Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

১৬.

গ্যারেজে গাড়িটা তুলে দিয়ে সবে তালা লাগিয়েছেন, বাড়ির দিকে এক পা বাড়াবেন, তখনই ওঁর পাঁজর ঘেঁষে এসে থামল একটা মোটর সাইকেল। না দেখেই ওঁর মনে হল : নেপো। দইয়ের হাঁড়িটা ‘মধুসূদন-দাদার’ ভাঁড়ের মতো বারে বারে ভরে ওঠে কি মা দেখতে এসেছে।

ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখলেন, না, নেপো নয়। কালো কোট গায়ে একজন অপরিচিত যুবক। নেপোকে উনি চেনেন না। তার চোখে ছিল গগলস, মাথায় হেলমেট-এরও তাই; কিন্তু দেহদৈর্ঘ্যে এ সেই নেপোর চেয়ে অন্তত ছয় ইঞ্চি লম্বা। ও–আজকাল তো আবার ছয় ইঞ্চি বলা চলবে না–পনের সে. মি. আর কি!

–প্রফেসর তালুকদার?

–ইয়েস?

–প্রফেসর রঞ্জন তালুকদার, পি. আর. এস.?

–হ্যাঁ তাই। আপনি কে?

মোটর-বাইকটা একপাশে সরিয়ে এগিয়ে এল। সসম্ভ্রম নমস্কার করে এবার নিম্নকণ্ঠে বললে, ডিটেকটিভ-সার্জেন্ট প্রণব মজুমদার, স্যার। আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল।

ভিতরের পকেট থেকে ওর আইডেন্টিটি কার্ডটা বার করে দেখায়।

সাবধানী মানুষটি আলোর নিচে ভাল করে দেখে নিলেন। হ্যাঁ, লোকটা পুলিস বিভাগের অফিসার, এতে সন্দেহ নেই।

–আসুন ভিতরে আসুন।

–আপনি আমাকে ‘তুমি’ই বলবেন, স্যার, কিন্তু ঐ পার্কের দিকে গেলে ভাল হতো না? আমি কিছু… মানে… গোপন কথা জানতে চাইব… হয়তো কিছুটা সঙ্কোচের…

তালুকদার হেসে বললেন, আমি পেশায় মাস্টার মানুষ। বয়সেও তোমার ডবল, আমার কাছে আবার তোমার সঙ্কোচ কিসের, মজুমদার?

প্রণব কেশে গলাটা সাফা করে নিল। তারপর বলল ইয়ে… মানে, সঙ্কোচটা আমার তরফে নয়, স্যার….. মানে, আপনার তরফে…. মিসেস্ তালুকদার কি বাড়িতেই আছেন?

–আছেন। তুমি জান না, তাই প্রশ্ন করছ। মিসেস্ তালুকদার আজ আঠাশ বছর শয্যাশায়ী, পার্মানেন্টলি ইভ্যালিড!

প্রণব অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর বললে, আয়াম সরি। আমি জানতাম না স্যার, কিন্তু আপনার ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতানরা কেউ কি এখন বাড়িতে….

ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে তালুকদার স্লান হেসে বলেন, বিবাহের এক বছরের মধ্যেই আমার স্ত্রী পঙ্গু হয়ে যান, প্রণব, সংসারে আর কেউ নেই। এস, ভিতরে এসে বস।

গাড়ি পার্কিং-এর শব্দ পেয়েই রামু এসে দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিল। উনি ডিটেকটিভ সার্জেন্ট প্রণব মজুমদারকে নিয়ে এসে ওঁর স্টাডিতে বসালেন। তার মুখোমুখি বসতে যাবেন তার পূর্বেই রামু ঘোষণা করে, মাইজী বোলাতি হৈঁ!

অগত্যা ফ্যানটা খুলে দিয়ে স্ত্রীর ঘরে চলে আসেন।

শয্যাশায়ী মানুষটির কৌতূহল অফুরন্ত। আর সে কৌতূহল মেটানোর তর সয় না। প্রণতি জিজ্ঞেস করেন, মোটরসাইকেল চেপে কে এল গো?

–ডিটেকটিভ পুলিস-সার্জেন্ট। রামুকে বল, দু’জনের চা-জলখাবার দিয়ে যেতে। আমরা দরজা বন্ধ করে কথা বলব। ও যেন টোকা দেয়।

এ কথাগুলো উনি নিজেই রামুকে বলতে পারেন। সচরাচর বলেন না। প্রণতিকে দিয়ে বলান। অর্থাৎ শুয়ে-শুয়ে যতটা গৃহিণীপনা করা চলে আর কি।

প্রণতি জানতে চান, ডিটেকটিড পুলিস-সার্জেন্ট! ও কেন এসেছে?

–বাঃ! ভুলে গেলে? সেই অসভ্য মাস্তানটা আমাকে টেলিফোনে শাসিয়েছিল, মনে নেই? সেই তার বোন–কী যেন নাম–তাকে পাস করিয়ে দিতে–

প্রণতি বলেন, মালিনী।

–হ্যাঁ, মালিনী। তাই ও এসেছে আমার নিরাপত্তা বিধানে!

–ও আচ্ছা। যাও, আমি রামুকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।

এবার বাইরের ঘরে ফিরে এসে ওর মুখোমুখি বসে বললেন, এবার বল মজুমদার, আমার সঙ্কোচ হবার মতো কী কথা বলতে চাও?

–আপনি কি, স্যার, ‘মেঘচুম্বিত’ অ্যাপার্টমেন্টটা চেনেন?

তালুকদারের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। সংক্ষেপে বলেন, চিনি।

–মাসখানেকের ভেতর ওখানে গেছেন?

একটু ইতস্তত করে স্বীকার করলেন, গেছি।

-–আট তলার বিশ নম্বর ফ্ল্যাটে? মিস্টার সোন্ধীর অ্যাপার্টমেন্টে?

এবার সরাসরি জবাব দিলেন না। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, মজুমদার, ভারতীয় সংবিধানে প্রভিসন্স আছে, পুলিস যদি মনে করে….

–আজ্ঞে, না না, আপনি আমাকে ভুল বুঝেছেন! আমরা কিছু তথ্য সংগ্রহ করছি মাত্র। আপনাকে অভিযুক্ত করার ইচ্ছা আমাদের আদৌ নেই। আচ্ছা …. আমি বরং ব্যাকগ্রাউন্ডটা আপনাকে খুলে বলি। তাহলে আপনার পক্ষে আমাদের সহযোগিতা করা সহজতর হবে। শুনুন…. গতকাল রাত্রে ট্যাংরার একটা বস্তির ঘরে সার্চ করতে গিয়ে আমার সহযোগী পুলিস একটা চাবি-দেওয়া অ্যাটাচি-কেস পায়। সেটা খুলে দেখা যায় তার ভিতর গোনা-গুনতি বাইশটা ম্যানিলা-কাগজের খাম। প্রতিটি খামের উপর এক-একজনের নাম লেখা। নাম আর ঠিকানা, কী কাজ করেন, কর্মস্থলের ঠিকানা আর টেলিফোন নম্বর। নামগুলি, অব্যতিক্রম, পুরুষের। আমরা অনুসন্ধান। করে দেখেছি, অধিকাংশই বয়স্ক, অর্থবান এবং জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত পুরুষের। প্রতিটি খামের ভিতর চার-ছয়টি রঙিন হট-শট ফটোগ্রাফ পোস্টকার্ড সাইজ–এবং সেলোফোনে মোড়া ঐ ছয়টি আলোকচিত্রের নেগেটিভ।

মজুমদার এই পর্যন্ত বলে থামল।

অধ্যাপক তালুকদার অধোবদনে নির্বাক বসে রইলেন।

আবার শুরু করল প্রণব, ছবিগুলি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র নরনারীর। ইন ফ্যাক্ট, সঙ্গমরত নরনারীর। বাইশটি খামে একই রমণী–কিন্তু পুরুষগুলি বিভিন্ন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, খামের উপর যার নাম-ঠিকানা লেখা আছে তারই ছবি। ….ওর একটা খাম, তাতে ছয়টা ফটো আর ছয়টা নেগেটিভ ছিল….

