Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আলোর স্বাক্ষর || Ashapurna Devi » Page 3

আলোর স্বাক্ষর || Ashapurna Devi

কী ব্যাপার ইন্দ্রদা? তুমি যে এখানেই আড্ডা গাড়লে? নতুন সুটকেস, নতুন জামাকাপড়!… কী হল বল তো? বাড়ি থেকে পালিয়ে নয় তো? বাদল নামক ইন্দ্রের পরম অনুরক্ত কর্মী ছেলেটি প্রশ্ন করে ইন্দ্রকে হাসতে হাসতে।

ইন্দ্রও হেসে ওঠে, বৃথাই তোকে দোষ দিই বাদল বুদ্ধিহীন বলে, বেশ সহজেই ধরে ফেলেছিস তো!

ঠাট্টা রাখ ইন্দ্রদা, সত্যি বল ব্যাপারটা কী? কাল-পরশু কিছু ভাবিনি, মনে করেছিলাম খুব বড়গোছের কিছু একটা প্ল্যান করছ বোধহয়, নাওয়া-খাওয়া ভুলতে হবে! তাই বাড়িতে মার খাবার ভয়ে দুদিন এখানে এসে আড্ডা গেড়েছ!..কিন্তু তোমার এই নতুন সুটকেস আর নতুন জামাকাপড় যে একটু ভাবনা ধরাচ্ছে!

ভাবনার কী আছে রে বাদল? চিরদিনই কি বাপের হোটেলে থাকব? বড় হয়েছি, চাকরি বাকরি করছি

ছেঁদো কথা রাখো ইন্দ্রদা, নির্ঘাৎ একটা কিছু ঘটেছে। কিন্তু বাড়িতে মনোমালিন্য করে বাড়ি থেকে পালিয়ে?–তুমি! উঁহু, হিসেব মিলছে না তো!

জগতের সব হিসেবই কি আর মেলে বাদল! ভেবেছিলাম মরুকগে যে যার খাতায় যে যার। অঙ্ক নিয়ে থাকুক! চলে যাবেই যা হোক করে! কিন্তু তোকে নিয়েই মুশকিল। তুই আমার বারণ শুনবি, এ ভরসা নেই। নিশ্চয় ছুটে যাবি মিটমাট করাতে।…কেমন তাই তো?

নিশ্চয় তো! এই এখুনি চললাম।

যাবে বৈকি! আমার গার্জেন যে তুমি!

গার্জেন-টার্জেন বুঝি না ইন্দ্রদা। এসব উল্টোপাল্টা ব্যাপার আমার ভাল লাগছে না।

তা জগৎসংসারে সবই কি আর সোজা হবে? কিছু তো উল্টোপাল্টা হবেই রে!

তাই বলে তো আর নিশ্চিন্ত হয়ে ছেড়ে দেওয়া চলে না! সোজা করে নেবার চেষ্টা করতে হবে। আমি তো ভেবে পাচ্ছিনে তুমি হেন লোক বাড়ি থেকে ঝগড়া করে

ঝগড়া করে!

হো হো করে হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ,-ঝগড়া কি বল?

আচ্ছা না হয় মনোমালিন্যই

দূর পাগলা!

তা কী তাই বলো?

কী তাই বলব? বলতে তোকে পারি তবে বিশ্বাস-অবিশ্বাস তোর হাতে!

.

নিতান্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে সেদিনের ইতিহাসটুকু বিবৃত করল ইন্দ্রনাথ বাদলের কাছে।

স্তম্ভিত বাদল সব শুনে প্রায় ধিক্কারের সুরে বলে–বাঃ বাঃ চমৎকার! এই হল আর অমনি তুমি সর্বত্যাগী হয়ে চলে এলে? প্রতিবাদ করলে না?

খুব বেশি না।

কেন খুব বেশি না? ধিক্কারে একেবারে ইয়ে করে দিতে পারলে না? বলতে পারলে না একটা রাস্তার লোকের কথা এত বিশ্বাস হল তোমাদের যে–

মুখে বলে লাভ কী?

ও, প্রতিবাদটা কাজে করেছ? এটা আবার বড্ড বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবছি

তা তোরই বা আমার সব কথা বিশ্বাস হচ্ছে কেন? কেন ভাবছিস না আমি বানিয়ে বানিয়ে নিরপরাধ সাজছি!

থামো ইন্দ্রদা! ইন্দ্রকে প্রায় ধমকে ওঠে বাদল,–আমি ভাবছি কে তোমার এমন শত্রু আছে যে এই চক্রান্তটি করছে!

জানা তো নেই। ইন্দ্র হেসে ওঠে, এযাবৎ তো নিজেকে অজাতশত্রু ভেবে বেশ একটা আত্মগৌরবই ছিল।

ভুল, খুব ভুল। জগতে ভাল লোকদেরই শত্ৰু বেশি থাকে। কে জানে আমাদের এই সঙ্গের অনিষ্টসাধক কেউ আছে কিনা, তোমার একটা দুর্নাম রটিয়ে যার ইষ্টসিদ্ধি হবে?

ত্রিজগতে এমন কোন নাম মনে আসছে না বাদল, আমার অনিষ্টে যার ইষ্টসিদ্ধি! এ স্রেফ টাকা আদায়ের কল! যত রাজ্যের রদ্দি ডিটেকটিভ গল্প পড়ে পড়ে দেশে এসব বিজাতীয় দুর্বুদ্ধির চাষ হচ্ছে!

মেনে নেওয়া শক্ত হচ্ছে। কাউকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের মানে বুঝি, কিন্তু এ কী?

এ আর একটা নতুন ফ্যাশান। হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ।

হেসো না তুমি ইন্দ্রদা।

তাছাড়া আর কী করবার আছে?

কিছু করবার নেই?…আশ্চর্য!…বদমাইশদের খুঁজে বার করতে হবে না?

খুঁজতে যাওয়া মানেই কতকগুলো কুশ্রী কথা আর কুশ্রী ঘটনার সম্মুখীন হওয়া!

তাই বলে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে?

থেকেই দেখা যাক না। হেসে ওঠে ইন্দ্র, সত্য যদি সত্যিই সূর্যের মত হয় তাহলে একদিন না একদিন মেঘমুক্ত হবেই।

আর তুমি সেই দিনের প্রত্যাশায় এই ভবঘুরে ভিখিরীর মতন হাটেবাজারে পড়ে থাকবে?

ক্ষতি কী? এও তো মন্দ লাগছে না। দেশে এমন অনেক ভদ্রলোক আছে বাদল, যারা এভাবে থাকতে পেলেও ধন্য হয়ে যায়।

বাদল রেগে উঠে বলে, তুলনা করার কোনও মানে হয় না ইন্দ্রদা। দেশে এমন অনেক লোকও আছে যারা ফুটপাথের কোণে একটু জায়গা পেলেও ধন্য হয়ে যায়!–ওসব দার্শনিক কথা ছাড়ো। কথা হচ্ছে, অপরাধীর সন্ধান নিতে হবে।

হয়তো সন্ধান পাওয়া খুব একটা শক্ত নয়! হয়তো আরও আসতে পারে–গাছ নাড়া দিয়ে ফের ফুল কুড়োতে! এরকম অপরাধীরা যদি না ধমক খায় তো বারে বারে আসে ভয় দেখাতে। পিসিমা কি আর তাদের মুখ বন্ধ করতে কিছু-না-কিছু না দেবেন?

যা-ই বল ইন্দ্রদা, পিসিমার বিশ্বাস করাকে বলিহারী দিচ্ছি আমি!

মানুষ তো প্রতারিত হয়ই বাদল।

হোক–তবু তার একটা মাত্রা থাকে। কিন্তু ইদা, ওই ফটো না কী বললে, ওটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না!

বুঝতে আমিও খুব পারিনি বাদল, যা শুনেছি তাই বললাম তোকে।

আমার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ইন্দ্রজাল।

ইন্দ্রজাল!

হ্যাঁ তাই! আসলে কিছুই নয়, সাদা কাগজ। পিসিমাকে মেসমেরাইজ করেছে তারা।

পাঁচদিন পরে আজ নিজস্ব স্বভাবে দরাজ গলায় হেসে ওঠে ইন্দ্রনাথ। হেসে বলে, এই আর একবার শ্রীমান বাদলচন্দ্রের বুদ্ধির কাছে হার হলো আমার! বাস্তবিক এত সহজ কথাটা বুঝতে পারছিলাম না এতদিন!

কিন্তু বাদল উপহাসে হার মানবার ছেলে নয়, ও সংকল্প করে, যে করেই হোক এ রহস্যের সূত্র আবিষ্কার করবেই, ইন্দ্রদা, আমি যাচ্ছি পিসিমার কাছে।

এই বাদল, ওইটি করতে যেও না।

কেন বলো? আমি কি কখনো পিসিমার কাছে যাই না?

সে তুমি পিসিমার হাতের চন্দরপুলি, গোকুল পিঠে খেতে যেতে পার, কিন্তু এখন যাওয়া চলবে না। পিসিমা যে ভেবে বসবেন সন্ধির দূত হিসেবে তোমায় পাঠিয়েছি আমি, সে হতে দেব না।

আমি পুত্থানুপুঙ্খ জানতে চাই।

লাভ কী? কোন এক পক্ষ প্রতারণা করেছে আর অপর এক পক্ষ প্রতারিত হয়েছে, মূল ঘটনা তো এই! এর থেকে কারো বা কিছু ধনহানি হয়েছে, কারো বা কিছুটা মানহানি হয়েছে

কারো বা কোথাও প্রাণহানি হবে, দেখতে পাচ্ছি দিব্যচক্ষে। বলে ওঠে বাদল।

বাদল! রীতিমত বিরক্ত স্বরে বলে ইন্দ্রনাথ–আমি আরও একটা জিনিস দিব্যচক্ষে দেখতে পাচ্ছি।

কী? কী দেখছ?

এই তোমার সঙ্গেও সম্পর্ক রহিত! এভাবে আমাকে বিরক্ত করলে সব ছেড়েছুঁড়ে পালাব?

বেশ ঠিক আছে, পিসিমার কাছে আমি যাব না, কিন্তু এ চক্রান্তের সূত্র অন্বেষণ করতে পাব না, তুমি এমন হুকুম যদি দাও, তাহলে জেনো আমার হাতেও শাস্তির অস্ত্র আছে!

উঃ, বড্ড যে ভীতিপ্রদর্শন! তবে যা, জগতের যত গোয়েন্দাকুল আছে–মনে মনে সকলেব পদবন্দনা করে অভিযানে বেরিয়ে পড়! আসামীর আঙুলের ছাপ যদি নাও পাস, নিদেন দুএকগাছা ছেঁড়া চুল, অথবা

আচ্ছা এখন ঠাট্টা করছ, পরে—

পূজো করব, কী বলিস!

আঃ, ধ্যেৎ!

দ্যাখ বাদল, বাজে চিন্তা ছাড়। সঙ্রে আগামী অধিবেশনে

রাখো ইন্দ্রদা তোমার আগামী অধিবেশন! আমার মাথায় এখন,না থাক, এখুনি ফাস করব না।

.

বাদল চলে যায়।

ইন্দ্র ভাবে ওকে না বললেই বোধহয় ভাল হত! কী না কী একটা ফ্যাচাং বাধাবে!

অপরাধীকে উচিত শাস্তি দেবার উপযুক্ত প্রতিশোধ-স্পৃহা আপাতত নেই, কেমন একটা নির্বেদ ভাব এসে গেছে।

মাইনের মত মাইনে নয়। বলতে লজ্জা ভাবতে লজ্জা। তবু মাইনেটা পেলেই কমলির জন্যে কিছু-না-কিছু কেনে ননী। হয় সাবান নয় পাউডার, নয়তো বা দুগজ ফিতে, কি চারটি মাথার কাটা। নেহাতই তুচ্ছ বস্তু, তবু সেই তুচ্ছটুকুই দাতার হৃদয়-ঐশ্বর্যে পরম মূল্যবান হয়ে ওঠে।

আজ ননীর সেই মাইনের দিন। পরম লজ্জা আর পরম সুখের দিন।

সকাল থেকে কল্পনার পটে এঁকে চলেছে এক টুকরো সুখের ছবি। এবার একটা বড় রকমের খরচা করে ফেলেছে ননী, কিনেছে একটা ছিটের ব্লাউজ আর এক শিশি জবাকুসুম।

কথায় কথায় কমলা একদিন বলেছিল, বেজায় চুল উঠে যাচ্ছে কেন বল তো ননীদা? কী করা যায়?

তখন ননী ঠাট্টা করে বলেছিল, ভাবনাচিন্তাগুলো একটু কমা কমলি, অষ্টপ্রহর আকাশপাতাল ভেবে ভেবেই তোর মাথার চুল সব ঝরে যাচ্ছে। কিন্তু মনে মনে সংকল্প করেছিল, একটা সত্যিকার ভাল গন্ধতেল নিয়ে আসবে কমলার জন্যে!

আর ওই ছিটের ব্লাউজটা! ওটা ফুটপাতের ধারে পার্কের রেলিঙের গায়ে নিজের সৌন্দর্য বিস্তার করে ঝুলছিল, সে সৌন্দর্যে ননীর প্রাণ মোহিত হয়ে উঠল, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে কিনে ফেলল জামাটা নগদ দুটাকা বারো আনা দিয়ে।

এই খরচার জন্যে ননীকে অবশ্যই নিজের অবশ্য প্রয়োজনীয় থেকেও কিছুটা বঞ্চিত হতে হবে, তা হোক, তবু আজ ননী যেন হাওয়ায় ভাসছে।

.

কেনার পর বাড়ি এসে কাগজের প্যাকেটটা খুলে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিল, আন্দাজ করতে চেষ্টা করল গায়ে ঠিক হবে কিনা কমলির, তারপর নিশ্চিত হল নিশ্চয়ই হবে। কমলির সম্পর্কে ননীর আন্দাজ কি ভুল হতে পারে?

হাতের জিনিসটা খপ করে পিছনে চালান করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেও কেষ্টমোহিনীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না ননী। কেষ্টমোহিনী হাঁক দিয়ে উঠল, হাতে কী রে ননী?

কিছু না তো মাসি! ননী দরাজ গলায় বলে।

অমন ডাহা মিথ্যে কথা বলিসনে ননী, মুখে পোকা পড়বে। কমলির জন্যে কিছু এনেছিস বুঝি? খাবারদাবার?

না না, খাবার-দাবার আবার কি! ইয়ে–একটা চুলে মাখবার তেল। দুঃখু করছিল সেদিন, চুলগুলো সব শেষ হয়ে গেল ননীদা।

হু, দুঃখু জানাবার জন্যে যখন এমন সোহাগের ননীদা রয়েছে, আর জানালেই তার প্রতিকারের আশা রয়েছে তখন জানাবে বৈকি! কিন্তু তোর মতন এমন নেমকহারাম দেখলাম না রে ননী। বলি আমার এই মুখখানা যে মেচেতা পড়ে পড়ে একেবারে কালো অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে, তা তো কোনদিন তাকিয়ে দেখিস না! বলিস না তো যে মাসি এই ওষুধটা মেখে দেখ! হুঁ, মেচেতা…বলে বাতের ব্যথায় উঠতে নড়তে বাপকে ডাকি, তাই একটু ওষুধ জোটে না…

ননী এবার ব্যাজার মুখে বলে, তা তুমি যদি সব পয়সা জমাও! নইলে–।

খবরদার ননী। জমানোর খোঁটা দিসনে। পয়সা আমি জমাই? জমাতে পাই? দুদুটো মানুষের খরচ নেই?

ননী প্রমাদ গুনে বলে, আহা তা কি আর আমার জানা নেই মাসি! বিশেষ এই বাজারে। ও তোমায় ঠাট্টা করলাম একটু।

ঠাট্টা! পোড়াকপাল আমার! ঠাট্টা করবার আর সুবাদ পেলে না তুমি! কিন্তু ও বস্তু নিয়ে এগোচ্ছ কোথায়? কমলি ঘরে নেই

ঘরে নেই? কোথায় গেছে? টিউবওয়েলে?

তুই আর বকিসনে ননী! রাজনন্দিনী আবার কবে টিপকলে যান? সব জল বইবার ভার তো এই বুড়ির।–তিনি গিয়েছেন বেড়াতে।

বেড়াতে! একলা!

হ্যাঁ। ক্রমশ ডানা গজাবে তো! তোকে এই বলে দিলাম ননী, এরপর দেখে নিস, ও তোরও থাকবে না, আমারও থাকবে না! পাখা মেলে উড়বে! বলে কিনা কে কোথায় বিনি মাইনেয় সেলাই-ইস্কুল খুলেছে, তাইতে ভর্তি হবে!

সেলাইয়ের ইস্কুল?

হ্যাঁ রে হ্যাঁ। সেলাই শিখে দর্জি হবে। দর্জিগিরি করে পেট চালাবে। সেই সেদিনের সেখেনে আর একবার নিয়ে যাবার জন্য ঝুলোঝুলি করছি–পিসি মাগী তো বলেছিল, আপাতত মাসে মাসে কিছু কিছু করে দেবে–তা রাজনন্দিনী কিছুতে রাজী হলেন না। এখন নতুন করে ওঁর নাকি লজ্জা করে, ভয় করে! কাল করেছিস ননী ওই ছবি তুলে! চব্বিশ ঘণ্টা ঘরের কোণে বসে ওই ছবি নিয়ে দেখছে নাড়ছে তুলছে রাখছে। যেন সত্যি-বিয়ের বরের মুখ…মুখ কালি করে আর কী হবে বাছা! শান্তরেই আছে কাগের বাসায় কোকিল থাকে যতদিন না উড়তে শেখে, উড়তে শিখে ধর্ম রেখে চলে যায় সে অন্যবন!..তোর আর কী! আমারই সর্বনাশ। তিন তিনশ টাকা দিয়ে কিনেছিলাম, এতদিন খাওয়ালাম পরালাম, সব জলে যেতে বসেছে গা। সৎপথে থেকে উনি দুদুটো মানুষের পেট চালাবেন! হুঁ, পিরথিবীটা তেমনি সৎ যে!

ননীর আর উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। ননীর বুকে শক্তিশেল পড়েছে। বিনি মাইনের সেলাই-স্কুল কে খুলেছে, সে কথা কেষ্টমোহিনী না জানলেও ননী তো ভালই জানে।

.

মুখ নিচু করে দাঁড়িয়েছিল কমলা। চোখ তুলে তাকাবার সাধ্য নেই। পা কাঁপছে, হাত কাঁপছে, কঁপছে বুক।

শিক্ষয়িত্ৰী অনিমা পাল জনান্তিকে বলেন, এই আর একটি নতুন মেয়ে ভর্তি হতে এসেছে ইন্দ্রবাবু। এখন কী করি বলুন? সীট তো আর নেই!

ইন্দ্রনাথ নতুন মেয়ের প্রতি একবার তাকিয়ে বিব্রত ভাবে বলে, একেবারে নেই?

কোথা থেকে থাকবে বলুন? একেই তো এমন যুগ পড়েছে, মেয়েপুরুষ ইতরভদ্র সবাই কোন একটা কিছু শেখবার জন্যে ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছে, মাইনে নেওয়া স্কুলেরাই দেশের চাহিদা মেটাতে পারছে না, তার ওপর আবার আপনার এই উইদাউট ফী–! দলে দলে মেয়ে আসছে, ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে। কিন্তু এ মেয়েটি একেবারে নাছোড়!

ইন্দ্রনাথ একবার অদূরবর্তিণীর দিকে তাকিয়ে নিয়ে মিনতির সুরে বলে, এত যখন ইচ্ছে, কোনমতে নিয়ে নিতে পারবেন না মিসেস পাল?

মিসেস পাল নিতান্ত বেজার হন। মেয়েটি সম্বন্ধে তিনি কিঞ্চিৎ সন্দেহযুক্ত। ঠিক ভদ্রঘরের মেয়ে কি? থাকে তো কলোনিতে। সে কলোনিরও সুনাম নেই। তাছাড়া জায়গা তো সত্যিই নেই, প্রায় প্রতিদিনই দুপাঁচজনকে নিরাশ করতে হচ্ছে। আর এ যেন ছিনেজোঁক! কেবল একঘেয়ে কথা, দয়া করে যদি–! আরে বাবা, দয়া যদি করতেই হয়, তুই ছাড়া কি আর উপযুক্ত পাত্র নেই?

কিন্তু মনের কথা মনে থাক। অনিমা পাল বেজার মুখে বলেন, কী করে নিই বলুন? একে তো ঘর ছোট, তাছাড়া মেশিন কই? তিনটে শিফটে কুলিয়ে উঠতে পারছি না!

আচ্ছা আর একটা মেশিনের ব্যবস্থা আমরা করব মিসেস পাল, শীগগিরই করব, কিন্তু ঘরের ব্যবস্থা তো চট করে করা সম্ভব নয়। এখন ওর মধ্যেই যা হয় করে যদি এই আর একটা সীট

মিসেস পাল মনে মনে জ্বলে যান। সুন্দর মুখ দেখে যেন একটু বেশি গলছেন সেক্রেটারি সাহেব। কিন্তু অনেক মেয়েকে ফেরাচ্ছেন মিসেস পাল, সে মনের জোর তার আছে। কাজেই দৃঢ়স্বরে বলেন, হতে পারে না ইন্দ্রনাথবাবু। আপনার এই তাঁতঘরখানার মত বড় ঘর যদি আমি পেতাম, অনায়াসে আরও দুগুণ মেয়ে নিতে পারতাম। এঁদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রথম স্টেজদের শেখাতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু জায়গা কোথা? আপনাদের যে আবার কঠিন জেদ, গভর্নমেন্ট এড নেবেন না। যতটা কাজ হচ্ছে এখানে, সেটাই একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে দেখাতে পারলে সরকার থেকে মোটা টাকা সাহায্য পাওয়া যেত।

ইন্দ্রনাথ একটু হাসে, কাজের পরিমাণটা একটু গুছিয়ে-গাছিয়ে দেখিয়ে সরকার থেকে মোটা টাকা আদায় তো চিরকালই আছে মিসেস পাল, হাজারো প্রতিষ্ঠান তা করছেও। একটা প্রতিষ্ঠান না হয় তা থেকে একটু পৃথক থাকল। সরকার তো নিজের ঘর থেকে দেন না, দেন জনসাধারণের কাছ থেকেই কুড়িয়ে। জনসাধারণ না হয় সরাসরিই দিল।

তা দিলে তো আর ভাবনা ছিল না। দেয় কই? মিসেস পাল আরও বেজার মুখে বলেন, মানুষ মানুষের মত আচরণ করলে তো আইন গড়বার দরকারই হত না। করে না বলেই আইনের প্যাঁচ কষে করিয়ে নেওয়া।

মেয়েটি চঞ্চলভাবে বারবার চোখ তুলে মিনতি জানাচ্ছে। ইন্দ্রনাথ শেষ চেষ্টা করে, তাহলে কিছুতেই সম্ভব নয়?

আপনি যখন বিশেষ করে বলছেন তখন সম্ভব করিয়ে নিতেই হবে।

মিসেস পালের বিশেষ শব্দটির উপর জোর দেওয়া কান এড়ায় না ইন্দ্রনাথের। একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। আগে হলে পড়ত না–এখন পড়ল। এখন বুঝছে সমাজের কাজ করে বেড়াতে হলে মিথ্যে দুর্নামকেও একেবারে অগ্রাহ্য করা চলে না। তাই অগত্যাই বলে, তবে থাক। বুঝতে পারছি আপনি খুব অসুবিধেয় পড়েছেন। আচ্ছা, আমাদের উত্তর কলকাতার কেন্দ্রে যদি–ইয়ে শুনুন, কোথায় থাকেন আপনি? উত্তর কলকাতায় আমাদের একটা কেন্দ্র আছে, সেখানে চেষ্টা করলে হয়তো

আমি এখানেই থাকি। ওই নতুন ইস্কুলটার পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা সাঁকোর দিকে গেছে, সেই রাস্তায়।

তাই তো, তাহলে তো খুব সুবিধে হবে বলে মনে হচ্ছে না! যাতায়াতের খরচাতেই তো

তবে–মেয়েটি ব্যগ্রভাবে বলে, যেখানে থোক, যে করে তোক আমার একটা ব্যবস্থা করে দিন। সেলাই হোক যা হোক।নইলে আমার যে কী হবে!

তাঁত চালাতে শিখবেন? একটু হাসে ইন্দ্রনাথ।

আপনি যা বলবেন তাই করব। একটা কিছু করে নিজে দাঁড়াতে চাই আমি।

আমরাও তো তাই চাই, হাসে ইন্দ্র, কী বলেন মিসেস পাল?

মিসেস পাল আর কিছু বলেন না।

ইন্দ্রনাথই ফের বলে, ঠিক আছে, তাহলে আমাদের একটি কর্মী ছেলেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, আপনাকে তাঁতঘরে নিয়ে গিয়ে সব বুঝিয়ে দিয়ে ভর্তি করে নেবে, কেমন?

নীরবে ঘাড় কাৎ করে মেয়েটি।

আচ্ছা, কিন্তু এদিকে তো সন্ধ্যে হয়ে আসছে–দেরি করলে তাঁতঘর বন্ধ হয়ে যাবে। এক কাজ করুন, আমার সঙ্গেই চলুন। আমি ওখানে আপনাকে পৌঁছে দিয়ে বলে-কয়ে চলে যাব। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস। খুব ইন্টারেস্টিং, একটু মন দিয়ে শিখতে চেষ্টা করলে দেখবেন খুব ভাল লাগবে। চলুন তবে চটপট।

ইন্দ্রনাথ এগোতে থাকে। পিছন পিছন মেয়েটি।

মিসেস পাল অস্ফুট মন্তব্য করেন, আমি বুঝেই ছিলাম!

.

তাঁতঘর সেই সাঁকোর ওপারে। যেদিকে সূর্য ঢলছে।

চারিদিক সোনায় সোনা। গাছের মাথায় মাথায় সোনা রোদ, মাটির বুকে বুকে সোনালি আলো, পশ্চিমমুখী পথ ধরে এগিয়ে যাওয়া মানুষ দুটোর মুখে সোনারঙা আবীর।

আগে পিছের বাধা দূর হয়ে ক্রমশ কখন পাশাপাশি হয়ে পড়েছে দুজনে।

নীরবতা অস্বস্তিকর। ইন্দ্রনাথ কথা বলছে।

বাড়িতে আপনার কে কে আছেন?

মাসিমা।

মাত্র? আর কেউ না?

আর কেউ না।

এদিকে কতদূর এগিয়েছিলেন? মানে আর কি, স্কুলে!

সামান্যই। মাসিমার অবস্থা ভাল নয়।

আমাদের দেশে কজনেরই বা অবস্থা ভাল মিসেস মিস

আমার নাম কমলা।

ওঃ আচ্ছা! এখানকার ছাত্রীদের অনেককেই আমি নাম ধরে বলি।

আমাকেও বলবেন। চোখ তুলে কথাটা বলে বুঝি চোখ নামাতে ভুলে যায় কমলা।…এই সেই মুখ। যে মুখ প্রতিনিয়ত কী এক দুর্বার আকর্ষণে কমলাকে কেন্দ্রচ্যুত করতে চাইছে! দিনে দিনে ভেঙেচুরে গড়ছে কমলাকে–পুরনো কমলা ক্রমশই পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে।

কী সুন্দর! কী অপূর্ব!

ইন্দ্রনাথও একটু অবাক হয়েছে বৈকি। এতক্ষণ মেয়েটার মুখ এত নিচু ছিল যে ভাল করে দেখতেই পাওয়া যাচ্ছিল না, এখন দেখে অবাক হল।

দুপাশে দুটি ঝোলানো বেণী, কপালের উপর চুলের থাক, দীর্ঘ পল্লবে ঘেরা চোখ দুটি কী বড় বড় আর কোমল কালো! আর সেই চুলের পটভূমির উপর ওই চোখের ঐশ্বর্যে ঐশ্বর্যান্বিত সমস্ত মুখটা একেবারে নিখুঁত সুন্দর!

অবশ্য এই রূপ দেখেই যে অবাক হল ইন্দ্রনাথ তা নয়, অবাক হল এই ভেবে যে, এমন মেয়ের বিয়ে হয়ে ওঠেনি কেন? নিজের পায়ের দাঁড়াবার জন্যে এর এত আকুলতা কেন? তবে কি বিধবা?

এমন সুকুমারমুখী কিশোরী কি বিধবা হওয়া সম্ভব? হা, কিশোরীই মনে হয় কমলাকে!

ওর মুখশ্রীর জন্যেই মনে হয়, মনে হয় ওর সুগঠিত দেহের জন্যে। অমন সুকুমার মুখ, আর অমন বিশাল ঢলঢল চোখ বলেই না অমন করে লোকের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পারে কমলা! ওই চোখের আয়ত বিষণ্ণ দৃষ্টি, আর মুক্তাবিন্দুর মত অশ্রু!

এতে আবার মানুষ বিভ্রান্ত না হয়ে পারে?

কিন্তু এখন এ চোখে আর কিছু নেই, আছে শুধু মুগ্ধ বিনম্র চিত্তের পূজা।

কৃতজ্ঞ দৃষ্টি ঢের দেখেছে ইন্দ্রনাথ, তবু যেন কেমন চাঞ্চল্য জাগে। তাড়াতাড়ি চলার গতি দ্রুত করে ফেলে বলে, একটু শীগগির চলুন, স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে মুশকিল!

ননী এসে আগের মত চৌকির ওপর বসে পড়ল না, বসল প্যাকিং কাঠের টেবিলটার ওপর। আজ আর তার শ্যামল মুখে আলোর উপস্থিতি নেই। কালো শুকনো শীর্ণ মুখ, চোখদুটো যেন দপদপ করছে। মুখের রেখায় রেখায় ঈর্ষা আর হতাশা, ক্লান্তি আর রুক্ষতার ছাপ।

এখন আর আগের মতন উফুল্ল আনন্দে হাসতে হাসতে ঢোকে না ননী, এবং সহজ আনন্দে সে আবির্ভাবকে বরণ করতে পারে না কমলা। কমলা যেন লজ্জায় আড়ষ্ট, ননী বিস্ময়ে কঠিন। কমলার চোখ যেন নিরুপায় লজ্জায় ম্লান হয়ে বলতে চায়, কী করব ননীদা, আমি যে পারছি না। ভেসে যাচ্ছি।

ননীর দপদপে চোখদুটো যেন নীরব তিরস্কারে ধিক্কার দেয়,ছি ছি, তুই এই!

মুখে কিন্তু আর তেমন সহজে তুই বলতে পারে না ননী। ঈর্ষার মত কেমন একটা সূক্ষ্ম জ্বালা-ধরা-মনে কেন কে জানে কেবলই ভাবতে থাকে ননী, কমলা তার থেকে অনেকটা উঁচুতে উঠে গেছে। ননীর থেকে, মাসির থেকে, তার সমস্ত পরিবেশের থেকে।

আর কমলা? সজ্ঞানে কিছুতেই যদি স্বীকার করতে না চায়, তবু অবচেতন মনে কমলাই কি ননীকে তার চাইতে অনেকটা নিচু স্তরের জীব বলে মনে করতে শুরু করেনি?

তাই ননী এসে ঘরে ঢুকে দূরে বসে।

কমলা অকারণে একখানা পড়া বইয়ের পাতা ওলটায়।

বই পড়া কমলার নতুন নয়, যা বিদ্যে অর্জন করবার সুযোগ পেয়েছিল ছেলেবেলায়, তাকেই চেষ্টা করে বাড়িয়ে বই সে পড়ে ফেলেছে বিস্তর। মাঝে একবার কিছুদিনের জন্য যখন ননীর কী যেন একটু ভাল চাকরি হয়েছিল, কমলাকে তো একটা লাইব্রেরিতেই ভরতি করে দিয়েছিল। তারপর অবিশ্যি সে চাকরিও ঘুচল, লাইব্রেরিও ঘুচল। কিন্তু যেমন করে তোক বই কমলা পড়েই। উঁচুদরের সাহিত্য না হলেও সিনেমা-পত্রিকা, বাজার-চলতি সাহিত্য।

ননী জানে। তবু আজ ব্যঙ্গ করে বলে ওঠে, পড়ো পড়ো। পড়ে পড়ে বিদুষী হও। লেকচারবাবুর উপযুক্ত তো হতে হবে!

ছিঃ ননীদা! কমলা আরক্ত মুখে বলে, তুমি আজকাল যেন যা-তা হয়ে যাচ্ছ। কেবল এইসব বিচ্ছিরি কথা! শিখছি একটা কাজ ভালর জন্যেই তো? তা সেখানে তার সেক্রেটারি যাওয়া-আসা করবে না?

করবে বৈকি, একশোবার করবে আগে যেখানে মাসে তিনবার যেত, এখন সেখানে হপ্তায় তিনবার যাচ্ছে!

কমলার মুখটা লাল হয়ে ওঠে। কে জানে লজ্জায় না গর্বে?

তবে কথাতে কিছুই প্রকাশ পায় না। সহজভাবে বলে, আগে মাসে মাত্র তিনবার যেতেন, এ খবর কে দিয়েছে তোমায়?

খবর কাউকে কাছে এসে দিয়ে যেতে হয় না কমলা, খবর কানে হাঁটে। যাক ভালই তো, এ তো সুখবর! সুলক্ষণযুক্ত সময়ে দুজনের ফটো জুড়ে দিয়েছিলাম, এবার প্রজাপতি ঠাকুর সত্যি দুজনকে জুড়ে দেবেন!

আঃ ননীদা! ফের ওই পচা ঠাট্টা!

ঠাট্টা নয় সে তুমি নিজেই ভাল জানো কমলা। চারিদিকেই একথা রাষ্ট্র হয়ে গেছে। শুনছি নাকি, ইন্দ্রবাবু এখন বাড়ি থেকে আউট হয়ে এসে কোন্ বন্ধুর ফ্ল্যাটে বাস করছে।

সে তো শুনি কাজের সুবিধের জন্যে।

তা তো শুনবেই। শোনা কথা শুনতে ভালই হয়।

কিন্তু মনের জ্বালায় ফের তুই সম্বোধনে ফিরে আসে ননী, বলিহারি যাই তোকে কমলি, জোচ্চুরি করে যা বলে এলি, শেষ অবধি তাই করলি? ওর গলায় পরাবার জন্যেই মালা গাঁথতে বসলি?

আচ্ছা ননীদা, তুমি কিগো? যা মুখে আসে তাই বলবে? তিনি কী, আর আমি কি, এ জ্ঞান কি তুমি হারিয়ে ফেলেছ?

জ্ঞান আমি হারিয়ে ফেলিনি কমলি, যে হারাবার সে হারিয়েছে। ওসব বড়লোকরা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

কমলা গম্ভীরভাবে বলে, যা প্রাণ চায় বলো। আমি কিছু বলব না।

বলবার কিছু থাকলে তো বলবি? কিন্তু ভাবছি কমলি, তোরা মেয়েমানুষ–সব পারিস! অতবড় রুইটাকে কেমন গেঁথে তুললি!

আঃ ননীদা! দোহাই তোমার, ওঁর সম্বন্ধে এসব বিচ্ছিরি কথা বোলো না। উনি দয়ালু, সবাইকেই দয়া করেন। আমাকেও

দয়ালু!! দয়া করে সবাইকেই তাঁতঘর থেকে তাদের আপন আপন ঘরে সঙ্গে করে পৌঁছে দিয়ে যান, কেমন? সবাইয়ের জন্যেই তাঁতের মাকুর মতন সকল জায়গা থেকে ছুটে ছুটে তাঁতঘরে টানাপোড়েন করেন, কেমন? দয়া! আমাকে তুই আর হাইকোর্ট দেখাতে আসিসনি কমলি!

হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে ওঠে কমলা। জ্বলে উঠে জ্বলন্ত স্বরে বলে,–তুমিও আর আমাকে উত্ত্যক্ত করতে এসো না ননীদা। আমাকে নিজের মনে থাকতে দাও।

ওঃ! বুঝেছি! ননী তার সেই রাজাসন থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। মনে হল মুখখানায় তার কে যেন আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে। দুঃখে অপমানে ক্ষোভে বিকৃত সেই কালিপড়া মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে ননী বলে, বুঝেছি–তা এটুকু মুখ ফুটে বলতে বুঝি এতদিন চক্ষুলজ্জায় বাধছিল! বেশ চললাম।..নিষ্কণ্টক হও তুমি। তোমাদের ভগবান তোমায় সুখশান্তি দিন। কিন্তু মনে রেখো কমলা, যে পথে পা বাড়িয়েছ সে হচ্ছে চোরাবালি! হঠাৎ ছুটে বেরিয়ে যায় ননী!

গরিব ননী, নিঃসহায় নিঃসঙ্গ ননী। জীবনযুদ্ধে পরাজিত বেচারা ননী।

.

ননী ছুটে বেরিয়ে গেল, কিন্তু কই, কমলা তো ছুটে বেরিয়ে আটকাতে গেল না তাকে?

নাঃ, কমলার আর সে এনার্জি নেই। ননীর অবস্থা দেখে তার দুঃখ হচ্ছে, মমতা হচ্ছে, বুঝি বা করুণাও হচ্ছে, কিন্তু তার জন্যে কিছু করবার উৎসাহ খুঁজে পাচ্ছে না কমলা।

উৎসাহ কমলা কিছুতেই পাচ্ছে না। তাই বসে বসে ননীর ওপর রাগ আনতে চেষ্টা করে। আচ্ছা কেন–কেন ননী এভাবে অপমান করবে কমলাকে? শুধু কমলাকেই নয়, সেই দেবতুল্য মানুষটাকেও! ছি ছি ছি!

যেদিন থেকে তাদের স্কুলে ভরতি হয়েছে কমলা, সেইদিন থেকেই মুখ ভার ননীর। তারপর ক্রমশই মনের কালি ছড়াচ্ছে। ছুতোয়নাতায় ছুঁচ ফোঁটাচ্ছে কমলাকে, আজ তো একেবারে চরম হয়ে গেল।

সন্দেহের কীট কুরে কুরে খাচ্ছে ওকে। অথচ সমস্তই অমূলক। সমস্তই হাস্যকর ধৃষ্টতা।

সঙ্ঘ-সেক্রেটারি ইন্দ্রনাথ চৌধুরী, রাজপুত্রের মত যার রূপ, রাজপ্রাসাদের মত যার বাড়ি, চারটে ছটা পাস করে একটা অফিসের সাহেব হয়ে বসেছে যে লোক, তার কাছে কিনা কমলা! কী ধৃষ্টতা!

কমলাকে তিনি পৌঁছে দিয়ে যান সত্যি, কিন্তু সে তো দয়া করে। কমলা কমবয়সী বলেই। ওই তঁতঘরে কমলার মতন মেয়ে আর কটা আছে? একটাও তো না! সবাই বড় বড়। সবাই প্রায় কালো কুশ্রী। তবে?

এটুকু যদি তিনি করে থাকেন কমলার জন্যে, সে তার দয়ালু স্বভাব বলেই। সূর্যের আলো পথের ধুলোর ওপরও পড়ে, কিন্তু পথের ধুলো কি সূর্যের কাছে গিয়ে পৌঁছতে পারে? কমলা ধুলো, একেবারে পথের ধুলো। তবু কমলাকে তিনি আপনি বলে কথা কন। কী অসহ্য সুখ!

সে যেন আর কেউ আর কোনো কমলা, অথবা সেইটাই সত্যিকার কমলা। আর এই নীচ সংসর্গে পালিত, এই হীন পরিবেশে পড়ে থাকা, এই চোর জোচ্চোর ধাপ্পাবাজ কমলা সেই কমলার একটা ছাউনি!…উপরকার খোলস একখানা!

তাই! তাই! এই খোলসখানা ভেঙে সত্যিকার কমলা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে তখন, যখন তার উপর সূর্যের কিরণ এসে পড়ে।

ননীদা এই ফুটে ওঠার মর্ম কি বুঝবে?

ওদের মগজে একটা মাত্র কথাই ঢোকে, সেটা হচ্ছে বিয়ে।

বিয়ে! এমন অসম্ভব সৃষ্টিছাড়া কথা মাথাতেও আসে ননীদার।

কিন্তু হঠাৎ নিজের মধ্যেই নিজে স্তব্ধ হয়ে যায় কমলা। বিয়েটা তাহলে কাকে? ননীদাকে? পাল্লাটা যে একেবারে হালকা হয়ে ঠক করে উঠে পড়ছে!

.

কিন্তু শুধু তো একা ননীই নয়, সঙ্রে অনেক সভ্য-সভ্যারই নজর লেগেছে কমলার এই সামান্য সম্পদটুকুর ওপর। ইন্দ্রনাথের আড়ালে হাসাহাসি করছে ওরা, সঙ্ঘের এবার বারোটা বাজল হে! ইন্দ্রনাথবাবুই যখন

যাই বল, ইন্দ্রদার পক্ষে এটা যেন ভাবাই যায় না।

বুঝলাম না হয় দেখতে শুনতে একটু পরিষ্কার, কিন্তু পরিষ্কার মুখ কি এর আগে কখনো দেখেননি ইন্দ্রদা? কত কত রূপবতী যে তার জন্যে তপ্যসা করছে!

বাবা ভীষ্ম হওয়া অত সহজ নয়! মনে হত কতই বুঝি একেবারে ইয়ে–যেই একটি সুন্দরী তরুণী দেখলেন, ব্যস্!

প্রায়ই চলেছে এ রকম আলোচনা।

.

কিন্তু ইন্দ্রনাথ কি খুব একটা কিছু অশোভন আচরণ করছে? না, সেকথা বললে তাকে অন্যায় দোষ দেওয়া হয়। সেসব কিছুই না।

শুধু কমলাকে দেখলেই ওর মুখটা কেমন একটু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কমলার সঙ্গে দেখা হবার ইচ্ছেয় অন্য সব কাজ তাড়াতাড়ি সেরে নিতে ইচ্ছে করে, কমলার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর সময়ের জ্ঞানটা যেন একটু কমে যায়। আর কমলাকে তাদের সমস্ত কেন্দ্রের সমস্ত কাজকর্ম দেখিয়ে বেড়ানোটা একটা কর্তব্যের মধ্যে গণ্য করে ইন্দ্রনাথ।

আজও সেই কথাই হচ্ছিল। মধ্য কলকাতায় আমরা আর একটা প্রাথমিক স্কুল খুলেছি, চলুন না দেখে আসবেন।

মধ্য কলকাতা! কোথায়! মানে কোন রাস্তায়? বিহ্বলভাবে বলে কমলা। কমলা কি জানে কাকে বলে মধ্য কলকাতা, আর কাকে বলে উত্তর!

মির্জাপুর স্ট্রীটের একটু ওদিকে। আশপাশে অনেক বস্তি রয়েছে–কত যে দুঃস্থ ছেলেমেয়ে তার সংখ্যা নেই। অবিশ্যি কিছুই হয় না, বুঝলেন, কিছুই হয় না–আবেগভরা কণ্ঠে বলে ইন্দ্রনাথ। একটা কেন এক হাজারটা প্রাথমিক স্কুল খুললেও এদেশের নিরক্ষরতা দূর হবে না, তবু চেষ্টা তো করতে হবে, কী বলেন?

কী বলেন! কমলাকে জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কী বলেন? কী অভিমত তার? কমলার দীর্ঘ সুঠাম ঋজু দেহখানা বাতাসে বেতপাতার মত কাঁপতে থাকে।

কই কথা বলছেন না যে?

আমি কী বলব! অতি কষ্টে বলে কমলা।

আপনারাই তো বলবেন। কেবলমাত্র সুবিধের অভাবে উপযুক্ত শিক্ষার্জন করতে না পারার দুঃখ তো আপনারাই মর্মে মর্মে বোঝেন। দেখছি তো আপনাকে–কত বুদ্ধি, কত চেষ্টা, কি রকম অনলস পরিশ্রমী,-সুযোগ পেলে আপনি লেখাপড়ায় কত উন্নতি করতে পারতেন। হয়তো খুব ভাল একটি অধ্যাপিকা হতে পারতেন আপনি!

হয়তো পারতাম। কিন্তু সে তো আর এ জন্মে হল না! কমলা হঠাৎ সকৌতুকে হেসে ওঠে, তার বদলে না হয় একটি ভাল তাতিনীই হব! এ হাসি আচমকা। ইন্দ্রনাথের এই অগাধ আশার স্বপ্নবার্তা শুনে বুকের ভিতর থেকে নির্মল কৌতুকের হাসি উথলে উঠেছে কমলার।

সেই কমলা! খারাপ মেয়েদের কাছ থেকে বাচ্চা ছেলে ভাড়া করে এনে লোককে মিথ্যে দুর্নামের ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে টাকা আদায় করে পেট চালায় যে কমলা!

না, সেই থেকে অবিশ্যি আর কোনদিন সে-কাজ করেনি কমলা, কিছুতেই রাজী হয়নি করতে, কিন্তু এই সেদিনও তো করে এসেছে। তার সামনের এই জ্যোতির্ময় পুরুষটির নামেই তো কালি মাখিয়ে এসেছে সেদিন! উঃ, ভাগ্যিস ইনি সেদিন বাড়ি ছিলেন না! থাকলে তো কেষ্টমোহিনীর নির্দেশ আর ননীদার পদ্ধতি অনুযায়ী এঁর মুখের উপরই বলতে হত, এত নিষ্ঠুরই কি হতে হয়? বলতে হত, আমাকে দেখ না দেখ, এই দুধের শিশুটার মুখপানে চাও! বলতে হত, তা এখন তো চিনতে পারবেই না! কিন্তু ধর্ম আছেন, ঠাকুর আছেন। এই বাচ্চার দিকে তাকিয়ে… তারপর আর কথা শেষ করতে হত না, শুধু কাঁদলেই চলত।

আজ মনে হচ্ছে ঠাকুর আছেন। হা হা, ঠাকুর আছেন। তাই সেদিন ইন্দ্রনাথের বাড়িতে গিয়ে ইন্দ্রনাথের মুখোমুখি পড়তে হয়নি। পড়লে কোথায় থাকত এই স্বর্গ!

হাসি শুনে ইন্দ্র যেন চমকে উঠল। এ মেয়ে এমন করে হাসতেও জানে? এযাবৎ শুধু দেখে এসেছে ওর কুণ্ঠিত লজ্জিত নতমূর্তি!

ক্ষণিকের এই উচ্ছ্বসিত হাসিতে ওর যেন আর একটা দিক খুলে গেল। সেদিকটা শুধুই একটি অভাবগ্রস্ত ঘরের সাহায্যপ্রার্থী ম্রিয়মাণ মেয়ে নয়, একটি প্রাণোচ্ছল তরুণী মেয়ে। যে মেয়ে হয়তো সত্যকার একটা মানুষের জীবন পেলে এমনি হাসিই জীবনভোর হাসতে পারবে।

লেখাপড়ায় ত্রুটি আছে। কিন্তু সে ত্রুটি তো নিতান্তই বহিরঙ্গ। ওর ভিতরের ওই বুদ্ধি আর নিষ্ঠার সঙ্গে যদি টিউটরের চেষ্টা যুক্ত করা যায়, সে ত্রুটি পূরণ হতে কতক্ষণ?

মুহূর্তের চিন্তা মুহূর্তেই লয় পেল। লজ্জিত হল ইন্দ্রনাথ নিজের কাছেই। তারপর হেসে তাড়াতাড়ি বলল, কার মধ্যে যে কতটা সম্ভাবনা আছে, সে কথা আগে থেকে বোঝ শক্ত। উপযুক্ত ক্ষেত্রে এসে পড়লে তবে যোগ্যতা অযোগ্যতা প্রমাণিত হয়। এই ধরুন না কেন, আমি যদি আপনাকে এরকম কোন স্কুলে নিচুদিকের দুএকটা ক্লাসের ভার দিই, তাহলে আপনি হয়তো কোন গ্র্যাজুয়েট মেয়ের চাইতে কিছু কম করবেন না। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই।

ক্লাসের ভার? মানে পড়ানোর ভার? আর একবার তেমনি করে হেসে ওঠে কমলা। ওর বুঝি এই হাসির নেশা লেগেছে।

ইন্দ্রনাথ যেন চোখ ফেরাতে ভুলে যায়।

হাসতে হাসতে লালচে মুখে বলে কমলা, আমার সামনে বললেন বললেন, আর কারো সামনে যেন বলে বসবেন না! তবে হ্যাঁ, ক্লাস ঝাড় দেবার কাজটা যদি আমাকে দেন, তাহলে হয়তো সার্টিফিকেট পেতেও পারি।

ইন্দ্রনাথও হেসে উঠে বলে, তাহলে প্রথম নম্বর তাতিনী, দ্বিতীয় নম্বর ঝাড়দারনী—

দুজনের হাসি এক হয়ে বাজতে থাকে।

চলুন, যাওয়া যাক! বাসের রাস্তার দিকে এগোতে থাকে ইন্দ্রনাথ। এখন আর তার গাড়ি নেই। বাড়ি ছেড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটাও ছাড়তে হয়েছে।

মধ্য কলিকাতা সমাজকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর মধ্যেকার অবস্থাটা খুব এমন উৎসাহকর নয়। তবু কমলাকে এনে অনেক উৎসাহে অনেক আশার কথা বলতে থাকে ইন্দ্রনাথ। আর সেই বহু কথা বলার মধ্যে যে কখন আপনি থেকে তুমি হয়ে গেছে, সেকথা নিজেই টের পায় না ইন্দ্রনাথ।

সেই কথাই বলছি কমলা,–এইটুকু ঘর, কটিই বা ছেলেকে বসতে দেওয়া যায়। প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়। মরুভূমিতে বিন্দুজল। তবু আমি হতাশ হই না। বুঝলে কমলা, চিরকালের যে প্রবাদ আছে, বিন্দু থেকে সিন্ধু–সে কথায় আমি বিশ্বাসী। আমি কল্পনা করি

আমার সেই দেশের ছবি, যেখানে কেউ নিরক্ষর নেই, কেউ দরিদ্র নেই…।

কমলাকে বুঝি আজ হাসিতে পেয়েছে, তাই আবার হেসে উঠে ইন্দ্রনাথের সুরে বলে–কেউ চোর নেই, কেউ ডাকাত নেই!

না, চোর-ডাকাতটা থাকা দরকার। উচ্ছ্বসিত কৌতুকে হাসতে থাকে ইন্দ্রনাথ, চোর ডাকাত কিছু কিছু চাই। সর্বদা হারাই হারাই ভাব না থাকলে আর মজা কী!

এখন পড়ন্ত বিকেল, বিদ্যালয়ের বিদ্যাধারা নেই। দুএকজন শিক্ষিকা, একজন কেরানী, চাকরটা, দারোয়ানটা এদিক ওদিক ঘুরছে, তারা সেক্রেটারির এহেন কৌতুক-হাসির শব্দ শুনে একটু চকিত হল। প্রাণখোলা হাসি হাসে বটে ইন্দ্রনাথ, কিন্তু এরকম একক কোন তরুণী সঙ্গে করে নয়।

স্কুলবাড়ি থেকে বেরিয়ে ইন্দ্রনাথ বলল, উঃ কী ভীড়, বাসে চড়তে পারার আশা রাখেন? যাত্রীদের অবস্থা দেখুন!

আবার আপনি? বাঃ! কমলা একটু অভিমানের সুরে বলে।

আবার মানে? ইন্দ্রনাথ অবাক হয়ে তাকালো।

এতক্ষণ তো তুমি বললেন!

বললাম নাকি? ও হো হো কিছু মনে করবেন না, আমি ওইরকম অন্যমনস্ক।

মনে করব, যদি আবার আপনি চালান!

ইন্দ্রনাথ ওর মুখের দিকে গভীর দৃষ্টি ফেলে বলে, তুমি বললে খুশী হও?

কমলা মাথা নিচু করে। না, এ দৃষ্টির দিকে তাকাবার ক্ষমতা তার নেই।

কই, বললে না?

হই।

আচ্ছা! একটা ট্যাক্সিই নেওয়া যাক, কী বল?

ট্যাক্সি! মুহূর্তের জন্য একবার কেঁপে ওঠে কমলা। কেন? এ প্রস্তাব কেন? কী মতলব? তবে কি তবে কি ননীদার সন্দেহই ঠিক–এসব বড় লোকের ছেলেরা সুন্দরী মেয়ে দেখলেই জ্ঞান হারায়!

পরক্ষণেই নিজের মনে নিজেকে ছি ছি করে ওঠে কমলা। ছি ছি, কী তার পাপের মন!

ইন্দ্রনাথ ওর বিমনা ভাব লক্ষ্য করল। কী ভেবে বলল, তবে থাক, বাসেই যাওয়া যাক তেঁতুলগাছে বাদুড় ঝুলে!

কমলা লজ্জা ঢাকতে তাড়াতাড়ি বলে, কেন, কী হল? আমার তো শুনে বেশ মজাই লাগছিল।

মজা!

হ্যাঁ! কমলা স্থিরস্বরে বলে, গাড়ি চড়বার ভাগ্য আর আমাদের জীবনে কবে আসে বলুন? না না, ভয় করবে না কমলা, কিছুতেই না। ভয় করে নীচ হবে না, ছোট হবে না।

ট্যাক্সিতে চড়ে বসে ইন্দ্রনাথ আগের কথার জের টানে, সত্যি কমলা, নাও না আমার স্কুলের কিছু ভার। তাহলে আমি আরও ছেলেমেয়ে নিতে পারি।

কমলা এবার গম্ভীর হল। গম্ভীরভাবে বলল, আমাকে আপনি কী একখানা ভাবেন বলুন তো! মস্ত একটি বিদুষী?

না কমলা। মস্ত একটি বিদুষী তোমায় ভাবি না, কিন্তু মস্ত একটা সম্ভাবনা যেন দেখতে পাই তোমার মধ্যে। কিন্তু সে কথা থাক। আমার তো খুব একটা বিদুষীর প্রয়োজন নেই–পড়াতে হবে তো বর্ণপরিচয়, এটুকু তুমি নিশ্চয় পারবে।

ইন্দ্র কি বুঝছে, নিজেকেই নিজে ঠকাচ্ছে? বুঝছে কি কমলাকে এই কাজ দেওয়ার আকুলতা, তাকে আরও বারবার দেখতে পাবার, বেশি করে কাছে পাবার অবচেতন বাসনা! …না, ইন্দ্রনাথ সেকথা বুঝছে না। এমন অবস্থায় কেউই বোঝে না।

তোমাকে অবশ্য আমি একেবারে অমনি খাটাব না। ইন্দ্র হাসে। আগের কথার জের টেনেই বলে, তোমার সময়ের বিনিময়ে সরে ফান্ড থেকে সামান্য কিছু পাবে। তবে সে সামান্যটা যৎসামান্যই। জানোই তো, এসব সঙ্-টঙ্র ফান্ড কত কাহিল হয়!

কমলা মুখ তুলে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, আমি আপনার কিছু কাজ করতে পেলেই ধন্য হয়ে যাব। আর কিছুই চাই না।

ইন্দ্রনাথ কী উত্তর দিত কে জানে, হঠাৎ কেমন একটা হৈ-হৈ উঠল, কানের উপর এসে আছড়ে পড়ল যেন অতি পরিচিত কোন কণ্ঠস্বর, সঙ্গে সঙ্গে ঘঁাচ করে থেমে গেল গাড়িখানা।

ওঃ, শুধু এ গাড়িখানা নয়, পাশে আরও একখানা গাড়ি আচমকা থেমে গেছে।…ধাক্কা লাগছিল নাকি?

ধাক্কা লাগত নয়, লেগেছে। গাড়িতে গাড়িতে নয়, ধাক্কা লেগেছে ইন্দ্রনাথের বুকে… ধাক্কা লেগেছে তার চোখে। তাই হঠাৎ থেমে যাওয়া সেই মূল্যবান প্রাইভেট কারখানার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে ইন্দ্রনাথ।…কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্যে! বড় জোর এক পলক!

নীহারকণা নেমে পড়েছেন পথের ওপর। সমস্ত রাস্তা সচকিত করে তার আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়েছে, ও চন্দর, এই তো সেই সর্বনাশী!

কী ব্যাপার? ইন্দ্ৰনাথ উদ্ভ্রান্তের মত গাড়ি থেকে নেমে পড়ে।

কিন্তু কমলা? কমলা কি বেঁচে আছে?

কাকে কী বলছ পিসিমা? এ হচ্ছে কমলা, আমাদের সঙ্ঘের একটি সদস্য। ইন্দ্রনাথ বলে।

রেখে দে তোর সদস্য। কমলা কেন…ওর আরও ঢের নাম আছে। কাকে কী বলছি? ঠিকই বলছি। ছলাকলা-উলি ডাইনীকে যা বলবার বলছি।…এই তো সেই অরুণা। যে সেদিন মা নিয়ে ছেলে নিয়ে বাড়ি বয়ে গিয়ে আমার সর্বনাশ করে এল! আমার সোনার চাঁদকে ঘরছাড়া করল। এখনো আমাকে পথে পথে ঘোরাচ্ছে!…বাঃ, এখন যে আবার সিঁদুর মুছে ডবল বিনুনি ঝুলিয়েছ দেখছি! তাই তো বলি, এতবড় ঘোড়ড়ল মেয়ে না হলে আমার চোখে ধুলো দিয়েছে, আবার আমার ইন্দুর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে…

পিসিমা! ধমকে ওঠে ইন্দ্রনাথ, রাস্তায় আর একটি কথা নয়! এমন পাগলের মত কথা বলছ যে তোমার মাথায় বরফ চাপানো উচিত! বাবা আপনিও তো রয়েছেন, অথচ

নীহারকণা চেঁচিয়ে ওঠেন, ওর আবার থাকা-না-থাকা! ও যদি মানুষ হত, তাহলে কি আর এই এতদিন তোকে আমি ওই ডাইনীর কবলে ফেলে রাখতাম! ভাগ্যিস যাই এই ভালমানুষের ছেলেটি গিয়ে আমায় সন্ধান দিল! বল না গো বাছা!

গাড়ির মধ্যে পাথরের পুতুলের মত স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ননীর দিকে দৃষ্টিপাত করেন নীহারকণা।

কিন্তু ননীই কি বেঁচে আছে? ট্যাক্সির মধ্যে সীটের কোণে জড়ে বসে থাকা কমলার পাংশু মুখখানা দেখেই সমস্ত চৈতন্য লুপ্ত হয়ে গেছে। ওই মুখ দেখামাত্রই অনুভব করতে পারছে ননী কী কাজ করেছে সে! কী ভয়ংকর গর্হিত! কী গহিত, কী নীচ, কী ছোট।

ঈর্ষার জ্বালায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল সে। সহ্য করতে পারছিল না কমলা আর ইন্দ্রনাথের বন্ধুত্ব। কিন্তু এত কৌশল করে, এত দুঃসাহস করে ইন্দ্রনাথের চোখ থেকে কমলাকে সরিয়ে ফেলে লাভই বা কী হবে ননীর? কমলা কি কোনদিন ক্ষমা করতে পারবে ননীকে?

ট্যাক্সি ড্রাইভারটা প্রথমে হকচকিয়ে গিয়েছিল, এখন গজগজ করে উঠল–সে গাড়ি চালাতে বেরিয়েছে, তামাশা দেখবার সময় তার নেই। বাবু তাকে ছেড়ে দিক! ·

আচ্ছা ঠিক আছে। ছেড়ে দিচ্ছি তোমায়। ইন্দ্রনাথ বলে, চলো পিসিমা বাড়িতেই চলো। তোমাদের কতকগুলো ভুল ভাঙুক। কমলা নেমে এসো তো। এ গাড়িতে উঠে এস। দেখ এই হচ্ছেন আমার পিসিমা, আর এই আমার বাবা। মিথ্যে একটা ভুল করে ওঁরা তোমায় অপমান করে বসেছেন, তার জন্যে আমি ওঁদের হয়ে মাপ চাইছি। এস নেমে এস।

কিন্তু নেমে আসবে কে? নেমে আসবার ক্ষমতা কি কমলার আছে? ওই গাড়িতে ননীকে দেখেই সমস্ত ঘটনাটা জলের মত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে তার চোখে। সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে থেকে অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে সমস্ত পৃথিবী।

কর্মলা! কমলা!কমলা! ঝুঁকে পড়ে ডাক দেয় ইন্দ্রনাথ। বিব্রত বিপর্যস্ত বেচারী ইন্দ্রনাথ। মেয়েটা এত সুকুমার! পিসিমা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে কী বললেন আর ও এমন হয়ে গেল!

পিসিমার বলার ধরনটাও কী কুৎসিত, অপমানকর! এতখানি বয়সে প্রথম এই মনে হল ইন্দ্রনাথের, নীহারকণা কী অমার্জিত, কী গ্রাম্য, কী অভদ্র।

চন্দ্রনাথ এবার গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন। উদ্বিগ্নভাবে বলেন, কী, হল কী?

হবে আবার কী? পিসিমা চাপা ঝঙ্কার দিয়ে ওঠেন, বুঝতে পারছিস না? হাতে-নাতে ধরা পড়ে গিয়ে এখন ভয়ে লজ্জায় মুচ্ছো যাওয়ার ভান করছেন। যে মেয়ে অতবড় থিয়েটার করে বেড়ায়, তার কাছে আর এ কতটুকু?…ওরে ইন্দু, অমন আগুনজ্বালা চোখে আমার দিকে তাকাবার আগে এই ভালমানুষের ছেলের কাছে শোন্ ওই লক্ষ্মীছাড়া মেয়ের ইতিবৃত্ত! বলো না গো বাছা–ওমা একি! গেল কোথায় ছোঁড়া?

হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন নীহারকণা। এঁদের গোলমালের মাঝখানে নিঃশব্দে কখন চলে গেছে ননী।

বাঃ, চমৎকার! তোমার বিশ্বস্ত সংবাদদাতা একেবারে হাওয়া! নীহারকণার দিকে একটা ব্যঙ্গদৃষ্টি হেনে ইন্দ্রনাথ সহসা একটা কাজ করে বসে। ট্যাক্সিটায় চড়ে বসে সশব্দে তার দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলে, এই ট্যাক্সি, চলো যাদবপুর!

সামনে দিয়ে গাড়িটা চলে যায়, আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন নীহারকণা আর চন্দ্রনাথ। একটু পরে একটা নিশ্বাস ফেলে চন্দ্রনাথ বলেন, উঠে এসো দিদি। মনে হচ্ছে বারে বারে আমাদেরই ভুল হচ্ছে!

ভুল হচ্ছে? নীহারকণা ক্রন্দনজড়িত স্বরে বলেন, ভুল হচ্ছে আমার? আমি তোকে স্ট্যাম্পো কাগজে লিখে দিতে পারি চন্দর, এ মেয়ে সেই মেয়ে! ও যতই নাম বদলাক আর ভোল বদলাক, হাজারটা মেয়ের থেকে একনজরে চিনে বার করতে পারব আমি ওকে! ওর ছবি আমার বুকের মধ্যে খোদাই করা হয়ে আছে!

তাহলে তোমার এই কি বলে, ননী বলে ছেলেটা সরে পড়ল কেন?

নীহারকণা সনিশ্বাসে বলেন, সেই তো রহস্য!

.

কিছুক্ষণ পাতালপুরীর স্তব্ধতা।

তারপর এক সময় ফের নীহারকণাই বলেন, আসল কথা বুঝছি, বিয়েই করেছে। নইলে অত বুকে জোর? লক্ষ্মীছাড়া ছেলে, করলি করলি–একটা অঘরে কুঘরে বিয়ে করলি! আর সেই নিয়ে এমন ডুবলি যে আমাদের চিনতে পারছিস না! চন্দর, তুই কালই আমায় হরিদ্বারে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর! গুরু-আশ্রমে উঠোন ঝেটিয়ে বাসন মেজে খাব, তাও আমার মান্যের!

এতক্ষণ পরে চন্দ্রনাথ একটু হাসেন। ক্ষোভের, দুঃখের, তিক্ত ব্যঙ্গের–তুমি তো সুখী দিদি, তোমার তো তবু গুরু-আশ্রম আছে, মানের জায়গা আছে, ইচ্ছে হলেই চলে যেতে পারো সেখানে!

.

কৃষ্ণমোহিনী গালে হাত দিয়ে বলে, ওমা একি! কী ব্যাপার বাছা? মেয়েকে আমার কোথায় নে গিয়েছিলে যে, এমন অজ্ঞান অচৈতন্য হয়ে এসে পড়ল?

ইন্দ্রনাথ বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। ইনিই কমলার মাসি নাকি? .

কমলাকে দরজার কাছাকাছি পৌঁছে দিয়ে গেছে ইন্দ্রনাথ অনেকদিন, বেড়ার এই দরজাটার বাইরের পিঠটা তার চেনা, এ পিঠটা কোনদিন দেখেনি। কমলাও অনুরোধ করেনি কোনদিন, বরং ইন্দ্রনাথকে মোড়ের মাথা থেকে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টাতেই তৎপরতা তার।

আর আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, ওই তো আমাদের বাড়ি, এবার ঠিক চলে যাব–এই ছিল তার বুলি।

ইন্দ্রনাথ ভাবত দারিদ্র্যের লজ্জা। কিন্তু কৃষ্ণমোহিনীকে দেখেই তার বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।

এ কি কোন ভদ্রমহিলার কণ্ঠস্বর? আর মুখ? মুখের চেহারাতেও যেন স্পষ্ট ফুটে রয়েছে একটা কুৎসিত জীবনের গ্লানিকর ছাপ।

তবু ইন্দ্রনাথকে তো ভদ্রতা রাখতেই হবে। তাই মৃদুস্বরে বলে, গিয়েছিলেন আমাদের একটা স্কুল দেখতে উত্তর কলকাতায়। বোধহয় বেশী গরমে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেছেন। অন্যত্র নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করতে গেলে দেরি হবে, আপনি চিন্তিত হবেন, তাই এখানেই নিয়ে এলাম।

তা তো এলে। কিন্তু ইস্কুল দেখাতে নিয়ে যাবার হুকুমটা কে দিয়েছিল বাছা? আমার এই ভরা বয়সের মেয়েকে যে তুমি কোথায় না কোথায় নিয়ে বেড়াও, সেটাই কি ভাল কর? তারপর আজ এই কোথায় নিয়ে গিয়ে এই অবস্থা করে আনলে–কী জানি কী করেছ! বড়লোক বলে কি গরিবের মান-ইজ্জত রাখবে না? আমি যদি এখন লোক ডাকি! পুলিসে দিই তোমায়?

হ্যাঁ, কৃষ্ণমোহিনী আজ ইন্দ্রনাথের সম্বন্ধে একটা হেস্তনেস্ত করতে বদ্ধপরিকর। ওর জন্যেই তার ব্যবসাপত্র লাটে উঠতে বসেছে।

হঠাৎ ইন্দ্রনাথের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একটা বিদ্যুৎ-শিহরণ খেলে যায়।…তবে কি পিসিমার কথাই সত্যি? এ সবই ষড়যন্ত্র?…নইলে এ কি? এ কি জঘন্য কুৎসিত ভাষা আর ভঙ্গি!…

তবু নিজেকে প্রাণপণে সংযত রেখে ইন্দ্রনাথ বলে, লোক ডেকে আমাকে পুলিসে ধরিয়ে দেওয়ার চাইতে অনেক দরকারি কাজ হবে ডাক্তার ডেকে এঁর চিকিৎসা করান।

ডাক্তারের খরচাটা তাহলে তুমিই দাও বাছা! দয়ার শরীর, পয়সা আছে, দেবে না কেন?

হয়তো ইন্দ্রনাথ নিজেই ডাক্তার ডাকতে যেত, কিন্তু নীচ এই কথার পর তার সমস্ত অন্তরাত্মা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। দৃঢ়স্বরে বলে, না, তা দেব কেন? আপনাদের মেয়ে আপনিই দেবেন। অবশ্য আপনি যদি সত্যিই এঁর আত্মীয় হন!

কেন, অবিশ্বাস হচ্ছে বুঝি? কেষ্টমোহিনী মুখ সিটকে বলে, তা হবে বৈকি। আমি যে কাঙাল! এই কমলি, আর কতক্ষণ ভেক ধরে থাকবি? চোখ মেলে বুঝিয়ে দে না বাবুকে, আমি তোর সত্যি মাসি হই, না তুই রাজকন্যে, আমি খুঁটেকুড়নি!

মির্জাপুর থেকে যাদবপুর কম রাস্তা নয়। চলন্ত গাড়ির উদ্দাম হাওয়ায় অনেকক্ষণ আগেই আকস্মিক লুপ্ত হয়ে যাওয়া চেতনা ফিরে এসেছিল কমলার। কিন্তু নিদারুণ একটা আতঙ্কে আর আশঙ্কায় চোখ খুলতে পারছিল না। নির্জীবের মত চুপ করে চোখ বুজে পড়েছিল।

না, কিছুতেই ইন্দ্রনাথের সামনে চোখ খুলতে পারবে না কমলা, পারবে না মুখ দেখাতে। ও আগে চলে যাক।চোখ বুজে কল্পনা করছিল যদি এ অজ্ঞানতা না ভাঙত!

কিন্তু আর পারল না নিশ্চিন্ত হয়ে চোখ বুজে থাকতে। মাসির আক্রোশ যে কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে, সে সম্বন্ধে ধারণা আছে যে কমলার। তাই ধীরে চোখ খুলে হাতের ইশারায় কেষ্টমোহিনীকে চলে যেতে বলে।

অ! চলে যাব? তা যাচ্ছি। নাগিনী শেষ ছোবল মেরে যায়, কিন্তু এই পষ্টকথা বলে দিচ্ছি কমলি, তেমন বুঝলে আমিও ছেড়ে কথা কইব না!

কী বুঝলে কী ছাড়বে না, সেটা উহ্য থাকে।

কেষ্টমোহিনী চলে যেতেই ইন্দ্রনাথ কমলার কুশল প্রশ্নের পরিবর্তে জলদগম্ভীর স্বরে বলে,-যাক, জ্ঞান ফিরে এসেছে তাহলে? আশা করি আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে!..আমি শুধু জানতে চাই, তুমি আমার পিসিমাকে এর আগে কোনদিন দেখেছ?

দেখেছি। কমলার স্বরে মৃদুতা নেই, জড়তা নেই, ও যেন নিজেই নিজের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা দিতে দৃঢ়সঙ্কল্প।

ইন্দ্রনাথ বলে, তাহলে এসব সত্যি?

কমলা ঘাড় হেলিয়ে বলে, সব সত্যি।

সমস্ত?

সমস্ত।

আশ্চর্য!..যাক, ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে তোমার এ ছদ্মবেশ এত সহজে ধরা পড়ল। কিন্তু তবুও বলব তোমার জন্যে আমি দুঃখিত কমলা।…যাক। ইন্দ্রনাথ যাবার জন্যে পা বাড়ায়।

হঠাৎ কমলা দ্রুত এসে ইন্দ্রনাথের পথ রোধ করে দাঁড়ায়, আর কেমন একটা তীব্র স্বরে বলে ওঠে, শুধু দুঃখ জানিয়ে চলে গেলে তো চলবে না, আমার সব কথা শুনে যেতে হবে।

কোন দরকার নেই আমার। আর তাতে প্রবৃত্তিও নেই।

কমলা আচমকা অস্বাভাবিক জোরে হেসে ওঠে, অপ্রকৃতিস্থের মত হাসতে হাসতে বলে,-প্রবৃত্তি নেই? তা থাকবে কেন? আমাদের রূপ দেখতে আপনাদের প্রবৃত্তি আছে, আমাদের হাসি দেখতে আপনাদের প্রবৃত্তি আছে, প্রবৃত্তি থাকে না শুধু আমাদের জীবনের জ্বালা দেখতে!…বলতে পারেন, পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মেয়েমানুষ শুধু পেটের ভাতের অভাবে পুরুষের প্রবৃত্তির আগুনে পুড়ে মরছে বলেই আমাকেও তাই করতে হবে কেন?…আমি কেন বাঁচতে চাইব না? বাঁচবার সহজ কোন রাস্তা যদি খুঁজে না পাই, কেন কাঁটাঝোপ দিয়েও যাবার চেষ্টা করব না?…বলুন?…উত্তর দিন এর?

আপনি দয়ালু, আপনি পরোপকারী, আপনাকেই এর উত্তর দিতে হবে।… উত্তেজনায় পাগলের মত দেখতে লাগে কমলাকে।

ইন্দ্রনাথ ঠিক এর জন্য প্রস্তুত ছিল না। ঘৃণায় লজ্জায় তার অন্তরাত্মা সঙ্কুচিত হয়ে উঠেছিল, এখানকার আবহাওয়া নিতান্ত কলুষিত বোধ হচ্ছিল, তাই তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল। সত্যিই কমলার সঙ্গে কথা কইবার প্রবৃত্তি তার ছিল না। কিন্তু কমলার মধ্যে অপরাধিনীর ছাপ কই?

তোমার কথা বুঝতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কমলা। ইন্দ্রনাথ গম্ভীরভাবে বলে, পথ ছাড়ো, যেতে দাও।

না না না, আমার কথা আপনাকে শুনে যেতেই হবে। এরপর হয়তো আত্মহত্যা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না আমার, কিন্তু আপনার চোখে ছোট হয়ে, হেয় হয়ে গিয়ে, মরেও শান্তি হবে না আমার। এ কথার সঙ্গে সঙ্গেই সেই অগ্নিবর্ষী চোখের কোলে বন্যা উঁকি মারে।

বেশ শুনব তোমার কথা। ইন্দ্রনাথ ননীর একচেটে সিংহাসন সেই প্যাকিং বাক্সটার ওপর বসে পড়ে বলে, এই বসছি। বলো, কী বলবার আছে!

.

আমার প্রথম কথাটাই আবার বলব, কেউ যদি বাঁচতে চায়, পৃথিবী তাকে বাঁচতে দেবে না?

তোমার কোন ইতিহাসই আমি জানি না কমলা।

আমারই কি সবটা জানা আছে? কমলা মাথা নিচু করে গাঢ়স্বরে বলে, শুনতে পাই ভদ্রঘরের মেয়ে ছিলাম, কেউ বা কারা ভুলিয়ে ধরে এনে বিক্রি করে দিয়েছিল এদের কাছে।–যাকে মাসি বলি সে আমার কেউ নয়।

ইন্দ্রনাথ বলে, আমারও ঠিক ওই কথাই মনে হচ্ছে কমলা। এরা তোমার আত্মীয় হতে পারে না।..কিন্তু বলছিলে–শুনতে পাও–কে বলেছে সে কথা?

মাসিরই বন্ধুরা। যখন ঝগড়া হয় এরা তো আর তখন কেউ কারুর বন্ধু থাকে না; গালমন্দ দেয়; বলে হাটে হাঁড়ি ভাঙব, তোর সব কথা বলে দেব। সেই ঝেকে বলে দিয়েছে আমায়। কিন্তু ওই মাসি বলে– সহসা চুপ করে যায় কমলা। বোধ করি শক্তি সংগ্রহ করতে থাকে বলবার জন্যে।

ইন্দ্রনাথ একটু চুপ করে থেকে বলে, কী বলে?

কমলা মুখ তুলে দৃঢ়গলায় বলে,-বলে যে, আমি তোকে খাইয়ে পরিচয় মানুষ করলাম তার শোধ দে।…বলে খারাপ হতে…। আমি তা পারব না…মরে গেলেও পারব না। উত্তেজিত স্বরে বলে কমলা–একদিন মরতেই গেলাম, কিন্তু ননীদা বলল– আবার থেমে গেল কমলা।

ননীদা কে? বিস্মিত কণ্ঠে উচ্চারণ করে ইন্দ্রনাথ।

ননীদা এমনি একটা ছেলে, কমলা ঢোক গিলে বলে, কাছেই কোথায় থাকে, ছেলেবেলা থেকে আমায় খুব স্নেহ করত। আগে ওই মোড়ে চায়ের দোকানে কাজ করত, আমাকে রাস্তায় দেখলেই বিস্কুট দিত। তারপর ও কী করে যেন ফটো তুলতে শিখল, ফটোর দোকানে চাকরি হল, ভদ্রলোকেদের সঙ্গে মিশে মিশে অনেক বুদ্ধি হল, ও তাই আমাকে পরামর্শ দিলে মাসির কথা শোনার থেকে অনেক ভাল কাজ লোক ঠকিয়ে খাওয়া!…বললে পৃথিবীসুদ্ধ লোকই তো লোক ঠকিয়ে খাচ্ছে! তাই–

কত বড় ছেলে তোমার ননীদা?

আমার থেকে ছসাত বছরের বড়।

ইন্দ্রনাথ সহসা একটু তীব্রস্বরে বলে ওঠে,–তা সে তো তোমাকে বিয়ে করলেই পারে?

কমলা বলতে পারত, হ্যাঁ তাই তো ঠিক হয়ে আছে, বলতে পারত–সেই আশায় তো দিন গুনছি, বলতে পারত–দিন না ওর অবস্থার একটু উন্নতি করে–কিন্তু বলতে পারল না। ইন্দ্রনাথের পিসিমার গাড়িতে বসে থাকা ননীর হিংসে কুটিল মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে।

ওই নীচ ননীকে আর বিয়ে করতে পারবে না। ননী নিজের হাতে নিজের মূর্তি আছড়ে ভেঙেছে। নইলে ননীই কি কমলার আরাধ্য পুরুষ ছিল না এতদিন?

সত্যি বটে, বিগত কতকগুলো দিন ইন্দ্রনাথের মহিমা কমলার সমস্ত সত্তা, সমস্ত চেতনা, সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তি আচ্ছন্ন করে থাকলেও মনের মধ্যে ননীর কাছে একটা অপরাধ-বোধের ভারে পীড়িত হচ্ছিল, কিন্তু এ কী করলে ননী!….তার এতদিন ধরে আঁকা ছবিটার ওপর এমনি করে কালির পোঁচড়া বুলিয়ে দিলে!

.

ননীর সেই কালিমাখা ছবিটা স্মরণ করে কমলা মাথা নেড়ে ইন্দ্রনাথের কথার জবাব দেয়, না, তা পারে না। কারণ আমি করব না।

আমি করব না!

ইন্দ্রনাথ মিনিটখানেক স্তব্ধ থেকে বলে, কিন্তু কেন? ও তো তোমাকে স্নেহ করে! ও তোমার উপকার করেছে!

তা করেছে সত্যি, একশবার সে ঋণ স্বীকার করব, কিন্তু আর কিছু করবার নেই আমার। বুঝতে পারছি আমি অকৃতজ্ঞ, আমি নিষ্ঠুর, বুঝেও উপায় নেই আমার। কী করব, অকৃতজ্ঞ হবার জন্যেই ভগবান আমায় গড়েছেন। মাসি বলে অকৃতজ্ঞ, ননীদা বলবে অকৃতজ্ঞ, আর আপনি! আপনার হয়তো সেটা বলতেও প্রবৃত্তি হবে না! মাথা নিচু করে কমলা।

আমি? আমার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা অকৃতজ্ঞতার প্রশ্ন কী?

কিছুই নেই? কমলা উত্তেজিত স্বরে বলে, আপনি মহৎ, তাই একথা বলতে পারছেন। কিন্তু আমি তো জানি আপনার কাছে আমি কী পেয়েছি, আর আপনাকে আমি না, আমার কথা প্রকাশ করার ভাষা আমার নেই। মাথাটা আবার নিচু করে কমলা।

ইন্দ্রনাথ মিনিটখানেক সেই আনত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে, একটা কথা এখনো খুব পরিষ্কার হয়নি।

কী?

ওই যে তোমার ননীদা, কী যেন পরামর্শ দিলে—

সেই তো! সেই জন্যেই তো!..কিন্তু সে বড় বিশ্রী কথা, শুনতে পারবেন কি আপনি?

শুনতে জগতে অনেক কিছুই হয় কমলা, কিন্তু থাক, তোমার হয়তো বলতে কষ্ট হবে।

না, বলব।

দৃঢ়স্বরে বলে কমলা। তারপর ধীরে ধীরে বলে চলে আনুপূর্বিক ইতিহাস।…বলে, এই কুৎসিত পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হওয়ার নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা, আবার মাসির নিষ্ঠুর পীড়নে সেই কাজেই প্রবৃত্ত হতে বাধ্য হওয়া ..একটির পর একটি লোক কীভাবে তাদের শিকার হয়েছে, কী ভাবে ননী অদ্ভুত পদ্ধতিতে ফটোগ্রাফের কায়দায় সম্পূর্ণ অপরিচিত দুটো মানুষকে একত্রে জুড়ে এই শিকারের সহায়তা করেছে, শেষ পর্যন্ত কীভাবে নীহারকণাকে প্রতারণা করে নিয়ে এসেছে তার গলার হার, নগদ টাকা–সবই বলে শেষ করে কমলা, একটা মরীয়া মনোভাব নিয়ে।

বলতে বলতে কখন বেলা শেষ হয়ে গেছে, কখন সোনারঙা আলো ঝিমঝিমে হতে হতে মিলিয়ে গেছে খেয়াল হয়নি দুজনের একজনেরও।

বাইরের পৃথিবীতে হয়তো তখনও একটু আলোর রেশ, কিন্তু ঘরের মধ্যে নেমেছে অন্ধকারের যবনিকা। নিচু দেওয়াল টিনের চালাঘরে তো আরো তাড়াতাড়িই নেমেছে।

এখন আর কেউ কারুর মুখ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু স্তব্ধতা। শুধু মৃদু গভীর নিঃশ্বাসের শব্দ। নাই বা থাকল খুব বেশি বিদ্যে, নাই বা থাকল কথার খুব বেশি বাঁধুনি কিন্তু সরল তো!..খাঁটি তো! বুদ্ধিসম্পন্ন তো! মার্জিতরুচি ভদ্রমেয়ে তো!

তাছাড়া

সুন্দরীও তো।…অনুপম লাবণ্যময়ী..। তা মেয়েদের সৌন্দর্যও একটা গুণ বৈকি! লাবণ্য একটা ডিগ্রী বৈকি!

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *