উজান যাত্রা (Ujan Jatra) : তিনি
রাত্রে গভীর ঘুম হয়েছে। সারাদিনের ক্লান্তি, চমৎকার একটি চান, এবং একটা নিশ্চিন্ততা। যেন অনেক অনে-ক দিন নির্বাসিত ছিলেন। এত দিনে বাড়ি ফিরলেন। এই বাড়ির প্রতিটি কোণ তাঁর প্রিয়, খুঁটিনাটি সব চেনেন, মনে আছে। একটাই অসুবিধে। তিনি ঘুমিয়েছেন ছ’ বছরের একটি বালিকার মতো, পঞ্চান্ন বছরের অভিজ্ঞ এক বয়স্ক মানুষের মতো নয়। এরকমটা যে হতে পারে তা কি তাঁর ধারণায় ছিল? ছিল না। কেননা যতক্ষণ তিনি আমদাবাদে, সুরতে, ততক্ষণ তিনি কস্তুরীবেন, কস্তুরী মেহতা। কিন্তু কলকাতায় পৌঁছোবার সঙ্গেসঙ্গে টাইম-মেশিন তাঁকে সঙ্গে নিয়ে পেছনের দিকে ছুটেছে। সত্যি বলতে কি ঘুমের মধ্যে তাঁর যেটুকু চেতনা ছিল সেটা কিকির চেতনা, কস্তুরীর নয়। ঘুমটা যখন ভাঙব-ভাঙব করছে, কেমন একটা অস্বস্তি লাগছিল। যেন অনেকখানি জায়গা জুড়ে শুয়ে আছেন। পাটা যেখানে শেষ হয়েছে তার পরেই শূন্য। তা ছাড়া, কই পাশেও তো কেউ নেই! তার পরেই খেয়াল হল এ সবরমতীর তীরে শাহিবাগের নতুন শ্বেতপ্রাসাদ নয়। শাহপুরের দুর্গবাড়িও নয়। অন্য কিছু। দপ করে মনে পড়ে গেল।
ভোরবেলাগুলো আগের মতো আছে কিনা বোঝবার জন্যে তিনি বিছানায় শুয়ে শুয়েই সজাগ হয়ে রইলেন। চোখ বুজে। বোজা চোখের জগৎ আর খোলা চোখের জগৎ একেবারে আলাদা। তাঁর ব্লাইন্ড স্কুলের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সঙ্গে থাকবার ফলেই হয়তো ভিন্ন ভিন্ন ইন্দ্রিয়ের নিজস্ব কার্যকারিতা সম্পর্কে তাঁর এমন একটা পরিষ্কার ধারণা হয়ে গেছে। দৃশ্য নেই, ধ্বনি আছে, গন্ধ আছে, স্পর্শও আছে। খড়খড় করে কিছু একটা যাবার শব্দ। কী এটা! হাতে-ঠ্যালা গাড়ি নিয়ে জমাদার হতে পারে, কর্পোরেশনের গাড়ি যায় ছড়ছড় করে জল ফেলতে ফেলতে, রাস্তা ধুয়ে যায়। আবার এ-ও দেখেছেন সাইকেলে একগাদা দুধের ক্যান নিয়ে দুধওলা চলেছে। ভেতরে দুধ ছলকাচ্ছে তার আওয়াজ। সাইকেলে বাহিত হয়ে যাবার ফলে একটা অনির্দেশ্য শব্দময় গতির আওয়াজ। কোনটা? জানতে হলে বারান্দায় গিয়ে ভোরের কলকাতার প্রাচীন, বালিকা রাস্তায় চোখ রাখতে হবে। কেমন একটা রোমাঞ্চ হল। কোনটা হলে তাঁর ভাল লাগবে? খুব আশ্চর্য হয়ে দেখলেন জমাদারের গাড়ির আওয়াজটাই তিনি শুনতে চাইছেন। কেন? কেননা স্মৃতির রাস্তায় ওই আওয়াজটাই রয়ে গেছে। এ মহানগর জঞ্জাল পরিষ্কারে ধ্যান দিচ্ছে কিনা জানতে তাঁর আগ্রহ নেই। হঠাৎ তিনি নির্ভুল ঘ্রাণ পেয়ে যান— গন্ধরাজের। আবারও গায়ে কাঁটা দিল। ওটা কি সত্যিই আছে? না, স্মৃতির অতলে যেখানে মাটি পেয়েছে সেখানেই শেকড় গাছটার? তার ঘন সবুজ পাতা, শুভ্র থোকা থোকা ফুল, হৃদয় মন আর্দ্র করা সুগন্ধের।
আর থাকতে পারলেন না। কাল রাতে অত খেয়াল ছিল না, তখন ভিড়, ঘাম, ময়লা, রুদ্ধগতি, গাড়ির কালো ধোঁয়া, বাড়ি পৌঁছোবার তাড়া, দুটি নতুন সময়ের নতুন মুখ এবং ক্লান্তিও। নিশ্চয়! কে বলেছে তাঁর ক্লান্তি নেই! তবে হ্যাঁ, চট করে প্রকাশ করেন না। সহ্য করবার ক্ষমতা, মনোবল এসব তাঁর উত্তরাধিকার।
শাড়ির আঁচলটা গায়ে টেনে তক্তপোশ থেকে নামলেন, চটিজোড়া পায়ের আন্দাজে পরতে গিয়ে পেলেন না। খালি পায়েই বারান্দার দরজা খুললেন আর অমনি ‘হ্যালো’ বলে অভ্যর্থনা জানাল হাওয়া। হাওয়ার কোনও নতুন পুরনো নেই। গ্রাম-শহরের চেহারা বদল হয়। সভ্যতার চালচলন বদলে যায়। হাওয়া বদলায় না। সেই চির-পুরাতন, চির-নতুন হাওয়া তাঁকে দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল। হাওয়ার বুকের মধ্যে স্থির হয়ে রইলেন তিনি যেন বহুদিন পরে ধরা পড়েছেন প্রিয়জনের আলিঙ্গনের মধ্যে। কিন্তু তারপর গন্ধ তাঁকে আবার উতলা করে দিল। বারান্দার রেলিংপটিতে হাত রেখে তিনি ভয়ে ভয়ে ডান দিকে তাকালেন। আশ্চর্য! ঠিক মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে গন্ধরাজ বৃক্ষ। পাতাগুলো ঘন সবুজ, ফুলে ভরা। ঠিক যেন ছোট ছোট পাখির ছানা পড়েছে গাছটাতে। পরিযায়ী বকেদের সদ্যোজাত ছানাদের সঙ্গে অল্প দূর থেকে দেখা ওই ফুলগুলোর আপাতদৃষ্টিতে কোনও তফাত নেই। কিন্তু কী যে সুবাস বয়ে আনছে—টাটকা। হাস্নুহানার মতো তীব্র নয়। কেমন মগ্ন করা। গন্ধরাজের সুবাস-সায়রে এক ডুব, দুই ডুব দিয়েই দুঃখিনী কিকি পৌঁছে যায় বাহান্ন-তিপ্পান্নর-চুয়ান্নর কলকাতায়। তখনও ছিল এই গভীর সুবাস, ভোরবেলার ওই খড়খড় শব্দ!
