উত্তরণ -3
তার ভাবনার গভীরতা কেবলমাত্র অফিস কেন্দ্রিক।জীবন নিয়ে সে আর ভাবে না,তার সময় কোথায়?ঋদ্ধির যেন একটা ঘোরের ভেতর দিয়ে হাঁটছিল এতদিন ধরে।আজ তার জীবনে ববের ঠাঁইও নেই।যে ববকে নিয়ে সে নিয়ম করে সকালে আর রাতে চেনে না বেঁধে পাড়ায় ঘুরে বেড়াত,ববের একটু কিছু হলে একাই সাইকেল রিক্সা নিয়ে ডাক্তারের কাছে ছুটতো।আচ্ছা ববও কি তার এই পরিবর্তন বুঝতে পেরেছে?আগের মত সে আর ঋদ্ধির কাছে আসে না,যতটুকু সময় ঋদ্ধি বাড়িতে থাকে লক্ষ্য করেছে বব এখন সবসময়ই মায়ের পেছন পেছন ঘোরে।এত কিছু ভাবতে ভাবতে কখন যে ঋদ্ধির চোখ বেয়ে জলের ধারা নেবেছে সে নিজেও জানে না।সম্বিত ফিরল একটা ইয়ং ছেলে যখন তার কাঁধে টোকা দিয়ে জানতে চাইল যে তার কি হয়েছে।ঋদ্ধি ম্লান হেসে ছেলেটাকে ঘাড় নেড়ে তার যে কিছু হয়নি তা বোঝানোর চেষ্টা করলো।ছেলেটা শ্রাগ করে তার বান্ধবীকে নিয়ে চলে যেতে যেতে বলল-প্রেমে চোট খেয়েছে।এতক্ষণ পরে ঋদ্ধির খুব হাসি পেল।বাড়িতে এসে চা খেয়ে বাবার সঙ্গে ঠাকুমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্প করলো।মা তখন রান্নাঘরে, বলল-বাবু তুই ঘরে যা আমি একটু পরেই আসছি।ঘরে এসে রেডিও চালিয়ে এফ এম শুনতে লাগলো,কতদিন সে রেডিওতে হাত দেয়নি।এদিক ওদিক চ্যানেল সার্ফিং করতে করতে একটা চ্যানেলে এসে ঋদ্ধি স্তব্ধ হয়ে গেল-কিশোরকুমারের গান বাজছিল।”কভি পলকোঁ পে আঁশু হ্যয়, কভি লব পে শিকায়ত হ্যয়। মগর ইয়ে জিন্দেগী ফির ভি মুঝে তুঝসে মুহব্বত হ্যয় “; নির্বাক হয়ে ঋদ্ধি গানটা শুনে ভাবলো-সত্যিই তো মানুষের ভুল পদক্ষেপ তার জীবনের আলো নিভিয়ে দেয়,তাকে বাঁচতেই হবে তার মত করে। সে আর অফিসের মত বাঁচবে না।সঙ্গে সঙ্গে অমিতকে ফোন করে জানতে চাইল পরেরদিন তার ছুটি আছে কি’না।অমিত কারণ জানতে চাইলে ঋদ্ধি বলল তাকে নিয়ে সে একজায়গায় যাবে।অমিত সম্মতি দিতেই ঋদ্ধি আগরওয়ালজী-কে ফোন করে বলল যে তার জ্বর কমেনি, ডাক্তার তাকে বহু কিছু টেস্ট করতে বলেছে তাই আগামীকালও সে অফিস যেতে পারবে না।আগরওয়ালজী বললেন যে শরীর খারাপ থাকলে আর কি করা যাবে তবে যদি সে একটু সুস্থ বোধ করে একটু হলেও যেন সাইটে যায়,ওখানে ঋদ্ধির মুখ না দেখলে সবাই গা এলিয়ে বসে থাকবে। ঋদ্ধি সম্মতি দিল।ফোন কেটে দেওয়ার আগে হটাতই আগরওয়াল ঋদ্ধিকে একটু খোঁচা দিলেন আগের দিনের কাজটা না পাওয়ার জন্য। ঋদ্ধি থম মেরে বসে রইল,শুধু মুখে বলল সে দেখছে।অমিতকে ফোন করে বলল তারা এই সাড়ে এগারোটা নাগাদ বের হবে আর অমিত ওদের বাড়িতে খাবে,তারপর ড্রাইভার পুলককে ফোন করে সাড়ে দশটায় আসতে বলল।পুলকও এখানে খাবে তাও জানিয়ে দিল।