Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » উত্তরসাধক || Bani Basu » Page 21

উত্তরসাধক || Bani Basu

আজ রাত্তিরে মেধার চোখে ঘুম আসছে না। সারা সন্ধে বৃষ্টি হয়েছে। জল জমে গেছে রাস্তায় রাস্তায়। মরশুম শেষ হয়ে আসছে তবু এরকম ভারি বৃষ্টি। এলোমেলো ছাট দিচ্ছিল অনেকক্ষণ। জানলা বন্ধ করে রাখতে হয়েছিল। এখন অনেক রাত, বৃষ্টি থেমেছে। ভেজা-ভেজা দমকা হাওয়া দিচ্ছে থেকে থেকে। শিয়রের জানলাটা খুলে দিয়েছেন এবার। কালচে নীল আকাশ, চোখ চেয়ে কটাক্ষে আকাশ দেখতে না পেলে তাঁর ঘুম আসে না। চাঁদ উঠেছে মেঘের আড়ালে। চাঁদের ওপর দিয়ে বড় বড় মেঘের চাঙড় ভেসে যাচ্ছে। অন্ধকার, আবার আলো, আবার অন্ধকার। মেধা উঠে ছাতের দরজা খুললেন। ছাতে উঠে গেলেন। এ বাড়ির এই একটা ত্রুটি। বারান্দা নেই। ছাতটাকেই বারান্দার মতো শৌখিন করে তৈরি করেছিলেন বাবা। খোলামেলায় যাবার ইচ্ছে হলে ছাতে উঠে আসতে হয়। মেধা পায়চারি করছেন। অশান্ত পদক্ষেপ। আজ কদিন ধরেই তাঁর খুব অস্থির লাগছে। গুঞ্জন চলে যাচ্ছে। গুঞ্জন চলে যাচ্ছে। শুধু চলে গেলে এতো চিন্তা ছিল না। কত আসবে। কত যাবে। সে হিসেবে তো সেরকম কিছু বিয়োগ হয়ইনি। কিন্তু গুঞ্জন বুকে কষ্ট নিয়ে যাচ্ছে।

গুঞ্জনকে ওরা ফেয়ারওয়েল দিল। গুঞ্জন তাঁর কাছে থাকতে চাইল। আগে বাড়িতে লুকুকে, মৈথিলীকে কত রেখেছেন তিনি। ওরা দু বন্ধু তো যখন তখন আসত, এসে আর যেতে চাইত না। দুজনেই মাতৃহীন। মেধা সন্তান গর্ভে ধরেননি। মাতৃস্নেহ কি জিনিস জানা নেই। কিন্তু দুটি মাতৃহীন মেয়েকে তাদের প্রয়োজনের সময়ে আশ্রয় দিতে পেরেছিলেন। আবেগকে তিনি প্রকাশ্য জীবনে যথাসাধ্য পরিহার করে চলতে চেষ্টা করেন। আবেগ তাঁর নির্জন সময়ের একলার উপভোগের বস্তু। আবেগ সৃজনী-প্রতিভার সহচর ও স্নায়ুতন্ত্র এবং এণ্ডোক্রিন গ্রন্থি মন্থন করা অমৃত এবং গরল, ঊর্বশী এবং লক্ষ্মী, ঐরাবত, উচ্চৈঃশ্রবা এবং কৌস্তুভ। তাকে প্রয়োজনমতো বক্ষে ধারণ করো তাকে তোমার বাহন বানাও, তীব্র বৃংহণে, গম্ভীর পদক্ষেপে, কিম্বা উচ্চ হ্রেষায় শূন্য প্রকম্পিত করে সে তোমায় লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। সে উত্তেজক আবার শান্তশ্রীমণ্ডিত সৌন্দর্যসার। সে আবার ধন্বন্তরিও। কতবার সে নিভৃতে নিরাময় রূপে এসেছে। মেধা এই আবেগের নীলকৃষ্ণ গরলটুকু তাঁর কণ্ঠে ধারণ করে থাকেন। হৃদয়ে পৌঁছতে দেন না। মস্তিষ্কে উঠতে দেন না।

গুঞ্জন বলল—‘মিস, আজ আমি আপনার কাছে থাকি।’

—‘থাক। হোস্টেলে ফোন করে দে। না হলে অনর্থক কথা শুনবি।’

অনেক চেষ্টা করেও ফোন পাওয়া গেল না। উজান বলল—‘আমি খবর দিয়ে যাবো এখন।’

ঘরের ভেতর সেদিন খুব গুমোট। মেধা বললেন—‘গুঞ্জন আমি ছাতে যাচ্ছি। তুই আসবি?’

