আলোয় ফেরা-2
থর থর করে কাঁপছে মুন্নি ।যা বোঝার বোঝা হয়ে গেছে কিশোরের ।কিশোরের এখন কি কর্তব্য?দেশ যারা চালায় তাদের আশ্রয়ে এমন পশুদের ঠাঁই হয়? কাদের জন্য এঁরা? মুন্নির কে তখন সামলানো দায়।কিশোরের মনে হলো, “আমি থাকাতে এমন টা হলো না তো?ছোট বেলায় বাবা মা কে হারালাম ।প্রাণের প্রিয় দাদা তাঁকে ও হারালাম ।না,এই মেয়েটা ও আমার জন্য এই অবস্থায় পড়লো ।কাল ই কেটে পড়বো ।” একটু পড়ে মনে হলো, এই মেয়েটার কি হবে?এ দেশে অমন তিলক ধারীদের তো আর অভাব নেই । ওকে বরং কোলকাতা পৌঁছে দিয়ে তবে কিশোরের নিস্তার ।পুলিশ রাত কাটানোর ঠাঁই জোগার করেছে দুজনের ।কিন্তু কিশোরের মন তাতে সায় দিলো না। সুখের ঘরে রূপের বাসা যেমন, ঠিক তেমনই সুন্দরী এই মেয়ে ।একে সুন্দরী তায় সুখের মলমে মোড়ানো তার শরীর ।যৌবনের দাক্ষিন্যের ওপর বেশ বাসের শাসন ও কড়া নয়।এঁকে নিয়ে নিরিবিলিতে কোথাও থাকা মানে আর এক বিপদ ডেকে আনা ।সেদিকে কিশোর ষোলো আনায় কড়া ।তাই সেই রাতের মতো রেলওয়ে বিশ্রাম কক্ষে ই থাকা ঠিক করলো । মৃত দেহের পোস্ট মর্টেম না হওয়া অবধি ওদের ছাড়া পাওয়ার উপায় নেই ।দাহ হবার পর পুলিশ ই ওদের কোলকাতায় ফেরার ব্যবস্থা করে দিল। মুন্নি র এখন চরম মৃত্যু ওশোক।কিশোর ভাবছে, মুন্নি কাঁদছে কাঁদুক ।কিশোরের ও ভালো হতো কাঁদতে পারলে ।ওর ও তো বুক ভেঙে যাচ্ছে, তবু ও হালকা হতে পারছে না।মুন্নি র এখন সমূহ শোক । একটা রাত খৈতান আর স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়েছিল ।কতো কথা, সব ছবির মতো ভাসছে চোখে । ওদের কোনো খুঁত চোখে পড়েনি ।মুন্নির পক্ষে তো চরম কষ্টে র সময় ।একাই বা থাকবে কি করে!কিশোর ই ঘরে ফিরে থাকবে কি করে!শেষ বারের খড় কুটো ধরার মতো মিঃ খৈতান কিশোর কে বলেছিল তাঁর মেয়ে কে বাঁচাতে ।সেই অসহায় লোকটার কথা কিশোর ভোলে কি করে?না না ঐ মেয়ের একটা ভালো ব্যবস্থা কিশোর নিশ্চয়ই করবে ।দাদার শোকে কিশোর ঘর ছেড়ে ছিল ।মুন্নির শোক তো এখন সাগর সমান ।কিশোর দাদার মৃত্যুর জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল ।মুন্নি তো ভাবতেই পারে নি সেই শেষ দেখা ।মনুষ্যত্ব হীন হতে পারবে না কিশোর । হাওড়া পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল ।ট্যাক্সি পেতে বেগ পেতে হয় নি ।ড্রাইভার এর সংগে করার করা হলো মুন্নি কে বাড়িতে পৌঁছে তারপর কিশোরের বাড়ি যেতে হবে । বাড়ির কাছাকাছি এসে মুন্নি র কান্নার বেগ বেড়ে গেল ।হঠাৎ ই কিশোরের মনে হলো,-মুন্নি ঘরে একা থাকবে কি করে?ঘরে আর কেউ কি আছে? না থাকে যদি? তাহলে ?তাহলে কি যে করবে তার ঠিক নেই ।কিশোরের ঘরে কি আনবে?একটা অবিবাহিত মেয়েকে কি ঠাঁই দেয়া যায়? তাই জিজ্ঞেস করলো——তোমার ঘরে কেউ আছে কি?মানে, কেউ না থাকলে একা থাকতে পারবে তো? ———–“আছে ।বাবার এক ‘মু বলি ‘ বোন ।সেই পিসি আমাদের বাড়িতে থাকে ।তার কেউ নেই ।” পার্ক সার্কাস এ মুন্নির বাড়ির সামনে গাড়ি দাঁড় করানো হলো ।জিনিস পত্র ড্রাইভার ই এগিয়ে দিলো ।মুন্নি কে অভয় দিয়ে কিশোর বললো—— “চিন্তা করো না আমি কাল আবার আসবো ।” মুন্নি যতক্ষণ না ভেতরে ঢুকে যায় তার জন্য কিশোর ট্যাক্সিতে বসে অপেক্ষা করছিল । বেল্ বাজার সাথে সাথে দরজা খুলে গেল ।বয়স্ক এক মহিলা বেড়িয়ে এলেন ।তাঁকে জড়িয়ে ধরে মুন্নির বুক ফাটা কান্না । কিশোর ড্রাইভার কে বললো——“সোজা টালিগঞ্জ চলো ।” বহু দিনের অব্যাহৃত ঘর দাদা ছাড়া ঘরে এই প্রথম । বুক টা হু হু করে উঠছে কষ্টে ।কিন্তু মুহূর্তে ই মনে পড়ে যাচ্ছে মুন্নি র শোকের কথা ।যে দম বন্ধ করা কষ্ট নিয়ে ঘর ছেড়ে ছিল সেটা অনেক ফিকে লাগছে এখন ।হিন্দুদের মৃত্যুর পরে সব সন্তানেরা একসাথে অশৌচ পালন বুঝি এই জন্য ই করে ।এক সাথে শোক পালনে মনের দুঃখ টা বাটোয়ারা হয়ে যায় ।সমব্যথী বলেই কষ্ট টা কম পড়ে ।সদ্য মুন্নির শোকে কিশোরের শোকটা ফিকে হয়েছে ।তাই বুঝি দম বন্ধ হওয়া কষ্টটা অনেক টা হালকা লাগছে । হঠাৎ ই দরজার নিচে একটা খাম নজরে পড়লো । খামখানা তুলে নিয়ে এপাশ ওপাশ ভালো করে দেখলো কিশোর ।প্রেরকের নাম দেখে মনটা তেতো হয়ে গেল ।মোটা দাগে লেখা——–“ফ্রম নির্মলা আগরওয়াল ।” পাশে লেখা—–আরজেন্ট । খুলতেই হয় চিঠি টা।নির্মলা জানে যে ঐ আরজেন্ট কথা টা না লিখলে কিশোর ঐ চিঠি পড়বে না । পড়তে শুরু করলো । ভাই,কিশোর, নবীন কে কথা দিয়েছিলাম যে সত্যি কথাটা তোমাকে জানাবো ।নবীন জানতো যে তুমি আমাকে ঘৃণা করো।সেই কষ্টে ই নবীন আমাকে দিয়ে করার করিয়ে নিয়েছিল যাতে সত্যি কথাটা জেনে তুমি আমাকে ঘেন্না না করো।নবীন কে ভালোবেসেছিলাম ।ওর কথার খেলাপ কি করে করি বলো? নবীন আমাকে অনেক আগেই বিয়ে করতে পারতো । কিন্তু ওকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল শুধু তোমার কথা ভেবে ই।বলতো—–একটু সবুর করো ।কিশোর নিজের পায়ে দাঁড়াক।তার পর তোমাকে বিয়ে করবো ।ওঁর ইচ্ছা য় বাঁধা হইনি কখনো । বিধি বাম হলো ।এজন্মে আর বিয়ে হলো না ।তুমি ভাবছো সেদিন তোমার দাদা বলেছিল “এই দেখ,কোর্ট ম্যারেজ করে তোর বৌদি কে নিয়ে এলাম ।না গো তা হয় নি ।কারণ ওর অসুখের কথা ও জেনে গিয়েছিল । তুমি পালিয়ে যাবে হুমকি দিয়েছিলে নবীন কে ।ভয় পেয়ে আমাকে বলেছিল,——কি করি বলো তো? আমি হেসে বললাম—–তা বিয়ে করতে অসুবিধা কোথায়? আমার উত্তরে থমকে গিয়েছিল নবীন ।তখন ই ক্যানসার এর কথা টা জানতে পারলাম ।খুব কেঁদে ছিলাম ।আমাকে জড়িয়ে নবীন ও কেঁদেছিল । সেই শেষ ।আর কাঁদিনি ওর সামনে ।তাতে ও দুর্বল হয়ে যাবে ।সেই সময়েই অনুরোধ করেছিলাম, —– নবীন, তোমার কাছে আমায় থাকতে দাও । তোমার মাথা ঠান্ডা রাখতে আর নবীনের কাছে থাকার উদ্দেশ্যেই কোর্ট ম্যারেজ কথা টা বলতে আমি ই বুদ্ধি দিয়েছিলাম ।কাজ হয়েছিল কিনা জানিনা । যাইহোক তুমি চলে যাওয়ার পর কিছু দিনেই আমি বুঝলাম তোমার দাদার বাকি জীবনটা য় আমার থেকে তোমাকে বেশী দরকার ।তাই তোমাকে টেলিগ্রাফ করেছিলাম ।আমি জানতাম এটুকু ঘরে আমি যাতে সচ্ছন্দে থাকি তাই তুমি চলে গিয়েছিলে ।তুমি যেমন তোমার দাদা কে ভয় দেখিয়েছিলে,চলে যাবে বলে ।আমাকে ও তোমার দাদা ভয় দেখিয়েছিল । একদিন বলেছিলাম, সুভাষ জৈন আমাকে প্রোপোজ করার চেষ্টা করছে ।সেই টোপ টা কাজে লাগিয়ে বলেছিল যদি আমি সুভাষ কে বিয়ে না করি তবে ফ্ল্যাট এর ছাতের ওপর মানে ন’তলা থেকে ঝাঁপ দেবে ।ভয়ে রাজী হলাম ওর কথায় । সুভাষ কে আমার আর নবীনের ভালোবাসা র কথা বলি।নবীনের ন’তলা থেকে ঝাঁপ দেবার কথা ও বলি।ও আমাকে আমার দুঃসময়ে পাশে থাকবে বলে অভয় দেয় ।সেই জন্য নবীন কে দেখতে যাবার সময় আমার পাশে থেকে আমার পিঠে হাত দিত।যেন আমরা বিয়ে করবো। আমি জানি সেই জন্য তুমি আমাকে ঘেন্না করতে । আমার আর নবীনের ভেতরের কথা তুমি জানবে কি করে? নবীন কে আমি ভালোবাসি জেনে আমাকে শ্রদ্ধা করতো সুভাষ জৈন ।এখন ও করে।আমি কোন দিন নবীন কে ভুলতে পারবো না ।তবে তোমার দাদা শেষ সময়ে যাতে কষ্ট না পায় তাই মিথ্যের আশ্রয় নিয়েছিলাম । সুভাষ এর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ ।শেষ অবধি নবীন জানতে পারেনি যে,আমি সুভাষের স্ত্রী হবো না।স্বামীর রোল টা ভালো ই করেছে সুভাষ । নবীন ছাড়া আর কারো কথা ভাবতে পারি না । ভগবান জানে আমি নিরুপায় ছিলাম । আমার কথা বুঝতে পারলে এসো। ইতি——তোমার বৌদি—- নির্মলা আগরওয়াল। চিঠি টা শেষ হতে চোখ মুছে ফেললো কিশোর ।না আর না।সারাটা জীবন দাদা আর বৌদি ওর জন্যে ই নষ্ট করলো ।সেই তাঁকে কিশোর ঘেন্না করতো!ছিঃছিঃ ।প্রায়শ্চিত্ত করতে ই হবে কিশোরকে।আর একজনের কথা মনে হলো ।সেও আজ একেবারে নিঃসঙ্গ ।দুজনের নিঃসঙ্গতা কি একসাথে থেকে দূর করা যায় না ।নিশ্চয়ই যায় ।কিন্তু তার আগে একবার কথা বলা দরকার ।কাল সকালে ই যাবে তার কাছে । রাস্তায় বেরিয়ে ই ট্যাক্সি পেয়ে গেল ।ভেতরে একটা উচাটন ।কি জানি যদি মুখের ওপরে ‘না ‘ বলে দেয় । ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে দরজার বেল বাজালো।মুন্নি র সেই পিসি দরজা খুলে ভেতরে বসতে বললেন ।কিশোর পরিচয় দেবার পর সেই পিসি মুন্নি কে ডাকতে ডাকতে ভেতরে ঢুকে গেছে । একা কিশোর ঘরের সাজসজ্জা দেখতে ব্যস্ত ।তখুনি সেই পিসি ট্রে তে করে চা জলখাবার নিয়ে ঢুকলো । খাবার দেখে কিশোরের খিদে টা চনমনিয়ে উঠলো । কারণ কোলকাতা য় এসে অবধি খাওয়া হয়নি । কিশোর গোগ্রাসে খেতে শুরু করলো ।খেতে খেতে কোন দিকে দৃষ্টি নেই কিশোরের ।হঠাৎ ই মনে হলো কে যেন দরজায় দাঁড়িয়ে ।নজর ফেললো সে দিকে । কাল যাকে দিয়ে গেছে,এই কি সেই মেয়ে ।এর তো চোখ ঝলসানো রূপ ।নজরে ও আর আগের তেজ নেই ।তবে সে নজর অনেক নরম।কিশোরের দিকেই সমাহিত । কিশোর বললো,–এসো,কথা আছে ।এখানে বসো। বাধ্য মেয়ের মতো সে এগিয়ে এলো কিশোরের কাছে ।হাত ধুয়ে কিশোর শুরু করলো প্রথম থেকে ।দাদাই কিশোরের বাবা মা সব ছিল ।সেই দাদা চলে যেতে কিশোরের অবস্থা ,এমন কি নির্মলার চিঠির কথা ও বাদ গেল না । মুন্নি বললো—-আপনি এসব আমাকে বলছেন কেন? কিশোর বললো—-বুঝতে পারছো না? আমাকে কেমন লাগে তোমার?জানি তোমার আমার সম্বন্ধে ভালো ধারণা নেই ।তবু ও আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই । মুন্নি বললো—-আমি একা বলে দয়া দেখাচ্ছে নও। কিশোর বললো ——না না আমি বলার কেউ না। যে বলার তাঁর কাছে তোমায় নিয়ে যাব ।অবশ্য তুমি যদি আপত্তি না করো। মুন্নি র পিসি যে দরজার আঁড়াল থেকে সব শুনেছে তা বুঝলো কিশোর যখন সে ঘরের ভেতরে এসে কিশোরের হাত দুটো ধরে অনুরোধ করলো।—- —–মুন্নি কো বাঁচা লো বেটা।উসকো মুঝকো ছোড়কর আপনা কোই নহি ।মুন্নি না মৎ বোল । কিশোর বললো—মুন্নি,এখন ও বলো।তুমি রাজী? তোমার মত না থাকলে আমি আবার বেড়িয়ে পড়বো। ।মুন্নি বলে—-কোথায় যাবে? কিশোর বললো——তা জানিনা ।তুমি রাজি না বুঝেছি ।আচ্ছা এবার উঠি । মুন্নি বললো—-আমি রাজি হলে? কিশোর বললো —-অবশ্য ই যাবো । মুন্নি—–মানে? কিশোর বললো —–তবে বৌদি র কাছে যাবো।তোমাকে নিয়ে ।তুমি আমাকে বিয়ে করতে রাজি তো? মুন্নি র সরম রাঙা মুখ আনত।সম্মতি জানায় এবং মাথা হেলিয়ে । রিং হয়ে যাচ্ছে ।ওপাশে রিসিভার তুলেছে। কিশোর বললো——-বৌদি, আমি কিশোর বলছি। ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল—–তোমার নাম না বললেও চিনেছি ।ঐরক্ত তো আমার মনে ঘুড়ে বেড়ায় । ——-তোমার চিঠি পেয়েছি ।আসবো ।সংগে তোমার আর আমার মতো কপাল পোড়া আরও একজনকে সংগে আনবো বিকেল চারটেতে।দেখো মানুষ করে নিতে পারো কিনা আমাদের ।!!!!!