আসন
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেল। দরদাম, দলিলদস্তাবেজ, ইনকামট্যাক্স ক্লিয়ারেন্স, সব। সব হয়ে যাবার পর গলদঘর্ম বাড়ি ফিরে একটু জল গরম করে নিয়ে ঠাকুর্দার আমলের বাথটাবটাতে শুয়ে শুয়ে বিকেল সাড়ে তিনটেয় একটা লম্বা। অবগাহন স্নান। আ-ই। যেন অনেক দিনের পুরোনো পাপের বোঝা নেমে গেল। ঘাড় থেকে। শুধু স্নান নয়, শুচিস্নান। সত্যিই, পিছটান বলে তো কিছু নেই। শুধু আপনি আয় কপনি। তা আপনির ইচ্ছেমতো কপনি চলবে? না কপনির। ইচ্ছেমতো আপনি! এ ক-দিনের মধ্যে এই নিয়ে বোধহয় সাতবারের বার গুরুদেবের ছবির দিকে তাকিয়ে দু-হাত কপালে ঠেকাল সুনন্দা। স্থাবর সম্পত্তির বড়ো জ্বালা! বড়ো গুরুভার। হালকা হয়ে যে আকাশে পাখা মেলতে চায় ইট-কাঠ তার ঘাড়ের ওপর অনড় হয়ে বসে থাকলে সে বাঁচে কেমন করে? সবই গুরুদেবের কৃপা! বাড়িটা শেষ পর্যন্ত কিনতে রাজিই হয়ে গেল শরদ দেশাই। তিন শরিকের এক শরিকি অংশ। বাবা নিজের অংশটুকু ঢেলে সাজিয়ে নিয়েছিলেন তাই বাসযোগ্য ছিল এতদিন। সামনের উঠোন চৌরস করে ভেঙে খোলামেলা নিশ্বাস ফেলবার জায়গা খানিকটা। একটা আম গাছ, একটা নিম, সেগুলো ফেলেননি। নিম-আমের হাওয়া ভালো। তা ছাড়াও আমের কোঁকড়া পাতায় ফাগুন মাসে কেমন কচি তামার রং ধরে! বাকি জায়গাটুকু নানারকমের বাহারি গাছপাতা দিয়ে সাজানো। ফুল গাছ নয়, পাতাবাহার। বাবার শখের গাছ সব। না-বাগান না-উঠোন এই খোলা জায়গাটুকু পার হতে হতে দোতলার লাল টালি ছাওয়া বারান্দাখানা চোখে পড়বে। তার ওপর ছড়ানো বোগেনভিলিয়ার ফাগ আর মুক্তো রঙের ফুলঝুরি। মার্চ-এপ্রিল থেকে ফুল ফোঁটা শুরু হবে, চলবে সেই মে অবধি।
বারান্দাটা যেন বেশ বড়োসড়ো একখানা মায়ের কোল। তেমনি চওড়া, নিশ্চিন্ত। নির্ভয়। সুনন্দার নিজের মায়ের কোলটিও বেশ বড়োসড়ো ছাড়ালো দোলনার মতোই ছিল বটে। মনে থাকার বয়স পর্যন্ত সেই শীতল, গভীর কোলটিতে বসে কত দোল খেয়েছে সুনন্দা। তারপর মায়ের বোধহয় বড্ড ভারি ঠেকল। হাত-পা ঝেড়ে চলে গেলেন, ফিরেও তাকালেন না। টাকার সাইজের এক ধামি সাদা ময়দার গোল পিংপং বলের মতো লুচি সাদা আলুভাজা দিয়ে না হলে যে সুনন্দা রেওয়াজে বসতে পারে না এবং সে-জিনিস যে আর কারও হাত দিয়েই বেরোবার নয় সে-কথা মায়ের মনে থাকল না।
অনেকদিন আগলে ছিলেন বাবা। মায়ের কোল থেকে বাপের কাঁখ, সে তো কম পরিবর্তন নয়। ঈশ্বর জানেন বাবাকে মা হতে হলে স্বভাবের নিগুঢ় বাৎসল্য রসের চালটি পর্যন্ত পালটে ফেলতে হয়। তিনি কী তা পারেন? কেউ কী পুরোপুরি পারে? মায়ের জায়গাটা একটা বায়ুশূন্য গহ্বরের মতো খালি না থাকলে বুঝবে কেন সে কে ছিল। কেমন ছিল? বোঝা যে দরকার। মা হতে পারেননি, কিন্তু চেষ্টা করেছিলেন, তাই বাবা আরও ভালো বাবা, আরও পরিপূর্ণ বাবা হতে পেরে গিয়েছিলেন। পাঁচজন যেমন বউ মরলেই হুল দিয়ে থাকে তেমন দিয়েছিল বই কি! তিনি চেয়েছিলেন মাথায় আধ-ঘোমটা গোলগাল ছবিটির দিকে। চোখ দুটি ভারি উদাস, কিন্তু ঠোঁটের হাসিতে ফেলে-যাওয়া সংসারের প্রতি মায়া ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা। তারপর ফিরে তাকিয়েছিলেন ঘুমন্ত ফুলোফুলো মুখ, ফুলো-ঠোঁট আর বোজা চোখ দুটির দিকে। ঘুমের মধ্যে চোখের মণিদুটো পাতার তলায় কাঁপছে। আহা! বড়ো বনস্পতির বীজ। কিন্তু কত অসহায়! মাতৃকুলে যন্ত্রসংগীত পিতৃকুলে কণ্ঠসংগীত। সরু সরু আঙুলে এখনই কড়া পড়ে গেছে। ওইটুকুন-টুকুন আঙুল তার টেনে টেনে এমন নাজনখরা বার করে যে মনে হবে রোশেনারা বেগম স্বয়ং বুঝি হেরি গুনগুন করছেন।
মানুষের আপন পেটের বাপ-মা কি দুটো হয়? ভ্যাবলা মেরে-যাওয়া কন্যাদায়গ্রস্ত কিংবা হিতৈষীদের তাঁর এই একই উত্তর। নাও এখন মানে করো।
বালিকা থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে তরুণী, তরুণী থেকে যুবতি বাবা ঠায় কাঁধে মাথাটি নিয়ে। আয় ঘুম যায় ঘুম বর্গিপাড়া দিয়ে। একটি দিনের জন্যও ঢিলে দেননি। সনি নতুন শীত পড়েছে, বালাপোয়খানা বার কর, সুনি, আদা তেজপাতা গোলমরিচ দিয়ে ঘি গরম করে খা, গলাটা বড়ই ধরেছে, টানা তিন ঘন্টা রেওয়াজ হল সুনি, আজ যেন আর খুন্তি ধরিসনি, তোর বাহন যা বেঁধেছে তাই ভালো।
মাতৃহীন, অবুঝ, অভিমানী, তার ওপর অমন গুণী পিতৃদেব কিছুতেই আর বিয়ের জোগাড় করে উঠতে পারেন না। পাত্র ঠিক বলে তো পাত্রের বাড়ি যেন উলটো গায়। বাড়ি-ঘর ঠিক আছে তো পাত্র নিজেই যেন কেমন কেমন! অমন ধ্রুপদি বাপের সেতারি মেয়ের পাশে দাঁড়াবার যুগ্যি নয়। গুণীর পাশে দাঁড়াতে হলে গুণী যে হতেই হবে তার কোনো মানে নেই। কিন্তু সমঝদারিটাও না জানলে কি হয়? বাবার যদি বা পছন্দ হয়, মেয়ে তা-না-না-না করতে থাকে।
অমনি রাঙা মুলোর মতো চেহারা তোমার পছন্দ হল বাবা? সবসুদু ক-মণি হবে আন্দাজ করতে পেরেছ?
মেয়ের যদি বা পছন্দ হল তো বাপের মুখ তোম্বা হয়ে যায়, হলই বা নিজে গাইয়ে। দু-দিন পরেই কমপিটিশন এসে যাবে রে সুনি, তখন না জানি হিংসুটে কুচুটে তোর কী হাল করে!
এই হল সুনির বিবাহ বৃত্তান্ত। বেলা গড়িয়ে গেলেও উৎসুক পাত্রের অভাব ছিল না। কে বাগেশ্রী শুনে হত্যে দিয়ে পড়েছে, কে দরবারির আমেজ আর কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছে না। কিন্তু পিতা-কন্যার মন ওঠেনি। আসল কথা ধ্রুপদি পিতার ধ্রুবপদটি যে কন্যা! আর কন্যা তার পরজ-পঞ্চমের আরোহ-অবরোহ যখন ঘাট নামিয়ে-নামিয়ে বেঁধে নিয়েছিল পিতার সুরে, জীবনের সুরটিও তখনই ঠিক তেমনি করেই বাঁধা হয়ে গেছে।
বেলা যায়। বেলা কারও জন্যে বসে থাকে না। একটু একটু করে একজনের মাথা ফাঁকা হতে থাকে। আরেকজনের রুপোর ঝিলিক দেয় মাথায়। বাবার মুখে কালি পড়ে। শেষে একদিন পাখোয়াজ আর পানের ডিবে ফেলে উঠে আসেন শীতের মন-খারাপ-করা সন্ধ্যায়।
কী হবে মা, বেশি বাছাবাছি করতে গিয়ে আমি কি তোর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করে দিলুম?
ঝংকার দিয়ে উঠল সুনন্দা, করেছই তো, খুব করেছ, বেশ করেছ! এখন তোমার ডিবে থেকে দুটো খিলি দাও দেখি, ভালো করে জর্দা দিও, কিপটেমি করো না বাপু! হেসে ফেলে মেয়ে। বাপের মুখের কালি কিন্তু নড়ে না।
অবশেষে সুনন্দা হাত-দুটো ধরে করুণ সুরে বলে, বাবা, একবারও কি ভেবে দেখেছো, আর কেউ সেবা চাইলে আমার সেতার, সুরবাহার, আমার সরস্বতী বীণ সইবে কীনা! এই দ্যাখো–কড়া পড়া দু-আঙুল বাড়িয়ে দিয়ে সুনন্দা বলে, এই দ্যাখো আমার বিবাহচিহ্ন, এই আমার শাঁখা, সিঁদুর।
আমি চলে গেলে তোর কী হবে সুনি, আঁধার মুখে বাবা বললেন।
বাঃ, এই আমার একলেশ্বরীর শোবার ঘর, ওই আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার ঠাকুরঘর, ও-ই আমার জুড়োবার ঝুলবারান্দা, আর বাবা নীচের তলায় যে আমার তপের আসন! আমি তো আপদে থাকব না! এমন সজ্জিত, নির্ভয় আশ্রয় আমার, কেন ভাবছ বলো তো?
বাবার মুখে কিন্তু আলো জ্বলল না। সেই আঁধার গাঢ় হতে হতে যকৃৎ ক্যান্সারের গভীর কালি মুখময়, দেহময় ছড়িয়ে পড়ল। অসহায়, কাতর, অপরাধী দু-চোখ মেয়ের ওপর নির্নিমেষ ফেলে রেখে তিনি পাড়ি দিলেন।
তারপরও দশ-এগারোটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেছে, সুনন্দা খেয়াল করতে পারেনি। রেডিয়োয়, টেলিভিশনে, কনফারেন্সে, স্বদেশে-বিদেশে উদ্দাম দশটা বছর। খেয়াল যখন হল তখন আবারও এক শীতের মন-খারাপকরা সন্ধ্যা। এক কনফারেন্সে প্রচুর ক্লিকবাজি করে তার প্রাপ্য মর্যাদা তাকে দেয়নি, চটুল হিন্দি ফিলমের আবহসংগীত করবার জন্য ডাকাডাকি করছে এক হঠাৎ-সফল সেদিনের মস্তান ছোকরা, যে গানের গ-ও বোঝে না, এখনও এই বয়সেও এক আধা বৃদ্ধ গায়ক এত কাছ ঘেঁষে বসেছিলেন যে টেরিউলের শেরওয়ানির মধ্যে আটকে পড়া ঘামের দুর্গন্ধ দামি আফটার শেভের সৌরভ ছাপিয়ে যেন নাকে চাবুক মেরেছে।
সামনের কম্পাউন্ডে নিমের পাতা আজ শীতের গোড়ায় ঝরে গেছে। আম্রপল্লবের ফোকরে ফোকরে শীতসন্ধ্যার কাকের চিকারি কানে তালা ধরায়, শরিকি বাড়ির ডান পাশ থেকে স্বামী-স্ত্রীর চড়া বিবাদী সান্ধ্য ভূপালির সুর বারবার কেটে দিয়ে যাচ্ছে। বাঁ দিকের বাড়ি থেকে কৌতূহলী জ্ঞাতিপুত্র বারান্দায় মুখ বাড়িয়ে থেকে থেকেই কী যেন দেখে যাচ্ছে। এত রাগ-রাগিণীর ঠাট মেল জানা হল, নিজের রক্তের এই রক্তবীজটি যে কোন ঠাটে পড়ে, কী যে ও দ্যাখে আর কেন যে, সুনন্দা তা আজও ধরতে পারল না। শিল্পী বাড়ির শরিক যে কী করে এত রাম-বিষয়ী হয়, তাও তার অজানা। দেখা হলেই বলবে, তোমাদের ড্রেনটা ভেন্ন করে ফ্যালো, আমি কিন্তু কর্পোরেশনে নোটিফাই করে দিয়েছি, এর পরে তুমি শমন পাবে। হয় এই, আর নয়তো বলবে, ইস মেজদি, চুলগুলো তোমার এক্কেবারেই পেকে ঝুল হয়ে গেল। বয়ঃ কত হল বলো তো!
চুল পেকে গেলে যে কী করে ঝুল হয় তা সুনন্দা জানে না। আর, বিসর্গ যে উচ্চারণ করতে পারে স উচ্চারণ করতে তার কেনই বা এত বেগ পেতে হবে, তা-ও জানে না। ও যেন যমের দক্ষিণ দুয়ার থেকে রোজ এসে একবার করে জানান দিয়ে যায়। এই যে মেজদি, তুমি হয়ে গেলেই আমার হয়ে যাবে।
সামনের ঝুপসি অন্ধকারের দিকে চেয়ে সুনন্দা হঠাৎ বলে উঠল, ধ্যাত্তেরি।
বারান্দার আরামচেয়ার থেকে সে উঠে পড়ে, শোবার ঘরে ঢুকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে তার একলার খাট-বিছানা, চকচকে দেরাজ-আলমারি, দেয়াল আয়নার গোল মুখ, আবার বলে-ধ্যাত্তেরিকা। পাশে ছোট্ট ঠাকুরঘর। সোনার গোপাল, কষ্টিপাথরের রাধাকৃষ্ণ এসব তাদের কুলের ঠাকুর। মার্বেলের শিব, কাগজমণ্ডের বুদ্ধ, পেতলের নটরাজ, এসব শেলফের ওপর, নানা ছাত্রছাত্রী, গুণমুগ্ধ অনুরাগীর উপহার। চারদিকে সাদা পঙ্খের দেয়াল, খালি, বড্ড খালি। সিলিং থেকে জানলার লিনটেল বরাবর বেঁকা একটা চিড় ধরেছে। সেই খালি দেওয়ালে একটি যোগীপুরুষের ছবি। সেই দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে তাকিয়ে শেষকালে সে বলে, তুমিই ঠিক। তুমিই সত্য। তুমিই শেষ আশ্রয়।
ড্রয়ারের ভেতরে ফাইল, ফাইলের ভেতর থেকে মধুরাশ্রম ছাপ মারা খামটা দিনের মধ্যে এই তৃতীয়বার সে তুলে নেয়।
মোটা সুতোর কাগজ। হাতের লেখা খুব জড়ানো। ঠাকুর এক বছর ধরে রোগশয্যায়। স্মিতমুখে শবের মতো টান-টান শয়ান। বুকের ওপর খাপ কাটা হেলানো লেখার ডেস্ক, মাথার দিকটা তোলা। ঠাকুর সিদ্ধদাস নিজ হাতে সুনন্দাকে এই চিঠি দিয়েছেন অন্তত ছ-মাস আগে।
সুরাসুরসিদ্ধাসু মা সুনন্দা,
তোমার সমস্যা নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ অনেক ভাবাভাবি করেছি মা। আমি ভাবার কেউ নয়, যাঁর ভাবনা তিনি ভাবছেন বলেই বুঝি তোমার সুরসমুদ্রটি এবার এমন স্রোত গুটিয়ে ভাঁটিয়ে চলল। তোমার হৃদয়ে যখন তাঁর ডাক। এমন করে বেজেছে তখন দরজা দু-হাতে বন্ধ রাখবে সিদ্ধদাসের সাধ্য কী? তুমি এসো। মনের সব সংশয়, দ্বিধা ছিন্ন করে চলে এসো। বিষয়সম্পত্তি তুমি যেমনি ভালো বুঝবে, তেমনি করবে। আশ্রমে খাওয়া-থাকার জন্য নামমাত্র প্রণামি দিতে হয়। সে তো তুমি জানোই। এখানে বরাবর বাস করতে গেলে লালপেড়ে সাদা শাড়ি পরার বিধি। নিজের পরিধেয়র ব্যবস্থা তুমি নিজেই করবে। খালি এইটুকু মনে রেখো মা, তোমার বস্ত্র যেন অন্য আশ্রমিকাদের ছাড়িয়ে না যায়। তোমার যন্ত্র সব অবশ্যই আনবে মা। তাঁর আশ্রম স্বর্গীয় সুরলাবণ্যে ভরিয়ে তুলবে, তাতে কি আমি বাধা দিতে পারি? তোমার সিদ্ধি সুরেই। সে তুমি এখানেই থাকো, আর ওখানেই থাকো। আমি ধনঞ্জয়কে তোমার ঘরের ব্যবস্থা করে রাখতে বলছি। আসার দিনক্ষণ। জানিয়ো। গাড়ি যাবে। শ্রীভগবানের আশীর্বাদ তোমার ওপর সর্বদা থাকে প্রার্থনা করি।
সিদ্ধদাস
চিঠিটা কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ ঠাকুরঘরে জোড়াসনে বসে থাকে সুনন্দা। তারপর আস্তে আস্তে ওঠে। ঠাকুরকে ফুল জল দেয়, দীপ জ্বালে। ধূপ জ্বালে। একলা ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে, কালো পাথরের চকচকে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে। নিচের ঘরের তালা খুলে সুইচ টিপে দেয়। অমনি চারদিক থেকে ঝলমল করে ওঠে রূপ। আহা। কী রূপ, কত রূপ! কাচের লম্বা চওড়া শোকেসে শোয়ানো যন্তরগুলো। সবার ওপরে চড়া-সুরে-বাঁধা তার হালকা তানপুরা। পরের তাকে ঈশ্বর নিবারণচন্দ্র গোস্বামীর নিজ হাতে তৈরি, তার ষোলো বছর বয়সে বাবার উপহার দেওয়া তরফদার সেতার। তারপর লম্বা চকচকে মেহগনি রঙের ওপর হাতির দাঁতের সূক্ষ্ম কারুকাজ করা সুরবাহার। আর সবার শেষে, একেবারে নীচের তাকে অপূর্ব সুন্দর সমান সুগোল দৈবী স্তনের মতো ডবল তুম্বি শুদ্ধ সরস্বতী বীণ। তানসেনের কন্যা সরস্বতীর নামে খ্যাত সুগম্ভীর গান্ধবী নাদের বীণা। ডানদিকে নীচু তক্তপোশে বাবার খোল, মৃদঙ্গ, পাখোয়াজ। কোণে বিখ্যাত শিল্পীর তৈরি কাগজের সরস্বতী মূর্তি-কাগজ আর পাতলা পাতলা বেতের ছিলে। বাঁ-দিকে শ্বেতপাথরের বর্ণহীন-সরস্বতী, গুরুদেব জববলপুর থেকে আনিয়ে দিয়েছিলেন। বলতেন অবর্ণা মা। এই মূর্তির সানুদেশ ঘেঁষে মেঝের ওপর সমুদ্রনীল কার্পেট। তার ওপর সাদা সাদা শুক্তি-ছাপ। পাশেই আর একটি নীচু কাচের কেসে তার শেখাবার সেতার এবং ডবল ছাউনির টঙটঙে তবলা। ঘরের মাঝখানে নীচু নীচু টেবিল-সোফা-মোড়ায় বসবার আয়োজন। মায়ের হাতের নকশা করা চেয়ার-ঢাকা, কুশন-কভার এখনও জ্বলজ্বল করছে।
সুনন্দা এই সময়ে রেওয়াজে বসবার আগে এ ঘরেও দীপ ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। ঘর খুলতেই যেন কতকালের ধূপগন্ধ তার নাকে প্রবেশ করল। অগুরু গন্ধে আমোদিত ঘর। মার্বেলের প্রতিমার সামনে দীপগাছ জ্বালিয়ে বিজলিবাতি নিবিয়ে দিল সুনন্দা। আধা-অন্ধকার ঘর যেন গন্ধর্বলোক। বাবার পাখোয়াজের বোল কি শুনতে পাচ্ছে সুনন্দা? না, না, সেখানে শুধু ইষ্টনাম। শুনতে পাচ্ছে কি গুরুজির সেই অনবদ্য বঢ়হত, আচার, মন লুটিয়ে দেওয়া তারপরন? দীপালোকে অস্ফুট ঘরে প্রতিমার সামনে আসনপিড়ি হয়ে বসেছে সুনন্দা। হাতে নিবারণ গোঁসাইয়ের সেতার। সোনালি রূপালি তারে মেজরাপের ঝংকার। রাগ দেশ। গুরুজি সিদ্ধ ছিলেন এই রাগে। সেতার ধরলেও যা সুরবাহার ধরলেও তা। বীণকারের ঘরের বাজ। সুরে ডুবে ডুবে বাজাতেন। আলাপাঙ্গে তাঁর অসীম আনন্দ। আলাপ থেকে জোড়, মধ্য জোড়, ডুব সাঁতার কেটে চলেছেন। নদীর তলাকার ভারী জল ঠেলতে ঠেলতে গতের মুখটাতে এসে যখন তেহাই মেরে ভেসে উঠতেন তখন আঙুলে সে কী জলের উল্লাস! অনেকদিনের স্বপ্ন বুঝি আজ সত্য হল। যা ছিল রূপকথার কল্পনাবিলাস তা বুঝি ধরা পড়ে গেল প্রতিদিনের দিনযাপনের ছন্দে রূপে। এমনিই ছিল গুরুজির বাজের তরিকা। কনফারেন্সে বাজাতে চাইতেন না। অভ্যাস ছিল নিজের গুরুদেবের ছবির সামনে বীণ হাতে করে বসে থাকা। কিংবা। গুটিকতক নিষ্ঠাবান তৈরি ছাত্রছাত্রী ও সমঝদারের সামনে আনন্দসত্র খুলতেন। বলতেন, আজ তোদের কাঁদিয়ে ছাড়ব। লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদবি বাবারা।
কিন্তু সুনন্দা আজ জানতেই পারল না কখন তার দেশ তিলককামোদ-এর রাস্তা ঘুরে ঘুরে বৃন্দাবনি সারঙের মেঠো সুর তুলতে লেগেছে। একেবারে অন্যমনস্ক। ক-দিন ধরেই এই হচ্ছে। দিন না মাস! মাস না বছর! সুনন্দা যেখানকার সেতার সেখানে শুইয়ে রেখে হাত জোড় করে বলল, আমি চললুম, আমার মাফ করো। অবর্ণা সরস্বতীর দিকে ফিরে বদ্ধাঞ্জলি আবারও বলল, পারলে ক্ষমা করো, আমি চললুম।
মধুরাশ্রমে ধনঞ্জয়ের সাজানো ঘরে, নিশ্বাসে মালতীফুলের গন্ধ আর দু-চোখ ভরা তারার বৃষ্টি নিয়ে তবে যদি এ হাতে আবার সুরের ফুল ফোটে। আর যদি না-ই ফোটে তো না ফুটুক। অনেক তো হল। আর কিছু ফুটবে। এই আর কিছুর জন্যে সে বড়ো উন্মুখ হয়ে আছে।
২.
মধুরাশ্রমে ঢোকবার গেট বাঁশের তৈরি? তার ওপরে নাম-না-জানা কী জানি কি নীল ফুলের বাহার। মধুরে মধুর। জমিতে মধু, হাওয়ায় মধু, জলে মধু। ভেতরে দেখ বিঘের পর বিঘে বাগান, ফলবাগান, ফুলবাগান, সবজিবাগান। প্রতি বছরেই একবার করে এখানে এসে জুড়িয়ে যায় সুনন্দা। কোলাহল নেই। না যানের, না যন্ত্রের, না মানুষের। নিস্তব্ধ আশ্রম জুড়ে শুধু সারাদিন বিচিত্র পাখির ডাক। সন্ধান দিয়েছিল আজ দশ-এগারো বছর আগে–মমতা বেন। এক ছাত্রী। মমতার বাপের বাড়ির সবাই সিদ্ধদাসের কাছে দীক্ষিত। বাবার মৃত্যুর পর তখন সেই সদ্য সদ্য সুনন্দার মধ্যে একটা হা-হা শূন্যতা তেপান্তরের মাঠের মতো। সব শুনে বুঝে ছাত্রী মমতা গুরুগিরি করল। ঠাকুর সিদ্ধদাসের হাতের ছোঁয়ায় অনেকদিনের পর সেই প্রথম শান্তি।
দেশাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগও মমতার মাধ্যমে। মধুরাশ্রমে যখন মন টানল তখন। শরিকি বাড়ির অংশটুকু নিয়ে মহা মুশকিলে পড়েছিল সুনন্দা। মোটে আড়াই কাঠার বাস্তু, তার ওপরে তো আর জগদ্দল কংক্রিট-দানব তৈরি করা যাবে না, সুতরাং পোমোটারে ছোঁবে না। যারা বাস করবার জন্য কিনতে চায় তারাও দুদিকে শরিকি দেয়াল দেখে সরে পড়ে। জমির দাম আকাশ-ছোঁয়া। কে আর লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিবাদ-বিসংবাদ কিনতে চায়? এইরকম হা-হতোস্মি দিনে মমতা বেন দেশাইয়ের খোঁজ দিয়েছিল। কোটিপতি ব্যবসায়ী, কিন্তু সমাজসেবার দিকে বিলক্ষণ নজর। সোশ্যাল সার্ভিস সেন্টার খুলবে। একটা ছোটোখাটো বাড়ি কিনতে চায়। পরিবার-পরিকল্পনা, ফার্স্ট এড, শিশুকল্যাণ ইত্যাদি ইত্যাদি। সুনন্দার বাড়ি তার খুব পছন্দ হয়ে গেল। বসবার ঘরটাকে পার্টিশন করেই তিনটি বিভাগ খুলে দেওয়া যায়। ভালো দাম দিল দেশাই।
সবটুকুই সামলাল মমতা আর তার স্বামী। সমস্ত আসবাবসমেত বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে সুনন্দা। মায়ের বিয়ের আলমারি, খাট, দেরাজ, সোফাসেট, রাশি রাশি পুতুল আর কিউরিকো-ভর্তি শোকেস, বাহারি আয়না, দেওয়ালগিরি, ঝাড়বাতি, সমস্ত সমস্ত। শ্বেতপাথরের সরস্বতী প্রতিমাটি মমতাকে সে উপহার দিয়েছে। বেত-কাগজের শিল্পকীর্তি দেশাইয়ের বড়ো পছন্দ। তার নিজস্ব বাড়ির হলঘরে থাকবে। বিক্রিবাটার পর যতদিন সুনন্দা থেকেছে, বাড়ি যেমন ছিল তেমনি। আশপাশের কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেনি কিছু।
ঠাকুরঘরের ফাটল আর শোবার ঘরের বাঁ কোণে চুইয়ে-পড়া জলের দাগটার, দিকে তাকিয়ে সুনন্দা মনে মনে ভেবেছিল, বাববাঃ, এসব কি একটা একলা মেয়ের কম্মো! ওই ছাদ কতবার হাফ-টেরেস হল, টালি বসানো হল, তা সত্ত্বেও জল চোয়াচ্ছে দেখে মাঝরাত্তিরে ডাক ছেড়ে কেঁদে উঠেছিল সে। এখন বেশ ঝাড়া হাত, ঝাড়া পা, পরনে লাল পেড়ে সাদা শাড়ি আর হাতে সেতার, বাঃ!
এবার যেন মধুরাশ্রম আরও শান্তিময় লাগল। গুরুভাই ধনঞ্জয় সেই ঘরটাই ঠিক করে রেখেছে যেটাতে সে প্রত্যেকবার এসে থাকে। সরু লম্বা। ছয় বাই বারো মতো ঘরটা। ঢাকবার নীচ দরজা সবজ রং করা। উলটো দিকে চার পাল্লার জানলা। খুলে দিলেই বাগান। এখানকার সবাই বলে মউ-বাগান। মউমাছির চাষ হয় ফুলবাগানের এই অংশে। ঘরের মধ্যে নীচু তক্তাপোশে শক্ত বিছানা। একপাশে সেতার রেখে শুতে হবে। একটিমাত্র জলচৌকি। ট্রাঙ্ক সুটকেস রাখতে পার, সেসব সরিয়ে লেখার ডেস্ক হিসেবেও ব্যবহার করতে পার, কোণে চারটি ইটের ওপর মাটির কুঁজো। আশ্রমের ডিপ টিউবওয়েলের জল ধরা আছে। ঘরের বাইরে টিউবওয়েলের জলে হাত-পা ধুয়ে পাপোশে পা মুছে, কুঁজো থেকে প্রথমেই এক গ্লাস জল গড়িয়ে খেল সুনন্দা। আহা! যেন অমৃত পান। ধনঞ্জয় বলল, দিদি, ঠাকুরের সঙ্গে যদি দেখা করবেন তো এই বেলা।
ট্রেনের কাপড় ছেড়ে সঙ্গে আনা বেগমপুরের লালপেড়ে শাড়িটা পরে দাওয়া পেরিয়ে ঠাকুর সিদ্ধদাসের ঘরে চলল সুনন্দা। চারদিকে খোলা আকাশ, একেবারে টইটম্বুর নীল। সেই আকাশটা তার রং, তার ব্যাপ্তি, তার গাঢ়তা আর গভীরতা নিয়ে ফাঁকা বুকের খাঁচাটার মধ্যে ঢুকে পড়ছে টের পেল সে। প্রণাম করল যে, আর প্রণাম পেলেন যিনি উভয়েরই মুখ সমান প্রসন্ন। সিদ্ধদাস বললেন, মা খুশি হয়েছ তো? আলোকিত মুখে জবাব দিল সুনন্দা।
ঠাকুর সিদ্ধদাস তাঁর পুবের ঘরের আসন থেকে বড়ো একটা নড়েন না। ব্রাহ্মমুহূর্তে একবার, সন্ধ্যায় একবার আশ্রমের চত্বর বাগান ঘুরে আসেন। নিত্যকর্মের সময়গুলো ছাড়া অন্য সময়ে তিনি তাঁর আসনে স্থির। ভোরবেলা তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যায় সুনন্দার। সে-ও সে সময়টা বেড়াতে বেরোয়। কিন্তু তখন সিদ্ধদাস তদগত তন্ময়। কারও সঙ্গে কথা বলেন না, হনহন করে খালি হেঁটে যান। কে বলবে ক-মাস আগেও কঠিন রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন!
এখানকার দিনগুলি যেন বৈদিক যুগের। শান্তরসাস্পদ। পবিত্র, সরল, উদার, সুগন্ধ। একটু কান খাড়া করলেই বুঝি মন্ত্রপাঠের ধবনি শোনা যাবে। নাসিকা আরেকটু গ্রহিষ্ণু হলেই যজ্ঞধুমের গন্ধ পাওয়া যাবে। যেন জমদগ্নি, শ্বেতকেতু, নচিকেতা, উপমন্যু এই বনবাগানের অন্তরালে কোথাও না কোথাও নিজস্ব তপস্যায় মগ্ন। কিন্তু কী আশ্চর্য, আশ্রমের রাতগুলি যে আরব্য উপন্যাসের! তারার আলো কেমন একটা রহস্যজাল বিছিয়ে দেয় রাত আটটা নটার পরই। কে যেন ড্যাঁও ড্যাঁও করে রবারের তাঁতের তারে চাপা আওয়াজ তোলে, চুমকি বসানো পেশোয়াজ, ওড়না সারা আকাশময়, ঘুঙুর পায়ে উদ্দাম নৃত্য করে কারা, হঠাৎ কে তীব্র স্বরে চিৎকার করে বলে খামোশ! একদিন দু-দিন করে মাস কেটে গেল। আকাশে বাতাসে চাপা রবাবের আওয়াজ শুনে শুনে সুনন্দা আর থাকতে পারে না। ব্রাহ্মমুহূর্তে বেড়াতে বার হয় না সে, চৌকির ওপর বিছানা গুটিয়ে রাখে। সদ্যতোলা গোলাপফুল রেকাবির ওপর রেখে অদৃশ্য সরস্বতী মূর্তিটির উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে সেতারের তারে মেজরাপ ঠেকায়। ললিতে আলাপ। মন্দ্র সপ্তকে শুরু। খরজের তারে অভ্যাস মতো হাত চালায়, টাঁই আওয়াজ করে তার নেমে যায়, নামিয়ে তারগুলোকে আবার টেনে বাঁধে সুনন্দা। কান লাগিয়ে লাউয়ের ভেতরের অনুরণন শোনে। আবার আলাপ ধরে! তারগুলি কিন্তু সমানে বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে, সুনন্দার তর্জনী আর মধ্যমার তলায় যেন কিলবিল করছে অবাধ্য, সুর-ছাড়া, সৃষ্টিছাড়া কতকগুলো সাপ, জোর হাতে কৃন্তন লাগাতে গিয়ে আচমকা ছিঁড়ে যায় তার।
সন্ধ্যাবেলায় ঠাকুরের ঘরের ধ্যানের আসর থেকে নিঃশব্দ পায়ে উঠে আসে সুনন্দা। সকালবেলাকার সেই ছেড়া তার যেন আচমকা তার বুকের মধ্যে ছিটকে এসে লেগেছে। সারি সারি নিস্তব্ধ, তন্ময় গুরু ভাইবোনেরা। কেউ লক্ষও করে না। কিন্তু তার মনে হয় ধূপজ্বলা অন্ধকারের মধ্য থেকে জোড়া জোড়া ভুরু তার দিকপানে চেয়ে কুঁচকে উঠছে।
রাতে তার ঘুম আসে না। সকালের ডাকে কলকাতার চিঠি এসেছে। অন্তরঙ্গ এক সহকর্মী দুঃখ করে লিখেছেন, তিনি ছিলেন না বলেই সুনন্দা এমন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছেন। তিনি থাকলে নিশ্চয় বাধা দিতেন। কেন যে এ কথা লিখেছেন পরিষ্কার করে বলেনি। সুনন্দার ভালোমন্দ সুনন্দা কি নিজে বোঝে না! জানালা দিয়ে কত বড়ো আকাশ দেখা যাচ্ছে। শহরের সেই গলির বাড়িতে এত বড় আকাশ অকল্পনীয় ছিল। আস্তে আস্তে মনটা কী রকম ধোঁয়ার মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ওই আকাশে, তার যেন আর কোনো আলাদা অস্তিত্ব থাকছে না। কিছুতেই তাকে গুটিয়ে নামাতে পারছে না সে আঙুলে।
মাস তিনেকের মাথায় সিদ্ধদাস নিভৃতে ডেকে পাঠালেন, মা, খুবই কি সাধনভজন করছ?
সুনন্দা চুপ।
তোমার বাজনা শুনতে পাইনে তো মা!
বাজাই না ঠাকুর।
চমকে উঠলেন সিদ্ধদাস, বাজাবার কি দরকার হয় না মা? এমন দিন আসা অসম্ভব নয় যখন বাজাবার দরকার আর হয় না, মন আপনি বাজে।
আমার সে দিন তো আসেনি! সুনন্দা শুকনো মুখে বলল, আঙুলে যেন আমার পক্ষাঘাত হয়েছে। হাত চলে না। সুর ভুলে যাচ্ছি, হৃদয় শুষ্ক, সুনন্দার চোখ দিয়ে এবার অধৈর্য কান্না নামছে, অপরাধ নেবেন না ঠাকুর, কিছু ভালো লাগছে না, সব যেন বিষ, তেতো লাগছে সব।
সিদ্ধদাস বললেন, অপরাধ কি নেব! তুমিই আমার অপরাধ মার্জনা করো মা। তোমাকে সঠিক পথ দেখাতে পারিনি। কিছুদিন ধরেই শুনতে পাচ্ছি, তুমি খাচ্ছ না ভালো করে, ঘর ছেড়ে বেরোও না, ধ্যানের সময়ে আস না। মন অস্থির চঞ্চল হয়েছে বঝেছি। তুমি আর কিছুদিন অপেক্ষা করো, একটা না একটা উপায় বার হবেই, আশ্রম কখনও তোমাকে জোর করে ধরে রাখবে না। তোমার যেখানে আনন্দ, তাঁরও যে আনন্দ সেইখানেই।
সেই রাত্রে অনেক ছটফট করে ঘুমিয়েছে সুনন্দা, দেখল সে সমুদ্রের ওপর বসে বাজাচ্ছে। বার বার ঢেউয়ে ডুবে যাচ্ছে, আবার ভেসে উঠছে। বিশাল তুম্বি সুন্ধু বীণ বারবার তার সিল্কের শাড়ির ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে। খড়খড়ে তাঁতের কাপড় পরে এল সে। বীণে মিড় তুলেছে। পাঁচ ছয় পর্দা জোড়া জটিল মিড়। কার কাছে কোথায় যেন শুনেছিল। কিছুতেই পারছে না। বীণ শুধু ডাঁও ডাঁও করে মত্ত দাদুরির মতো আওয়াজ তুলে চলেছে, হাত থেকে ছটাং ছটাং করে তার বেরিয়ে যাচ্ছে। এক গা ঘেমে ঘুম ভেঙে গেল, বীণ কই? সুরবাহার কই? সেসব তো
এখনও আসেইনি! আঁচল দিয়ে সেতার মুছে দাঁতে দাঁত চেপে বসে রইল সুনন্দা। শেষ রাতে আবার চোখ জড়িয়ে এসেছে। আবারও সেই স্বপ্ন। সমুদ্রের ওপর বীণ হাতে একবার ডুবছে, একবার ভাসছে। হাত থেকে বীণ ফসকে যাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সুনন্দা।
দরজার কড়া নড়ছে জোরে। ঝাঁকাচ্ছে কেউ। খুলতেই সামনে মমতা।
সারা রাত কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! এখানে পৌঁছে দেখি বালি মাটির ওপর দিয়ে সব জল কী সুন্দর সরে গেছে, মমতা একগঙ্গা বকে গেল, তারপর অবাক হয়ে বলল, একি সুনন্দাদি, কাঁদছ কেন?
সুনন্দা চোখের জল মুছে বলল, তুই হঠাৎ? কী ব্যাপার? আমার বীণ নিয়ে এসেছিস?
মমতা বলল, ব্যাপারই বটে সুনন্দাদি। বীণ আনব কি? গোটা বাড়িটাকেই বুঝি তুলে আনতে হয়।
ঘরে এসে বসল মমতা, শোনো সুনন্দাদি রাগ কোরো না। দেশাই তোমার বাড়ি নিতে চাইছে না। বলছে ওখানে ভূত আছে। রি-মডেলিং করার আগে যোশী আর দেশাই ক-দিন তোমার নীচের ঘরে শুয়েছিল, অমন সুন্দর ঘরখানা তো! তা সারা রাত বাজনা শুনেছে।
যাঃ, সুনন্দা অবাক হয়ে গেছে, কী বাজনা।
ওরা কি অত জানে! খালি বাজনা, কত বাজনা। ঘুম আসলেই শোনে, চোখ মেললেই সুর মিলিয়ে যায়। ঘরের একটা জিনিসও সরাতে পারেনি।
কেন? মমতাকে দুহাত দিয়ে চেপে ধরেছে সুনন্দা।
কেন আর? কিছুই না জিনিস সরাতে গেলেই অমন কাঠখোট্টা ব্যবসাদারেরও মনে হয় আহা থাক। বেশ আছে, বড়ো সুন্দর আর ক-দিন যাকই না।
সুনন্দা বলল—তুই বলছিস আমার ঘর যেমন ছিল তেমনি আছে?
শুধু ঘর নয় গো। বাড়ি আসবাব যা যেখানে ছিল, সেখানেই আছে।
সুনন্দা হঠাৎ উত্তেজিত পায়ে বাইরে ছুটল, ধনঞ্জয়! ধনঞ্জয়!
কী দিদি!
আমি আজকের গাড়িতেই কলকাতা যাচ্ছি। আমার বাজনা প্যাক করে তুলে দেবার ব্যবস্থা করো ভাই।
বৃষ্টি ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে ঘরে ফিরছেন ঠাকুর সিদ্ধদাস। উদভ্রান্ত সুনন্দা উল্কার মতো ছুটে আসছে।
ঠাকুর ঠাকুর, আমি বাড়ি ফিরছি, বাড়ি।
স্মিতমুখে ডান হাত তুলে সিদ্ধদাস বললেন, স্বস্তি স্বস্তি।
কেউ নেই এখন। কেউ না। না তো। ভুল হল। আছেন। অবর্ণা, বর্ণময়ী আছেন। সর্বশুক্লা। তাই লক্ষ সুরের রংবাহার তাঁর পায়ের কাছে মিলিয়ে গিয়ে আরও লক্ষ সুরের আয়োজন করে। সেতার নামিয়ে আজ বীণ তুলে নিয়েছে সুনন্দা। গুরুজির শেষ তালিম ছিল বীণে। বলতেন নদী তার নাচনকোঁদন সাঙ্গ করে সমুদ্রে গিয়ে মেশে বেটি, বীণ সেই সমুন্দর সেই গহিন গাঙ। বীণ তক পঁহুছ যা। সুনন্দা তাই বীণে এসে পৌঁছেছে। মগ্ন হয়ে বাজাচ্ছে, হাতে সেই স্বপ্নশ্রুত মিড়। সুরের কাঁপনে বুকের মধ্যে এক ব্যথামিশ্রিত আনন্দ, তবুও মিড়ের সূক্ষ্ম জটিল কাজ কিছুতেই আসছে না। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে, সুনন্দা অসম্পূর্ণ সুরের জাল বুনেই চলেছে, বুনেই চলেছে। খোলা দরজা, বাইরের ছায়াময় উঠোন বাগান দেখা যায়। কিন্তু সুর বন্দিনির মতো গুমরে গুমরে কাঁদছে ঘরময়। কিছুতেই মুক্তি পাচ্ছে না। সেই সঙ্গে মুক্তি দিচ্ছে না তাকেও, দরদর করে ঘাম নামছে, ঘাম না কি চোখের জল যা দেহের রক্তের মতোই গাঢ়, ভারী! পরিচিত জুতোর শব্দ। খোলা দরজা দিয়ে গুরুজি এসে ঢুকলেন, বললেন, সে কী? এতক্ষণেও পারছিস না বেটি। এই দ্যাখ। চট করে দেখিয়ে দিলেন গুরুজি। কয়েকটা শ্রুতি ফসকে যাচ্ছিল। স্মৃতির কোণে কোথায় লুকিয়ে বসেছিল। গুরুজি তাদের টেনে আঙুলে নামিয়ে আনলেন। সুনন্দা বাজিয়ে চলেছে। হুঁশ নেই আনন্দে। গুরুজি যে চলে যাচ্ছেন, ওঁকে যে অন্তত দুখিলি পান দেওয়া দরকার সে খেয়ালও তার নেই। যাবার সময়ে বলে গেলেন, আসন, বেটি। আসন! তুই যে আসনে ধ্যান লাগিয়েছিস, তুই ছাড়লেও সে তোকে ছাড়বে কেন? বলতে বলতে গুরুজি মসমস করে চলে গেলেন। হঠাৎ দেয়ালঘড়িতে ঢং ঢং করে দুটো বাজল। সুনন্দা যেন এতক্ষণ ঘোরে ছিল। সে বীণ নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। গুরুজি এসেছিলেন এত রাত্রে? সে কি? পান? অন্তত দু খিলি পান…কাকে পান দেবে? গুরুজি তো বাবা যাবার তিন বছর পরেই কাশীতে…।
চারদিকে চেয়ে দেখে সুনন্দা। খোলা দরজায় এসে দাঁড়ায়। নিমের পাতায় হু হু জ্যোৎস্না। কোথাও কারও চিহ্ন নেই। দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল সে, তারপর তীব্র ভঙ্গিতে এসে বীণ তুলে নিল। মিড় তুলল। সেই জটিল, অবাধ্য মিড়। হ্যাঁ। ঠিকঠাক বলছে। অনেক দিনের স্বপ্নের জিনিস তুলতে পেরে এখন সুনন্দার হাতে সুরের জোয়ার। আরও মিড়, জটিলতর, আরও ব্যাপ্ত, আরও প্রাণমন কাঁদানো, সব মানুষের মধ্যেকার জাত-মানুষটাকে ছোঁবার মিড়। গুরুজি সত্যি এসেছিলেন কি আসেননি তৌল করতে সে ভুলে যায়। সে তার আসনে বসেছে, তার নিজস্ব আসন। সমুদ্র নীলের ওপর বড়ো বড়ো শুক্তি ছাপ। সাত বছর বয়স থেকে এই আসনে বসে সে কচি কচি আঙুলে আধো আধো বুলির মতো কত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নাজ নখরা ফুটিয়েছে ত্রিতন্ত্রী বীণায়। ঠিক যেমনটি কেসর বাই কি রোশেনারার রেকর্ডে শুনেছে। অবর্ণা দেবীমূর্তির দিকে মুখ করে, কিন্তু নতমুখ আত্মমগ্ন হয়ে, সারারাত সুনন্দা সমুদ্রের দিকে চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। পাশে শোয়ানো সেতারের তরফের তারগুলি ঝংকৃত হয় থেকে থেকে। কাচের কেসের ডালা খোলা। সেখান থেকে সরু মোটা নানান সুরে আপনা আপনি বেজে ওঠে সুরবাহার, তানপুরা।
কে আছে দাঁড়িয়ে এই সুরের পারে? তারের ওপর তর্জনীর আকুল মুদ্রায় প্রশ্ন বাজতে থাকে। কে আছে? কে আছ? ঝংকারের পর ঝংকারে উত্তর ভেসে আসে। সুর। আরও সুর। তারপরে? আরও সুর। শুধুই সুর। ধু ধু করছে সুরের কান্তার। ঠিক আকাশের মতোই। তাকে পার হবার প্রশ্ন ওঠে না। শুধু সেই সুরের ধুলি বৃন্দাবন রজের মতো সর্বাঙ্গে মাখো। সেই সুরের স্রোতে ভেসে যাও, আর সুরের আসনে স্থির হয়ে বসো। মন রে, তুই সুরদীপ হ।