Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

শমা হর রঙ্গ মেঁ জলতি হৈ সহর হোনে তক

আমার শৈশব আবার ফিরিয়ে দাও। আমি বড়ো হতে চাই না। আমি ছোটোই থাকতে চাই। বড়োদের জগতে বড় জ্বালা। কোথায় গেল আমার সেই কল্পনার জগৎ! স্বপ্নের জগৎ! তখন আকাশ কত নীল ছিল! কত তারা ছিল! কত বিশ্বাস ছিল! তখন জীবন ঘিরে ভগবান ছিলেন। স্বর্গ ছিল আকাশের ওপরে। পাপ ছিল, পুণ্য ছিল। নির্ভরতার দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল, শৈশব—জগৎ।

কি যে হয়ে গেল! কি যে হয়ে গেলুম! একটি ঝুনো নারকোল। আয়নার সামনে দাঁড়াতে ভয় করে। নিজের চোখে চোখ পড়ে গেলে ভয়ে আঁতকে উঠি। লোকটা কে! ওই কি আমার সেই আমি! চোখের সাদা অংশে আগে কেমন সমুদ্রের নীল লেগে থাকত! এখন ঘোলাটে লাল। মণিদুটোয় অদ্ভুত এক দুরভিসন্ধি থমকে আছে। কিছুক্ষণ তাকালেই মনে হয়, আমি আর আমার হাতে নেই। জগৎ আমাকে গ্রাস করেছে। আমাকে এমন অনেক কিছুই শিখিয়েছে, যা আমার শেখা উচিত ছিল না।

ব্যঙ্গের মতো, উপহাসের মতো আমার শৈশবের ছবি ঝুলছে দেয়ালে। ভাই বোন বসে আছি পাশাপাশি, হাতে হাত রেখে। ছবি আছে, আমরা নেই। জগতের হাটে হারিয়ে গেছি দুজনে। নিজেরাই নিজেদের বেচে দিয়েছি। একজন হয়েছে দাস, আর একজন দাসী। দুজনেই ভাবছি, আমরা বেশ আছি। সুখে আছি, সুন্দর আছি। আমরা কেউ কিন্তু সুখে নেই, সুন্দরও নেই। মাঝে মধ্যে দেখা হয়। করুণ হাসির বিনিময় হয়। কেমন আছিস দাদা? কেমন আছিস বোন? দুজনেই ভালো আছি। কেউ কাউকে ঘাঁটাতে চাই না। দুঃখ বেরিয়ে আসবে। বাবুদের বাড়ির বৈঠকখানার মতো, আমাদের বাইরেটা বেশ সাজানো। এসো, বোসো, উঠে চলে যাও, অন্দরমহলে নাই বা ঢুকলে? তবু কখনো কখনো অসাবধানে, এ ওর মধ্যে ঢুকে পড়ে। বেরিয়ে আসে বিভ্রান্ত হয়ে।

শৈশব অতুলনীয়। বৈভব নেই কিন্তু প্রাচুর্যে ভরা। রাজার মতো ঘোরাফেরা। সবে যার চোখ ফুটেছে, তার চোখে পৃথিবীর সব কিছুই বড় মধুর। সবুজ আরও সবুজ, নীল আরও নীল। চারপাশের মায়ায় শিশু মশগুল। কে কার দাস, কে কার প্রভু, জানার দরকার নেই। সংসার কে চালায়, কীভাবে চলে, তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। অল্পেই সন্তুষ্ট। সামান্যই অসামান্য। দিনের পৃথিবী স্বপ্নে ভরা, রাতের পৃথিবী রহস্যে ঘেরা। সেখানে চাঁদের আলোয় পক্ষীরাজ এসে নামে রাজকন্যার ছাদে। সোনার পালঙ্কে মাথার কাছে সোনার কাঠি, পায়ের কাছে রুপোর কাঠি। শিশুর কল্পনায় তেপান্তরের মাঠ আজও আছে। শতচেষ্টাতেও সেখানে দেশলাই বাক্সের মতো পাশাপাশি বাড়ি বানানো যাবে না। সে জগতে সন্ধেবেলা গাছেরা চলে বেড়ায়। হাজার ওয়াটের বাতি জ্বালিয়েও ভূতেদের কাহিল করা অসম্ভব ব্যাপার। মানচিত্রে কোথাও আর কোনো অজানা দেশ নেই। শিশুর মানচিত্রে আছে। এমন দেশ আছে যেখানে রাস্তাঘাট সব সোনার। গাছে গাছে রুপোর পাতা, হিরের ফল। পাখি কথা বলে মানুষের ভাষায়। অ্যালিস খরগোসের গর্ত দিয়ে চলে যায় আজব জগতে।

শিশুর কাছ থেকে কিছু কেড়ে নেওয়া যায় না। শিশুকে রিক্ত করা যায় না। তার গলায় ক্রীতদাসের তাবিজ ঝোলানো যায় না। সে সম্রাট। সে স্বচ্ছন্দে রাজার টেবিলে বসে ভোজ খেতে পারে। আমি পারি না। আমার পৃথিবী শ্রেণি—বৈষম্যে ভরা। শিশু ভাবতেই পারে না, কেউ তাকে ঘৃণা করে, উপেক্ষা করে, অবহেলা করে। ভাবতেই পারে না, সে বড় হচ্ছে মিথ্যার পৃথিবীতে অভিনয়ের পৃথিবীতে। সে বিশ্বাস করে, সবাই তাকে ভালোবাসে, সবাই তাকে আগলে রাখবে। যে কোল আদর করে তুলে নিয়েছে, সে কোল অনাদরে আর ফেলে দেবে না।

মা যেদিন হঠাৎ মারা গেলেন, সেদিন ভাই—বোন স্তব্ধ বিস্ময়ে তাঁর মাথার সামনে। এর নাম মৃত্যু! একেই বলে চিরকালের মতো চলে যাওয়া! আমার জন্যে যে সোয়েটার বুনছিলেন, তা আর শেষ হবে না? আচারের শিশি রোজ সকালে কে রোদে দেবে! কে আবার তুলে নেবে বেলা পড়ে এলে! স্কুল থেকে ফিরে এলে কে আমাদের খেতে দেবে! রোজ রাতে কে আমাদের কোলের কাছে টেনে নিয়ে দেশ—বিদেশের গল্প শোনাবে! দুজনের কেউই আমরা বিশ্বাস করিনি, মা চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। ফুল আর মালা দিয়ে সাজিয়ে মাকে যখন নিয়ে গেল, আমরা দুজনে তখন বাড়ির রকে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছি। কে যেন বললেন, আরে বোকা! মা তো তোদের স্বর্গে গেলেন। যখনই ডাকবি তখনই আসবেন, সোনার আঁচল জড়িয়ে আগুনের শরীর নিয়ে। শিশুর বিশ্বাসে কথাটা একেবারে মিথ্যে মনে হয়নি। বড়দের চোখে ধুলো দিয়ে মাঝরাতে আমরা দুজনে ছাদে উঠে মাকে ডাকতুম। মা এসো, তোমার আগুনের শরীর নিয়ে, সোনার শাড়ি পরে। মা ভীষণ পান খেতে ভালোবাসতেন। আমার বোন খুব যত্ন করে দু’খিলি পান সেজে নিয়ে যেত। আকাশে কালপুরুষ হেলে যেত। সপ্তর্ষি নেমে যেত পশ্চিমে। কোথায় মা! কোথায় তাঁর আগুনের শরীর। ঝাঁ করে উল্কা নেমে আসত। বোন আমার শরীরের পাশে সরে আসত ভয়ে। এক সময় ক্লান্ত হয়ে তুলসী গাছের টবে খিলি দুটো রেখে, বোন আমার ধরা ধরা গলায় বলত, মা তুমি খেয়ো। চুন আমি মাপ করে লাগিয়েছি। তোমার জিভ পুড়ে যাবে না। ভোর না হতেই ছুটে এসে দেখতুম, খিলি দুটো আছে না নেই! যেমন খিলি তেমনি পড়ে আছে। শিশির—বিন্দু লেগে আছে ফোঁটা ফোঁটা। বোন বলত, দ্যাখ দাদা, রাত কেমন কেঁদেছে!

মা এলেন, তবে অন্যরূপে। অন্য চেহারা, ভিন্নস্বভাব। আমরা ভাই—বোন নির্জনে বলাবলি করতুম, এ কি হল রে! মায়ের আসনে কে এসে বসল! সন্দেহের চোখে দুজনে দূর থেকে সেই অপরিচিতাকে দেখতুম। দেখতুম ধীরে ধীরে সব কিছু কেমন তাঁর অধিকারে চলে যাচ্ছে। বড় হয়ে বুঝেছি, এর নাম সংসার, এরই নাম মানুষ। সন্তানের চেয়ে কাম বড়। স্মৃতির চেয়ে ভোগ বড়। তাজমহল এই কারণেই পৃথিবীতে একটি।

যে ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়িতে রান্না করতেন, একদিন দুপুরে এক জোচ্চর এসে তাকে ঠকিয়ে গেল। পেতলের চাকতিকে সোনার চাকতি বলে সেই গরিব মহিলার সব সঞ্চয় ফাঁক করে উবে গেল। সেইদিনই আমরা বুঝে গেলুম, পৃথিবীর সব কিছুই নির্ভেজাল সুন্দর নয়। সব পাখিই গান গায় না, সব গাছই ছায়া লোটায় না, সব ফলই সুস্বাদু নয়। বিষ—ফলও আছে। এখন বুঝি লোভ আছে বলেই মানুষ ঠকে। অথচ লোভ এমন জিনিস যাকে কিছুতেই সংযত করা যায় না। বেড়াল এত মার খায়, তবু হেঁসেলে ঢোকে মাছ কি দুধের লোভে।

একদিন তখমাধারী, জাঁদরেল এক ভদ্রলোক আমাকে বেকায়দায় ফেলে আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় শেফার্স কলমটি চুরি করে নিয়ে গেলেন। কলমটি পেয়েছিলুম পৈতেতে। ভদ্রলোক দুপুরের দিকে এসেছিলেন। বসলেন পড়ার টেবিলে, আমি তখন লিখছিলুম। গরম কাল। গ্রীষ্মের ছুটি। ঘর্মাক্ত মানুষটি স্মিত হেসে বললেন, এক গেলাস জল খাওয়াবে খোকা! দেবতার মতো চেহারা। গৌর বর্ণ। খোলা কলমটি টেবিলে রেখে ভেতরে গেলুম জল আনতে। জলপানের পর বললেন, একটা পান খাওয়াবে? সামনের দোকানে গেলুম জর্দা—পান আনতে। পানপর্ব শেষ করে শুরু হল নানা প্রশ্ন, কী পড়, কোথায় পড়? মৃদু হাসি লেগে আছে মুখে। অবশেষে তিনি বিদায় নিলেন। জানালা দিয়ে দেখছি, লম্বা রাস্তা ধরে তিনি এগিয়ে চলেছেন রাজার মতো। হঠাৎ কলমের কথা মনে পড়ল। আমার কলম? কই টেবিলে নেই তো! তা হলে? আমি কি ভেতরে কোথাও রেখে এসেছি। তোলপাড় করে খুঁজতে খুঁজতেই তিনি মোড় ঘুরে অদৃশ্য। সহজে যাঁকে সন্দেহ করা যায় না, তাঁর পকেটে চড়ে চলে গেল আমার প্রাণের কলম। এখন জানি, বেশ ভালোই জানি পৃথিবীতে আমরা সবাই বড় অরক্ষিত। এখন বুঝেছি, মন আর অনুভূতির চেয়ে জিনিস অনেক মূল্যবান। আমি চাই, আমার ভালো লেগেছে, যেমন করেই হোক আমাকে তা পেতে হবে। মানুষ এই ভাবেই মানুষের সম্পত্তি ধরে টানাটানি করে। এর রাজ্য ঝাঁপিয়ে পড়ে আর এক রাজ্যের ওপর। অন্যের মুখের গ্রাস কেড়ে নিজের উদর পূর্তি। কলমটি চুরি যাওয়ার পর বুঝেছিলুম—পৃথিবী এমন জায়গা যেখানে চোর আর সাধুকে সহজে আলাদা করার উপায় নেই। সকালে এক বাউল আসতেন গান গাইতেন :

জগতে লোক চেনা ভাল মুখ দেখে

মুখে সবাই পরম বন্ধু

হৃদয় ভরা বিষ।।

একদিন পাড়ায় হই হই কাণ্ড। এক বড়োলোক তাঁর বালক ভৃত্যকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছেন। অপরাধ? ঝুল ঝাড়তে গিয়ে ঝাড়লণ্ঠন ভেঙে ফেলেছে। যাঁকে ঈশ্বর এত দিয়েছেন, তিনি একটা ঝাড়লণ্ঠনের জন্য একটি জীবনদীপ এক ফুঁয়ে নিবিয়ে দিলেন! সেদিন অবাক হয়েছিলুম, আজ আর হই না। এখন বুঝেছি পৃথিবীতে জীবনের চেয়ে স্বার্থ বড়। ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য মানুষ সহজেই পশু হয়ে যেতে পারে। ভাই ভায়ের গলায় ছুরি চালাতে পারে। স্ত্রী স্বামীকে, স্বামী স্ত্রীকে বিষ দিতে পারে। রবার্ট ফ্রস্টের একটি লাইন মনে গেঁথে গেছে, Blood has been harder to dam back than water। বাঁধ বেঁধে জল আটকানো যায়, রক্তের স্রোত অত সহজে রোকা যায় না। যুগ যুগ ধরে মানুষ মানুষকে মেরে আসছে, It will have outlet, brave and not so brave।

সেদিন সবাই বলেছিল, বড় মানুষটির খুব সাজা হবে। ফাঁসি হয়ে যাবে। কিছুই হল না। অনেক টাকায় ছেলের বাপের সঙ্গে সহজ রফা হয়ে গেল। এখন জেনে গেছি, জীবনের চেয়ে অর্থ অনেক দামি। তা না হলে পিতা কি করে কন্যাকে বেচে দেন! স্বামী কি করে স্ত্রীর হাত ধরে বেশ্যালয়ে তুলে দিয়ে আসে! মা কীভাবে শিশুকে আফিং খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফুর্তি করতে ছোটে।

কত কেতাব তো লেখা হল, কত মহাপুরুষ তো এলেন আর গেলেন। সংখ্যাহীন মন্দির, মসজিদ আর কাবায় মানুষের নিত্য মাথা ঠোকাঠুকি তবু পৃথিবীর চেহারা কেন পালটায় না। আমার শৈশব তুমি ফিরিয়ে দাও। সেই সবুজ খেলার মাঠ। দু’ধারে সাদা দুই গোলপোস্ট। সেই সব ছবির বই। ঈশপস ফেবলস। কাক নুড়ি ফেলছে একটি একটি করে জলের কলসিতে। রেশমের মতো এক মাথা চুল। দু চোখ ভরা বিস্ময়। কাঁচা শালপাতা মোড়া তেঁতুলের আচার। ফিরিয়ে দাও আমার ড্যাঙগুলি, লাট্টু। দু চোখ ভরে দাও দুঃস্বপ্নহীন নিদ্রা। আমার বিশ্বাস ফিরিয়ে দাও, ফিরিয়ে দাও আমার নিষ্পাপ জীবন। আমি আর বড় হতে চাইব না।

আমার প্রার্থনা কেউ শুনবে না। গম—এ হস্তী—কা, অসদ, কিস—সে হো জুজ মর্গ ইলাজ/শমা হর রঙ্গ—মে জলতি হৈ সহর হোনে তক।। মৃত্যু ছাড়া জীবনযন্ত্রণার আর কী ওষুধ আছে, আসাদ/প্রদীপকে তো সবরকমের জ্বালা জ্বলতেই হবে ভোর হওয়া পর্যন্ত। [অনু : আবু সয়ীদ আইয়ুব]

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress