আকাশ পাতাল – ১৭
জন্তু হয়ে জন্মেছি, মানুষ হয়ে মরতে চাই
‘বইপত্তর পড়ছ পড়ো, সেই সঙ্গে নিজের মনটাকেও পড়তে শেখো।’ এক মহাপুরুষ একবার আমাকে বলেছিলেন। বর্ষাকালে উশ্রী নদীর ধারে সেই সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আজ থেকে অন্তত তিরিশ বছর আগে তাঁরই আস্তানায়। এক পাশে বর্ষার স্ফীত উশ্রী সগর্জনে নামছে নীচে। অন্য তিন পাশে গভীর অরণ্যানী। সামান্য এক আট চালা হল সাধুর আস্তানা। মৌনী সাধু। সঙ্গে এক শিষ্য। একপাশে স্লেট—পেনসিল। মুখে প্রশ্ন, উত্তর লিখিত। দক্ষিণ ভারতীয় সন্ন্যাসী ইংরেজিতে মনে হয়েছিল খুবই ব্যুৎপন্ন। আমার প্রশ্ন ছিল অনেক। উত্তর এসেছিল একটি—’রিড ইয়োর মাইন্ড।’
সেই নির্দেশ এতকাল ভুলেছিলাম খুবই স্বাভাবিক কারণে। আলো থেকে সরে এলেই অন্ধকার। ক্ষণ—সান্নিধ্যের আলোক স্পর্শে ভেতরটা তেমন উদ্ভাসিত হয়নি। তা ছাড়া জীবনের একটা নেশা মানুষকে বুঁদ করে রাখে। কিছু করার নেশায় করা। চলার নেশায় চলা। ঘোরে ঘুরে বেড়ান। দিন আসছে। দিন চলে যাচ্ছে। অজস্র কথার স্রোত বইছে উশ্রীর বর্ষার ঢলের মতো। জীবনের ওপর দিয়ে যে সময় বয়ে গেল অতীতের দিকে, চলমান ক্যামেরায় সেই সময়কে যদি ধরে রাখা হত, আর এখন যদি পর্দায় ফেলে দেখানো হত, তা হলে বোঝা যেত কি তামাশায় কেটে গেছে কাল! হাত নেড়েছি, মাথা নেড়েছি। চোখের ভঙ্গি করেছি। অন্তঃসারশূন্য বড়ো বড়ো কথা বলেছি। অকারণে নিজেকে জাহির করেছি। কখনো বিমর্ষ, হতাশ। কখনো উল্লসিত। কখনো ভাঁড়ু, কখনো চাটুকার। কখনো প্রভু, কখনো ক্রীতদাস! কখনো চরিত্রবান, কখনো দুশ্চরিত্র। কখনো আদর্শবাদী, কখনো চরম আদর্শভ্রস্ট। মন হীন, মননহীন একটা দেহের সংকল্প শূন্য অস্তিত্ব। সময় কী ভাবে, কী কাজে চলে গেল বোঝাই গেল না। ‘অ্যাকশান রিপ্লে’ দেখে একজন ব্যাটসম্যান যেমন বুঝতে পারেন, বলটা কীভাবে খেলা উচিত ছিল। অতীত জীবনের ‘অ্যাকশান রিপ্লে’ সম্ভব হলে, জীবনটাকে কীভাবে খেলানো উচিত ছিল বোঝা যেত। চলে যাওয়া তিরিশটা বছরের প্রাপ্তি, হাত পা ছোঁড়ার ক্লান্তি আর স্বাভাবিক প্রাচীনতা। বাতি জ্বলতে জ্বলতে ক্ষইতে থাকে ঠিকই, কিন্তু আলো দিয়ে যায়। সে আলোয় বসে কেউ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে, কেউ নোট জাল করে। যে যাই করুক, বাতি গলতে গলতে আলো দেয়। জীবন তিরিশ কি চল্লিশ বছরের মতো ক্ষয়েই গেল, কেউ কিছু পেল না।
‘রিড ইয়োর মাইন্ড।’ সেই মন পড়তে গিয়ে প্রতি মুহূর্তের উপলব্ধি, জীব—জগতে মানবজীবন হয়তো হিরের মতোই দুর্লভ; কিন্তু আকাটা হিরে, ‘আনকাট ডায়মন্ডে’র যেমন কোনো দাম নেই, অপরিস্রুত, বিকাশহীন, মত্তপ্রায় জীবনেরও কোনো দাম নেই। জীবন নামক শক্তি পোকার মতো নড়াচড়া করিয়েছিল, ঘুরিয়েছিল, ফিরিয়েছিল, সবাই বলেছিল মানুষটা বেঁচে ছিল। একদিন সেই শক্তি উবে গেলেই মৃত্যু। একজন ছিল, একজন নেই, এর বেশি কিছু নয়। গণনার সংখ্যা হয়ে বেঁচে থাকার এই গ্লানি সময় সময় অসহ্য লাগলেও, ক্ষুদ্র স্বার্থের ছাতাটি খুলে মানুষ কেমন নিজের খেয়ালে টুকুর টুকুর করে জীবনের শেষ অধ্যায়ের দিকে এগিয়ে চলে! জীবন নাটকে আমার ভূমিকাটা তাহলে কী ছিল! কার লেখা জানি না, একটি কবিতা খুঁজে পেয়েছি, যাতে আমার এই প্রশ্নের উত্তরে আছে :
পাঁচটা মিনিট সময় দাও
একটু সেজে আসি।
ভূমিকা! এখন ভূমিকাটা কি?
একটু ধরিয়ে দেবে!
এই তো একটু আগেই
আমার ছিল ভাঁড়ের সাজ,
একটা বেলুনের মত ফুলো লোক
তার সঙ্গে বসে গিলছিলাম মদ
ওই মোড়ের পানশালায়
বলছিলাম মজার মজার কথা
পুরছিলাম আরও হাওয়া
ওই বেলুনটায়, কিসের আশায়!
জানো কী তা? টাকা, টাকা
আমি হাসছি, খুব হাসছি
ওদিকে আমার স্ত্রী রোগশয্যায়
যন্ত্রণায় কুঁকড়ে কুঁকড়ে
হয়তো চাইছে জল, একটু জল
কে দেবে? আমি তো তখন ভাঁড়ের ভূমিকায়
পাঁচটা মিনিট সময় দাও একটু সেজে আসি
এবার কী? এবার ভূমিকাটা কী?
একটু আগে ছিল আমার বন্ধুর বেশ
একটি লোক, বেশ বড় লোক
তাকে নিয়ে বেড়িয়ে এলাম
কেন জানো? সেই একই ব্যাপার, উমেদারি।
আমি যখন ঘুরছি বেশ মজা করে ঘুরছি
ঠিক সেই সময় আমার স্ত্রী
একটু জলের আশায় হাঁ ক’রে, খাবি খেয়ে
জানি না, আমার কথা ভাবতে ভাবতে
অথবা না ভাবতে ভাবতে চলে গেল।
আর আমি, ঠিক সেই সময় ফুরফুরে বাতাসে
লোকটির পাশে পাশে বেড়াতে বেড়াতে
আমাদের দাম্পত্য প্রেমের কথা বেশ ফেনিয়ে
বেশ গুছিয়ে গাছিয়ে বলে চলেছি।
পাঁচটা মিনিট, বেশি না ঠিক পাঁচটা মিনিট
সময় আমাকে দাও
আমি সেজে নেবো নিখুঁত সাজ
কেবল বলে দাও ভূমিকাটা কী?
যে সব দায়িত্ব, আদর্শ আর মূল্যবোধের অছি করে জীবন আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিল, তার কোনো কিছুরই মর্যাদা আমার পক্ষে রাখা সম্ভব হয়নি। সছিদ্র চালুনি থেকে সবই ঝরে পড়ে গেছে। এতকাল পরে নিজের মন পড়তে গিয়ে নিজেই আঁতকে উঠছি। মানুষের অবয়বে ঢুকে আছে জন্তুর মন। কখনো ঈর্ষায় কাতর, লোভে অশান্ত, ক্রোধে উন্মাদ, অহংকারে অন্ধ, স্বার্থে সংকুচিত। মহাপুরুষের ছবিতে মালা ঝুলিয়েছি বেহুঁশ অবস্থায়। হাজার বার পড়েছি, মহাজন যেনো গতঃ স পন্থাঃ। তাতে আমার ঘোড়ার ডিম হয়েছে। সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়েও সেই একই প্রশ্ন, সীতা কার বাবা! পেঁয়াজের খোসার মতো নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে দেখেছি, পরতে পরতে খুলে আসছে সংস্কারের খোসা, স্বার্থের খোসা, সংকীর্ণতার গোলাপি আবরণ, কামনার ঝাঁঝালো গন্ধ, অন্তঃকরণের অংশ কিন্তু খুঁজে পাওয়া গেল না। জীবনের প্রাচীরে কুৎসিত এক বহুরূপী, ক্ষণে ক্ষণে রং পালটে চলেছে। প্রতিবেশীরা একেই বিশ্বাস করেছে, পিতা এর কথাই ভেবেছেন, বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে, একটি মেয়ে এসে এরই গলায় মালা পরিয়ে বলেছে, তুমিই আমার স্বামী, সন্তান এসে হাত ধরেছে পিতা বলে, বন্ধু এসে বলে গেছে গোপন কথা। দেশ ভেবেছে দেশাত্মবোধী, কর্ম ভেবেছে কর্মী, ধর্ম ভেবেছে ধার্মিক। আসলে আমি কিছুই না। শ্বাসে গ্রহণ করেছি পৃথিবীর বায়ু, প্রশ্বাসে ফেলেছি বিষ।
আমি জন্তু হয়ে জন্মেছি, মরতে চাই মানুষ হয়ে।