১
ও ভাই বঙ্গবাসী, আমি মর্লে,
তোমারা আমার চিতায় দিবে মঠ !
আজ যে আমি উপাস করি,
না খেয়ে শুকায়ে মরি,
হাহাকারে দিবানিশি
ক্ষুধায় করি ছট্ ফট্ |
সে দিকেতে নাইক’ দৃষ্টি,
কেবল তোমাদের কথা মিষ্টি,
নির্জলা এ স্নেহ-বৃষ্টি,
শিল পড়িছে পট্ পট্ |
ও ভাই বঙ্গবাসী, আমি মর্লে,
তোমারা আমার চিতায় দিবে মঠ !
২
দুধটুকু নাই নারীর বুকে,
মাড়টুকু নাই দিতে মুখে,
ক্ষুধায় কাতর শিশু ছেলে
ধুলায় লুটে চট্ পট্ !
শুষ্কচোখ কণ্ঠতল,
এক বিন্দু নাইক জল,
লোল-রসনা, ভাম-লোচনা,
চাহিছে নারী কট্ মট্ !
শতছিন্ন বসন গায়ে,
শত চক্ষে লজ্জা চায়,
এমনি দৈন্য এমনি দুঃখ,
যোটে মোটে ছালার চট্ !
নীলগিরি নাহি সে খোপা
শুকনা মরা বিন্না ছোপা,
তৈল বিনা রুক্ষ কেশ
অযতনে শিবের জট্ !
শুষ্ক জীর্ণ শ্মশানকালী
সারিন্দার খোল পেটটি খালি,
আকাল ভারে বাঁচান দেহ
কাঁকাল-ভাঙ্গা কটিতট্ !
আমি মর্লে,
তোমারা আমার চিতায় দিবে মঠ,
ও ভাই বঙ্গবাসী, !
৩
পাখীও ত গাছের ডালে,
আপন বাসায় শাবক পালে
আমার নাই সে আশা, নাই সে বাসা,
কেমন বিপদ, কি সংকট |
আমি থাকি পরের বাড়ী,
নিয়ে ছেলেপপুলে নারী,
নাই যে ডালা কুলা হাড়ী,
বাপ-দাদার সে ভাঙা ঘট্ !
ও ভাই বঙ্গবাসী, আমি মর্লে,
তোমারা আমার চিতায় দিবে মঠ !
৪
আমি আজ
স্বদেশ-চ্যুত বিদেশবাসী
পরদেশ পর-প্রত্যাশী,
না জানিয়া মর্লেম আমি,
ব্যাস-কাশী — এ পদ্মার-তট্ !
দেখিনি এমন দারুন জা’গা,
লক্ষ্মীছাড়া হতভাগা
তিন পয়সা এক বেতের আগা,—
কি মহার্ঘ, কি দুর্ঘট !
আমি মর্লে, তোমারা আমার চিতায়
দিবে মঠ !
৫
হেথা ছলনা বঞ্চনা খালি,
কে কার ভোগে দেবে বালি |
এ কিষ্কিন্ধ্যায় সবাই “বালী”
আত্মম্ভরী মর্কট !
জানেনা এরা সত্য বাক্য,
ব্যবসা এদের মিথ্যা সাক্ষ্য,
চোর গেরস্থ দু’জনারি পক্ষ,
উভচর সব কর্কট !
এরা, শিকড়ে শিকড়ে বাঁশি বাঁধা,
সকল কলার এক ছড়া—কাঁধা,
এদের, অসাধ্য নাই,—স্বার্থে আঁধা,
আকাশে “ব” নামায় বট,
কুক্ষণে হেথা আসিয়াছি,
এখন, পালাতে পার্লে প্রাণে বাঁচি |
এরা জন্তুর চেয়ে অধম পশু
আত্মগুপ্ত কূর্ম কর্মঠ !
আমি মর্লে, তোমারা আমার চিতায় দিবে মঠ !
৬
কথার বন্ধু অনেক আছে,
কথায় তুলে দিবে গাছে,
বিপদ কালে পাইনে কাছে
কেমন স্নেহ অকপট,
অভাব দুঃখ শুনলে পরে,
পাছে কিছু চাইব ডরে,
স্বভাব-দোষে স’রে পড়ে
চোরের মত দেয় চম্পট !
কত বন্ধু দেশের নেতা,
মূখবন্ধ স্বাধীন-চেতা,
কাজের বেলায় আরেক কেতা
হৃদয় ভরা ঘোর কপট,
লেখক মেরে অনাহারে,
লুঠবে টাকা উপহারে,
সাহিত্যের যে কসাই বন্ধু
বিষম ধূর্ত, বিষম শঠ |
আমি মর্লে, তোমারা আমার চিতায় দিবে মঠ !
ও ভাই বঙ্গবাসী !
৭
যা হোক, আমি শত ধন্য,
কৃতজ্ঞ কৃতার্থমন্য
তোমাদের এ স্নেহের জন্য
আজ তোমাদের সন্নিকট |
চিতায় মঠ বা দিবে কেহ,
গড়বে “স্ট্যাচু” অর্ধ-দেহ’,
ছায়া-চিত্র রাখবে কেহ
কেউ বা তৈল চিত্রপট !
করবে তোমারা শোক-সভা,
চোখে চসমা স্বেতজবা,
ওষ্ঠে চুরুট ধূম্রপ্রভা,
করতালি চট্ পট্,
স্বর্গ কিম্বা নরক হ’তে,
আসব তখন আকাশ-পথে,
দেখতে আমার শোকসভা,
সঙ্গে নিয়ে অলকট !
সত্যই কি লজ্জা শরম
বাঙালীরে করেছে বয়কট্ ?