একটু আগেই ধোয়া হয়ে গেছে রাস্তা, জমাদার চলেছে। সন্ধেবেলা কর্পোরেশনের যেসব বাতিওলা গ্যাসের আলো জ্বেলে দিয়ে গেছে, এখন তারা লম্বা মই কাঁধে বাতি নিবোতে নিবোতে যাচ্ছে। গাছে গাছে ভরা রাসবিহারী। সন্ধেবেলা বাসা-ফিরতি পাখির কাকলিতে ঝরনার মতো একটা আওয়াজ হচ্ছে। ছেড়ে ছেড়ে বাড়ি। ট্রামরাস্তা চলে গেছে ভীষণ একটা বিস্ময়ের পথ হয়ে। কোথায় গেছে পথটা? দিল্লি? ‘দিল্লি চলো’ কথাটা মাঝে মাঝেই শোনা যেত কিনা! দিল্লি একটা লক্ষ্যস্থল। আবার পথটা বিলেতেও গিয়ে থাকতে পারে। যেখানে বিলিতি সাহেবরা সব তাড়া খেয়ে চলে গেছে। মাঝে যে সমুদ্র আছে, অতশত মনে পড়ত না। সমুদ্রটা কী, তাই-ই জানা ছিল না তো!
ফার্ন রোড চিরকালই সরু। সরু সরু শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে গেছে বলেই কি নাম ফার্ন রোড? ভোরবেলা বাবা-মা’র সঙ্গে লেকে যাওয়া একটা মস্ত আনন্দের ব্যাপার! বাবা-মা পেছনে পেছনে। সামনে লাফাতে লাফাতে চলেছে কিকি। ওইখানেই সে পাটকিলে রঙের কুকুর কুৎরাকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। ধুঁকছিল ছানাটা। একটু বড় হয়েই অবশ্য তার বিরাট বন্ধুবান্ধবের দল হয়ে গিয়েছিল। বখা কুকুরগুলোর ডাকে সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে যেত। কিকির বকুনিতে কান না দিয়ে। তবে রাস্তায় তাদের কাউকে দেখলেই এমন বাঁইবাঁই লেজ নাড়ত যে মনে হত লেজটা উপড়েই যাবে বুঝি বা! খাওয়ার সময়েও তিনের একের সামনে ঘুরঘুর করত। তবে তিনতলার সিঁড়ি বেয়ে ওঠার তার উপায় থাকত না। দারোয়ান দুরদুর করে তাড়িয়ে দিত। বাচ্চাবেলার কুৎরার ডাকটা তিনি ক্ষীণস্বরে শুনতে পেলেন। কত দূর থেকে ডাকছে কুৎরা? কাকে ডাকছে?
সেই ডাকেই কি বেবি-ফ্রক পরা বালিকাটি বেরিয়ে এল? বাবা তো হুশ করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। পাশে বসে শরদকাকা। ওটা ছিল একটা পুরনো মরিস মাইনর। বাবা কিকিকে বলেছেন এর পরে একটা স্টুডিবেকার, তারপরে? তারপরে একটা ডেমলার। রোলস রয়েস রাক্ষুসে তেল খায়, দেখতেও কেমন বিদঘুটে মতো। বাবার পছন্দ নয়। কিকিরও পছন্দ নয়। সে অবশ্য ডেমলার বা রোলস রয়েস কিছুই দ্যাখেনি, তবু বাবার যা পছন্দ, তারও তাই-ই পছন্দ। বাবা তাকে চুপিচুপি বলেছেন, আমদাবাদে দুটো গাড়ি আছে— একটা বুইক আর একটা স্টুডিবেকার। বাড়িটা অনেক বড়, সুন্দর। কত আসবাবপত্র!
মা বেরিয়ে এলেন। ডুরে শাড়ি, মাথার ঘোমটা খসে পড়ে গেছে। সরু সিঁদুরের রেখা; মায়ের হাতে পল কাটা কাটা সোনার চুড়ি, হাত নাড়লেই ঝিকঝিক করত। ঘুমোবার সময়ে সে চুড়িগুলো নিয়ে খেলা করত। তবে গলার হারটার ওপরই বেশি লোভ ছিল কিকির। সেটাও চিকমিক করত। মায়ের মুখটা মনে করতে গিয়ে শুধু সোনার চুড়ির ঝকমকানিটাই মনে পড়ল! চুড়ি, হার, দুল। তবে কি সোনাই মাকে হারিয়ে দিল?
গান্ধী-টুপি খদ্দরের ধুতি পরা বা না পরা কত লোক আসছেন বিকেল হতে না হতেই। সুধাকাকা, রবিজ্যাঠা, অজিতবাবু, নিবেদিতা মাসি আর মেসো, রমাপিসিমা, স্নেহকাকিমা, আত্রেয়ীদিদি, রবিনদাদা। কত। কত! মা একটা বিরাট ডেকচিতে চা চাপিয়েছেন। একটা পেল্লাই অ্যালুমিনিয়মের কেটলিতে সেই চা ছাঁকা হল। সবাইকার মাঝখানে মা বসিয়ে দিলেন কেটলিটা। অনেক মাটির ভাঁড়। বাইরে থেকে আলুর চপ কি বেগুনি, কিংবা কচুরি এসেছে। এক গামলা মুড়ি। খেতে গিয়ে কিকি দেখে উঃ কী ঝাল! কী ঝাল! মা বলছেন, তোমার মুড়ি আলাদা বাটিতে মেখেছি সোনা। এই যে! গমগম করে আলোচনা চলছে। বাবা আর শরদকাকাও আছেন। একটু পরেই দু’জনে বেরিয়ে গেলেন। কারবার আছে। কুৎরাকে নিয়ে কিকি খেলা করছে। বল নিয়ে, ছোটবেলাকার ঝুমঝুমি নিয়ে। ঝুমঝুমিটা মুখে করে আনছে ছোট্ট মিষ্টি মতন কুৎরা। ঝুমঝুম, ঝুমঝুম করে শব্দ হচ্ছে। হঠাৎ কস্তুরীর মনে হয় তাঁর জগৎ প্রধানত গন্ধময়। তারপরেই আসে শব্দ; তারপরে স্পর্শ, শেষে রূপ। কেননা তিনি তাঁদের দ্বিতীয় গাড়ি বুইকটার চেহারা মনে করতে পারছেন না। মায়ের মুখটাও না। কিন্তু মাতৃগন্ধ এখনও কোনও কোনও সময়ে তাঁকে উতলা করে। স্পর্শটা রয়েছে আরও গভীরে, ঘুমের মধ্যে পান, আঁকড়ে ধরতে গেলে উবে যায়। কুৎরার ডাকটা শুনতে পাচ্ছেন, মনে পড়ছে তার পাটকিলে রংটা, এবং যেহেতু সে অতি সাধারণ গড়পড়তা একটা নেড়িকুকুর যাদের রাস্তায়-ঘাটে দেখাই যায়, তাই হয়তো এখনকার কোনও পথকুকুরের আদলের ওপর পাটকিলেটা চাপিয়ে তিনি কুৎরাকে গড়ে নিচ্ছেন। তার হয়তো আলাদা কোনও ব্যক্তিত্ব ছিল, স্বরূপ ছিল, তিনি বুঝতে পারেননি। সুধাকাকা, রবিজ্যাঠা, নিবেদিতা মাসি এঁরাও সব যেন জল পড়ে ধেবড়ে যাওয়া ছবি। কতকগুলো অদরকারি তথ্য মনে পড়ছে, কে কীভাবে শাড়ি পরতেন, কার আসা-যাওয়ার ভঙ্গিটা কেমন।
খালি অজিতবাবুকে দপ করে পুরোটা মনে পড়ে গেল। কাঁচা পাকা দাড়ি বুক অবধি। তিনি সেটাতে প্রায় সবসময়ে হাত বোলাতেন। একটা মুদ্রাদোষ। সে জিজ্ঞেস করত— অজিতবাবু, দাড়িটা কি তোমার কুৎরী?
কেন? কেন?
সবসময়ে আদর করো যে!
গোঁফদাড়ির মধ্যিখানে অজিতবাবুর কালচে লাল ঠোঁট হাসছে। গেরুয়া পাঞ্জাবি সমেত মোটাসোটা শরীরটা দুলে দুলে উঠছে। সবাই হাসছে। কিকি একটুও অপ্রতিভ নয়। বাবা বললেন, কিকি এখন তুমি ওপরে গিয়ে ছবির বই দেখো। হ্যাঁ আরও ছবির বই এনে দেব তোমাকে।
সে বুঝতে পারে, তার অজিতবাবু ডাকটা বাবা পছন্দ করছেন না। মা- ও দু-একবার শোধরাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আর সবাই ডাকটাতে খুব মজা পেত। অজিতবাবু নিজে তো বটেই। ঘরসুদ্ধ সবাই ভীষণ আপত্তি করে ওঠে। কিকির বাচ্চা গলার ‘অজিতবাবু’ ডাক প্রতিদিনের সভায় একটা কমিক রিলিফ।
রামলাখন দোকান থেকে ধোকলা কিনে এনেছে। দুধ ফুটিয়ে এনেছে। এই বাড়িতে রান্নাঘর আছে, কিন্তু উনুন নেই। শুকনো খাবারদাবার কিছু কিনে আনতে হবে। ফলটল। কিন্তু রান্না খাবারের জন্য রামলাখনের ওপরই নির্ভর করতে চাইছেন তিনি। কেরোসিন স্টোভ একটা কিনে এনে, কেরোসিনটিন দিয়ে রেডি রাখতে বলেছেন। তবে সেটা হঠাৎ কোনও দরকার পড়লে। এমনিতে এই-ই বেশ!
খাওয়া শেষ করে রামলাখন বাসন নিয়ে বেরিয়ে গেলে একটা পুরনো ডায়েরি বার করলেন তিনি ব্যাগ থেকে। মহামূল্যবান ডায়েরি। বহুব্যবহারে জীর্ণ। কিন্তু বাবার হাতে, মায়ের হাতে লেখা অজস্র নাম ঠিকানা টেলিফোন নম্বর লেখা। যেগুলো বিশেষ করে চাইছেন, দরকার, সেগুলোতে ফোন নেই। কবেকার ঠিকানা সব। কে জানে এখনও এই ঠিকানায় ঠিক লোক থাকে কিনা। থাক বা না থাক, তাঁকে তো চেষ্টা করতেই হবে। তাড়াতাড়ি চানটান সেরে তৈরি হয়ে নিলেন তিনি। একবার মনে হল—ওই ছেলেটি? কী যেন নাম? কাজল? কাজলকে সঙ্গে নেবেন? সুবিধে হত। নাঃ, কালকে অতক্ষণ সময় নিয়ে নিয়েছেন ছেলেটার। আজ ডাকলে ওর কাজের ক্ষতি হবে। কোথাও নিশ্চয় কাজটাজ করে। তিনি ডাকলে না করতে পারবে না। ঠিক হবে না। তা ছাড়া কস্তুরী মেহতা কবেই বা কার সাথ সঙ্গতের পরোয়া করেছেন!
রামলাখনকেই জিজ্ঞেস করলেন, বোসপাড়া লেন কীধর হোগা মালুম হ্যায়?
বাউস পাড়হা? জরুর মাজি! গড়িয়াহাট সে এক ট্যাক্সি লে লিজিয়ে, উসকো বোস পুখখর জানে কো বোল দিজিয়ে। পতা আপ কি পাস হ্যায় তো উধার হি মিল জায়েগা। উও যো বিজুয়ান পুল হ্যায় না? উস কি বগল মে।।
সত্যি কথা বলতে কী কীভাবে কোথায় পড়বেন তাঁর এইবার একটু গুলিয়ে যাচ্ছে। বাড়ির দরজায় ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়ালে কোনও অসুবিধে ছিল না। কিন্তু রামলাখন পরম আস্থাভরে তাঁকে গড়িয়াহাট দেখিয়ে দিয়েছে, কোন না কোন বিজুয়ান পুল দেখিয়ে দিয়েছে। কী করেন? রাস্তায় বেরিয়ে এক মিনিট ভাবলেন। কাল বাড়ি আসবার সময়ে রামকৃষ্ণ মিশনের মস্ত বিল্ডিংটা চোখে পড়েছিল, ওই দিকেই চললেন। মিষ্টির দোকান রয়েছে। গোলপার্ক।
মোড়ে বেরিয়েই চোখে পড়ল বিল্ডিংটা। রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অফ কালচার। সামনে একটা পুতুলের মতো বিবেকানন্দর মূর্তি। অনেকক্ষণ চেয়ে রইলেন। বিবেকানন্দর মূর্তির মধ্যে বিবেকানন্দকে দেখতে পেলেন না। ইনস্টিটিউটটা তার লম্বাচওড়া ভারিক্কি চেহারা নিয়ে তাঁকে বলতে লাগল— বোসপুকুর চেনো না? গড়িয়াহাট রোড চেনো না। শ্যামবাজার চেনো না, বিজন সেতু চেনো না, আমাকে চেনো না, বিবেকানন্দকে চিনতে চাও? জান না, যত বয়স হয় মানুষ ছোট্ট থেকে আরও ছোট্ট হয়ে যায়! দেড়শো বছরের কাছাকাছি বয়স হল না ভদ্রলোকের? রবীন্দ্রনাথের থেকে মোটে দু’ বছরের ছোট। তার ওপর বিংশ শতাব্দী দেখতে না দেখতে কেটে পড়েছেন। আর থাকেন? এ তো তবু পুতুল!
একটা মিষ্টির দোকানে জিজ্ঞেস করলেন, বোসপুকুর কোথায়?
ট্যাক্সিকে বলুন দিদি, বিজন সেতু পার হয়ে কসবা, তারপর বোসপুকুর। সবাই চেনে, দারুণ ঠাকুর হয়— শিশি-বোতল, শনের দড়ি…দেশলাই…বিস্কুট…।
কেমন অবাক হয়ে তিনি একটা ট্যাক্সি ধরলেন। শিশি বোতল, শনের দড়ি…দেশলাই?
—চিনো? বোসপুকুরে বোসপাড়া লেন? যেতে পারবে?
—কেন পারব না, কলকাতা আমার হাতের পাতার মতো চেনা। বোসপুকুর যখন আছে তখন বোসপাড়াও থাকবে। একটু খুঁজে নিতে হবে আর কী!
আরে! এই তবে বিজন সেতু? বাঁয়ে একডালিয়া পড়বে না? কর্নফিল্ড রোড? ডাইনে বালিগঞ্জ স্টেশন! কী চমৎকার গাছগুলো! রাধাচূড়ায় এখনও ফুল আছে। কৃষ্ণচূড়ার ঝিরিঝিরি পাতাগুলো চমৎকার সবুজ। কাঁপছে। দুদিকে বড় বড় বাড়ি!
বললেন, বাঃ, এসব তো নতুন নতুন বাড়ি দেখছি!
ড্রাইভার বলল, আপনি নতুন, না? এসব জায়গা নতুন ডেভেলপ করছে। সব তো জলজঙ্গল ছিল। এখনই কী দেখছেন, বাইপাসে গিয়ে মিশবে রাস্তা। কত বড় বড় হাসপাতাল। একেবারে যেন বিলেত আমেরিকার মতো। হাসপাতাল, কী হোটেল, বুঝতে পারবেন না দিদি!
কিন্তু কলকাতা হাতের পাতার মতো চেনা ড্রাইভারটি কোনও বোসপাড়া লেন খুঁজে পেল না। পুকুরের পাশ দিয়ে, খোলা জমির পাশ দিয়ে দিয়ে সরু সরু রাস্তা, ঝকঝকে নতুন বাড়ি, কিন্তু না আছে রাস্তার নাম, না কোনও হদিশ! অনেককে জিজ্ঞেস করেও কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না।
শেষ পর্যন্ত আর এক ট্যাক্সি-ড্রাইভারই বলল, বোসপাড়া লেন তো নর্থে, বাগবাজারে, বুদ্ধু আর কাকে বলে?
বেচারি ডাইভার অপ্রস্তুত। —যাবেন দিদি? এখান থেকে অনেক ভাড়া পড়ে যাবে কিন্তু। তারপরে…মানে…আমি তো চিনি না ঠিক। এইরকম ঘুরব আবার।
তুমার ঘুরতে ইচ্ছা করলে চোলো, আমার অসুবিধা নাই। —বলে কস্তুরী সিটে হেলান দিয়ে দীর্ঘযাত্রার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। একটা ট্যাক্সি, তার থেকে আবার আর একটা ট্যাক্সি, এত ঝামেলায় কাজ কী! পৌঁছোনো নিয়ে কথা।
বাগবাজার! তার মানে তিনের একে পরস্পরের সঙ্গে আলোচনার জন্য সুদূর উত্তর থেকে অজিতবাবুরা আসতেন। একদিন দু’দিন ছাড়াই সভা বসত। কয়েকটা ঠিকানা দেখে তিনি বুঝতে পারছেন কোন অঞ্চলে। যেমন বেহালা, শিবপুর, হাওড়া, কিন্তু কলকাতা ৫, ৬, ১২—দেখে তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। তখন এই একডালিয়াই ছিল দক্ষিণের শেষ সীমানা। কসবা অঞ্চলে নিশ্চয়ই মানুষের বসবাস ছিল, কিন্তু সে কেমন তাঁর জানা নেই। জামির লেন মনে আছে খুব। জাদুকর পি. সি. সরকারের বাড়ি। বাবার সঙ্গে গিয়েছিলেন একবার। উনি তাসের ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। কিন্তু এই মেয়েটি যেখানে গেল—লেক গার্ডনস, ছেলেটি যেখানে গেল— সল্টলেক করুণাময়ী—এসব তাঁর জ্ঞানের বাইরে। পরে হয়েছে। ছোটবেলার সেই কলকাতাকে সবচেয়ে ভাল চেনা যায় তার ট্রামে। আর তার লেকে। ছুটির দিনে সারাদিনের টিকিট কিনে বাবা কয়েকবার কলকাতা ঘুরিয়েছিলেন। ময়দানের পাশ দিয়ে চলেছে ট্রাম। একদিকে অথই সবুজ। অনেক জায়গাও চিনিয়ে দিয়েছিলেন। টিপু সুলতানের মসজিদ, পার্ক স্ট্রিটের কবরখানা। জোড়া গির্জা, কলেজ স্কোয়্যার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি কলেজ। অনেক কিছুই মনে নেই। বউবাজার, শেয়ালদা, শামবাজার। মা বলতেন, আসলে বহুবাজার, হু লিখতে শেখা হল, শিয়ালদহ, শ্যামবাজার, য-ফলা শেখা হল। এগুলো কিছুই ভোলেননি।
হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল কলকাতার গন্ধটা কেমন বদলে গেছে। আবারও সেই গন্ধ দিয়ে চেনা। একটা কেমন বিশ্রী পোড়া পোড়া গন্ধ জ্বলজ্বলে রোদের ঝাপটার সঙ্গে নাকে আসছে। জ্বালা করছে নাক-চোখ। চারপাশে ঠিক দুর্গাপুজোর মতো ভিড়। বড় বড় উড়ালপুল, আকাশছোঁয়া বাড়ি সব। খুব আধুনিক, জায়গায় জায়গায় গ্ল্যামারাস! হঠাৎ যেন কলকাতার খুব টাকাপয়সা হয়ে গেছে। আশ্চর্য! তাঁর ছোটবেলার দেখা দিল্লি কেমন আমূল পালটে গেল, পালটে গেল আমদাবাদ। ওল্ড আমদাবাদের দেওয়াল ক্রমে ভেঙে ভেঙে মিশে গেল মাটির সঙ্গে। নতুন নতুন ব্রিজ হল সবরমতীর ওপর, প্রীতম নগর, উসমানপুরি, বিদ্যাপতনগর কত এলাকা গড়ে উঠল। তিনি কি আশা করেছিলেন কলকাতা পঞ্চাশ বছর আগে থমকে থাকবে? এক প্রৌঢ়ার মনের শৈশবস্মৃতির ফসিল! গাছের ছায়ায় স্নিগ্ধ গলি। ঝকঝকে ধোয়া রাস্তা, খালি জায়গায় জায়গায় বাড়ির জঞ্জালের ছোট ছোট স্তূপ, যেগুলো জমাদার রাস্তা পরিষ্কার করে যাবার পরে পড়ত। মা খুব রাগারাগি করতেন। ঢং ঢং ভোরের ট্রামের শব্দ।
মনে হল কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়ে থাকেন। স্মৃতির শহর স্মৃতিতেই থাক। নতুন ছবি দেখলে যদি পুরনোটা মুছে যায়! মুছে গেলে স্মৃতি-সত্তার বড় ক্ষতি! কিন্তু এটুকু ক্ষতি তো তাঁকে সইতেই হবে। তিনি তো কোনও ছবি ঝালিয়ে নেবার বিলাস নিয়ে আসেননি! বাস্তবকে জানতে, সত্যের মুখোমুখি হতে এসেছেন। পুরনো ছবির ওপর দাগা বোলানো তাঁকে সাজে না। তবু চক্ষুষ্মান হয়ে চলতে চলতে তাঁর মনে হল পুরনো ছবিটা ঠিক মুছে যাচ্ছে না। তার ওপর এখনকার ছবিটা সুপার-ইমপোজড হয়ে একটা কীরকম পরাবাস্তব ছবি হয়ে যাচ্ছে। এবং যতই উত্তরে যাচ্ছেন সার্কুলার রোড ফিরে আসছে তার চেনা চেহারায়। যেন গভীর জলের মধ্যে থেকে ঘাই-মেরে উঠে এল বসু বিজ্ঞান মন্দির, ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়। এই বাড়িগুলো তিনি একদা চিনতেন।
আরে! ওই গোলাপি বাড়িটা ডান দিকে! বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ!!! মায়ের সঙ্গে এখানে তো তিনি অনেকবার বক্তৃতা শুনতে এসেছেন! বক্তৃতা শুনতে কিকি একদম ভালবাসত না। কিন্তু মা-বাবারা এসেছেন অতএব আসতেই হত। অখিলজেঠু বলতেন, আহা হা, ছোট্ট মেয়েটাকে কেন কষ্ট দেওয়া! আমি না হয় ওকে নিয়ে একটু গড়ের মাঠে বেড়িয়ে আনি। বাস, নীল সবুজ কাঠি আইসক্রিম, কুলফি, বেলুন…মজা…।
অনেক ঘোরাঘুরির পর বোসপাড়া লেন খুঁজে পেয়ে তিনি এবং তাঁর ড্রাইভার যেন ডাইনোসরের কঙ্কাল আবিষ্কারের গর্বে উল্লসিত হয়ে উঠলেন। তবে গলিতে গাড়ি ঢুকবে না। তিনি ড্রাইভারকে ছেড়ে দিচ্ছিলেন। কিন্তু ছেলেটি বলল—আপনার কি খুব দেরি হবে? কলকাতার তো কিছুই চেনেন না দিদি! আমি বরং একটু দাঁড়াই। মিটার ডাউন করে দিচ্ছি, যা উঠবে তাই দেবেন।
এখন যা উঠেছে তা হলে দিয়ে দিই? —কস্তুরী বুঝলেন না ড্রাইভারটি তাঁর সঙ্গে এত ভদ্রতা করছে কেন। ওয়েটিং চার্জটাও নিতে চাইছে না!
আমার কিন্তু দেরিও হতে পারে। কী নাম তোমার?
আমেদ।
ঠিক আছে। আমি টাকাটা দিয়ে দিই। যদি বেশি দেরি হয় চলে যেয়ো।
ঠিক আছে— বলে, দিব্যি সিটে হেলান দিয়ে ঘুমোবার তোড়জোড় করল ছেলেটি।
গোলকধাঁধার মতো গলি ঘুরে পাঁচের বি-র সামনে যখন দাঁড়ালেন, ততক্ষণে আবারও বহুকাল আগেকার কোনও সুগন্ধপ্রবাহ তাঁকে একেবারে অধিকার করে নিয়েছে। স্মৃতির ঘরে অনেক জমা-খরচের স্তূপের তলায় এতদিন চাপা পড়ে ছিল। কড়হি, খেপলার গন্ধ ভেদ করে এখন ছোটবেলা তার মুসুর ডালে কালো জিরে ফোড়নের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে, মাছের ঝোল হচ্ছে কোথাও, ধনে জিরে হলুদ— তিনি মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছেন। ভেটকি মাছ তাঁর গন্ধ লাগত বলে মা লেবু দিয়ে গন্ধ কাটিয়ে নিতেন, বলতেন নে গরম গরম খেয়ে নে… নইলে আবার… প্রত্যেক বাড়িই যেন তার রান্নাঘরের জানলা এই সরু গলিপথের মধ্যে উন্মুক্ত করে দিয়েছে শুধু তাঁরই জন্য। যাতে তিনি কিকির কলকাতায় পৌঁছতে পারেন। এক ধরনের সুগন্ধ অভ্যর্থনা।
বেল নেই। ভাল করে খুঁজেও পেলেন না। কে জানে চোখে এখন ঠিকঠাক নজর আছে কিনা! কড়া নাড়লেন ঠকঠক। নিচু দরজা খুলে চৌকাঠের ওপর এসে দাঁড়িয়েছে একটি ফরসামতো বউ—তিনি নিৰ্ণিমেষে চেয়ে রইলেন। সেইভাবেই শাড়ি পরা, গলায় হার, হাতে চুড়ি, কানে দুল, কিন্তু সে নয়। এ সবই খাঁচা, খাঁচা ছেড়ে পাখি উড়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে গেছে তার যাবতীয় নিজত্ব। এই যে সময়ের বিপুল তফাত এটা যেন এই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারছেন না।
—কাকে চাইছেন?
—ওজিতমোহন বোস কি এখানে থাকছেন?
বউটি একবার ভেতরের দিকে তাকাল— শুনছ! কে একজন কী বলছেন, একবার এদিকে শোনো না।
খুব আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন কস্তুরী, যতক্ষণ না প্যান্টের ওপর একটা পাঞ্জাবি চাপিয়ে, হাতে দাড়ি কামানোর ক্ষুর, এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন।
—কে? কাকে চান?
—অজিতমোহন বোসকে খুঁজছেন উনি—বউটি বলল।
—আহ, তুমি চুপ করো না। আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলছি। আপনি কে?
কী অদ্ভুত! তিনি কে না বললে কি এঁরা অজিতমোহন সংক্রান্ত কোনও খবরই তাঁকে দেবেন না?
—আমি আমদাবাদ থেকে কলকাতা এসেছি কাল, উনি আমার বাবার বন্ধুলোক ছিলেন। তাই…
—আপনি ভেতরে আসুন, নমস্কার। অজিতমোহন বোস আমার দাদু ছিলেন, দীর্ঘদিন রোগ ভোগ করবার পর এই মাস কয়েক হল ওঁর দেহান্ত হয়েছে। অনেক বয়স হয়েছিল।
—তা হলে আমি যাই!
—না, যাবেন কেন? একটু বসে যান— ভদ্রলোক দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন আপ্যায়নের ভঙ্গিতে।
একটু ইতস্তত করলেন কস্তুরী। তারপর তাঁর সংকোচের ওপর স্মৃতি, কৌতূহল জয়ী হল। তিনি ভেতরে ঢুকলেন।
চৌকো উঠোনে রোদ, কয়েকটা কাক ছোট্ট কিছুর টুকরো নিয়ে ঝগড়া করছে। দৃশ্যটা তাঁর চোখ যেন শুষে নিচ্ছে। এরকম চৌকো উঠোন থাকত, সেখানে রোদ-হাওয়া। ভেতর-উঠোন যাকে বলে। তিনি দেখেছেন, কারও বাড়িতে দেখেছেন। ডান দিকের প্রথম ঘর। ভদ্রলোক বললেন—আসুন। এবং ঢোকবামাত্র অজিতবাবুর গন্ধ পেলেন। নির্ভুল। গাটা কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল। সামনের দেওয়ালে একটা ফটো। এনলার্জ করা, এখনও চন্দনের ফোঁটা লেগে আছে। বেশ বৃদ্ধ, দাড়ি চুল সব সাদা হওয়ায় কেমন অসংসারী-অসংসারী ছাপ পড়েছে। যেন সৌম্য বিবাগী সন্ন্যাসী। গুরুটুরু জাতীয়।
ছবিটার তলায় একটা দেরাজ। তার ওপর একটি পালিশ করা ছড়ি শোয়ানো। আর একটা চমৎকার গজদন্তর কৌটো। আরও কতকগুলো রয়েছে—কোনটা শাঁখের কোনটা কাঠের।
তাঁর দৃষ্টি লক্ষ করে ভদ্রলোক বললেন, দাদুর এই নেশাটি জব্বর ছিল। এক ঘনিষ্ঠ গুজরাতি বন্ধু ওঁকে প্রত্যেক উপলক্ষে একটা করে নস্যদান প্রেজেন্ট করতেন। দেরাজের ড্রয়ারে রেখে দিয়েছি। এই ছড়িটা ওঁর শেষজীবনের অবলম্বন। অন্ধের নড়ি।
—আন্ধা? উনি কি আন্ধা হয়েছিলেন নাকি?
—না, না, তা নয়। ওটা একটা বলবার ধরন ম্যাডাম— ইনডিসপেন্সেবল, আর কি!
কাঠের চেয়ারের ওপর আসন পাতা, তার ওপরে বসালেন ভদ্রলোক কস্তুরীকে।
—চা খাবেন ম্যাডাম!
—না, আপনি এখন বোধহয় অফিস বেরোচ্ছেন, আমি আর…
—ঠিক আছে, আমি বেরোব, প্রায় রেডি, আপনি একটু বসে যান না। চা?
—না।
—কেন? খান না?
—খায়, তবে বিশি না।
—তা হলে শরবত দিই। কিছু মুখে না দিয়ে যেতে পারবেন না। ওগো শুনছ, একটু শরবত! আচ্ছা…আপনার বাবা?
বউটি দু গ্লাস শরবত এনে রাখল।
কস্তুরী বললেন—নরেন্দ্র মেহতা। এই দু’মাস আগে গোতো হয়েছেন।
আরে তবে তো ঠিকই ধরেছি! এই নরেন্দ্রভাই-ই তো খুব বন্ধু ছিলেন দাদুর। গল্প শুনেছি অনেক। উনি বলতেন নরেন্দ্রর কাছে যে আমি কতভাবে ঋণী! আপনি ওঁরই মেয়ে?
খুবই কৌতূহলের দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকালেন ভদ্রলোক। উনি কী জানেন, কতটা জানেন ভেবে অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন কস্তুরী। হয়তো তিনি যা জানেন, অজিতবাবুর এই নাতিটি তার চেয়েও বেশি জানেন।
শরবতে চুমুক দিয়ে বেশ আরাম পেলেন তিনি। ছ্যাঁক করে তেলে পাঁচফোড়নের শব্দ হল। দু’টি ছেলে এসে দাঁড়াল—বারো থেকে চোদ্দোর মধ্যে বয়স।
আমার দুই ছেলে—অমিত আর অরিন্দম। অসিত… আমি অসিতমোহন। এই তোমরা প্রণাম করো এঁকে। একজন দিদা হন।
না না, শরবতের গ্লাস রেখে দিয়ে তিনি পা ঢাকলেন। ছেলে দুটি দ্বিধা না করে একরকম ছুটে বেরিয়ে গেল।
তাদের বাবা হেসে বললেন, আজ ইনটার স্কুল খেলা আছে। দু’জনেই ফুটবল। আজকালকার ছেলেরা… বুঝলেন তো! রোনাল্ডো, বেকহ্যাম, জিনেদিন জিদান সব রোল মডেল।
বা বেশ ভাল— কস্তুরী উঠে দাঁড়ালেন।—ওঁর কাছে বন্ধুরা কেউ আসতেন না?
আসতেন কেউ কেউ কিন্তু তাঁরা লোক্যাল লোক, আপনি চিনবেন কি? সুরেশ আচার্যি মশাই, বৃন্দাবন দাশ। রামমোহন লাইব্রেরির এগজিকিউটিভ কমিটিতে ছিলেন সব। ওঁরাই…।
এঁদের কাউকে চেনেন বলে মনে করতে পারলেন না কস্তুরী।
—আচ্ছা যাই, নমস্কার। পালটে বললেন ‘আসি।’
—যদি কিছু মনে না করেন ম্যাডাম, দাদুর একটা ছোট্ট স্মৃতি নিয়ে যান না! এই অজস্র নস্যিদানি রয়েছে, হয়তো সবই আপনার বাবার দেওয়া। দাঁড়ান, আমি বেছে দিচ্ছি।
ড্রয়ার থেকে ভারী সুন্দর একটা কাঠ-খোদাইয়ের কৌটো বার করলেন অসিতবাবু—এইটা পছন্দ হয়! এত দূর থেকে দাদুকে মনে করে এসেছেন!
এইবার কৌটোটা যেন সাড়ে চার দশক লাফিয়ে কস্তুরীর হাতে উঠে এল।
—অজিতবাবু এটা কী?
—এটা? আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের গল্প শুনেছিস তো? এটা হল তেমনই একটা আশ্চর্য কৌটো।
—এটা যদি মাজি, দৈত্য আসবে?
—দুর পাগলি, এটা তো আর পেতল তামা নয় যে মাজবি! এটার মধ্যে একটা ঝোড়ো দৈত্য থাকে, তার সঙ্গে খালি আমার ভাব।
—আমার কাছে আসবে না?
—আসবে। তবে সে তো নাক দিয়ে ফুঁসে বেরোয়, তোর ছোট্ট নাকখানা না ভেঙে দিয়ে যায়। বল, নিবি?
—ন্ না! —যে দৈত্য কিছু দেবে না, মাঝখান থেকে নাক ভেঙে দিয়ে যাবে, তাতে কিকির দরকার নেই।
কিন্তু কৌটোটার ওপর তার ভীষণ লোভ ছিল। ওইটা পেলে সে ওর ভেতর ভাজা মৌরি কি লেবু জোয়ান রাখতে পারে। ইচ্ছে হল একটু খেয়ে নিল। আজ নাতির হাত দিয়ে সেই কৌটো অজিতবাবু দিচ্ছেন কিকিকে।
—দাদুই দিচ্ছেন ধরুন— কেমন একটা রহস্য স্বরে বললেন অসিতবাবু। অজিতমোহন কি নাতিকে বলে গিয়েছিলেন— যদি কোনওদিন নরেন্দ্রর মেয়ে আসে তাকে এই কৌটোটা দেবে!
হাসিমুখে কৌটোটা নিলেন কস্তুরী, খুললেন— আর সঙ্গে সঙ্গে নাক সুড়সুড় করে জ্বালা করে ঝোড়ো দৈত্য তাঁর নাক দিয়ে আপসে বেরিয়ে এল।
ইশ্শ্ আপনার নাক তো ভারী সেনসিটিভ ম্যাডাম, কিছু মনে করবেন না। ছি। ছি। কবেকার…কৌটো…
কস্তুরী লাল চোখে, নাকে রুমাল চেপে রুদ্ধস্বরে বললেন—ইটস ও.কে!
অসিতমোহন জানেন না, তাঁর দাদু কিকির কাছে ছোট্ট একটা পুরনো রহস্য ভেদ করলেন। চমৎকার একটা ঠাট্টা হয়ে গেল একজন পরলোকবাসীর সঙ্গে একজন জীবিতের। অতীতের সঙ্গে বর্তমানের! ডিব্বাটা হাতে চেপে ধরে তিনি বললেন—থ্যাংকিউ ফর দিস। আচ্ছা আসি।
শুনছ—ভদ্রলোক আবার হাঁক পাড়লেন—ইনি যাচ্ছেন যে! ফরসা বউটি তাড়াতাড়ি এসে দাঁড়াল। কী মনে করে তাঁকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করল। তিনি মাথায় হাতটা ছোঁয়ালেন।
আমেদ নিশ্চিন্তে গাড়ির মধ্যে বসে। চোখ বন্ধ। গান শুনছে। ‘সিসা হো ইয়া দিল হো, টুট জায়েগা!’ দরজা খুলে ধরল। ক্যাসেট বন্ধ করে দিচ্ছিল, কস্তুরী বললেন, থাক, গান চলুক না!… সিসা টুটে যায়, কিন্তু দিল কি টুটে?
কী মনে করে তিনি একটা বড় দেখে দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। —রসগুল্লা আছে? স্পঞ্জ মতোন! বাগবাজারের?—দু’ হাঁড়ি কিনলেন। ধবধবে সাদা। রসের ভেতর টুবটুব করছে। বাড়িতে নামবার সময়ে এক হাঁড়ি আমেদকে দিলেন। ওয়েটিং চার্জ কিছুতেই নেবে না। যদি রসগোল্লা নেয়, তাহলে ওয়েটিং চার্জ নয়। অনেক কষ্টে তাকে দুটোই নেওয়ালেন কস্তুরী। খুশিখুশি মুখে চলে যেতে, মনে মনে বললেন, স্মৃতিসত্তা তোমায় দিলাম। আটপৌরে, আন্তরিক, অতিথিবৎসল পুরনো কলকাতা— তোমায় দিলাম।