কিছুক্ষণ পরে মা রান্না শেষ করে ঋদ্ধির কাছে এসে বসলো।দু একটা কথার পর ঋদ্ধি পরের দিনের তার প্রোগ্রাম বলল। মা শুনে অত্যন্ত খুশি হলেন তারপরেই অনুযোগের বন্যা।মূল কথা এইভাবে সারাদিন টো টো করে ঘুরলে ঋদ্ধির শরীর পাত হবে,দুপুরে ঋদ্ধি কি যে ছাইপাঁশ ক্যান্টিনে খায়,সময়ে খায় কি’না,এইসব ভেবে ওনার দুশ্চিন্তা হয়।ঋদ্ধি মৃদু হেসে মা-কে সামলে ঐ দিন রাতে কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় উত্তর পেল পরোটা ঘুগনি।ঋদ্ধির ফেভারিট ডিশ।ঋদ্ধি আনন্দে মা’কে জাপটে ধরলো।এরপর মায়ের কোলে মাথা রেখে বহুদিন বাদে মা ব্যাটা গল্প করলো।পরেরদিন ঋদ্ধি বাজারে গেল, আনাজের সঙ্গে কিনলো তার প্রিয় মাছ ভেটকি আর বাগদা চিংড়ি।অমিত যথা সময়ে চলে এলো,খুবই কৌতুহলী সে ঋদ্ধির ব্যাপারে।পুলকও গাড়ি নিয়ে হাজির। পুলক কোম্পানি থেকে মাস মাইনে পেলেও দরকারে ঋদ্ধির কাছ থেকে দু চারশো টাকা ধার পায়।তাই সে খুব ন্যাওটা।খাওয়া দাওয়া সেরে ওরা প্রথমে গেল সাইটে।ঋদ্ধি একটু ঘুরে ফিরে দেখল, অফিসে গিয়ে কিছু কাগজ সই করে ছেড়ে দিল।জুনিয়ারদের সঙ্গে ছোট মিটিং করে কাজ বুঝিয়ে দিল তারপর আগরওয়াল জীকে ফোন করে তার আগমন বার্তা এবং কাজের একটা হিসেব দিল। আগরওয়ালজী শুনে খুশি হলেন,সঙ্গে হালকা ইঙ্গিতে ঋদ্ধির হেরে যাওয়া কাজটাও তুললেন।ঘন্টাখানেক বাদে ওরা সাইট ছাড়লো।ঋদ্ধি পুলককে গাদিয়ারা যেতে বলল।অমিত এতক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করছিল ঋদ্ধির কাজ, গাদিয়ারা যাওয়ার কথা শুনে বলল-ওখানেও কি তোদের মক্কেল আছে? ঋদ্ধি মুচকি হেসে মৌন হয়ে রইল।গাদিয়ারাতে পৌঁছে নদী-গাছ-পাখীর ডাক, এককথায় প্রকৃতির কোলে নিজেকে সমর্পণ করল ঋদ্ধি।নৌকা ভাড়া করে দুই বন্ধু অনেক্ষণ জল বিহার করে, মাঝির ঘর সংসারের গল্প শুনতে শুনতে যখন তারা ফের ঘাটে এলো সূর্য তখন আর নেই ,রেখে গেছে আলোর রেশটুকু।নদীর পাড়ের ঘাসজমিতে পা ছড়িয়ে দু বন্ধু বসে আড্ডা দিতে লাগল,পুলক ওদের চা এনে দিল।অমিত জানতে চাইল ঋদ্ধি কি এই রকম মাঝে মাঝে বেড়াতে আসে,ঋদ্ধির সঙ্গে গাড়ি থাকে অসুবিধে হওয়ার তো কথা নয় আর চাকরি করলেও ঋদ্ধির স্বাধীনতা অঢেল।ঋদ্ধি ঠোঁটের কোণে আলতো করে হাসি ঝুলিয়ে উত্তর দিতে লাগল।তার চাকরি জীবনের আগের কথা, বন্ধুদের প্রবলেমের সমাধান করে হিরো হওয়া।পুরোনো অফিসের বিশৃঙ্খল অবস্থাকে সিস্টেমে নিয়ে এসে মালিকের চোখের মনি হওয়া এবং সব শেষে এই চাকরিতে ঢোকা।এই চাকরিতে এসে তার একের পর এক সাফল্য কোম্পানিতে তাকে বিশেষ পজিশনে পৌঁছে সে ধরাকে সরা জ্ঞান করতে শুরু করেছিল আর এই মনোভাবের জন্য অমিতদের দায়ী করলো।