উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তিনি স্মৃতি ও মাসি
কাঠের নস্যিদানিটা হাতে করে বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে রইলেন কস্তুরীবেন। এক টুকরো অতীত বা ছুটোবেলা। সে সময়ে শরদকাকাকে শরদকাকা বলেই জানতেন। বাবার ছোট ভাই। পরে, দুজনের মধ্যে যখন কোনও সম্পর্কই আর রইল না, তখন জিজ্ঞাসাবাদ করে আস্তে আস্তে জানলেন শরদকাকা বাবার ছোট ভাই নন। বন্ধু। আদর্শবন্ধু। দু’জনেরই তখন এক মন, এক প্রাণ, দেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে, দেশকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ না হোক উত্তম আসন দিতে হবে। হরিপুরা কংগ্রেসে সভাপতি সুভাষচন্দ্রকে দেখে, তাঁর ভাষণ শুনে তখন বাবা বাংলায় আসবেন বলে ঠিক করেন। বিয়াল্লিশের আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে প্রেসিডেন্সি জেলে থাকাকালীন দু’জনের ঠিকঠাক আলাপ। যখন জেল ছেড়ে বেরোলেন কোথায় সুভাষ? তখন সুভাষ-পন্থার সঙ্গে গাঁধী-পন্থার ঘোর তর্ক। তাঁরা বলতেন গাঁধীর অনশন এক ধরনের ইমোশন্যাল ব্ল্যাকমেল, গুরুতর কোনও বিপদ ঠেকাতে, প্রতিবাদ হিসেবে ভাল। কিন্তু উনি সে অস্ত্র যথেচ্ছ ব্যবহার করেন। যুদ্ধের সময়ে ইংরেজ শাসকের সঙ্গে যে চুক্তি তিনি করেছিলেন তার চেয়ে মূর্খামি আর হয় না। আর শেষ পর্যন্ত তো দ্যাখাই গেল তিনি আসল সময়েই অস্ত্রটা ব্যবহার করলেন না। জিন্নাকে শত্রুতে পরিণত করেছিলেন নেহরু-গাঁধীই। তারই অবশ্যম্ভাবী ফল হিসেবে যখন পার্টিশন হল, গাঁধী তো কোনও অনশনে গেলেন না আর! অথচ কথা দিয়েছিলেন নাকি তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়ে পার্টিশন হবে! সুভাষচন্দ্র ছিলেন যাকে বলে কমপ্লিট লিডার। পূর্ণ নেতা, পূর্ণ মানুষ। তাঁর পরিকল্পনা ছিল স্বাধীনতার পর ঠিক কীভাবে দেশের মানুষ ও দেশকে গড়তে হবে। তাঁর আশা ছিল যে-মুহূর্তে তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ নিয়ে ভারতের মাটিতে পা দেবেন, পুরো ভারত তাঁর সঙ্গে যোগ দেবে।
জেল থেকে বেরোনোর পর দু’জনে ঠিক করেন, কিছু করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন। সুতরাং দু’জনে মিলে নানারকম ব্যাবসা আরম্ভ করলেন। বাবার পৈতৃক জুয়েলারির ব্যাবসা ছিল। সেই ব্যাবসাই ঠাকুরদার সাহায্যে কলকাতায় শুরু করলেন তাঁরা। তারপর বিজনেস এমন একটা জায়গায় চলে গেল যে দুজনেরই মনের তিন-চতুর্থাংশ চলে গেল সেদিকেই। বাড়িতে যেসব সভা বসত তাতে প্রায়ই গরহাজির থাকতে হত। অজিতবাবুই ছিলেন বোধহয় সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ। কস্তুরীর কখনওই মনে হয়নি অজিতবাবুর নিজস্ব সংসার, ছেলেমেয়ে থাকতে পারে। ভাবতেন, শিশুমনে যতদূর ভাবা সম্ভব, যে, অজিতবাবু বোধহয় অকৃতদার। সন্ন্যাসী ধরনের মানুষ। যে-কোনওদিন উনি হিমালয়ে চলে যেতে পারেন, একমাত্র দেশের জন্যই পারছেন না। সন্ন্যাসী ধারণাটা মজবুত করেছিল দাড়ি। ঘাড় অবধি কাঁচাপাকা চুল, গেরুয়া খাদির পাঞ্জাবি। রবীন্দ্রনাথ মানেই যেমন দাড়ি। ওইরকম দাড়ি গোঁফওলা লোক হলেই বলা হয় রবীন্দ্রনাথের মতো। শুধু দাড়ি দিয়ে রবীন্দ্রনাথকে চেনা— হাস্যকর!
অজিতবাবু তা হলে মারা গেছেন! অতি বৃদ্ধ বয়সে? একটা পাতা শূন্য হয়ে গেল। পূর্ণ করা গেল না। কত কী জানবার ছিল, বোঝবার ছিল! — অজিতবাবু আপনারা কী চেয়েছিলেন? কীরকম দেশ ও দেশবাসীর কল্পনা ছিল আপনাদের? তাকে সাকার করতে কোন পথে চেষ্টা করেছিলেন আপনারা? আচ্ছা, দেশের কাজের সঙ্গে কি বিবাহ করা যায় না? বিবাহিতকে অবিবাহিতের জীবন কাটাতে হয়? বা ভান করতে হয়? আপনাদের এক আইকন গাঁধীজি কিন্তু এন্ডস অ্যান্ড মিনস-এর শুদ্ধতার ওপর জোর দিয়েছিলেন। অজিতবাবু, আমার বাবা কিন্তু জানতেন না আপনি বিবাহিত। কেন এই ছলনা! লজ্জা! আপনার নাতির বয়স যদি আজ ৩৪/৩৫ হয় তাহলে আপনার ছেলের কম করে হলেও ষাট। তাহলে সে সময়ে আপনি বিবাহিত। পিতা। অথচ পুরোটাই চেপে গিয়েছিলেন, কেন? অজিতবাবু আপনার জীবন আপনাদের দেশপ্রেমের চরিত্র সম্পর্কে একটা নতুন দিক উদঘাটন করছে আমার কাছে। প্রাচীন ভারতের সব রকম ধর্মদর্শনে ব্রহ্মচর্য-সাধনাকে সবার ওপর স্থান দেওয়া হত। তাই কি আপনাদের এরকম সংস্কার হয়েছিল? এখনও পুরো জিনিসটার তাৎপর্য আমি বুঝতে পারছি না। মিথ্যে দিয়ে শুরু করলে কি কিছু সত্য দিয়ে শেষ হয়?
