একদিন সকালবেলায় গাব্বু
একদিন সকালবেলায় গাব্বু তার চুরি করা জিনিসপত্তরগুলো বের করে মেঝেয় ছড়িয়ে বসে দেখছিল। তেমন সুবিধে করে উঠতে পারছে না সে। তার হাত এখনও পাকেনি, ওস্তাদের অনেক গুণই সে অর্জন করতে পারেনি। চুরির জিনিসগুলো নিতান্তই এলেবেলে। রুপোর সিঁদুরের কৌটো, সস্তার দু’টো হাতঘড়ি, একটা টর্চবাতি, কয়েকটা স্টিলের বাটি, গোটা দুই শাড়ি, একজোড়া সোনার মাকড়ি, পেতলের ঘটি, একখানা পেতলের পিদিম, একটা পেতলের মোমদানি, একশিশি চ্যবনপ্রাশ, বেচলে কুড়িয়ে বাড়িয়ে শ’দুয়েক টাকা হতে পারে। মহাজন তাও দেবে কিনা সন্দেহ। ইদানীং চোরাই জিনিস কিনতে চাইছে না। সোনার মাকড়ি দুটোই যা বিকোবে। তবে খুবই হালকা জিনিস।
গাব্দু একটু উদাস চোখে জিনিসগুলো দেখতে-দেখতে তার নিজের অপদার্থতার কথা ভাবছিল। সে বংশানুক্রমেই চোর। তার ঠাকুরদা চোর ছিল, বাবা চোর ছিল এবং তাদের বেশ নামডাকও হয়েছিল। কিন্তু গাব্বু নিতান্তই কুলাঙ্গার। এই সব ভাবতে-ভাবতে সে জিনিসগুলো একটু নেড়েচেড়ে দেখতে হঠাৎ পিদিমখানা হাত ফসকে পড়ে যেতেই ঠাৎ করে শব্দের সঙ্গে-সঙ্গে একটা বিদ্যুতের মতো ঝলকানি। বোমা মনে করে গান্ধু আঁতকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল। চোখ খুলে সে কাঠ। সামনে একটা পেল্লায় চেহারার দানব দাঁড়িয়ে আছে, মাথা ঠেকেছে ঘরের চালে। গায়ে জরির পোশাক ঝলমল করছে। হাতজোড় করে ভারী বিনয়ের সঙ্গে বলল, “হুঁকুম করুন হুজুর!”
ব্যাপারটা একদম বুঝতে না পেরে গাব্বু হাঁ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে বলল, “আপনি কে?”
“আমি আপনার বান্দা, আপনার খিদমতে হাজির।”
গাব্বু চোখ কচলাল, নিজের পেটে চিমটি দিল। তবু ঘুম ভাঙল না দেখে একটু অবাক হয়ে বলল, “নাঃ, ঘুমটা বেশ চেপে এসেছে দেখছি।”
“আপনি ঘুমোচ্ছন না মালিক, জেগেই আছেন। আমি ওই চিরাগের দৈত্য। মালিকের হুকুম তামিল করাই আমার কাজ। বিশ্বাস না হয় পরীক্ষা করে দেখুন।”
গাব্বু ভয়ে কিছুক্ষণ সিঁটিয়ে থেকে ব্যাপারটা আন্দাজ করার চেষ্টা করল। এটা কোনও ঘাপলা নয়তো? কোনও চক্রান্ত? তাকে বিপদে ফেলার ফাঁদ? তারপর একটু-একটু সাহস ফিরে এল তার। একটু ঢোক গিলে গলাখাকারি দিয়ে বলল, “যা বলব তাই করবেন?”
“আলবাত মালিক।”
“যাঃ, বিশ্বাস হচ্ছে না!”
“হুঁকুম করেই দেখুন।”
“একহাঁড়ি রসগোল্লা আনুন তো দেখি।” দৈত্য হুশ করে গেল আর এল। হাতে এক বড় হাঁড়িভর্তি রসগোল্লা।
চোখ বড়-বড় করে ব্যাপারটা দেখল গাব্বু। বিশ্বাস হচ্ছে না বটে, তবু দু’খানা রসগোল্লা টপাটপ খেয়ে দেখল, অতি ভাল জাতের জিনিস। বলল, “আপনিও দু’টো খান!”
দৈত্য মাথা নেড়ে বলল, “আমাদের খাওয়ার হুকুম নেই হুজুর! আর কী করতে হবে আদেশ করুন!”
গাব্বু চারদিক চেয়ে তার জীর্ণ ঘরখানা দেখল। আসবাব কিছুই নেই। বর্ষায় চাল দিয়ে জল পড়ে। হাঁড়ির হাল। সে বলল, “বাড়িখানা পাকা করে দিতে পারেন?”
“আলবাত।” বলেই দৈত্যটা হুশ করে অদৃশ্য হয়েই ফিরে এল। গাবু অবাক হয়ে দেখল, তার ঘর রীতিমতো ঝকঝকে দালানকোঠায় পরিণত হয়েছে। ফের হুকুম দিতেই আসবাবপত্র, খাট-পালঙ্কও চলে এল। খিদে পেলেই খাবার এসে যাচ্ছে। তেষ্টা পেলেই জল বা শরবত।
গাব্বু বলল, “মজা মন্দ নয় তো!”
তা তিনটে দিন ভারী মজায় কেটে গেল গাব্বুর। জুতো, জামা, ছাতা, লাঠি কিছুরই অভাব নেই। তবে শুয়ে-বসে, আয়েশ করে তিনটে দিন কাটিয়ে দেওয়ার পর তার ভারী একঘেয়ে লাগল। নাঃ, এরকম নিষ্কর্মার জীবনে তার ঠিক জুত হচ্ছে না। তার হাত-পা অন্য কিছুর জন্য নিশপিশ করছে। তার বাবা দশরথ রাতে চুরি করতে বেরিয়ে যেত, ফিরত ভোরবেলায়। কোনও-কোনও দিন মেলা জিনিস নিয়ে আসত, কোনও দিন খালি হাতে। তখন থেকেই সে ঠিক করে রেখেছিল বাবার মতো চোর সে হবে না। উঞ্ছবৃত্তি তার পছন্দ নয়। বড় হয়ে সে হবে ডাকাত। এক-একটা ডাকাতিতে যা রোজগার হয় তাতে মাস কেটে যায়। কিন্তু সাহস আর দলবলের অভাবে সে ডাকাত হয়ে উঠতে পারেনি। হল ছিচকে চোর। আর চুরি করতে গিয়ে হেনস্থা ও অপমান কি কম জুটেছে তার কপালে? বাখরগঞ্জের গেরস্ত নীলমণি রায় তাকে দিয়ে পা টিপিয়ে নিয়েছিল। খাগড়াহাটের লোকেরা তাকে ধরে মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢেলে গাঁয়ে ঘুরিয়েছিল। সাত হাত নাকে খত দিতে হয়েছিল নবীনগরে ব্যোমকেশবাবুর বাড়িতে ধরা পড়ে যাওয়ায়। সেই সব মনে পড়ায় মাথাটা বড্ড গরম হয়ে গেল তার।
সে দৈত্যকে হুকুম করল, “ওহে, আমার এরকম আরামে সময় কাটাতে ইচ্ছে করছে না। আমি আজ ডাকাতি করতে বেরোব। তার সব ব্যবস্থা করো।”
“জো হুজুর!”
ঘোড়ায় চেপে মাঝ রাত্তিরে বন্দুক-পিস্তল নিয়ে সে ফরাশডাঙা গায়ে হাজির হল। ফরাশডাঙায় বিস্তর মহাজনের বাস। তাদের পাইক বরকন্দাজও আছে। তারা লাঠি-সড়কি নিয়ে তেড়ে এল, কেউ-কেউ গুলিও চালাল বটে। কিন্তু দৈত্য পটাপট তাদের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে গান্ধুর পথ পরিষ্কার করে দিল। মোট পাঁচটা গদি লুট করে মহানন্দে ফিরে এল গাব্বু। তীব্র আনন্দে তার শরীরের রক্ত গরম, মনে তৃপ্তি আর আনন্দ। দুটো দিন আরাম আর বিশ্রাম নিয়ে তিনদিনের দিন প্রতাপগড়ে হাজির হল সে। জমিদার বিষ্ণুচরণের বাড়ি আর মগনলাল মহাজনের গদি সাফ করে ফিরে এল। তার পিস্তলের গুলিতে মগনের দরোয়ান বীরবাহাদুর জখম হল। তিনদিন পর সে সামতাপুরের গ্রামীণ ব্যাঙ্ক সাফ করে নিয়ে এল। চারদিকে সবাই যে গাব্বু ডাকাতের কথা আলোচনা করছে, সেটাও কানে এল তার। হ্যাঁ, এই হচ্ছে জীবন। এরকমভাবেই বাঁচতে চেয়েছিল সে।
পর পর ডাকাতির চোটে ভূপেনদারোগার নাওয়াখাওয়া যে ঘুচে গিয়েছে এটা আন্দাজ করে ভারী আহ্লাদ হচ্ছিল তার।
খুশি হওয়ারই কথা। মাসখানেক আগে এই ভূপেনদারোগা তাকে পাকড়াও করে থানায় নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু চালান করেননি। নাক সিঁটকে বলেছিলেন, “এঃ, তুই যে একেবারে ছিচকে চোর! বিশবার কান ধরে ওঠবোস কর তো!” তাই করেছিল গাব্বু। তারপর তাকে গোটাকতক রুলের ঘা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অপমানটা আজও ভোলেনি গাব্বু।
আজ রাতে তাই পায়েসপুর অভিযানে যাওয়ার আগে সে ঘোড়ায় চেপে হবিবপুর থানায় হানা দিয়ে ভূপেনদারোগার ঘরে ঢুকতেই ভূপেন সিঁটিয়ে গেলেন। গাব্বু বুক ফুলিয়ে বলল, “ওহে ভূপেন, তোমাকে জানিয়েই যাচ্ছি, আজ পায়েসপুর লুট করব। তোমার কিছু করার আছে?”
ভূপেন মাথা নেড়ে বললেন, “আজ্ঞে, না। পায়েসপুরকে দেউলিয়া করে দিলেও কিছুই করব না।”
“সে চেষ্টা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ। এবার কান ধরে বিশবার ওঠবোস করলেই তোমার ছুটি।”
ভূপেন লাল মুখে, রাগ চেপে আদেশ পালন করে ফেললেন। কারণ, গাব্বুর হাতে এস এল আর বন্দুক, তার পিছনে দশাসই চেহারার দানবাকৃতি স্যাঙাত। সেপাইরা থানা থেকে পালিয়ে গিয়েছে। ভূপেনদারোগা একা!
এই সব গুরুতর কাজ সেরে টগবগে ঘোড়ায় চেপে গাব্বু পায়েসপুর রওনা হল। ঘোড়ার পাশে-পাশে গাব্বুর পোষা দৈত্যও চলেছে। গাবু বলল, “ওরে দত্যি!”
“জি হুজুর!”
“আমাকে কেমন দেখছিস?”
“চমৎকার মালিক।”
“কেমন ডাকাতি করি?”
“খুব ভাল হুজুর।”
“তোর কি মনে হয় আমি একদিন দেশের সবচেয়ে বড় ডাকাত হব?”
“আপনার চেয়ে বড় ডাকাত কেউ নেই মালিক!”
“কিন্তু একটু খিচ থেকে যাচ্ছে যে?”
“কীসের খিচ হুজুর? হুকুম করুন, সব ঠিক করে দেব।”
“এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনা পড়লে কী হয় জানিস?”
“দুধ কেটে যায়।”
“আমারও যে তাই হচ্ছে।”
“কেন হুজুর?”
“লোকে আমাকে খাতির করছে বটে, কিন্তু সেটা তোর জন্য।”
“আমি তো আপনার গোলাম আছি মালিক।”
“সেইটেই তো হয়েছে মুশকিল। আমার সন্দেহ হচ্ছে, লোকে আমাকে যতটা না ভয় পায়, তার চেয়ে তোকে ভয় পায় অনেক বেশি। এটা কি তাদের উচিত হচ্ছে?”
“না হুজুর। কী করতে হবে হুকুম করুন।”
“আমার মনে হচ্ছে, তুই সব সময় সঙ্গে-সঙ্গে থাকলে ওরা আমাকে ভয় পাবে না। তোর ভয়ে আমাকে মেনে নেবে। আমার তেমন নামও হবে না।”
“জরুর হবে মালিক। হুকুম করুন, সবাইকে সবক শিখিয়ে দেব।”
“ঠিক আছে। কিন্তু আমার মনটায় বড় খচখচ করছে রে। নামডাক হচ্ছে বটে, লোকে ভয়ও খাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যেন এক চিমটি খামতিও থেকে যাচ্ছে।”
“হুঁজুর, পায়েসপুরের লোকেরা কিন্তু আপনার জন্য তৈরি হয়ে আছে।”
“তার মানে?”
“তাদের হাতে লাঠি, সড়কি, দা এবং বঁটি তো আছেই, দু’জনের হাতে দোনলা বন্দুকও আছে। তারা আপনাকে ‘কুটুম’ সম্বোধন করে নানারকম গালিগালাজও করছে। তারা নাকি আজ রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবে?”
“বাঃ বাঃ! এই তো চাই। পায়েসপুরের লোকেরা তো বেশ বীর দেখছি! যেখানেই যাই সেখানেই লোকেরা সব ভয় খেয়ে তাড়াতাড়ি সোনাদানা, টাকাপয়সা বের করে দেয়, সেলাম ঠুকে পথ ছেড়ে দেয়, হাত কচলায়, ছ্যাঃ ছ্যাঃ! ডাকাতি করাটা যেন জলভাত হয়ে যাচ্ছে। এরকম হলে ডাকাতিতে সুখ কী? একটু লড়ালড়ি হবে, গুলিগোলা চলবে, খুনজখম হবে, লাশ পড়বে, তবে না সুখ!”
“হুঁজুর, যদি হুকুম দেন তো আগেভাগে গিয়ে ওদের অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে সব কটাকে বেঁধে রেখে আসি।”
“খবরদার না! তাতে আমার নামও হবে না, আনন্দও হবে। তুই ব্যাটা ডাকাতির বুঝিস কী? লড়ালড়ি না হলে যে শরীরটা গরমই হয় না বাপ! আর শরীর গরম না হলে আনন্দ কীসের? বরং পায়েসপুরের লোকদের আমার অভিনন্দন জানিয়ে দে। তারা যে বীরত্বের পরিচয় দিচ্ছে, তাতে আমি বেজায় খুশি।”
“তারা অভিনন্দন নিতে চাইছে না মালিক। তারা আপনার মুণ্ডু চাইছে।”
“বাঃ বাঃ, চমৎকার! ওদের জানিয়ে দে, যা চেয়েছ তার কিছু বেশি দেব, গুলির সঙ্গে মাথা!”
“গুলিগোলাকে তারা মোটেই ভয় পাচ্ছে না আঁহাপনা।”
“খুব ভাল, খুব ভাল। সব সময় কি রসগোল্লা খেতে ভাল লাগে রে! মাঝে-মাঝে একটু আখ চিবোতে বা কড়মড় করে ছোলাভাজা খেতেও তো ইচ্ছে যায়।”
“সে কথা ঠিক জনাব!”
পায়েসপুরে ঢুকবার মুখেই বিস্তর লোক সত্যিই পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে দেখতে পেয়ে গাব্বু একটা হুংকার ছাড়ল, “খবরদার! আমার পথ আটকালে তার পরিণাম কিন্তু ভয়ংকর! তোমরা সবাই হাত তুলে আত্মসমর্পণ করো।”
হারাধনবাবু উলটে চেঁচালেন, “কভি নেহি! বল বীর, চির উন্নত মম শির। বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী! পায়েসপুর জিন্দাবাদ।”
জনতাও সঙ্গে-সঙ্গে গর্জন করে উঠল।
তারপর বন্দুকের গুলির আওয়াজ, লাঠির ঠকাঠক, বল্লমের ঝলকের মধ্যে ধুন্ধুমার লড়াই হতে লাগল।
কিন্তু লড়াই খুব বেশিক্ষণ চলল না। পায়েসপুরের লোকেরা রণেভঙ্গ দিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু দৈত্য তাদের ধরে এনে গায়ের চণ্ডীমণ্ডপে শামিল করল।
ঘোড়া থেকে নেমে হাসিমুখে গাবু বলল, “শাবাশ!” হারাধনবাবু জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বললেন, “এক মাঘে শীত যায় রে গাব্বু!”
গাবু বলল, “দ্যাখো বাপু, বীরত্ব আমি পছন্দ করি বটে, কিন্তু আস্পর্দা আমার একদম সহ্য হয় না। বেয়াদপি করলে পায়েসপুরকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে যাব।”
নগেন সর্বাধিকারী ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “দোহাই বাবা, হারাধনের কথাটায় আমল দিয়ো না। পায়েসপুর আমাদের বড় আদরের গা তো, তাই ফস করে কথাটা বলে ফেলেছে। তা বাবা, তুমি নির্বিঘ্নে লুটপাট করে চলে যাও, কেউ কিছু বলবে না।”
গাঙ্কু একটু তেরছা হাসি হেসে বলল, “ছোঃ, লুটপাট! লুটপাট করার মতো তোমাদের আছেটা কী মশাই? থাকার মধ্যে ছিল তো এই পিদিমখানা। তা সেটাও কাজে লাগাতে পারনি! অপদার্থ আর কাকে বলে!”
ভিড়ের মধ্যে হলধর ঘোষ পিছন দিকটায় মাথাটা নুইয়ে পাশের গজপতিকে বললেন, “ইস! আমার হিপনোটিক রাইফেলটা যদি তৈরি থাকত, ব্যাটাকে মজা বুঝিয়ে দিতাম।”
অন্য পাশ থেকে ব্ৰজেন বোস খিঁচিয়ে উঠে বললেন, “তার চেয়ে একটা গাদাবন্দুক আবিষ্কার করলেও তো কাজের কাজ করতে। তোমার রোবট হাত-পা নাড়ল না, তোমার অটোমিস্ত্রি দেওয়ালে একটা পেরেকও পুতল না, অটোইস্তিরিকে দিয়ে ইস্তিরিটাও হল না, তা এতদিন ধরে করলেটা কী?”
হলধর কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, গাবু একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বলল, “কে রে পিছনের সারিতে ফিসফাস করছিস? কোনও ষড়যন্ত্রের মতলব থাকলে কিন্তু মুশকিল আছে।”
হলধর উবু হয়ে তাড়াতাড়ি নিজের মুখে হাত চাপা দিলেন। গাব্বু উচ্চকণ্ঠে বলল, “শোনো হে পায়েসপুরের লোকেরা, পায়েসপুরের মতো একটা দীনদরিদ্র গ্রামে লুটপাট চালানো আমার উদ্দেশ্য নয়। দুচো মেরে আমি হাত গন্ধ করতে চাই না। মাতব্বরের মধ্যে কেউ একজন আমার এই আজ্ঞাবহের হাতে একটা টাকা দিয়ে বশ্যতা স্বীকার করে নিক, তা হলেই হবে।”
খগেন তাড়াতাড়ি হারাধনকে একটা খোঁচা দিয়ে বললেন, “যাও না হে হারাধন।”
হারাধন চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, “আমি! কভি নেহি!”
“আহা চুপ, চুপ। গলা নামাও। ইংরেজিতে গ্লোরিয়াস রিট্রিট বলে একটা কথা আছে, জানো?”
হারাধন মাথা নেড়ে বললেন, “এখন দেশের দুর্দিনে আপনি কি আমাকে ইংরেজি শেখাচ্ছেন? এখন কি ইংরেজির ক্লাস নেওয়ার সময়?”
“আহা, এটা হল স্ট্র্যাটেজি।”
হারাধন সমান তেজের সঙ্গে বললেন, “আপনার মতো ইংরেজের ধামাধরা কিছু লোক যে দেশকে আবার পরাধীন করতে চাইছেন, তা আমি জানি।”
নগেন সর্বাধিকারীই এগিয়ে গিয়ে দৈত্যের হাতে একটা টাকা দিয়ে খুব চাপা স্বরে বললেন, “তুমি একদিন আমাদেরই কাজের লোক ছিলে কিন্তু বাপু।”
দৈত্য নির্বিকার গলায় বলল, “এখন আর নই।”
গাঙ্কু সহাস্যে বলল, “তা হলে পায়েসপুরের হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন তো নগেনবাবু?”
“হ্যাঁ বাবা, করলাম।”
পিছন থেকে কে যেন সরু গলায় বলে উঠল, “তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।”
গাবু চিৎকার করে উঠল, “কে? কে বলল কথাটা?”
কেউ সাড়া দিল না। সবাই পাথরের মতো চুপ। গাব্বু সঁতে দাঁত ঘষে দৈত্যের দিকে চেয়ে হুকুম দিল, “এই ব্যাটা, কথাটা যে বলল তাকে ধরে আন তো!”
চোখের পলকে দৈত্য গিয়ে পিছনের সারি থেকে কাক করে একটা ছোঁকরাকে ঘাড় ধরে তুলে এনে গাব্বুর সামনে ফেলল।
গাব্বু জ্বলন্ত চোখে ছোঁকরার দিকে চেয়ে বলল, “কে তুই?”
নগেন সর্বাধিকারী কাঁপতে কাঁপতে উঠে জোড়হাতে বললেন, “ওকে মেরো না বাবা, আমি ওর হয়ে মাপ চাইছি। বয়সের দোষ তো, দুমদাম বলে ফেলে। ও আমার নাতি পান্টু।”
গাবু ধমক দিয়ে বলল, “আপনি বসুন। এই হারামজাদা পান্টু, এবার বল তো, কে আমাকে বধ করবে।”
পান্টু গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। জবাব দিল না। গাব্বু এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে তার গালে একটা চড় কষিয়ে বলল, “কাপুরুষের মতো লুকিয়ে থেকে আওয়াজ না দিয়ে, বাপের ব্যাটার মতো সামনে এসে বলতে পারলি না, কে আমাকে বধ করবে? কার এত ক্ষমতা, কার এত বুকের পাটা? বল বদমাশ।”
আরও গোটাকয়েক চড় খেয়ে পান্টু কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলল, “আমি জানি না। এমনিই বলেছি।”
“তোর কাছে নিশ্চয়ই কোনও খবর আছে! বল, কে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। বল, নইলে এক্ষুনি গুলি করে মারব।”
গাব্বু তার পিস্তল তুলতেই একটা শোরগোল উঠল। সবাই বলতে লাগল, “ওকে মারবেন না! ওকে মারবেন না! এবারের মতো মাপ করে দিন!”
গাবু পিস্তল নামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “আমার আড়ালে যদি কেউ ষড়যন্ত্র করে তা হলে কিন্তু আমি ঠিকই খবর পাব। হুশিয়ার করে দিয়ে যাচ্ছি, কারও বদমতলব থাকলে সে কিন্তু রেহাই পাবে না। পায়েসপুরকে শ্মশান বানিয়ে ছাড়ব। মনে থাকে যেন।”
পায়েসপুরকে শাসন করে ঘোড়ায় চেপে টগবগ করে নিজের ডেরায় ফিরে এল বটে, কিন্তু গাব্বুর মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছে। সত্যিই কি তাকে কেউ বধ করার ষড়যন্ত্র করছে নাকি?
আজও রাত্রিবেলা তার বড় হলঘরে হুরি-পরিরা নাচ-গান করে তাকে খুশি রাখার চেষ্টা করছিল। কিন্তু মনটা ভাল নেই বলে সে হাতের ইশারায় তাদের বিদায় করে দিল। হুরি-পরি, গায়ক বাদকরা চোখের পলকে মিলিয়ে গেল। দেশ-বিদেশ থেকে ওস্তাদ বঁধুনিদের আনিয়ে তার জন্য বিশাল ভোজের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু দুশ্চিন্তায় কিছুই মুখে রুচল না গাব্বুর। তার হাতের ইশারায় ভোজের টেবিল, বঁধুনি, সবই অদৃশ্য হয়ে গেল। সে দৈত্যকে ডেকে বলল, “কারা আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে খবর আন তো?”
দৈত্য এক লহমায় ঘুরে এসে বলল, “সবাই ষড়যন্ত্র করছে জাহাপনা।”
“সবাই?”
“হ্যাঁ মালিক।”
“সর্বনাশ!”