কুসুমের বাড়ী যাইবার জন্য রওনা
হাজারি এদিকের সব কাজ মিটাইয়া কুসুমের বাড়ী যাইবার জন্য রওনা হইল, পথে হঠাৎ পদ্মঝিয়ের সঙ্গে দেখা। পদ্মঝিয়ের পরনে মলিন বস্ত্র। কখনও হাজারি জীবনে যাহা দেখে নাই।
হাজারি বলিল–হাতে কি পদ্মদিদি? যাচ্ছ কোথায়?
পদ্ম হাজারিকে দেখিয়া দাঁড়াইল, বলিল–ঠাকুরমশায়, কবে ফিরলে? হাতে তেঁতুল, একটু নিয়ে এলাম হোটেল থেকে।
হাজারি মনে মনে হাসিল। হোটেল হইতে লুকাইয়া জিনিস সরাইবার অভ্যাস এখনও যায় নাই পদ্মদিদির!
হাজারি পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিল, কিন্তু পদ্ম বলিল–শোনো, দাঁড়াও না ঠাকুরমশায়! কাল তোমাদের বাসায় গিয়েছিলাম যে! বলে নি বৌদিদি?
–হ্যাঁ হ্যাঁ বলচিল বটে।
–বৌদিদি লোক বড় ভাল, আমার সঙ্গে কত গল্প করলে। আর একদিন যাব।
–বা, যাবে বৈ কি পদ্মদিদি, তোমাদেরই বাড়ী। যখন ইচ্ছে হয় যাবে। হোটেল কেমন চলছে?
–তা মন্দ চলছে না। এককরম চলছে।
–বেশ বেশ। তাহলে এখন আসি পদ্মদিদি—
হাজারি চলিয়া গেল। ভাবিল–একরকম চলছে বললে অথচ কাল বাড়ীতে বসে গল্প করে এসেছে হোটেল আর চলে না, উঠে যাবে। পদ্মদিদি ভাঙে তো মচকায় না!
কুসুমের বাড়ীতে হাজারি অনেকক্ষণ কথাবার্তা বলিল। কথায়-কথায় নতুন গাঁয়ের বধুটির কথা মনে পড়াতে হাজারি বলিল–ভাল কথা কুসুম মা চেনো? এঁড়োশোলার বনমালীর স্ত্রীর ভাইঝি–তোমাকে দিদি বলে ডাকে একটি মেয়ে, বিয়ে হয়েছে নতুন গাঁ?
কুসুম বলিল–খুব চিনি। ওর নাম তো সুবাসিনী। ওকে কি করে জানলেন জ্যাঠা মশায়?
হাজারি বধুটির সম্বন্ধে সব কথা খুলিয়া বলিল, তাহার টাকা লইয়া আসা, হোটেলে তাহাকে অংশীদার করার সঙ্কল্প।
কুসুম বলিল–এ তো বড় খুশির কথা। আপনার হোটেলে টাকা খাটলে ওর ভবিষতে একটা হিল্লে হয়ে রইল।
–কিন্তু যদি আজ মরে যাই মা? তখন কোথায় থাকবে হোটেল?
–ও কথা বলতে নেই যাঠামশায়–ছিঃ
কুসুমের অবস্থা আজকাল ফিরিয়াছে। হাজারি তাহাকে শুধু মহাজন হিসাবে দেখে না, হোটেলের অংশীদার হিসাবে প্রতি মাসে ত্রিশ-বত্রিশ টাকা দেয়, মাসিক লাভের অংশরূপ।
কুসুম বলিল–অমন সব কথা বলেন কেন, ওতে আমার কষ্ট হয়। আপনি ছিলেন তাই আজ রাণাঘাট শহরে মাথা তুলে বেড়াতে পারছি, ছেলেপিলে দু-বেলা দু-মুঠো খেতে পাচ্ছে। এই বাড়ী বাঁধা রেখে গিয়েছিলেন শশুর, আপনাকে বলি নি সে-কথা, এতদিন বাড়ী বিক্রি হয়ে যেতো দেনার দায়ে যদি হোটেল থেকে টাকা না পেতাম মাস মাস। ওই টাকা দিয়ে দেনা সব শোধ করে ফেলেছি–এখন বাড়ী আমার নামে। আপনার দৌলতেই সব জ্যাঠামশায়– আমার চোখে আপনি দেবতা।
হাজারি বলিল–উঠি আজ মা। একবার ইষ্টিশানের হোটেলটাতে যাব। একদল বড় লোক টেলিগ্রাম করেছে কলকাতা থেকে, দার্জিলিং মেলের সময় এখানে খানা পাবে। তাদের জন্যে মাংসটা নিজে রাঁধবো। তারে তাই লেখা আছে।
দার্জিলিং মেলে চার-পাঁচটি বাবু নামিয়া হাজারির রেলওয়ে হোটেলে খাইতে আসিল। হাজারি নিজের হাতে মাংস রান্না করিয়াছিল। উহারা খাইয়া অত্যন্ত খুশী হইয়া গেল–হাজারিকে ডাকিয়া আলাপ করিল। উহাদের মধ্যে একজন বলিল–হাজারিবাবু, আপনার নাম কলকাতায় পৌঁচেছে জানেন তো? বড়ঘরে যারা পঞ্চাশ টাকা মাইনের ঠাকুর রাখে, তারা জানে রাণাঘাটের হিন্দু-হোটেলের হাজারি ঠাকুর খুব বড় রাঁধুনী। আমাদের সেইটে পরীক্ষা করে দেখবার জন্যে আজ আপনার এখানে আসা। তারে বলাও ছিল যাতে আপনি নিজে রাঁধেন। বড় খুশি হয়েছি খেয়ে।
.
