Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ইঞ্জিনিয়ারের বুড়ো আঙুল-শার্লক হোমস || Adrish Bardhan

ইঞ্জিনিয়ারের বুড়ো আঙুল-শার্লক হোমস || Adrish Bardhan

ইঞ্জিনিয়ারের বুড়ো আঙুল-শার্লক হোমস (Sherlock Holmes)

ওয়াটসনের তখন মরবার সময় নেই। ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সদ্য বিয়ে হয়েছে। একদিকে বউ, আরেক দিকে রুগি। দু-দিক সামলাতে গিয়ে ব্যাচেলর বন্ধু শার্লক হোমসকে পর্যন্ত ভুলতে বসেছে।

ঠিক এই সময়ে একদিন ভোরবেলা ঘুম চোখে নীচে নেমে আসতে হল ওয়াটসনকে। অদ্ভুত একটা রুগি এসে বসে আছে বসবার ঘরে। লোকটা পেশায় হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। বুড়ো আঙুলটা সদ্য কাটা গেছে। রক্তে জবজবে রুমাল জড়ানো।

ব্যান্ডেজ করার পর ইঞ্জিনিয়ার বললে, আমাকে এখুনি পুলিশের কাছে যেতে হবে। কেসটা সিরিয়াস।

ওয়াটসন এই সুযোগে শার্লক হোমসের ওকালতি করে বসল। শুনে লাফিয়ে উঠল আঙুলকাটা ইঞ্জিনিয়ার। পুলিশের চাইতে হোমসের ওপর তার আস্থা বেশি।

সুতরাং সেই সকালেই সটান বেকার স্ট্রিটে এসে পৌঁছল ওয়াটসন। হোমস যথারীতি বসে আছে আরাম কেদারায়। মুখে-পাইপ, ঘরে তামাকের ধোঁয়া। পেট খালি। হাতে খবরের কাগজ।

ইঞ্জিনিয়ারের অবস্থা তখন শোচনীয়। বিপুল রক্তপাত আর ক্লান্তিতে কথা বলার শক্তিও নেই। হোমস্ ব্র্যান্ডি খাইয়ে দিতে একটু চাঙ্গা হল ভদ্রলোক। ইজিচেয়ারে আরাম করে শুয়ে শুরু করল অতি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার অত্যাশ্চর্য কাহিনি।

নাম তার ভিক্টর হেথার্লি। হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ার। আপিস সাজিয়ে বসেও সুবিধে করে উঠতে পারছিল না। এমন সময়ে গতকাল একটা অদ্ভুত লোক এসে দেখা করল তার সঙ্গে।

লোকটার নাম কর্নেল স্টার্ক। ভীষণ ঢ্যাঙা আর পাকানো চেহারা। গালের চামড়া যেন হাড়ের ওপর সেলাই করা। নাকটা খাঁড়ার মতো। চোখ ঝকঝকে, চলন-বলন চটপটে। কথার মধ্যে জার্মান টান।

শকুনের মতো তীক্ষ্ণ চোখে হেথার্লিকে বিঁধে ফেলল কর্নেল। ঝট করে লাফিয়ে গিয়ে দেখে এল দরজায় কেউ আড়ি পাতছে কিনা। তারপর শপথ করিয়ে নিল হেথার্লিকে দিয়ে কোনও কথা যেন কেউ জানতে না পারে। যেহেতু হেথার্লি অনাথ আর আইবুড়ো–তাই তার কাছেই এসেছে কর্নেল। কেন না অনাথ আর আইবুড়ো লোকেরা পেটে কথা রাখতে জানে। কাজটা অবশ্য সামান্য ঘণ্টা কয়েকের মতো। দক্ষিণাটা অসামান্য। পঞ্চাশ গিনি নগদ।

শুনেই হেথার্লির টনক নড়ল। পঞ্চাশ গিনি চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু কাজটা কী?

কর্নেল তখন ফিসফাস করে বলল, তার একটা হাইড্রলিক মেশিন আছে। মেশিনটার কোথায় যেন একটি গলদ হয়েছে। হেথার্লিকে গিয়ে তা বার করে দিতে হবে।

কিন্তু একাজ এত চুপিসাড়ে করার দরকারটা কী? কর্নেল সেঁতো হাসি হেসে বুঝিয়ে দিল কারণটা। রিডিংয়ের কাছে খানিকটা জমি কিনেছিল সে। তারপর একদিন দেখল, জমির তলায় সাজিমাটির স্তর হয়েছে যা কিনা সোনার চেয়েও দামি। তার চাইতেও বড় কথা–স্তরটা বেশি করে ছড়িয়ে পড়েছে পাশের দুই ভদ্রলোকের জমিতে। তারাও জানে না তাদের জমিতে সোনার চেয়েও দামি জিনিস পড়ে আছে। জানলে চড়চড় করে দাম উঠে যাবে জমিগুলোর। কিন্তু জলের দরে ও জমি কিনতে চায় কর্নেল। তাই আগে নিজের জমি থেকে সাজিমাটি তুলে দু-পয়সা জমিয়ে নিয়ে সেই টাকা দিয়ে কিনবে পাশের জমিগুলো। এত গোপনতা সেই কারণেই। নিজের জমিতে মেশিন চলছে–এ খবর একবার প্রকাশ পেলে পাশের জমিওলা আর তো জমি বেচতে চাইবে না। সুতরাং হেথার্লি যেন সন্ধের দিকে রিডিং স্টেশনে চুপিসাড়ে হাজির থাকে। কর্নেল এসে তাকে নিয়ে যাবে তার খামারবাড়িতে।

সব শুনে শুধু, একটা প্রশ্নই করেছিল হেথর্লি, সাজিমাটি তো মাটি খুঁড়ে বার করতে হয়– কিন্তু হাইড্রলিক মেশিনের দরকার তো চাপাচাপির জন্যে।

ও সব আপনি বুঝবেন না। আমাদেরও চাপ দেওয়া দরকার আছে বলে হেথার্লিকে যেন তোপের মুখে উড়িয়ে দিল কর্নেল।

অত কৌতূহলে দরকারটা কী? পঞ্চাশ গিনি পেলেই হল। সুতরাং যথাসময়ে রিডিং স্টেশনে হাজির হল হেথার্লি। স্টেশনের বাইরে কর্নেল দাঁড়িয়েছিল একটা এক-ঘোড়া গাড়ি নিয়ে। ঘোড়াটা বেশ তেজালো বাদামি রঙের, গায়ে ধূলোবালি, ঘামের চিহ্নমাত্র নেই।

গাড়ির মধ্যে হেথার্লিকে উঠিয়ে নিয়ে কোচোয়ানকে চলতে হুকুম দিল কর্নেল। দরজা-জানলা বন্ধ থাকায় হেথার্লি দেখতে পেল না কোন পথে চলেছে গাড়ি। তবে ওইরকম বেগে ঘণ্টাখানেক একনাগাড়ে ছুটে চলা মানে মাইল বারো পথ যেতে হয়েছিল নিশ্চয়। পাহাড়ি পথ হলে টের পাওয়া যেত। রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো কিন্তু চড়াই উত্রাই পেরোতে হয়নি।

একঘণ্টা পরে একটা বাগানের মধ্যে গাড়ি ঢুকল। হেথার্লিকে নামিয়ে বেরিয়ে গেল গাড়িটা। একজন জার্মান মহিলা আলো হাতে সভয়ে দরজা খুলে কী যেন বলল কর্নেলকে। তারপর বেরিয়ে এল একজন মোটা ইংরেজ। কর্নেলের ম্যানেজার। মেয়েটাকে ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে কর্নেল আর ম্যানেজার হেথার্লিকে নিয়ে এল হাইড্রলিক মেশিনের ঠিক তলায় একটা ছোট্ট খুপরি ঘরে।

ঘরটার তলায় লোহার প্লেট–ওপরে লোহার প্লেট। চারদিকে কাঠের দেওয়াল। মেশিন চললেই ওপরের লোহা নেমে এসে মিশে যায় নীচের লোহার সঙ্গে।

হেথার্লি সামান্য একটু ঘটাং-ঘটাং করেই বুঝে ফেলল রবারের ঢাকনি দিয়ে প্রেসার বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই সেরকম চাপ উঠছে না অত বড় মেশিনেও।

তারপরেই তেলের বাতি হাতে একা ফিরে এল খুপরি ঘরে। মনটা খুঁতখুঁত করছিল মেশিনের সাইজ দেখে। এত বড় মেশিন দিয়ে সাজিমাটি চাপ দেওয়ার কথাটা যে মিথ্যে, তা ধরে ফেলল লোহার পাত দুটোয় হাত বুলোতেই। অদ্ভুত কতকগুলো ধাতুর গুড়ো লেগে সেখানে।

ঠিক এই সময়ে পেছনে পায়ের শব্দ শোনা গেল। কর্নেল জ্বলন্ত চোখে দেখছে হেথার্লিকে। তারপরেই আর সময় পাওয়া গেল না। চক্ষের নিমেষে বেরিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল কর্নেল।

মেশিনের চাপ-ঘরে বন্দি হল হেথার্লি। পরক্ষণেই কানে ভেসে এল সোঁ-সোঁ শব্দ। মেশিন চালিয়ে দিয়েছে কর্নেল। ওপরের লোহার প্লেট নীচে নেমে আসছে হেথার্লিকে চিঁড়েচ্যাপটা করতে। আচম্বিতে পাশের কাঠের দেওয়ালে খুলে গেল আর একটা দরজা। সেই জার্মান মহিলাটা ওকে টেনে নিয়ে এল বাইরে। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে তেলের বাতি গুঁড়ো হওয়ার এবং ধাতুতে-ধাতুতে ঠোকাঠুকির আওয়াজ শোনা গেল মেশিন ঘরের ভেতর থেকে।

মেয়েটা হেথার্লিকে বললে তিনতলার জানলা থেকে লাফ দিয়ে পড়তে। কিন্তু কর্নেল ততক্ষণে ছুটে এসেছে কৃপাণ হাতে। দরজা আটকে দাঁড়াল মেয়েটা। ঠেলে ফেলে দিয়ে ছুটে এল কর্নেল। হেথার্লি তখন চৌকাঠ ধরে বাইরে ঝুলছে। কৃপাণের কোপে বুড়ো আঙুলটা রয়ে গেল ঘরের মধ্যে।

তারপর আর কিছু মনে নেই হেথার্লির। জ্ঞান হলে দেখল কোথায় সেই বাগানবাড়ি? ও শুয়ে আছে স্টেশনের ধারে একটা ঝোঁপের মধ্যে। রক্তপাতে প্রাণটা গলায় এসে ঠেকেছে।

শার্লক হোমস্ তক্ষুনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে লোকজন নিয়ে রওনা হল রিডিং স্টেশনে। সঙ্গে হেথার্লি আর ওয়াটসন। আর একটা ম্যাপ। রিডিং স্টেশনকে ঘিরে দশ মাইল মত জায়গা নিয়ে একটা বৃত্ত টানা হয়েছে ম্যাপের ওপর। বাগানবাড়িটা এই বৃত্তের মধ্যেই নিশ্চয় পড়বে। কিন্তু কোথায়? ট্রেনে বসেই আরম্ভ হল জল্পনাকল্পনা।

ওয়াটসন, ইন্সপেক্টর সার্জেন্ট আর ইঞ্জিনিয়ার–এই চারজনে দেখিয়ে দিলে স্টেশনের উত্তর, দক্ষিণ, পুব, পশ্চিম দিক। কিন্তু সবাইকে বোকা বানিয়ে শার্লক হোমস্ আঙুল টিপে ধরল বৃত্তের ঠিক মাঝখানে রিডিং স্টেশনের ওপর।

আশ্চর্য! ট্রেন রিডিং স্টেশনে পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই দেখা গেল ছাতার মতো ধোঁয়ার কুণ্ডলী। স্টেশনের পাশেই একটা গাছপালা ঘেরা বাগানবাড়িতে আগুন জ্বলছে। হেথার্লির বুড়ো আঙুল সেই বাড়িতেই পাওয়া গেল। একজোড়া ছোট পায়ের ছাপ, আরেক জোড়া ভারী পায়ের ছাপ। অচেতন হেথার্লিকে এই দুজন বয়ে নিয়ে ফেলে গেছে স্টেশনের ধারে। তারপর পালিয়েছে বাড়ি ছেড়ে। মেশিন ঘরে কেবল পাওয়া গেল টিন আর নিকেলের গুঁড়ো।

এবার আসুন রহস্য সমাধানে।

এক নম্বর রহস্য–শার্লক হোমস জানল কী করে রিডিং স্টেশনের ধারেই ওদের বাড়ি?

দুনম্বর রহস্য–কে আগুন লাগাল বাড়িতে?

তিন নম্বর রহস্য–হাইড্রলিক মেশিন কী কাজে লাগান হত?

চার নম্বর রহস্য–অচেতন হেথার্লিকে কারা বয়ে নিয়ে এসেছিল স্টেশনের ধারে?

.

গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান

এক নম্বর সমাধান–হেথার্লিকে নিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা ছমাইল গিয়ে আবার ফিরে এসেছিল। বারো মাইল দূর থেকে যদি আসতে হত, তাহলে ঘোড়াটার গায়ে ধুলোবালি ঘাম থাকত। কিন্তু হেথার্লি দেখেছিল ঘোড়াটা একেবারে ঝকঝকে তাজা।

দু-নম্বর সমাধান–হেথার্লি নিজেই। তেলের বাতিটা ফেলে এসেছিল মেশিন ঘরে। সে ঘরে দেওয়ালগুলো কাঠের। বাতি ভেঙে যেতেই কাঠে আগুন লেগে গেছিল।

তিন নম্বর সমাধান–টিন আর নিকেলের গুঁড়ো দেখেই হেথার্লি টের পেয়েছিল মেকি টাকার কারখানা খুলে বসেছে কর্নেল।

চার নম্বর সমাধান–ছোট পা একজন মহিলার, ভারী পা ভারী লোকের। অর্থাৎ জার্মান মেয়েটা মোটা ইংরেজকে নিয়ে হেথার্লিকে পাঁজাকোলা করে তুলে এনেছিল নিরাপদ জায়গায়। বাড়িতে আগুন লাগার পর পালানো ছাড়া আর পথ ছিল না। ইংরেজের প্রাণটা একটু নরম ছিল বলেই হেথার্লিকে আর প্রাণে মারেনি।

* সাপ্তাহিক অমৃত পত্রিকায় প্রকাশিত। ১৩৮১।

স্যার আর্থার কোনান ডয়ালের গল্প নিয়ে গোয়েন্দা ধাঁধা
বউ উধাও। শার্লক হোমস

গোয়েন্দা হওয়ার ঝকমারি অনেক। বিশেষ করে আইবুড়ো গোয়েন্দার। বউ হারালেও বউকে খুঁজে আনতে হয়-বউয়ের মর্যাদা না বুঝেও।

বেচারা শার্লক হোমস-কেও এই জোয়াল কাঁধে বইতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার কেলেঙ্কারির কথা কে না জানে। আরেকবার প্রায় একই ঘটনা ঘটল লর্ড সাইমনের বিয়ের পর।

কী বিশ্রী ব্যাপার! টি-টি পড়ে গেল সারা লন্ডন শহরে। তারপরেই অবশ্য দরদে বুক উথলে উঠল যখন লেডি সাইমনের জামাকাপড় পাওয়া গেল একটা লেকে। আহারে! বিয়ের পরেই বিপত্নীক।

ঘটনাটা গোড়া থেকে না বললে জমবে না। লর্ড সাইমন ইংল্যান্ডের সেইসব জমিদার-তনয় যাদের বংশের নামের ডাকেই গগন ফাটে, কিন্তু তালপুকুরে ঘটি ডোবে না। মাঝখানে খুব হিড়িক উঠেছিল আমেরিকার টাকাওলা মেয়েদের পটিয়ে বিয়ে করে ফেলা এবং মোটা বরপণ নিয়ে নতুন করে কাপ্তেনি করা।

লর্ড সাইমন তার ব্যতিক্রম নন। লন্ডনের কাগজে কাগজে এই নিয়ে ঝালমশলা মুড়ির মত জিভে জল ঝরানো খবর ছাপা হল অনেকবার। কনের বাবার নাকি টাকা গুণে শেষ করা যায় ্না –খনির মালিক তো। মেয়েটারও কেবল ডানা দুটো নেই বাদবাকি অবিকল পরির মতোই। কিন্তু এইসব দেখে কোনওক্রমে ভোলো উচিত হয়নি লর্ড সাইমনের ইত্যাদি ইত্যাদি।

ফালতু কথায় কান না দিয়ে ঝটপট বিয়েটা সেরে ফেললেন লর্ড মহাশয়। বয়স তার কম। হুকুম করার জন্যেই জন্মেছেন হুকুমমাফিক কাজ করিয়ে নিতেও জানেন। বিয়েটাও একটা হুকুম। সুতরাং বউ বেচারিকেও আশা করেছিলেন সেবাদাসীর মতো খাটাবেন–দরকার মতো মোচড় মেরে টাকাও বার করে নেবেন।

কিন্তু কী আশ্চর্য! কী আশ্চর্য! বিয়ে সেরে বাড়ি পৌঁছতে না পৌঁছতেই বাতাসে মিলিয়ে গেল বউ! লর্ড সাইমন মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন। ঘরভরতি লোক তখন একপেট খিদে নিয়ে বসে আছে খাওয়ার টেবিলে কনেবউ এসে বসলেই মুরগির ঠ্যাং চিবোবে–এমন সময়ে খবর এল কনে উধাও।

সঙ্গে-সঙ্গে পুলিশ এসে গেল। পুলিশ মানে ইন্সপেক্টর লেসট্রেড। যার চেহারা খর্বকায় নেউলের মতো। বেজায় চটপটে। বেজায় ধুরন্ধর। বেজায় প্র্যাকটিক্যাল। অনুমান ফনুমানের ধার ধারে না। সে এসে দেখলে ফ্লোরা মিলার বলে একটা নাচুনে মেয়ে এসে বাড়িতে হামলা জুড়েছিল। লর্ড সাইমনকে নাকি এত সহজে সে হাতছাড়া করতে রাজি নয়। ফুর্তি করার সময়ে মনে ছিল না? ফ্লোরাকে নাকি ঘাড় ধরে বার করে দেওয়া হয় বাড়ি থেকে। তারপর সেই ফ্লোরার সঙ্গেই নাকি লেডি সাইমনকে বাগানে পাশাপাশি হাঁটতে দেখা গেছে। সুতরাং কেসটা জলবৎ তরলম। অর্থাৎ ফ্লোরাই গায়েব করেছে লেডি সাইমনকে। মেয়েরা ভারী হিংসুটে হয়। হবুবর পালালে বাঘিনী হতেও আপত্তি নেই। সুতরাং পাকড়াও ফ্লোরা মিলারকে।

প্রমাণ? লেসট্রেড অত কাঁচা ছেলে নয়। তাও জুটিয়ে ফেলল সার্পেন্টাইন লেকের জল থেকে। লেডি সাইমনের পরিত্যক্ত জামাকাপড় পাওয়া গেলেও অবশ্য লাশটা পাওয়া গেল না। তাই বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়ার জন্যে প্রতিবারের মতো এবারও শখের গোয়েন্দার পায়ে তেল দেওয়ার জন্যে বেকার স্ট্রিটের আইবুড়ো মন্দিরে হাজির হল সরকারি গোয়েন্দা।

শার্লক হোমস তখন সবে বিদেয় করেছে লর্ড সাইমনকে। কেসটা গোড়া থেকে শেষপর্যন্ত শুনে নিয়ে মনে-মনে সাজিয়েও ফেলেছে। সামান্য দু-চারটে প্রশ্ন অবশ্য করেছিল। লর্ড সাইমন তার জবাবে বলেছেন, ক্লারা, মানে তার সদ্য উধাও বউয়ের মাথাটা বিয়ের আগে থেকেই একটু বেসামাল ছিল বলে মনে হয়। নইলে ফ্লোরার ভয়ে এভাবে কেউ পালায়? ফ্লোরার সঙ্গে লটঘট ছিল কিনা? তা হ্যাঁ, একটু-আধটু ছিল বইকি। বিয়ের আগে কার না থাকে? তাই বলে বাড়ি বয়ে বিয়ে ভণ্ডুল করতে আসবে? এত বড় স্পর্ধা? ক্লারাকেও বলিহারি যাই। বিয়ে করতে গেল হাসতে-হাসতে। বরকে নিয়ে ফিরে এল মুখখানা তোলা হাঁড়ির মতো করে। গির্জের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাওয়ার সময়ে হাতের ফুলের তোড়াটা পড়ে গেল মেঝেতে। একজন গেঁইয়া টাইপের লোক তুলে দিল হাতে। তারপরেই বাড়ি ফিরে এসে ওর বাপের বাড়ির ঝি-কে ডেকে কী যে বলল ভগবান জানেন। একটা কথা শুধু কানে এসেছিল। কথাটা আমেরিকার চাষাড়ে লোকদের মধ্যেই চালু। কথাটার সাদা মানে হল, আগের জিনিসের ওপর দাবি নিয়ে তা দখল করা।

ঝি-য়ের সঙ্গে গজর-গজর করার পরেই হাওয়া হয়ে গেল ক্লারা। ব্যাপারটা সিরিয়াস। লর্ড সাইমনের ইজ্জৎ বলে একটা কথা আছে।

সব শুনে নিয়ে লর্ডকে বাড়ি ফেরত পাঠাল হোমস। তারপরেই ধূর্ত হাসি হেসে ঘরে ঢুকল লেসট্রেড।

সোল্লাসে বলল হোমস, আসা হোক! আসা হোক! কিন্তু কোটের হাতা ভিজে কেন বৎস?

সার্পেন্টইনে জাল ফেলেছিলাম যে।

জাল! সার্পেন্টাইনে। কেন? চোখ কপালে উঠে গেল হোমসের।

লেডী সাইমনের লাশ তোলার জন্যে। হোমসের অজ্ঞতা দেখে অনুকম্পার সঙ্গেই বলল লেসট্রেড। সেইসঙ্গে বললে লেডির জামাকাপড় পাওয়ার বৃত্তান্ত। এমনকী ফ্লোরা মিলার যে এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত তার প্রমাণ পর্যন্ত নাকি পাওয়া গেছে লেডির পোশাকের পকেটে।

অতি তুচ্ছ প্রমাণ। একটুকরো ছেঁড়া কাগজ। তার ওপর পেনসিল দিয়ে লেখা?

একটু সামলে নিয়ে দেখা করো আমার সঙ্গে।

–এফ, এইচ এম।

মোক্ষম প্রমাণ। ফ্লোরা মিলারকে ঘানি ঘুরিয়ে ছাড়বে লেসট্রেড এই একটা প্রমাণের জোরে।

ভীষণ উৎসুক হয়ে কাগজটা হাত পেতে নিল হোমস। দেখতে-দেখতে চোখেমুখে ফুটে উঠল প্রচণ্ড কৌতুক। অট্টহাসি হেসে বললে, সাবাস!

কিন্তু একী! আপনি উলটোদিকে দেখছেন কেন? আঁতকে উঠল লেসট্রেড।

উলটো কোথায়? ওইটাই তো সোজা দিক হে! হোটেলের বিলের ভেঁড়া টুকরো তো! পেছনের হিসেবটাই আসল।

ও হিসেব আমিও দেখেছি। চৌঠা আগস্টের তারিখ আর ঘরভাড়ার জন্যে ৮ সিলিং দেওয়া হয়েছে জেনে আমার লাভ? রেটটা যদিও চড়া–

আরেক দফা অট্টহাসি হেসে হোমস বললে, বৎস লেসট্রেড, শুধু একটা কথাই শুনে যাও। লেডি সাইমন বলে কেউ নেই, কোনওকালেই ছিল না!

বিমূঢ় লেসট্রেড বিদেয় হতেই সুট করে বেরিয়ে পড়ল শার্লক হোমস। ওয়াটসন বেচারি বসে রইল একা-একা। কিছুক্ষণ পরেই হোটেল থেকে লোকজন এসে পাঁচজনের খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল টেবিলে। ওয়াটসন বুঝল না কেন এই রাজসিক আয়োজন। তারও অনেকক্ষণ পরে

হোমস ফিরে এসে বললে, যাক, খাবার এসে গেছে। তারাও এলেন বলে।

কারা?

লর্ড সাইমন এবং আরও দুজন।

বলতে না বলতেই ঘরে ঢুকলেন সাইমন। চোখমুখ লাল। ভীষণ উত্তেজিত, বিচলিত এবং হতচকিত।

কী বলছেন মশায়? টেবিল চাপড়াতে-চাপড়াতে বললেন লর্ড। আপনি ঠিক জেনে বলছেন তো?

ঠিকই বলছি।

কিন্তু এ যে সাংঘাতিক অপমান, ঠকাঠক-ঠকাঠক শব্দে টেবিলে আঙুল বাজাতে লাগলেন লর্ড। পরক্ষণেই তড়াক করে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে কটমট করে চেয়ে রইলেন দরজার দিকে।

দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন একজন ডানাকাটা পরি। পাশে একজন ছোটখাটো চেহারার চটপটে লোক।

পরিচয় করিয়ে দিল শার্লক হোমস, মিস্টার অ্যান্ড মিসেস ফ্রান্সিস হে মুলটন!

ক্লারা! বজ্রকণ্ঠে হুঙ্কার ছাড়লেন লর্ড।

ডানাকাটা পরিটি এগিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বললে, রবার্ট, খামোকা রাগ করো না। ফ্রান্সিসের সঙ্গে অনেক আগেই গোপনে বিয়ে হয়ে গেছিল আমার। বাবা জানতেন না। ফ্রান্সিস গরিব ছিল বলে জানাইনি। কিন্তু ও পণ করেছিল আরও বড় খনির মালিক হয়ে এসে তবে আমাকে ঘরে নিয়ে যাবে। কিন্তু বছর খানেক পরেই খবরের কাগজে ওর নাম দেখলাম–খনি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। তারপরেও অনেকদিন বসে থাকার পরেও যখন ও এল না, বাবার জেদে আমার দেহটা তোমাকে দেব ঠিক করলাম–মনটা নয়। তুমি বলো, আমি ঠিক করেছি না বেঠিক করেছি?

আমি চললাম কাঠের পুতুলের মতো পা বাড়ালেন লর্ড।

কোথায় যাবেন? খেয়েদেয়ে তারপর যাবেন। বলল হোমস।

এরপরেও খাওয়া নামবে গলা দিয়ে? বলে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উধাও হলেন লর্ড সাইমন।

বেচারা! নাকের ডগা দিয়ে ফস্কে গেল রাজকন্যা এবং আধখানা রাজত্ব। কিন্তু রহস্য সমাধানের সূত্রগুলো এখনও আপনার সামনে থেকে পালাতে পারেনি। সামনেই আছে। বলুন দিকি কী?

গোয়েন্দা ধাঁধার সমাধান

হাসতে-হাসতে বিয়ে করতে গেল ক্লারা, ফিরে এল মুখখানা বাংলা পাঁচ করে। কী ঘটেছিল মাঝখানে? না, হাত থেকে ফুলের তোড়া পড়ে গিয়েছিল গিঞ্জের সিঁড়িতে তুলে দিয়েছিল একজন গেঁইয়া চেহারার লোক। তারপরেই গেঁইয়া ভাষায় ঝি-কে বললে ক্লারা আগের জিনিসের দাবি নিয়ে তা দখল করতে হবে। কী সেই জিনিস? না একটা চিরকুট পাওয়া গেল ক্লারার পরিত্যক্ত পকেটে তাতে অমুক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে ক্লারাকে। চিরকুটটা ক্লারার পকেটে এল কখন? গির্জের মধ্যে ফুলের তোড়া হাতে তুলে দেওয়ার সময়ে নয় তো? গেঁইয়া চেহারার সেই লোকটার নামের আদ্যক্ষর এফ এইচ এম? সে চৌঠা আগস্ট লন্ডনের একটা দামি হোটেলে উঠেছিল। সেখানকার ঘরভাড়া দৈনিক ৮ সিলিং। পুরো ব্যাপারটাতেই পূর্ব-প্রণয়ীর গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না?

খোঁজ..খোঁজ…খোঁজ। লন্ডনে এমন খানদানি হোটেল বলতে তো মাত্র আটটা। তার একটিতে এক ভদ্রলোক উঠেছিলেন চৌঠা আগস্ট–নামের আদ্যক্ষর এফ এইচ এম–অর্থাৎ ফ্রান্সিস হে মুলটন।

পরিষ্কার হয়ে গেল হেঁয়ালি। ক্লারা-র ঝি ক্লারার বিয়ের জামাকাপড় পুঁটলি পাকিয়ে ফেলে দিয়ে এসেছিল সার্পেন্টাইনে–পুলিশকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যে ক্লারাকে অন্য পোশাকে পাচার করে দিয়েছিল বাড়ির বাইরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *