম‌, ‘ওহে‌, কে এসেছিলেন জানো? তোমার মিতে–মেসের সেই নূতন ব্যোমকেশবাবু।’

ব্যোমকেশ সটান উঠিয়া বসিয়া আমার পানে বিস্ফারিত নেত্ৰে তাকাইল। তারপর বেদী হইতে লাফাইয়া নীচে নামিয়া বলিল‌, ‘ঠিক দেখেছ? কোনও ভুল নেই?’

‘কোনও ভুল নেই।’

‘যাঃ‌, এতক্ষণে হয়তো পালাল।’

ব্যোমকেশের গায়ে জামা কাপড় ছিল বটে। কিন্তু জুতা পায়ে ছিল না‌, সেই অবস্থাতেই সে বাহিরের দিকে ছুটিল। হাসপাতালের সম্মুখে যে ভদ্রলোকটিকে আমি দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিয়াছিলাম, তিনিও তখনও সেখানে ছিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘কোথায় গেল? এখনি যে-লোকটা এসেছিল?’

ভদ্রলোক অত্যন্ত বিচলিত হইয়া বলিলেন‌, ‘সেই নাকি?’

‘হ্যাঁ–তাকেই গ্রেপ্তার করতে হবে।’

ভদ্রলোক মাথায় হাত দিয়া বলিলেন‌, ‘সে পালিয়েছে।’

‘পালিয়েছে?’

‘সে কলকাতা থেকে ট্যাক্সিতে এসেছিল‌, আবার ট্যাক্সিতে চড়ে পালিয়েছে। আমাদের মোটর-বাইকের বন্দোবস্ত করা হয়নি‌, তাই—’

দাঁতে দাঁত ঘষিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘এর জবাবদিহি আপনি করবেন।—এস অজিত‌, যদি একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায়–হয়তো এখনও–’

কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। অগত্যা বাসে চড়িয়াই কলিকাতা যাত্ৰা করিলাম।

পথে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘উনিই তাহলে?’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল‌, ‘হুঁ।’

‘কিন্তু বুঝলে কি করে?’

‘সে অনেক কথা-পরে বলব।‘

‘আচ্ছা‌, উনি অত তাড়াতাড়ি পালালেন কেন? তুমি যদি মরে গিয়েই থাকো—’

‘উনি শিকারী বেড়াল‌, ঘরের মধ্যে পা দিয়েই বুঝেছিলেন যে ফাঁদে পা দিয়েছেন। তাই চট্‌পট্‌ সরে পড়লেন।’

সাড়ে বারোটার সময় মেসে পৌঁছিয়া দ্বিতলে উঠিয়া দেখিলাম সিঁড়ির মুখে মেসের ম্যানেজার দাঁড়াইয়া আছেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘ব্যোমকেশবাবু এসেছিলেন?’

ম্যানেজার সবিস্ময়ে নগ্নপদে ব্যোমকেশকে নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন‌, ‘দু নম্বর ব্যোমকেশবাবু? তিনি তো এই খানিকক্ষণ হল চলে গেলেন। বাড়ি থেকে জরুরী খবর পেয়েছেন‌, তাই তাড়াতাড়ি চলে যেতে হল। তিনিও আপনার খোঁজ করছিলেন। আপনাকে নমস্কার জানিয়ে গেছেন। বলে গেছেন‌, আপনি যেন দুঃখ না করেন‌, শীগগির আবার দেখা হবে।’

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress