ইজ্জত বাঁচাতে
শকুন্তলাদেবীর শরীরটা বিশেষ ভালো নেই, বাতের ব্যাথাটা খুবই বেড়েছে। ছেলে সপ্তর্ষি পুলিশে কাজ করে। রাতে ডিউটি। কাজের মেয়েটা দুদিন ছুটিতে। ভাবছে মাকে একা রেখে কি করে যাবে। মাকে বললো, আজকে তাড়াতাড়ি চলে আসবো,একটু সাবধানে থেকো।
কাজে যাওয়ার জন্য মোটরসাইকেল বের করছে , হঠাৎ দেখে কিছু ছেলে হৈহৈ করে তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। সপ্তর্ষি তাড়াতাড়ি গেটের বাইরে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে? পুলিশের উর্দি পরা দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে একজন বললো, এখানে কোনো বাচ্চা মেয়ে এসেছে ? দশ-বারো বছরের?
সপ্তর্ষি অবাক হয়ে বলে, হারিয়ে গেছে? নিকটবর্তী থানায় জানান। লোকগুলো কিছু না বলে চলে গেলো। সপ্তর্ষিও কাজে রওনা দিলো।
শকুন্তলাদেবী দরজা বন্ধ করে ফিরতেই দেখে একটি মেয়ে হাতজোড় করে বলছে, আমায় বাঁচান, ওরা আমাকে নিয়ে গিয়ে মায়ের মতো বন্দি করে মারবে।
শকুন্তলাদেবী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করে, কীভাবে ঢুকলি এখানে! মেয়েটি বললো, আমি পাঁচিল টপকে তোমার বাগানে লুকিয়ে ছিলাম। দাদাবাবু লোকগুলোর সাথে কথা বলতে বেরোলে আমি হামাগুড়ি দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি।
শকুন্তলাদেবী ভাবে এ মেয়ে লোকগুলোর চর নাতো! বললেন, দেখলি তো দাদাবাবু পুলিশ। ঘরে চুরি ডাকাতি হলে রক্ষে রাখবেনা। মেয়েটি বলে, আমায় তাড়িয়ে দিওনা, আমি চোর না। সকাল হলেই চলে যাবো।
শকুন্তলাদবীর মায়া হলো। খাওয়ার দিয়ে বললেন,খেয়েনে। তারপর তোর মায়ের কথা শুনবো।
খাওয়ার পর, মেয়েটি বলে আমার নাম পূজা, মা বলে বাবার দেওয়া নাম।
মা আমার গরিব পরিবারের মেয়ে ছিল। প্রেম করে বিয়ে করেছিল বড়লোক বাড়ির ছেলেকে। মা’কে শ্বশুর-শাশুরি মেনে নেয়নি। আমি হওয়ার দুবছর পর মাকে ছেড়ে বাবা অন্য মেয়েকে বিয়ে করে।
মা কি করবে! কিছু কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য পরিচিত সবাইকে বলতে থাকে। পাড়ার এক দাদু মা’কে কাজ দেবার নাম করে এখানে বিক্রি করে দেয়। আমি তখন কোলের। বড় হলে মা আমাকে জানায় ওখানকার পরিবেশ কীরকম। মা প্রতিদিন ফুল কেনার পয়সা দিয়ে বলতো ফুল কিনে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে আসবি। আমি তাই করতাম।
দুদিন আগে মা বলে, তুই ফুল বিক্রি করতে গিয়ে যেখানে পারবি পালিয়ে যাবি, নাহলে তোর ইজ্জত বাঁচাতে পারবোনা। আমি খুব কাঁদলাম; তোমায় ছেড়ে কোথায় যাবো? আমি যে কিছুই চিনিনা! মা বললো, নদীতে ডুবে মরা ভালো – এই নরকে থাকার থেকে।
সকালবেলা ফুল বিক্রি করতে বেরোবার সময় ব্যাগে দুটো জামা নিই। মালতি মাসি ব্যাগ টেনে নিয়ে বললো, জামা কেন? কোথায় যাবি? আর যেতে হবেনা বলে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিল। মা বললো, সর্বনাশা! আমি ঠিক বুঝেছি, এবার তোকে ব্যাবসায় নামাবে। তোকে পালাতেই হবে।
দুপুর বেলায় সবাই খেয়ে যখন সাজতে ব্যস্ত ; মাসিও বিশ্রাম নিচ্ছে, মা আমায় নিয়ে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাতে টাকা দিয়ে বললো, নোংরা ফেলার এই গলি দিয়ে পালা। আমি দৌড়াতে দৌড়াতে অনেক দূরে রাস্তা হারিয়ে একটা জঙ্গলপূর্ণ জায়গায় বসে থাকি। রাত্রি হলে আমার ভয় লাগলো, খিদেও পেয়েছিল। আমি খাবার কিনতে দোকানে গেলে, কিছুলোক আমায় দেখে বললো ঐতো মেয়েটা। শুনেই আমি দৌড়াতে থাকি আর পিছনে ওরা। তারপর তোমার বাড়ি ঢুকে পড়ি।
শকুন্তলাদেবীর চোখ অশ্রুসজল হলো। ভাবে অভাগী মা এতটুকু মেয়ের ইজ্জত বাঁচাতে অজানায় ছেড়ে দিলো! কিন্তু দুনিয়ায় তো হায়নার অভাব নেই। আমি এই মেয়েকে কী করে হায়নার মুখে ঢেলে দেবো?
ছেলে এলে শকুন্তলাদেবী ঘটনাবৃত্তান্ত জানিয়ে বললেন, ও আমার কাছে থাকবে, আমার সবসময়ের সাথী হবে, তুই ওকে রাখার আইনি ব্যবস্থা কর। আমি ওকে পড়াশুনা, সংসারের যাবতীয় শেখাবো। পূজার জীবনের আলোর দিশারী হয়ে শকুন্তলাদেবী তাকে নাতনির স্নেহ দিয়ে ঘরে রাখলেন।