তিনি বুঝতে পারছিলেন গুঞ্জনের কিছু বলার আছে। গুঞ্জনকে নিজের একটা শাদা বিদেশী নাইট-ড্রেস পরতে দিয়েছেন। লেসে ভর্তি পোশাকটা। গুঞ্জন প্রায় মেধার কাছাকাছি লম্বা। ওর কুচকুচে কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত থাকে থাকে কাটা। খুব জৌলুস-অলা চেহারা। অনেকের মধ্যে চোখে পড়ার মতো। মাধুর্য একটু কম। কিন্তু খুব জমকালো।

মেধা বললেন—‘তোর রুটিগুলো দারুণ সুন্দর হয়েছিল।’

—‘পাঞ্জাবি রুটি। আমার দাদিমার কাছ থেকে শিখেছি।’

—‘এক পিঠ সেঁকিস, না?’

—‘হ্যাঁ খুব পাতলা তো! গুজরাটি রুটি খেয়েছেন? আরও পাতলা, ভীষণ ভালো খেতে। ওরা সেগুলো তাওয়ার ওপর সেঁকে সেঁকে একেবারে ক্রিস্‌প্‌ করে নিয়ে কৌটোর মধ্যে রেখে দেয়। মাখন বা জ্যাম লাগিয়ে খায়। খাকরা বলে।’

মেধা হেসে বললেন—‘ভারতবর্ষে বোধহয় যতরকম জাতি ততরকম রুটি। রুটির আমি রুটির তুমি তাই দিয়ে যায় চেনা। কি রিচ দেশটা, ভাবলে অবাক লাগে।’

—‘ভারতবর্ষকে আপনি খুব ভালোবাসেন, না মিস?’

—‘বোধহয়।’ গুঞ্জন স্কুলগার্লের মতো মিস বলাটা কোনদিন ছাড়ল না। ওর এই স্বাতন্ত্রটাও মেধার ভালো লাগে।

ও বলল—‘দেশের মাটিটাকে, না দেশের আইডিয়াটাকে, না মানুষগুলোকে?’

—মেধা বললেন—‘দ্যাখ গুঞ্জন, আমার বাবার শেষ উপলব্ধি ছিল দেশের মাটিটাই আসল দেশ। মানুষগুলো চেঞ্জিং, চেঞ্জফুল্‌, মাটিটা কনস্ট্যান্ট। এর মধ্যে যুক্তির অংশটা আমি মেনে নিতে পারি না। কিন্তু অনুভূতির দিক থেকে এই ভূখণ্ডের ওপর বোধহয় ভালোবাসা আমার বেশি।’

—‘মিস, তাহলে আপনি পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের সঙ্গে মিলে দূষণমুক্ত করতে চাইতেন জল, বাতাস। বন কাটা বন্ধ করতে চাইতেন। তাতো করেন না! আপনি তো মানুষ নিয়েই কাজ করেন। মানুষ নিয়ে কাজ করেন অথচ তাদের ভালোবাসেন না তা-ও কি হয়?’

গুঞ্জন আজ তাঁকে এরকম ছিন্নভিন্ন করার মেজাজে কেন আছে মেধা বুঝতে পারছিলেন না। বললেন,—‘বাসি। নিশ্চয়ই বাসি। কিন্তু তারা এই ভূমির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ আমার কাছে। আমিও এক রকমের এনভায়রনমেন্টালিস্ট। জল, বাতাস, বন শুদ্ধ করবার মন নিয়েই আমি ভারতের মানুষ, ভারতের সমাজকে গড়বার চেষ্টা করি বোধহয়।

—‘তার মানে মিস খুঁটিয়ে দেখতে গেলে আপনি আইডিয়াটাকেই ভালোবাসেন।’

—‘তোর তাই মনে হয়?’

—‘তবে কি বলুন! এইসব গ্রামের মানুষ যাদের জন্য এত করেন, তাদের আপনি ব্যক্তি হিসেবে দেখেন?

