উপলব্ধি
ওহে তোমার ফোন, সেকশানের বড়বাবু লম্বা হলঘরের মাঝামাঝি জায়গা থেকে হেঁকে উঠলেন। বাঁ-হাতে রিসিভারটা মাথার ওপর তুলে বারকতক নাড়ালেন। এইটাই তাঁর অভ্যাস।
যে-কোনও ফোন এলেই প্রভাতবাবু এই রকম করে থাকেন। এতবড় অফিসে অনবরতই ফোন আসে। সারাদিনে প্রভাতবাবু দাঁড়ে বসা চন্দনার মতো কপচে চলেছেন, ওহে তোমার ফোন। গলার জোরেই বড়বাবু, গলার জোরেই কাজ। তোমার ফোন বলেই প্রভাতবাবু রিসিভারটা ঠকাস করে টেবিলে নামিয়ে রেখে পাশের চেয়ারে যিনি বসে আছেন তাঁর সঙ্গে গল্পে মেতে যান। পাশের চেয়ারটা কদাচিৎ খালি থাকে। তদবিরের জন্যে অনবরতই লোক আসছেন। কাপ কাপ চা আসছে, খিলি খিলি পান উড়ছে। অবশ্য এ না হলে কোনও অফিসের বড়বাবুরই শোভা খোলে না। তোমার ফোন-এ নামটা উহ্য থাকে বলে অফিসসুদ্ধ সকলেই তারস্বরে চিৎকার করে। ওঠেন, কার ফোন বড়বাবু, কার ফোন? বড়বাবু ইতিমধ্যেই কার ফোন ভুলে যান। গল্প করতে করতেই রিসিভার আবার কানে তুলে নিয়ে নামটা জেনে নেন। সেই প্রতিক্রিয়াতেই বিমান জানতে পারল এবারের ফোনটা তার।
বড়বাবুর পেছন দিকে একটা বড় জানলা। জানলা দিয়ে বাইরে তাকালে অনেকটা নীচে রাস্তায় ছোট পিঁপড়ের মতো লোক দেখা যায়। খেলাঘরের গাড়ি। পোর্ট কমিশনারের গোডাউন। গঙ্গা। পরপারের দূর আকাশ। বিমান ফোনটাকে টেবিলের কোনায় টেনে এনে জানলার নির্জনতার দিকে সরে গেল। মৃদু গলায় জানতে চাইল, হ্যালো। যা ভেবেছিল তাই, ইলার গলা ভেসে এল। রাগ, ভালোবাসা, অভিমান, বিক্ষোভ সব মিলেমিশে ইলার গলাটা খসখসে রেকর্ডের মতো শোনাচ্ছে। মৃদু, সংযত। আড়ালে লুকিয়ে আছে উত্তেজনা। বিমান জানলার দিকে সরে এসে ভালোই করেছে। ফোনে নারীকণ্ঠ শুনলেই প্রভাতবাবু মনে করেন হয় প্রেমিকা না হয় রক্ষিতা। অবশ্য তাঁরও দোষ নেই। একই অফিসে, একই ফাইলে মুখ গুঁজে জীবন প্রায় কেটে গেল। চুলে অল্প পাক ধরেছে। স্ত্রী-র যৌবন চলে গেছে। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। জীবনীশক্তি আস্তে আস্তে কমে আসছে। লোভ বাড়ছে। প্রদীপ নেভার আগে ষড়রিপুর ছটি সলতে ছটি শিখার মতো। উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মানুষের চিন্তা, মানুষের রুচি এই বয়সে একটু অন্যরকম হয়ে যায়। পথের পাশে পড়ে থাকা আমের আঁটির গায়ে ঘিনঘিনে মাছির মতো।
বিমানকে কিছু বলার অবসর না দিয়েই ইলা শুরু করেছে এক গাদা অভিযোগ। দু-মাসের জমে থাকা অভিযোগ বাঁধ কেটে বেরিয়ে আসা জলের মতো কুলকুল করে বয়ে আসছে। তুমি আজকাল আমাকে এড়িয়ে যেতে চাও। কী তোমার এমন কাজ? রাখো রাখো, কাজ সবাই করে। এইরকম হয়, পুরোনো হয়ে গেলে তার আর দাম থাকে না! শনিবার তোমাকে গোলপার্কের কাছে দেখেছি। বুধবার তুমি সিনেমায় গিয়েছিলে। এর আগে তোমাকে আমি দুদিন ফোন করেছি। তোমাকে কেউ বলেনি! কই, তুমি তো রিংব্যাক করলে না! তুমি আমার সঙ্গে এরকম ব্যবহার। করবে না কিন্তু। পরে এজন্যে তোমাকে কাঁদতে হবে দেখো, বলে দিচ্ছি। ইলার গলা ক্রমশই ধরে আসছে। বিমান কোনও জবাব দিতে পারছে না। বিমান কোনও প্রতিবাদ করতে পারছে না। অফিসের ফোনে কাজের কথা বলা যায়, কোনও পাটিকে খেলানো যায়, অধস্তন কর্মচারীকে। ধাতানো যায়, কিন্তু অভিমানী কোনও মেয়ের মান ভাঙানো যায় না। ইলা যেভাবে শুরু করেছে তাতে চালাতে দিলে ঘণ্টাখানেকের আগে ফোন ছাড়বে না। ইতিমধ্যে বাইরের লাইন আসবেই। নিমতলার শ্মশানের মতো অফিসের জেনারেল ফোন কখনও খালি যায় না। বোর্ডে কল মুখিয়েই আছে। ঢোকবার জন্যে ঠেলাঠেলি করছে। অপারেটররা ঝুলিয়ে রেখেছেন। যাঁর ধৈর্য অসীম তিনিই প্রবেশপথ পাবেন। ইলা বলছে, ঘণ্টাদুয়েক চেষ্টা করে তবে তোমাকে পেলুম। তুমি দেখছি দুর্ভেদ্য দুর্গে বসে আছ। ফোনও করো না, দেখাও করো না। বেশ মজা! তোমাকে যে ফোন করব তাও সহজে লাইন পাবার উপায় নেই। দু-ঘণ্টা চেষ্টা করে আজ অবধি যদিও পেলুম, কী উকিলের জেরা রে বাবা! কে বলছেন, কেন বলছেন, কী দরকার? আমি কী বলেছি জানো? তোমার বোন বলছি। কী করব বলো? লোকটা কে গো?
লোকটা প্রভাত সরখেল। আরও পাঁচবছর চাকরি করবে নর্মাল কোর্সে, তারপর তদবিরের জোরে আরও তিন বছর একসটেনশন। বিমান প্রভাতবাবুর গর্দানের দিকে তাকিয়েছিল। বেশ ঘাড়ে গর্দানে চেহারা। মালটাল খায় নিশ্চয়ই। মেয়েছেলেও আছে। চুলে এখনও পুরো পাক ধরেনি। বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে তিন বছর আগেই। এই বয়েসে বিমানরা বুড়িয়ে যাবে নিশ্চয়ই, বিমান ফিশফিশ করে বলল, আমাদের অফিসের বড়বাবু।
কী অসভ্য বাবা! তুমি কতটা দূরে বসো?
বিমান তার বসার জায়গার দিকে তাকিয়ে আন্দাজে একটা হিসেব করার চেষ্টা করল। গজ, ফুট, মিটার সম্পর্কে তার ভালো ধারণা নেই। বলে দিল, তা প্রায় বিশ গজ হবে।
বিশ গজ আসতে তোমার এত সময় লাগল? তার মানে তুমি আমাকে এড়াতে চাইছিলে! আমি এত কথা বলছি তুমি কেবল হ্যাঁ না দিয়েই সেরে দিতে চাইছ!
বিমান একটা কড়া জবাব দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় বাইরের একটা লাইন ঢুকে পড়ল। অপারেটারের কীর্তি।
কে প্রভাত নাকি? আরে এবারে তো ব্যাগপাইপ বাজিমাত করবে বলে মনে হচ্ছে। সেমিখান এন্ড প্রিন্স টিউডর বুঝলে, লকে আটশো মিটার টাইমিং শুনবে—১৩ সেকেন্ড, ২৯ সেকেন্ড।
বিমান প্রভাতবাবুরই রেসুড়ে বন্ধুকে থামিয়ে দিলে, আজ্ঞে আমি প্রভাত নই।
প্রভাত নও, তাহলে বিশ গজ, তিরিশ গজ কী বলছিলে? আমি ভাবলুম ফেয়ার প্রিন্সের কথা বলছ। প্রভাতকে দাও, প্রভাতকে দাও। ব্যাগপাইপের কথাটা বলি। শালা কেবল হেরে মরে। আমার টিপস তো নেবে না।
আপনি একটু ধরে থাকুন প্লিজ। আমি একটা অন্য লাইনে কথা বলছি। এক্ষুনি হয়ে যাবে।
এক্ষুনি হবে না রে ভাই। মা আমার রেগে আছে। মেয়েছেলে আর ঘোড়া দুটোই এক জাতের রে
ভাই, মেজাজ বোঝা দায়।
ইলাকে ঠান্ডা করার জন্যে বিমান বললে, শোনো ইলা, এ লাইনে আর বেশিক্ষণ চালানো যাবে না। আজ আমি তোমার সঙ্গে দেখা করবই। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক বলছি। পৃথিবী রসাতলে গেলেও। তুমি প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে চলে এসো। ঠিক তিনটের সময়। তিনটে থেকে তিনটে তিরিশ। কেমন। তখন অনেক কথা হবে! অনেক অনেক। আরে দুর, এটা তো অফিস, না কি? এক ঘর লোক। লক্ষ্মী প্লিজ রাগ কোরো না।
বিমান হাত থেকে গরম জিনিস ফেলার মতো করে রিসিভারটা যথাস্থানে ফেলে দিল। মুক্তি! বাবা! একবার কথা শুরু করলে সহজে কি থামতে চায়? মেয়েদের কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। ফোনটা সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল। প্রভাতবাবু বললেন, দ্যাখো না হে কার এল। আচ্ছা স্বার্থপর তো। নিজেরটা যেই হয়ে গেল অমনি পালাচ্ছ।
বিমান বললে, আপনারই। রিসিভারটা তুলে প্রভাতবাবুর হাতে ধরিয়ে দিল।
বিমান নিজের চেয়ারে এসে বসতেই পাশের চেয়ার থেকে বিকাশ বলে উঠল, তাহলে আজও আড়াইটেয় কাটছ!
