উত্তর বসন্ত
অমল যখন দিদির বাড়িতে পৌঁছলো, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ট্যাক্সিকে বিদায় দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে একটা গানের আওয়াজ কানে এলো। কৌতুহলী হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে একটি ঘরের ভেতরে চোখ পড়লো,
কিন্তু ঘরটা আধো আলোর ঈশারায় আচ্ছন্ন। একটা মায়াবী পরিবেশের মধ্যে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীত ভেসে আসছে সুরেলা মহিলা কন্ঠে। এতো মনমুগ্ধকর সুরের আবর্তে অমল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
গানের কথাগুলো বহুবার শোনা। তবুও মনমুগ্ধ হয়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে গানটা শুনছে।
মোর ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো
দোলে মন দোলে অকারণ হরষে।
হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে
রসের ধারা বরষে।
তাহারে দেখি না যে দেখি না,
শুধু মনে মনে ক্ষণে ক্ষণে ওই শোনা যায়
বাজে অলখিত তারি চরণে
রুনুরুনু রুনুরুনু নূপুরধ্বনি…..।
এমন বরষার গান সুন্দর সন্ধ্যার পরিবেশ সৃষ্টিকারিকে স্পষ্ট প্রতক্ষ করতে পারছেনা।
অমল ভাবছে, দিদিতো..গান জানতো না..! ওতো বরাবর আঁকায় খুব ভালো ছিল। কিন্তু…গান……!
ভাবনার মধ্যেই কখন যেন গান থেমে গেছে খেয়ালই করেনি।
এমন সময় সম্বিৎ ফিরলো অবনিশ দাকে দেখে! কখন যে ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি। দেখলো সেই সুদর্শন সৌম্য কান্তি এক্বেবারে তার সামনে দন্ডায়মান। অবনিশদা বলে ডেকে উঠেই একগাল হাসি ছুঁড়ে বীরের মতো সহাস্য বদনে চমকে দিল অমল।
অবনিশ, মানে অমলের একমাত্র জামাইবাবু অমলকে দেখে অভিভুত। এবং না জানিয়ে আসার জন্য হাজার কৈফিয়ৎ তলবে জানতে পারলো হঠাৎ কোলতার অফিসে একটা কাজ পরেছে, তাই, এখানে কদিন থেকে কাজটা সেরে ফিরে যাবে।
অবনিশ খুব খুশি হলো শালাবাবুর এই না জানিয়ে আসায়।
এরপর দিদি জামাইবাবুর সাথে, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিয়ে যে যার ঘরে যাবার উদ্যোগ করতেই, হঠাৎ অমল জিজ্ঞেস করলো, আমি বাড়িতে ঢোকার সময়ে একজনের সুরেলা কন্ঠের গান শুনলাম, কই তাকে তো দেখতে পাচ্ছিনা!
অবনিশ বললো-ও আমার মামাতো বোন। দুমাস হলো এখানে এসেছে।
মামা মামীর একটিই মাত্র মেয়ে ওরা ভাগলপুরে ছিল- হঠাৎ ওনারা মহামারীতে দুমাসের মধ্যে চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। নিঃসহায় মেয়েটির আমি ছাড়া আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে। তাছাড়া-আর…কিছু বলতে গিয়ে দিদি জামাইবাবু দুজনেই যেন থেমে গেল। শুধু বললো আছোতো কদিন সবই জানতে পারবে।
অমল লজ্জিত হয়ে বলল, ও আচ্ছা, আমি তাহলে ওনার গানই শুনেছি!
ভোরের বেলায় অমলের ঘুমটা ভেঙে গেল একটা মিষ্টি গন্ধে। ও ঘরের বাইরের বারান্দায় এসে দেখলো,সাবেকী বাড়ির উঠোনের একপাশে একটি শিউলী ফুলের গাছ। তাতেই ফুলে ভরে আছে। তারই সুবাস ছড়িয়েছে চারিদিকে। অমল বহুদিন এমন ভোর দেখেনি। আবছা সরে যাচ্ছে ক্রমশঃ, পাখিরা কিচির মিচির করছে। নতুন সূর্যের আলো, বহু রকম গাছের ফাঁকফোকোর দিয়ে উঁকি ঝুঁকি করছে যেন অমলের সঙ্গে। উত্তরের ঠান্ডা হাওয়ায় ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশে উপভোগ করতে করতে হঠাৎ নীচের বারান্দায় নজর যেতেই দেখল, একটি অপরূপ যুবতী আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ওর চোখ দুটো যেন আবিষ্ট হয়ে আছে পূব আকাশের ওই শুকতারায়।
অমল ধীরে ধীরে কখন যেন নিজের অজান্তে মেয়েটির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মেয়েটির কোনো হেলদোল নেই।অমলকে যেন দেখতেই পায়নি! এমন একটা ভাব করে অস্ফূট স্বরে বললো, আপনিতো বৌদীর ভাই! গতকাল এসেছেন? অমল বললো, হ্যাঁ গতকাল সন্ধ্যায় এসেছি। এখানের একটা কাজে। এই দিদি জামাইবাবু ছাড়া আপন বলতে আর কেউ নেই। যখনই ফাঁক পাই, এখানেই চলে আসি। অমল খুব উৎসাহিত হয়ে বললো,
কাল কত রাত পর্যন্ত সবাই গল্প করলাম, আপনার সাথে পরিচয় হলো নাতো?
আপনি-তো জামাইবাবুর বোন! এর আগে কখনও দেখিনি! তবে আপনার গান শুনলাম। অপূর্ব গান করেন। একটানা কথাগুলো বলে, নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, “আমি অমল” আপনার নাম?
মেয়েটি বললো, আমার নাম আঁখি।
অমল মুগ্ধ হয়ে বললো, যথার্থ নাম। সত্যিই আপনার আঁখি দুটি অসাধারণ। বলেই লজ্জিত হয়ে ক্ষমা চাইলো। সরি এভাবে হয়তো আপনাকে বিব্রত করা উচিত হয়নি আমার। মেয়েটি হেসে বললো, হয়তো হবে! এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, আমার গান ভালো লাগার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই আপনাকে।
অমল কিছু বললো না। মেয়েটি বললো,আমি প্রতিদিন ভোরে এই বারান্দায় এসে দাঁড়াই। ভোর আমার খুব ভাললাগে। কেমন শান্ত, স্নিগ্ধ, একটা স্নেহের আকর্ষণ আমাকে মুগ্ধ করে। অমল বললো, হুম, আমিও বহুদিন পর আজ এতো সুন্দর ভোর দেখলাম।
মেয়েটি মিষ্টি হেসে বললো, আচ্ছা আমি এবার আসি বলেই, নিজের ঘরের দিকে ঘুরে চলে যাবার উদ্যোগ নিতে গিয়ে অমলের কাঁধে ধাক্কা লাগলো, এবং সঙ্গে সঙ্গে মাপ চেয়ে নিয়ে দু হাত দিয়ে আন্দাজে কিছু ধরার চেষ্টা করলো। তাই দেখে অমলের সন্দেহ হতে ওর হাতটা বাড়িয়ে দিতেই মেয়েটি চেপে ধরে বললো, আমি দৃষ্টিহীন। কিছু মনে করবেন না। আপনাকে বিব্রত করলাম হয়তো! অমল অবাক হয়ে আঁখির দিকে চেয়ে দেখলো, এতো সুন্দর আঁখি কখনই দৃষ্টিহীন হতে পারেনা।
এরপর অমল আঁখিকে ওর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিল। ভোরের আলোয় চারিদিকে উজ্জল হয়ে উঠলো। আঁখি অমলের হাতটা ছাড়তে চাইলে, অমল ছাড়লনা। কিছুক্ষণ বিহ্বল হয়ে আঁখির দিকে চেয়েছিল।
“এরপর”
সেদিনের সন্ধ্যায় আবার সবাই আঁখির গলায় গাওয়া গান শুনলো। অনেক রাতে দিদি জামাইবাবুর কাছে জানতে পারলো, আঁখি সঙ্গীতে মাস্টার ডিগ্ৰী করেছে।
আবার ভোরের অপেক্ষায় অমলের ঘুম এলোনা। সারারাত কি যেন একটা আকর্ষণে ওকে টানছে ভোরের দিকে।
আবার সেই ভোরে অমল দেখলো, একই ভাবে আঁখি চেয়ে আছে অনন্ত আকাশের দিকে। অমল ওর পাশে এসে দাঁড়ায়। আঁখি মৃদু হেসে বলে, আকাশের রঙটা কি নীল? পাখিরা কি ওই আকাশে ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে বহু দূরে? অমল আঁখির হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললো, “একদম তাই”
আপনার অন্তর দৃষ্টি ঠিকই দেখছে। আঁখি লজ্জায় হাতটা ছাড়তে চাইলো।
অমল বললো উঁহু- এই হাতটা আমি যদি চিরদিন ধরে থাকি আমার কি কোনো অপরাধ হবে? আঁখি অবাক হয়ে বললো, করুনা দেখাচ্ছেন? প্লিজ এভাবে আমাকে ছোট করবেন না।
আমি করুনা চাইনা কারোর। অমল আঁখির হাতটা একটু জোরে চাপ দিয়ে বললো, করুনা নয়, প্রেম!!
কানের কাছে ফিসফিস করে বললো আমি তোমাকে প্রথম দেখাতেই ভালবেসেছি। তুমি নিজের বুকে হাত দিয়ে দেখ, ওখানে আমার অধিষ্ঠান হয়ে গেছে। আঁখি দুরুদুরু বক্ষ উথালি পাথালি করে উঠলো। এক ভাললাগার অনুভূতিতে।
অন্তর দৃষ্টিতে দেখতে পেল, উত্তরের বাতাসের সাথে এক ঝলক প্রভাতী আলো বিচ্চুরিত হচ্ছে।