কীরকম হতভম্ব মতো হয়ে ডিব্বাটা হাতে বসে রইলেন কস্তুরীবেন। ছোট্ট একটু মিথ্যা আবিষ্কার দিয়ে যে যাত্রা শুরু হল তাকে কি আরও দীর্ঘ করা উচিত! ভাবতেই লাগলেন। ভাবতেই লাগলেন। তিনি সত্য জানতে এসেছিলেন, তথ্যও। একজন ছোট্ট মেয়ে তার নিজস্ব ছেলেমানুষি চোখ দিয়ে যা বুঝেছিল, তাকে প্রাপ্তবয়স্কর চোখ দিয়ে যাচাই করে নেওয়া চাই। কত মোহভঙ্গ হবে, হতেই পারে, সেটুকুর জন্য তাঁকে প্রস্তুত থাকতেই হবে। তিনি তো স্বপ্নে বাঁচেন না তাঁর বাবা-মাদের জেনারেশনের মতো। কঠিন বাস্তব নিয়ে তাঁর কারবার। চতুর্দিকে দেখেন ঈশ্বরের উপেক্ষিত প্রাণ সব—অন্ধ, মূক, বধির—তাদের হেলেন কেলার হবার প্রতিভা নেই, পরিবেশ নেই, জড়বুদ্ধি, স্প্যাস্টিক, অটিস্ট—এদের পুরো জীবনটা দুর্বহ বোঝার মতো নিজেদের কাছে, পরিবার-পরিজনের কাছে, আছে অত্যাচারিত স্ত্রী, মেয়ে, পথের শিশু—এদের সঙ্গে দেশ, তার নেতা, তার রাজনীতি, ধর্ম, উন্নয়ন— এসবের কোনও সম্পর্ক নেই। অর্থহীন জীবন, তবু বেঁচে থাকতে হয়। এক অক্ষম ঈশ্বর এদের সৃষ্টি করেছেন, তার দায় বইতে হয় তাঁদের মতো মানুষদের, যাঁরা নিরপেক্ষ নিরাবেগ কিন্তু সস্নেহ, মমতা দিয়ে দেখতে পারেন সব। উদাসীন ঈশ্বরের জায়গায় মমতাময় মানুষ, যার হাতে কোনও দৈব ক্ষমতা নেই।
নিবেদিতা মাসিই ছিলেন বোধহয় ওঁদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। কেননা তিনি মাকে দিদি বলতেন। মা-ও তো নিবেদিতাই বলতেন।
উঠে গিয়ে পুরনো ছাতাপড়া নোটবইটা নিয়ে এলেন তিনি। হাওড়া-৪৪৬। এ কবেকার ফোন নম্বর? এ বোধহয় অপারেটরের যুগের। তারপর গঙ্গা সবরমতী দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। স্যাম পিত্রোদা টেলি কমিউনিকেশনকে ঢেলে সাজিয়ে দিয়ে গেছেন। ফোন করে, চেক ইয়োর নাম্বার শুনলেন, ওয়ান নাইন ফাইভ ওয়ান করে—‘হমে খেদ হ্যায়, ইয়ে নাম্বার মজুত নহি’ শুনলেন। কিছু হবার নয়। ঠিকানা পাঁচ নম্বর ব্যাপটিস্ট বেরিয়্যাল গ্রাউন্ড রোড, শালকিয়া, হাওড়া। এক কাজ করলে হয়। একটা গাড়ি ভাড়া নিলে হয়, সেক্ষেত্রে একটু নিশ্চিন্ত হয়ে চলাফেরা করতে পারবেন। রামলাখনকে ডাকলেন।
—জরুর মায়ি, উও রেন্টাল তো বগলমেই হ্যায়, ম্যয় আভি জাতা হুঁ।
রামলাখনই ঠিক করে দিল।
দই চিঁড়ে খেয়ে বেরোচ্ছেন। জগদ্দল অ্যামবাসাডরটার ভেতরে সবে গুছিয়ে বসেছেন। মোবাইলটা বাজল। — হ্যালো দিদি, আপনি কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক চলছে তো?
কাজল।
—হ্যাঁ, টিকই আছে।
—‘ই’ টা কেন? কোনও দরকার হলেই আমাকে জানাবেন কথা দিয়েছিলেন!
—কুনও ‘ই’ নাই। কোথার কোথা। আমি একটু দোরকারে বেরোচ্ছি।
—কোথায়?
—হাওড়া।
—হাওড়া? নতুন ব্রিজ দিয়ে যাচ্ছেন তো?
—নয়া ব্রিজ? কওন সা নয়া ব্রিজ?
—নতুন ব্রিজ আছে দিদি, বিদ্যাসাগর সেতু, ড্রাইভারকে বলুন বিদ্যাসাগর সেতু দিয়ে যেতে। জিটি রোডে পড়বে। কোনদিকে যাবেন?
—সালাকিয়া।
—সালা…ও শালকিয়া। তার মানে আপনাকে হাওড়া ময়দানের পরও সোজা চলে যেতে হবে। রাস্তার নাম বলুন!
বললেন।
—এঃ, চিনি বলে তো মনে হচ্ছে না। তবে পিলখানা বলে একটা জায়গা আছে, ওটাই মোটামুটি শালকিয়ার শুরু। ওইখান থেকে জিজ্ঞেস করতে করতে যেতে হবে। একটা রেন্টাল গাড়ি নিলে পারতেন।
—নিয়েচি।
—বেশ, আপনার কোনও অসুবিধে হলেই আমাকে ফোন করবেন। ঠিক হাজির হয়ে যাব।
—টিক আছে। ওত ভেবো না।
পাঁচ মিনিটও যায়নি আবার মোবাইলটা বাজল। নাহ্, এই তথাকথিত প্রগতিশীল কলকাতিয়ারা তাঁকে লেডিজ সিটে না বসিয়ে ছাড়বে না। মেয়ে গলা। মৈত্রী।
দিদি, আমি স্নেহলতা ঘোষের ঠিকানা বার করতে পেরেছি। —খুব উত্তেজিত গলা মৈত্রীর।
—পেরেচো? তাঁর গলাও কম উত্তেজিত নয়। স্নেহলতা ঘোষের ফোন নম্বরও তিনি খোঁজ করেছিলেন। কোনও হদিশ পাননি। ঠিকানাটা ধেবড়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করলেন, কী করে? কুথায়?
উনি তো ফ্রিডম-ফাইটার। বাবার এক বন্ধু সেন্ট্রাল গভমেন্ট সার্ভিসে আছেন। উনি বললেন পেনশনার হলে আমি বার করতে পারব। পেয়ে গেছেন। আমি আপনাকে ওঁর কাছে নিয়ে যাব। আমারও খুব ইচ্ছে ওঁকে দেখি। আমি কখনও ফ্রিডম-ফাইটার দেখিনি দিদি।
টিক আছে।
মোবাইল বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে রইলেন কস্তুরী। কখনও ফ্রিডম-ফাইটার দেখিনি—কীভাবে বলল মৈত্রী। ফ্রিডম-ফাইটার যেন এক আজব চিজ। ম্যমি। কলকাতা মিউজিয়ামে এসেছে। দেখবার জন্যে লাইন দিতে হবে। না না, তিনি বায়াসড হয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ভাবা ঠিক নয়। ওর গলায় উত্তেজনার সঙ্গে একটা সন্ত্রমও ছিল। কিন্তু কেন যেন একটা দুর্নিবার তিক্ততা তাঁর মনকে প্রায় আচ্ছন্ন করে। তখন বিদ্যাসাগর সেতুর মুখে এসে পড়েছে গাড়ি। অ্যাপ্রোচটা ধরে শাঁশাঁ করে যাচ্ছে। পথ বদলাচ্ছে, দৃশ্য বদলাচ্ছে, তিনি লক্ষ করলেন না। এদের সঙ্গে তাঁদের জেনারেশন গ্যাপটা অদ্ভুত চরিত্রের। বড়র ভাবনার জগৎ আর ছোটর ভাবনার গ্যাপ নয়। আরও বেশি কিছু। তাঁরা ইতিহাসে বেঁচেছেন। তাঁদের বাবা-মা, দাদা-দিদিরা ইতিহাস তৈরি করেছিলেন— সেই চেতনা চুঁইয়ে চুঁইয়ে প্রবেশ করেছিল তাঁদের মগজে। তাঁদের কখনও কল্পনাতেও ছিল না, রাজনীতিকে শুধু একটা বৃত্তি হিসেবে কেউ নিতে পারে। রাজনীতি মানেই দেশ, দেশের জন্য ভাবনা। এরা বোধহয় পোস্ট-ইতিহাস। স্বদেশ-সচেতনতাহীন। মাত্র অর্ধ শতাব্দীর সামান্য বেশি স্বাধীনতা পেয়েছে। এখনও কলোনিয়্যাল প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেনি, এ বোধই নেই। সবচেয়ে বড় কথা— দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ নেই, ভালবাসা নেই। এরা … এরা বাইরের লোক, অন্য কোনও জগতের ছেলেমেয়ে। রাস্তাঘাটে এদের দেখে তিনি চিনতে পারেন না। যেমন মুম্বই, তেমন দিল্লি, এখন এই কলকাতা! আগের চেয়ে সাধারণভাবে সপ্রতিভ, কিন্তু সেই সঙ্গে সঙ্গে মূল্যবোধহীন। নৈতিকতার ধার ধারে না। হয়তো তাদের আগের প্রজন্মই শেখাচ্ছে এসব। কে বলতে পারে! যদি তাঁর স্বামী একদম অকালে চলে না যেতেন, যদি ছেলেমেয়ে থাকত, তা হলে হয়তো বুঝতে পারতেন কোন পথ ধরে তারা এই অচেনা গুহায়, গোলকধাঁধায় এসে ঢুকেছে। কিন্তু আপাতত কোনও সূত্রই পাচ্ছেন না।
তবে, কাজল ছেলেটিকে তাঁর ভাল লাগছে। আধুনিক, সপ্রতিভ অথচ খুব সহজ, কোনও কৃত্রিমতা নেই। এক এক সময়ে মনে হয় ওর সঙ্গে তিনি সমবয়সি বন্ধুর মতো ব্যবহার করে ফেলবেন। কাজলের মতো ছেলেরা আবহমান। স্বাধীনতা-পূর্ব সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত তার প্রাসঙ্গিকতা বদলায়নি। ওর বাবা-মাকে বাহবা দেবেন, না বাহবাটা ওকেই দেবেন— বুঝতে পারলেন না। নিজের ভাবনার ধারায় নিজেই অবাক হয়ে গেলেন কস্তুরী। তিনি সম্পূর্ণ কর্মজগতের লোক। পরিকল্পনা করেন, মগজ এখন এমনভাবে কাজ করে যে অনেক সময়েই পরিকল্পনাটা আপনাআপনি হয়ে যায়। যেমন হয়েছিল এবারের দাঙ্গার সময়ে। হয় ছোটখাটো দাঙ্গা, কিন্তু সেটা সাধারণত দরিদ্র সুন্নিদের পাড়ায়, এবার শিয়া, বোহরা, ইসমায়েলি কেউ বাদ যায়নি। বড়-ছোট ব্যাবসাদারের বাড়িঘর লুঠ হয়ে গেছে। দোকান থেকে ইলেকট্রিক্যাল গ্যাজেটস, কসমেটিকস নিয়ে হরির লুঠ হয়েছে। বলির পাঁঠার মতো কাঁপতে কাঁপতে যখন তাড়া-খাওয়া এক দঙ্গল মানুষ তাঁর বাড়িতে ঢুকে পড়ে, সেই ভুলে যাওয়া পঞ্চাশ রক্তের মধ্যে, পেটের মধ্যে গুলিয়ে উঠেছিল। তাঁর বাবা, কাকা, মা, মামিদের মতো নির্ভীকচিত্তে তিনি তাঁর গ্রিল, ডবল কোল্যাপসিবল সব বন্ধ করেন। ওদের তিনতলায় চলে যেতে বলে হাতে নিয়েছিলেন রিভলভার, কোল্যাপসিবলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে দিয়েছিলেন জাতীয় পতাকা। কার সাহস আছে এর ওপর পা দিয়ে দাঁড়া, দেখি কত বড় দেশদ্রোহী তোরা! মরবার জন্যে প্রস্তুত থাক।
গালাগালের হররা। অকথ্য। একটা গুলি বিঁধে গিয়েছিল তাঁর বাঁ হাতের কবজিতে। গ্রেনেড ফাটল, অন্ধকার, ধোঁয়া, তিনি পেছোননি। তাঁর বাড়ির লোকেরা, দোতলার বারান্দা থেকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করেছিল। ফুটন্ত গরম জল ঢেলে দিয়েছিল। সাত-আটদিন এইভাবে কাটে। তাঁর বাড়ি গিজগিজ করছে, মেয়ে পুরুষ শিশু। আরও আসছে। আরও। আকবরনগর, কাপুরনগর, হিম্মতনগর। পক্ষকাল কেউ ঘরে ফিরতে পারেনি। ঘরে খিচুড়ি হচ্ছে, চাটনি, আর অফুরন্ত দুধ। তারপর চারদিকে শ্মশানের স্তব্ধতা। তাঁর বাড়িতে জন্ম হচ্ছে। জন্ম হচ্ছে। মানবশিশু তিনটি। কিন্তু অনেক বরাভয়, সাহস, আস্থাও কি জন্মায়নি? নিশ্চয় জন্মেছে। তিনি প্রাণপণ করেছেন। তাতেও যদি আস্থার গর্ভপাত হয়ে যায়, তিনি কেন বাঁচবেন আর?
টোল দেবেন দিদি— দশ টাকা— ড্রাইভার বলল।
এইবার চোখ চেয়ে দেখলেন কস্তুরী, দু’ দিকে ত্রিকোণ তৈরি করে চমৎকার স্টিলের দড়ির ওপর ঝুলছে বিদ্যাসাগর ব্রিজ। দুপাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঘোলা জলের গঙ্গা। তাতে নৌকো। জেটির কাছ থেকে তেরছা গতিতে যাতায়াত করছে স্টিমার। গাছ, বড় বড় উঁচু উঁচু প্রাসাদ। তিনি মনে মনে বললেন, বেশ দ্যাখাচ্ছে, হঠাৎ দেখলে ভারত বলে মনে হয় না। যেন কোনও সমৃদ্ধতর দেশ, কিন্তু তোমরা মাটির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ কোরো না, গজদন্ত-মিনারে থেকো না। এ তোমাদের বিবেকের প্রশ্ন শুধু নয়, নিরাপত্তারও প্রশ্ন। খরা, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, অনাহার-অর্ধাহার মানুষ সয়, কিন্তু চিরদিন সয় না। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি অর্ধনগ্ন মানুষ যদি গর্জন করতে করতে ঢুকে পড়ে তোমাদের ঘরে ঘরে, কতজনকে মারবে তোমার ওয়াচম্যান, তোমার রিভলভার! তোমার পুলিশ আর তোমার কানেকশনস! তবু, কস্তুরী মেহতা তোমার চিন্তা, বেদনা দু-এক নিমেষের জন্য সরিয়ে রাখো। জীবনে, দৃশ্যে কিছু সুন্দরও আছে, অবকাশও আছে। ক্ষণিক বিরতির, বিস্মৃতির সুযোগ আছে। দু’হাত পেতে নাও।
সংকীর্ণ জি.টি. রোডের মধ্যে ইটকাঠ, বহুতল, বাজার, দোকানের সারি, ভিখারি এবং ইত্যাদি ইত্যাদি দেখতে দেখতে মনটা আবার খিঁচড়ে গেল। তা হলে কি পূর্বাঞ্চলের রাস্তাঘাট এত বছর পরেও সেই একই কুশ্রীতায় ভরে আছে! একই রকম দুঃখের আঁচড় কাটা, তার চেয়েও বেশি, শৃঙ্খলাহীন, কদর্য। তিনি শুধু প্রসাধন দেখে সমালোচনা করছিলেন বা মুগ্ধ হচ্ছিলেন। তাঁরই যদি ভুল হয় তাহলে আর সবার হবে না কেন? হয়তো বা এই দুঃখের আঁচড়ও সত্য। প্রসাধনও সত্য। দুই মেরুকে কি কোনওভাবেই কোনও মধ্যপথে মেলানো যায় না! রাজধানী এক্সপ্রেস নিউ দিল্লি স্টেশনের দিকে এগোচ্ছে। কামরার ভেতর থেকে দেখা যায় অকথ্য আবর্জনার স্তূপ, অসহ্য দুর্গন্ধ, চতুর্দিকে ছেঁড়া ন্যাকড়া-কানি ঝুলছে, মানুষেরই পরিধেয়। আর সেইসব শহরতলিতে যেসব বাড়ি দ্যাখা যায়, তাদের কুশ্রীতারও কোনও তুলনা নেই। দেশের রাজধানীই যদি এই হয়, তা হলে অন্যত্র আর ভাল কী হবে!