ইহার কয়েক দিন পরে একখানা চিঠি আসিল কলিকাতা হইতে। সেদিন যাহারা রেলওয়ে হোটেলে খাইয়া গিয়াছিল তাহারা পুনরায় দেখা করিতে আসিতেছে আজ ওবেলা, বিশেষ জরুরী দরকার আছে। সাড়ে তিনটার কৃষ্ণনগর লোকালে দুইজন ভদ্রলোক নামিল। তাহাদের একজন সেদিনকার সেই লোকটি –যে হাজারির রান্নার অত সুখ্যাতি করিয়া গিয়াছিল। অন্য একজন বাঙালী নয়–কি জাত, হাজারি চিনিতে পারিল না।
পূর্বের ভদ্রলোকটি হাজারির সঙ্গে অবাঙালী ভদ্রলোকটির পরিচয় করাইয়া দিয়া হিন্দীতে বলিল–এর কথাই আপনাকে বলেছিলাম। এই সে হাজারি ঠাকুর।
অবাঙালী ভদ্রলোকটি হাসিমুখে হিন্দীতে কি বলিলেন, হাজারি ভাল বুঝিল না। বিনীত ভাবে বাঙালী বাবুটিকে বলিল যে সে হিন্দী বুঝিতে পারে না।
বাঙালী বাবুটি বলিলেন–শুনুন হাজারিবাবু, কথাটা বলি। আমার বন্ধু ইনি গুজরাটি। বড় ব্যবসাদা, ধুরন্ধর খাড্ডে কোম্পানীর বড় অংশীদার। জি. আই. পি. রেলের সব হিন্দু রেস্টোরান্টের কন্ট্রাক্ট হোল খাড্ডে কোম্পানি। ওরা আপনাকে বলতে এসেছে ওদের সব হোটেলের রান্না দেখাশুনা তদারক করবার জন্যে দেড়শো টাকা মাইনেতে আপনাকে রাখতে চায়। তিন বছরের এগ্রিমেন্ট। আপনার সব খরচ, রেলের যে কোনো জায়গায় যাওয়া-আসা, একজন চাকর ওরা দেবে। বম্বেতে ফ্রি কোয়ার্টার দেবে। যদি ওদের নাম দাঁড়িয়ে যায় আপনার রান্নার গুণে আপনাকে একটা অংশও ওরা দেবে। আপনি রাজী?
হাজারি নরেনকে ডাকিয়া আলোচনা করিল আড়ালে। মন্দ কি? কাজকর্ম এদিকে যাহা রহিল নরেন দেখাশুনা করিতে পারে। খরচ বাদে মাসে তিনি দেড় শত টাকা কম নয়–তা ছাড়া হোটেলের ব্যবসা সম্বন্ধে খুব একটা অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ এটি। এ হাতছাড়া করা উচিত হয় না–নরেনের ইহাই মত।
হাজারি আসিয়া বলিল–আমি রাজী আছি। কবে যেতে হবে বলুন। কি একটা কথা আছে-হিন্দী তো আমি তত জানিনে! কাজ চালাব কি করে?
বাঙালী বাবু বলিলেন–সেজন্যে ভাবনা নেই। দুদিন থাকলেই হিন্দী শিখে নেবেন। সই করুন এ কাগজে। এই আপনার কন্ট্রাক্ট ফর্ম, এই এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার। দুজন সাক্ষী ডাকুন।
যদু বাঁড়ুয্যেকে ডাকিয়া আনা হইল তাহার হোটেল হইতে, অন্য সাক্ষী নরেন। কাগজ পরে হাঙ্গামা চুকিয়া গেলে উহারা চা-পানে আপ্যায়িত হইয়া ট্রেনে উঠিল। বাঙালী ভদ্রলোক বলিয়া গেল–মে মাসের পয়লা জয়েন করতে হবে আপনাকে বম্বেতে। আপনার ইন্টার ক্লাস রেলওয়ে পাস আসছে আর আমাদের লোকে আপনাকে সঙ্গে করে বম্বে পৌঁছে দেবে। তৈরী থাকবেন–আর পনেরো দিন বাকী।
.