—‘ব্যক্তি হিসেবে দেখি, কিন্তু ইমোশন্যাল ইনভল্‌ভ্‌মেন্ট চাই না। তবে গুঞ্জন, তোদের কথা আলাদা। তোরা কিন্তু আমার কাছে ব্যক্তি। প্রত্যেকে আলাদা। তোদের সুখদুঃখের কথা আমাকে ভাবায়।’

—‘তবে কেন উজান বলল গুঞ্জন চলে গেলে আরেকজন তার স্থান নেবে! কোনও অসুবিধে নেই।’

—‘গুঞ্জনের কাজটা আরেকজন করবে। কাজের দিক থেকে কোনও ফাঁক পড়বে না। উজান নিজেও চিরকাল থাকবে এ আমি আশা করি না। কাজের চেইনে যদি ফাঁক থাকে তাহলে তোদের সঙ্ঘ চলবে কি করে? তার মানে এই নয় যে তুই গুঞ্জন মানুষটা আমাদের মধ্যে কোনও ভ্যাকুয়াম রেখে যাবি না!’

—‘যাবো? আমার এমন কি গুণ আছে, এমনকি শক্তি আছে মিস, যাতে আপনাদের মনে শূন্যতা রেখে যেতে পারি! মিস, আমার কাজটুকু ছাত্রসংঘ নেয়। আমাকে নেয় না।’

মেধা অনেকক্ষণ কিছু বললেন না। গুঞ্জন এতো অভিমানী তাঁর জানা ছিল না। দুজনে দুটো বেতের মোড়ায় বসলেন। খানিকটা পর তিনি বললেন—‘গুঞ্জন এ অভিমান কি তোর সাধারণভাবে ছাত্রসঙ্ঘের প্রতি, না আমার প্রতি, না অন্য কোনও বিশেষ ব্যক্তি আছে এর মধ্যে?’

চাঁদের আলোয় মেধা দেখলেন গুঞ্জনের চোখ ভারি হয়ে এসেছে। টুপ করে একফোঁটা নামল তার সাদা গালে, আরেক ফোঁটা, আরেক ফোঁটা। ফোঁটাগুলো পরস্পরকে অনুসরণ করতে করতে চিবুকের খাঁজে এসে মিলিত হচ্ছে, তারপর শূন্যে ঝাঁপ দিচ্ছে।

মেধা বললেন— ‘আমার কথা যদি বলিস, আমি তোদের মধ্যে যার যার সঙ্গে খানিকটা মিশেছি প্রত্যেককে গভীরভাবে ভালোবেসেছি, যেন তোরা আমার চোখ, কান, হাত, পা। তোদের কল্যাণ, তোদের সম্পূর্ণতা আমার ততটাই কাম্য যতটা এই বিশাল দেশের। তোরা ঠিক পথে চললে, তোরা কষ্ট পেলে আমি এতো কষ্ট পাই যা আমার কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু নিজের মত যাতে তোদের ওপর চাপিয়ে না দিই, যাতে তোদের চয়েস তোদেরই থাকে, সে বিষয়ে আমি সতর্ক থাকি। আমার কোনও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দেওয়া হলে সেটা তো আমায় মেনে নিতেই হবে। মানিয়ে নিতেই হবে। তোদের চলে যাওয়াটাও সেইরকম। ভেবেছিলাম তোদের ভেতরে ঢুকব না, বাইরে দাঁড়িয়ে থাকব। ইমোশন্যাল ইনভলভ্‌মেন্ট আমাকে কি ভীষণ কষ্ট দেয় তার একাধিক অভিজ্ঞতা আমার আছে। সে রকম হলে আমি পঙ্গু হয়ে যাবো; কাজ করতে পারব না। কিন্তু, তোদের ব্যাপারে আমি এই নীতি বজায় রাখতে পারছি না গুঞ্জন। প্রমিতটা ছাত্রসঙ্ঘের এই সৌহার্দ্য, সৎ-সংকল্পের আবহাওয়াতে থেকেও নষ্ট হয়ে গেল, এ যেন শূলবেদনার মতো আমাকে বিঁধছে।’

