চিন্তা করিবার খোরাক পাইলে
চিরদিনই লক্ষ্য করিয়াছি, চিন্তা করিবার একটা বড় রকম খোরাক পাইলে ব্যোমকেশ কেমন যেন নিশ্চল সমাহিত হইয়া যায়। তখন তাহার সহিত কথা কহিতে যাওয়া প্ৰাণান্তকর হইয়া উঠে; হয় কথা শুনিতে পায় না, নয়তো এমন তেরিয়া হইয়া উঠে যে হাতাহাতি না করিয়া আর উপায়ান্তর থাকে না, কিন্তু আজ দ্বিপ্রহরে আহারাদির পর সে যখন বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিল এবং সিগারেটের পর সিগারেট পুড়াইয়া ছাই করিয়া ফেলিতে লাগিল, তখন তাহার ভাবগতিক দেখিয়া বুঝিলাম-কোনও কারণে তাহার একাগ্ৰ চিন্তার পথে বিঘ্ন হইয়াছে, চেষ্টা করিয়াও সে মনকে ঐকান্তিক চিন্তায় নিয়োজিত করিতে পারিতেছে না। তারপর সে যখন চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া এ-ঘর ও-ঘর ছটফট করিয়া বেড়াইতে লাগিল, তখন আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আজ কি হল তোমার! অমন ফিজেট্ করছ, কেন?’
ব্যোমকেশ লজ্জিতভাবে চেয়ারে বসিয়া পড়িয়া বলিল, ‘কি জানি আজ কিছুতেই মন বসাতে পারছি না, কেবলই বাজে কথা মনে আসছে—‘
আমি বলিলাম, ‘গুরুতর কাজ যখন হাতে রয়েছে তখন বাজে চিন্তায় সময় নষ্ট করা উচিত নয়।‘
ঈষৎ বিরক্তভাবে ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমি কি ইচ্ছে করে বাজে চিন্তা করছি? আজ সকালের ঐ চিঠিখানা—‘
‘কোন চিঠি?’
‘আরে ঐ যে কোকনন্দ গুপ্ত। ঘুরে ফিরে কেবল ঐ কথাই মনে আসছে।’
আমি বিস্মিতভাবে বলিলাম, ‘ও চিঠিতে এমন কি আছে–’
‘কিছুই নেই। তবু মনে হচ্ছে চিঠিখানা যদি আমাকেই লিখে থাকে–যদি–’
‘ঠিক বুঝলুম না। চিঠির লেখককে তুমি চেনো না, আর একজন লোক সে-চিঠি নিজের বলে দাবি করছেন, তবু চিঠি তোমার হবে কি করে?’
‘তা বটে–কিন্তু চিঠির কথাগুলো তোমার মনে আছে?’
‘খুব গদগদভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ছাড়া তাতে তো আর কিছু ছিল না। এ নিয়ে এত দুর্ভাবনা কেন?
‘ঠিক বলেছ’—হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া সে বলিল, ‘মস্তিষ্ককে বাজে চিন্তা করবার প্রশ্রয় দেওয়া কিছু নয়, ক্রমে একটা বদ-অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। নাঃ—এখন কেবল দেশলায়ের বাক্স ধ্যান জ্ঞান করব। আমি লাইব্রেরিতে চললুম, চা তৈরি হলে ডেকো।’ বলিয়া লাইব্রেরি ঘরে ঢুকিয়া, যেন বাজে চিন্তাকে বাহিরে রাখিবার জন্যই দৃঢ়ভাবে দরজা বন্ধ করিয়া দিল।
তারপর বিকাল কাটিয়া গেল; রাত্রি হইল। কিন্তু ব্যোমকেশের সেই অস্থির বিক্ষিপ্ত মনের অবস্থা দূর হইল না। বুঝিলাম, সে এখনও কিছু স্থির করিতে পারে নাই।
গভীর রাত্রে, লেপ মুড়ি দিয়া ঘুমাইতেছিলাম, হঠাৎ ব্যোমকেশের ঠেলা খাইয়া জাগিয়া উঠিলাম। বলিলাম, ‘কি হয়েছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ওহে, একটা মতলব মাথায় এসেছে—‘
মাথার উপর লেপ চাপা দিয়া বলিলাম, ‘এত রাত্ৰে মতলব?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘হ্যাঁ, শোনো। যে লোক দেশলাই চুরি করেছে, সেই আমাকে মারবার চেষ্টা করছে–কেমন? এখন মনে করা, আমি যদি সত্যিই–’
আমি ঘুমাইয়া পড়িলাম।
সকালে প্রাতরাশ করিতে করিতে বলিলাম, কাল রাত্ৰে তুমি কি সব বলছিলে, শেষ পর্যন্ত শুনিনি।‘
ব্যোমকেশ গভীর মুখে কাগজ দেখিতে দেখিতে বলিল, ‘তা শুনবে কেন? কাল রাত্রে আমার মৃত্যু-সংবাদ তোমাকে দিলুম, তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে লাগলে। এমন না হলে বন্ধু!’
আমি আৎকাইয়া উঠিলাম, মৃত্যু-সংবাদ! মানে?’
‘মানে শীঘ্রই আমার মৃত্যু হবে। কিন্তু তার আগে একবার কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দেখা করা দরকার।‘ ঘড়ির দিকে তাকাইয়া সে বলিল, ‘এখন সওয়া আটটা। ন’টার সময় বৈরুলেই হবে।‘
‘কি আবোল-তাবোল বকছ বুঝতে পারছি না।’
ব্যোমকেশ মৃদু হাসিয়া কাগজে মন দিল। বুঝিলাম, কাল গভীর রাত্রে উত্তেজনার ঝোঁকে যাহা বলিয়া ফেলিয়াছিল এখন আর তাহা সহজে বলিবে না। নিশ্চয় কোনও অদ্ভূত ফন্দি বাহির করিয়াছে; জানিবার জন্য মনটা ছটফট করিতে লাগিল। রাত্রে তাহার কথা শেষ হইবার আগেই ঘুমাইয়া পড়িয়া ভাল করি নাই।
মিনিট পাঁচেক নীরবে কাটিল। ব্যোমকেশকে খোঁচা দিয়া কথাটা বাহির করা যাইতে পারে কি না ভাবিতেছি, হঠাৎ সে কাগজ হইতে মুখ তুলিয়া বলিল, ‘এক লাখ টাকা দিয়ে এক বাক্স দেশলাই কিনবে?’
‘সে আবার কি?’
‘একজন ভদ্রলোক বিক্রি করতে চান। এই দ্যাখ।’ বলিয়া সে সংবাদপত্র আমার হাতে দিল। দেখিলাম দ্বিতীয় পৃষ্ঠার মাঝখানে ব্র্যাকেট দিয়া ঘেরা এই বিজ্ঞাপন বাহির হইয়াছে–
এক বাক্স দিয়াশলাই বিক্রি আছে। দাম–এক লক্ষ টাকা। বাক্সে কুড়িটি কাঠি আছে; প্রত্যেকটির মূল্য পাঁচ হাজার। খুচরা ক্ৰয় করা যাইতে পারে। ক্রয়ার্থী নিজ নাম ঠিকানা দিয়া কাগজে বিজ্ঞাপন দিন। এই অমূল্য দ্রব্য মাত্র সাতদিন বাজারে থাকিবে, তারপর বিদেশে রপ্তানি হইবে। ক্রেতাগণ তৎপর হৌন।
আমি যতক্ষণ এই বিস্ময়কর বিজ্ঞাপন পড়িতেছিলাম ততক্ষণ ব্যোমকেশ বাহিরে যাইবার জন্য প্ৰস্তুত হইতেছিল। আমি হতভম্ব মুখ তাহার পানে তুলিতেই সে বলিল, ‘অতি বিচক্ষণ লোক। দেশলায়ের বাক্স চুরি করে এখন আবার সেইটেই গভর্নমেন্টকে বিক্রি করতে চান। গভর্নমেন্ট না কিনলে, জাপান কিম্বা ইটালিকে বিক্রি করবেন। এ ভয়ও দেখিয়েছেন।—চল।’
‘কোথায়?’
‘খবরের কাগজের অফিসে গিয়ে খোঁজ নেওয়া যাক কিছু পাওয়া যায় কি না। যদিও সে সম্ভাবনা কম।‘
দ্রুত জুতা জামা পরিয়া ব্যোমকেশের সহিত বাহির হইলাম।
‘কালকেতু’ অফিসে গিয়া কাযাধ্যক্ষ মহাশয়ের সাক্ষাৎ পাইতে বিলম্ব হইল না। ব্যোমকেশের প্রশ্ন শুনিয়া তিনি বলিলেন, ‘বিজ্ঞাপন বিভাগ আমার খাস এলাকায় নয়, তবু এ বিজ্ঞাপনটা সম্বন্ধে আমি জানি। ইন্সিওর-করা খামখানা আমার হাতেই এসেছিল। মনেও আছে, তার কারণ এমন আশ্চর্য বিজ্ঞাপন আমরা কখনও পাইনি।’
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘তাহলে বিজ্ঞাপনদাতা লোকটিকে আপনি দেখেননি?’
‘না। বললুম তো, ডাকে বিজ্ঞাপনটা এসেছিল। খামের মধ্যে কুড়ি টাকার নোট আর বিজ্ঞাপনের খসড়া ছিল। প্রেরকের নাম ছিল না। খুবই আশ্চর্য হয়েছিলুম; কিন্তু তখন আমাদের কাজের সময়, তাই বিজ্ঞাপন বিভাগের ম্যানেজারকে ডেকে খসড়া তাঁর জিম্মা করে দিই, তারপর ভুলে গিয়েছি। ব্যাপার কি বলুন তো? দেশলায়ের বাক্স দেখে সন্দেহ হচ্ছে, গুরুতর কিছু নাকি?’
ব্যোমকেশ সহাস্যে বলিল, ‘আপনাদের কানে পৌঁছুবার মত এখনও কিছু হয়নি। আচ্ছা, প্রেরক সম্বন্ধে কোনও খবরই দিতে পারেন না? তার ঠিকনা?’
কার্যাধ্যক্ষ মাথা নাড়িলেন, ‘খামের মধ্যে নোট আর বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু ছিল না।’
‘ইন্সিওর-করা খামে বিজ্ঞাপন এসেছিল বলছেন। খামের ওপরেও প্রেরকের নাম ঠিকানা ছিল না?’
কার্যাধ্যক্ষ সচকিতভাবে বলিলেন, ‘ওটা তো খেয়াল করিনি। নিশ্চয় ছিল। অন্তত থাকা উচিত। যতদূর জানি প্রেরকের নাম-ঠিকানা না থাকলে পোস্ট-অফিসে রেজিস্ট্রি চিঠি নেয় না—‘
টেবিলের পাশে একটা প্ৰকাণ্ড ওয়েস্ট-পেপার-বাস্কেট ছিল, অধ্যক্ষ মহাশয় হঠাৎ উঠিয়া তাহার মধ্যে হাতড়াইতে আরম্ভ করিলেন। কিছুক্ষণ পরে বিজয়গর্বে সোজা হইয়া দাঁড়াইয়া বলিলেন, ‘পেয়েছি–এই, এই নিন।’
সাধারণ সরকারী রেজিস্ট্রি খাম, তাহার কোণে প্রেরকের নাম ও ঠিকানা রহিয়াছে–
বি কে সিংহ
১৮/১, সীতারাম ঘোষের স্ট্রীট, কলিকাতা
ঠিকনা টুকিয়া লইয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমাদের পাড়াতেই দেখছি। —এখন তাহলে উঠলুম, অকারণে বসে থেকে আপনার কাজের ক্ষতি করব না–বহু ধন্যবাদ৷’
অধ্যক্ষ বলিলেন, ‘ধন্যবাদের দরকার নেই; যদি নতুন খবর কিছু থাকে, আগে যেন পাই। জানেন তো, দেবকুমারবাবুর কেস আমরাই আগে ছেপেছিলুম।’
‘আচ্ছা, তাই হবে’ বলিয়া আমরা বিদায় লইলাম।
কালকেতু অফিস হইতে আমরা সোজা সীতারাম ঘোষের স্ত্রীটে ফিরিলাম। ১৮/১ নম্বর বাড়িখানা দ্বিতল ও ক্ষুদ্র, রেলিং-এর উপর লেপ তোষক শুকাইতেছে, ভিতর হইতে কয়েকটি ছেলেমেয়ের পড়ার গুঞ্জন আসিতেছে।
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভুল ঠিকানা। যা হোক, যখন এসেছি তখন খোঁজ নিয়ে যাওয়া যাক।’
ডাকাডাকি করিতে একজন চাকর বাহির হইয়া আসিল–‘কাকে চান বাবু?’
‘বাবু বাড়ি আছেন?’
‘না।‘
‘এ বাড়িতে কে থাকে?’
‘দারোগাবাবু থাকেন।’
‘দারোগাবাবু? নাম কি?’
‘বীরেনবাবু!’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চাকরিটার মুখের পানে হ্যাঁ করিয়া তাকাইয়া রহিল, তারপর হঠাৎ হাসিয়া উঠিয়া বলিল, ‘ও–বুঝেছি। তোমার বাবু বাড়ি এলে বোলো ব্যোমকেশবাবু দেখা করতে এসেছিলেন।‘ বলিয়া হাসিতে হাসিতে ফিরিয়া চলিল।
আমি বলিলাম, ‘তুমি বড় খুশি হয়েছ দেখছি।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘খুশি হওয়া ছাড়া উপায় কি! লোকটি এমন প্ৰচণ্ড রসিক যে মহাপ্ৰতাপান্বিত ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে তাঁর রসিকতা করতে বাধে না। এমন লোক যদি আমার সঙ্গে একটু তামাসা করেন তাহলে আমার খুশি না হওয়াই তো ধৃষ্টতা!–তুমি এখন বাসায় যাও, আমি অন্য কাজে চললুম। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে পরামর্শ হবে।’
হ্যারিসন রোডে আসিয়া পড়িয়ছিলাম, ব্যোমকেশ লাফাইয়া একটা চলন্ত ট্রামে উঠিয়া পড়িল।