উত্তরণ – 2
অবশেষে ঋদ্ধি নতুন চাকরিতে যোগ দিল।বড়মামার কথা মত নিয়োগপত্রে সব লেখা ছিল।বোম্বে রোডের ধারে তৈরি হচ্ছে নতুন লজিস্টিক হাব।ঋদ্ধির কাজ আপাতত তদারকি করা।উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা এলাকাটা।ব্যবসায়িক এলাকার বাইরে হচ্ছে স্টাফ কোয়ার্টার,পদ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের।ঋদ্ধির জন্য বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে বাংলো প্যাটার্নের কোয়ার্টার।ঋদ্ধি এখনও বাড়িতেই থাকে।অফিসের গাড়ি নিয়ে যায় আর ফেরৎ দিয়ে যায়।আগরওয়াল জী একদিন কনটাক্টরদের সঙ্গে মিটিং করে ঋদ্ধির সঙ্গে তাদের আলাপ আর ওর পদমর্যাদা বুঝিয়ে বলেছিলেন যে ঋদ্ধির কথাই এখানে শেষ কথা,এইটা যেন সবাই মাথায় রাখে।একটা অস্থায়ী অফিসে ঋদ্ধি বসে।তার এই মূহুর্তের কাজ তদারকি করা আর হিসেব রাখা। একদিন আগরওয়াল জী দেখতে এসে ঋদ্ধিকে বললেন যে ওনার কাছে বেশ কিছু কোম্পানির নাম এসে জমা হয়েছে,ঋদ্ধি এইবার ওদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করে দিক যেন তারা এই হাবে তাদের গোডাউন করে।কেননা ঐ ভাড়া থেকেই কোম্পানির সঙ্গে সরকারের চুক্তি মত লিজ্ রেন্ট মেটাতে হবে।উনি এক মার্কেট সার্ভে সংস্থাকে দিয়ে ঐ সব কোম্পানির নাম এবং অন্যান্য তথ্য জোগাড় করেছেন।ঋদ্ধি নতুন এই চ্যালেঞ্জিং কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লো।টেলিফোন করে ঐ সব কোম্পানির মাথাদের সঙ্গে মিটিং শুরু হলো।কখনও কখনও তাদের খাতির করে সাইটে নিয়ে এসে দেখালোও।ঋদ্ধির বাকচাতুর্যে তাদের কেউ কেউ ঐ হাবে গোডাউন বানাতে শুধু সম্মত নয় পুরো দস্তুর চুক্তিই করে ফেলল ঋদ্ধিদের কোম্পানির সঙ্গে।আগরওয়াল জী মহা খুশি।ঋদ্ধির নামে ইনসেনটিভ্ ঘোষণা করলেন।পুরানো অফিসের মালিক একদিন ফোন করে ঋদ্ধির আরও উন্নতি কামনা করলেন।ঋদ্ধি এক রবিবার ওনার সঙ্গে দেখা করে এলো। আর একদিন পুরোনো অফিসেও প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে আড্ডা দিল বেশ কিছুক্ষণ।ঋদ্ধি সব পাচ্ছে শুধু হারিয়ে গেল তার অবসর।বেড়াতে যাওয়া দূরস্থান বাড়িতেও বাবা, মা বা ঠাকুমার সঙ্গেও তেমন ভাবে আর কথা বলতে পারে না।টিভি দেখা, একটু সিনেমা দেখা,পুজোয় ঠাকুর দেখা বা অঞ্জলি দেওয়া আজ তার কাছে সময়ের অপচয় বা বিলাসিতা।সে বুঝতে পারলো কাজের নাগপাশ তাকে ক্রমশ যান্ত্রিক করে তুলছে।ইতিমধ্যে তাদের কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড হয়েছে।এত কাজের মধ্যেও তাকে প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে হয় মিটিং-জন্য।একদিন অফিস যাওয়ার পথে সিগন্যালে যখন গাড়ি থেমে আছে ঋদ্ধি দেখে পাশেই পাড়ার ছোট্টবেলার বন্ধু অমিত বাইকে।সে গাড়ির কাঁচ নাবিয়ে অমিতকে ডাকতেই অমিত তাকে দেখে মাথা ঝুঁকিয়ে বো করে বলল – ভাল আছেন ?ঋদ্ধি অবাক।ইতিমধ্যে গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে দেখে সে চটপট তার নেম কার্ড অমিতকে দিয়ে ফোন করতে অনুরোধ করলো।তিন চার দিন পরের কথা,নতুন মক্কেলের সঙ্গে ঋদ্ধির মিটিং সফল হয় নি।মন মেজাজ তার খুব খারাপ।মুখটা যেন কুইনাইন খাওয়ার পরের মত।সে তার এই অসফলতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না,এ যে তার পরাজয়।সে তো হারতে শেখেনি!অফিসে ঢোকার মুখে একটা সিকিউরিটি গার্ডকে বিড়ি খেতে দেখে তার মেজাজ সপ্তমে চড়ে গেল।ড্রাইভারকে হুকুম করলো ওই গার্ডকে তার সামনে হাজির করতে।লোকটি আসতেই ঋদ্ধি তাকে যা তা বলে অপমান করে ঘর থেকে বের করে দিয়ে যে কোম্পানিকে তারা বরাত দিয়েছে গার্ড দেওয়ার জন্য তাদের মালিককে ফোন করে ডেকে পাঠালো।সে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসতেই ঋদ্ধি তাকেও প্রচুর বকাঝকা করে জানিয়ে দিল এমন লোক পাঠালে তারা আর চুক্তির পুনর্নবীকরণ করবে না।ব্যবসা হরানোর ভয়ে তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া। অতি কষ্টে সে ঋদ্ধিকে শান্ত করে চলে গেল।ঋদ্ধি বেয়ারাকে ডেকে বললো সে একটু বিশেষ কাজ করবে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে।মোবাইলটা সুইচ অফ করে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগল ঠিক কি কারণে আজকের মিটিং-এ সে সফল হয় নি।অনেক ভেবেও সে রহস্যের সমাধান করতে পারলো না।মোবাইলের সুইচ অন করতেই একটা মেসেজ পেল।অমিত লিখেছে-বহুবার ফোন করেও আপনাকে অন পেলাম না,আমার নম্বর দিলাম,ফোন করলে বাধিত হই।ফের মাথা গরম। অমিতকে ফোন করলো। প্রথমেই প্রশ্ন অমিত ঋদ্ধিকে কেন আপনি করে কথা বলছে।যতটা উষ্মা দেখিয়ে ঋদ্ধি বললো অমিত ততোধিক ঠান্ডা স্বরে পুরোনো ঋদ্ধি আর বর্তমান ঋদ্ধির ফারাকটা বুঝিয়ে বলে অনুরোধ করলো ঋদ্ধি যেন কয়েকদিন ছুটি নিয়ে বিশ্রাম নেয়।ফোন ছেড়ে ঋদ্ধি অমিতের কথা, তার আজকের অসফলতা, অকারণে এক দুজনকে বকাঝকা, ভাবতে বসল।কাকস্য পরিবেদনা,কোন উত্তর খুঁজে না পেয়ে সাইটে রোঁদে বের হল।রাতে একফোঁটা ঘুমতে পারলো না ঋদ্ধি।পরের দিন আগরওয়াল জী-কে ফোন করে জ্বর হয়েছে বলে ছুটি নিল।সেই আগের কাজগুলো করতে গিয়ে দেখলো বাড়ির লোক থেকে শুরু করে বন্ধুরাও তাকে অবাক চোখে দেখছে।অস্বস্তি লাগলো।বিকেলে একা একা চলে গেল গঙ্গার ঘাটে।আচমকাই সে উপলব্ধি করতে পারলো একের পর এক সাফল্যে সে অহংকারী হয়ে গেছে,নিজেকে গর্ববোধ এখন তার যেন সহজাত চারিত্রিক গুণ,কিন্তু ঋদ্ধি তো তা চায় নি।রোজ সকালে সে একটা তাগড়া আখ হয়ে অফিস নামের আখের রস বের করার কারখানায় ঢুকছে আর বিকেলে ছিবড়ে হয়ে বেরিয়ে আসছে।তার সূক্ষ্ম মূল্যবোধগুলো এখন অক্সিজেনের অভাবে মৃতপ্রায়,জীবনদর্শন ঠেকেছে তলানিতে,চোখ বাঁধা কলুর বলদের মত একই ভাবে ঘুরে চলেছে।