গুঞ্জন হঠাৎ মেধার কোলের ওপর মুখ নামিয়ে দিল, তারপর ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল। ‘মিস আপনি প্রমিতকে বাঁচান। প্রমিত নষ্ট হয়ে যায়নি। আপনি লুকুকে একটু বুঝিয়ে বলুন। লুকু যদি প্রমিতকে অ্যাকসেপট করে ওর জীবনটাই অন্য রকম হয়ে যাবে। মিস, প্লিজ ওকে বাঁচান। দেবের সম্পর্কে লুকুর ব্যাপারটা আসলে হিরো ওয়ারশিপ। দেব আপনার মতো নির্বিকার, মহান, বড় বড় কাজ করার জন্যই ওর জন্ম। ওর লুকুকে না হলেও চলবে, প্রমিতের চলবে না…’

চোখের জলে মাখামাখি গুঞ্জনের মুখটা অনেক কষ্টে তুলে ধরলেন মেধা। ভারি গলায় বললেন—‘এইজন্যে তুই চলে যাচ্ছিস?’

গুঞ্জন কোনও উত্তর দিল না। মেধার কোলটা গরম চোখের জলে ভিজে উঠতে থাকল। তিনি কোলের ওপর কালো কঠিন কোমল ক্লান্ত করুণ মাথাটায় আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। তাঁর মনের মধ্যেকার সক্রিয় ভালোবাসা যদি আরোগ্য হয়ে আঙুলগুলো দিয়ে নামে তো নামুক। বুকের ভেতরে একটা শেল বিঁধেছিল, তীব্র গতিতে আরেকটা শেল এসে বিঁধে গেল। তাঁর বিশাল ভারতকল্যাণযন্ত্রের নাট, বল্ট, পিস্টন, রোলার, সব দীর্ঘশ্বাস ফেলে গা মোড়ামুড়ি দিচ্ছে।

এতগুলো তরুণ হৃদয় নিয়ে কারবার। এটা তাঁর ভাবা উচিত ছিল। তাঁর অল্প বয়সে ছেলেমেয়েদের মেলামেশা এতো অবাধ হয়নি। তাই হৃদয় নিয়ে গণ্ডগোল প্রায়ই হত। মেধার নিজের বাড়িতে কত খোলামেলা আবহাওয়া ছিল সে সময়ের তুলনায়, বাবা-মার ছাত্ররা যখন তখন আসতেন, দাদাদের বন্ধু-বান্ধব, বাবা-মার ছাত্র-ছাত্রী সবাইকে নিয়েই যেন ছিল তাঁদের বৃহৎ যৌথ পরিবার। তবু তো মেধা অমিয়নাথের প্রচণ্ড আকর্ষণ কাটাতে পারেননি। সে আকর্ষণটা পরে মিথ্যা, গুঞ্জন যাকে হিরো-ওয়ারশিপ বলছে তা-ই-ই প্রমাণিত হয়ে যায়। অমিয়নাথের ঘটনাটা প্রতিষেধক টিকার মতো কাজ করেছে তাঁর জীবনে। বিয়ের কথা মনে হয়েছে, সম্ভাবনাও হয়েছে অনেকবার, কিন্তু আর কখনো অমন গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েননি, পড়তে চায়নি তাঁর অন্তরাত্মা। তাঁর আনুগত্য, তাঁর প্রতিজ্ঞা সবই নিয়ে নিয়েছে এই জীবনব্যাপী গবেষণা।

এ যুগের ছেলে-মেয়েরা কত ছেলেবেলা থেকে মেলামেশা করছে। ওদের সম্পর্ক কত সহজ! গুঞ্জন কী শক্ত মেয়ে। অথচ ভেতরে ভেতরে এইরকম অভিমানী! এই ঝুঁকির কথা ভেবেই বা তিনি কী করতেন! তিনি কি এদের আবেগ-অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন? ওরে তুই ওদিকে যাসনি, এদিকে আয়, এভাবে হৃদয়-নিয়ন্ত্রণ করার ট্রাফিক পুলিস কি পাওয়া যায়! সে পুলিস অনেক দুঃখে নিজেকেই হতে হয়। প্রত্যেকটি মানুষ তার নিজস্ব অভিজ্ঞতার পথ দিয়ে যাবে, যে পথ দিয়ে একজন গিয়ে ঠকেছে, সে পথ দিয়েই আরেকজনকে যেতে হবে। পূর্ববর্তীর অভিজ্ঞতা থেকে—সে প্রায় কিছুই শিখবে না। জীবনের পর্বতারোহণ এমনি এক অদ্ভুত জিনিস!

প্রমিতের ব্যক্তিত্বটা আজ এই বর্ষণক্ষান্ত রাত্রে তাঁর স্মরণে আসছে বারবার। খুব শৌখিন ছেলে। এতো পরিষ্কার, কড়া ইস্ত্রির পোশাক পরে থাকতো এবং আগাগোড়াই তাকে টিকিয়ে রাখতে পারতো যে ওর বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলত, প্রমিত পোশাক পরেনি ওর পোশাক প্রমিতকে পরেছে। ছেলেটা উদার স্বভাব। অনেক টাকা ছাত্রসংঘকে দিয়েছে ডোনেশন হিসেবে। কর্মী হিসেবে উজান বা মৈথিলীর মতো, এমন কি লুকু বা গুঞ্জনের মতোও নির্ভরযোগ্য নয়। কিন্তু সীরিয়াস কাজকর্ম করতে করতে মাঝে মাঝে একটা মুক্তির দরকার হয়। সেই হাসিখুশি, ফাজলামি, রসের স্রোত অব্যাহত রাখার কাজটা প্রমিতকে দিয়ে খুব ভালো হত। প্রমিতের চরিত্রের সীরিয়াস দিকটা তখনই প্রকাশ পেত, যখন ও চুপিচুপি ওঁর মার নাম করে ডোনেশন দিয়ে যেত, বলত—‘ম্যাডাম, আমার নিজের বিজনেস চলবে যতদূর সম্ভব স্ট্রেট লাইনে, আমাদের জীবনধারণের জন্য যতটা দরকার রেখে, বাকি সবটাই ছাত্রসঙ্ঘের কাজে যাবে।’

মেধা বলতেন—‘কেন? অত দরকার কি? “আমার ভাণ্ডার আছে ভরে তোমা সবাকার ঘরে ঘরে” এই নীতিই তো ছাত্রসঙঘ নিয়েছে।’

প্রমিত বিজ্ঞের মতো হাসত—‘কত টাকা লাগবে, আপনার কোনও ধারণা আছে ম্যাডাম! আপনি তো বলেইছেন এদেশে ধনের বণ্টনে চূড়ান্ত বৈষম্য। সিসটেমের বিরুদ্ধে যাবার শক্তি তো আমাদের নেই। এভাবেই সেই বৈষম্য দূর করা যাক।’

মেধা বলতেন— ‘ঠিক আছে। যখন সত্যি-সত্যি আন্তরিকভাবে পারবি, করবি, কিন্তু কমিট করার দরকার নেই। আমি মুষ্টিমেয়ের আত্মত্যাগের থিয়োরিতে বিশ্বাস করি না। করা উচিত বলেও মনে করি না।’

একথা প্রমিতকে কি কোথাও আঘাত করেছিল? তার মধ্যে কি কোথাও দানের অহঙ্কার কাজ করছিল? তাঁর কথা সেখানে আঘাত করে থাকলে তিনি নিরুপায়। সমস্ত দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করবে মুষ্টিমেয়র দান, সুবুদ্ধি তার ত্যাগের ওপর, পৃথিবী জোড়া এই ব্যবস্থাটাকে পাল্টানো তাঁর খুব জরুরি মনে হয়। উন্নয়ন হবে কেওড়াখালির। কেওড়াবাসীরা সেই উন্নয়নের যাবতীয় উপকরণ কোনও গৌরী সেনের কাছ থেকে লাগাতার নিয়ে যাবে এ হয় না। সেইজন্যেই এবার যখন ওদের ট্র্যাক্টর দেবার কথা হল, ছাত্রসঙ্ঘ পুরো টাকাটা দিতে চাইলেও তিনি বাধা দিয়েছেন। ওরা এখন যথেষ্ট উপার্জন করছে। ওরা অর্ধেক দিক, বাকিটা ছাত্রসঙ্ঘের কাছ থেকে সুদ ছাড়া ঋণ। কলের লাঙল আসছে। ওদের জমি কয়েক ঘণ্টায় চাষ হয়ে যাবে, তারপরে ওরা সরাল আর ফলসা গ্রামে ভাড়া খাটাবে কলের লাঙল। সেই টাকায় বছর খানেকের মধ্যে শোধ হয়ে যাবে ছাত্রসঙ্ঘের ঋণ। নিজেদের টাকায়, নিজেদের ঋণ করে কেনা টাকায়, নিজেদের কলের লাঙল। তার আনন্দই আলাদা।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress