আলতার দাগ
“এই শুনছো ওঠো ওঠো ।কি করেছো ওঘরে রাতে?কাল সারা রাত ঘুমের ঘোরে কি যে বিড়বিড় করে গেছো-কি হয়েছে গো তোমার”- বলে রিয়া জোরে জোরে হেঁকে ঘুম ভাঙালো রজতের।পাশে হাঁ করে মায়ের কথা শুনছে পাঁচ বছরের তিতলি।
” মা ওঘরে কিসের রক্ত?-মেয়ের কৌতূহলী প্রশ্ন শুনে বললো রিয়া,”না সোনা ওটা রক্ত নয়,আলতা”।”এই তুমি শুনতে পাচ্ছ না,উঠতে বলছি যে “-বলে আবার ঝাঁকুনি দিলো অনেক দেরি করে শুতে আসা স্বামীকে। “কখন থেকে বলছি যে ও ঘরের মেঝেতে কাল আলতা ফেলে কি করেছো?”
আলতা শুনে এবার ধড়ফড় করে উঠে বসলো রজত। জানলার আলোতে হাত দুটো মেলে অদ্ভুত ভাবে দেখে অস্ফুটে বললো,” কি হল এইতো ছিল এখন তো নেই দেখছি”! “আরে কি হয়েছে বলবে তো নাকি, কি যে সব বিড়বিড় করছো !আগে বলো কাল মেঝেতে আলতা ফেলেছো কেন?
চোখ রগড়ে এবার একটু একটু করে সব মনে পড়তেই শিরদাঁড়া সোজা করে নিঃশ্বাস নিলো রজত।রিয়া,তিতলিকে নিয়ে শুয়ে পড়ার পরেও বেশ কিছুক্ষণ নিজের ঘরে কাটায় সে।কখনো লেখালেখি, পেপার পড়ে আবার ক্লান্তিতে কখনো হাই তুলে বালিশে মুখ গুঁজে দেয়। মশার কামড়ে কখনো তিতিবিরক্ত হয়ে উঠে পরে বা ভাবনায় ডুব দেয়।ঘুম চোখে রাতে বাথরুম যায়,ডাইনিংয়ে মালায় সজ্জিত মায়ের ঝুলন্ত ছবির দিকে তাকায় তারপর ঘুমাতে যাওয়া এই তার নিত্য রুটিন। এক বছর হল মা গত হয়েছেন।এই সপ্তাহেই ছিল মায়ের বাৎসরিক কিন্তু এমন লক ডাউন পরিবেশের জন্য পিছিয়ে গেল সকল ক্রিয়াকর্ম।
কাল কিছু একটা লিখছিল রজত।বারোটা কি সাড়ে বারোটা বেজেছে এমন সময় ঘুমটা সাংঘাতিক ভাবে এলো যে একটু শুই বলে বালিশে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেছে। দরজাটা হাওয়ায় কেমন যেন খুলে গেল তারপর আর কিছু মনে নেই! ঘুম ভাঙলো মায়ের ডাকে।রজত বলে উঠলো” হ্যাঁ গো মা কিনে এনেছি বলছি তো। ওই দেখো বারান্দায় বেঞ্চে থলির মধ্যে আলতা টা এনে রেখেছি”। আজ লক্ষীপূজা, মা কদিন থেকেই আলতা কিনে আনতে বলছিল।”হ্যাঁ রে তোর কোনো আক্কেল জ্ঞান নেই, কাঁচের বোতল ওভাবে থলির মধ্যে কেউ রাখে নাকি, তারপর ওই বেঞ্চটার কোনো বাছ বিচার আছে নাকি বলতো,কি যে করিস না তোরা! যেমন তোর বাবা তেমনি তুই !বলে মা থামলো।
প্রতিবার লক্ষীপুজায় মা নিজে ঠাকুর ঘরে লক্ষ্মীর ঘট পাতে, কতক্ষন ধরে কি সুন্দর পাঁচালী পড়ে।একটা লাল পাড় পাটের শাড়িতে কি সুন্দর লাগছে আজ মা কে,রজত হাঁ করে দেখছিল। মা স্নান সেরে সবে উঠেছে,কোঁকড়া স্প্রিং এর মতো চুল বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল বিন্দু চক চক করছে।মা এরপর খুশি হয়ে ঘরের মেঝেতে বসে আলতা পড়তে লাগল আপন মনে । এমন জোরে একটা মশা হুল ফুটিয়ে উড়ে গেল যে উফ করে ঘুম ভাঙলো।সে অবাক হলো দরজা হাট করে খোলা দেখে।ঘড়িতে দেখলো সবে একটা সতের,তবে তো আর একটু সময় জেগে দেড় টা অব্দি বসাই যায় বলে খবর কাগজটা খুললো। হাফ পড়া সম্পাদকীয় কলমটা পড়তেই মাথায় মাখার আর্নিকা তেলের গন্ধ ভেসে এলো নাকে।কিন্তু কে মাখবে এত রাতে মাথায় তেল ?নিচে ভাড়াটিয়ারাও কেউ নেই ,বাড়ি গেছে,নিচে আসে পাশে একদম শুনশান নীরবতা।
রজত খাট থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ালো। এই ঘরের দেওয়াল আলমারিতে তার মায়ের ব্যবহৃত পাউডার,ক্রিম এমনকি কাফ সিরাপ পর্যন্ত সমস্ত কিছু বাবা সাজিয়ে রেখে দিয়েছেন।কাঁচের সাটার সরিয়ে ওগুলোর সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কোণে রাখা আর্নিকা তেলের শিশিটা দেখতে পেয়ে বের করে আনলো।যদিও তেল প্রায় শেষ ,ওই নিচে খুব সামান্যই পড়ে আছে কিন্তু ওখান থেকে গন্ধ আসছে না তো ! ততক্ষণে গন্ধটাও আর ঘরে নেই। একটা নতুন কালো বিড়াল কদিন ধরেই আসছে বাড়িতে আসা শুরু করেছে কিন্তু ওসব ভূত-ভয় কোনোদিনই রজতের লাগে না ।আর কেনই বা লাগবে ভয়,তার মা তার কাছে ছিল ভীষণ ভাবে উৎসাহ অনুপ্রেরণার প্রতীক। শুতে যাবার আগে তাই প্রতিদিন যখন মায়ের ছবিতে প্রণাম করে মায়ের বলা গল্প,কথা গুলো মনে আসে।সারাটা জীবন কত কষ্ট কত সংগ্রামটাই না করেছে এই মহিলা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত শারীরিক কষ্টের সাথে মানসিক টানাপোড়েন চলেছে। খুব ভালোবাসতো সবার খবর রাখতে,সকলের সাথে গল্প করতে। কাউকে নিজের হাতে কিছু যদি দিতে পারতো খুব খুশি হতো কিন্তু সংসার,অসুস্থতা সব সময় আমাদের ইচ্ছা থাকলেও সাধ ও সাধ্যের মধ্যে ফারাক থেকেই যায় তবু মা দমতো না কখনো।
“কই গো, কি ভাবতে বসলে এতক্ষন ধরে ! বললে নাতো ঘরে মেঝেতে আলতা ফেলেছো কেন?এই রে তাইতো দাঁড়াও ব্রাশ করে আসছি বলে রজত বিছানা থেকে নামলো।তিতলি বললো বাবা “কাল হাত গুলো কি এমন করে দেখছিলে সেটাও আমায় বলবে কেমন।”বেসিনের আয়নায় নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখে একটা খুশি খুশি ভাব ফুটে উঠলো রজতের আবার মুহূর্তেই মন ভারাক্রান্ত হলো।খুশি এই কারণেই যে, যখন সে ঘুমিয়ে পড়েছিল মা কপালে চুমু খেয়েছিল। মা যে আর কোনদিন ফিরবে না এটা ভেবেই তার মনখারাপের ঢেউ।ব্রাশ করতে করতে ঘরের মেঝেতে তাকিয়ে অবাক হল, কোথায় আলতা কিছুই তো নেই! তবে কি কাজের মাসি মুছে দিয়েছে নাকি?নিচের কলতলা থেকে মাসি সাড়া দিল,”না না আমি মুছতে গিয়ে কিছু না দেখতে পেয়ে চলে এসেছি “!
তিনতলায় ঠাকুর ঘর থেকে বাবার জোরে জোরে মন্ত্র উচ্চারণ আর ধূপ ধূনোর মিষ্টি গন্ধ আসছিল।যেদিন বাবার মনটা ভালো থাকে সেদিন এভাবে অনেকক্ষণ ধরে পুজো করে।রজত ভেবে খুশি হলো তবে মা নিশ্চয়ই ঠাকুরঘরে পূজা করে আসার ছাপ ,পরিপাটি করে ঠাকুর ঘর রেখে এসেছে । ততক্ষনে রিয়াও রীতিমতো অবাক ,মেঝে একদম পরিষ্কার দেখে।”ও মাসি তোমায় যে বললাম ও উঠুক,দেখাবো, আগেই মুছে দিলে নাকি?” রজত বলল,” না গো না কেউ মোছে নি,ওটা আমাদের মনের ভ্রম ছিল রিয়া,আর জানো কাল রাতে মা এসেছিল । আলতার শিশিটা খোলা ছিল আমি ধরতে যেতেই হাতে দাগ লেগে যায় আর ওটাই মনে হয় কাল স্বপ্ন দেখছিলাম”।তিতলি ততক্ষণে দেখি ঠাকুর ঘরে দাদুর কাছ থেকে একটা জ্বলন্ত ধূপ নিয়ে এসে তার প্রাণের ঠাকুমের ছবিতে দেখাচ্ছে আর জোড়হাত করে প্রণাম করছে। মনে মনে রজতও বলে উঠলো,”মা গো যেখানেই থেকো তুমি ভালো থেকো মা, এভাবেই পাশে থেকো আমাদের”।