এইরকম ক্রোধ-শান্তি, আশা-হতাশার মধ্যে দুলছিল মেজাজ, ড্রাইভার বলল, এই আমরা পিলখানা দিয়ে চলেছি দিদি।
জিজ্ঞেস করো, জিজ্ঞেস করো, ব্যাপটিস্ট বেরিয়্যাল গ্রাউন্ড রোড কোথায়।
কেউ বলতে পারল না।
জেলেপাড়ার কথা বলছেন?
জেলেপাড়া, মেছোপাড়া, তাঁতিপাড়া কিছুই তিনি জানেন না। তাঁর ড্রাইভারও না। একবার মনে হল ট্যাক্সি করলেই বোধহয় ভাল হত। ওরা রাস্তাঘাট অনেক ভাল জানে।
অবশেষে একজন বৃদ্ধ লোক বললেন, ও রাস্তাটার নাম এখন শৈলেন্দ্র বসু রোড মা, অনেকটা চলে এসেছেন। একটু পিছিয়ে ডান দিকে বেঁকে যান বেরিয়্যাল গ্রাউন্ডটা দেখতে পাবেন। পাঁচ নম্বর? ও তো নিবেদিতা মুখার্জির বাড়ি। নামকরা স্বাধীনতা সংগ্রামী।
ওঁকে, ওঁকেই তো খুঁজছি— উত্তেজনায় কস্তুরীর চোখ ছলছল করতে লাগল। অবশেষে …।
ছোট একটা দোতলা বাড়ি। বেশ খানিকটা জায়গা নিয়ে বাগান। তার একদিকে প্রচুর গার্ডেন চেয়ার পরপর ডাঁই করা, কিছু টেবিলের লম্বা লম্বা কাঠ। এই রে! কোনও বিয়েবাড়ি-টাড়িতে এসে পড়লেন না কি?
দরজা খুলল একটি ফ্রক-পরা মেয়ে, তাঁকে দেখেই বলল— মেনু কার্ড আনছি। একটু দাঁড়ান। ভেজ, নন-ভেজের রেট সব লেখা আছে।
তিনি বললেন— এটা কি নিবেদিতা মুখার্জির বাড়ি?
এবার ফ্রকের পেছনে একটি শাড়ি দেখা গেল, মুখে রুক্ষতা।
—কাকে চাইছেন?
—নিবেদিতা মুখার্জি—
—আমার ঠাকুমা— মেয়েটি বলল।
—তুই চুপ কর, বউটি বলল। কী দরকার আপনার? জানতে পারি? কী নাম?
—কস্তুরী মেহতা, আমদাবাদে থাকি। এখানে এসেছিলাম। ছোটবেলায় চিনতাম ওঁদের। দেখা করতে এসেছি। —বলতে বলতেই কস্তুরী বুঝতে পারছিলেন একটু বেশি কৈফিয়ত দেওয়া হয়ে যাচ্ছে। এমনই রুক্ষতা বউটির যে তাঁর মতো কিছুই পরোয়া-না-করা মানুষের মুখ থেকেও জবাবদিহি বেরিয়ে এসেছে।
আবার প্রশ্ন এল— উনি কি আপনাকে চিঠি দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন?
—কেন বলুন তো? —এবার একটু চড়া হলেন কস্তুরী— আপনার কিছু অসুবিধে আছে? আমার ঠিকানাই ওঁর জানা নাই। চিঠি কী?
—না, তা নয়। বয়স হয়েছে তো, একটু সাবধান হতে হয়— জোঁকের মুখে নুন পড়েছে।
—আমার কোনও ইনফেকশাস ডিজিজ নাই— বিরক্ত সুরে বললেন তিনি।
—না, না, সে কী— আসুন …।
দোতলার উত্তর-পশ্চিমের একটা ছোট ঘরে পাত্তা পাওয়া গেল নিবেদিতা মাসির। রাস্তায় দেখলে চিনতে পারতেন না। হায় নিবেদিতা মাসি, আগুনের মেয়ে, আগুনের বউ, কোথায় তোমার সে উজ্জ্বল উচ্ছ্বাস! চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে আছে। বেশ শীর্ণ চেহারা, সাদা সবুজ পাড় একটা মিলের শাড়ি পরা। একটা কাঠের চেয়ারে বসে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কাজ করছিলেন।
বউটি দাঁড়িয়ে রইল। কস্তুরী নিজের নাম পরিচয় বললেন। নিবেদিতা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। চিনতে পারছেন না। কস্তুরী মেহতা? কিকি? কে? —বউটির দিকে তাকিয়ে বললেন— আবার কোনও নতুন চালাকি ধরেছ নাকি? মহিলা এনে আমাকে মিসগাইড করবার চেষ্টা করছ? —গলা বেশ কড়া।
দেখছেন তো কী রকম মাথা খারাপ … ওই জন্যেই …
মাথা খারাপ? আমার না তোমাদের? ওই ফুলচাঁদ একেবারে জোচ্চোর। ওর সঙ্গী-সাথী লাড্ডু, খোকন, বাচ্চু, সুবীর সব্বাই। ওরা পার্টির গুন্ডা তোমরা জানো না? নিজেদের পায়ে নিজেরাই কুড়ুল মারছ?
আপনি বকুন, আমি নীচে যাচ্ছি, কাজ আছে। বউটি পড়পড়িয়ে পালিয়ে গেল। তার গতিপথের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন উনি। উঠলেন, বাইরে গেলেন, সিঁড়ি কয়েক পা নামলেন, হাঁটুতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে উঠলেন। তারপর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন— যা আড়ি-পাতা স্বভাব! কিকি আজ আমার সঙ্গে খেয়ে যাবে। বুঝলে?
অবাক হয়ে মুখ তুলে চাইলেন কস্তুরী— আপনি আমায় …
নরেন্দ্র ভাইয়ের মেয়ে— চিনব না! কী যে বলো? সমস্ত মুখটা হাসিতে ভরে গেল। —কেমন আছ? তোমার কাজকর্মের খবর কিছু কিছু রাখি। অনেক ধন্যবাদ কিকি, মাসির কাছে আসার জন্যে।
—এরকম কেন? এঁরা! এসব কী?
—হবে না! ফ্রিডম-ফাইটার্স পেনশন পাই। তা দিয়ে নিজের খরচ পুরোপুরি চালাই। কেটারিং বিজনেস করে, তার ক্যাপিট্যালও অর্ধেক আমি দিয়েছি। এরা সব আমার মাসতুতো ভাইয়ের সংসার, আশ্রয় দিয়েছি। এরকম করবে না! কৃতঘ্নতাই মানবজাতির মূল চরিত্র কিকি, অকৃতজ্ঞতা নয়… একেবারে কৃতঘ্নতা। যে উপকার করেছে করো তার সর্বনাশ! কষে করো।… আমার তো নিজের সংসার নেই … নিশ্চয় জানো …
—আপনি বললেন তাই জানলাম … নইলে …
—তোমার মনে আছে কি মেসোমশাই কমিউনিস্ট পার্টিতে ছিলেন! পুলিশের গুলিতে মারা যান। ফিফটিজ-এর গোড়াতেই। তখন খুব ধরপাকড় চলছে। দু’জনেই নিজেদের মতো করে দেশসেবা করেছি, ছেলেমেয়ে হবার আর সুযোগ আসেনি। —চুপ করে রইলেন নিবেদিতা মাসি— এদের ডেকে আশ্রয় দিলাম, প্রোমোটারের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে বাড়িটি হাতাতে চাইছে। তবে তোমাকে নিশ্চিন্ত করার জন্য জানিয়ে রাখি, আমি বাড়িটি উইল করে ভারত সেবাশ্রম সংঘকে দান করেছি। উইল ওঁদের কাছে। দ্যাখো কিকি, সেবা ছাড়া তো আমাদের আর কিছুই করবার নেই। আমাদের নেতারা তো একটা দুর্ভিক্ষ-খরা-বন্যাপীড়িত দেশ ছাড়া কিচ্ছু দিয়ে যেতে পারেননি। পেটে খেতে পাবে, আশ্রয় প্রতি বছর ভেসে যাবে না, তবে তো তাকে বলতে পারি — শেখো, পড়ো, পৃথিবীর সঙ্গে নিজেকে যোগ করো। তাই আমার দিক থেকে, সেবাতেই আমি সবচেয়ে কৃত্য কাজ দেখি। আর্তত্রাণ। একটা বন্যা হল, চতুর্দিক থেকে কোটি কোটি টাকা এল, কেউ জানে না, সেসব কোথায় গেল! তার চাইতে যারা নিঃসংশয়ে কাজ করে, তাদের কাছেই আমার সামান্য টাকা যাক— থানায় ডায়েরি করে রেখেছি। এরা আমার ওপর মানসিক অত্যাচার করছে, মেরে ফেলতে পারে।
—একটু শিউরে উঠে কস্তুরী বললেন, সত্যিই কি সে ভয় আছে?
আছে। তবে কিকি, তোমার মাসি মরতে ভয় পায় না। দুঃখ কী জানো? দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে যেতে পারতাম তো দুঃখ ছিল না। যাদের স্বাধীন করেছি, তারা ষড়যন্ত্র করে আমাদের নিঃস্ব করতে চায়, মারতে চায়— এটাই অসহ্য লাগে। কী পরিহাস বিধাতার! ভাবো! আমরা কিছু নিইনি, যথাসম্ভব সাধারণ খেয়েছি, পরেছি। জেল খেটেছি, মিছিল করেছি, দিনে-রাতে কোনও অবসর ছিল না। আর এরা? আমাদের ত্যাগের ওপর সংগ্রামের ওপর ডিজনেস্ট ভোগের প্রাসাদ তুলতে চায়। এই আয়রনি সহ্য করতে পারছি না। আহত বাঘিনীর মতো ভয়ানক হয়ে উঠছি ক্রমশ! গড নোজ, হয়তো একদিন আমি এদের ফাঁসাব, সবাইকে …
—মাসি যা করবার তো করে রেখেছেন। আর কেন এইসোব …
—তুমি জানো না কিকি, আমি এমনভাবে আত্মহত্যার কৌশল বানাচ্ছি, যাতে এই ভাইপো, তার বউ, ওই প্রোমোটার, ওদের সবগুলো ফেঁসে যাবে।
—মাসি, এসব করবেন না, ভাববেন না প্লিজ।
কস্তুরী এগিয়ে এসে তাঁর শীর্ণ পিঠটাতে হাত রাখলেন, এবং নিবেদিতা সেই হাতটা তাঁর সামনে বুকের কাছে নিয়ে কাঁদতে লাগলেন। এবং এই সময়ে এই দৃশ্যে বউটি আবার এসে দাঁড়াল।
কস্তুরী মাসির মুখটা হাতের ওপর নরম করে চেপে রেখে বললেন, শেষ পর্যন্ত উনি আমাকে চিনতে পেরেছেন। আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারেন। যদি হাতে সময় থাকে তো বসুন না। ওনেক ওনেক সত্যি গল্প শুনাব। সেই সোময়কার।
—কোন সময়কার?
—সেই যোখন দেশ সোবে স্বাধীন হয়েছে, এই এঁরা কোতভাবে লড়েছেন … স্যাক্রিফাইস করেছেন।
মুখ বেঁকিয়ে বউটি বলল— এ বাড়িতে এসে ইস্তক তো শুনছি।
নিবেদিতা মুখ তুললেন, রাগে ও চোখের জলে মাখামাখি মুখ। বললেন, শুনেছ তো! কিন্তু বুঝেছ কি? মুখ্খু! তো যাও, সেইসব বোরিং গল্পই আমরা মাসি-বোনঝিতে করব আজ। ভাতে ভাত চাপাচ্ছি, যাও, রান্নার সময়ে অশুচিতা আমি সইতে পারি না।
মুখ কালো করে বউটি চলে গেল। কোনও কথা না বলে চাল ধুতে লাগলেন নিবেদিতা।
কিছুক্ষণ সব চুপ। তারপর শান্ত স্নেহমাখা গলায় বললেন, ভাতে ভাত খাবে তো কিকি?
—হ্যাঁ, খুব ভালবাসি। একটু দই আনব মাসি!
—ও তোমরা আবার দই ছাড়া খেতে পারো না। নিয়ে এসো।
কস্তুরীর মনে হল মাসির মেজাজ এখনও ঠিক হয়নি। তাঁর নিরাড়ম্বর জীবনযাত্রার সরলতা বুঝি একটু দইয়ের আঘাতে ভেঙে যাবে। তিনি বললেন, আমার কোনও ওসুবিদা নাই মাসি। কিন্তু আপনাকে আমার একটু খাওয়াতে ইচ্ছে করছে। কিচুমিচু, একটু সোন্দেশ, একটু দই। কোতদিন পোরে দেখা।
—আনো, তবে ভদ্রতা করে আবার পুরো ফ্যামিলির জন্য এনো না।
—কেন মাসি? ওঁরা কুশি হোবেন।
—ওরা খুশি হলে আমার কিছু সুবিধে হবে না কিকি। ওরা যেমন তেমনই থাকবে। মাঝ থেকে তোমার ভদ্রতা অপাত্রে নষ্ট। অপাত্রে নষ্ট’টা বুঝলে তো?
—বুঝেচি— আসলে কস্তুরী নষ্টটা বুঝেছিলেন। অপাত্রেটা আন্দাজে বুঝে নিয়েছিলেন। মোট কথা মাসি চান না তাঁর ভাইপো-ভাইপো বউয়ের সঙ্গে তিনি কোনওরকম ভদ্রতা করুন। আর তাঁর চাওয়ার ওপর তো কথাই নেই! কস্তুরীও সে রকম আপ্যায়নকেন্দ্রিক সামাজিকতার ধার ধারেন না। ট্যাক্সি-ডাইভারকে ভাল লাগলে রসগোল্লা কিনে দিতে পারেন। কিন্তু যে-কোনও আত্মীয় বা পরিচিতকে লাড্ডুর বাক্স উপহার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা তিনি স্বীকার করেন না। অতএব তিনি স্থানীয় লোকজনকে জিজ্ঞেস করে দই আর ভাল সন্দেশ কিনলেন, বেশ কিছু ফল। একটু দেরিই হল ফিরতে। ততক্ষণে মাসির রান্নাও শেষ।
গলা ভাতের ওপর মাখন ছড়িয়ে দিয়ে আলু কাঁচালঙ্কা-ডালভাতের ভোজ চমৎকার হল। দইটাও চমৎকার। কিন্তু নিবেদিতা মাসি এত মিষ্টি আর ফল দেখে ভীষণ রাগ করলেন। সত্যি রাগ।
দ্যাখো কিকি, আমার ভাগ্য আর আমার সরকার আমাকে যেটুকু খেতে দিচ্ছে তার বেশি আমার দরকার নেই।
—বেশ এগুলো তা হলে আমি নিয়ে যাচ্ছি— কস্তুরী গম্ভীর, অভিমানী মুখে বললেন।
—ওই দ্যাখ অমনি রাগ হয়ে গেল। আচ্ছা আচ্ছা বাবা, রাখছি, ফল মিষ্টি সব তোমার রাখছি।
কস্তুরী মনে মনে একটু হেসে নিলেন। যাই বলো আর তাই বলো নিবেদিতা মাসি, তুমি আর সেই তুমি নেই। আগুনের মেয়ে, আগুনের বউ, তাতে অভিমানের নোনা জল পড়ছে, একটু একটু করে নিবছ। অত সম্ভ্রমের বাড়াবাড়িও এক ধরনের আগুন, কিন্তু সে-ই পুরনো উদ্দীপনার ইতিবাচক আগুন নয়। ডিপ্লোম্যাসি দিয়ে তোমাকে ভোলাতে হয়। বড়রা ছোটদের ভোলায়, যেমন একদিন তোমরা আমায় ভুলিয়েছিলে, আজ আমার পালা। আমি তোমাদের ভোলাব।
—নরেন্দ্রভাই কেমন আছেন? নিবেদিতা মাসি ঘরের তক্তপোশটার ওপর বসে বললেন।
সামনে একটা লাল রঙের মোল্ডেড চেয়ার। কস্তুরী সেখানে। এতক্ষণে খবরাখবরের পুঙ্খানুপুঙ্খ।
—তোমার কী মনে হয় মাসি, বাবা কেমন থাকতে পারেন!
অন্যমনস্ক স্বরে মাসি বললেন— ভালই। বয়স হয়েছে, কিন্তু যৌবনের ব্যায়াম করা শরীর, বাজে নেশা-ভাঙ নেই, অর্থ-কষ্ট নেই, কাজের চাপ আছে অবশ্য বেশ। এবং কিকিকে নিয়ে দুশ্চিন্তা। এইগুলোয় কাটাকুটি হয়ে শরীর ভাল আছে, মন ভাল নেই।
—আমার জন্য আবার চিন্তা কী?
—এই, কিকিটা বিয়ে করল না। হাঙ্গাম-হুজ্জুতে জড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ।
কস্তুরী বাবার প্রয়াণের খবর ভাঙলেন না। তাঁর স্বামী যে দু’বছরের মধ্যে মারা যান, সে খবরও না। বললেন, মাসি, তোমরা যারা সোর্বস্ব পোণ করেছিলে তাঁদের মুখে এমোন কথা মানায় না।
মাসি হাসলেন, বললেন, কিকি, তুমি কি এখনও বোঝে না, মানুষ কিন্তু আদতে স্বার্থপর, তার চেয়েও বেশি আত্মপর। পাবলিক ক্যালামিটি ইজ এ মাইটি লেভেলার। তাই গোটা দেশের মানুষের ওপর যখন সংকটের খাঁড়া নেমে এসেছিল, তখন কিছুদিনের জন্য তারা একত্র হয়েছিল। খাঁড়া সরে গেল, সব আবার যে যার ছোট্ট গর্তে। কেউ আর তার বাইরে দেখতে পাচ্ছে না। চাইছেও না। আমার ছেলে কেন লাখ টাকা উপার্জন করবে না, আমার মেয়ে কেন একটা ভাল বিয়ে করে ঘর-সংসার করবে না, কেন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াবে …
শেষ দুপুরের জানলা দিয়ে হঠাৎ দমকা হাওয়া হুটোপাটি করে ঢুকে পড়ল। এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল কাগজপত্তর। মাসি তাড়াতাড়ি উঠলেন।
—কাগজগুলো ড্রয়ারে ঢোকাও, ড্রয়ারে ঢোকাও, জানলা বন্ধ কোরো না। মাসি চেঁচিয়ে উঠলেন। জানলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিবেদিতা মাসি ঈষৎ ভাঙা গলায় গেয়ে উঠলেন …
আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে ডালে
ঝড় নেমে আয় আয় …
দমকা মনে পড়ে গেল হারানো সুর। দোতলার বড় ঘর। শতরঞ্চি পাতা, কয়েকটা তাকিয়া। জড়ো হয়েছেন অনেক চেনা, আধো-চেনা মুখ। এগুলো সাধারণ সভা, অনেক সময়ে ঘর ছাড়িয়ে বাইরের দালানে, সিঁড়িতে পর্যন্ত লোক জমে যায়।
তোমার বাঁধন যতই শক্ত হবে, মোদের বাঁধন টুটবে।
সেটা বোধহয় তেইশে জানুয়ারি— সুভাষচন্দ্রের জন্মদিন ছিল। গান হল।
কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ জ্বালিয়ে তুমি ধরায় আসো
সাধক ওগো, প্রেমিক ওগো, পাগল ওগো ধরায় আসো।
আরও কত গান কত সুর মনের মধ্যে তালগোল পাকিয়ে আছে। তাদের এই আধো-স্মরণে কী যে একটা অদ্ভুত সুগন্ধ। যেন কোথা থেকে, কত দূর থেকে, কত কাল আগে থেকে ভেসে আসছে এই সুরভিত সুর। শুধু তাঁদের ছোঁবে বলে। ছুঁয়েই তার কাজ শেষ। আর সে দাঁড়াবে না। বয়ে যাবে, উধাও হয়ে যাবে। এখন তুমি যদি তার মানে বুঝলে, তো সে চিরদিনের মতো তোমার মধ্যে বসে গেল। ভেতর থেকে ঠেলা দিতে লাগল মাঝে মাঝে, মাঝে মাঝে আবার বুঁদ করে রাখল, যেমন নিবেদিতা মাসিদের ক্ষেত্রে হয়েছে। ‘আয়রে আমার শুকনো পাতার ডালে ডালে ঝড় নেমে আয় আয়—’ এ শুধু গান নয়, গানের মধ্যে দিয়ে এখনও সেই যৌবনের বিশুদ্ধ ঝড়কে উনি ওঁর বয়সের শুকনো ডালে আহ্বান করে চলেছেন। সম্ভবত আমৃত্যু চলবেন। ঝড়ের জন্য তাঁর প্রার্থনা ছড়িয়ে যাবে আরও কত মানুষের মধ্যে যাঁরা এখনও শুদ্ধ আছেন, সত্য আছেন, কিন্তু ঝড় জানেননি, কাকে বলে প্রণোদনা এখনও বোঝেননি।
আর তুমি যদি শুধু মুগ্ধ হও, তাকে চলে যেতে দাও, তাহলে সেই অলস মুগ্ধতার দাম তোমাকে দিতে হবে সারা জীবন ধরে। গানকে যাঁরা শুধু সাময়িক বিলাস বলে নেন, তাঁদের এই দাম দিতে হয় সারাজীবনের অচেতনায়। কস্তুরী খুবই আবেগবর্জিত, কেজো মানুষ। কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর মনে হয় আগুন যদি তাঁর আহুতি নিত! যদি দিতে পারত সেই যজ্ঞফল যার জন্য একদিন সংকল্প করে আসনে বসেছিলেন তাঁর পিতৃপুরুষেরা!
আমার মা কোথায় মাসি? —এতক্ষণে হয়তো ওই সাধক, প্রেমিক, পাগলের ‘প্রোচোদনা’তে, ‘ওই ঝড় নেমে আয়’-এর প্রার্থনাতেই তিনি প্রশ্ন করলেন।
নিবেদিতা মাসি চুপ করে রইলেন। অনেক পরে বললেন…
আমি তো আর কল্যাণী মেহতার খবর রাখি না, সেই থেকেই …
কেমন যেন একটা খটকা! আমি তো আর কল্যাণী মেহতার খবর রাখি না। কল্যাণী মেহতা? নিবেদিতা মাসি মাকে কল্যাণীদি বলতেন না? খবর ‘রাখি না’? ‘জানি না’ নয়?