বিমান অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তার মানে?
তার মানে তুমি আজও কাটছ, এখান থেকেই আমি শুনতে পাচ্ছি, প্লিজ আর লক্ষ্মীটির ছড়াছড়ি। আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবে। অনেক দিন তো হল। এবার ঘরের জিনিস ঘরে তুলে ফেল। রোজ রোজ এই অফিস থেকে আগে আগে বেরিয়ে পড়া, ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু হে! আফটার অল আমরা হলুম গিয়ে পাবলিক সারভেন্ট!
বিমান সবে চাকরিতে ঢুকেছে। ঢুকেই পাবলিক সারভেন্টদের যা নমুনা দেখছে তাতে পাবলিকদের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হওয়ারই কথা। অফিসের বাইরে সে-ও তো পাবলিকের একজন। বিকাশও তাই, প্রভাতবাবুও তাই। বিমান বিকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। বিমানের সারা মুখে অত্যাচারের চিহ্ন। মুখ দেখলেই একজন মানুষের জীবনধারণ পদ্ধতির, তার চিন্তাজগতের কিছু আভাস পাওয়া যায়। বিকাশ চেয়ারে গা এলিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। সকাল। থেকে একটাও ফাইল ধরেনি। সিনেমা-পত্রিকা ওলটাছে। বিমান বললে, আমার জন্যে তোমার চিন্তার প্রয়োজন নেই। ছুটি পাওনা আছে। প্রয়োজন হলে হাফ সিএল নিয়ে নেব। তুমিও তো পুরো খেলার সিজনটা তিনটের মধ্যেই হাওয়া হয়ে যাও। আজও তো বড় খেলা আছে।
বিকাশ গুম হয়ে গেল। বিমান বললে, নিজেকেই বললে, পেড ব্যাক ইন হিজ ওন কয়েনস। অফিসের যে কটা লোক চাকরি করছে তাদের নব্বই ভাগের স্বভাব যেমন, চরিত্রও তেমন। আসলে এই ধরনের লোককেই বেছে বেছে চাকরি দেওয়া হয়, না চাকরি করতে করতে এইরকম হয়ে যায়! কথায় বলে, দশ বছর স্কুল মাস্টারি করলে গাধা হয়ে যায়, তেমনি হয়তো বছরকয়েক সেরেস্তায় চাকরি করলে মানুষের কালচার-টালচার নষ্ট হয়ে গিয়ে মোটামুটি একটা পশুতে পরিণত হয়। না পশুরও তো গুণ আছে, ক্রিমিনাল হয়ে যায়। একদিন আমিও হয়তো এদের মতো হয়ে যাব। বিমান যেন একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল। জীবিকার জন্যে এ কী দাসত্ব, এ কোন পরিবেশে তিল তিল করে শুকিয়ে যাওয়া। মাঝে মাঝে তার প্রতিবাদ করতে ইচ্ছা করে। বিকাশের গালে ঠাস করে একটা চড়। বাপের বয়সি প্রভাতবাবুর ঘাড়ে একটা রদ্দা। চড় অথবা রদ্দা সম্ভব না হলেও, কড়াকড়ি কিছু কথা। নেহাত চাকরিটা বেশি দিন হয়নি। এইসব দপ্তরে। কোথায় যে কী ফাঁদ পেতে রেখেছে জানা নেই। তারপর শালা ক্লিকবাজি করে এমন গাড়ায় ফেলে দেবে—ফিউচার ডুমড। যে করে চাকরি পেয়েছে ভাবলে গায়ে জ্বর আসে। এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ থেকে নাম। লাখ লাখ বেকার থেকে একটি নাম, ঝাঁক থেকে একটি পাখি তুলে আনার মতোই কঠিন কাজ। তারপর কম সে কম ছবার ইন্টারভিউ। চাকরি যেন দৈত্যের প্রাণ। এক ডুবে সরোবরের তলায় গিয়ে স্ফটিকস্তম্ভ চুরমার করে কৌটোর মধ্যে থেকে ভোমরা বের করে ছাইগাদায় ফেলে টিপে মারতে পারলে তবেই সিদ্ধিলাভ। নচেৎ সেই অফুরন্ত কর্মহীন অবসর।
বিমান মনে মনে হাসল। কর্মহীনতা। যতদিন চাকরি পাইনি ততদিন ভেবেছি বসে বসে আর কতদিন পারা যায়? এখন চাকরি পেয়ে দেখেছি, বেকাররাই অফিসে আর এক বেকার মজলিশ বসিয়েছে। বাইরের বেকাররা মাইনে পায় না, এরা পায়। এই একটা বড় তফাত। যেহেতু বিমানের নতুন চাকরি, যত কাজ বিমানের ঘাড়ে। পুরোনো পাপীরা সারাদিন বসে বসে চা খাবেন, পান চিবোবেন, টেবিলে টেবিলে জটলা করবেন, আজ ইলেকট্রিক বিল জমা, কাল বিয়ের প্রেজেনটেশান কেনা, পরশু হাওড়া স্টেশনে ট্রেন অ্যাটেন্ড করার বাহানা করে হাওয়া হয়ে যাবেন। অফিস চালাবে নতুন রিক্রটরা। বলিহারি নিয়ম! রাসকেলদের জগতের রাসকেলিয়ান নিয়ম। ডায়েরি করার জন্যে একগাদা চিঠি খুলে বিমান আড়চোখে একবার বিকাশকে দেখে। নিল। প্রভাতবাবুর কীর্তনপার্টির লোক। কেমন সুখে আছে! এ জগতে যে আত্মবিক্রয় করতে পেরেছে সেই ব্যাটাই সুখী। এ এক সাধনা, এ-ও একপ্রকার সিদ্ধি! দল পাকাও, ঘোঁট পাকাও আর ক্ষমতার আসনে ফুল ফেলো, দুধের সরের মতো জগতে সুযোগের সরটুকু তুলে তুলে খাও।
কতরকমের চিঠি, কত রকমের আবেদন-নিবেদন, চাহিদা। কাদের কাছে আবেদন? সেই সংস্থার কাছে যেখানে বসে আছে বিকাশ, প্রভাত, মাধবীর মতো জনসেবকরা। এইসব চিঠি যাবে। প্রভাতবাবুর টেবিলে। সেই প্রভাতবাবু যিনি সারা সপ্তাহ ব্যাগপাইপ আর ফেয়ার প্রিন্সের চোদ্দোপুরুষ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সারাটা দিন অফিসে যাঁর কাজ হল উলটো দিকের চেয়ারে ছড়িয়ে বসে থাকা মাধবীর শরীরের অনাবৃত অংশের দিকে তাকিয়ে থাকা। এই এক মেয়েছেলে মাইরি! সারা অফিসটাকে জ্বালিয়ে দিলে। যেমন সাজপোশাক, তেমনি চালচলন। কোনও ভদ্রঘরের মেয়েছেলে পারবে ওইভাবে টেবিলের তলায় বিশ্রীভাবে পা ছড়িয়ে বসতে পারবে বুকের। কাপড়টা ওইভাবে অনায়াসে ফেলে দিতে? পারবে সারা অফিসে ওইভাবে ফ্লার্ট করে বেড়াতে? পারবে বড়বাবুকে পিঠে করে খাওয়াতে? পারবে বিকাশের চেয়ারের হাতলে এসে বসতে? পারবে টাইপিস্ট নীলকণ্ঠর পিঠে হাত রেখে গায়ের ওপর ঢলে পড়ে দাঁড়াতে পারবে না। বিমান এতদিনে বুঝেছে কেন তার বোনের চাকরি হয় না। চাকরিও হবে না, বিয়েও হবে না। চাকরির বাজার মাধবীদের দখলে, বিয়ের বাজার ইলাদের। কীভাবে বিমানকে কামড়ে ধরেছে ইলা!
কামড় শব্দটা বিমানের খুব ভালো লাগল না। মনে হল ইলাকে ছোট করা হল। আসলে অনেকদিন ইলার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নেই বলে ইলার আকর্ষণটা বোধহয় ক্রমশ কমে আসছে। অভাবের জগতে প্রেমের ভাব কতদিন বজায় রাখা যায়? তা ছাড়া দিনের পর দিন রোজ ঘন্টাসাতেক মাধবীকে খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে ইলা আর মাধবী যেন এক হয়ে গেছে। অফিসটা যেন মাধবীর কুঞ্জবন। প্রেম মানেই মাধবীর প্রেম। বড়বাবু যখন মাধু বলে ডাকেন, বিমানের পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে যায়। সব মেয়েই যদি মাধুহত, সব ছেলেই যদি বিকাশ হত, সংসারের কী অবস্থা হত! ভাবা যায় না শালা। সব সংসারই হয়ে যেত মাধবীর সংসার, হাফগেরস্তর সংসার। স্বামীও থাকত, আবার অফিসের প্রভাতবাবু, বিকাশ-মিকাশও থাকত।
মাধবীর স্বামী! মনে হতেই বিমান খুব নার্ভাস হয়ে গেল। ইলাকে যদি বিয়ে করে তাহলে সেও মাধবীর স্বামী হয়ে যাবে না তো! মেটামরফসিস। তার এই আবরণটা ক্রিশ আলিস-এর মতো খুলে পড়ে যাবে। বেরিয়ে আসবে মাধবীর স্বামী। খেকুরে, দাঁত উঁচু একটা লোক। গায়ে গেরুয়া পাঞ্জাবি। থাকে আলাদা। মাঝে মাঝে চোরের মতো অফিসে এসে ইশারায় মাধবীকে বাইরে ডেকে নিয়ে যায়। দুজনকে একসঙ্গে দেখলে মনে হয় স্বামী নয়, ট্যাক্স কালেকটার কিংবা জলের মিস্তিরি। মাধবীর বাথরুমের কল ঠিক করতে এসেছে কিংবা মেয়েছেলের দালাল, মাধবীকে বুক করতে এসেছে। অফিসের বাইরে দুজনের গুজুর-গুজুর ফুসুর-ফুসুর হয়। ব্লাউজের বুকের কাছে হাত ঢুকিয়ে মাধবী ব্যাগ বার করে। লোকটা মাধবীর এই অবস্থা করেছে, না মাধবী লোকটার। ওই অবস্থা করেছে বিমানের জানতে ইচ্ছে করে। কী করলে কী হয়, কী থেকে কী হয়, জীবন শুরুর আগেই জানতে পারলে সচেতন মানুষ সাবধান হতে পারে।
বিকাশের মতো সচেতন-অচেতন জড়পদার্থ কিংবা প্রভাতবাবুর মতো জীবনহীন জীবদের কথা অবশ্য আলাদা। সংসারে এরা চেনামুখ। কিন্তু ঘরের বউ মাধবী কী করে প্রভাতবাবুর মাধু হল, বিকাশের মাধবীদি, জানার জিনিস। জানতে হলে বিমানকে মধুচক্রের সভ্য হতে হয়। শনিবার শনিবার প্রভাতবাবু আর বিকাশের সঙ্গে রেসের মাঠ থেকে বেরিয়ে দিশির বোতল ব্যাগে ভরে। খানদানি পাড়ায় মাধবীর বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতে হয়। তার আগে মাধবীদি নামের মহিলার সঙ্গে অফিসেই ঘনিষ্ঠ হতে হয়। বিমানচন্দ্র তা কি তুমি পারবে? বিমান নিজেকেই নিজে প্রশ্ন। করল। জবাবে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বড় ধরনের একটা না। অসম্ভব। মাধবীকে সে ঘৃণা করে। মাধবী তার কাছে নারীত্বশূন্য সেক্স। মাধবী তার কাছাকাছি বিকাশের টেবিলে এলে তার মনে হয় ঘিনঘিনে কোনও সরীসৃপ এসে দাঁড়িয়েছে।
সে যদি বিকাশ হত, তাহলে জানতে পারত, মাধবীরা কেন মাধবী, বিকাশরা কেন বিকাশ। জানতে পারত জীবন এক, অথচ জীবনদর্শন এত ভিন্ন কেন। কী করে বিকাশতাকে একদিন বলেছিল, এ যুগে বিয়ে করে কারা? যারা বোকা। এ যুগ হল জিও-পিওর যুগ। মেয়েছেলে সো চিপ। গোটাকতক সিনেমা দেখালেই দে আর বেডেবল। বিমান চমকে উঠেছিল। এই যদি
জীবনদর্শন হয় কামিং জেনারেশনটা কী দাঁড়াবে। আগামী পুথিবী কি শাসন করবে বাস্টার্ডরা? সেদিনই তোমার দাঁত ভেঙে দিতুম হারামজাদা যেদিন তুমি বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলে, মেয়েটা কে হে বিমান? প্রায়ই তোমাকে ফোন করে। একদিন ব্যবস্থা করো না। ডায়মন্ডহারবার থেকে ঘুরে আসি। টানা ট্যাক্সিতে যাব-আসব। মালফাল খাওয়াদাওয়া সব খরচ আমার, তোমার নো এক্সপেন্স।
বিমান জিগ্যেস করেছিল, কেন?
বিকাশ বলেছিল, দেখব মালটা কেমন! তোমার সঙ্গে ফিট করবে কি না! আমরা হলুম গিয়ে এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট। বিমান সঙ্গে সঙ্গে কলার চেপে ধরেছিল। তুমি শালা ইউনিয়নের নেতা। অফিসে মর্যাল গার্জেন। দাবিদাওয়া নিয়ে তুমি যাও কর্তৃপক্ষের কাছে। আর এই তোমার ভেতর! বিকাশ ভাবতেও পারেনি তার মতো একজন নেতার ওপর বিমান হঠাৎ এমন। খেপে উঠবে। নিজের আখেরের কথা ভেবেও বিমানের অন্তত হয় রাজি, না হয় হজম করা উচিত ছিল। বিকাশ বলেছিল, ইয়ার্কি বোঝো না! কথায় কথায় অত তেরিয়া হয়ে ওঠো কেন? আজকাল বিয়ে করা বউ ঘরে থাকছে না, এ তো প্রেম করা মেয়ে! তুমি কি ভাবো এ অন্য কোনও ছেলের সঙ্গে ঘোরে না, সিনেমা দেখে না? ধারণা পালটাও বিমান। যুগ পালটাচ্ছে। বি প্র্যাকটিক্যাল। কলারটা চেপে ধরা অবস্থাতেই বিমান বলেছিল, সবাইকে তুমি নিজের মতো ভাবো, তাই না? শালা, তোমার হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেব। সব মেয়েই বেশ্যা তাই না?
অফিসে পাশাপাশি চেয়ারের ঘটনা এর চেয়ে বেশি দূর এগোয়নি। পেছন থেকে মোহন মিটমাট করিয়ে দিয়েছিল। মোহন আবার বিকাশের চামচা। এক কলকের স্যাঙাত। ইউনিয়নের নাম। করে চাঁদা তোলে, যার কোনও হিসেব নেই। কোথাকার চাঁদা কোথায় যায় জিগ্যেস কোরো না। মাসে মাসে শুধু চাঁদাটা দিয়ে যাও। বছরে একটা করে থিয়েটার, একবার পিকনিক, এ তো বাঁধা ব্যাপার। রিহার্সালে ভাড়া করা মেয়েরা আসবে। মোহন চা আর খাবার সাপ্লাই করবে। বিকাশ আর প্রভাতবাবুর পকেটে এক আউন্স শিশিতে ভাইনাম গ্যালেসিয়া থাকবে। হাফ চা, হাফ এ জিনিস। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে যাবে। প্রভাত সরখেল একটা চেয়ারে বসে রিহার্সাল শুনতে শুনতে রসের কথা বলবেন। মাঝে মাঝে মেয়েদের পিঠে কিংবা হাতে আঙুলের খোঁচা মেরে খিক খিক করে হেসে উঠবেন। মেকআপ করা গালে বুড়ো বয়সের পাকা আঙুলের টুসকি মারবেন। বিকাশ বলবে, প্রেমের দৃশ্যে অত আড়ষ্ট হলে চলে? আহা স্টেজে না হয় চুমু চলবে না। রিহার্সালে দোষটা কি? চাঁদার টাকায় বিকাশ চুমু খাবে। প্রভাত সরখেল যৌবনে খোঁচা মারবেন, মোহন মালের হিসেব রাখবে। বিমান বলেছিল তোমরা হিসেবটা দাও না কেন? বিকাশ বলেছিল, কালকা যোগী, ব্যাটাকে থেফট কেসে ফেলে সাসপেন্ড করিয়ে দেব। কত হাতি ঘোড়া গেল তল, মশা বলে দেখি কত জল!
দুজনে পাশাপাশি বসলেও সেই থেকে বিকাশ বিমানের শত্রু। বিমানের সব কিছুর ওপর বিকাশের নজর। স্পাইং করে চলেছে। সাপের ফণা তোলাই আছে, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে। মাঝে মাঝে বিমানের খুব ইচ্ছা করে বিকাশের চোয়ালে একটা আন্ডারকাট ঝেড়ে প্রভাত সরখেলের মুখের ওপর একটা রেজিগনেশান ছুড়ে দিয়ে রাস্তায় নেমে জনতার দলে মিশে গিয়ে বহুতল এই বাড়িটার দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে বলে—ওই দেখুন, ওই বাড়িটার তলায় তলায় আপনার আমার পয়সায় একদল করাপ্ট পাবলিক সারভেন্ট দিনের পর দিন আমাদের স্বার্থ নিয়ে তামাশা করে চলেছে। আমি দেখেছি আপনারা আশা নিয়ে, বিশ্বাস নিয়ে প্রতিকার চেয়ে, বিচার চেয়ে সব চিঠি লেখেন। ওরা দিনের পর দিন সেইসব চিঠির ওপর চেপে বসে থেকে সময় পার করে দেয়। নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়েই ওরা ব্যস্ত। ডিএ চাই, টিএ চাই, ক্ষমতা চাই। লাঠি ঘোরানোই ওদের কাজ। ওই পুরো কাঠামোটাই ঘুণ ধরা। সাহস করে নাড়া। দিতে পারলেই ভেঙে পড়বে। বিমান ভাবে, কিন্তু পারে না। পারে না, কারণ সে জন্ম থেকেই ক্রীতদাস। ক্রীতদাসের পুত্র ক্রীতদাস। কে বলেছে, এ দেশ থেকে দাসব্যবসা উঠে গেছে? জন্ম থেকেই শুনে আসছে—ভালো করে পড়ো, চাকরি করতে হবে। কই তার বাবা তো বলেননি, চাষ করতে হবে, কী পান-বিড়ির দোকান করতে হবে। মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক হতে হবে। মাধবীর মতো হাফগেরস্ত হতে হবে। বিমানবাবু হতে হবে। হরিদাসবাবুর ছেলে, যিনি জর্জ শেফিল্ডের ক্যাশিয়ার ছিলেন। বর্তমানে রিটায়ার্ড। বয়স তিয়াত্তর। এক ছেলে তিন মেয়ের জনক। যাঁর। শরীর বর্তমানে জরাজীর্ণ, যাঁর অ্যাসেটের চেয়ে লয়াবিলিটিই বেশি। যিনি যাওয়ার আগে আর এক হরিদাসকে রেখে যাবেন। সেই এক ইতিহাস, এক গতি! এ যেন ইংল্যান্ডের রাজসিংহাসন —প্রথম জর্জ, দ্বিতীয় জর্জ…পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ জর্জ।
বিমান ভাবতে ভাবতেই কাজ করছিল। একের পর এক ডায়েরি। প্রেরকের নাম, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, যে ফাইলে সমাধি হবে সেই ফাইলের নম্বর। পাকা কাজ। চিঠি যেন না হারায়, মিসপ্লেসড না নয়, অ্যাকশন চুলোয় যাক। সারা বছর চিঠির সংখ্যা দেখিয়ে এতগুলো লোকের চাকরির প্রয়োজনের জবাবদিহি করতে হবে। সারা বছর আমরা ভেরেন্ডা ভাজিই না। কাজে কাজে আমাদের নাভিশ্বাস। সুধীর চা দিয়ে গেছে। বিমান চা খেতে খেতে একটু উদাস হয়েছে। রাগটা ক্রমশ থিতোচ্ছে। অফিসটাকে সে এখন চোখের অফ লেন্সে ঝাপসা দেখছে। চাকরিটা সে ছাড়তে পারবে না দুটো কারণে—তাকে এখানেই থাকতে হবে। থেকে থেকে ওই প্রভাত সরখেলের চেয়ার পর্যন্ত যেতে হবে। প্রথম কারণ, তার সংসারে মা, বাবা, বোন। দ্বিতীয় কারণ, ইলা। যে। মেয়ে তিন বছর ধৈর্য ধরে তার জন্যে অপেক্ষা করে থাকতে পারে সে মেয়ে, বিকাশ যতই বলুক, সস্তা মেয়ে নয়। বাজারের মেয়ে নয়। বিমান এমন কিছু রাজপুত্র নয়। হিরো নয়। বড়লোকের পয়সা ওড়ানো ছেলে নয়। কী দেখেছে ইলা তার মধ্যে এই তিন বছরে বিমান তাকে কোনও উপহার দিতে পারেনি, দামি রেস্তোরাঁয় খাওয়াতে পারেনি, এখানে-সেখানে বেড়াতে নিয়ে যেতে পারেনি। হ্যাঁ, সিনেমায় গেছে মাঝে মাঝে, তাও সব সময় বিমানের একার পয়সায় নয়। আর মাঝে মাঝে ময়দানের ঘাসের ওপর বসে একশো গ্রাম চিনেবাদাম ভেঙে ভেঙে খেয়েছে, গল্প করেছে। এই একশো গ্রামই বরাদ্দ। তাও ইদানীং দাম বাড়ায় কমে পঞ্চাশ হয়েছে। ইলা সময় সময় বিমানের কাছে কর্কশ ব্যবহারও পেয়েছে! সংসারের চাপে, সমাজের উৎপীড়নে সবসময় মানুষ মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারে না। সবসময় প্রেম থাকে না! কাম থাকতে পারে। ক্রোধের মতো কামও একটা জৈব তাড়না। প্রেম অনেকটা চোলাই করা সিজনড মদের আবেশের মতো। সুইচ টিপে আলো জ্বালাবার মতো চট করে প্রেমের আবেগে মন ভরে তোলা যায় না। দুটো মন সব সময় একই তরঙ্গে কাঁপে না। সেই সব ক্ষত-বিক্ষত মুহূর্তে ইলা হয়তো এসে পড়েছে। তার নারীসুলভ ভবিষ্যৎ কল্পনার ছবি তুলে ধরেছে। ভবিষ্যৎকে দ্রুত বর্তমান করে তুলতে চেয়েছে। বিমানের জীবনে ভবিষ্যৎ কোথায়! বর্তমানের ভেলায় ভেসে চলেছে। কোথায় গিয়ে ঠেকবে সে কিছুই জানে না। সে পরিস্থিতির দাস। মুহূর্ত ঝরছে বৃষ্টির মতো। বিমান ভিজতে ভিজতে চলেছে। ইলারও ভবিষ্যৎ তৈরি করার ক্ষমতা নেই। তবে স্বপ্ন তৈরি করার ক্ষমতা আছে। সময় তার তাসের ঘর তৈরিতে ব্যস্ত বিমান তাস সাজিয়ে দেয়নি তা নয়, তবে বেশির ভাগ সময়ই ইলা যতটুকু সাজিয়েছে বিমান ভেঙে দিয়েছে। ইলা হয়তো অভিমান করেছে, কিন্তু ত্যাগ করেনি। অধৈর্য হয়েছে, ধৈর্য হারায়নি। দুমড়ে গেছে, ভেঙে যায়নি। এই ইলাকে নিয়ে বিকাশ যাবে ডায়মন্ডহারবারে মালের সঙ্গে টেস্ট করতে। শালা মাংসলোলুপ হারামজাদা!
বিমানের চিঠি প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। চা অনেক আগেই শেষ। ইলার টেলিফোন পেয়ে সে যেন এই প্রথম ভবিষ্যতের ভাবনা ভাবতে শুরু করেছে। ভবিষ্যৎটাকে কেন সে কিছুতেই বর্তমানের মতো একটা সুনিশ্চিত চেহারা দিতে পারছে না। তার বাবা কিন্তু পেরেছিলেন। হরিদাসবাবুর। ভবিষ্যৎ তাঁর কল্পনার মতোই হয়েছে। তিনি তাঁর বর্তমানটাকে অভিজ্ঞ মাঝির মতোই ঝড়ঝাপটা ঠেলে ভবিষ্যতের কূলে গিয়ে ঠেকাতে পেরেছেন। দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। যা হোক একটা চাকরি অবশেষে সম্ভব হয়েছে। বড় কিছু। অ্যামবিশান তাঁর ছিল না। থাকলেও বড় চুল ছোট করার মতো হেঁটে নিয়েছিলেন। এখন তিনি বিদায়ি। যাওয়ার দিন গুনছেন। সকলকেই যেতে হবে। তবে যাওয়ার জন্যে এমন তৈরি হয়ে। বেঁধেবঁধে বসে থাকা কটা মানুষের হয়? প্রায়ই দেখা যায় হঠাৎ উপড়ে গেল। যাঃ শালা, কেটে গেছি গোছের ব্যাপার। ইলার কথা বিমান বাড়িতে বলেনি! বলার সাহস নেই বলেই বলেনি। মোটামুটি তার জন্যে একটি মেয়ে ঠিক করাই আছে। সেই ঠিককে বেঠিক করতে হবে। শক্ত কাজ। চাকরির দোহাই দিয়ে এতদিন ইলাকে আটকে রাখা গিয়েছিল। এখন তো সে অজুহাত খাটবে না। এইবার কী চাল চালবে বিমানচন্দ্র? ডায়েরি বন্ধ করতে করতে বিমান নিজেকেই। নিজে প্রশ্ন করল। জীবন নিয়ে তো খেলা চলে না। এ পাখি খাঁচার পাখি। দাঁড়ে দাঁড়ে বসে মাপা ছোলা আর জল। শিস দিতে পারো ভালো। না পারো কর্কশ গলার ডাক শুনিয়ে যাও গৃহস্থকে। মুক্ত হওয়ার জন্যে তো তোমার জন্ম নয়। বন্দি হওয়ার জন্যেই জন্মেছ। আঠাকাঠি দিয়ে হরিদাসবাবু তোমাকে ডাল থেকে পেড়ে এনেছেন। কর্তব্যের সোনার খাঁচায় পুরেছেন। সংসারের শিকল পরিয়ে দিয়েছেন। অনন্ত আকাশ তোমার নয়। খাঁচার আকাশে একটু একটু উড়তে পারো। ডানা ঝাপটাতে পারো। শিকলের মানে তোমার স্বাধীনতার পরিধি। বিমান, এ যে বড় শক্ত ঠাঁই। ইলাকে তুমি এখন কী করে ঠেকাবে? কী করে মৃত্যুপথযাত্রী পিতাকে জানাবে। আপনার নির্বাচিত পাত্রী নয়, আমার পছন্দকে আমি ঘরে নিয়ে আসতে চাই বাবা।
বিমানের মনে হল, এই মুহূর্তে সে বিকাশের জীবনদর্শন ধার করবে কি না? আরে ম্যান, প্রেম করলেই বিয়ে করতে হবে নাকি? ফুল তুমি শুকবে তারপর ফেলে দেবে। জলের মাছকে খেলিয়ে জলেই আবার ছেড়ে দেবে। উসমে কেয়া হ্যায় গুরু। তুমিও অ্যাডাল্ট, সেও অ্যাডাল্ট। এ কি মুচলেকা লিখে দিয়ে প্রেম? এ তো সেই চিরাচরিত স্টোরি-বয় মিটস গার্ল। কত আসবে কত যাবে! বি এ ডগ। সিজনে সিজনে একটা করে বিচ ধরবে অ্যান্ড ডোন্ট ফরগেট দিস ইজ দি এজ অফ পিলস এন্ড কন্ট্রাসেপটিভস। কথাটা ভেবেই বিমানের গা-টা কেমন করে উঠল। কিছুতেই সে হিউম্যান ডগ হতে পারবে না। বিকাশ হতে পারবে না। এমনকী প্রভাত সরখেলও নয়, মাধবীর গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা খেকুরে স্বামী তো নয়ই। এই রোজগারে সংসার চলবে না, তখন কাঁঠাল ভেঙে চালাতে হবে। একটা বিকাশ জোটাতে হবে। সামনে একটা মাধবীকে বসাতে। হবে। শনিবার শনিবার ব্যাগপাইপে ভাগ্য লাগাতে হবে। তারপর চাঁট খেয়ে বাঙলা মেরে মাধবীর গোদা পায়ে মাথা খুঁড়ে বলতে হবে—দোষ কারও নয় গো মা আমি স্বখাত সলিলে।
এই যে বিমান, সরু মেয়েলি গলার বড়বাবু প্রভাত সরখেল বিমানকে ডাকলেন। বিমান তার। সমস্ত চিন্তা ধামাচাপা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। কী নির্দেশ কে জানে! কার বাড়া ভাতে ছাই দিতে হবে দেখা যাক। হয়তো নিজেরই! সরখেলের খুঁটি সোজা রাস্তায় চলে না। মাধবীর দেওয়া জর্দাপানে। সরখেলের পাতলা ঠোঁটদুটো কালচে লাল। দেখলেই গা ঘিনঘিন করে। মনে হয় যেন রক্ত পান করেছিলেন, শুকিয়ে আছে। চেহারাই যেন চরিত্রহীনের। বড়বাবু তীক্ষ্ণ সরু গলা একটু খাদে নামিয়ে বললেন, আজ যেন তাড়াতাড়ি কেটে পোড়োনা। সেন্ট্রাল বাজেটের দিন। সাতটা অবধি থাকতে হবে সকলকে। পার্লামেন্টে কোশ্চেন উঠলে জবাব দিতে হবে। নতুন ডিউটি যে যে। জিনিসে চাপল, লিস্ট করে সাইক্লোস্টাইল করতে হবে। বুঝলে কিছু?
বুঝলেও কিছু করার নেই। সাড়ে তিনটের সময় আমার এনগেজমেন্ট আছে। বিমান সোজাসুজি মুখের ওপর বলে দিল। প্রভাতবাবু বাঁকা চোখে বিমানের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ব্যঙ্গের গলায় বললেন, কোথায়? ক্যালকাটা ক্লাবে? তারপর অত্যন্ত অভদ্রভাবে যোগ করলেন, অফিসটা কি তোমার মামারবাড়ি ভাবো নাকি হে! যাও, অর্ডার ইজ অর্ডার। বিমানের ইচ্ছে করছিল প্রবীণ মানুষটির গালে ঠাস করে একটা চড় মারে কিংবা বাঘের মতো টুটি চেপে ধরে ভবসাগর তারণ পারণ করে দেয়। অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করে নিল। এখনও বোনের বিয়ে বাকি। ইলার সঙ্গে সংসার পাততে হবে। শিল-নোড়া, হাতা-খুন্তি, বেবিফুড, মশারি, গ্রাইপওয়াটার, কাফ মিক্সচার। বিমান চেয়ারে বসতে বসতে মনে মনে বলল, ইলা স্রেফ তোমার জন্যে বুড়োটা বেঁচে গেল।
তিনটের সময় বিমানকে অফিস ছাড়তেই হবে। ইলাকে সে কথা দিয়েছে—পৃথিবী রসাতলে গেলেও দেখা আজ হবেই। আবার ফোন করে বারণ করারও উপায় নেই। সে কোথা থেকে ফোন করছিল তাও জানে না। দাঁড়িয়ে থেকে থেকে হতাশ হয়ে ইলা ফিরে যাচ্ছে এর চেয়ে বেদনাদায়ক ঘটনা আর কী হতে পারে! বিমান যাবেই। দেখা যাক কী হয়! বড়জোর চাকরিটা চলে যাবে। যায় যাক। ফুটপাথে গামছা ফিরি করবে। হাওড়া স্টেশনে কুলিগিরি করবে। পারবে না? পারতেই হবে। জীবনের বাজি ধরে পাশার চালে হারলেই হল! এবার সে খেলবে। লোহার বাঁধনে সংসার বেঁধেছে সত্যি তবু দাসখত লিখিয়ে নিতে পারবে না। অন্তত একবার সে বিজয়ী হবে।
বিমান সোজা বড়কর্তার ঘরে চলে গেল। চাকরির ভয়টাকে সে হত্যা করতে পেরেছে। এখন সে সবকিছু করতে পারে। বিমানের মনে হল, প্রকৃত স্বাধীনতার অর্থ ভয় থেকে মুক্তি। অফিসের সর্বময় কর্তা বিমানকে কখনও দেখেননি। বিমানও তাঁকে দেখেনি। তিনি থাকেন বিশাল পর্দা ফেলা ঘরে। বসেন ঘূর্ণায়মান চেয়ারে। তাঁর টেবিল অর্ধচন্দ্রাকৃতি। মেঝেতে কার্পেট। সমস্ত। আয়োজনটাই ভয় ধরানোর মতো। তাঁর অঙ্গসজ্জার মধ্যেও একটা ক্ষমতার ভাব। সে ক্ষমতা মঙ্গলের কি অমঙ্গলের বলা শক্ত। যে-কোনও ছবির দিকে তাকালে চোখ যেমন প্রথমেই বিশেষ একটি কেন্দ্রীয় বস্তুতে ধাক্কা খায়, যাকে আর্টের ভাষায় বলে সেন্ট্রাল অবজেক্ট কিংবা আইলাইন, বিমানের চোখও তেমনি প্রথমেই গিয়ে পড়ল পাইপের ওপর। পাইপ থেকে ঠোঁট, ঠোঁট থেকে। গোঁফ, গোঁফ থেকে নাক, নাক থেকে চোখ, অবশেষে পুরো মুখ, গলা, হাফবোস্ট। মুখটা অল্প নীচু করে তিনি কী একটা কাগজ দেখছেন। মাথার পেছন দিকে ধোঁয়ার একটা আবরণ তৈরি হয়েছে। বিমানের মনে হল নীহারিকা থেকে সদ্য একটি তারকার জন্ম হচ্ছে। এত সহজে সে এই ভাবতে পারছে কারণ ভয়ের নার্ভটাকে সে অবশ করে দিতে পেরেছে। কত সহজে সোজা সোজা পা ফেলে সে টেবিলের সামনে দাঁড়াতে পেরেছে। বিমান ভেবেছিল টেবিলের উলটোদিক থেকে। একটা ভয় দেখানো গলায় প্রশ্ন আসবে, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট? তা কিন্তু এল না। মুখটা কাগজের দিকে টেবিল ল্যাম্পের মতো নেমেই রইল। বিশেষ কোনও চিঠি বা রিপোর্ট হতেও পারে আবার না-ও হতে পারে। এটা এক ধরনের চালও হতে পারে। বাড়ির বেড়াল কি কুকুর হঠাৎ ঘরে ঢুকলে যেমন আমরা গ্রাহ্যই করি না কিন্তু একটা বাঘ ঢুকলে লাফিয়ে উঠি, এক্ষেত্রেও তাই। তোমাকে দেখেই বুঝেছি অধস্তন কোনও কর্মচারী। নিশ্চয় কোনও তদবিরে এসেছ, কিছু চাইতে এসেছ। অতএব তোমাকে অত খাতিরের কী প্রয়োজন! তুমি অধমর্ণ।
বিমান কাজের কথাটা পেড়েই ফেলল, স্যার, আপনি কি আমাকে আজ সাতটা অবধি থাকতে বলেছেন বাজেটের জন্য?
বাই নো মিনস। হোয়াই শুড আই আস্ক ইউ টু স্টে? মুখ না তুলেই দাঁতে পাইপ চেপে উত্তর দিলেন। বিমানের হাসি পেল। কেমন একটা উপেক্ষার ভাব। দুজনের শারীরিক ব্যবধান ফুট ছয়েক, স্ট্যাটাসের ব্যবধান যোজনখানেক। এই ভদ্রলোককেই নির্জন রাস্তায় অন্ধকারে চেপে ধরে তলপেটে ভোজালি ধরলে নতজানু হয়ে প্রাণভিক্ষা করবেন। এই লোকেরই হঠাৎ চাকরি চলে গেলে বিমানের কাঁধে হাত রেখে বলবেন—হ্যাললো ফ্রেন্ড! ক্ষমতা এক ধরনের ইনটকসিকেশান।
বিমান বললে, স্যার, আমি আজ তিনটের সময় অফিস লিভ করতে পারি?
আস্ক ইওর বড়বাবু।
তিনি তো আপনার নাম করে সাতটা অবধি থাকার ফতোয়া জারি করেছেন অথচ আমার গার্লফেন্ডকে কথা দিয়ে ফেলেছি।
ইজ ইট? এতক্ষণে চোখ তুলে তাকালেন। ইজ ইট অফিস অর ক্লাব?
আজ্ঞে অফিস। তবে আমরা সবাই মানুষ তো! সামটাইমস এমন কিছু জেনুইন প্রবলেম আসে যখন আপনার কর্মচারীরা অফিসের নিয়মে না চলে জগতের নিয়মে চলতে চায়। বড়বাবু, ম্যানেজিং ডিরেক্টার প্রভৃতিকে মানুষ বলে ভাবতে চায়। বোথ অফ আস ইন এ জেনুইন প্রবলেম। সেই সমস্যাগুলোর জন্য আমি অনুমতি চাইতে এসেছি।
বড়কর্তা ঠোঁট থেকে পাইপ খুলে নিয়ে বিমানের দিকে বিস্ময় মাখানো মুখে চেয়ে রইলেন। মুখের শক্ত রেখাগুলো যেন নরম হয়ে আসছে। কর্মজীবনে কর্মচারীদের মুখ থেকে স্পষ্ট সত্য কথা বোধহয় কমই শুনেছেন। কী সংসার, কী অফিসসর্বত্রই ছলচাতুরী। ঠোঁটের কোণে একটু হাসিও দেখা গেল। তিনি বললেন, সরখেল, আই মিন ইওর বড়বাবু আপনাকে খুব লাইক করছেন বলে মনে হচ্ছে না। হি কুড হ্যাভ ইজিলি গিভ ইউ পারমিশান টু লিভ।
তার কারণ আছে স্যার, আমাদের জেনারেশনকে আগের জেনারেশনের ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। প্রবাবলি আমরা স্পষ্ট কথা বলি, প্রতিবাদ করি বলে।
দ্যাটস রাইট, দ্যাট মে বি দি রিজন। হাওয়েভার আপনি কি ওই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন? উইল ইউ ম্যারি হার?
সেইরকমই ইচ্ছে আছে।
কী করছেন তিনি? আই মিন হোয়াট শি ইজ!
টিচার।
ভেরি গুড। কোথায় আপনাদের মিটিং প্লেস, আই মিন প্লেস অফ অ্যাপয়েন্টমেন্ট।
প্ল্যানেটোরিয়াম স্যার।
ঠিক আছে, আমি ওই দিকেই যাব, গিভ ইউ এ লিফট। বড়কর্তার পাইপ ফিরে গেল ঠোঁটে। মুখ নেমে গেল কাগজে। বিমান বললে, থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।
বিমান চেয়ারে এসে বসল। হায় সরখেল! তুমি জানতেও পারলে নাকী ঘটে গেল। রেসের বই কোলে ফেলে বিকাশ আর সরখেল দুজনেই তন্ময়। কাল শনিবার। ব্যাগপাইপ দৌড়োচ্ছে মাঠে। পৃথিবীতে এখন আর অন্য কিছু নেই। অশ্বময় পৃথিবী। ওদিকে টাইপিস্ট সুখময় মাধবীর টেবিলের সামনে ঝুঁকে পড়ে হেসে হেসে খোশগল্পে মশগুল। মাধবীর লো কাট হাতকাটা ব্লাউজ, শরীরের ভাঁজে ভাঁজে মধ্যবয়সের মেদ। নাভির তলায় শাড়ি। বিমান মনে মনে প্রশ্ন করল, ইজ ইট এ ক্লাব? বড়কর্তার মতো গলা করে উত্তর দিল, নো স্যার অবসলিউটলি এ ব্রথেল।
বিমানের আবার একটা ফোন এল। এবার ধরেছে মাধবী। আপনার ফোন। মাধবীর চোখ চিকচিক করে উঠল, একটি মেয়ে। মেয়ে মানেই মজার জিনিস, লোফালুফি খেলার বল। বিমান উঠে গিয়ে ফোন ধরল। প্রভাত সরখেল সিট ছেড়ে কোনও ধান্দায় গেলেন। ইলার ফোন নাকি! বিমান খুব ধীর গলায় বললে, হ্যালো। বিমানের ছোট বোন চিত্রার গলা ভেসে এল, দাদা! হ্যাঁ দাদা, কী ব্যাপার রে? তুই আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবি। বাবার শরীরটা ভালো নেই। তুই যাওয়ার পর থেকেই স্প্যাজমটা বেড়েছে রে। ঠিক আছে শোন; আমি যতটা সম্ভব। তাড়াতাড়ি যাবার চেষ্টা করব, তুই ততক্ষণে ডাক্তার সেনকে একবার কল দিয়ে দেখিয়ে নে। বুঝলি। ক্লিক করে লাইন কেটে গেল। অপারেটারদের কারসাজি। মেয়েদের সঙ্গে কথা বলা। মানেই ফস্টিনস্টি। সুতরাং লাইন অফ করে দাও।
বিকাশ কিছু মন্তব্য করবেনই, কী আবার ফোন? সব প্ল্যানমাফিক চলছে, কী বলো?
মানে?
মানে বেশ সাজিয়েছ হে। প্রথমে কী আসবে? পরে কী আসবে? অতঃপর তুমি কাটবে। অতঃপর আমরা সবাই বাসর জাগিয়ে রাখব।
বিমান বললে, বিকাশ, এর জবাব আমি আজ দোবোনা, এখানেও দেব না, দেব অফিসের বাইরে, মুখ নয়, হাতে।
বিকাশ বললে, তাহলে তো একটা ইঁদুরের গর্ত খুঁজতে হচ্ছে হে! বড় ভয় পেয়ে গেলুম যে।
এখনও ভয় পাওনি তবে বিটিং স্কোয়াডের হাতে পড়লে ভয় অবশ্যই পাবে এবং আমাদের। মেথডটা ভেরি স্নিক অ্যান্ড ফানি। তুমি কিছু বোঝবার আগেই তোমার উইন্ড পাইপটা ওপেন করে দেওয়া হবে। ভেতরের দূষিত হওয়ার সঙ্গে প্রাণপাখিটা ফুড়ুক করে উড়ে যাবে। কেউ। জানবে না, উড়বে সাধের ময়না।
বিকাশ হাতটা দুবার মুঠো করল। শরীরটা কাঁপছে। বেশ বুঝল, নেশা-ভাঙ করে শরীরের ওপর অসাধারণ অত্যাচার করে স্নায়বিক দুর্বলতায় ভুগছে। হাত-পা কেমন হলুদ হলুদ। চোখ ঘোলাটে। অথচ বিমান! সবুজ গাছের মতো। মাথা তুলে দাঁড়ালে শালের খুঁটি। শহরে হঠাৎ মৃত্যুর সংখ্যাও বেড়েছে। সমাজ আর আগের মতো নেই। বাঙালির ছেলের স্বাদ পেয়ে গেছে। বিকাশ যেন একটু স্তম্ভিত হয়ে গেল।
তিনটে বাজতে দশ মিনিটে বেয়ারা এসে খবর দিলে, সাহেব সেলাম দিয়েছেন। বড়বাবু একবার চোখ বড় বড় করে দেখলেন। ভাবলেন, এইবার মরেছে ছোকরা। চাকরি থাকে কি যায়। বিকাশের বিমর্ষ মুখেও প্রত্যাশার ঝিলিক, শালা একটু আগে তুমি বিটিং স্কোয়াড দেখাচ্ছিলে, তাই না! এদের কাছে বড়সাহেবের তলব যেন মৃত্যুর পরোয়ানা। সবকটাই তো গিল্টি কনসেন্স বয়ে বেড়াচ্ছে। সব সময়েই তাই দেখছে খাঁড়া বুঝি নেমে এল।
বিমান একটু পরেই ফিরে এসে যেই বললে, সাহেবের সঙ্গে বেরোচ্ছি, আজ আর ফিরব না, সরখেল আর বিকাশের চোখ কপালে উঠল। বিস্ময়ে হতবাক। কী ব্যাপার। সাহেবের আপনার লোক নাকি। কী ভুল করেছি এতদিন। একে তো তাহলে সমীহ করা উচিত ছিল। সরখেলের গলার সুরই পালটে গেছে, এ আর বলার কী আছে? সাহেব যখন বলছেন।
আপনি বাজেট দেখাচ্ছিলেন তো, সেই কথাই বললুম। বিকাশের কথাও বললুম। দুজনের মুখই চুপসে গেছে।
কী বললেন? কেন বলতে গেলেন?
একটা কথাই বললেন, আই উইল সি। বিমান ভয়ের একটা আবরণ তৈরি করে দিয়ে চলে গেল।
তিনটে পনেরো। ইলা প্ল্যানেটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কচি কলাপাতা রঙের শাড়িতে পশ্চিমের রোদ।
ইলা যেন রাস্তা আলো করে দাঁড়িয়ে আছে। থিয়েটার রোড পেরিয়ে গাড়ি বাঁ-দিকে দাঁড়াল।
এসেছেন? যাকে চাইছেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ, ওই তো দাঁড়িয়ে।
ভেরি গুড। কোয়াইট চার্মিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং, পরে একদিন আলাপ করব। উইশ ইউ লাক।
বিমানকে রেখে গাড়ি ডানদিকে সরে গিয়ে সোজা বেরিয়ে গেল।
ইলা অবাক। কী ব্যাপার, ময়ূরপঙ্খী থেকে নামলে! বিমান বললে, একদিন তো তোমার বাড়ির সামনে নামতে হবে। আজ তোমার সামনে নেমে মহড়া দিলুম। ইলা বেশ খুশি হল। বিমান। বললে, বড়কর্তার গাড়ি। তোমার সঙ্গে এনগেজমেন্ট শুনে লিফট দিয়ে গেলেন। তোমাকে পাকা দেখাও হল। পছন্দ। বললেন, চার্মিং অ্যান্ড ইন্টারেস্টিং।
ইলা বলল, উনি পাকা দেখার কে? বরপক্ষ নাকি?
অফকোর্স। আমার চাকরিদাতা। বেকার থেকে সাকার করেছেন। ইচ্ছে করলে আমাকে কত কী করে দিতে পারেন। হি ইজ মাই ব্রেড অ্যান্ড বাটার ডিয়ার।
বুঝেছি। চলো এখন কোথাও বসা যাক।
কোথায় যাবে বলো?
মাঠে-ময়দানে যেখানে খুশি। তোমার সঙ্গে জাহান্নামেও যেতে পারি।
ইলা আজ যত্ন করে সেজেছে। সন্ধে আর রাত্রির কিছু অংশ সে বিমানের সঙ্গে কাটাবার জন্যে তৈরি হয়ে এসেছে। বিমানের মন বাড়ির দিকে পড়ে আছে। চিত্রা ফোন করেছিল বাবা অসুস্থ। অসুস্থ অনেকদিনই, আজ একটু বেড়েছে। এদিকে খোলা ময়দান, ভিক্টোরিয়া, ইলা আর যৌবন। আকর্ষণ এদিকেও কিছু কম নয়। একদিকে, কর্তব্য, রক্তের টান। আর একদিকে হৃদয়ের টান, আবেগের টান, আগুনের টান। দুটো আকর্ষণের টানে বিমান যেন উদাস। মনে হচ্ছে সমস্ত ঘটনা ঘটে চলেছে তার মনের বাইরে। বিমান যেন সুদূরে বসে লক্ষ করছে বিমানের চালচলন। বিমান দু-খণ্ড হয়ে গেছে।
ভিক্টোরিয়ার রেস্তোরাঁয় দুজনে দু-কাপ কফি খেয়ে নিল। কফি খেতে খেতে বিমানের মনে হল একবার বলে, ইলা আজ এই পর্যন্ত থাক। মনটা পড়ে আছে বাড়ির দিকে। মন ছাড়া দেহ নিয়ে পুতুলের মতো তোমার সঙ্গে ঘুরে মুহূর্তগুলো কেন অপচয় করি। বিমান কিছু বলার আগেই ইলা বললে, আমি যেদিনই আসি তুমি কেমন গম্ভীর আর উদাসীন হয়ে যাও। আমাকে ভালো না লাগলে স্পষ্ট করে বলে দিলেই পারো।
বিমান প্রাণ খুলে হাসার চেষ্টা করল, জানো, সাইলেন্স ইজ সামটাইম গোল্ডেন। অনুভূতির একটা জায়গায় ভাষা আর পোঁছোতে পারে না। আমরা এখন সেই জায়গায় আছি। ভাষাহীন নীরবতায় দুটো প্রাণের যোগাযোগ।
ইলা বোঝে। তার মন বোঝে কিন্তু দেহ যে বোঝে না। সে চূর্ণ-বিচূর্ণ হতে চায়। উত্তাপে সে মোমের মতো, আইসক্রিমের মতো গলে যেতে চায়, জ্বলে যেতে চায় শুকনো পাতার মতো। বিমানকে সে দিতে চায়। সে শিকার হতে চায়। এমন কোনও নিভৃত জায়গা তারা আবিষ্কার করতে পারেনি যেখানে দেহের পাওনা বুঝে নেওয়া যায়। বিমান এসব ব্যাপারে বড় পিউরিটান। ছিচকে চুরি তার পোয় না। পার্কে, ট্যাক্সিতে, পরদাঢাকা রিকশায়, রেস্তোরাঁর কেবিনে পাশাপাশি ঘেষাঘেষি বসে জানুতে নিতম্বে কিংবা অন্য কোথাও তার আবেগকে খেলো করতে চায় না। তার অপেক্ষা আছে, বাঁধন আছে, তার একটা স্বতন্ত্র আভিজাত্য আছে। ইলারও আছে। তবে ইলা একটু বেশি সাহসী। মাঝে মাঝে বিদ্রোহী।
ভিক্টোরিয়ার বাইরে এসে ইলা বললে, চলোনা, আজ প্ল্যানেটোরিয়ামে যাই।
স্পষ্টতই ইলা আজ ছটফট করছে। অন্ধকার তারামণ্ডলে সে নিশ্চয়ই তারা দেখতে চায় না। অন্ধকারে সে বিমানকে কাছে পেতে চায়। কী বলবে বিমান? হ্যাঁ বলবে না না বলবে? শেষে ইলাই আবার বিকল্প প্রস্তাব দিল, তার চেয়ে চলো ট্যাক্সি করে একটু ঘুরে আসি, আজ আমার খরচ। বিমান আর ইলা হাতে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটছে। বিমানের কেবলই বাড়ির কথা মনে। পড়ছে। অদৃশ্য একটা হাত যেন তাকে বাড়ির দিকে টানছে।
এখন ট্যাক্সি পাওয়া দুরূহ হলেও এই অঞ্চলে এক জোড়া তরুণ-তরুণীর জন্যে ট্যাক্সিদের মমতা আছেমিটার ছাড়া রোজগারের লোভে। ড্রাইভার জানে তাকে কিছুক্ষণ দেখেও দেখছি না, শুনেও শুনছি না এই ভাব করে বসে থাকতে হবে। আর তার পিঠের দিকে দুটি প্রাণী কিঞ্চিৎ জড়াজড়ি করবে, হাসবে, খেলবে, মাঝে মাঝে পরিবেশ ভুলে যাবে। তাদের চোখের সামনে চালক ঝাপসা হয়ে যাবে। তার নিজেরও বাড়তি আনন্দ। সময় সময় তার নিজের কানও গরম হয়ে উঠবে।
ইলা আজ খুশিতে চঞ্চল। দু-মাস পরে তার পাশেবিমান। ফর্সা টকটকে চেহারা। উঁচু নাক। টানা টানা চোখে প্রথম উষার নির্মলতা। ঝাঁকড়া চুল হাওয়ায় উড়ছে। ইলার সংযম শাসন মানছে না। ভুলে যেতে চাইছে সে একজন শিক্ষিকা। কবে তুমি ঘরে তুলে নেবে। রজনীগন্ধার মালা ঝোলাবে। তিনটে বছর গেছে, আরও কত বছর যাবে। দাঁতের গর্ত আরও বড় হবে। জীবন যে বড় চঞ্চল বিমান। আর একটু কাছে সরে এসো। সূর্য অনেক আগে অস্ত গেছে। আলোর বিন্দু উলটো দিকে ছুটে চলেছে। ছুটছে মানুষ। কেউ দেখছে না আমাদের। মানুষ আর এসব দেখে না। জীবনের এ একটা অপরিহার্য অবস্থা। প্লিজ আর একটু কাছে এসো। মুহূর্ত বড় তাড়াতাড়ি অতীত হয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ বড় দ্রুত হেঁটে আসছে। প্লিজ তোমার হাতটা এইখানে এইভাবে রাখো। অনেকদিনের অব্যবহৃত পালঙ্কের মতো আমার সারা শরীর তোমার ভারে শব্দ করে উঠুক।
বিমান বলছে, আমি যে বিকাশ হতে পারব না ইলা। সে তোমাকে ডায়মন্ডহারবারে নিয়ে গিয়ে চোখে দেখতে চেয়েছিল। আমার এটা যে টেস্ট-কেস নয়। আমি ধরতে জানি, ছাড়তে জানি না। তুমি আর একটু ধৈর্য ধরো। মানুষ কত অসীম ধৈর্য নিয়ে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করে, কত ক্লেশ স্বীকার করে একটা জীবনের জন্ম হয়। তুমি আর একটু ধৈর্য ধরতে পারবে না নতুন জীবনের জন্যে? ধৈর্য একটা অভ্যাস। সে অভ্যাসটা হারিয়ে ফেললে তুমি মাতাল হয়ে যাবে।
বিমান কথা বলছে, অল্প অল্প অংশও নিচ্ছে হয়তো কিন্তু তার মনের বিশাল একটা অংশ অকেজো হয়ে আছে। মনের সামান্য একটা অংশে সে ইলাকে রেখেছে। সারা মনে ছড়িয়ে যেতে দেয়নি। বাইরের ঘরে অতিথির মতো বসিয়ে রেখেছে। পুরো মনটাকে চালু করে দিলে বিমান। আর এক মুহূর্তও ইলাকে সঙ্গ দিতে পারবে না, ছুটবে বাড়ির দিকে। চিত্রা ফোন করেছিল, বাবার খুব বাড়াবাড়ি।
ট্যাক্সি ম্যারিন হাউসকে বাঁয়ে রেখে আলিপুরের দিকে বাঁক নিয়েছে। ইলার নির্দেশে গাড়ি চলেছে। যেমন চলেছে বিমান। আজ সুন্দর সেজেছে। বড় খোঁপা, কাজল টানা চোখ। শরীরের ত্বক তেলতেলে মসৃণ। ওপর বাহুতে হাত রেখেছিল—ধোয়া মার্বেলের মতো শীতল। প্রসাধনের হালকা গন্ধ। এই তো এই মুহূর্তে জীবন কত সুন্দর। এখন তাদের বাঁচবার বয়েস অথচ হরিদাসবাবুর কী নিদারুণ শ্বাসকষ্ট। ইলার ফর্সা চওড়া বুকের ওপর পেন্ডেন্টের একটা লাল। পাথরে আলো পড়ে চকচক করে উঠছে। বিমানের মনে হচ্ছে জেড-এর পানপাত্র থেকে অমনই উজ্জ্বল লাল পানীয় পান করে সে খিলখিল করে হেসে উঠে বলে, আমি বিমান, আমি স্বয়ম্ভু, আমি দাস নই। আমি প্রভু, আমি ঘটনার প্রভু, আমি সময়ের প্রভু, পরিস্থিতি, পরিবেশের প্রভু। সব কিছু আমার হাতের মুঠোয়। আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, তারপর তলিয়ে যায় পাশে বসা নারী শরীরের কোমল জ্বণের ডিম্বাধারের জেলিতে।
বিমান হঠাৎ উপলব্ধি করল, সে মোটেই প্রভু নয়, দাস। মানুষ কখনও প্রকৃত প্রভু হতে পারবে না। পারলে বিমান এই রকম স্থাণুর মতো ইলার পাশে বসে থাকত না। ইলার হাত থেকে নিজের ডান হাতটা মুক্ত করে, এই রোককে বলে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়ে সে বাড়ির দিকে ছুটত। ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষমতা যদি তার থাকত তাহলে ইলা ফোন করবার পরই চিত্রার ফোন। আসত না। এ হরিদাসবাবুর ষড়যন্ত্র নয়, অদৃশ্য কোনও শক্তির খেলা। যুগ যুগ ধরে মানুষ যাকে বলে আসছে নিয়তি। সেই নিয়তি বিমানকে আজকের এই সন্ধ্যাটা পুরোপুরি ভোগ করতে দিলে না। পাথরের মূর্তির মতো বিমানকে বসিয়ে রেখেছে ইলার উষ্ণ সান্নিধ্যে। ইলা আজ মুডে আছে, তা না হলে লক্ষ করত তার একতরফা আদরে বিমানের অংশ কত কম! তবুও সে সুখী। বিমানের বুকের কাছে তার মাথা। গাড়ি ছুটছে হু-হু করে। হাওয়ায় একটা-দুটো আলগা চুল উড়ে বিমানের মুখে চোখে লাগছে। শরীরের ঘ্রাণ।
অবশেষে সময় একটা মাইল পোস্টে এসে বিমানকে মুক্তি দিল। আর পারছিনা বিমান, এইবার যা হয় একটা কিছু করো বলে ইলা বিদায় নিয়েছে। ভরা রাতের আকাশ মাথার ওপর থমকে আছে। বিমান ছুটছে বাড়িমুখো। চিত্রা শক্ত মেয়ে। বিশেষ ভয়ের কিছু না থাকলে সে ফোন করত না। বিমান মুসাম্বি কিনেছে, নরম পাকের সন্দেশ কিনেছে এক বাক্স। অসুস্থ পিতার প্রতি তার কর্তব্য—মুসাম্বি আর সন্দেশের বাক্স! বিচারক বিমানের এজলাসে বিমানের বিচার চলেছে। তিনটের সময় তুমি তো বাড়িমুখো হতে পারতে। তা না করে তুমি কী করে এলে। জানো না তুমি হরিদাসবাবুর অন্নদাস ছিলে বহুদিন। তোমার শরীর কার দান?
বাড়ির সামনে ছোটখাটো একটা ভিড়। বিমানের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। যা ভেবেছি ঠিক তাই। বিমানকে ঢুকতে দেখে প্রতিবেশীদের মধ্যে কে যেন ব্যঙ্গের গলায় বললেন,—বাবু এসেছেন! আত্মীয়দের মধ্যে থেকে একজন বললেন,—এত দেরি করলে বিমান! ঘরের বাইরে চিত্রা চোখ মুছতে মুছতে বললে, তোকে কখন ফোন করেছি দাদা আর তুই এখন এলি! শুনলাম তুই তিনটের সময় অফিস থেকে বেরিয়েছিস। বিমান অপরাধীর মতো মুখ নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ফল আর সন্দেশের বাক্স। চিত্রা বলছে, তোর কথা বারবার বলছিলেন। শেষ কথাটা। একবার বললি না। চিত্রা হু-হু করে কাঁদছে। বিমানের মনে হচ্ছে তার ঘুমভাঙা চোখের সামনে যেন ভীষণ চড়া পাওয়ারের একটা আলো জ্বলছে, সব যেন ভীষণ ঝলসানো সাদা। কারুর মুখ সে দেখতে পাচ্ছে না। কেবল কিছু শব্দ শুনছে। তাও যেন বহু দূর থেকে।
বয়স্ক কে একজন বলছেন, তুমি তাড়াতাড়ি জামাকাপড় ছেড়ে নাও। কী মুশকিলে যে ফেলেছিলেন। সেই তিনটেয় বেরিয়েছ। ছি-ছি! সে আর এক ভাবনা। এতক্ষণ লাগে আসতে!
নিজের ঘরে এসে জামা খুলতে গিয়ে বিমান আবিষ্কার করল কাঁধের কাছে একটা লম্বা সোনালি চুল আটকে আছে! কী আশ্চর্য মন! হঠাৎ তার মনে হল ইলাকে আরও কাছাকাছি পাবার সবচেয়ে বড় বাধা সরে গেল। কোনও আপত্তি আর কোনওদিক থেকে আসবে না, কেউ। গুরুগম্ভীর গলায় বলবেন না–না ওসব হবে না, বলে দাও ওকে। জাতে মিলছে না। যদি কিছু করতে চাও এ বাড়ির বাইরে। এখানে তার স্থান হবে না।
চিন্তাটা নিমেষে সরে গেল। চড়া আলো স্বাভাবিক হয়ে গেছে বিমানের চোখে, সব কিছু তখন
স্পষ্ট। ফুল, খাট, মৃতদেহ, মানুষ। বিমানের চোখের কোল বেয়ে এইবার জল নামছে। এর জন্যেই যেন সে অপেক্ষা করে ছিল!