হাজারি স্টেশন হইতে বাহির হইয়াই কুসুমের সঙ্গে একবার দেখা করিবে ভাবিল। এত বড় কথাটা কুসুমকে বলিতেই হইবে আগে। বোম্বাই! সে বোম্বাই যাইতেছে। দেড়শো টাকা মাহিনায়! বিশ্বাস হয় না। সব যেন স্বপ্নের মত ঘটিয়া গেল। টাকার জন্য নয়। টাকা এখানে সে মাসে দেড়শো টাকার বেশী ছাড়া কম রোজগার করে না। কিন্তু মানুষের জীবনে টাকাটাই কি সব? পাঁচটা দেশ দেখিয়া বেড়ানো, পাঁচজনের কাছে মান-খাতির পাওয়া, নূতনতর জীবনযাত্রার আস্বাদ–এ সবই তো আসল।
পিছন হইতে যদু বাঁড়ুয্যে ডাকিল–ও হাজারি-ভায়া, হাজারি-ভায়া শোন, হাজারি-ভায়া–
হাজারি কাছে যাইতেই যদু বাঁড়ুয্যে–রাণাঘাটের হোটেলের মালিকদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যে–সেই যদু বাঁড়ুয্যে স্বয়ং নীচু হইয়া হাজারির পায়ের ধূলো লইতে গেল। বলিল–ধন্যি, খুব দেখালে ভায়া, হোটেল করে তোমার মত ভাগ্যি কারো ফেরে নি। পায়ের ধূলো দাও, তুমি সাধারণ লোক নও দেখছি–
হাজারি হা-হা করিয়া উঠিল।
–কি করেন বাঁড়ুয্যেমশায়–আমার দাদার সমান আপনি—ওকি—ওকি–আপনাদের বাপমায়ের আশীর্বাদে, আপনাদের আশীর্বাদে–একরকম করে খাচ্ছি–
যদু বাঁড়ুয্যে বলিল—এসো না ভায়া গরীবের হোটেলে একবার এক ছিলি তামাক খেয়ে যাও–এসো।
যদু বাঁড়ুয্যের অনুরোধ হাজারি এড়াইতে পারিল না। যদু চা খাওয়াইল, ছানার জিলাপি খাওয়াইল, নিজের হাতে তামাক সাজিয়া খাইতে দিল। স্বপ্ন না সত্য? এই যদু বাঁড়ুয্যে একদিন নিজের হোটেলে কাজ করিবার জন্য না ভাঙাইতে গিয়াছিল! তাহার মনিবের দরের মানুষ ছিল তিন বছর আগেও!
না, যথেষ্ট হইল তাহার জীবনে। ইহার বেশী আর সে কিছু চায় না। রাধাবল্লভ ঠাকুর তাহাকে অনেক দিয়াছেন। আশার অতিরিক্ত দিয়াছেন।
.
কুসুম শুনিয়া প্রথমে ঘোর আপত্তি তুলিয়া বলিল–জ্যাঠামশায় কি ভাবেন, এই বয়সে তাঁহাকে সে অত দূরে যাইতে কখনই দিবে না। জেঠিমাকে দিয়াও বারণ করাইবে। আর টাকার দরকার নাই। সে সাত সমুদ্র তেরো নদী পারের দেশে যাইতে হইবে এমন গরজ কিসের?
হাৰি বলিল–মা বেশীদিন থাকব না সেখানে। চুক্তি সই হয়ে গিয়েছে সাক্ষীদের সামনে। না গেলে ওরা খেসারতের দাবি করে নালিশ করতে পারে। আর একটা উদ্দেশ্য আছে কি জান মা, বড় বড় হোটেল কি করে চালায়, একবার নিজের চোখে দেখে আসি। আমার তো ঐ বাতিক, ব্যবসাতে যখন নেমেছি, তখন এর মধ্যে যা কিছু আছে শিখে নিয়ে তবে ছাড়ব। বাধা দিও না মা, তুমি বাধা দিলে তো ঠেলবার সাধ্যি নেই আমার।
টেঁপির মা ও টেঁপি কান্নাকাটি করিতে লাগিল। ইহাদের দুজনকে বুঝাইল নরেন। মামাবাবু কি নিরুদ্দেশ যাত্রা করিতেছেন? অত কান্নাকাটি করিবার কি আছে ইহার মধ্যে। বম্বে তো বাড়ীর কাছে, লোকে কত দূর-দূরান্ত যাইতেছে না চাকুরির জন্য?
সেই দিন রাত্রে হাজারি নরেনের মামা বংশীধর ঠাকুরকে ডাকিয়া বলিল–একটা কথা আছে। আমি তো আর দিন পনেরোর মধ্যে বোম্বাই যাচ্ছি। আমার ইচ্ছে যাবার আগে টেঁপির সঙ্গে নরেনের বিয়েটা দিয়ে যাব। নরেন এখানকার কারবার দেখাশুনা করবে–রেলের হোটেলটা ওকে নিজে দেখতে হবে–ওটাতেই মোটা লাভ। এতে তোমার কি মত?
বংশীধর অনেকদিন হইতেই এইরূপ কিছু ঘটিবে আঁচ করিয়া রাখিয়াছিল। বলিল হাজারিদা, আমি কি বলব, বল। তোমার সঙ্গে পাশাপাশি হোটেলে কাজ করেছি। আমরা সুখের সুখী দুঃখের দুঃখী হয়ে কাটিয়েছি বহুকাল। নরেনও তোমারই আপনার ছেলে। যা বলবে তুমি, তাতে আমার অমত কি? আর ওরও তো কেউ নেই–সবই জান তুমি। যা ভাল বোঝ কর।
দেনাপাওনার মীমাংসা অতি সহজেই মিটিল। হাজারি রেলওয়ে হোটেলটির স্বত্ব টেঁপির নামে লেখাপড়া করিয়া দিবে। তাহার অনুপস্থিতিতে নরেন ম্যানেজার হইয়া উভয় হোটেল চালাইবে–তবে বাজারের হোটেলের আয় হিসাবমত কুসুমকে ও টেঁপির মাকে ভাগ করিয়া দিতে থাকিবে।
বিবাহের দিন ধার্য্য হইয়া গেল।
টেঁপির মা বলিল–ওগো, তোমার মেয়ে বলছে অতসীকে নেমন্তন্ন করে পাঠাতে। ওর বড় বন্ধু ছিল–তাকে বিয়ের দিন আসতে লেখ না?
হাজারিও সে-কথা ভাবিয়াছে। অতসীর সঙ্গে আজ বহুদিন দেখা হয় নাই। সেই মেয়েটির অযাচিত করুণা আজ তাহাকে ও তার পরিবারবর্গকে লোকের চোখে সম্ভ্রান্ত করিয়া তুলিয়াছে। অতসীর শ্বশুরবাড়ীর ঠিকানা হাজারি জানিত না, কেবলমাত্র এইটুকু জানিত অতসীর শ্বশুর বর্ধমান জেলার মূলঘরের জমিদার। হাজারি চিঠিখানা তাহাদের গ্রামে অতসীর বাবার ঠিকানায় পাঠাইয়া দিল, কারণ সময় অত্যন্ত সংক্ষেপ। লিখিয়া ঠিকানা আনাইয়া পুনরায় পত্র লিখিবার সময় নাই।
.
বিবাহের কয়েকদিন পূর্বে হাজারি শ্ৰীমন্ত কাঁসারির দোকানে দানের বাসন কিনিতে গিয়াছে, শ্ৰীমন্ত বলিল–আসুন আসুন হাজারিবাবু, বসুন। ওরে বাবুকে তামাক দে রে–
হাজারি নিজের বাসনপত্র কিনিয়া উঠিবার সময় কতকগুলি পুরনো বাসনপত্র, পিতলের বালতি ইত্যাদি নূতন বাসনের দোকানে দেখিয়া বলিল–এগুলো কি হে শ্ৰীমন্ত? এগুলো তো পুরোনো মাল–ঢালাই করবে নাকি?
শ্ৰীমন্ত বলিল–ও-কথা আপনাকে বলব ভেবেছিলাম বাবু। ও আপনাদের পুরোনো হোটেলের পদ্মঝি রেখে গেছে–হয় বন্ধক নয় বিক্ৰী। আপনি জানেন না কিছু? চক্কত্তি মশায়ের হোটেল যে সীল হবে আজই। মহাজন ও বাড়ীওয়ালার দেনা একরাশ, তারা নালিশ করেছিল। তা বাবু পুরোনো মালগুলো নিন না কেন? আপনাদের হোটেলের কাজে লাগবে–বড় ডেকচি, পেতলের বালতি, বড় গামলা। সস্তা দরে বিক্রী হবে–ও বন্ধকী মালের হ্যাংনামা কে পোয়াবে বাবু, তার চেয়ে বিক্রীই করে দেবো–
হাজারি এত কথা জানিত না। বলিল–পদ্ম নিজে এসেছিল?
শ্রীমন্ত বলিল–হ্যাঁ, ওদের হোটেলের একটা চাকর সঙ্গে নিয়ে। হোটেল সীল হলে কাল একটা জিনিসও বার করা যাবে না ঘর থেকে, তাই রেখে গেল আমার এখানে। বলে গেল এগুলো বন্ধক রেখে কিছু টাকা দিতেই হবে; চক্কত্তি মশায়ের একেবারে নাকি অচল।
বাসনের দোকান হইতে বাহির হইয়া অন্য পাঁচটা কাজ মিটাইয়া হোটেলে ফিরিতে অনেক বেলা হইয়া গেল। একবার বেচু চক্কত্তির হোটেলে যাইবে ভাবিয়াছিল, কিন্তু তাহা আর ঘটিয়া উঠিল না।
কুসুম এ কয়দিন এ বাসাতেই বিবাহের আয়োজনের নানারকম বড়, ছোট, খুচরা কাজে সারাদিন লাগিয়া থাকে। হাজারি তাহাকে বাড়ী যাইতে দেয় না, বলে–মা, তুমি তো আমার ঘরের লোক, তুমি থাকলে আমার কত ভরসা। এখানেই থাক এ কটা দিন।
বিবাহের পূর্বদিন হাজারি অতসীর চিঠি পাইল। সে কৃষ্ণনগর লোকালে আসিতেছে, স্টেশনে যেন লোক থাকে।
আর কেহ অতসীকে চেনে না, কে তাহাকে স্টেশন হইতে চিনিয়া আনিবে, হাজারি নিজেই বৈকাল পাঁচটার সময় স্টেশনে গেল।
ইন্টার ক্লাস কামরা হইতে অতসী আর তাহার সঙ্গে একটি যুবক নামিল। কিন্তু তাহাদের অভ্যর্থনা করিতে কাছে গিয়া হাজারি যাহা দেখিল, তাহাতে তাহার মনে হইল পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এক মুহূর্তে মুছিয়া লেপিয়া অন্ধকারে একাকার হইয়া গিয়াছে তাহার চক্ষুর সন্মুখে।
অতসীর বিধবা বেশ।
অতসী হাজারির পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া বলিল–কাকাবাবু, ভাল আছেন? ইনি কাকাবাবু–সুরেন। এ আমার ভাসুরপো। কলকাতায় পড়ে। অমন করে দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
–না—মা–ইয়ে, চলো–এস।
–ভাবছেন বুঝি এ আবার ঘাড়ে পড়ল দেখছি। দিয়েছিলাম একরকম বিদেয় করে আবার এসে পড়েছে সাত বোঝা নিয়ে–এই না? বাবা-কাকারা এমন নিষ্ঠুর বটে!
হাজারি হঠাৎ কাঁদিয়া উঠিল। এক প্ল্যাটফর্ম বিস্মিত জনতার মাঝখানে কি যে তাহার মনে হইতেছে তাহা সে কাহাকেও বুঝাইয়া বলিতে পারিবে না। মনের কোন স্থান যেন হঠাৎ বেদনায় টন টন করিয়া ভাঙিয়া পড়িতেছে। অতসীই তাহাকে শান্ত করিয়া নিজের আঁচলে তাহার চক্ষু মুছাইয়া প্ল্যাটফর্ম হইতে বাহির করিয়া আনিল। রেলওয়ে হোটেলের কাছে নরেন উহাদের অপেক্ষায় দাঁড়াইয়া ছিল। সে হাজারির দিকে চাহিয়া দেখিল হাজারি চোখ রাঙা, কেমন এক ভাব মুখে! অতসীর বিধবা বেশ দেখিয়াও সে বিস্মিত না হইয়া পারিল না, কারণ টেঁপির কাছে অতসীর সব কথাই সে শুনিয়াছিল ইতিমধ্যে–সবে আজ বছর তিন বিবাহ হইয়াছে তাহাও শুনিয়াছিল। অতসীদি বিধবা হইয়াছে এ কথা তো কেহ বলে নাই।
বাড়ী পৌঁছিয়া অতসী টেঁপিকে লইয়া বাড়ীর ছাদে অনেকক্ষণ কাটাইল। দুজনে বহুকাল পরে দেখা–সেই এঁডোশোলায় আজ প্রায় তিন বছর হইল তাহাদের ছাড়াছাড়ি, কত কথা যে জমা হইয়া আছে।
টেঁপি চোখের জল ফেলিল বাল্যসখীর এ অবস্থা দেখিয়া। অতসী বলিল–তোরা যদি সবাই মিলে কান্নাকাটি করবি, তা হলে কিন্তু চলে যাব ঠিক বলচি। এলাম বাপ-মায়ের কাছে বোনের কাছে একটু জুড়ুতে, না কেবল কান্না আর কেবল কান্না–সরে আয়, তোর এই দুল জোড়াটা পর তো দেখি কেমন হয়েছে–আর এই ব্রেসলেটটা, দেখি হাত–
টেঁপি হাত ছিনাইয়া লইয়া বলিল–এ তোমার ব্রেসলেট অতসী-দি, এ আমায় দিতে পারবে না–ককখনো না–
–তা হলে আমি মাথা কুটবো এই ছাদে, যদি না পরিস–সত্যি বলচি। আমার সাধ কেন মেটাতে দিবি নে?
টেঁপি আর প্রতিবাদ করি না। তাহার দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া গেল, ওদিকে অতসী তাহার ডান হাত ধরিয়া তখন ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ব্রেসলেট পরাইতেছে।
হাজারি অনেক রাত্রে তামাক খাইতেছে, অতসী আসিয়া নিঃশব্দে পাশে দাঁড়াইয়া বলিল—কাকাবাবু!
হাজারি চমকিয়া উঠিয়া বলিল–অতসী মা? এখনও শোও নি?
–না কাকাবাবু। আজ তো সারাদিন আপনার সঙ্গে একটা কথাও হয় নি, তাই এলাম।
হাজারি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিল–এমন জানলে তোমায় আনতাম না মা। আমি কিছুই শুনি নি। কতদিন গাঁয়ে যাই নি তো! তোমার এ বেশ চোখে দেখতে কি নিয়ে এলাম মা তোমায়?
অতশী চুপ করিয়া রহিল। হাজারির স্নেহশীল পিতৃহৃদয়ের সান্নিধ্যের নিবিড়তায় সে যেন তাহার দুঃখের সান্ত্বনা পাইতে চায়।
হাজারি সস্নেহে তাহাকে কাছে বসাইল। কিছুক্ষণ কেহই কথা বলিল না। পরে অতসী বলিল–কাকাবাবু, আমি একদিন বলেছিলাম আপনার হোটেলের কাজেই উন্নতি হবে–মনে আছে?
–সব মনে আছে অতসী মা। তুলি নি কিছুই। আর না কিন্তু এখানকার ইষ্টাটপত্র–সব তো তোমার দয়াতেই মা–তুমি দয়া না করলে–
অতসী তিরস্কারের সুরে বলিল–ওকথা বলবেন না কাকাবাবু ছিঃ–আমি টাকা দিলেও আপনার ক্ষমতা না থাকলে কি সে টাকা বাড়তো? তিন বছরের মধ্যে এত বড় জিনিস করে ফেলতে পারত অন্য কেউ আনাড়ি লোক? আমি কিছুই জানতুম না কাকাবাবু, এখানে এসে সব দেখে শুনে অবাক হয়ে গিয়েছি। আপনি ক্ষমতাবান পুরুষমানুষ কাকাবাবু।
–এখন তুমি এঁড়োশোলায় যাবে মা, না আবার শ্বশুরবাড়ী যাবে?
–এঁড়োশোলাতেই যাবো। বাবা-মা দুঃখে সারা হয়ে আছেন। তাদের কাছে গিয়ে কিছুদিন থাকব। জানেন কাকাবাবু, আমার ইচ্ছে দেশে এমন একটা কিছু করব, যাতে সাধারণের উপকার হয়। বাবার টাকা সব এখন আমিই পাব, শ্বশুরবাড়ী থেকেও টাকা পাব। কিন্তু এ টাকার আমার কোন দরকার নেই কাকাবাবু। পাঁচজনের উপকারের জন্যে খরচ করেই সুখ।
–যা ভাল বোঝ মা কয়ে। আমি তোমায় কি বলব?
–কাকাবাবু, আপনি বম্বে যাচ্ছেন নাকি?
–হ্যাঁ মা।
অতসী ছেলেমানুষের মত আবদারের সুরে বলিল–আমায় নিয়ে যাবেন সঙ্গে করে? বেশ বাপেঝিয়ে থাকবো, আপনাকে রেঁধে দেব–আমার খুব ভালো লাগে দেশ বেড়াতে।
–যেও মা, এবারটা নয়। আমি তিন বছর থাকব সেখানে। দেখি কি রকম সুবিধে অসুবিধে হয়। এর পরে যেও।
–ঠিক কাকাবাবু? কেমন মনে থাকবে তো?
–ঠিক মনে থাকবে। যাও এখন শোও গিয়ে মা, অনেক কষ্ট হয়েছে গাড়িতে, সকাল সকাল বিশ্রাম কর গিয়ে।
.
পরদিন বিবাহ। টেঁপির নরম হাতখানি নরেনের বলিষ্ঠ পেশীবদ্ধ হাতে স্থাপন করিবার সময় হাজারির চোখে জল আসিল।
কতদিনের সাধ–এতদিনে ঠাকুর রাধাবল্লভ পূর্ণ করিলেন।
বংশীধর ঠাকুর বরকর্তা সাজিয়া বিবাহ-মজলিসে বসিয়া ছিল। সেও সে সময়টা আবেগপূর্ণ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল–হাজারি-দা!
কাছাকাছি সব হোটেলের রাঁধুনী বামুনেরা তাহাদের আত্মীয়-স্বজন লইয়া যাত্রী সাজিয়া আসিয়াছে। এ বিবাহ হোটেলের জগতের, ভিন্ন জগতের কোনো লোকের নিমন্ত্রণ হয় নাই ইহাতে। ইহাদের উচ্চ কলরব, হাসি, ঠাট্টা ও হাঁকডাকে বাড়ী সরগরম হইয়া উঠিল।
বিবাহের পরদিন বর-কনে বিদায় হইয়া গেল। বেশীদূর উহারা যাইবে না। এই রাণাঘাটেই চূর্ণীর ধারে বংশীধর একখানা বাড়ী ভাড়া করিয়াছে পাঁচ দিনের জন্য। সেখানে দেশ হইতে বংশীধরের এক দূর-সম্পর্কের বিধবা পিসি (বংশীধরের স্ত্রী মারা গিয়াছে বহুদিন) আসিয়াছেন বিবাহের ব্যাপারে। বৌভাত সেখানেই হইবে।
.
হাজারি একবার রেলওয়ে হোটেলে কাজ দেখিতে যাইতেছে, বেলা আন্দাজ দশটা, বেচু চক্কত্তির হোটেলের সামনে ভিড় দেখিয়া থামিয়া গেল। কোর্টের পিওন, বেলিফ, ভিড়ের মধ্যে দাঁড়াইয়া আছে আর আছে রামরতন পালচৌধুৰী জমাদার। ব্যাপার কি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল মহাজনের দেনার দায়ে বেচু চক্কত্তির হোটেল শীল হইতেছে।
হাজারি কিছুক্ষণ থমকিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। তাহার পুরোনো মনিবের হোটেল, এইখানে সে দীর্ঘ সাত বৎসর সুখে-দুঃখে কাটাইয়াছে। এত দিনের হোটেলটা আজ উঠিয়া গেল! একটু পরে পদ্মঝি দু হাতে দুটি বড় বালতি লইয়া হোটেলের পিছনের দরজা দিয়া বাহির হইতেই একজন আদালতের পেয়াদা বেলিফের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট করিল। বেলিফ সাক্ষী দুজনকে ডাকিয়া বলিল–এই দেখুন মশায়, ওই মেয়েলোকটা হোটেল থেকে জিনিস নিয়ে যাচ্ছে, এটা বে-আইনী। আমি পেয়াদাদের দিয়ে আটকে দিচ্ছি আপনাদের সামনে।
পেয়াদারা গিয়া বাধা দিয়া বলিল–বালতি রেখে যাও—
পরে আরও কাছে গিয়া হাঁক দিয়া বলিল–শুধু বালতি নয় বাবু, বালতির মধ্যে পেতল কাঁসার বাসন রয়েছে।
পদ্মঝি ততক্ষণে বালতি দুটা প্রাণপণে জোর করিয়া আঁটিয়া ধরিয়াছে। সে বলিল–এ বাসন আমার নিজের–হোটেল চক্কত্তি মশায়ের, আমার জিনিস উনি নিয়ে এসেছিলেন, এখন আমি নিয়ে যাচ্ছি।
পেয়াদারা ছাড়িবার পাত্র নয়। অবশ্য পদ্মঝিও নয়। উভয় পক্ষে বাকবিতণ্ডা, অবশেষে টানাহেঁচড়া হইবার উপক্রম হইল। মজা দেখিবার লোক জুটিয়া গেল বিস্তর।
একজন মহাজন পাওনাদার বলিল–আমি এই সকলের সামনে বলচি, বাসন নামিয়ে যদি না রাখো তবে আদালতের আইন অমান্য করবার জন্যে আমি তোমাকে পুলিশে দেবো।
একজন সাক্ষী বলিল –তা দেবেন কেমন করে বাপু? ওর নামে তো ডিক্রি নেই আদালতের। ও আদালতের ডিক্রি মানতে যাবে কেন?
বেলিফ বলিল–তা নয়, ওকে চুরির চার্জে ফেলে পুলিশে দেওয়া চলবে। এ হোটেল এখন মহাজন পাওনাদারের। তার ঘর থেকে অপরের জিনিস নিয়ে যাবার রাইট কি? ওকে জিজ্ঞেস করো ও ভালোয় ভালোয় দেবে কিনা–
পদ্মঝি তা দিতে রাজী নয়। সে আরও জোর করিয়া আঁকড়াইয়া আছে বাতি দুটি। বেলিফ বলিল–কেড়ে নাও মাল ওর কাছ থেকে–বদমাইশ মাগী কোথাকার–ভাল কথায় কেউ নয়।
পেয়াদারা এবার বীরদর্পে আসিয়া গেল। পুনরায় একচোট ধস্তাধস্তির সূত্রপাত হইবার উপক্রম হইতেই হাজারি সেখানে গিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–পদ্মদিদি, বাসন ওদের দিয়ে দাও।
লজ্জায় ও অপমানে পদ্মঝিয়ের চোখে তখন জল আসিয়াছে। জনতার সামনে দাঁড়াইয়া এমন অপমানিত সে কখনো হয় নাই। এই সময় হাজারিকে দেখিয়া সে হাউ হাউ করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
–এই দেখোনা ঠাকুর মশায়, তুমি তো কতদিন আমাদের হোটেলে ছিলে–এ আমার জিনিস না? বলো না তুমি, এ বালতি কার?
হাজারি সান্ত্বনার সুরে বলিল–কেঁদো না এমন করে পদ্মদিদি। এ হোল আইন-আদালতের ব্যাপার। বাসন রেখে এসো ঘরের মধ্যে, আমি দেখছি তারপর কি ব্যবস্থা করা যায়–
অবশ্য তখন কিন্তু করিবার উপায় ছিল না। সে আদালতের বেলিফকে জিজ্ঞাসা করিল–কি করলে এদের হোটেল আবার বজায় থাকে?
–টাকা চুকিয়ে দিলে। এ অতি সোজা কথা মশাই। সাড়ে সাতশো টাকার দাবীতে নালিশ–এখনও ডিক্রী হয় নি। বিচারের আগে সম্পত্তি সীল না করলে দেনাদার ইতিমধ্যে মাল হস্তান্তর করতে পারে, তাই সীল করা।
আদালতের পেয়াদারা কাজ শেষ করিয়া চলিয়া গেল। বেচু চক্কত্তিকে একবারে ডাকিয়া হাজারি বলিল–আমার সঙ্গে চলুন না কর্তা মশায় একবার ইষ্টিশনের দিকে–আসুন, কথা আছে।
রেলের হোটেলে নিজের ঘরটিতে বেচু চক্কত্তিকে বসাইয়া হাজারি বলিল–কর্তা একটু চা খাবেন?
বেচু চক্কত্তির মন খারাপ খুবই। চা খাইতে প্রথমটা চাহে নাই, হাজারি কিছুতেই ছাড়িল না। চা পান ও জলযোগান্তে বেচু বলিল–হাজারি, তুমি তো সাত-আট বছর আমার সঙ্গে ছিলে, জানো তো সবই, হোটেলটা ছিল আমার প্রাণ। আজ বাইশ বছর হোটেল চালাচ্ছি –এখন কোথায় যাই আর কি করি। পৈতৃক জোতজমা ঘরদোর যা ছিল ফুলে-নবলায়, সে এখন আর কিছু নেই, ওই হোটেলই ছিল বাড়ী। এমন কষ্ট হয়েছে, এই বুড়ো বয়সে এখন দাঁড়াই কোথায়? চালাই কী করে?
–এমন অবস্থা হোল কি করে কর্তা? দেনা বাধালেন কী করে?
–খরচে আয়ে এদানীং কুলোতো না হাজারি। দু-বার বাসন চুরি হয়ে গেল। ছোট হোটেল, আর কত ধাক্কা সইবার জান ছিল ওর! কাবু হয়ে পড়লো। খদ্দের কমে গেল। বাড়ীভাড়া জমতে লাগলো–এসব নানা উৎপাত–
হাজারি বেচু চক্কত্তিকে তামাক সাজিয়া দিয়া বলিল–কর্তা, একটা কথা আছে বলি। আপনি আমার পুরনো মনিব, আমার যদি টাকা এখন থাকতো, আপনার হোটেলের সীল আমি খুলিয়ে দিতাম। কিন্তু কাল মেয়ের বিয়ে দিয়ে এখন অত টাকা আমার হাতে নেই। তাই বলচি, যতদিন বম্বে থেকে না ফিরি, আপনি আমার বাজারের হোটেলের ম্যানেজার হয়ে হোটেল চালান। পঁচিশ টাকা করে আপনার খরচ দেবো। (হাজারি মাহিনার কথাটা মনিবকে বলিতে পারিল না।) খাবেন দাবেন হোটেলে, আর পদ্মাদিদিও ওখানে থাকবে, মাইনে পাবে, খাবে। কি বলেন আপনি?
বেচু চক্কত্তির পক্ষে ইহা অস্বপনের স্বপন। এ আশা সে কখনো করে নাই। রেলবাজারের অত বড় কারবারী হোটেলের সে ম্যানেজার হইবে। পদ্মঝিও খবরটা পাইয়াছিল বোধ হয় বেচুর কাছেই, সেদিন সন্ধ্যাবেলা সে কুসুমের বাড়ী গেল। কুসুম উহাকে দেখিয়া কিছু আশ্চৰ্য্য না হইয়া পারিল না, কারণ জীবনে কোনোদিন পদ্মঝি কুসুমের দোর মাড়ায় নাই।
–এসো পদ্মপিসি বসো। আমার কি ভাগ্যি। এই পিঁড়িখানতে বোসো পিসি। পান-দোক্তা খাও? বসো পিসি, সেজে পানি–
পদ্মঝি বসিয়া পান খাইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া কুসুমের সঙ্গে এ-গল্প ও-গল্প করিল। পদ্ম বুঝিতে পারিয়াছে কুসুমও তাহার এক মনিব। ইহাদের সকলকে সন্তুষ্ট রাখিয়া তবে চাকুরি বজায় রাখা। যদিও সে মনে মনে জানে, চাকুরি বেশী দিন তাহাকে করিতে হইবে না। আবার একটা হোটেল নিজেরাই খুলিবে, তবে বিপদের দিনগুলিতে একটা কোনো আশ্রয়ে কিছুদিন মাথা গুঁজিয়া থাকা।