নিতান্ত সৌভাগ্যই বলতে হবে, এই নাটকীয় মুহূর্তে রামু রুদ্ধদ্বারে টোকা দিল। তালুকদার উঠে পড়েন, এক্সকিউজ মি…

তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলে দেন।

রামু দুই প্লেট খাবারের ট্রে ও দু’কাপ চা নামিয়ে দিয়ে যায়।

তালুকদার দরজাটা পুনরায় ভিতর থেকে অর্গলবদ্ধ করে ফিরে এসে বসে পড়েন। বলেন, অপ্রিয় আলোচনাটা বরং খেয়ে নিয়ে হবে।

প্রণব চায়ের কাপটা টেনে নেয়। অনেকে খাবার খেয়ে চা পান করে, অনেকে চা-পানান্তে আহারে মন দেয়। প্রণব দ্বিতীয় দলে।

তালুকদার আবার প্রথম দলে। ফ্রেঞ্চ-টোস্টের পাত্রটা টেনে নিয়ে বলেন, কল্যাণকে চেন? কল্যাণ সেনগুপ্ত, আই. পি. এস.?

–বাঃ। স্যারকে চিনব না? উনি এখন সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টে। দিল্লীতে পোস্টেড। ওঁকে চেনেন বুঝি?

–কল্যাণ আমার ছাত্র ছিল। ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়। তারপর আই. পি. এস.।

আহার এবং চা-পানান্তে আবার সেই অনিবার্য অপ্রিয় প্রসঙ্গ। তবে প্রণব জিনিসটা সহজ করে পরিবেশ করল। পকেট থেকে একটা পোস্টকার্ড-সাইজ রঙিন ফটোগ্রাফ বার করে বললে; দেখুন তো স্যার, এ মেয়েটিকে চেনেন?

হ্যাঁ, মালিনীরই। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ–যদি তিনি থাকেন মেয়েটি বিবস্ত্রা নয়। দেখে নিয়ে প্রফেসার তালুকদার ফেরত দেন, হ্যাঁ, চিনি!

–এই মেয়েটিই মোহজাল বিস্তার করে, টেলিফোনে ডেকে আপনাকে ঐ এইট বাই টোয়েন্টি অ্যাপার্টমেন্টে নিয়ে যায়। তাই নয়?

নতমস্তকে স্বীকার করলেন মাথা নেড়ে।

–কত টাকা দিয়েছিলেন ওকে?

চমকে চোখে-চোখে তাকান। বলেন, টাকা! না, টাকা তো কিছু দিইনি!

–কিন্তু ঐ মেয়েটির সঙ্গে আপনি তো এক বিছানায় শুয়েছিলেন।

তালুকদার নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলেন ওর দিকে।

প্রণব স্পষ্টস্বরে বললে, অস্বীকার করে লাভ নেই, স্যার। একটা খামের উপর আপনার নাম-ঠিকানা লেখা। আর ভিতরে আপনাদের দুজনের ছয়খানা ফটোগ্রাফ। আপনি হয়তো খেয়াল করেননি, মেয়েটির শয়নকক্ষে জোরালো বাতি ছিল। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ আপনাদের দু’জনের ফটো তুলেছিল।

তালুকদার দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন।

–আপনি বলতে চান, ফটোর কথা আপনি আদৌ জানতেন না?

মুখ থেকে হাত সরল না। শিরশ্চালনে জানালেন, উনি তা জানতেন না।

–অর্থাৎ আমার কাছে এইমাত্র জানলেন?

–হ্যাঁ, তাই। আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি সেই শয়তানীটা….

–না স্যার! সে শয়তানী নয়! সেও এক হতভাগিনী। ব্ল্যাকমেলিং-এর শিকার। তারও জীবনে একবার পদস্খলন হয়েছিল। আর বাকি জীবন তারই মাশুল দিয়ে চলেছে।

এতক্ষণে সত্যই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন উনি। আর অভিনয় নয়। মুখ থেকে হাতটা সরে গেল। বললেন, মানে?

প্রণব বুঝিয়ে বলে:

মেয়েটি খানদানী বড় ঘরের। পড়াশুনাতেও দুর্দান্ত। য়ুনিভাসির্টিতে পড়ার সময় পদস্খলন হয়। পদস্খলন ঠিক নয়। অপাত্রে বিশ্বাস করা যদি অপরাধ হয় তবে তাই। ছেলেটা ওকে ফেলে পালিয়ে যায়। ওর পরিবারের ধারণা অপহৃতা মেয়েটি মারা গেছে। বাস্তবে ওর একটি পুত্রসন্তান হয়েছিল : জীবন।

তালুকদার চমকে উঠে বলেন, কী বললে? জীবন? জীবক নয়?

–আজ্ঞে না। কেন? জীবক হতে যাবে কেন?

–কিছু না! আমারই ভুল। তারপর?

–ওর ঐ সন্তানটাই হচ্ছে ঐ মস্তান পার্টির ট্রাম্প কার্ড। মেয়েটি যদি কোনো সময় বেশ্যাবৃত্তি করতে অস্বীকৃত হত, তাহলে ওরা ভয় দেখাতো জীবনকে পঙ্গু করে ভিক্ষাজীবী বানিয়ে মায়ের অপরাধের শোধ নেবে। প্রতি মাসে দূর থেকে জীবিত জীবনকে দেখতে পাওয়াই ছিল ওর জীবনধারণের একমাত্র সান্ত্বনা। অবিবাহিত ছোট বোনদের কথা ভেবে সে আত্মপ্রকাশও করেনি।

–মেয়েটি এখন কোথায়, প্রণব?

–সে মুক্তি পেয়েছে। ছেলেকেও পেয়েছে। নিজের পরিবারে সে ফিরে যেতে চায়নি। সোশাল ওয়েলফেয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে মা-ছেলের একটা রিহ্যাবিলিটেশানের ব্যবস্থা হচ্ছে। দিল্লীতে। মেয়েটি একটা অরফানেজে চাকরি পাবে…

–ঐ মস্তান পার্টি সেখানে আবার গিয়ে…

–না, স্যার! মেয়েটির দুঃস্বপ্নের অবসান হয়েছে। তার সাহায্যে আর ব্ল্যাকমেলিং করা যাবে না। ওর অবৈধ সন্তানটি ঐ অ্যানেজেই থাকবে, মাও ওখানে চাকরি করবে….

তালুকদার অফুটে বললেন, থ্যাঙ্ক গড!

ঈশ্বর আছেন কিনা এ প্রশ্নটা কিন্তু এই মুহূর্তে মনে পড়ল না বিজ্ঞানভিক্ষুর।

আবার কিছুটা নীরবতা। অধ্যাপক তালুকদারই সে নীরবতা ভেঙে বললেন, বিশ্বাস কর প্রণব, কাজটা যে বে-আইনী তা আমি আদৌ জানতাম না।

প্রণব চায়ের কাপটা নামিয়ে রেখে বললে, আপনাকে একটা কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার। আপনি কোনও বে-আইনি কাজ করেননি। ‘প্রস্টিট্যুশান’ এ দেশে ‘ওপেন প্রফেশন’। তাছাড়া আপনি বলছেন, ওকে কোনো টাকাও দেননি। মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে যখন নয়, আর সে যখন প্রাপ্তবয়স্ক ….. এমনকি ঐ ফ্ল্যাটে আপনি অনধিকার প্রবেশও করেননি। মেয়েটির আহ্বানে তারই ফ্ল্যাট মনে করে…

–তাহলে তুমি কী অনুসন্ধান করতে এসেছ আমার কাছে?

–আপনার ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তার বিষয়ে আমাদের, মানে পুলিসের, কোনো কৌতূহলই নেই। কোনো জিজ্ঞাস্যও নেই। আমার বড়কর্তার ধারণা ওরা বাই দ্য ওয়ে, ওরা ছিল দুজন, গুরু আর চেলা–ওরা ঐ মেয়েটির সাহায্যে অর্থবান, বয়স্ক ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষদের ঐ অ্যাপার্টমেন্টে টোপ ফেলে টেনে নিয়ে যেত। তারপর বিশেষ মুহূর্তে পর্দার আড়াল থেকে ফটো তোলা হত। এইভাবে এ পর্যন্ত বাইশজন মানুষকে ওরা কবজা করেছে। তারপর ঐ ফটো দেখিয়ে তাদের ব্ল্যাকমেলিং শুরু হয়ে যেত। এটাই ছিল ঐ গুরু-শিষ্যের ব্যবসা।

গুরু-শিষ্য! নেপো আর মাস্তান। কে গুরু? কে চেলা? তালুকদারের মনে যে এই সব প্রশ্ন জাগছে তা তার মুখ দেখে আদৌ বোঝা গেল না।

তিনি নির্বাক তাকিয়ে রইলেন প্রণবের মুখের দিকে।

–এইবার বলুন স্যার, কী করে মেয়েটির সন্ধান পেলেন?

উনি সংক্ষেপে জানালেন তা। ট্যাক্সির গর্ভে পত্রিকা পাওয়া থেকে টেলিফোনে যোগাযোগ। ট্যাক্সি নিয়ে ‘মেঘচুম্বিত’ অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়া। তারপর অভিজ্ঞতাটা একেবারে সংক্ষেপিত করে বললেন, হঠাৎ দরজায় কলবেল বেজে ওঠায় উনি তাড়াতাড়ি চলে এসেছিলেন, মেয়েটিকে কোনো টাকাকড়ি না দিয়েই।

–তারপর? টেলিফোন কলটা কখন পেলেন?

–না। তারপর মেয়েটি তো আমাকে টেলিফোন করেনি।

–মেয়েটি নয়। আমি মস্তান অ্যান্ড পার্টির কথা বলছি।

–আহ মাস্তান। হ্যাঁ, মাস্তান বলে একজন আমার শালাকে ফোন করেছিল। প্রিন্সিপাল-সাহেবকেও ফোন করেছিল। কিন্তু আমাকে তো করেনি।

–তার মানে আপনার কাছে কেউ কোনো টাকা দাবী করেনি? ঐ ফটো আর নেগেটিভ ফেরত দেবার প্রস্তাব করে?

–না! ফটো যে তোলা হয়েছে, তাই তো জানতাম না আমি।

–আই সী! আমার মনে হয় আপনার দান আসেনি বলেই। বাইশ জন মানুষকে দোহন করছিল তো ওরা? একে একে অগ্রসর হচ্ছিল। আপনার শ্যালক ও প্রিন্সিপ্যালকে বাজিয়ে রেখেছিল। আশা করেছিল, তাঁরা আপনাকে কিছু বলবেন। আপনি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে থাকবেন। সে যাই হোক, আপনি বলছেন যে, আপনার কাছে ব্ল্যাকমেলের প্রস্তাব নিয়ে কেউ আসেনি। তাই তো?

–না, আসেনি। বোধহয় আমার দান আসার আগেই তোমরা ট্যাংরার বস্তিতে রেড করেছ। … একটা কথা, ঐ ছবিগুলোর কী হবে?

–আমি যে মুহূর্তে লালবাজারে রিপোর্ট করব যে, আপনার সঙ্গে এই ব্যাপারে কোনো যোগাযোগ নেই, তখনই ওরা আপনার খামটা পুড়িয়ে ফেলবে। মাননীয় নাগরিকদের বেইজ্জত করার কোনো বাসনা আরক্ষা-বিভাগের নেই।

–কিন্তু তোমরা যখন তদন্ত করে বেড়াচ্ছ, তখন ব্ল্যাকমেলারকে একদিন না একদিন আদালতে তুলবেই। সেদিন কোনো-না-কোনো মাননীয় নাগরিক তো বেইজ্জতের চূড়ান্ত হবেন।

প্রণবের চা-জলখাবার শেষ হয়েছিল। এখন তার একটু ধূমপানের নেশা চেগেছে। বৃদ্ধ অধ্যাপকের সম্মুখে সে সিগারেটটা ধরাতে চায় না। উঠে দাঁড়ায়। বলে, না, স্যার। ঘটনাচক্রে কোনো মাননীয় নাগরিকই এই বিশেষ ক্ষেত্রে বেইজ্জত হবেন না। আমরা কোনো আদালতে এভিডেন্স হিসাবে ঐ বাইশজনের কোনো ফটোগ্রাফই দাখিল করব না।

–তাহলে ঐ ব্ল্যাকমেলারদের কনভিকশন হবে না? শাস্তি হবে না?

একগাল হেসে প্রণব মজুমদার বললে, ওর কনভিকশন হয়ে গেছে, স্যার। ওর একার নয়, দুজনেরই।–গুরু আর চ্যালার। ডেথ পেনালটি।

তালুকদার অবাক হয়ে বললেন, ডেথ পেনাল্টি! হাইকোর্টে?

–না স্যার। হায়ার কোর্টে!-–উপরের ঘূর্ণমান সিলিং ফ্যানটার দিকে আঙুল তুলে দেখায়।

প্রফেসর সেদিকে একবার তাকিয়ে দেখলেন। বোঁ-বোঁ করে ফ্যানটা ঘুরছে।

বললেন, তার মানে?

–তার মানে, আমি এখানে কোন ব্ল্যাকমেলিং-এর চার্জের জন্য এনকোয়ারি করতে আসিনি, স্যার। চার্জটা ব্ল্যাকমেলিং নয়।

–তাহলে?

–মার্ডার! খুন!

প্রফেসার তালুকদার এক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধবিস্ময়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর যেন কণ্ঠস্বর ফিরে পান। বলেন, মার্ডার! তার মানে ঐ অ্যান্টিসোশাল গুন্ডা দুটো কাউকে খুন করেছে?

–আজ্ঞে না। ঐ গুরু-শিষ্য দুজনেই খুন হয়ে গেছে।

–গুড হেভেন্স। কী ভাবে? গুলিতে? রিভলভারের?

–এবারেও আপনার অনুমানে ভুল হল, স্যার! এত ভুল তো সচরাচর আপনি করেন না, স্যার?

প্রফেসর তালুকদার গম্ভীর হয়ে যান। সামলে নিয়ে বলেন, তবে কীভাবে?

–বলছি। কোনো একজন ‘এ-ওয়ান’ ধুরন্ধর ওস্তাদের শেষরাত্রের প্যাঁচে। তিনি ঐ মস্তানের দাবী মেনে নেন। ব্ল্যাকমেলিঙের টাকাটা মিটিয়ে দেন একটা মজবুত কালো রঙের স্টীলের ক্যাশবাক্সে। ওরা গুরু-শিষ্য কেউ কাউকে বিশ্বাস করত না। দুজনেরই আশঙ্কা ছিল যে, পার্টনার-ইন-ক্রাইম ডবল-ক্রশ করবে। তাই ক্যাশবাক্সটা খোলার সময় দুজনেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল দশ বিশ টাকার নোটের বান্ডিল গুনতি করতে। চাবিটা সেলোটেপ দিয়ে বাক্সের গায়েই আটকানো ছিল। চাবি লাগিয়ে পাল্লাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণ হয়। টালিঘরের আধখানা ছাদ উড়ে যায়। গুরু আর চেলার দেহ শতচ্ছিন্ন। কোনটা কার হাত, আর কোনটা কার পা, তা জিগ্‌স পাজল-এর মতো পুলিসকে মেলাতে হয়েছে। শিষ্যকে সনাক্ত করা গিয়েছে তার একটি টিপিক্যাল টম্যাটো রঙের স্পোর্টস্ গেঞ্জি দেখে, আর গুরুর মাথায় হেলমেট পরা ছিল বলে তার মুণ্ডুটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়নি। দুজনের নামেই একাধিক পুলিস কেস ছিল। সনাক্ত করার কোনও অসুবিধা হয়নি।

মরা পাবদা মাছের মতো নিষ্পলক দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন অধ্যাপক তালুকদার। মুখটা হাঁ।

ডিটেকটিভ-সার্জেন্ট বুঝিয়ে বলে, আসলে বাক্সটা ছিল একটা বুবি-ট্র্যাপ। ইঁদুর মারা কলের স্প্রিং-এর স্টোর-করা স্ট্যাটিক এনার্জি পাল্লা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কাইন্যাটিক এনার্জিতে রূপান্তরিত হয়ে ড্রাই সেল ব্যাটারির ফিউজ দুটিকে জুড়ে দেয়। ইলেকট্রিক স্পার্ক দেয়। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।

তালুকদার জিব দিয়ে ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে বলেন, য়ু মীন বোমা? বোমা বিস্ফোরণ? ক্যাশবাক্সে বোমা এল কোথা থেকে?

প্রণব হাসতে হাসতে বললে, বোমা-পেটো আজকাল রাম-শ্যাম-যদুও বানায়, স্যার। পাড়ায় পাড়ায়–

–তা বটে!

–কিন্তু এটা কোন রাম-শ্যাম-যদুর হাতের কাজ নয়।

তালুকদার ইতস্তত করে বললেন, এ কথা কেন বলছ?

–কারণ এটাতে ছিল ‘মাস্টার টাচ’! কে বানিয়েছেন তা নিয়ে আপনি কোন চিন্তা করবেন না, স্যার! তিনি ধরণীর পাপের ভার কিছুটা লাঘব করেছেন। তিনি আমাদের নমস্য…..

তালুকদার ক্ষীণ প্রতিবাদ না করে পারেন না, না, না, তা বললে কি চলে? সবাই যদি এভাবে আইন নিজের হাতে নেয়….

প্রণব হেলমেটটা বগলদাবা করে উঠে দাঁড়িয়েছিল। এ-কথায় একগাল হেসে বলে, না, স্যার! সবাই তা পারে না। এক্সপ্লোসিভে বিশেষ ট্রেনিং নিয়েছি বলেই আমাকে এই তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে। একোয়ারি করে আমি যা বুঝেছি তা আমি আমার রিপোর্টে লিখতে পারব না। তবে আপনি পণ্ডিত মানুষ, আপনাকে চুপি চুপি জানিয়ে যেতে পারি–আপনি বুঝবেন!

তালুকদার কোনও কৌতূহল দেখালেন না। তা সত্ত্বেও প্রণব একই নিশ্বাসে বলে গেল, আমি নিশ্চিত, ঐ বুবি-ট্রাপটা যিনি বানিয়েছেন তিনি কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, এবং উদ্ভাবনী প্রতিভায় অদ্বিতীয়! হি ইজ আ জিনিয়াস।

তালুকদারের কণ্ঠনালী শুকিয়ে ওঠে।

প্রণব বলে চলে, তবে আপনার ও কথাটাও খাঁটি! হান্ড্রেড পার্সেন্ট কারেক্ট। আইন কেউ নিজে হাতে নিতে পারে না। আমরা তা অ্যালাও করতে পারি না। আপনিও বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন, স্যার, আমরা শেষ পর্যন্ত তদন্ত করে দেখব। এক-এক করে ঐ একুশ জনকেই….

–একুশ?

–নয়? আজ আপনার বারে বারে এমন ভুল হচ্ছে কেন, স্যার? এখন তো একুশই বাকি থাকল। আপনি তো ব্ল্যাকমেলিঙের শিকার হননি আদৌ। ফটোগুলোর অস্তিত্বই জানতেন না। দেয়ারফোর বাইশ মাইনাস এক, ইজুক্যালটু একুশ। আচ্ছা চলি, স্যার। তবে যাওয়ার আগে আপনার পায়ের ধুলো একটু নিয়ে যাব।

অধ্যাপক তালুকদার অনুমতি দিতে পারলেন না।

আপত্তি করতেও পারলেন না।

প্রস্তর মূর্তির মতো শুধু দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রণব নিচু হয়ে ওঁর পদধূলি নিল। হেলমেটটা মাথায় চড়ালো। তারপর নির্গমন দ্বারের দিকে একপা এগিয়ে আবার হঠাৎ থমকে থেমে পড়ে।

আবার পিছন ফেরে।

অধ্যাপক তালুকদার অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তিনি বুঝতে পেরেছেন, ঐ প্রণব মজুমদার কোন ‘এনডেঞ্জার্ড স্পেসিস্’-এর দুর্লভ একটি উদাহরণ। ঐ যে মুষ্টিমেয় কিছু পুলিস অফিসার আজও টিকে আছে, যাদের জন্যে এই সর্বব্যাপী দুর্নীতির মধ্যেও মানুষ বেঁচে আছে, শান্তি-শৃঙ্খলার কিছুটা আজও বজায় আছে। পার্টি-ইন-পাওয়ারের প্রতিবন্ধকতার প্রভাবে গুণ্ডা-মস্তান দমন করতে পারে না বলে যারা নিজের নিজের হাত কামড়ায়। প্রণব সেই ‘দুর্লভ-প্রাণী’র একটি দৃষ্টান্ত!

প্রণব বলে, একটা কথা বলতে ভুলেই যাচ্ছিলাম। আপনি আমার একটা উপকার করবেন, স্যার?

অধ্যাপক তালুকদার দুরু দুরু বুকে বলেন, বলো?

–আমি চলে গেলে ডক্টর সেনের বাড়িতে একটা টেলিফোন করবেন, স্যার! ডঃ অপরেশ সেন। তাঁর মেয়ে আজ নিয়ে পাঁচ দিন অনশনে আছে। কেউ তাকে কিছু মুখে দেওয়াতে পারেনি…

–শুনেছি! কিন্তু আমার কথাই বা সে শুনবে কেন?

–শুনবে! কারণ আপনি যে তাকে ঐ সঙ্গে আরও একটা খবর জানিয়ে দেবেন : শ্ৰীযুক্ত লালমোহন বিশ্বাস মশাই দেহ রেখেছেন।

তালুকদার-সাহেব চমকে ওঠেন, কী বললে! লালমোহন বিশ্বাস?

–আজ্ঞে না। তা তো বলিনি আমি–

–তবে কার কথা বলছ? কে মারা গেছেন?

–শ্রীযুক্ত লালমোহন বিশ্বাস ‘মশাই’! পার্টির সম্মানিত কর্মী ছিলেন তো!

তালুকদার বুঝতে পারেন প্রণব অতি ধুরন্ধর গোয়েন্দা। রুদ্ধদ্বার কক্ষে তিনি মহিম হালদারকে কী ভাষায় কথা বলেছেন তা পর্যন্ত জানে।

উনি জানতে চান, লালমোহন বিশ্বাস মশাই হঠাৎ কীভাবে দেহ রাখলেন, প্রণব?

–সে কথাই তো এতক্ষণ আমরা আলোচনা করছিলাম, স্যার। বোমা বিস্ফোরণে। বুবি-ট্র্যাপের খপ্পরে পড়ে।

এমন একটা সন্দেহ ওঁর নিজেরও হয়েছিল। এতক্ষণে নিঃসন্দেহ হলেন। বলেন, কিন্তু এ খবরটা তো কৃষ্ণাকে যে কেউ জানাতে পারে। পারে না?

–বাস্তবতার বিচারে পারে, নৈতিকতার অগ্রাধিকারে পারে না। সে অধিকার যে নিজ শৌর্যে অর্জন করেছেন আপনি। কী করে অমন অগ্রাধিকার আপনার হল, তা আমার কাছে জানতে চাইবেন না, স্যার! সে কথা আমরা আলোচনা করতে পারি না। প্রফেশনাল এথিক্সে বারণ।

হেলমেট নাড়িয়ে আবার একটি ‘বাও’ করে প্রণব বেরিয়ে যায় অন্ধকারে।

.

প্রায় এক মাস পরের কথা।

দেবু আর কৃষ্ণা ইতিমধ্যে একদিন এসে ওঁকে যুগলে প্রণাম করে গেছে। দুজনেই এখন হাঁটা-চলা করতে পারছে।

হঠাৎ একদিন দিল্লী থেকে ডাকে একটা চিঠি পেলেন। মাদার টেরিজার স্নেহধন্য একটি অনাথ আশ্রমের মহিলা সেক্রেটারির ইংরেজিতে ছাপানো আবেদনপত্র। ওঁর প্রতিষ্ঠানে পিতৃপরিচয়হীন হতভাগ্যদের মানুষ করার, মনুষ্যত্বের দাবী মিটিয়ে দেবার চেষ্টা হয়।

ছাপানো আবেদনপত্রটা কিন্তু বুক-পোস্টে আসেনি।

এসেছে মুখবন্ধ খামে। তাই পুরো ডাকটিকিট লেগেছে।

ইংরেজি আবেদনপত্রের তলায় সাদা বাঙলায় গোটা গোটা হরফে কে যেন লিখেছে :

“প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি…”

প্রফেসর তালুকদার প্রায়শ্চিত্তের সুযোগ পেলেন।

প্রায়শ্চিত্ত? না পাপ তিনি কিছু করেননি। প্রণব মজুমদারের ভাষায় ধরণীর পাপের ভার কিছুটা লাঘব করেছেন মাত্র। কবি সাহিত্যিক হিসাবে সমাজের প্রতি যা তাঁর প্রতিশ্রুতি :

“দু একটি কাঁটা করি দিব দূর
তার পরে ছুটি নিব।”

বরং বলা উচিত উপযুক্ত পাত্রে করুণা প্রদর্শনের একটা সুযোগ পেলেন মাতা আম্রপালীর উদাত্ত পুকারে।

দেরাজ খুলে চেক বইটা বার করে আনলেন উনি।

পঁচিশ হাজার টাকার একটা চেক লিখতে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16
Pages ( 16 of 16 ): « পূর্ববর্তী1 ... 1415 16

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *