Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উদ্ভিদ || Bimal Kar

উদ্ভিদ || Bimal Kar

পূর্ণেন্দুবিকাশ বটানির প্রফেসর হয়ে এল আমাদের কলেজে। সে আসার পর, তাকে দেখে আমরা—আমি আর মোহিত বলাবলি করেছি, এ একটা কন্‌ট্রাস্ট।

বলাবলি করতাম আর ভাবতাম। মাস তিনেক আগের দৃশ্য মনে পড়ত। তখন আমরা সবে এসেছি, এসে জুটেছি মফস্বলের এ-কলেজ ও-কলেজ থেকে রাজা প্রদীপনারায়ণে, ছেলে ছোকরা মাস্টারের দল। আমার আসার পর তবে কলেজ খুলল। রীতিমত ওপেনিং সেরিমনির পর। তখনই, সেই অনুষ্ঠানেই তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম, রানী সুবর্ণসুন্দরীকে। ম্যাজিস্ট্রেটের পাশেই তিনি বসেছিলেন। ইসলামপুরী সিল্কের দুধসাদা থান পরনে। হাতির দাঁতের মতন রং গায়ের, ননীর মতন কোমল আর মসৃণ মনে হচ্ছিল তাঁর দুটি হাত আর গ্রীবা। আশ্চর্য সুন্দর সেই মুখ, উজ্জ্বল ও অভিজাত। হীরে বসানো একটি হার ছিল সুবর্ণসুন্দরীর কণ্ঠে, আর দুটি বলয়, বাহুতে।

আমরা অবাক হয়ে সেই রূপ দেখছিলাম, সেই দুটি ধূসর, দীপ্ত চোখ। অল্পক্ষণ পরেই মনে হল, এতক্ষণ যা দেখেছি তা রূপ নয়—রূপের ছায়া। রূপের কায়াকে প্রত্যক্ষ করলাম, রানী সুবর্ণসুন্দরী যখন বক্তৃতা দিতে উঠে দাঁড়ালেন। একটি নমস্কার তিনি করেছিলেন, মৃদু একটা হাসি খেলে গিয়েছিল তাঁর ঠোঁটে। তারপর থেমে থেমে মৃদু অথচ স্পষ্ট, যথাস্থানে ধ্বনির স্বরাঘাত হেনে একটি বক্তৃতা তিনি দিলেন। সেই বক্তৃতায় বাংলার সঙ্গে মাঝে মাঝে ইংরেজি মেশানো ছিল এবং পুরো বক্তৃতাটাই শোনার মতন, শুনে অভিভূত হওয়ার মতন।

রানী সুবর্ণসুন্দরীর সেই বক্তৃতা ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব আর দেওয়ানকে ক্ষণে ক্ষণে চমকে দিচ্ছিল। চমকে উঠছিল রাজকুমারী চন্দ্রাও। কিন্তু কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল তাঁর। তিনি তখন প্রকাশ্যেই, স্বাভাবিক কণ্ঠেই তাঁর স্বামীগৃহ এই রাজপরিবারের সংস্কার, শৌখিনতা, জাঁকজমকের মধ্যে নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায় ঘুমিয়ে থাকার কথাই বলছিলেন। বলছিলেন, এই রাজপরিবার কিভাবে ঝাড়লণ্ঠনের নকল আলোয় এই জগতকে দেখেছে, জগতকে এবং জীবকে। ‘আসল আলোয়, দিনের আলোয় এই জগতকে আমি দেখতে জানি! আমি এই যুগকে চিনতে ও বুঝতে শিখেছি।’ তিনি বললেন, ‘আর তাই তেমন আলোই জ্বালাতে চাই যা সমস্ত অন্ধকারকে দূর করে। এ-কলেজ তার জন্যেই। মনে রাখবেন আপনারা, আমি কী চাই, কী চাইছি আর কেন রাজপরিবারের ক-পুরুষের বিলাসব্যসনের গোপনতীর্থ এই বাগানবাড়ির কলুষিত অন্তরকে ভেঙে চুরমার করে সর্বজনের বিদ্যার তীর্থে পরিণত করলাম, তুলে দিলাম আপনাদের হাতে।’

সভার সমস্ত গুঞ্জন থেমে গিয়েছিল। একটি সরব দীর্ঘনিশ্বাসও শোনা যেত এমন নিস্তব্ধতা। সকলেরই চোখ রানী সুবর্ণসুন্দরীর সেই দীপ্ত ও দৃপ্ত ভঙ্গির দিকে। একটি কোষমুক্ত অসি যেন জ্বলছে তার নিজের আভায়।

রানী সুবর্ণসুন্দরী আবার বললেন, “মনে রাখতে হবে আমরা অ্যানিমাল্‌—হায়ার অ্যানিমাল্‌। আমরা রেস্‌প্‌ন্ড করতে পারি, রি-অ্যাক্ট করতে জানি। বাইরের ডাকে সাড়া দিতে এবং আঘাতে নিষ্ক্রিয় না থাকার ধর্মই আমাদের, অ্যানিমালদের। আমরা ভেতর থেকে দিনে দিনে বাড়ি, নিজেকে প্রসারিত করি। এগিয়ে চলেছি আমরা। তাই শিক্ষা।”

এর পর আমরা কেউ-ই বিমুগ্ধতা সংবরণ করতে পারিনি। চমৎকৃত, বিহ্বল হয়েছি যে-পরিমাণ, সেই পরিমাণ উচ্ছ্বসিত হয়ে অভিনন্দন জানিয়েছি রানী সুবর্ণসুন্দরীকে।

রানী সুবর্ণসুন্দরী তাতে আত্মবিস্মৃত হননি। আতিশয্য তাঁকে উত্তেজিত করেনি। এর পরই ম্যাজিস্ট্রেটসাহেব নিজের হাতে রুপোর ট্রে তুলে ধরেছিলেন। কালো ভেলভেটের ওপর একটি ছোট কাঁচি ছিল। রানী সুবর্ণসুন্দরী সেই কাঁচি তুলে। নিয়েছিলেন। আর ফিতে কাটার পর, রাজা প্রদীপনারায়ণ কলেজের প্রশস্ততম কক্ষের ভেজানো দরজাটি ঠেলে খুলে দিলেন তিনি। হাতে প্রদীপ ধরে সেই কক্ষে প্রথম পা দিলেন রাজকুমারী। মনে হল যেন শতরাত্রির নটীকুল-নূপুর-নিক্কণের চটুল ছন্দ সেই মুহূর্তে স্তব্ধ হয়ে গেল, বহুকালের আসব-সিক্ত একটি রুদ্ধ বাতাস অন্ধকারে শেষবারের মতো আর্তনাদ জানিয়ে মিলিয়ে গেল শূন্যতায়। আর আলো ফুটল, আলো জাগল সেই কক্ষে। কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে। যেন এতকাল পরে একটি কমল ফুটল পঙ্কে।

একটি কমল যদি ফুটে থাকে তবে আবার ফুটবে আরো ফুটবে আমরা আশা করেছি এবং নিঃসন্দেহ হয়েছি। আমরা জানতাম, সুবর্ণসুন্দরী আলোর আড়াল আর সহ্য করবেন না, করতে পারবেন না।

তাই হল। তেমন সব কাণ্ডই হচ্ছিল। আমরা দেখছিলাম। দেখছিলাম, রাজকুমারী চন্দ্রা কলেজে আসছিল, ফার্স্ট ইয়ার ক্লাসে আর পাঁচটি মেয়ে—গীতা, ললিতা, রেবাদের সঙ্গে একাসনে না বসে—বসছিল আলাদা গদিমোড়া চেয়ারে। ব্যবস্থাটা করেছিলেন প্রিন্সিপাল। রানীর কানে খবরটা যেতেই একটা চিঠি এল : রাজকুমারী আর পাঁচটি মেয়ের মতনই একজন ছাত্রী ; তার জন্যে পৃথক ব্যবস্থা আমি পছন্দ করি না। চন্দ্রা নিজেকে সাধারণ মানুষের সমগোত্রীয় না ভাবতে পারে এমন উদাহরণ স্থাপন করবেন না।

সেই চিঠি পড়ে আমরা—মাস্টাররা চমৎকৃত হয়েছি। কেউ বলেছেন রানী-ই ট্রু ডেমোক্র্যাসির একটি উদাহরণ। কেউ তাঁর শিক্ষা দীক্ষার সঙ্গে ইংলন্ডের বাতাসের লিবারেল হাওয়া ক-বছর জড়িয়ে আছে তার হিসেব দিয়েছেন। ব্যতিক্রম ছিলেন সংস্কৃতের অধ্যাপক মথুরেন্দ্রবাবু। তিনি বলেছিলেন, “আসলে কি জানেন মশাই, দ্বিতীয় পক্ষের বউ রাজার। বিলেত ঘোরা বিবিয়ানা-রপ্ত মেয়েকে দেখে রাজাবাহাদুরের মাথা ঘুরে গিয়েছিল—বিয়ে করে ফেলেছিলেন। তা বিয়ে হয়েছিল বছর চারেক, শেষের দিকে রাজা যখন অসুস্থ তখনই বছরখানেক বড় জোর রানীসাহেবা রাজার কাছে ছিলেন। তাই বলছিলাম, মেয়ে তো নিজের পেটের নয়—তাই অত উদারতা!”

রানী সুবর্ণসুন্দরী যদিবা বিমাতা, কিন্তু কুমাতা নন। মাস দুয়েকের মধ্যে আমরা তা অনুমান করতে পারলাম। দেখলাম সব-ই। রাজকুমারী চন্দার খেয়াল, সে বটানি পড়বে। প্রিন্সিপালের কাছে কথা পাড়লো। মুশকিলে পড়লেন প্রিন্সিপাল। আমাদের কলেজে বটানি কম্বিনেশানের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। অথচ রাজকুমারীর আগ্রহ। সরাসরি না বলতে পারেন না, আবার স্বতন্ত্র কোনো ব্যবস্থা করতেও ভরসা পান না। অগত্যা রানীর সঙ্গেই সাক্ষাৎ করতে হল। রানী বললেন, “বটানি হয়ত আরো ছেলেমেয়েরা পড়তে পারে। আপনি একজন লেকচারার নিন বটানির।”

এর পরই আমাদের পূর্ণেন্দুবিকাশ এল, বটানির লেকচারার হয়ে, রাজা প্রদীপনারায়ণে। আর এসেই লক্ষ্য করলে প্রিন্সিপালের অফিসে, প্রফেসরস্‌ রুমে, করিডোরে স্বর্গত রাজার ছবি আর সুবর্ণসুন্দরীর বক্তৃতার শেষাংশ কাচের ফ্রেমে বাঁধানো, দেওয়ালে দেওয়ালে ঝোলানো।

ওর জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে আমাদের সব কথা বুঝিয়ে বলতে হয়েছে। বলতে হল, ওপেনিং সেরিমনির কথা। রানী সুবর্ণসুন্দরীর সেই ইন্স্‌পায়ারিং টক্‌স্‌ কী পরিমাণ অভিভূত করেছিল আমাদের। প্রিন্সিপাল কেন সকলের চোখের সামনে প্রতিদিন তা তুলে ধরতে চান। পূর্ণেন্দু চুপমুখে অন্যদিকে তাকিয়ে সব কথা শুনেছে আমাদের।

পরের দিনই আমি আমার ক্লাসে বসে শুনেছি, পার্টিশানের ওপাশে—মৃদু, মোলায়েম ঈষৎ-উত্তেজিত একটি কণ্ঠস্বর অ্যানিমাল আর প্ল্যান্ট লাইফের পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়েছে। উৎকর্ণ হয়ে শোনবার চেষ্টা করছিলাম। সব কথা কানে আসছিল না, তবু আবেগগাঢ় কটি কথা শেষের দিকে স্পষ্টই শুনতে পেলাম। পূর্ণেন্দু বলছে, “হয়ত, হয়ত জীবনসৃষ্টির আদিতেই প্রকৃতি এই দুরূহ পরীক্ষায় হাত দিয়েছেন—হু ইজ্‌ মোর সুটেবল্‌ টু দিস্‌ আর্থ, অ্যানিমালস্ অর প্ল্যান্টস্? অর্থাৎ কোন জীবন উপযুক্ত বেশি ; সেই জীবন, যা রেসপন্ড্‌ করতে পারে, রি-অ্যাক্ট করতে জানে, প্রয়োজনে হিংস্র, ক্রুয়েল—অথবা অসহায়, অনড়, মুক জীবন—যা সম্পূর্ণভাবেই দাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করে আয়ু আর ক্ষুধা নিয়ে পড়ে আছে। ”

পূর্ণেন্দুর গলার স্বর পার্টিশানের ওপারেই হঠাৎ সেই ছবি ফুটে উঠেছিল, রাজা প্রদীপনারায়ণ কলেজের ওপেনিং সেরিমনির সেই দৃশ্য, রানী সুবর্ণসুন্দরী কোষমুক্ত অসির মতন জ্বলছেন তাঁর নিজের আভায় এবং বলছেন, ‘মনে রাখতে হবে আমরা অ্যানিমালস্—হায়ার অ্যানিমালস্…’

হঠাৎ মনে হল, এ একটা কনট্রাস্ট্‌। রানী সুবর্ণসুন্দরী আর পূর্ণেন্দু জীবজগতের দুটি প্রাচীন, পৃথক অস্তিত্ব। পৃথক এবং প্রতিদ্বন্দ্বী দুই অস্তিত্ব যেন।

  • *

পূর্ণেন্দু যে আমাদের কাছে স্থায়ী কৌতূহলের পাত্র হয়ে উঠবে, আমাদের এবং অন্যান্যদের, এমন কি ছাত্রছাত্রীদের তা অবশ্য প্রথমে ভাবিনি। ভাববার কোনো কারণ ছিল না। ও আসার পর সাধারণভাবেই কনট্রাস্টের কথাটা মনে এসেছে। কিন্তু কে জানত—!

অথচ আমাদের দিনে দিনে জানতে হচ্ছিল। না জেনে উপায় ছিল না। দারাপুত্র-পরিবারহীন কটি ছেলে ছোকরা মাস্টার আমরা একটা বাড়ি পেয়েছিলাম থাকবার, রানীর অনুগ্রহে। আমি আর মোহিত থাকতাম এক ঘরে। তার পাশেই ছিল এক চিলতে ঘর, ফাঁকাই পড়েছিল। পূর্ণেন্দুকে দিলুম সেই ঘর। আর শুধু ঘর নয়, পূর্ণেন্দুকে বন্ধুত্বের গণ্ডির মধ্যে টেনে নেবারও চেষ্টা করেছি আমরা। কিন্তু বোধ হয় পারিনি। ওর স্বভাবটাই যেন আলাদা ধাতের। অন্তত তাই মনে হয়েছিল। আমাকে আর মোহিতকে সে যে পছন্দ না করত এমন নয় ; পছন্দ করত, আমাদের ঘরে আসত বসত, ওর মনোমত কোনো আলোচনা হলে মাঝে মাঝে যোগ দিত। এই পর্যন্ত। তার বেশি কিছু নয়। আর যদি বেশি কিছু হয়-ই, তবে বলব, বয়সে দু-তিন বছরের বড় বলে হয়ত কিছুটা সমীহ করত আমাদের।

অগত্যা ওকে ওর মতনই থাকতে দিতে হয়েছিল আমাদের। গভীর স্নেহে আমরা তাকে অদৃশ্য ভাবে ঘিরে ছিলাম। তার মনের ওপর হাত ছিল না আমাদের, কিন্তু প্রত্যক্ষ শরীরটার সুখ-সুবিধের ওপর নজর রাখা সম্ভব ছিল। আমরা তাই রাখতুম। এবং দিনে দিনে পূর্ণেন্দু রাজা প্রদীপনারায়ণের অধ্যাপক-কুল ও ছাত্রছাত্রীদের যতই কৌতূহলের বিষয় হয়ে উঠছিল, আমরা—আমি আর মোহিত ততই যেন তার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিলাম। বলা ভাল, অন্যদের মতন নিরলস কৌতূহল পূর্ণেন্দু সম্পর্কে আমাদের খুব কমই ছিল। আমরা তাকে লক্ষ্য করতাম অন্য চোখে, গভীর মনোনিবেশে। কারণ, কারণ পূর্ণেন্দু এমন একটি সমাহিত সৌন্দর্য ও বেদনা নিয়ে এখানে ছিল, আমাদের মধ্যে তপস্বীর মতন, যা আর কেউ ছিল না, এমন কি আমরাও। সত্যি বলতে কি, সুবর্ণসুন্দরী যদিও আমাদের হাতে জ্ঞানের আলো জ্বালাবার ভার দিয়েছিলেন, তবু কেউ-ই সে-চেষ্টা করতাম না। সে-ক্ষমতাও ছিল না আমাদের। জীবিকার প্রয়োজন একটি অভ্যাসকে বাঁচিয়ে রেখেছিলাম শুধু। পূর্ণেন্দুকেই দেখলাম ব্যতিক্রম। অভ্যাস নয়, আপন তাগিদেই সে যেন ব্যাকুল হয়ে আলো খুঁজছিল, পথভ্রান্ত পথিকের মতন অন্ধকারে অন্বেষণ করছিল পথ।

কাজেই পার্টিশান করা ঘরের মধ্যে বসে রাজকুমারী চন্দ্রা কি গীতা, ললিতা, রেবার ছোট্ট দলটি এবং সহপাঠিনী-সংস্পর্শ লোভী দু-তিনটি ছাত্র অতি মৃদু, মোলায়েম যে কণ্ঠস্বরটি শুনেছে, ক্রিপ্‌টোগ্যামিয়া আর ফাইলোট্যাক্সি বোঝাতে গিয়ে আত্মবিস্মৃত যে-কথক উদ্ভিদ-রহস্যের এক সূত্র থেকে অন্য সূত্রে চলে গেছে তাকে তারা আর একটি উদ্ভিদ ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারে না। তাই কলেজময় নামটা ছড়িয়ে পড়েছিল, প্ল্যান্ট প্রফেসর। আশ্চর্য, পূর্ণেন্দুর নামটাই যেন সকলে ভুলে গেল। সকল মহলেই তার পরিচয় দাঁড়াল ওই নামে, প্ল্যান্ট প্রফেসর।

সে-নাম শুনে আমরা—আমি আর মোহিত অসন্তুষ্ট হয়েছি, চটেছি। আমাদের ক্লাসে সেই সব অকালপক্ক ছাত্রদের সাক্ষাৎ পেলে বহু শ্লেষোক্তি করেছি। কিন্তু যাকে নিয়ে এই হাসি তামাশা, গুঞ্জন—সে কোনো কিছুতেই ভ্রূক্ষেপ করত না।

তাকে দেখতাম তার বটানির বাগানে। আমাদের কলেজের অর্থাৎ রাজকুলের সেই বাগানবাড়ির পশ্চিমে একটু তফাতে ঝিল ছিল একটা। লতাপাতার বাহার আর গাছগাছড়ার ভিড়টাও ছিল সেখানে। ঝিলের একদিকে সিঁড়ি বাঁধানো ঘাট, সেই ঘাটের একপাশে একটি স্ট্যাচু, রাজা-রাজড়ার প্রমোদোদ্যানে যেমনটি থাকে, তেমনি। একটি শ্বেত নগ্ন নারীমূর্তি। কঠিন প্রস্তরেও এক উদ্ভিন্ন-যৌবনার কমনীয়তাটুকু ফুটিয়ে তুলেছে শিল্পী। ওই মূর্তির ঠিক সোজাসুজি—ঘাটের ওপর ক-পা পিছিয়ে এলে একটি শেড্‌। কোনো একসময় ওই শেডের তলায় বসে হয়ত বিলাসী লম্পট রাজপুরুষ বাগানের ঠাণ্ডা হাওয়ায় নেশার আচ্ছন্নতা খানিকটা লাঘবের চেষ্টা করতেন। আর এখন। এখন সেখানে অন্য এক মূর্তি। এই মূর্তিটিও আচ্ছন্ন হয়ে বসে থাকে, সমাধিস্থ যোগীর মতন। মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে সাইটোপ্ল্যাজমের আশ্চর্য জগতে সে যেন কোনো এক রহস্য খুঁজে বেড়ায়। স্লাইডের প্ল্যান্ট সেল আয়োডিনের ছোঁয়ায় যে-নীলাভ বিচিত্র রূপসজ্জা করে, রূপদক্ষ একটি চোখ নিষ্পলক চোখে দেখে সেই রূপোত্তীর্ণ রহস্যকে।

পূর্ণেন্দু নিজের হাতেই করেছিল এসব। জালি-তার দিয়ে ঘিরেছিল সেই শেড, রোদ বৃষ্টি আটকেছিল কাচে, টব আর গামলায় লালন করেছিল গাছ লতাপাতার স্পেসিমেন। ক্রিপার আর রুটের সেই জগতকে আমরা দেখেছি দূর থেকে। আর দেখেছি তারের বেড়া দিয়ে বাঁধা বিচিত্র গাছগাছড়ার বাগান শেডের বাইরেও ঝিল পর্যন্ত এগিয়ে এসে থেমেছে। বর্ণবহুল ও বর্ণহীন সেই পাতা আর ফুল, গাছ আর গাছড়া এই নিয়ে পূর্ণেন্দু মগ্ন ছিল। বিভোর ছিল তার বটানির গার্ডেন নিয়ে। প্রায় সর্বক্ষণই ড্রাই ব্যাটারিতে বাতি জ্বালিয়েও অনেক দিন মাইক্রোস্কোপ চোখে বসে থেকেছে পূর্ণেন্দু, হাওয়ায় হাওয়ায় কতটা রাত সময় হয়ে ফুরিয়ে গেছে তার খেয়াল রাখেনি।

বটানির ছাত্রদের পূর্ণেন্দু তার এই বাগানে নিয়ে আসত। চাক্ষুস উদ্ভিদ-পরিচিতির জন্যে।

হঠাৎ একদিন এই আসা বন্ধ হল তার। আর আমরা, আমরা প্রফেসর মহল চমকে উঠলাম, অবাক মানলাম। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি, অথচ ছাত্রমহল মনে হল বেশ চঞ্চল এবং উদ্দীপ্ত। আর যদিও বাইরে চুপ, ভেতরে ভেতরে উগ্র কৌতূহল ফুটছে। প্রিন্সিপালের কঠিন হুকুম—কেউ গার্ডেনের দিকে যেতে পারবে না, তবু তাদের কী চেষ্টা, কী লুকোচুরি, কানাকানি।

কলেজ ছুটির পর প্রিন্সিপাল আমাদের বললেন, “বটানির গার্ডেনটা আপনারা ঘুরে আসুন।”

আমরা গেলাম, মাস্টারমশাইরা সকলেই। পূর্ণেন্দু সেদিন কলেজেই আসতে পারেনি জ্বর জ্বর হয়েছিল। ভালই হয়েছিল নয়ত এত বড় লজ্জার মধ্যে পড়লে হয়ত তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যেত।

আমরা পূর্ণেন্দুর বটানির বাগানে এসে দৃশ্যটি লক্ষ করলাম। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম কটি মুহূর্ত। তারপর চোখ নামিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।

কি সেই পাথরের পূর্ণ নগ্ন নারীমূর্তির কণ্ঠে, বাহুতে, বক্ষে কে যেন অলঙ্কার পরিয়ে দিয়ে গেছে হলুদ আর নীল চক দিয়ে। লালচে খড়িরও রং রয়েছে এখানে সেখানে। আর শুধু অলঙ্কার নয়, অর্থকরণও করে গেছে অতি প্রাঞ্জলভাবে।

অলঙ্করণটা যদিও বা ক্ষমা করা যায়, অর্থকরণটা কোনো মতেই নয়। পূর্ণেন্দর কথা বাদ দি, রাজকুমারী চন্দ্রার নামে এত বড় স্ক্যান্ডাল কে ক্ষমা করবে, কে সহ্য করতে পারে। রানী সুবর্ণসুন্দরীর কানে কথাটা উঠবেই, হয়ত উঠে গেছে এর মধ্যে। আর তিনি নিশ্চয়ই বিস্মিত হচ্ছেন, ভাবছেন, এত বড় স্পর্ধা, দুঃসাহস কার হতে পারে!

আমরা জানতাম, রানী সুবর্ণসুন্দরী কখনই এত বড় অপমান, নির্লজ্জতা, নোংরামি সহ্য করবেন না। করতে পারেন না।

প্রিন্সিপালের ঘরে আমাদের প্রফেসারদের ক্লোজ ডোর মিটিং বসল। নানা অনুমান এবং সন্দেহ। অবশেষে প্রিন্সিপাল বললেন, আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে, এ-কাজ কে করেছে, কে? আর আজ থেকে ছেলেমেয়েদের কাছেও বাগানের পথ বন্ধ হল।

পূর্ণেন্দু সব শুনল। এত বড় চাঞ্চল্যকর ঘটনা সম্পর্কে তার কোনো আগ্রহ দেখলাম না। শুধু বললে, “মুছে ফেলেছে?”

বললাম, “হ্যাঁ। জল দিয়ে ধুয়ে ফেলেছে। ”

খড়ির দাগ জলে মুছল কিন্তু যা রটে গিয়েছিল কলেজময় সেই রটনা ঘুচল না। অত্যন্ত চাপা একটা কানাকানি ছাত্র থেকে অধ্যাপক সকল মহলেই জিইয়ে থাকল। রানী সুবর্ণসুন্দরীর কানে সব খবরই গিয়েছিল। একদিন বিকেলে তিনি এলেন। কলেজ ছুটির পর। প্রিন্সিপালের সঙ্গে সটান বাগানে গিয়ে হাজির। পূর্ণেন্দু তখন ঝিলের শেষ সিঁড়িতে বসে শেওলা তুলেছিল মুঠো করে। আমি ছিলুম একটু দূরে।

সম্ভবত এই প্রথম ভাল করে দেখলেন রানী পূর্ণেন্দুকে। মনে হল বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ করলেন। তারপর প্রশ্ন।

রানী। কী দেখছেন ওটা?

পূর্ণেন্দু। স্পাইরোগাইরা।

রানী। স্পাইরোগাইরা! তবে মস্‌?

পূর্ণেন্দু। দেওয়াল-টেওয়ালের গায়ে যে-শেওলা জন্মায়—তাই মস্‌!

রানী কথাটা শুনলেন। অথচ অকিয়ে ছিলেন তখন স্ট্যাচুটার দিকে। সেই স্ট্যাচু। কী মনে করে হাসলেন ঠোঁটের কোণে। চোখের ইশারায় স্ট্যাচুটাকে দেখালেন। বললেন, “যদি ওর গায় শেওলা পড়ে—তবে? কী নাম হবে তার?”

পূর্ণেন্দু চুপ। যেন চমকে উঠেই চুপ করে গেল। একবার চোখ তুলে দেখল রানীকে, আর-একবার সেই স্ট্যাচুটি।

রানী ফিরে চললেন। চলতে চলতে বললেন প্রিন্সিপালকে, “আপনার কলেজের ছাত্রছাত্রীরা শিশু নয়। আগে যে-ব্যবস্থা চলছিল তাই থাক—ছেলেমেয়েদের আপনি বাগানে যেতে দিন।”

রানী সুবর্ণসুন্দরী যে এত সহজে রাজকুমারীর নামে রটানো স্ক্যান্ডাল ক্ষমা করবেন, ভুলে যাবেন তা আমরা আশা করিনি। কিন্তু সব যেন ভুলেই গেলেন রানী, খড়ির দাগকে সহজেই মুছে ফেললেন মন থেকে। দেখে শুনে আমরা বিস্মিত এবং বিমুগ্ধ হলাম।

বটানি ক্লাসের ছেলেমেয়েরা আবার বাগানে যেতে শুরু করেছিল। গীতা, ললিতাদের সঙ্গে রাজকুমারী চন্দ্রাকেও দেখেছি শেডের তলায় বসে প্র্যাক্‌টিকাল ক্লাস করছে। তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ করিনি আমি। করার কথাও আমাদের নয়। শুনতাম, বটানিতে ওর উৎসাহ খুব। সাবজেক্টটায় তার মন বসে গেছে। রেজাল্ট করবে ভালই। কথাটা বলত পূর্ণেন্দু-ই।

আমি আর মোহিত একবার ভেবেছিলাম, পূর্ণেন্দুকে একটু সাবধান করে দেওয়া উচিত। কিছুদিন আগেই যে-কাণ্ডটা ঘটে গেছে, তারপর অত্যুৎসাহী ছাত্রীটিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে থাকাই বোধ হয় ভাল। বলি বলি করেও কথাটা আর বলা হয়নি। ভেবেছি, হয়ত কথাটার অন্য কোনো অর্থ ধরবে পূর্ণেন্দু ; এবং দুঃখ পাবে।

এদিকে কলেজময় নতুনভাবে এই কথাটা রাষ্ট্র হয়ে পড়ছিল যে, রাজকুমারী মাইক্রোস্কোপে চোখ রেখে বসে থাকলে—পূর্ণেন্দুর মুখটাও চন্দ্রার মাথার ওপর নেমে আসে। হাতে হাত ছুঁয়ে থাকে অ্যাডজাস্টারে। কেন?

সত্যিই তো কেন, আমরাও ভেবেছি। সত্যি হোক, মিথ্যা হোক, এ-রটনা কেন, কিসের জন্যে? মোহিত বলত, যদি সত্যিই হয় সব তবে এই লুকোচুরির দরকার কী? রানী সুবর্ণসুন্দরী যথেষ্ট উদার। আর পূর্ণেন্দু কিছু অপাত্র নয়। ক্ষতি কি সহজ কথাটা স্পষ্ট করে বলতে।

অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্নটা একদিন করতেই হল। বললাম, “চন্দ্রা কি তোমার কাছে একস্ট্রা টাইম পড়ে পূর্ণেন্দু?”

পূর্ণেন্দু। না।

আমি। তবে যে শুনি প্রায়ই বিকেলে নাকি বাগানে ও থাকে, কলেজ আওয়ার্সের পরেও।

পূর্ণেন্দু। কই না। আমি দেখিনি। দিন দুয়েক বোধ হয় ছিল বেশিক্ষণ।

মোহিত। কী মনে হয় তোমার?

পূর্ণেন্দু। কিসের ব্যাপারে?

এ-প্রশ্নের পর আমাদের চুপ করে যেতে হয়। না গিয়ে উপায় থাকে না। অত নিরীহ, লাজুক, আত্মবিভোর একটি পুরুষকে আর কী বলা যেতে পারে! আর কেমন ভাবেই বা বলা যায়।

কাজেই আমরা চুপ করে ছিলাম। নীরবে শুনে যাচ্ছিলাম নিত্য নতুন মুখরোচক গুজব। রসালো টীকাটিপ্পনি। আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও কখনো কখনো চোখ রাখতে হচ্ছিল বাগানে।

একদিন, তখন হঠাৎ ঝড় উঠেছে—আকাশটাও কালো। ফিরব কলেজ থেকে। মনে হল, বৃষ্টি আসবে খানিক পরেই—ডেকে নিয়ে যাই পূর্ণেন্দুকে তার বাগান থেকে।

ঝিলের কাছে এসে থামতেই চোখে পড়ল—শেডের খোলা দরজায় একটি হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে চন্দ্রা। চোখ তার খোলা বাগানে। ঝড়ের হাওয়ায় চন্দ্রার বেশবাস বিশৃঙ্খল ; কপালে কটি কুন্তল উড়ে পড়েছে। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে চন্দ্রা বাগানে, কলা ফুলের দিকে, পূর্ণেন্দু যেখানে পুষ্প পর্যবেক্ষণেই সম্ভবত তন্ময় হয়ে দাঁড়িয়ে। উভয়ের ব্যবধান অনেকটা। দাঁড়াবার ভঙ্গিও দুজনের দুরকম। মনে হয় না—একের সঙ্গে অন্যের কোনো যোগসূত্র ছিল, আছে।

সেই একদিনই আমি দেখেছিলাম। আর-একদিন দেখেছিল মোহিত। কৃষ্ণচড়ার তলায় গোধূলির আলোতে ওরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে—পূর্ণেন্দু আর চন্দ্রা। মুখোমুখি কিন্তু চোখে চোখে তাকিয়ে ছিল না, নিশ্চয়ই। নয়ত চন্দ্রার ঠোঁট দুটি কেন পাথর হয়ে থাকবে, আর কেনই বা স্তব্ধ ছিল পূর্ণেন্দু। কেন দুজনেই চমকে উঠে সরে যাবে একটি পাখি উড়ে গেলে। কটি কাঠচাঁপা ফুল ঝড়ে পড়ার পরও।

সেই বসন্তেই চিঠি পেলুম আমরা। এত আচমকা যে, তুলট কাগজের অমন হলুদ রং, সিঁদুরে হরফের যথাবিহিত রাজকীয় পাঠ ভাল করে লক্ষ করবার কথাও মনে আসেনি। এমন আকস্মিকভাবে রাজকুমারী চন্দ্রার বিবাহ স্থির হয়ে যাবে, কে জানত, কে ভেবেছিল! তবু স্বীকার করলাম, রানী ভালই করেছেন। তিন-তিনটে অভ্রখনির অন্ধকারে যাঁদের বিভব গচ্ছিত রয়েছে, দু-দুটো উড্‌ ফ্যাক্টরি আর বরফকল যাঁদের তেমন বিত্তবান পাত্র হাতছাড়া না করে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। কী এল গেল কুল পরিচয়ে খাটো যদি হয় পাত্রপক্ষ!

কলেজে আসা বন্ধ হল চন্দ্রার। ঝিলের জল তখন কাচের মতন ঝকঝকে, বটানির বাগানে পরাগ-মিলনের মরসুম, প্রজাপতি উড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে, ফাল্গুনের মিষ্টি রোদ-গায়ে লতাপাতা আলসেমি ভাঙছে।

আমরা লক্ষ করছিলাম পূর্ণেন্দুকে। আর লক্ষ করে ক্রমশই হতাশ হচ্ছিলাম। বলতে কি, কোনো ভাবান্তর দেখলাম না তার। একবার শুধু বলেছিল, “পরীক্ষাটা—?”

বলেছিলাম, “পরীক্ষায় আর কি কাজ চন্দ্রার? ফুল দেখার দিন শেষ হয়েছে বেচারির, এবার মালা গাঁথার দিন শুরু।”

পূর্ণেন্দু পরম নিস্পৃহতার সঙ্গেই কথাটা শুনল। মনে হল না, মনের কোথাও ওর দাগ পড়েছিল। নয়ত অমন নিস্পৃহতা কি সম্ভব!

এতদিনে আমরা নিঃসন্দেহ হলাম, সকল রটনাই ভুল। সকল অনুমান এবং সন্দেহ। এমন কি, স্বচক্ষে যা দেখেছিলাম আমরা—তারও সঠিক অর্থ বুঝিনি, বুঝতে পারিনি।

সানাইয়ের সুর ছড়িয়ে সেই সকালটি এসে গেল। বিয়ের সকাল। আমরা আলস্য ভাঙলাম শুয়ে বসে, রোদ দেখে। কলেজ ছুটি। দুপুর কাটল ঘুমিয়ে, সানাইয়ের উদাস সুরে মন মিলিয়ে। বিকেল রং বদলাল। বিলিতি ব্যান্ড বেজে উঠল রাজবাড়িতে, দু-চারটে হাউই উড়ে গেল আকাশে। আর সন্ধের গোড়াতেই আলোর মালা গায়ে ঝলমল করে উঠল রাজবাড়ি। ব্যান্ড থেমে রোশনচৌকি বাজল। বাজি পুড়তে লাগল। আলোর স্ফুলিঙ্গে আর রঙে রঙে একাকার হয়ে গেল উত্তরদিকের আকাশ।

সেজেগুজে আমরা বসে আছি। পূর্ণেন্দুর দেখা নেই। কখন যে দরজায় তালা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেছে কে জানে! আসছে, আসছে করে সন্ধে শেষ হল। রাজবাড়ির শুধু নয়, অন্নদাতার নিমন্ত্রণ, ছাত্রীর বিয়ে—আর তো অপেক্ষা করা যায় না। পূর্ণেন্দুর ওপর বিরক্তই হলাম। কাণ্ডজ্ঞান সত্যিই নেই ছোকরার। যদি সে না যায় বাস্তাবিকই ব্যাপারটা শুধু বিসদৃশই হবে না, রানী এই অবিনয়, ঔদ্ধত্য ভাল মনে নেবেন না।

শেষ পর্যন্ত মোহিত আর আমি কলেজেই এলাম। বাগানের পথ ধরে পূর্ণেন্দুর খোঁজে এগিয়ে চললাম ঝিলের দিকে। কই না, তার সেই নির্জন উদ্ভিদকক্ষে বাতি তো জ্বলছে না। সে ঘর অন্ধকার। কাচের গায়ে চাঁদের আলো পড়েছে। লতাপাতার আশ্চর্য ছায়া। অসাড়, অচঞ্চল। তবে? কোথায় গেল তবে পাগলটা? এদিক-ওদিক যতদূর সম্ভব তীক্ষ্ণ চোখে পূর্ণেন্দুর অস্তিত্ব আবিষ্কারের চেষ্টা করছি তখন আমরা। সারা বাগানটাই আলো-ছায়ায় জাফরি কেটে ঝিম মেরে পড়ে আছে।

বুঝি ফিরেই আসতাম। হঠাৎ চোখে পড়ল ঝিলের বাঁধানো ঘাটের দিকে। আর সেদিকে তাকিয়ে আমরা চমকে উঠলাম। হতবাক, হতবুদ্ধি আমরা। চোখের পলক পড়ছে না, নিশ্বাস নিতেও যেন ভুলে গিয়েছি তখন।

চোখের ভ্রম নয়। সত্যি সত্যিই আমরা পূর্ণেন্দুকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। আর সেই পূর্ণ নগ্ন নারীমূর্তি—মর্মর অবয়ব। চাঁদের আলোয় অপ্রত্যক্ষ ছিল না কিছুই। মনে হল, ধবল জ্যোৎস্নার কোন অদৃশ্য কুহক মোহ বিস্তার করেছে পূর্ণেন্দুর চোখে, মনে, চেতনায়। আশ্চর্য, অদ্ভুত কোনো মোহ। নয়ত, এ-বিভ্রম কেন তার? কেন একটি নিষ্প্রাণ, কঠিন দেহতটের কিনারা ঘিরে লতার মতন জড়িয়ে জড়িয়ে উঠছে ও? কিসের আশায়? …পূর্ণেন্দুর মাথাটা ক্ষণিকের জন্যে থামল। তখন স্ট্যাচুর গলার কাছে তার মাথা। মুখটা উঁচু হয়ে আছে। মূর্তিটা যেন নড়ে উঠল, দুলে গেল। তবে কি প্রাণ পেয়েছে নিরেট পাথর? কিন্তু না। মর্মর মূর্তি তেমনই প্রাণহীন, স্থির। পূর্ণেন্দুই বেড় দিয়ে আরো কিছুটা উঠে গেল। আর স্পষ্টই দেখলাম, দুটি নিষ্প্রাণ ওষ্ঠে একটি আবেগতপ্ত ওষ্ঠ মিশে গেল। চাঁদের স্বচ্ছ শুভ্র আলোয় সব রহস্যই অনাবৃত হয়ে গেল, এই নির্জনে এমন দিনে।

মোহিত এগুতে যাচ্ছিল। হাত ধরে ফেললাম তার। নিশ্বাসের সুরে বললাম, ফিরে চল।

—বল কি? পুরনো স্ট্যাচু, যদি টলে পড়ে যায়—যেভাবে দুলে উঠল।

—যায় যাক্‌। ডোন্ট ডিস্টার্ব হিম। এস।

মোহিতের হাত ধরে অতিসন্তর্পণে অনেকটা ব্যবধানে এসে থামলাম।

—দেখলে তো? বললাম আমি।

—পূর্ণেন্দুকে?

—না, একটা ক্রিপারকে। কত সোহাগে, আদরে—কী নিবিড় ভালবাসায় পাকে পাকে জড়িয়ে ধরেছে—। হঠাৎ, অত্যন্ত হঠাৎই আমি থামলাম। থামতে বাধ্য হলাম।

আমি থামলেও মোহিত থামল না। প্রশ্ন করলে, কাকে—চন্দ্রাকে?

জবাব দেবার কিছু কী ছিল! হতে পারে চন্দ্রাকেই—রাজকুমারী চন্দ্রাকেই, অথবা দুর্লভ চন্দ্রার সুলভ স্মৃতিকেই। কিংবা একটি অবচেতন কামনাকেই।

বধূ চন্দ্রা একে একে মোহর দক্ষিণা দিয়ে গুরু বিদায় করছিল। প্রশস্ত কক্ষ, ফুলের আলোয় উজ্জ্বল, গন্ধময়। আমি কাছে এলে নমস্কার করলে চন্দ্রা। মোহর দিলে হাতে। আর তার আয়ত সুন্দর কাজল কাল চোখ তুলে মৃদু সুরে বলল, উনি আসেননি?

“ মাথা নাড়লাম। মিথ্যে করেই বললাম, ল্যাবরেটারিতে রয়েছে—কাজে মত্ত। কোনো হুঁশ নেই।

রানী সুবর্ণসুন্দরী কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন—দেখিনি। তিনি বুঝি কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন।

—হুঁশ নেই! কার? ও, বটানির সেই পূর্ণেন্দুবাবুর কথা বলছেন। রানী সুবৰ্ণসুন্দরীর ঠোঁটের কোণে আশ্চর্য এক হাসি খেলে গেল, হুঁশ থাকে না কার, কাদের—? যাদের চেতনা নেই, যে-চেতনা রেসপন্ড্ করতে জানে না, তাদেরই। নয়কি চন্দ্রা? আর তোমার বটানির প্রফেসর তো একটা প্ল্যান্ট। উদ্ভিদ। ওর একটু অ্যানিমাল হওয়া উচিত ছিল। নয় কি?

চন্দ্রার দুটি চোখের পাতা বুজে এল। ঘাড় হেঁট করল ও ধীরে ধীরে। রানী সুবৰ্ণসুন্দরী তেমনভাবেই, সেই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সব দেখলেন।

তিনি কী দেখলেন জানি না। আমি দেখছিলুম ঝিলের সেই চাঁদের আলোছায়ার নির্জনতায়, একটি আশ্চর্য উদ্ভিদ-ভালবাসার অব্যক্ত বেদনা আর সুখকে। অনুভব করবার চেষ্টা করছিলুম, তেমন সুখ—যে-সুখে এমন স্তব্ধ রাতেও একটি লতা চুপি চুপি তার সবুজ ডগা তিল তিল করে বাড়িয়ে জড়িয়ে একটি অদ্ভুত কামনাকে প্রকাশ করছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *