Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আবেশ || Bani Basu

আবেশ || Bani Basu

বাঁড়জ্যেদের বাড়ির অলকার উপর তারা-মার ভর হয়েছে শুনেছ গো?–ও শান্তি!

শান্তি সারাদিনের কাজকর্ম সেরে একটু দুপুর-ঘুমের জোগাড় করছিল। তার স্বামী পোস্টঅফিসে কাজ করে, ছেলে সেক্রেটারিয়েটে কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে। নিশ্চিন্দির চাকরি। খেয়েদেয়ে স্বামী দুটি পান, ছেলে চারটি সুপারি-কুচি মুখে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ছোটো ছেলে তারও পরে। তারপর শান্তির কাজ শুরু। একটা না কি? আড়াইটে নাগাদ সে একটু নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পায়। পাশের বাড়ির গীতাদি বারান্দা থেকে বুক অব্দি ঝুঁকিয়ে ডেকে যাচ্ছে তো ডেকেই যাচ্ছে।

কে অলকা?—ধড়মড় করে সে উঠে বসে। বারান্দা নেই, জানলায় দাঁড়ায় শান্তি।

অলি গো, অলি, আমাদের ঠাকুরবাড়ির অলি।

তাই বলো, অলকা বললে বুঝব কী করে? ওর বিয়ের জন্যে পাত্তর দেখা চলছে না?

সে তো কবে থেকেই চলছে। রূপের ধুচুনি মেয়ে। তার উপরে বিএ এমএ পাস দিয়ে বসে আছে। বিয়ে কি সোজা?

তা গীতাদি, রূপের ধুচুনি পাত্তরও তো চারিদিকে কিছু কম দেখছি না। তোমার আমার ছেলের কথা বাদ দাও। নিজের ছেলে কেউ কুচ্ছিত দেখে না। কিন্তু আমাদের বরেরাই বা কী নবকার্তিক ছিল গো? তা-ও তো তোমার মতো চোখোলো মুখোলো মেয়ে জুটেছে। আমার যে অন্তত রংটা আছে এটুকু তো স্বীকার করবে? কেউই মুকখু নই।

তা যদি বললি—ব্যাটাছেলের রূপ আর কে দেখতে যাচ্ছে।

তাহলে গুণ দেখুক। কোনোমতে রোজগার। দুটি মাছ-ভাত। কোনোমতে বছরের কাপড়চোপড়, ছেলে চাকরিতে ঢুকে গেল এতদিনেও একখানা গয়নার মুখ দেখলুম না তা যদি বলো? ছেলের বউ এলে ওই ঘরের সোনা-ই হাতে ধরে তুলে দিতে হবে ভেবে আমার এখন থেকেই বুক কাঁপছে ভাই। গতর ক্ষয়ে গেল। বাসন মাজা, ঘর পোঁছার একটা লোক আছে এই পর্যন্ত। রান্না করো, কাপড় কাচো, ইস্ত্রি করো, সাধের রকম রকম জলখাবার করে দাও, বোতাম বসাও, শার্টের কলার উলটে দাও। নিজের ব্লাউজ-সায়া, এদের পাজামা-লুঙ্গি নিজে হাতে সেলাই করো। এসো জন বসো জন—যেটুকু বজায় আছে দিদি আমার জন্যেই আছে। নিজে না খেয়েও কিছু না কিছু জমাই। ছোটো ছেলেটার আবার যেমন দামালপনা, তেমন বায়না, কে হ্যাপা পোয়ায় গো? এই আমিই তো!

গীতাদির ছেলে এখনও হায়ার পড়াশোনা করছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। স্বামী স্কুলমাস্টার। উদরাস্ত কোচিং আর কোচিং। গীতাদির সিচুয়েশনও কিছু উত্তম নয়। ছেলে যে কত হাজার রকমের ট্রেনিং নিচ্ছে। ইয়া ইয়া টাকার ছোড়া বেরিয়ে যাচ্ছে। সাধের গয়না মেয়ের বিয়েতে তো সবই প্রায় গেছে। এখন ছেলের ট্রেনিং এর জন্যে স্বামী মুখে রক্ত তুলে খাটছেন, বাকিটুকুতে হাত দেওয়া কারো মনোমতো নয়। এই যা। ছেলেটার একটা কিছু হয়ে গেলে বাঁচা যায়। আরও একটি গুপ্ত ভয় তার আছে ছেলেকে নিয়ে। সেটা শান্তি জানে না। গীতাদি বললেন, যাবি নাকি?

কী করতে?

তারা-মার ভর সোজা কথা নয় শান্তি। গিয়ে দেখতে ক্ষতি কী?

রোজ হচ্ছে?

আমাদের যমুনা বলছিল, শনি-মঙ্গলবারে হয়। প্রথম প্রথম নাকি রোজ হত। এখন শনি-মঙ্গলে এসে ঠেকেছে আজ তো শুকুর হল। কাল যাওয়া যায়। যদিও আমার তর সইছে না।

তাহলে কাল বিকেলে গা-ধয়ে, এদের একটু বলে কয়ে রাখতে হবে। কতক্ষণে ছাড়া পাব তো জানি না! রুনিটাকে নিয়েই ভাবনা। সন্ধেবেলা অবিশ্যি কোচিনে যাবে। তবু…।

ও সব ম্যানেজ করো, কাল যাবই।গীতাদির ইচ্ছে ছেলে নিয়ে দুশ্চিন্তার গুপ্ত কথাটি তারা-মাকে পেশ করে।

পালপুকুর নাম হতে পারে। কিন্তু ঠিক গাঁ-গঞ্জ নয়। বিটি রোড ধরে যেতে যেতে যেতে যেতে যখন ভাবছ এ আর আসবে না, ঠিক তখনই এসে যাবে স্টপ। সামনে দিয়ে রেললাইন গেছে। সেই লেভেল ক্রসিং পার হলেই দেখবে দু-দিকে উপছে পড়ছে বাজার। আলু, পটোল, কুমড়ো, লাউ, পেঁপে, চিচিঙ্গে, ঢ্যাঁড়স সারি দিয়ে তো আছেই। ঘ্যাঁস ঘাঁস বড়ো বড়ো অন্ধে পোনা কাটছে মেছোরা, ঘ্যাঁস ঘ্যাঁস মুরগির গলা কাটছে মুরগিঅলা, সরু একচিলতে দোকানে রোগা ছাল ছাড়ানো পাঁঠাও ঝুলছে। খাও কোনটা খাবে। জিলিপি ভাজছে গরম গরম, কচুরি ভাজার কটু গন্ধ উঠছে বাতাসে। বাজে ডালডা আর কেরোসিনের ঝাঁঝ। তার পাশে মস্ত মুদির দোকান। ডাল, মশলা থেকে বড়ি, পাঁপড়, আমসত্ত্ব, খেজুর, খোবানি কিছুই বাদ নেই। আর একটিমাত্রই ল্যান্ডমার্ক। একটি ফোটো স্টুডিয়ো। কাচের মধ্যে বাহার দেওয়া উত্তম-সুচিত্রার ছবি, প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণার ছবি, কে নেই? সববাই এখানে ওই পালপাড়ার ম্যাজিকল্যান্ড স্টুডিয়োয় এসে ফোটো তুলিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও ফ্রক ছড়িয়ে কুঁজো হয়ে বসে ফোকলা দাঁতে বাচ্চা মেয়েটি হাসছে। থামে হাত দিয়ে স্টাইল মেরে শাড়ি পরা লোকাল সুন্দরীর ছবি, বিয়ের জন্য তুলতে আসা ছবির সার। ম্যাজিকল্যান্ড-এর তলায় ব্র্যাকেটে লেখাও আছে—এক ছবিতেই বিয়ে। বাস, আর কোনো ল্যান্ডমার্ক নেই। ডাইনে, বাঁয়ে সরু সরু গলি—তার ভিতরে ঢুকে আবার ডাইনে, বাঁয়ে সরু সরু গলি। এর ভেতর থেকেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় গুণে গেঁথে যে গলি চাইছ খুঁজে বার করতে পারলে তো পারলে। গুনতে ভুল হলে নিশি পাওয়ার মতো ঘোরো মাঝদুপুরে, কেউ দেখতে আসবে না খাঁ খাঁ গা-জ্বালানি রোদে।

জমির দাম সস্তা ছিল। খুব একটা বসতও গড়ে ওঠেনি। তাই এদিকে আসা। সস্তা হবে। শুনতেই বারো নম্বর রেলগেট পেরিয়ে। এক বাসে তুমি রবীন্দ্রভারতী ইউনিভার্সিটি, স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট পৌঁছোতে পার। পালপুকুর উত্তর চব্বিশ পরগনা, সড়কপথে, রেলপথে ঋদ্ধ। কোনো অসুবিধা নেই। কাছে-পিঠে কলকারখানা নেই, গাড়ি-ট্রাকের ধোঁয়া নেই। বাজারের এলোমেলো নোংরামিটুকু ছাড়িয়ে ডাইনে, বাঁয়ে ঘুরে যেতে পারলে নতুন বাড়ির গন্ধ, পুরোনো বাড়ির ভরসা, খোলামেলা মাঠে এবং নিষ্কলুষ আকাশ দেখতেই পারো। তবে কিনা— পপুলেশনে জেরবার এই দেশের আপামর সাধারণের নজর বড়ো নীচু, বা বলা ভালো সরু হয়ে গেছে। জমি যখন রয়েছে, বসত যখন নতুন হচ্ছে তখন রাস্তা কেন পাশাপাশি দুটো ছোটো গাড়ি পাস করার মতোও হবে না—এ প্রশ্নের জবাব নেই। কারা জমি বিক্রি করে, কারা বিল্ড করে কর্পোরেশন কতটা জমি রাস্তায় জন্যে হিসেবে রেখেছে সে অঙ্ক কবার দরকার নেই আমাদের। আমরা দেখব আমার রিকশায় উলটোদিকের রিকশার চাকা বেধে গিয়ে বিভ্রাট হল। দেখে গালাগালি দেব। গাড়িতে গেলে ওপাশ থেকে গাড়ি আসছে দেখে ও ড্রাইভারের হাত নাড়ুনিতে আমি পেছোব না আমার ড্রাইভারের খিচুনিতে ও পেছোবে, সেটা পরিস্থিতিই বলতে পারবে। বাড়িগুলি একটু উঁচু করে তৈরি করা ঠিকই। তিন চার ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উঠতে হয়, কিন্তু সিলিং সেই নীচু। হাইরাইজের ফ্ল্যাট বাড়িতে যেমনটা হয়। ওই যে নীচু নজর! দোতলার বারান্দা লম্বা মানুষ হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবে।

পালপুকুরের পালপাড়ার এই চেরা চেরা অলিগলির গোলকধাঁধা পেরোতে পেরোতে শেষকালে গা ঠেকে যাবে যে কুঠিতে সেটিই অলকার বাপ-ঠাকুরদার ভিটে তারাকুঠি। শ্রী দেবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, তস্য পুত্র তারাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধিকারে এখন। এর পরেই পালপুকুর এবং তার সামনে বিরাট মাঠ। পুকুরটি বাঁড়জ্যেদের, এখনও প্রোমোটারের নজর পড়েনি। সামনের মাঠ কার কে জানে। তবে বার্ষিক শারদ দুর্গাপুজো, শ্ৰীশ্ৰীকালীপুজো, বাণীবন্দনা, রবীন্দ্রজয়ন্তী…আদি উৎসব এখানেই হয়। পালপুকুর বন্ধুসংঘ, পালপুকুর পিপলস ক্লাব দুটিই মাঠের উপর শ্যেনদৃষ্টি রেখেছে, এলাকার কেউ কেউ জানে, সবাই জানে না। ছেলেপিলেরা এখানে একটু খেলাধুলো করতে পায়, এতেই সব খুশি আছে। বর্ষাকালে ঘাসে-আগাছায় ভরে যায়, খেলাধুলো হতে হতে টাক-পড়া মাথায় মাঝে মাঝে খামচা খামচা চুলের মতো ঘাসপাতা গজিয়ে থাকে।

এই তারাকুঠির বাড়িটির দিকেই মঙ্গলবার ভোর থেকে দলে দলে লোক চলেছে। বহুদূর ছড়িয়ে গেছে তারা-মার খ্যাতি। মাঠটি ভরো-ভরো। এইরকম শনিবারও। অন্য কোনো দিনে কিন্তু সব শুনসান। ছিমছাম মেয়েটি বাঁডজ্যে বাড়ির চাতাল পেরিয়ে সিঁড়ির ধাপে এসে পা দেয়। পায়ের বাসি আলতার ছাপ সে সাবান ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি। কালো মেয়ে, ছিপছিপে, একটু বেশি লম্বাই বোধহয়। একসময়ে পাত্রপক্ষ বলত–তাল-ঢ্যাঙা। যা ভালোবাসার লোকের কাছে শ্যামা ছিপছিপে বা তন্বী শ্যামা তাই পাত্রপক্ষের কাছে তাল-ঢ্যাঙা রক্ষাকালী প্রতিভাত হয়। রূপের খানিকটা তো নজরের উপর নির্ভর করেই। মেয়ের মুখটি রোগা, লম্বা, হনু জাগা ছিল-পাত্রপক্ষের ভাষায় ঘোড়ামুখো। তবে এখন শাঁসে-জলে খানিকটা ভয়ে ভরাট লম্বাটে আদল এসেছে। কপাল বড়ো, ঘন ভুরু, চোখ লম্বা, সরু, মণি বাদামি, নাক টিকোলো, হাঁ মুখটি বড়ো। ছড়ানো ঠোঁট। সবচেয়ে খারাপ ছিল বোধহয় দাঁত, সামনের দাঁতগুলি বড়ো বড়ো, এবড়োখেবড়ো। আজকালের সম্পন্ন সচেতন বাড়ির বাবা-মা ছোটোতেই এমন দাঁত ঠিকঠাক করিয়ে দেন। টলস্টয় বলেছিলেন, হাসলে যাকে ভালো দেখায় না সে মেয়ে দুর্লভ, তবে যদি নিতান্তই মেলে, সে-ই প্রকৃত কুৎসিত। এ মেয়েটি সেদিক থেকে প্রকৃতই কুৎসিত। তবে সে হাসতই না। ছোটো থেকে নিজের চওড়া কপাল, বড়ো হাঁ আর অসমান দাঁতের অসুন্দর হাসি সে লক্ষ করেছিল, তাই মুখ খুলে হাসতই না। এখন হাসে। খারাপ তো দেখায় না। সবচেয়ে যা ভালো তা হল চুল। অনেক চুল মেয়েটির। এখন শ্যাম্পু করে কীসব মেখে ফুলো চুল বাগে এনেছে। হলুদ শাড়ি পরা কেশবতী মেয়েটিকে পিছন থেকে দেখলে রূপবতীই মালুম হয়। পিছনের লোক সামনে এসে নির্লজ্জের মতো মুখ দেখে তারপর নির্লজ্জতরের মতো মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে যাই হোক, যারা অলকাকে আগে দেখেছে তারা আকাশ-পাতাল তফাত দেখে। এই মেয়েটির চিকন কালোয় হলুদ, কমলা শাড়ির আভা লেগেছে। চোখদুটির চাউনি গভীর রহস্যে স্থির। মুখে চাপা হাসি। মুখমণ্ডলে প্রসন্ন বিভা। অনেকেরই চেয়ে চেয়ে আঁখি না ফিরে। কেননা তারা দেবী না হোক দেবীর আধার দেখে। আর যারা নিতান্তই কামিনী রমণী দেখতে চায়, না জেনে না শুনে, তাদের পিছন থেকে দেখার প্রত্যাশাটা সম্মুখ দর্শনে পূর্ণ যদি না হয় তো কার কী করার আছে? অলকার? বয়েই গেল। এখন।

তখন? তখন বয়ে যেত না। বড়ো লজ্জা, বড়ো অপমান। গোঁড়া বাড়ি। ঠাকুরদা দেবপ্রসাদ ছিলেন তারা-মার ভক্ত। শেষদিকে প্রায় বিবাগী হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পূজিত, নিজে হাতে গড়া তারা মূর্তি ঠাকুর ঘরে, সেখানে সকাল সন্ধে পুজো ঠাকুমার দায়। তারপরে মায়ের। পুজো মানে পুজোর জোগাড়। আসল পুজোটুকু বাবা ব্যাটাছেলে তারাপ্রসাদই করতেন। কখনও কখনও তিনি অসুস্থ হলে পুত্র শ্যামাপ্রসাদ বা শ্যামই করত। মায়ের অসুবিধা থাকলে অলকা করত পুজোর জোগাড়। অলকা বিএসসি পাস করল তারপর বাবা পড়া বন্ধ করে দিলেন, মুখে বললেন, গ্র্যাজুয়েট হয়েছে আর কী! ঠাকুরবাড়ির মেয়ে পুজো-অর্চনা করুক, রান্নাবান্না, বিয়ের জন্যে তৈরি হোক। আসল কথা অবশ্য অলকা জানে। তার মাও জানেন। শ্যামা অলকার মতো লেখাপড়ায় ভালো নয়। তার পড়ার খরচ আছে। মিনি মাগনা হয় না। সৎ ব্রাহ্মণ হলে কী হবে, তারাপ্রসাদ সামান্য চাকরি করেন। বসতবাটিটি ছাড়া আর কিছুই নেই। কাজেই মেয়ের পড়া বন্ধ। বিএড পাশ করে টিচার হওয়ার ঘোর বাসনা হয়েছিল অলকার। এমন কিছু খরচ না। না হয় টিউশনি করে সে নিজেই জোগাড় করবে। কিন্তু বাঁডজ্যেবাড়ির মেয়ে চাকরি করবে এতেও তারাপ্রসাদের ঘোর আপত্তি। হতে পারেন তাঁরা বংশানুক্রমে শক্তিপূজারী। কিন্তু বংশের মেয়ের হাতে তাঁরা কোনো প্রহরণ দেখতে চান না। সে কলম পেনসিল হলেও। বিশ্বাসও করেন না। রমণী চৌকাঠের পার কী ঘরের বার। বিশ্বাস নাই। ভালো কথা, মা তাকে রান্নাঘরে বেশি যেতে দ্যান না। উনুন তাতে কালো মেয়ের কী মূর্তি হবে কে জানে! তবে রান্নাঘর ছাড়াও ঊনকোটি কাজ আছে সংসারে। অলকা সবই করে, করেও ভাববার সময় পায়। একতলা বাড়ির ছাদের ওপর ফুলবাগান করার সময় পায়। বাড়ির পিছনে সামান্য জমি, সেখানেও ফুল ফুল আর ফুল। সবই অলকার এক হাতের করা। লাল পঞ্চমুখী, গোলাপি সপ্তমুখী। জবার গাছ বাগানে আছে অন্তত গোটা দশেক। ময়ের পুজোর ফুল। এ ছাড়া পেয়ারা গাছ এবং কদম, শিউলি, কাঠ-চাঁপা, করবী। একটি নিম গাছ, বাতাবি লেবু, গন্ধলেবুর গাছ এবং অদ্ভুত কথা এক সৃষ্টিছাড়া বটল পাম বাগানে।

ছাতে সাদা ফুলের জোছনায়, সুগন্ধে মাত হয়ে থাকে বাঁড়জ্যেবাড়ির ওপর বাতাস। কামিনী, বেল, জুই, কুন্দ, রজনিগন্ধা, টগর, শ্বেতকাঞ্চন, হাসনুহানা। সিমেন্টের উঁচু বেঞ্চি করা আছে, তার ওপর পরপর গাছ। বড়ো টব, ছোটো টব, দেয়ালের গায়ে ছোটো একটি খুপরি কুলুঙ্গিতে খুরপি, সারের কৌটো, কাঁচি সব মজুত থাকে। এই ছাতটিই অলকার জুড়োবার জায়গা ছিল। শীতকালে বড়ি দেওয়ার নাম করে, আচারের ভরসা নিয়ে সবাইকে সে ছাতে চলে আসত। যতক্ষণ রোদ ততক্ষণ সে টুপটুপ বড়ি দিচ্ছে, বড়ি দিয়ে আচারের শিশির ঢাকনা খুলে রোদে দিচ্ছে। মাঝারি সব কড়ির বয়ামে আমতেল, ছড়া তেঁতুল, এঁচোড় ফুলকপি-মটরশুটি তেলে দিয়ে রকম রকম আচার, আম কোরা, তেঁতুলের কাই। রকমারি। রোদ একটু সরে গেলে দেখবে কোন গাছে ঝুড়ি এসেছে, চড়ুই-শালিখ কুঁড়ির বোঁটা কেটে দিয়ে যাবে, সেগুলো সে বড়ো বড়ো কাঠির কুঁড়ি চাপা দেবে। আচার ছাতের ঘরে তুলবে। তারপর নীচে নেমে শুরু হবে রাজ্যের কাজ। রোদের ঝাঁঝ মরে এলে আবার চলল। হাতে বই, বেতের চেয়ার ছাত-ঘর থেকে টেনে নামিয়ে, চুল মেলে দিয়ে সাঁঝ না নামা পর্যন্ত পড়া। কী পড়ে অলকা? যা পায়। সঞ্চয়িতা, গীতাঞ্জলি, লাইব্রেরি থেকে আনা গল্প-উপন্যাস, ভ্রমণের বই, অদ্ভুত যত অভিজ্ঞতার গল্প, আর পড়ে পাঁজি, গীতা এবং ঠাকুরদা দেবপ্রসাদের ডায়েরি। শেষোক্ত বস্তুটি সে বইয়ের আলমারি ঝাড়তে-গোছাতে গিয়ে আবিষ্কার করে। করে এত অবাক হয়ে যায় যে প্রথমেই গলা দিয়ে আওয়াজ বার হয়ে গিয়েছিল। ভাগ্যিস ঝিমঝিমে দুপুর, বাবা অফিসে, মা ঘুমে, ভাই বাইরে—কেউ শুনতে পায়নি সঙ্গে সঙ্গেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠাকুরদার ডায়েরি হেন রত্ন পাওয়া গেলে বাবা তো অবশ্যই তার রত্ন দাবি করবেন, সে ডায়েরি তার ছোঁয়া তত বারণ হয়ে যাবে। তাই সে ঝেড়েঝড়ে বাইরের সারির পিছনদিকে জিনিসটি যেমনকে তেমন। রেখেই দেয়। মাঝেমধ্যে অন্য বইয়ের ভেতর করে নিয়ে এসে পড়ে।

ডাক পড়ত। মাঝে মাঝেই। তার পাঠ-নিমগ্ন, কুসুমবেষ্টিত নির্জনতা থেকে নেমে যেতে হত। আলমারি থেকে টিসুর শাড়ি, কেন-না ফুলে থাকবে, ভরন্ত দেখাবে। মেক-আপ স্টিক তো স্রেফ এইজন্যেই কেনা। সাজগোজ শেষ করে কপালে একটি বড়ো টিপ দেবেন মা। তাতে কপাল একটু যদি ছোটো দেখায় চুলগুলো হাতখোঁপা করে হাজিরা দিতে হবে তাকে বাইরের ঘরে। সুটেবল গার্ল এর খোঁজে যেখানে দলকে দল বসে কচুরি-আলুর দম-রসগোল্লার গুষ্টির তুষ্টি করছে।

কী নাম মা?

অলকা ব্যানার্জি।

কুমারী তো? আসল কথাটি যে বন্দ্যোপাধ্যায়—বোধহয় জানা নেই।

অলকার মনে হয়, বলে, কুমারী জেনেছেন বলেই তো দেখতে এসেছেন। বিবাহিতা মেয়ের সঙ্গে ছেলের সম্বন্ধ করতে আসেননি নিশ্চয় অবশ্যই এত কথা সে বলে না। হাসি ঠেকিয়ে নম্র, নতভাবে জবাব দেয়–

কুমারী অলকা বন্দ্যোপাধ্যায়।

হ্যাঁ গো মেয়ে, খুব নাকি পাস করেছ শুনতে পাই।

মায়ের চোখের শাসনে, প্রাইভেটে এম এ পাস করার কথাটা সে আর বলে না, বলে—এমন আর কী! বিএসসি।–কেমিস্ট্রিতে অনার্স ছিল। ফার্স্ট ক্লাস কান ঘেঁসে বেরিয়ে গেছে, এত কথা সে কেনই বা বলতে যাবে।

চুলটা একটু আলগা করো তো মা!

কাঁটা তিনটি আলতো করে খুলে নিতেই পিঠে ফণা তুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে রাশি রাশি কেশ। অলকার চোখে হাসি খেলে যায়।

তা ওদিক থেকে রি-অ্যাকশন আসে। বৃদ্ধাটি বলছেন,—চুল নিয়ে কি ধুয়ে খাব? —অথচ দেখতে তো ইনিই চেয়েছিলেন।

পরে খবর দেব বলে চলে গিয়ে যখন আর খবর দ্যান না এরা, বাবা-মার গায়ে কাঁটা ফুটতে পারে কিন্তু অলকার বড়ো স্বস্তি বোধ হয়। এরা তো বউমার হাতের রান্না চেয়ে-চিন্তে চেটেপুটে খেয়েও বলবে, রান্না নিয়ে কি ধুয়ে খাব?

তবে অলকা বেশি কথার মানুষ নয়। নিজের ভিতরের সোয়াস্তি সে বাইরে প্রকাশ করতে যায় না।

এভাবে দ্বিতীয় দল, তৃতীয় দল আসে। অলকাকে নিজে হাতে খাবার প্রস্তুত করতেও হয়। কিন্তু খবর আর আসে না। দেখতে দেখতে সাতাশ পার হয়ে গেল। হঠাৎ ঠাকুরঘরের চৌকাঠে বাবা খাড়া হয়ে দাঁড়ালেন। কী ব্যাপার? ঠাকুরঘরে ঢুকতে পাবে না অরক্ষণীয়া কন্যা। পুজোর জিনিসপত্রে হাত দেবে না।

মা বললেন, পাগল হলে না কি? আগেকার ওসব অরক্ষণীয়া-টিয়া আছে নাকি এখনও?

না।

রাগটা করছ কার উপর? মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, কালোকুষ্টির ঝাড় তো তোমরা। দেয়ালের দিকে চেয়ে ছবিগুলো দ্যাখো না। আমার যদি কিছু ছিরিছাঁদ থেকেও থাকে, সে তোমাদের এই সংসারের পিছনে গেছে। মেয়ে যে রূপটা পাবে, কোন স্বগগো থেকে পাবে শুনি? আজকাল কত কি স্নো, ক্রিম উঠছে, পার্লার, মার্লার সেসব করার জন্যে দু-দশ টাকা ধরে দিয়েছ কোনোদিন? ওই মেয়ে বড়ি, আচার, পূজোর জোগাড়, কাপড় কাচা, বাসন মাজা সবই করছে আমার সঙ্গে সঙ্গে। ঝনাৎ করে মা চলে গেলেন।

সত্যি কথাই। জিনে থাকবে তবে তো রূপ পাবে? ছিটেফোঁটা নেই কোনো কুলে!, আয়নার দিকে চেয়ে অলকা মনে মনে বলে। দেবপ্রসাদ যেন কালীর হাতের খাঁড়াটা। একবগ্না, ঘাড় উঁচিয়ে পইতে হাতে করে এগিয়ে আসেন আর কী! ফোটোগ্রাফেও বোঝা যায় খসকা কালো রং, সব ঢেকে কাঁচাপাকা দাড়ি গোঁফ। তস্য পত্নী একেবারেই কেলে হাঁড়ি। ঠাকুমাকে ছোটোবেলায় দেখেছে, ভালোই মনে আছে তার। খুব বড়োলোকের মেয়ে ছিলেন। তাঁর অনেক গয়নাপত্তরও ছিল। হয়তো সেইসব ঘুষ দিয়েই নিরূপ কন্যার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মানুষটি ছিলেন বড়ো ভালো। বউমাকে কোনোদিন কষ্ট দেননি। নাতি-নাতনিকে অশেষ ভালোবাসতেন। তাঁকে কোনোদিন দেখতে খারাপ বলে মনে হয়নি অলকার। রূপের ছববা কী জিনিস এই এখন ইদানীংই পুরো মালুম হচ্ছে। চতুর্দিকে হোডিং, তাতে রূপসি মেনকা রম্ভারা বুকের ভাঁজ দেখিয়ে সব উলঙ্গহার ছড়িয়ে রয়েছেন, ছিঃ। এইসব কাগজ, বিজ্ঞাপন আর পত্রপত্রিকার দৌলতেই তাদের পৃথিবী জানল রূপ রূপ, বিরূপ, রূপকথার নানান আখ্যান-ব্যাখ্যান। তা নয়তো সে কি কোনোদিন নিজের মাকে অসুন্দর দেখেছে? মুখে মেচেতার ছাপ, না ফরসা কালো, মাথার চুলগুলি সামনের দিকে উঠন্ত, থলথলে গড়নের মা তার জননীই তো! আর ভাই সেই আদরকাড়া বল-খেলুনেটা! লম্বা চওড়া, একমাথা চুল এখন, কিন্তু কুচকুচে খসকা কালো, মুখময় ব্রণর দাগ এক মুরারি ওকে কি কোনোদিন কুরূপ বলে সে জেনেছে! এতদিনে জানল—বাবা মা, ঠাকুরদা ঠাকুমা, সে নিজে সবাই কুরূপ। তবু সে হয়তো এই এদেরই মধ্যে একটু খোলতাই। কে জানে হয়তো যৌবনের গুণে। তার হ্যাঁ ওই, মা বলেছে আরেকটু দেখনসই হতে সে পারত যদি ক্রিম…ট্রিমের দৌলতে আরেকটু চকচকে হওয়ার চান্স পেত, পার্লারের গুণে সরু ভুরু, একটু ভালো খাওয়া দাওয়া করে দলমলে ঢলঢলে। তা সেও তো তোমরা দিতে পারছ না। তবে রাগটা কীসের, ঝালটা কার উপর ঝাড়ছো? নিজে যে রোজগার করে নেব–তাতেও তো বাদ সাধছ!

কিন্তু যেদিন জানালা দিয়ে লম্বা সুঠাম চেহারার ব্যাকব্রাশ চুল শ্যামকান্তি যুবকটিকে দেখে তার নিজেরই খুব পছন্দ হয়ে গেল, সেদিনই হল তার আসল মুশকিল। সে দিনেই মন দিয়ে হালকা কমলা রংয়ের সরু জরিপাড় শাড়িটা সে পরেছিল। মুখটি মেজে ঘষে, চুলগুলি খুলে দিয়েছিল। কপাল ঢেকে কান ঢেকে পড়েছিল চুলের গোছা। ছোটো তার পছন্দসই টিপ ছিল কপালে। টান টান করে শাড়ি পরা ফিগারে তনুশ্রী যতদূর খোলবার খুলেছিল। ঠোঁট ভালো করে ঘষে সামান্য একটু ভেসলিন দিয়ে চকচকে করে নিয়েছিল। আর বুকের খাঁজে লুকিয়ে নিয়েছিল একমুঠো শুভ্র কু-কুসুম। মৃদু সুগন্ধে চারদিক মাত হয়ে থাকবে।

যুবকটি ভদ্রভাবে নমস্কার করে বলল, আপনি সত্যি কথা পছন্দ করেন তো?—সে কী বলবে? সত্যেরও যে তেমন কোনো অ্যাবসলিউট নেই সে তো জীবন দিয়েই জানে।

দেখুন, আমি রাইটার্সের এইচডিসি। যতই চাই আমার ভাগ্যে যে হুরিপরি জুটবে না সে আমি জানি। আমার মা যিনি এতদিন আমাকে ভাত বেঁধে খাওয়ালেন দুঃখ ধান্ধা করে বড়ো করলেন, তিনিই দুরারোগ্য রোগে শয্যাশায়ী। আমি একজন ভদ্রঘরের রাঁধুনি-কাম-নার্স-কাম আয়া খুঁজছি স্ত্রীর মধ্যে। টানাটানির ঘরে একজন এইরকম রোগীকে সেবাশুশ্রুষা করে আর যাবতীয় যা করার যদি করতে রাজি থাকেন, তাহলে আপনার রূপ আমার চলবে।

চাঁছাছোলা কথাগুলি বলে ছেলেটি তার চোখের দিকে সোজা চেয়েছিল। অলকার কী যে হল, যেন ভেতরটা দারুণ গরম হয়ে উঠছে, সে যেন আর নিজেতে নেই। সে নমস্কার করল, তারপর উঠে দাঁড়াল চেয়ার থেকে, পেছনে ফিরে চলে এল।

কী ব্যাপার, কী হল?_যুবকটি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, বাবা তারাপ্রসাদও তাই। কী হল? হলটা কী?

মা তার বন্ধঘরের দরজায় ঘা দিতে দিতে ক্রমাগত কাঁপা গলায় বলতে থাকলেন, কী রে অলি? তুই কি হ্যাঁ বললি, না, না বললি? হ্যাঁ বললি, না, না বললি!

সে বন্ধ ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসেছিল, কীরকম অসাড় দেহমন নিয়ে, কোনো জবাব দেয়নি। যুবকটি শেষে বলেছিল, আমার কথা বোধহয় ওঁর পছন্দ হয়নি।

সে সারারাত দরজা খোলেনি।

না, খুলেছিল। মাঝ নিশীথে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে যথাসম্ভব নিঃশব্দে দরজা খুলে বাগানে চলে গিয়েছিল ধীর পায়ে। সৃষ্টি ছাড়া বটল পামটির শুভ্র সুগোল কাণ্ডটি জড়িয়ে ধরেছিল। গাল বেয়ে চোখ ছুঁইয়ে, নাক চুইয়ে মনে মনে বলেছিল, বৃক্ষ যদি তুমি সত্যিকারের বৃক্ষ হও তাহলে আমাকে আশ্রয় দাও। পরদিন ওই গাছের তলাতেই তাকে পাওয়া যায়—জ্ঞানহীন। এবং কপাল ফিরতেই সে রক্ত চোখে চারপাশে তাকিয়ে বলেছিল, তোরা অপবিত্র, আমার এ পূতাঙ্গ ছুঁস না। যা স্নান করে আগে পবিত্র হয়ে আয়। আমার পেটিকায় পাটের কাপড় আছে। তারা-মালা, পলা আছে নিয়ে আয় পরি। হ্রীং শ্রীং স্ত্রীঃ ফট।

তার চোখের দিকে তাকিয়ে শিহরিত তারাপ্রসাদ ও সর্বাণী চুপ। তারাপ্রসাদ ছাড়া কেউ জানেনই না মায়ের পেটিকায় কী কী বস্তু আছে। শ্যাম শুনল না, শশব্যস্তে ডাক্তার ডাকল। তানা না না করে তিনি যখন এলেন তখন চান করে ভরপেট ফলাহার করে কেশের ঐশ্বর্য ছড়িয়ে মা তারা বগলামুখী নিবিড় ঘুম ঘুমোচ্ছেন। লাল চওড়া পাড় তসরের শাড়ি পরনে। হাত ভরতি লাল পলা, গলার থেকে লম্বা তারা তারা সোনার মালা লুটিয়ে আছে বুকের উপর। তারাপ্রসাদ ঘরের সামনে প্রহরায়।

উনি ঘুমোচ্ছেন, ছোঁবেন না।

শ্যাম বলল, বাবা আপনি কী পাগল হলেন? একটু দেখতে দিন।

হ্যাঁ দর্শন। একবারমাত্র দর্শন করুন, তারপর চলে যান।

সামান্য ফাঁক দরজা দিয়ে শয়ান মূর্তিটি দেখে সভয়ে ডাক্তার বললেন, অন্য সময়ে জাগলে, বুঝলে শ্যামাপ্রসাদ! ব্যাগ গুটিয়ে ভদ্রলোক পালিয়ে গেলেন।

প্রথম ক-দিন সে এইরকম গভীরভাবেই রইল। ভোরবেলায় উঠে স্নান সেরে কোরা লাল পাড় শাড়ি পরে সেজেগুঁজে ছাতে যায়, ঘুরে ঘুরে গাছগুলির উপর আশীর্বাদের হাত রাখে। আপন মনেই বীজমন্ত্র বিড়বিড় করতে করতে ঘোরে। নীচে আসে রোদ কড়া হয়ে উঠলে। তখন বাবা তাকে ঠাকুরঘরে ঢুকতে বললে, সে স্থির চোখে তাকায়। নিজের কোণের ঘরটিতে চলে যায়। যথাসময়ে পবিত্রভাবে প্রস্তুত তার ভোগ আসে। খাওয়া দাওয়া সারা হলে সে দরজা বন্ধ করে দেয়। পড়ে, পড়ে, পড়ে। বিকেল হলে আবার বেরিয়ে পবিত্র হয়ে বাগানে যায়। এই শ্বেত কাঞ্চন গাছটি তার বিশেষ প্রিয় ওই যুথী গাছটি তার বড়ো ন্যাওটা, সে না এলে কেমন ঝিমিয়ে থাকে। অনন্য মনে সে পরিচর্যা করে গাছগুলির, তাদের মৃদু অভিমান বোঝে, আদর করে, ফুলগুলি আহ্লাদে ফেটে পড়ে। তারপর পড়ন্ত সন্ধেয় নীচে নেমে সে সোজা ঠাকুরঘরে চলে যায়, আসন পেতে পদ্মাসনে বসে।

সে জানে না কখন সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়েছে। ডানহাতে যেন খড়গ ধরা, বামহাতে কপাল, কোন সুদূরে তার চোখ নিবদ্ধ মুখে প্রশান্তি। আবার কখনও তেজ। সে জানে না কখন সে বসেছে। মুখ দিয়ে অস্ফুট ধবনি বেরোচ্ছে—কোনো মন্ত্র কিন্তু এদের বোধের অতীত। বোঝেন অনুমান করতে পারেন একমাত্র তারাপ্রসাদ। তিনি বিহ্বল হয়ে প্রণাম করেন বারবার। সে দেখেও না, তার খেয়ালের মধ্যেই তখন থাকে না ঠাকুরঘরে শুধু প্রণত মাথার গাঁদি লেগেছে, যখন জ্ঞান হয় দেখে তার গলায় আজানুলম্বিত রক্তজবার মালা। আশেপাশে ঝুড়িতে ফলফুল মিষ্টান্ন, শাড়ি, কয়েনে কয়েনে ছয়লাপ, যে যা পেরেছে, পাঁচটাকা, দু-টাকা এক টাকা। নোটের তাড়া। ক্রমে ক্রমে বেনারসি, সিল্ক শাড়ি, মাকে প্রদত্ত সোনার গহনা। আরও বড়ো নোট, আরও বড়ো।

কোনোদিকে তাকায় না উঠে দাঁড়ায় সে। সসম্ভমে সবাই পথ করে দেয়। সে চলে যায় কোণে নিজের ঘরে। অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। কোনো সময়ে মা ঘুম ভাঙিয়ে নিজে হাতে খাইয়ে যান। এবং আরও রাতে চুপিচুপি শ্যামা ভাই তার ওষুধের গুলি ঠোঁট ফাঁক করে খাইয়ে দেয়। যতই ঠাকুরবাড়ির ছেলে হোক শ্যামা আজকালকার ছেলে। বাবাকে লুকিয়ে দিদির সাধ্যমতো চিকিৎসা সে করাবেই। এবং চিকিৎসাতেই কিনা কে জানে ফল হয়। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তার নিজের ছাপা শাড়ি পরে অলকা রান্নাঘরে গিয়ে চা করে, রুটি তরকারি করে। পিছন থেকে মা এসে হতবাক।

ওরে তুই কেন? আমি তো আসছি।

সামান্য অবাক সামান্য বিরক্ত হয়ে সে একবার তাকায় তারপর চায়ের কাপ মায়ের হাতে তুলে দেয়। বাবা আর ভাইয়ের চা নিয়ে চলে যায় বইয়ের ঘরে যেখানে সবে সকালের কাগজ এসে পৌঁছেছে, দুজনে দু-খানা পাতা নিয়ে দু-দিকে বসে আছে। দুজনেরই মুখ কাগজে ঢাকা। শাড়ির খসখস শব্দ। তারাপ্রসাদ বললেন, বুঝলে এবার রান্নাবান্নার জন্যে দেখে শুনে একজন বামনি রাখো। এখন

অলকা বলল, বাবা চা নিন।

কাগজ হাত থেকে খসে গেল। তারাপ্রসাদ ভ্যাবলার মতো চেয়ে রইলেন, অবশেষে ফাঁসফেঁসে গলায় কোনোক্রমে বললেন, মা, তুই?

শ্যামাও চমকে উঠেছিল, সামলে নিয়ে বলল, আরে দিদি, তোর চা-টাও দিয়ে নিয়ে আয়। একসঙ্গে…।

অলকা শান্ত মুখে বাবার দিকে একবার তাকাল, ভাইয়ের দিকে একবার। মুখে কী মৃদুর চেয়েও মৃদুতর হাসি? হাসি না আর কিছু!

সকলের কাজকর্ম সারা হলে অলকা চিরদিনের অভ্যাসমতো সামান্য একটু পাড়া বেড়াতে বেরোয়। তার কাছাকাছি বয়সি কোনো বউ বা মেয়ে, পাড়াপড়শি, ছেলেবুড়ো, পিপলস ক্লাব বা বন্ধুসংঘর ছেলেরা যারা এখনও তেমন কোনো কাজকর্ম পায়নি, চারদিকে খুঁটির মতো ছিটিয়ে থাকে। চলতে চলতে কথা বলতে বলতে সে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে যায়। শীত পড়ছে, রোদে তেমন ঝাঁঝ নেই। আকাশের রং সাদাটে। সবাই চলতে চলতে কেমন সম্ভ্রম মিশ্রিত কৌতূহলের দৃষ্টিতে চায়। সে খেয়াল করে না। বড়ো বাড়ির আধখোলা সবুজ ফটক আলতো ঠেলে সে ডাকে, রুবি বউদি, আসব?

চমকে উঠে বউদি বলে, ওম্মা অলকা! এসো এসো। পড়িমরি করে সে একখানা তোলা আসন এনে চেয়ারের উপর পেতে দেয়, বস।

হঠাৎ তুমি?–অলকা হেসে ফেলে। রুবি বউদিদের সঙ্গে তার বরাবর তুই তোকারির সম্পর্ক। প্রথমটা একটু আড়ষ্ট হয়ে কথা বলে, তারপর সহজ হয়ে যায় বউদি, তুমুল গল্প করে। এইরকমই অরুণা, মাধুরী, শীলাদের সঙ্গেও তার গল্প জমে যায় কোনো কোনো বিকেলবেলা।

কিন্তু শ্যামাপ্রসাদ যেটাকে মনে করেছিল হোমিও-আরোগ্য, এবং তার বাবা মনে করেছিলেন দৈবী অন্তর্ধান, অচিরেই দেখা গেল সে জিনিসটা স্বল্পস্থায়ী। সেই বিশেষ বিশেষ বার অর্থাৎ শনি, মঙ্গলবারেই এখন মায়ের ভর হয়। কখন হবে কেউ জানে না, কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে হঠাৎ অলকা চুপ হয়ে যায়। তারপর অচেনা ভঙ্গিতে ওঠে, ঢুকে যায় ঠাকুরঘরে। বেরিয়ে আসে। পরনে লাল পাড় পাটের শাড়ি, গলায় তারা-মালা, হাত ভরতি লাল রুলি। বেরিয়ে আসে আরও অচেনা ভঙ্গিতে। তার কেমন একটা ঘোর লাগে। শাঁ শাঁ করে সে যেন এক মায়াবী পথ দিয়ে ক্রমাগত ওপরে আরও ওপরে উঠতে থাকে। চলে যায় এক আলোময় ভিন্ন জগতে যেখানকার চলাফেরা বোধ বোধগম্যতা সবই অন্যরকম। সে পাক খায় এক অস্তিত্বহীন অন্য চরাচরে। কণ্ঠ আর এই কণ্ঠ থাকে না। হাত পা চলে অন্যকোনো নির্দেশে—এর চেয়ে বেশি আর কিছু সে জানে না।—এটুকুও সে অনেক চেষ্টায় মনে করে বলে অনেকবার জিজ্ঞাসার পরে, শুধুমাত্র তার ভাইকেই। তাই শেষপর্যন্ত তারাপ্রসাদকে ডিঙিয়ে শ্যামাপ্রসাদই দেবীর সেবায়েৎ হয়ে যায় এবং পট্টবস্ত্র পরা, তারা-মালা গলায়, লাল পলা পরা হাত দুটি যখন খড়গধারী পদ্মকোরক মুদ্রা রচনা করে তার কোলের উপর এসে থামে প্রবল হুড়োহুড়ির মধ্যেও জনতা টু শব্দ করে না, সেবায়েতের চোখের নির্দেশে কিউ করে, পুজো দেয় এবং সকাতরে প্রশ্ন করে—

প্রশ্ন 1। মা আমার চাকুরে ছেলে কেমন উড়-উড়। আলগা হয়ে যাচ্ছে মা, বড়ো কষ্ট করে মানুষ করেছি।

উত্তর . তোমার ছেলের ভিনজাতের প্রেমিকা, সত্বর মেনে নাও, নইলে ছেলে হারাবে-অলৌকিক স্বর বলে।

প্রশ্ন 2। মা ভাড়াটে কিছুতেই উঠছে না, মামলা করেছি, জিত হবে তো? উত্তর . কিছুমাত্র সত্য যদি তোমার পক্ষে থাকে তবেই।

প্রশ্ন 3। মা, স্বামী ইদানীং অফিসের কাজ বলে হপ্তায় দু-দিন বাড়ি ফিরছে না, সব সময়ে দুর্ব্যবহার করে।

উত্তর . লোকটি চরিত্র হারিয়েছে। দুরারোগ্য রোগ হবে। মার পায়ের কাছে নিয়ে আসতে পারলে রক্ষা হতে পারে।

এবং প্রণামি পড়ে। প্রণামির পাহাড়। দেশবিদেশ থেকে পত্র আসে, দুঃখ আসে, প্রশ্ন আসে। জবাব যায়। আশীর্বাদ যায়। প্রসাদি ফুল ও ফল বিতরণ হয় অকাতরে। এতদিনে বাড়িটি প্রকৃতই ঠাকুরবাড়ি হয়। দোতলা ওঠে। সেখানে বসবাস। নীচে মন্দির। সেখানে অধিষ্ঠিত দেবপ্রসাদের নিজ হাতে গড়া তারামূর্তি। পেছনে মায়ের বসনভূষণ সমেত পেটিকা। সেই পেটিকার তত্ত্বাবধায়ক তারাপ্রসাদ তারই মধ্যে একদিন আবিষ্কার করেন পিতার জীর্ণ ডায়েরিটি। কপালে ঠেকিয়ে পড়েন—মায়ের অষ্টমূর্তি—তারা, নীলসরস্বতী, ভদ্রকালী এবং কামেশ্বরী। মূল মূর্তি নীলকণ্ঠ মহাদেবকে স্তন্যপানরত মহালক্ষ্মীর। এভাবেই তিনি নীলকণ্ঠের বিষ দূর করেছিলেন। শিলাময় সেই স্বয়ম্ভ মূর্তিকে নাটোরের মহারানি ঢেকে দেন লোকরঞ্জিনী লোকপালিনী মূর্তি দিয়ে।

বিবর্ণ অক্ষরমালা, স্থানে স্থানে কালি ম্লান হয়ে গেছে, উদ্ধার করা দুঃসাধ্য। অনেক চেষ্টায় সেইসব বর্ণ উদ্ধার করেন একদিন তারাপ্রসাদ এবং বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যান। সাধক বলছেন, ইনি ব্রহ্মের পরাশক্তি। পঞ্চ মহাশূন্যে বিরাজ করতেন, আকাশ, মহাকাশ, পরাকাশ, তত্ত্বাকাশ ও সূর্যাকাশ। আমি তাঁকে তারা মূর্তিতে দেখেছি, গড়েছি, প্রতিষ্ঠা করেছি। তিনি প্রসন্না কিন্তু রক্তাভ বদনা, তাঁর জিহ্বা অগ্নিশিখার ন্যায়। চতুর্ভুজা ডান হস্তদ্বয়ে খড়গ কর্তরী ধারণ করে আছেন, বামহস্তদ্বয়ে কপালপাত্র ও পদ্মকোরক। কিন্তু মায়ের যে ধ্যান মূর্তি আমি দেখি তাতে পিঙ্গল জটা। কাল সুর্যের ন্যায় প্রখর ত্রিনয়ন। প্রজ্বলিত চিতাবহ্নি থেকে উর্থিতা হন তিনি। মহালক্ষ্মী মূর্তি দিয়ে সেই দুঃসহ ধ্যান মূর্তিকে আবৃত করলাম। কিন্তু লোকশিক্ষার জন্য মা যে-কোনো মুহূর্তে উগ্রা, উগ্রতারা, মহাউগ্রতারা হতে পারেন। বস্তুত শক্তির অষ্টরূপের এই অষ্টাঙ্গী মাতৃমূর্তি আমি দর্শন করেছি। যদি সত্য সাধক হই তো কোনো না কোনোদিন লোকপালিনী, লোকশাসনা এই মহাশক্তি আমার এই সাধনক্ষেত্রেই প্রকাশিত হবেন।… পাঠ শেষ করেই স্থাণু হয়ে থাকেন তারাপ্রসাদ। মুখময় বিন্দু বিন্দু স্বেদ।

যেদিন শনিবারের সন্ধ্যারাত্রে জ্যান্ত মা দুশ্চরিত্র লোকটির গালে প্রবল চপেটাঘাত করলেন এবং সে তাঁর পায়ে পড়ে মা মা করে কাঁদতে লাগল,

তারাপ্রসাদ ছেলেকে এবং স্ত্রীকে ডেকে পিতৃডায়েরির সেই পরম অর্থময় অংশগুলি পড়ে পড়ে শোনালেন।

শীতের বিকেল সন্ধেয় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। বৃহস্পতিবার। চারদিকে শাঁখ বাজছে। চুলে দীর্ঘ আলগা বিনুনি ঝুলিয়ে তার ফেভারিট চুনে হলুদ রংয়ের তাঁতের শাড়িটি পড়ে, গলায় সরু হার, কানে ছোটো মাকড়ি, হাতে বালা, সে বেরিয়ে আসে। পায়ের বাসি আলতা সাবান ঘষে ঘষেও তুলতে পারেনি। পিছনে পড়ে থাকে মন্দির, প্রণামি, সেবাইত, সে নির্বাধ বেরিয়ে পড়ে। কেউ বলে না, কোথায় যাচ্ছিস? কেউ বলে না, তাড়াতাড়ি ফিরিস।

ক্লাবে ক্যারাম খেলতে খেলতে কর্কশকান্তি তরুণের দল জানলা দিয়ে দেখতে পায়, শশব্যস্তে বেরিয়ে আসে, অলকাদি, একটু খেলা দেখে যাবে না? অলকাদি।

সে মৃদু হাসে, বলে, কাল আসব এখন, আজ যাই। রুবি বউদি, মণি বউদির বাড়ি লক্ষ্মীপুজোর নেমতন্ন আছে।

আশ্চর্য! এতগুলি আমন্ত্রিত মানুষ, অচেনা, আত্মীয়স্বজন রুবি বউদি মণি বউদির বাড়িতে। কেউ তো বলে না, এতবড়ো মেয়ে, বিয়ে হয়নি?

কেউ বলে না, কাদের বাড়ির মেয়ে? কী করে? কী পাস?

শুধু সসম্ভ্রম বিহ্বলতায় এ ওকে শুধোয়, কে? কে? কে? এ কে গো?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress