উত্তরসাধক (Uttarsadhak) : 09
লুকুর যখন সম্পূর্ণ চেতনা ফিরে এলো, তার মনে হল একটা অদ্ভুত অর্থহীন স্বপ্ন দেখেছে সে। চোখ বড় বড় করে ঘরটা দেখতে থাকল লুকু। এখন যেটা দেখছে সেটাও স্বপ্নের অঙ্গ নয় তো? সীলিংএর ফ্যানটা এখন বন্ধ তার ওপর একটা চড়ুইপাখি বসে। কিরকম একটা হলদেটে রঙ ঘরের ভেতরে, পর্দাগুলো কমলা রঙের বলে আলোটাও কিরকম অদ্ভূত হয়ে যায় এ সময়ে। অর্থাৎ এখন বিকেল, সূর্য এদিকে, পশ্চিমের দিকে চলে এসেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে টেবিলের ওপর টাইম-পীসটা দেখবার চেষ্টা করল, পারল না। শরীরটা কি রকম ভারি হয়ে আছে। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকল, ‘ঝড়ু’, দু তিনবার ডাকের পর ঝড়ু এলো। মা মারা যাবার পর বাবা তাদের দারুণ ভালো রাঁধুনি মহেশদাকে রাখতে চাইলেন না। একটি বয়স্ক মহিলা দু বেলা রান্না করে দিয়ে যান। বাকি কাজ ঝড়ুই করে।
‘কটা বাজে রে?’
বেশ কিছুক্ষণ ঘড়িটা নিরীক্ষণ করে ঝড়ু উত্তর দিল—‘বড় কাঁটা পাঁচের ঘরে, ছোট কাঁটা চারের ঘরে’
‘এখনও তুই বড় কাঁটা ছোট কাঁটা করবি? শিখবি না?
ঝড়ু সন্ত্রস্তভাবে হাসল।
‘হ্যাঁ কেউ এসেছিল?’
‘তোমার বন্ধু দাদাবাবুর পর আর কেউ আসেনি।’
লুকুর ঝপ করে স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। ওটা তাহলে স্বপ্ন নয়! শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। লুকু বলল—‘এক গ্লাস গরম দুধ নিয়ে আয় তো, চকলেট দিতে ভুলবি না।’
ঝড়ু অন্তর্হিত হলো। দেব তাহলে কেওড়াখালি যায়নি? কেন? দেব কি জানত লুকু যাচ্ছে না! জানাই সম্ভব। দেব কেন এসেছিল? লিকর খাওয়ালো খানিকটা, কি যত্ন করে, লুকুর গলা-ব্যথা অনেক কমে গেছে, এভাবে খাওয়ানো মায়ের পরে, মা-ও নয় ঠিক, দিদার পরে আর কেউ কখনও করেনি। বাবা-মা পার্টিতে বেরিয়ে গেলে, লুকু মুখ গোঁজ করে থাকত, দিদা তখন গল্প বলতে বলতে একটু একটু করে তাকে খাইয়ে দিতেন। দিদার ঘরে ঠাকুর ছিল, ভীষণ শুচিবাই ছিল দিদার। তা-ও। লুকুর মাছ-ভাতের থালা নিয়ে সে দিদার কাছে চলে যেত। দিদাই তার নাম রেখেছিলেন লক্ষ্মীশ্রী। সেকেলে নাম বলে, সবার কত আপত্তি। শেষকালে ডাকতে ডাকতে লুকু হয়ে গেল। লুকুর গলার কাছে এখন একটা পিণ্ড আটকে যাচ্ছে। দিদা, মা। দিদার ডাক ‘লক্ষ্মীশ্রী’ই’। পুরোটা উচ্চারণ করে ডাক দিতেন দিদা! ‘লুকু!’ ছোট্ট করে ডাকত মা! কেউ আর সেভাবে ডাকবে না। শুধু লিকর কেন? ঝড়ু কি জানে না বেশি দুধ দিয়ে চা খেতে লুকু ভালোবাসে! বেশ ক্ষীরের মতো চা, তাতে একটু তেজপাতা, দারচিনি দিলে আরও ভালো। লুকু বমি করে ফেলেছিল। মুখে-চোখে জল দিয়ে দিল দেব। একটুও ঘেন্না করল না তো! অবশ্য দেব ডাক্তার। দেব তাকে ধরে ধরে এনে এখানে শুইয়ে দিয়েছে। কি যেন একটা চাইছিল! লুকুর হঠাৎ সবটা একসঙ্গে মনে পড়ে গেল। দেব তার সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে গেল, গার্বেজ বিনটা হাঁটকে। স্ট্রেঞ্জ! যাবার সময় বলে গেল লুকু স্মোক করো না, কেউ দিলেও নেবে না, অ্যাজ এ ডকটর অ্যাজ এ ফ্রেন্ড বলছি। যতই ভাবে দেবের হাবভাব, কার্যকলাপ খুব আশ্চর্য লাগে লুকুর। দেব ছেলেটাই আশ্চর্য। মৈথিলী বলে দেবের শ্রেষ্ঠত্ব মেডিক্যাল কলেজের প্রতিটি ক্লাসে, ডিসেকশন রুমে, বারবার প্রমাণ হয়ে যায়। সঠিক উত্তরগুলো ওর মুখ থেকে এমন গড় গড় করে বেরিয়ে আসে যেন মন্ত্র, ভেতরে কোথাও রেকর্ড করা আছে। ওর ডিসেকশনও দেখবার মতো। সরু সরু আঙুলগুলো চলে নিখুঁত সাবলীলভাবে, ও যেন শল্য চিকিৎসক হবার জন্যই জন্মেছে। ডক্টর বাগচি একদিন বলছিলেন ‘তোমরা নিশ্চয়ই অন্তত তিন পুরুষ ডাক্তার।’ নয় শুনে আশ্চর্য হয়েছিলেন ডাঃ বাগচি। ওরা বন্ধুরা বলাবলি করে দেবের বংশে কোথাও সার্জনের জিনটা রিসেসিভ থেকে যাচ্ছিল অনেক দিন থেকে, দেবের মধ্যে প্রকাশিত হল। দেব ছাত্রসংঘের একটা স্তম্ভ। উজান, মৈথিলীও করে। কিন্তু লুকুর কি রকম একটা মনে হয়। আড়াল থেকে দেব সবার ওপরে ছাতটা ধরে আছে। কেন এরকম মনে হয় সে অবশ্য জানে না। ওকে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে হয় তার, তার মায়ের কথা, নিজের আশা-আকাঙক্ষার কথা। ছাত্রসঙ্ঘে যোগ সে দিয়েছে ঠিকই। মৈথিলীর কথায় আর মেধা ভাটনগরের জন্য। যতটা অ্যাডভেঞ্চারের নেশায়, ততটা সমাজসেবার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নয়। মেধাদি বলেন ইতিহাসের সাক্ষ্য বলছে মেয়েরা বারবার যুদ্ধবিগ্রহ, ও রাজনৈতিক জটিলতার উপলক্ষ্য এবং শিকার হয়েছে, যেমন দেবলাদেবী ও কমলা, যেমন পদ্মিনী ও নূরজাহান। রণ ও রাজনীতিতে তারা প্রায় কখনও সফল হয়নি যেমন রাজিয়া, দুর্গাবতী, লক্ষ্মীবাই এবং ক্ষমতা হাতে পেলে তারা প্রায়শই ক্রূর নিষ্ঠুর স্বার্থপর হয়ে দেখা দিয়েছে যেমন ব্লাডি মেরি, ক্যাথরিন দা গ্রেট, মারি আঁতোয়ানেৎ। হয় তারা পুরুষদের ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে যাচ্ছে, নয় তো অত্যাচারী পুরুষ শাসকের আদলে নিজেদের গড়ে নিচ্ছে। ষোড়শ শতাব্দীর রাণী এলিজাবেথও কিছু কম স্বার্থপর, কম অত্যাচারী ছিলেন না। এখন মেয়েদের একাংশের ওপর থেকে সমাজের চাপ, পুরুষের চাপ ধীরে ধীরে উঠে যাচ্ছে। গঠনশীল, সৃষ্টিশীল কাজ করে মেয়েরা ইতিহাসের এই কঠোর সাক্ষ্য পাল্টে দিক। মেয়েরা আগে মানুষ পরে মেয়ে এটা যেন সর্বদা মনে রাখে।
একথাগুলো মেধাদি সাধারণ ক্লাসে বলেননি। বলেছিলেন তাদের তিনজন মেয়েকে একত্রে। সে গুঞ্জন আর মউমিতা। খুব লজ্জাকর একটা ঘটনা ছিল উপলক্ষ্য। ঘটনাটা লুকুকে নিয়ে। ক্লাসের একটি ছেলে সারা বছর ধরে লুকুকে বিরক্ত করছিল। এ ধরনের উপদ্রব ছোট থেকেই লুকুর অভ্যেস আছে। ওরা অর্পণকে নিয়ে একটু মজাই করত। অর্পণ একদিন একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলল। লুকুকে তো একটা সাংঘাতিক প্রেমপত্র লিখলই, লুকুর বাবাকেও লিখে জানাল সে লুকুকে বিয়ে করতে চায়।
বাপী ভীষণ গম্ভীর মানুষ, লুকুরা দু ভাই বোন বাপীকে বরাবর খুব সমীহ করে এসেছে। যদিও বাপীর আদরও ছিল অতিরিক্ত এবং মা মারা যাবার পর বাপী ক্রমশই নরম হয়ে যাচ্ছিল। রাতে বাপী ঘরে ডেকে বলল—‘কে এ ছেলেটা? অর্পণ দেব না কি নাম? এমন কায়দা করে নাম সই করেছে যে নামটাও ভালো করে উদ্ধার করতে পারছি না। কি সব উল্টোপাল্টা লিখেছে রে? একটা সেকেন্ড ইয়ার হিসট্রি অনার্সের ছেলেকে তুই বিয়ে করবি? তুই, তোরা এতো ইমম্যাচিওর! লুকু, শেষ পর্যন্ত তুই…তোর মার কতো আশা ছিল!’
‘ব্যাস ব্যাস!’ লুকুর চোখ জ্বলছে, সে প্রায় বাঘিনীর মতো বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল; আঁচড়ে কামড়ে একসা করে দিচ্ছে।’
‘কি করছিস! কি করছিস?’
‘তুমি আগে কেন জিজ্ঞেস করলে না, আমি ওকে বিয়ে করতে চাই কি না। সব কিছু ধরে নাও কেন?’
লুকুর মা মারা যাবার পর লুকু এইরকম হিস্টিরিক হয়ে যায় মাঝে মাঝে। তার বাপী ভয় পান, বললেন, ‘ঠিক আছে। আমি ভুল করেছি। ভুল ভেবেছি। কিন্তু তা বলে তুই এভাবে রি-অ্যাক্ট করবি কেন? আমাকে বললেই তো হয়…।’
কাঁদতে কাঁদতে লুকুর সেই এক কথা—‘তুমি সব কিছু ধরে নিলে কেন?’
পরের দিন লুকু কলেজ গেল না। তারপর দিন ক্লাসে ঢোকবার মুখে অর্পণ এক গোছা রক্তগোলাপ নিয়ে তার জন্যে অপেক্ষা করছে দেখা গেল। লুকু ঢুকে যাচ্ছিল, মাথা উঁচু করে কোনদিকে না তাকিয়ে, অর্পণ গোলাপের গুচ্ছ তার দিকে বাড়িয়ে ধরল, সঙ্গে সঙ্গে ডান হাতের উল্টো পিঠের ঝটকায় লুকু সেটা ফেলে দিয়েছে। অর্পণের মুখ ফ্যাকাশে। সে আস্তে আস্তে ওখান থেকে চলে গেল। সহপাঠীদের অনেকেই হাসছিল। লুকুর রাগ দেখে কেউ কেউ তাকে শান্ত করবার জন্যও এগিয়ে আসে। অর্পণ এর কিছুদিন পর আত্মহত্যার চেষ্টা করে, হাসপাতালে সময় মতো নিয়ে যাওয়া গিয়েছিল বলে অনেক চেষ্টা চরিত্র করে তাকে বাঁচানো যায়। এখন তাকে কলেজ ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। সহপাঠীরা বলে অর্পণকে ওর দিদির কাছে দিল্লিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার মানসিক অবস্থা ভালো নয়।
এই ঘটনায় গোটা ইউনিভার্সিটি তোলপাড়। করিডরে করিডরে, কমনরুমে, স্টাফরুমে ওই এক আলোচনা। এম ভি সেই সময়ে একদিন ওদের তিনজনকে ডেকে পাঠান।
মউমিতা স্বীকার করে ছেলেটিকে নিয়ে ওরা মজা করত; স্রেফ মজা দেখবার জন্যে ওরা ব্যাপারটা বাড়তে দিয়েছিল। অর্পণ এতো বোকা যে সে ওদের ইয়ার্কিগুলো সত্যি বলে ধরে নিত।
গুঞ্জন খুব তেরিয়া ধরনের মেয়ে, সে বরাবরই লুকুকে খানিকটা আড়াল দিয়ে চলে। সে বলে—‘আমি হলে অনেক দিন আগেই ওকে বেশ করে কষে একটি চড় মারতাম। লুকুর কোনও দোষ নেই।’
মিস ভাটনগর বললেন, ‘এটা তুমি কি বললে গুঞ্জন? ছেলেটির জীবনটা নষ্ট হতে চলেছে, তোমাদের কোনও অনুতাপ নেই?’
‘হোয়াট কুড উই ডু? বলুন মিস তাহলে ও যখন লুকুর জন্য পাগল, লুকুর ওকে পছন্দ না হলেও, ওকে বিয়ে করতে হবে?’
‘তা একেবারেই নয়। কিন্তু ফুলটা ওইভাবে ফেলে দেওয়া ওর উচিত হয়নি। ফুলটা একটা সিম্বল, ভালোবাসার, আত্মার। সে আত্মা যারই হোক, যেমনই হোক, ওভাবে তাকে অপমানিত করা উচিত হয়নি। এটার দায়িত্ব তোমাদের সবার। লুকুর একার নয়। নেভার ট্রাইফ্ল্ উইথ এনিবডিজ লাভ। গোড়ার থেকেই খুব সাফ কথায় জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল তুমি এ মনোভাব পছন্দ করছ না। বরং ওকে সহজ হতে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল তোমাদের।’
মেধাদির কথা শুনে লুকু কাঁদতে আরম্ভ করে। একেবারে সান্ত্বনাহীন কান্না। অর্পণের অবস্থার জন্য সে তো তখন মরমে মরে যাচ্ছিল। গুঞ্জন বললে—‘ও কে লুকু, নাউ সে সরি।’
মেধাদি বললেন—‘না, গুঞ্জন না। সরি বললেই সব কিছু ঠিক হয়ে যায় না। লুকু তুমি যদি সাবধান না হও, সীরিয়াস না হও, এরকম ঘটনা আবার ঘটবে। কে বলতে পারে তোমার নিজেরও ক্ষতি হতে পারে।’
গুঞ্জন, মউমিতা চলে গেল, উনি বললেন—‘তোমরা যাও, আমি ওকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করছি।’
লুকু কাঁদছিল তখনও। উনি তার মুখটাকে নিজের কোলে তুলে নিলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মেধা ভাটনগরের কোলে একটা মৃদু সুন্দুর সুগন্ধ। একটু পরে বললেন, ‘লুকু একটু কফি খাও।’ লুকু দু হাত দিয়ে মেধাদির কোল চেপে ধরেছে, কিছুতেই উঠতে দেবে না। কান্নাবিকৃত স্বরে বলছে ‘অর্পণের কি হবে মিস।’ দিদি বললেন—‘এত সেন্টিমেন্টাল বোকা ছেলেদের কিছু হওয়া খুব শক্ত। ওকে আরও অনেক শক্ত হতে হবে। এতো ভালনারেবল হলে কি চলে? এই ধাক্কাটায় ওর চোখ খুলে যেতে পারে। ও আরও অনেক শক্তধাতের হয়ে যেতেও পারে, বলা তো যায় না। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা জীবনটাকে আরও গভীরভাবে ভালোবাসতে শেখাতে পারে ওকে। সেটাই আমরা আশা করতে থাকি। দেখি আমি খোঁজ নেবো। তবে তুমি যেন শুদ্ধু এই অন্যায়টা করেছ বলে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ো না।’
সেদিন রাতে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ালেন উনি লুকুকে। উনি মাছ মাংস খান না। ছানার একটা তরকারি, চিলি চিকেনের মতো খেতে, রুটি, আর ফ্রুট স্যালাড। স্কুটারের পেছনে চাপিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। গুঞ্জনরা বাপীকে খবর দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বাপী পায়চারি করছিল। দরজা খুলে হেলমেট পরা দিদিকে আর লুকুকে দেখে অবাক। ভীষণ বিচলিত।
‘আপনি এভাবে এতো রাতে, আমাকে একটা খবর দিলেই আমি নিয়ে আসতাম।’
সেসব কথার কোনও জবাব না দিয়ে মিস বললেন—‘এখন থেকে লুকুকে মাঝে মাঝে আমার বাড়ি রেখে দেবো মিঃ মজুমদার।
বাপী যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে—‘প্লীজ ডু প্রোফেসর ভাটনগর, শী ইজ আ মাদারলেস চাইল্ড। ওর ভাই ওর থেকে অনেক শক্ত। মেয়েটার আমার কি যে হবে!’
‘কী যে হবে বলে ছেড়ে দিলে চলবে? একটু বেশি সময় তো ওদের দিতেই হবে আপনার। দ্বিতীয় কেউ নেই যখন। আমি তো পুরা দায়িত্ব নিতে পারবো না।’
‘না না সে কি!’ বাপী খুব লজ্জা পেয়ে গেল। সব কিছু অবশ্য লুকুর শোনার কথা না। বাড়ি পৌঁছেই সে ভেতরে চলে গিয়েছিল। ভাইয়া খেয়েছে কি না, বাপীকে ঝড়ু কি দিয়েছে খোঁজ করতে। কিছুটা লুকু লুকিয়ে লুকিয়ে শুনেছে। সেই থেকে মেধা ভাটনগরকে দেখলেই ও পালায়। মুখ নিচু করে ফেলে। যেন তার গোপন সত্তার একটা চেহারা উনি ঢাকনা সরিয়ে দেখে ফেলেছেন, দেখে ফেলেছেন কোথায় সে নগ্ন। লজ্জা করে। অথচ রাতে শুয়ে শুয়ে মেধা ভাটনগরকেই স্বপ্ন দেখে লুকু। মেধাদির কোমর ধরে সে স্কুটারে করে অনেক দূর চলেছে। মেধাদির কোলে তার মুখ, তিনি ওকে আদর করছেন। মেধাদির মতোই সে হতে চায়। আসলে প্রথম থেকেই সে মেধা ভাটনগরের ভীষণ ভক্ত। গুঞ্জনকে একদিন বলেছিল, ‘আই অ্যাম ক্রেজি অ্যাবাউট হার। এম ভি ক্লাসে এলেই আমার গা শিরশির করে। মনে হয় ঝাঁপিয়ে পড়ে আঁচড়ে কামড়ে দিই। ওই ডিম্পলটা! ডিম্পলটা যে কী পাগল করে দ্যায় আমাকে ধারণা করতে পারবি না।’
গুঞ্জন বললে—‘তোর মধ্যে লেসবিয়ান টেনডেনসি দেখা দিচ্ছে লুকু সাবধান হ। ইটস নট হোলসাম।’
লুকু মনে মনে জিভ কামড়ায়। কেন কথাটা গুঞ্জনকে বলতে গেল! এই হোস্টেলাইটগুলো জীবনযাপনের অনন্ত স্বাধীনতা পায়। যা খুশি করে, যা খুশি ভাবে।
প্রথমবার কেওড়াখালি যেতে পারল না সে। মেধাদিও যাননি। দেবও দেখা যাচ্ছে যায়নি। দ্বিতীয়বার যাবে। যাবেই। অশত্থ গাছের ছায়ায় বয়স্ক মহিলাদের অক্ষরপরিচয় করাচ্ছে লুকু। সই করতে শেখাচ্ছে। ফার্স্ট এডের ট্রেনিং দিচ্ছে মৈথিলীর সঙ্গে। দেবের সঙ্গে। তার হাতে ট্রায়াংগুলার ব্যান্ডেছ। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছেন মেধা ভাটনগর। চোখে তারিফের দৃষ্টি। উনি কি করছেন? কি করবেন? কিছু না করে শুধু তদারকি করবার পাত্র তো উনি নন! সেবার ডিপার্টমেন্টাল পিকনিকে সব্বাইকে পরিবেশন করে খাওয়ালেন অত্তখানি লম্বা মানুষটা নুয়ে নুয়ে। লুকুর হঠাৎ মনে হল সে একটা ছবি দেখছে। সিনেমার মতো। মেধাদি গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে একটা চত্বরে দাঁড়িয়ে আছেন। যদিও এরকম কোনও চত্বর সত্যি-সত্যি আছে কি না সে জানে না। সেই সাদা রঙের কমলাবুটির সরু পাড় টাঙাইলটা পরেছেন। ব্লাউজের হাত কনুই পর্যন্ত। সাদা একটা হাত উঁচু দিকে উঠে আছে। সোজা লম্বা। কোথা থেকে অনেক গাছের পাতা মাথার ওপর ঝরে ঝরে পড়ছে। দেবপ্রিয় অনেক সাদা ফুল নিয়ে এসে পায়ে অঞ্জলি দিল। কে যেন কোথায় বলে উঠল—‘মেধা ভাটনগর’, অমনি চারদিকে রব উঠল ‘অমর রহে।’ কান-ফাটানো চিৎকার। কিন্তু খোলা জায়গায় বলে সে ভাবে কান ফাটায় না। লুকুর বড্ড গলা ব্যথা করছে এখন। কানটা যেন তালা লেগে গেছে।
ঝড়ু সদর দরজা খুলছে। বাপী ঢুকছে, ভাইকে নিয়ে।
‘লুকু, কেমন আছো মা!’
‘ভালো না বাপী’, লুকু কোনমতে বলল।
‘বিকেলবেলার ডোজগুলো খেয়েছ?’
‘এখনও খাইনি।’
‘আচ্ছা আমি দিচ্ছি। আগে কিছু খাও। ঝড়ু…’ বাপী ডাকতে ডাকতে ওদিকে চলে গেল।
ভাইয়া কাছে এসে বলল—‘দিদি আজ বাবা কাউবয় থেকে মাটন চপ এনেছে। গরম একেবারে। তুই খেতে পারবি?
বাপী ঘরে ঢুকছিল, বলল—‘ঠিক পারবে, ‘কাউবয়ে’র মাটন চপ একেবারে মাখনের মতো। আজকে থার্ড ডে ওষুধ পড়ে গেছে। দেখি লুকু গলাটা।’
লুকু অনুভব করল তার গলার ব্যথা ব্যথা ভাবটা অনেক কমে গেছে। আসলে এতক্ষণ যে ব্যথাটা করছিল সেটা গ্ল্যান্ডের ব্যথাই নয়। গলার কাছে ভাবাবেগের পিণ্ড আটকে থাকার ব্যথা। হয়ত সে চেষ্টা করবে খেতে পারবে না, কিন্তু বাপী যে তাকে মনে করে মাখনের মতো নরম মাটন চপ নিয়ে এসেছে এতেই তার মুখের মধ্যেটা স্বাদে ভরে যাচ্ছে।