আকাশে পাখিরা
কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অবনীশ আর সীতার সঙ্গে বহুকাল পরে দেখা হল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাট, ওরা বলে কানেটিকাট স্টেটে। বাঙালি ছেলে অবনীশ আর আমেদাবাদের মেয়ে সীতার প্রেম আমাদের মধ্যে বেশ জল্পনাকল্পনার বিষয় ছিল। আন্তঃপ্রদেশীয় বিয়ে! অবনীশের বাড়ি শেষ পর্যন্ত মানবে কি না, সীতার বাড়ি থেকে আপত্তি উঠবে কি না, ওরা দুজনে শেষ অবধি অ্যাফেয়ারটা টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না? তা, সত্যিই কোনো পক্ষ বাদ সেধেছিলেন কি না জানি না। অবনীশ চটপট মার্কিন দেশে একটা ফেলোশিপ জোগাড় করে চলে গেল। বছরখানেক পরে গেল সীতা। ও বরাবরই দুর্ধর্ষ ছাত্রী ছিল। সব দিক থেকেই চৌখশ। প্রথমে গেল কলম্বিয়া, কী সব ম্যানেজমেন্ট-টেন্ট করল। তারপর দু-জনেই এই কানেটিকাট। ওখানেই ওদের বিয়ে, ওখানেই ওদের স্থিতি। এই তিরিশ বছরে একবারও আসেনি। কিংবা হয়তো এসেছে আমি জানি না। এলে আমাকে জানাবে না এটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে ঠিকই। কিন্তু এতগুলো বছর ধরে নতুন বছরের কার্ড আর পুজোর সময়ে সংক্ষিপ্ত চিঠি বাদে যাদের মধ্যে সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন, এ ধরনের খেলাপ তাদের মধ্যে হতেই পারে। তা সত্ত্বেও আমি যখন বিশেষ কাজে নিউইয়র্ক যাবার একটা সুযোগ পেলুম, তখন আমার প্রথম। কাজই হল ওদের একটা বিস্তারিত চিঠি লেখা, পরিবর্তিত ফোন নম্বর সহ। ঠিক তেরো দিন পরে ওদের ফোনটা পাই।
কী রে লম্বু, আমাদের মনে পড়ল তাহলে?
তাহলে তুই বাড়ি আছিস?, আমি বলি।
কেন? রাত এগারোটায় বাড়ি থাকব না কেন?
আমি হাসি—অবনীরা শুনেছি বাড়ি থাকে না!
একটু সময়! তারপয়েই অবনীশের মার্কামারা হাহা হাসি। যেটাকে আমরা হাহাকার বলতুম। যাক, হাসিটা যখন এক আছে, মানুষটাও খুব বদলাবে না। এই সময়ে বোধহয় অবনীশের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল সীতা।
উদোয়, তুমার তো ওপন টিকেট। আমাদের এখানে অন্তত মাসখানিক থাকবে কিন্তু।
সীতার ভাঙা বাংলা আমরা বরাবরই উপভোগ করেছি। মজার এবং মিষ্টি, দুটোই। জানি না বাঙালিরা যখন অন্য ভাষা এমনি ভাঙা ভাঙা বলেন, তখন সেই ভাষাভাষীরা সেটা আমাদের মতো সানন্দে উপভোগ করেন কি না। আমরা নিজেরা কিন্তু খুবই অপ্রস্তুত হই। লজ্জা পাই। সীতা দিব্যি স্মার্টলি তুমার, অ্যাকন, কেন কি, হামরা চালিয়ে গেল।
আরও কিছুক্ষণ ওদের উচ্ছসিত আলাপ চলল। মাঝখানে এতগুলো বছর কেটে গেছে বলে মনে হল না। আমার এক মেয়ে, এক ছেলে শুনে ওরা জানাল ওদের দুই ছেলে, এক মেয়ে। টেলিফোনের তারের মধ্যে দিয়ে যেন উৎসাহের ঝড় বয়ে গেল কিছুক্ষণ।
অবনীশ বলল, চলে আয়। আমরা পথ চেয়ে বসে আছি। তোকে সময় দিতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না। আমি একটু-আধটু ছুটি ম্যানেজ করতে পারব। সীতাটারই একটু মুশকিল…।
কথা শেষ হল না, সীতা বলে উঠল, অবনী কীকর্ম একলা ষাঁড় থেকে যাচ্ছে দেখেছ? আমি মোটেই অসুবিধে করব না। আমরা তিনজনে খুব ঘুমব।
বুঝতেই পারছেন এ ঘুম সে ঘুম নয়। এ হল ঘোরানোর উদাত্ত প্রতিশ্রুতি। সুতরাং অফিস ম্যানেজমেন্টের কাছে দরবার করি। আপনাদের কাজ ষোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা করে দেব কথা দিচ্ছি। কিন্তু পত্রপাঠ আমাকে ফিরতে বলবেন না। প্লিজ!!
ম্যানেজমেন্ট মৃদু হেসে বললেন, উই আন্ডারস্ট্যান্ড। ইউ হ্যাভ স্কোর্স অব রিলেটিভস অ্যান্ড ফ্রেন্ডস দেয়ার।
গৃহিণী নিপুণভাবেই সব গুছিয়ে দিলেন। কিন্তু অবিকল, যেতে নাহি দিব-র স্টাইলে। চক্ষু ছলছল। কারণটা অবশ্য আলাদা। তিনি কেঁদেছিলেন বিশুদ্ধ পতিবিরহে। ইনি ফোঁপাচ্ছেন মজা মারতে নিজে যেতে পারছেন না বলে। বাড়ির বিচ্ছু দুটোও সমানে তালে তাল দিচ্ছে। রিনি বলল, বলছ দেড় মাস, কিন্তু ভিসা তিন মাসের। দেড় মাসের বেশি থেকেছ তো বাবা আমিও অদূর ভবিষ্যতে জার্মানি কি ইংল্যান্ডে সেটল করছি। তার ভাই রণো আবার এক কাঠি বাড়া। সে বলল, আমি তো ভাবছি হায়ার সেকেন্ডারিটা হলেই জি. আর. ই, তারপরই স্টুডেন্ট ভিসা। এবং মার্কিন মুলুক। এখন সেটাই করব না এই পচা কাঁকুড়গাছিতে পচা বাবার পচা বাড়িতেই পচব, সে সিদ্ধান্তটা নির্ভর করছে বাবার সময়মতো ব্যাক করার ওপর। আমি মনে মনে বলি—বাবার কিছুর ওপরই কিছু নির্ভর করছে না। বাপধন, সেটা শর্মা জানে।
প্রসঙ্গত আমার মেয়েটি যাদবপুরে সিভল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। অঙ্কে খুব মাথা ছিল। আমার পরামর্শ ছিল অঙ্ক নিয়ে পড়া। মুচকি হেসে ইঞ্জিনিয়ার হতে চলে গেল। ছেলে শুনেছি চান্স পেলে ডাক্তারিও পড়তে পারে। আবার না পেলে ইতিহাসও পড়তে পারে। ওদের ব্যাপারস্যাপার আমি বুঝি না।
আমার মা আবার আর এক। তিনি বললেন, আমিও তাহলে বাপের বাড়ি চলে যাব। বোঝে ঠ্যালা। চুয়াত্তর বছর বয়সে মহিলা অরিজিনাল বাপ-এর বাড়ি কোথায় পাবেন তা তিনিই জানেন।
যাই হোক, এদের কাটিয়ে তো কোনো মতে ব্রিটিশ প্লেনে ওঠা গেল। এ ঘটনা এগারোই সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর পাঁচ বছর আগেকার। কাজেই সহযাত্রীদের আগাপাশতলা জরিপ করার দরকার পড়েনি। ডাউনটাউন নিউ ইয়র্কে ঘোরবার সময়ে কোনো সন্দেহজনক আঁশটে গন্ধও পাইনি। বেশি কথা কি ওই ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের দ্বিতীয় টাওয়ারটার পনেরো তলাতেই আমার বেশিরভাগ কাজকর্ম ছিল।
প্রতিদিনই ফোনে অবনীশ আর সীতার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছিল। আমার হোটেলে ফেরার ওয়াস্তা। পি পি করে ফোন বাজবে।
কী রে লম্বু! ব্যাটা সেটল করিচিস?
এক্ষুনি সেটল করব কী রে?
আরে ফর দা টাইম বিয়িং। চান করিচিস? এক পাত্তর নিয়ে বসিচিস?
সময় দিলি কোথায়? এই তো ঢুকছি।
এই ঢুকছিস বলে নাঙ্গাবেলার বন্ধু ফোন করবে না?
করবে না কেন, কিন্তু চান টান, সেটল-ফেটল, এক্সপেক্ট করবে না। …
কিংবা হয়তো সত্যিই চান সেরে এক পেগ নিয়ে বসেছি, সঙ্গে সোনালি চিংড়ি ভাজা। ফোন এসে গেল, উদোয় আছে?
উদয়ের ঘরে আর কে থাকবে ম্যাডাম? বুধোয়?
আমি আর অপেক্ষার সহ্য হচ্ছে না, তাড়াতাড়ি কোরো।
এতই যদি অধৈর্য তো গ্যাঁটের ডলার খর্চা করে একটা রিটার্ন-টিকিট কিনে পাঠিয়ে দিলেই তো পারতেন দেবী! দিব্যি হলিডে করতে আসতে পারতুম! যে অফিস পাঠিয়েছে তার ফাইল বগলে সারা মাস চরকি-নাচন নাচতে হত না।
সরি উদোয়। যু আ রাইট। নেক্সট টাইম আর ভুল করছি না। যা হোক, ছাড়া পেলেই আসছ তো?
আর কোন চুলোয় যাব দেবী, এক কাজিন থাকে ক্যালিফোর্নিয়া, শ্বশুরবাড়ির দিকের এক আত্মীয় থাকেন ফ্লরিডা, তা সেসব জায়গায় যাবার কড়ি আমার নেই আজ্ঞে।
যাক, তুই সেই আগের মতোই আছিস রে লম্বু!–অবনী বোধ হয় শুনছিল, ফট করে বলে উঠল।
তুইও তো আগের মতোই আছিস। ঠিক আড়ি পেতেছিস? তোর শ্যোন চক্ষু শ্যোন কর্ণ ফাঁকি দিয়ে যে বউ একটু পরকীয় করে নেবে তার উপায়ও রাখিসনি।
দুজনেরই ইচ্ছে আমাকে নিতে নিউ ইয়র্ক আসে। একটু শহর দেখায়। কিন্তু এখানে আমার অফিসতুতো এক পূর্বতন সহকর্মী থাকেন। বিপত্নীক মানুষ, দুই ছেলের একজন কানাডার মনট্রিঅলে। আর একজন ইউ.এস.এ-তেই এইমস-এ। নিউ ইয়র্কে কেউই থাকে না। ভদ্রলোক আমাকে কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে নিউ ইয়র্কের থিয়েটার, পার্ক, মিউজিয়াম, স্টাচু অফ লিবার্টি, মায় লং আইল্যান্ড পর্যন্ত ঘুরিয়ে দেখাবার ভার নিয়েছেন। তাঁর উৎসাহেই বা জল ঢালি কী করে? এক মানুষ, সঙ্গী পেয়ে আর ছাড়তে চান না।
সেই মি, বাগচিই আমাকে অ্যামট্রাকের নীলবরণ ট্রেনে তুলে দিলেন। আমাদের এখানে একদম গোড়ায় ইলেকট্রিক ট্রেনগুলো এইরকমই ছিল। শুধু রংটা আলাদা। হুশশশ করে মফসসলি প্রকৃতি দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই।
সবুজ-স্টেশনে দুই মূর্তি হাজির। অবনীশের মাথা প্রায় ফাঁকা। কিন্তু চেহারাটি একেবারে পেটা। পঞ্চাশোধেঁ পেটে-ফুটবল নেই সফল স্বজাতীয় আমি দেখিনি। বিশ্ব পরিসংখ্যান বলছে, বাঙালিদের মধ্যে হার্ট ট্রাবল বেশি, কারণ এই ফুটবলের ধাক্কা। সীতার সবচেয়ে সৌন্দর্য ছিল তার চুলে। সেই চুল দেখি কেটে ফেলেছে। তা ছাড়া একটু গায়ে সেরেছে। গাল-টালগুলো একটু বয়ঃভারী। ব্যাস।
কী করে চেহারাটা এমন ফিট রেখেছিস রে?
বন্ধু বলল, খর্চা আছে! খাটনি আছে!
আমাদের শুভদীপ য়ুনিভার্সিটি ব্লু ছিল, মনে আছে? এখন তাকে দেখলে চিনতে পারবি না। ছ-ফুট ব্যাসের একটি প্রকাণ্ড বল।
অবনীশ গর্বের হাসি হেসে আমার পিঠ চাপড়ে দিল।
তোকেও কিছু আধবুড়ো লাগছে না, তবে এইবেলা যদি সাবধান না হোস তো ফুটবল না হোক একটি টেনিস বল তোর প্রাপ্তি হবেই। শরীরটা আলগা হতে থাকবে। তার হাইটটাই এখনও তোকে বাঁচাচ্ছে।
ওকে আশ্বস্ত করি। আমিও মোটামুটি স্বাস্থ্য-সচেতন। একটু-আধটু যোগাসন করি, হাঁটাহাঁটিও করি। শুভদীপকে দেখে আমার ভয় ধরে গেছে।
তোমার তো চুলও চোমোক্তার আছে উদোয়। বেশ সল্ট অ্যান্ড পেপার। তুমার বন্ধুর দিকে একবার তাকিয়ে দেখ। একেবারে চোকচোক গোড়ের মাঠ হয়নি?
তখন আমি সুযোগ পেয়ে বলি, তো সীতাদিদি, তোমারই বা সে ভ্রমরকৃষ্ণ মেঘপুঞ্জ কেশদামের কী হল?
মুখটা বিরক্তিতে কুঁচকে সীতা বলল, যা খাটুনি! চুল এখানে রাখা যায় না উদোয়। অন্তত আমি পারি না। লম্বা চুল গাছের পাতার মতো ঝরে পড়ে যায়।
হইহই করতে করতে গাড়ি চালাচ্ছে অবনীশ। পাশে সীতা। পিছনে আমি বেল্ট বাঁধা-ছাঁদা লাগেজের মতো।
শহর থেকে দূরে, পাইন-মেপল-বার্চ ঘেরা একটা চমৎকার গ্রামে থাকে ওরা। নাম শেলটন। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে অনায়াসে আমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে গেল সীতা। কিছুতেই আমাকে নিতে দিল না। পিছন-পিছন আমি। অবনী গ্যারাজে গাড়ি রেখে আসছে। বাড়ির বাইরেটা অবিকল ইংরেজি ফেয়ারি-টেলের বাড়িগুলোর মতো। ভেতরটাও যেন খেলাঘর। তা সিঁড়ি দিয়ে উঠে কফি রঙের কার্পেটের ওপর পা রেখেছি কি না রেখেছি—কুঁ কি ক্যাঁ কুঁ কি ক্যাঁ করে কিছু একটা কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠল।
ওঃ মাই প্রিটি, মাই সুইটি মিটু ডিয়ার, মা ইজ হিয়ার—বলতে বলতে কয়েক কদম গিয়ে সীতা হাত উঁচু করে একটা খাঁচার দরজা খুলল। খাঁচাটা সোনালি রঙের। সিলিং থেকে একটা চকচকে ধাতুর বাঁকানো ডগায় ঝুলছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয়—কোনো গৃহসজ্জা। কিন্তু কাঁচের দরজা খুলতেই একটা সবুজ টিয়াজাতীয় পাখি বিদ্যুৎবেগে উড়ে সীতার কাঁধে গিয়ে বসল।
আমার দিকে ফিরে সীতা বলল, প্লিজ বসো, উদোয়, আগে একটু রেস্ট নিয়ে নাও তারপর তুমাকে বাড়ি দেখাব।
ততক্ষণে কয়েক সিঁড়ি টপকে টপকে উঠে এসেছে অবনীশ। পিছন থেকে সোৎসাহে বলল, ও কী বলল বল তো!
আমি বলি, বলল আগে একটু রেস্ট নিয়ে নিতে, তারপর…
অবনীশ হা হা করে হেসে বলল, সীতা নয় সীতা নয়, মিঠুর কথা বলছি।
মিঠু কে?
কী আশ্চর্য! ওই প্যারটটা।
ও আর কী বলবে? ক্যাঁ ক্যাঁ করে চেঁচাল খানিকটা।
উঁহু, আমাকে হারিয়ে দেবার বিজয়গর্ব ফুটে উঠল অবনীশের মুখে।
সীতা হেসে বলল, ও বলল হু ইজ দ্যাট, হু ইজ দ্যাট। আশ্চর্য ইনটেলিজেনট পাখি। একটা মানুষ বাচ্চার সঙ্গে কোনো তফাত নেই।
অবনীশ বলল, চন্দনা জাতীয় বুঝলি। আমি আবার ল্যাটিন নামটা মনে রাখতে পারি না। আয় এদিকে আয়।
ওকে অনুসরণ করে যাই। ওদিকে সোফায় সীতা বসে আছে। তার টি শার্ট শোভিত কাঁধে চন্দনা। হঠাৎ একটা সবুজ ঝলকানি তারপরই আমার মাথায় খটাস করে লাগল। উঃ আমি মাথাটা সরিয়ে নিই।
নটি বয়, যাও মিঠু মায়ের কাছে যাও, যাও, … অবনীশের গলায় আদেশের সুর।
সীতা বলল, হি ইজ জেলাস, বুজলে উদোয়। অবনী যে তুমাকে আদর করে নিয়ে যাচ্ছে, কাঁধে হাত রেখেছে! হিজ পা হ্যাজ টু বি ওনলি হিজ।
অবনী তাড়াতাড়ি আমার মাথাটা দেখল, রক্ত-টক্ত কিছু বেরোয়নি নাকি। তবু অবনী একটু ফার্স্ট এইড দিল। মাথার ভেতরটা ঝনঝন করছে আমার। সীতা বলল, জেনার্যালি হি ইজ ভেরি ওয়েল-বিহেভড, আসোল কথা, হিংসা হচ্ছে।
এখন মিঠু তার ডান হাতের উলটানো পাতার ওপর। এই ভঙ্গিতে মোগল বাদশাদের ছবি পাওয়া যায়। তাঁদের হাতে অবশ্য চন্দনা থাকে না, থাকে শিকরে বাজ। তা এই বা কম কী?
আমি সংক্ষেপে বলি, ওরে বাপ।
সত্যিই রে উদয়, ও একদম এসব করে না। পার্ফেক্ট ম্যানার্স একেবারে।
আমি বলি, আমি খারাপ লোক বুঝতে পেরেছে আর কি! আমাকেও ওয়ার্নিং দিল, তোদেরও সাবধান করে দিচ্ছে।
এই যাঃ, সীতা বলল, তুমি মাইন্ড করেচো। এক্সট্রিমলি সরি, উদোয় আ অ্যাম গোয়িং টু পানিশ হার।–সে পাখিটার ওপর তার বাঁ হাত চাপা দিল, তারপর তাকে তার তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে খাঁচায় পুরে দিল।
কাঁ কাঁ কাঁ, পাখিটা চিৎকার করেই যাচ্ছে।
নো মা। অ্যাম নট ইয়োর মাদার এনি মোর।
সীতা চলে এল। কী আশ্চর্য! পাখিটাও ঘাড় গুঁজে কেমন একটা ঝিমিয়ে মতো বসে রইল। ঠিক যেন একটা বাচ্চা দুষ্টুমি করে বকুনি খেয়ে মুখ গোঁজ করে, নীচু করে বসে আছে।
ততক্ষণে আমরা লিভিংরুমটার শেষ প্রান্তে এসে পড়েছি। লম্বা লম্বা ভেনিশিয়ান ব্লাইন্ড সরে গেল। কাচ দিয়ে সমস্তটা ঢাকা, তার ওদিকে একটা রীতিমতো জঙ্গল দেখা যাচ্ছে। ঘন কালচে সবুজ পাতা-ঝরা-গাছের অরণ্য। বাড়ি আর জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে একটা চওড়া নালার জল বইছে। তাতে দু-চারটে হাঁস।
অবনীশ বলল, ওই যে জঙ্গলটা দেখছিস ওটা আমাদের। ওই স্ট্রিমটাও।
আমি জীবনে এই প্রথম কোনো জঙ্গল এবং নালার মালিক দেখলাম ভাই। আমি বলি।
আরে এখানে সাবাবে অনেকেরই এমন জঙ্গল আছে। জঙ্গলই বলিস, বন বাগানই বলিস!
মানে!
ওয়াইল্ড গার্ডেন ধর। আমাকে রীতিমতো মেনটেইন করতে হয়। সময় মতো ডাল-ফাল কাটানো, নীচেটা পরিষ্কার করা। এ সবের লোক পাওয়া যায়। তবে আমাদের স্পেশ্যাল অ্যাকুইজিশন হচ্ছে ওই নালাটা, হরিণ জল খেতে আসে। চাঁদনি রাতে যা লাগে না!
হরিণও আছে তোর জঙ্গলে? তুই তাহলে হরিণযুথেরও ওনার?
না তা নয়।–ও বলল, হরিণরা রাস্তা ক্রস করে জঙ্গল পেরিয়ে অন্য জঙ্গলে চলে যায়। যাবার স্বাধীনতা তাদের আছে। আমার জঙ্গল বলে তাকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আমি ঘিরতে পারি না। দিস ইস আ ফ্রি কানট্রি।
সীতা বলল, কোতো পাখি আসে ওখান থেকে। আমাদের ডেকটার তলাতেই বার্ড ফিডার রাখি। দেখবে এস, ভাগ্যে থাকলে ফ্লিনচ রবিন, ব্ল্যাক বার্ড, ব্লু জে, কার্ডিন্যাল আরও কোতো পাখি দেখতে পাবে। মাঝে মাঝে ওয়াইল্ড টার্কিও এসে যায়।
আমাদের ছাদ থাকে, বারান্দা থাকে। এদের এখানে বেশিরভাগই দেখছি বাড়ির পেছনে একটা ডেক থাকে, ঠিক জাহাজের ডেকের ছোটো সংস্করণেরই মতো। এরা সেখানে নানা রকম হার্বস চাষ করে-ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, চায়না-গ্রাস, আরও কত কী তাদের নামও ছাই আমি জানি না। সীতা-অবনীশের ডেকে একটা রং-করা বেতের বসবার ব্যবস্থা দিবারাত্র রোদ খাচ্ছে জল খাচ্ছে। জঙ্গলের দৃশ্যটা এখান থেকে বেশ ভালো দেখা যায়। একটা মাত্র ধূসর রঙের পাখি খুঁটে খুঁটে কী সব খাচ্ছিল, আমরা ঢুকে বসতেই হুশশ করে উড়ে গেল।
সীতা বলল, আশ্চর্য, ওরা তো অন্য দিন পালায় না।
আমি বলি, আমি খারাপ লোক, দেখো তোমাদের পোষা এবং না-পোষা পাখি সকলেই তোমাদের জানিয়ে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে অবনীশ অতি চমৎকার দেখতে মার্গারিটার ট্রে নিয়ে উপস্থিত। একটা ক্রিস্ট্যালের পাত্রে যথেষ্ট মেওয়া, যাকে এরা বলে ড্রাই ফুট। আমার এখন একটু হাত-পা ছড়িয়ে কোনো পানীয় নিয়ে বসবারই দরকার ছিল।
আমার শেষ কথাটা অবনীশ বোধ হয় শুনতে পেয়েছিল। বলল, পোষা-টোষা বলিসনি। মিঠুটা পোষাও নয়, পাখিও নয়, ও আমাদের পুত্র, যাকে বলে ছোটোখোকা।
সীতা বলে, আমাদের চারটা। অত্রি, জিষ্ণু, রশমি আর মিটু।
একটু গল্পগাছা করবার পর ওরা পরম উৎসাহে বাড়ি দেখাতে লাগল। প্রাসাদবিশেষ। তিন ছেলেমেয়ের তিনখানা ঘর, ওদের নিজেদের একটা বিশাল শোবার ঘর, সঙ্গে লাউঞ্জ। টয়লেটে বাথটবে জাকুজি। অতিথি-ঘরটার সঙ্গেও একটা লাউঞ্জ। আগাগোড়া ছবির মতো সাজানো। লাইব্রেরি। ডাইনিং কাম লিভিংরুম। ফর্মাল ড্রয়িংরুম। বিশাল ব্যাপার। যাদের বাড়ি তারা বিশেষ উপভোগ করতে পায় বলে মনে হয় না। আমি দু-দিনের জন্যে এসে আচ্ছা করে আরাম খেয়ে নিই। ভোরবেলা উঠে হাঁটতে হাঁটতে শেলটনের গাছে-ছাওয়া গ্রামাঞ্চলের রাস্তা বেয়ে চলে যাই যত দূর পারি। আশ্চর্য সবুজ গাছপালা সব। যেন কেউ প্রতিদিন সাবানজল দিয়ে ঝকঝকে করে মুছে যায়। রাস্তার নেড়ি-বিল্লি বলে জিনিস নেই। মাঝে মাঝে অবশ্য ডিয়ার ক্রসিং নোটিস দেখে বুঝতে পারি নেড়ি হরিণ এখানে আছে বিস্তর। আর আশ্চর্য, আকাশে কোনো পাখি নেই। আমাদের তো গাছ থাকলেই সেখানে কাকে বাসা করবে। ভোর বা সন্ধে মানেই হরবোলা অর্কেস্ট্রা। এখানে সকালে পাখিদের জেগে-ওঠা নেই, বিকেলে তাদের ঝাঁকে-ঝাঁকে ঘরে ফেরা নেই। কাকের কা-কা নেই এমন অবস্থা তো আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আশ্চর্য নিরালা, নীরব দিন-দুপুরে হঠাৎ-হঠাৎ কেমন অপ্রাকৃত নিঃশব্দ লাগে সব। কেন এত অস্বস্তি! তার পরে আবিষ্কার করি—কাক নেই, কা-কা নেই তাই। পাখি দেখতে হলে যাও সেই ডেকে। মেহেদি আর থাইদেশীয় তুলসীর মধ্যে বসে থাকো যদি ব্লু-ফিনচ, রবিন কি ব্ল্যাকবার্ড দেখতে চাও।
কিন্তু আমরা তো আর সবাই সেলিম আলি নই, বিভূতিভূষণ বা বুদ্ধদেব গুহও নই, যে পাখির জন্য পথ চেয়ে আর কাল গুনে বসে থাকব! আসলে পাখপাখালির ডাকাডাকি আমাদের শহুরে জীবনযাত্রারও আবহসংগীত। সংগীত হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যাওয়ায় কেমন একটা কেমন-কেমন লাগে।
আমাকে কথা দিলেও অবনীশরা সেভাবে ছুটি নিতে পারেনি। দুটো উইক এন্ডের সঙ্গে আর একটা করে দিন যোগ করে নিয়েছে। ওই দুটোর একটায় আমরা যাব হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, বস্টন এবং তার কাছাকাছি নিউ হ্যাম্পশায়ার বলে একটি পাহাড়ি জায়গায়। আর একটায় যাব নিউ ইংল্যান্ডের প্লিমাথ নায়াগ্রা।
ভোরবেলা আমার চ্যানেল মিউজিক শুনে ঘুম ভাঙে। আমি চটপট বেরিয়ে পড়ি। ফিরে দেখি ব্রেকফাস্ট রেডি। ফেনায়িত কফির গন্ধে বাড়ি ভরপুর। সীতা বেচারি অত সকালে পরোটা-ফরোটা ভেজে ফেলে এক এক দিন। অবনী আগে, সীতা একটু পরে বেরিয়ে যায়। দুজনের দুটো গাড়ি মোড়ের ওধার ঘুরে হারিয়ে যায়। আমি আস্তে আস্তে ভেতরে এসে বসি। খুব ভোরে উঠি তাই এক এক দিন আর এক ঘুম ঘুমিয়ে নিই। অলস মাথায় বই পড়ি। ভি.সি.পি-তে ক্যাসেট চাপিয়ে ভালো ভালো ছবি দেখি। একটা কি দুটো কি আড়াইটে বাজলে ফ্রিজ থেকে কিছুমিছু বার করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে নিই। তবে অনেক সময়ে মাঝেও একটু মুখ চালাতে ইচ্ছে করে। ফ্রিজের মধ্যে দিব্যি ছাড়ানো বেদানা-ডালিম, বাদাম আখরোট থাকে, টুকটাক চালাই। মোটকথা এরকম আলসে কুঁড়ে নিপাট নিশ্চিন্ত বাদশাহি ছুটিযাপন আমার ভাগ্যে জীবনে এই প্রথম। লাগছে মন্দ না। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এই বাড়ি এই জঙ্গল এই বৈভব এই হরিণ সব বোধহয় আমারই। গান শুনতে শুনতে একঘেয়ে লাগলে ঘুরে বেড়াই বাড়িটার মধ্যে। কত রকমের যে অলংকরণ! কাচের স্ফটিকের, কাঠের, গালার, কাপড়ের, পোড়া মাটির। আর ঘরে ঘরে ছবি, ছবি মানে ফোটো। ছবি দেখে-দেখে অত্রি-জিষ্ণু রশমিকে আমার চেনা হয়ে গেছে। শিশুকাল থেকে এখনকার বয়স পর্যন্ত অজস্র ছবি। কখনও মার সঙ্গে কখনও যাবার সঙ্গে কখনও দুজনের কোলে পিঠে, কখনও ভাইবোন তিনজন, কখনও কেউ একা, বন্ধুদের সঙ্গে, পাহাড়-নদী-অরণ্য-পথ, পথের মানুষের সঙ্গে। অজস্র অজস্র। অত্রি নাকি এখন আঠাশ তো আট বছরের অত্রিও যদি আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি নির্ভুল চিনতে পারব। জিষ্ণু ছাবিবশ, তার নাকি আবার নিজস্ব পরিবারও আছে, রীতিমতো ফ্যামিলি ম্যান। আর রশমি একটা উনিশ বছরের কিন্তু গাল টিপলে দুধ বেরোয় গোছের বালক-বালক মেয়ে। তিনজনেই সুন্দর প্রাণবন্ত। রঙিন ছবিতে তাদের গালের লালিমা, স্বাস্থ্যের দীপ্তি ফেটে বেরোয়। জিষ্ণুই ওদের মধ্যে অবনীশের রং পেয়েছে, ঘষা তামার মতো একটা অদ্ভুত রং যেটা অবনীশের ছাত্রবেলায়ও ছিল।
একা-একা একঘেয়ে লাগত যদি সন্ধে থেকে মাঝরাত্তির অবধি অমন জমাট আড্ডাটা না হত। এতদিনের জীবনের আদি-মধ্য-অন্তের ভেতরে যে আদি-ঘেষা মধ্যভাগটায় আমাদের তিনজনের জানাশোনা সেইসব দিনের স্মৃতিচারণের বেশিরভাগ সময়টা কাটে। তবে তারই অনুষঙ্গে আগেকার জীবন, এখনকার জীবনযাত্রার প্রসঙ্গে এসেই পড়ে। অবনীশ আসে আগে, ডিনারের ব্যবস্থা শুরু করে দেয়। দুজনে চা নিয়ে বসি। ওদের জন্যে ভালো দার্জিলিং চা নিয়ে এসেছি, তারই সদব্যবহার হয়। খাঁচার মধ্যে ঝটপটাতে থাকে মিঠু। কাঁ কাঁ, কাঁক, কাঁক।
কী বলছে বল তো!—অবনীশ পরমোৎসাহে জিজ্ঞেস করে।
আমি তোর টিয়ের ভাষা কিছুই বুঝতে পারছি না অবনী, অনেস্টলি।
আরে কী আশ্চর্য! ও বলছে বাবা, বাবা, বাবা।
আমি হেসে বলি, আমি তো শুনছি বড়োজোর নাকিসুরের কাকা, আবার টাটা ও হতে পারে।
না রে, এটাই ওর ফেমাস বাবা ডাক। প্রথম ডেকেছিল মা। সে ঠিক আছে। মা একটা এক অক্ষরের শব্দ, সবাই বলে। কিন্তু বাবা বলে যেদিন আমার কাঁধের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম বুঝলি। কেননা, ডাকটা ও শুনল কোথায়? আমার ছেলেমেয়েরা যখন আসে, ডাকে ড্যাডি। বাবা কোত্থেকে পেল ও অনেক ভেবে-ভেবে বার করি একদিন ও এই টেবিলটাতে খেলে বেড়াচ্ছিল, আমি আর সীতা আমাদের বাবাদের গল্প করছিলাম। সেই থেকে পিক-আপ করেছে। বোঝ একবার, কী সাংঘাতিক বুদ্ধি!
ইতিমধ্যে তো অবনীর সেই প্রডিজি পাখি ছাড়া পেয়ে তার বাবার মাথায় চড়ে বসেছে। বাবা তাকে মাথায় নিয়েই ফ্রিজের দরজা খুলল। দেখি সেই বেদানা আর কাঠবাদামের কৌটোগুলো নিয়ে আসছে।
বুঝলি এই আমন্ড আর ডালিম—এই দুটোই ওর সবচেয়ে ফেভারিট।
যাচ্চলে! আমি মনে-মনে জিভ কাটি। দুপুরের একাকিত্ব কাটাতে পাখির দানা মেরে দিয়েছি?
তবে অবনীর মিঠুর যে কোনটা ফেভারিট নয়, বুঝলাম না। ছোট্ট একটা সোনালি কফি পটে তার জন্য চা এল, খেল, ফেলল, ছড়াল, তাতেও শানাল না, অবনীর কাপেও ঠোঁট ভিজিয়ে নিল তুরন্ত। বিস্কিটে ঠোকর মারতে লাগল। প্লেটে চুড়ো করে চিনি দিতে হল তাকে।
বুঝলি উদয়, এই পুঁচকেটাকে আর ম্যানার্স শেখাতে পারলাম না। অত্রি, জিষ্ণু এমনকি আমাদের একমাত্তর মেয়েটাও এত অসভ্য ছিল না। কারও সামনে বেসহবত হলে বাচ্চা বয়সে ওদের কত বকাঝকা করেছি। এটার বেলায় ফেল মেরে গেলাম।
আমি বলি, একটা পাখিকে পেট হিসেবে তুই কতকগুলো সাধারণ জিনিস শেখাতে পারিস, কিন্তু…
অবনী বলে উঠল, উদয় প্লিজ, মিঠুকে পাখি-পাখি পেটটেট বলিসনি, বিশেষত সীতার সামনে। ভীষণ দুঃখ পাবে। রেগে যেতেও পারে।
যা ব্বাবা! যতই ভালোবাসুক, পাখিকে পাখি বলতে পারব না?
সীতা এলে আর দেখতে হবে না। কাঁ কাঁ করে ডাকতে ডাকতে সীতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
আমি বলি, আমি একটু বেড়িয়ে-টেড়িয়ে আসি বাবা, তোমাদের মিঠুর তো। এখন আবার হিংসে হবে, আর ঠোক্কর খেতে আমি রাজি নই।
প্লিজ উদোয়, একটু আদর খেয়ে নিক, তারপর ওর ব্যবস্থা করছি, যেয়ো না।
মিঠুর চিৎকার আর ওলটপালট, সীতার মুখ ঠুকরোনো অর্থাৎ চুমু খাওয়ার বহর দেখবার মতো। অনেকটা সেই সার্কাসের টিয়ার খেলার মতো। কাঁধ থেকে কোলে লাফিয়ে পড়ছে, তারপরেই আমাকে চমকে দিয়ে ঝটপট করতে করতে উড়ে গিয়ে বসছে মাথায়। হাত থেকে ডালিমের দানা নিয়ে কুট কুট করে খাচ্ছে। গর্বে ভরতি মিঠুর বাবা-মার মুখ। ভাবটা কেমন দেখছিস? জীবনে কখনও এমনটা দেখেছিস আর?
যাই হোক, অবশেষে সীতা মিঠুর ব্যবস্থা করে, নিজেদের শোবারঘর ও লাউঞ্জের ভেতরে তাকে পুরে দিয়ে আসে। ওখানে নাকি মিঠু অনেকটা ওড়বার জায়গা পাবে। টয়লেটে জল ভরা টব আছে, সেখানে চান করতেও পারে। আলমারির মাথায় বসে থাকতে পারে আবার কার্পেটের ওপর বসে বসে ঝিমিয়ে নিতেও পারে।
রশমিকেও নাকি ওরা ঠিক ওইরকম নিজেদের হলে বন্ধ করে রেখে দিত। সেটা অবশ্য কোনো দুষ্টুমির শাস্তি। এক ঘন্টা-দু ঘন্টার জন্যে।
অবনী বলল, রশমি খুব দুষ্টু ছিল ঠিকই, কিন্তু জিষ্ণুর কাছে ও কিছুই নয়। জিষ্ণু অবিকল সেই আবোল-তাবোলের বাপরে কী ডানপিটে ছেলে!
দুজনেই হাসতে লাগল।
আমি বললুম, তা সেই সবচেয়ে ডানপিটেই তো সবচেয়ে আগে পোয মেনেছে শুনছি।
ওর কথা আর বলো না, সীতা বলল, হাইস্কুল পাস কোরবার পোরই কলেজে জয়েন করতে না করতেই একটা ব্ল্যাক মেয়ের সঙ্গে থাকতে লাগল।
অবনী বলল, এ হে হে, এসব কথা উদয়কে বলছ কেন? কী মনে করবে বলে তো?
সীতা বলল, চব্বিশ বছর বয়েসে এখানে এসেছি উদোয়, থার্টি ইয়ার্স প্রায় হতে চোলে, হামাদের ওয়েজ আমেরিকান হোয়ে গেছে, মোনে কিছু কোরো না। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
আমি তাড়াতাড়ি ওদের আশ্বস্ত করি, আমি কিছুই মনে করিনি, আর মার্কিন সমাজ ও জীবনযাত্রার আদর্শ সম্পর্কে কিছু-কিঞ্চিৎ ধারণা তো আমাদেরও আছে রে বাবা!
সীতা বলল, ইভন দেন, উই ওয়্যার শকড। অ্যাট ফাস্ট। একটা আঠারো বছরের ছেলে তো আফটার অল!
তোমরা কিছু বলোনি? রাগারাগি করে এখানে লাভ হয় না জানি।
আরে জানব তবে তো বলব। অবনী বলে, জানানোর দরকার বলেই মনে করেনি। বিয়ে করলে জানাত। এখানেই জন্মকর্ম, এখানেই শিক্ষা, এদের মতোই অবিকল তো। এটা ওরা লুকোনোর বা বলবার মতো কিছু মনে করে না। তবে আমরা ঠিকই জানতে পেরেছিলাম। তারপর এসেছেও এখানে।
সীতা বলল, মোজা কি জানো উদোয়, মেয়েটা নিজে চাকরি করে পোড়াতে লাগল। দুটো বাচ্চা হয়ে গেল। তার নিজের কেরিয়ার বারোটা। তারপর জিষ্ণু কী বিহেভ করেছিল জানি না। দুটো বাচ্চা নিয়ে মেয়েটা, সোফিয়া, একজন ব্ল্যাককে বিয়ে কোরে চোলে গেল। জিষ্ণু কিছুদিন পোরেই একটা ট্রাভল এজেন্সি খুলল, একটা স্প্যানিশ মেয়েকে বিয়ে কোরলো। দুজনে মিলে বিজনেস ভালোই চালায়। একটা বাচ্চা।
থাকে অ্যারিজোনা স্টেটে বুঝলি উদয়, অবনীশ বলল, আসে বছরের একবার তো বটেই। নাতিটা বেড়ে হয়েছে। ওর মায়ের মতো। তবে মজা কি জানিস, সীতা কিন্তু মনে মনে সেই প্রথম দুটো নাতি-নাতনিকেই বেশি ভালোবাসে, সম্ভবত সোফিয়াকেও যদিও তারা আমাদের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না।
সীতা বলল, এগুলো একদোম বিশ্বাস কোরো না, বিয়ে হোক না হোক বাচ্চা দুটো তো আমাদেরই। বোলো? তাদের জন্য মন পুড়বে না? আর সোফি! হোতে পারে ব্ল্যাক। মেয়েটা প্রাণ দিয়ে জিষ্ণুকে তৈরি করে দিয়েছিল। তার স্যাক্রিফাইসটা হামি নিজে মেয়ে হরে কী করে ভুলতে পারি? উই হ্যাভ অ্যাকসেপ্টেড হার অ্যাজ আওয়ার ডটার-ইন-ল।
আমি কথা পালটাই। আবহাওয়া ভারী হয়ে উঠেছে। আমি ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে বুঝতে পারছি অবনীর পক্ষপাত বর্তমান পুত্রবধূর ওপর, সীতার সহানুভূতি পুত্রবান্ধবীটির ওপর। কেন? কোন সূক্ষ্ম মনস্তত্ত্ব এখানে কাজ করেছে কে বলবে?
সীতাও বলে, তুমার ফেমিলির কোথা বলো উদোয়।
আমার ফ্যামিলি? সেই যথা পূর্বম তথা পরম। আমার বাবাকে ওরা চিনত খুব। তা বাবা গত হয়েছেন অনেকদিন। আমার ছাত্রজীবন শেষ হতে না হতে। ভাগ্যিস একটা চাকরি পেয়ে গিয়েছিলুম তাড়াতাড়ি, দিদিরও বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তাই সামলে নিতে পেরেছি।
মা বেচারি অনেক কষ্ট করেছেন ক-টা বছর। তারপর দিদির ননদ শকুন্তলাকে বিয়ে করেছি। বলা যায় একটা আধা-প্রেম, আধা-অ্যারেঞ্জড গোত্রের ব্যাপার। ছেলে রণো ছোটো কিন্তু আমার চেয়েও বড়ো এক এক সময়ে মনে হয়। মেয়ে রিনির ঠাকুমা মা-বাবার ওপর টান এমনই যে সে যাতায়াত অসুবিধে হলেও যাদবপুরে হস্টেলে থাকতে চায় না এখনও পর্যন্ত। কাঁকুড়গাছিতে একটা ছোটো বাড়ি করতে পেরেছি। জমি বাবারই কেনা ছিল। জামাইবাবু অনেক সাহায্য করেছেন বাড়িটা দাঁড় করাতে। মায়ের ত্যাগের কথা না-ই বললাম। শকুন্তলা মাকে অনেক আগে থেকেই চিনত, মাও ওকে। কে জানে সেই জন্যেই কিনা, বেশ মানিয়েই তো আছে। বিশেষত আমার মাতৃদেবী একটু মাই ডিয়ার গোছের আছেন। রিনি বলে গেছো মেয়ে। রণো বলে বড়ো-ছোটো মেয়ে। রিনি এখনও ঠাকুমার কাছেই শোয়। রিনির রণোর উভয়েরই পড়াশোনার বিপুল খরচ আমাকেই চালাতে হয়। শকুন্তলা অবশ্য শাড়ির ব্যাবসা করে কিছু রোজগারপাতি করে। তবে তার হ্যাপা অনেক। এখন এইসব খবরাখবরের মধ্যে কোনটা কতটা ওদের বলব। এই প্রগতিশীল, অত্যাধুনিক সমাজে থাকে। দেশে এই ত্রিশ একত্রিশ বছরে কবার গেছে হাতে গোনা যায়। ওদের অভ্যাস, ধ্যানধারণা, অভিজ্ঞতা, সুখদুঃখ সবই আমাদের থেকে একেবারে আলাদা। ছেলেমেয়ে যে আমায় দেড় মাসের কড়ারে আমেরিকা পাঠিয়েছে এ কথা কি ওদের বলবার? আমার ফাজিল বড়ো-ছোটো মেয়ের মা যে তাড়াতাড়ি না ফিরলে বাপের বাড়ি যাবার ভয় দেখিয়েছেন সে কথা বলতে গিয়ে যদি হাস্যকর প্রতিপন্ন হই?
ওদের মেয়ে রশমির মোটে উনিশ বছর বয়স। আমার রিনির চেয়েও দু-বছরের ছোটো। সেই মেয়ে স্কুলের পড়া শেষ করে এখন মাউন্টেনিয়ারিং করছে। আপাতত পূর্ব আফ্রিকায়। তার জন্য কোনো খরচখরচা করতে হয় না ওদের। গিফট দেয় অবশ্য। গিফট হিসেবে ডলার-ড্রাফটও দেয়। কিন্তু এই উনিশ বছরের কিশোরী পার্বতী মা-বাবার জন্মদিনে বিবাহবার্ষিকীতে কিছু-না-কিছু গিফট পাঠাতে ভোলে না। কোথা থেকে সে নিজের খরচ চালায়, কোথা থেকে আবার উপহারের ব্যবস্থা করে ভাবতে গিয়ে আমি মুগ্ধ, অভিভূত হয়ে থাকি। আমার মেয়েও অবশ্য আমাকে উপহার দেয়। মার্চ মাস থেকে তাড়া দেবে, বাবা আমার শ তিনেক টাকা বড্ড দরকার, দাও না।
শ তিনেক? অত কেন?
বেশি হল? আমি তো মিনিমানটাই চাইলাম।
এপ্রিলের পনেরো আমাদের বিয়ের তারিখে আমরা পতি-পত্নী একটি ফ্লাওয়ার ভাস, বা একটা-দুটো বিখ্যাত বই উপহার পাই। ওই তিনশো টাকা থেকে কেনা। মোড়কের বাহারি কাগজ, আর একগোছা ফুল রণোটাই নাকি যোগ করে। ও বলে, কাগজ আর ফুল বলে তুচ্ছ করো না বাবা, আই হেট টু বাই য়ু আ গিফট উইথ ইয়োর ওন মানি। ইটস রিডিক্লাস।
আমি বলি, তা তোর কি আজকাল নিজের রোজগার হয়েছে? ড্রাগ-পেডলার হয়েছিস না কি?
শকুন্তলা বলে, দেখো কোনো বন্ধুর কাছ থেকে ধার করেছে, পকেট মানি থেকে বাঁচিয়ে শোধ করবে। পাকামি না করলেই যেন নয়। মারব এক থাবড়া। তো এই আমার ছেলেমেয়ের আধুনিকতা। এখনও পর্যন্ত।
আর ওদের বড়ো ছেলে অত্রি? মাত্র আঠাশ বছর বয়সেই তার ট্যালেন্টের জোরে সে সিয়াটলের কোনো ইউনিভার্সিটির বায়োকেমিস্ট্রির হেড। বিয়ে করেছে নিজেরই মতো পণ্ডিত আর এক শ্রীমতীকে। সে আবার গ্রিক। অত্রি এবং তার গ্রিক স্ত্রী সারা পৃথিবী পরিভ্রমণ করে বেড়ায় গবেষণার দরকারে। বিভিন্ন সময়ে ওদের পাঠানো কার্ড ও ছবিগুলো দেখাল অবনী। ক্রিসমাস কার্ড, বার্থ ডে, ম্যারেজ অ্যানিভার্সরি, নিজেদের এবং মা-বাবার, নভেম্বরে থ্যাংকস-গিভিং-এর কার্ড, অসুখ করলে গেট ওয়েল কার্ড। অত্রি আর আদ্রিয়ানার কার্ড দিয়েই গোটা কয়েক অ্যালবাম হয়ে যায়।
রবিবারের সকালবেলা। এইবারে আমরা বেরোব। গত সপ্তাহান্তে দেখে এসেছি নিউ হ্যাম্পশায়ারে অপূর্ব উইনিপেসাকি লেক, বোটিং-ও হল। নামটা কী সুন্দর। এইসব রেড ইন্ডিয়ান নামে ভরতি মহাদেশটা। সাসকাচুয়ান, কেন্টাকি, কানেটিকাট, মিসিসিপি, মিসৌরি, ক্যানসাস, উইসকনসিন মিনেসোটা। দুদিন বেশি ছুটি নিয়েছিল ওরা। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হু হু করে পেরিয়ে, বস্টনের পাশে হার্ভার্ড থেকে পৌঁছে গেলাম নিউ ইংল্যান্ডের প্লিমাথ-এ। সেখানে আমেরিকায় প্রথম ব্রিটিশ পদার্পণের স্মৃতিসমূহ ঠিক তেমনই করে সাজানো আছে। আজ যাচ্ছি সোজা বাফেলো শহর। সেখানে থেকে নায়াগ্রায় মার্কিন দিকের চেহারাটা দেখা যায়।
গ্যারাজের দিকের দরজা দিয়ে আমরা বেরোই। গাড়িতে মালপত্র সব ভোলা হয়ে গেছে। আমি, সীতা বেরিয়ে এসেছি। শেষ ব্যক্তি বেরোবে অবনী। হঠাৎ ফরফর ফরফর শব্দ। একটা সবুজ ঝিলিক, তারপরেই সীতার আর্ত চিৎকার, মিটু! মিটু! মিটু! ব্লু-জিনস আর কুঁচি-দেওয়া হলুদ শার্ট পরে সীতা দৌড়াচ্ছে, ক্রমেই গতি বাড়ছে তার। অবনীর মুখে গভীর আতঙ্কের অভিব্যক্তি। আমি হতভম্ব।
দু-তিন দিনের সফরে গেলে ওরা মিঠুকে ওদের শোবার ঘরে বন্ধ করে রেখে যায়। ওই স্যুইটটা মিঠুর ভারি পছন্দ। ওখানে রাখলে নাকি ও মনে করে ওকে ভি.আই.পি ট্রিটমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। ঘরের মধ্যে ভারে ভারে ডালিম, কমলার কোয়া, বাদাম আরও কী সব ভিটামিন-মিশ্রিত বার্ড-ফিড রাখা থাকে, বাথটবে জল। যত খুশি চান করবে মিঠু। আর একটা ছোটো ভারী পাত্রে খাবার জল। এ ক-দিন ইচ্ছে করলে মিঠু তার বাবা-মার বিছানায়ও নৃত্য করতে পারে। এখন আজ ওরা দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে, না টেনেছে ঠিকই কিন্তু ল্যাচ আলগা হয়ে গেছে, তারপর খুলে আধখোলা মতো হয়ে গেছে দরজা। ভগবান জানেন। মোট কথা মিঠু কোন ফাঁকে বেরিয়ে এসেছে। গ্যারাজের দরজা দিয়ে আনাগোনাগুলো লক্ষ করেছে এবং ফাঁক পেয়েই ফুড়ুৎ করে পালিয়েছে।
বাড়িটা ডানদিক দিয়ে বেড়ে হরিণের নালা পার হয়ে পিছনের জঙ্গলের দিকে যাই আমরা। সবুজে সবুজে সব বিরাট ওক, মেপল, বার্চ অ্যাশ জঙ্গল আঁধার করে দাঁড়িয়ে আছে।
অবনী বলল, কোন দিকে গেছে খেয়াল করেছ?
এদিকেই এদিকেই-কাতর উচ্চকিত স্বর সীতার।
মিটু, মিটু, মা ইজ হিয়ার, কাম ব্যাক, কাম ব্যাক মাই সুইট।–কম্পমান অক্লান্ত স্বরে ডেকে যেতে থাকে সে।
অবনী দৌড়ে বাড়ি ফিরে যায়, চিনি আর আঙুর নিয়ে আসে। কালো আঙুর মিঠুর বিশেষ প্রিয়। হাতে আঙুরের থোকা দোলাতে থাকে সে। সীতা হাত ভরতি চিনি নিয়ে ঊর্ধ্বমুখী।
মি–ঠু, লুক অ্যাট দ্য গ্রেপস, কাম ডাউন মিঠু।
মিঠু। মিঠু!
হঠাৎ দেখি সীতার দু চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে।
কাঁদছ কেন সীতা।–আমি ব্যস্ত হয়ে বলি, যদি ওই বন আর আকাশের স্বাদ ও পায় তত ভালোই তো, ওটাই কিন্তু এর আসল জায়গা, ওখান থেকে কখনও ফিরে আসে? বর্ন ফ্রি-র সেই সিংহটার কথা মনে করো।
হঠাৎ চোখ ভরতি জল নিয়ে পিছন ফিরে আমার বুকে দুম দুম করে কিল মারতে লাগল সীতা, হাউ ক্যান য়ু বি সো ক্রুয়েল, ওহ হাউ ক্যান য়ু বি সো ক্রুয়েল।
অবনী তাড়াতাড়ি এসে তাকে থামায়। বলে, ও ঠিক ফিরে আসবে, যাবে কোথায়? এমন কোরো না সীতা, ধৈর্য ধরো।
মি-ঠু—আবার ডাকে অবনী। তার কপালে ভাঁজ। গলার স্বরে মরিয়া রাগ।
অনেক উঁচুতে গাছের পাতার ঘন সবুজ থেকে একটা হালকা সবুজ বিন্দু হঠাৎ আলাদা হয়ে যায়। আমরা সবাই দেখতে পাই। কেমন গোঁত্তা খেয়ে খেয়ে উড়ছে। মিঠু। এক গাছ থেকে আর এক গাছে। সীতা হিস্টিরিক গলায় বলল, ও ভোয় পেরেছে। কখনও জোঙ্গল দেখেনি। অত উঁচুতে ও গেল কী করে? অবনী কিছু। করো, কিছু একটা করো প্লি-জ।
মুখের দুপাশে হাত রেখে তীব্র স্বরে শিস দিয়ে ওঠে অবনী। মিঠু ঝাঁপ খেয়ে নীচের ডালে নেমে আসে।
মিটু-উ-উ, মায়ের কোলে এসো… দু-হাত বাড়িয়ে বলে সীতা।
আর একটা এলোমেলো ঝাঁপ শূন্যে। মিঠু আরও নীচের ডালে এসে বসেছে।
হাত উঁচু করে আঙুর দোলায় অবনী। চিনিসুদ্ধ হাত অঞ্জলি করে ওপর দিকে তুলে ধরে সীতা। মুখে অনর্গল আদরের ডাক। গলা ভেঙে গেছে, মুখের চামড়ায় গভীর কষ্টের খাল, সীতা চিৎকার করে, মিটু, মি-টুস মাম কলস ডিয়ার, কাম ব্যাক টু মা, লুক হিয়ার, আই হ্যাভ সুগার ফর য়ু, মি-টু।
গ্যারাজের মাথায় এসে বসেছে মিঠু। ঢালু করোগেটের ওপর পায়ের কুড়মুড় খচমচ মতো শব্দ তুলে গুটগুট করে হেঁটে হেঁটে আসছে।
অবনী বলে, টেক কেয়ার বেবি। হাঁ, ঠিক হয়েছে হাঁটি হাঁটি পাপা, হাঁটি হাঁটি পা পা।
ঠোঁট বাড়িয়ে আঙুরের থোকা কামড়ে ঝুলে পড়ল মিঠু। অন্য হাত দিয়ে তাকে ধরে ফেলল অবনী।
লিভিংরুমের সোফাগুলোতে হাত-পা ছড়িয়ে এখন বসেছি তিনজনে। বাববাঃ। একখানা কাণ্ড হল বটে।
সীতা লজ্জিত, অনুতপ্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আয়্যাম স্যরি উদোয়। আই ওয়াজ নট ইন মাই সেনসেজ। প্লিজ।
আমি হাসি, ইটস অল রাইট। কিছু মনে করার প্রশ্নই নেই। আই আন্ডারস্ট্যান্ড। কিন্তু সীতা মনে করো যদি আবার একদিন এরকম হয়। হতেই পারে। বোঝাই যাচ্ছে ও সব সময়ে তক্কে তক্কে থাকে। ফাঁক পেলেই আবার পালাবে। আফটার অল ওর ওই ডানা দুটো তো ওড়বার জন্যেই, কবিত্ব করে বলতে গেলে আকাশের নীল ডাকে হারিয়ে যাবার জন্যে। যদি ওকে ভালোবাসো, ওর ছোট্ট জীবনের এই কৃতিত্বে, সার্থকতায় তোমরা খুশি হবে না?
ডোন্ট য়ু সি। সীতা ভয়ের গলায় বলে, আমরা তো ওর ডানা হেঁটে দিয়েছি। সামান্য একটু, এরকমই করতে হয় বুঝলে। ও বার্ড-ব্রিডারদের কাছে হ্যাচারিতে জন্মেছে, জোঙ্গল আকাশ এসোব ও জানে না, জেনেটিক্যালি হয় তো জানে, কিন্তু অ্যাকচুয়ালি জানে না। ও ভয় পাবে। হার্ট ফেল করবে। সাপখোপ কি কোনো শিকরে পাখিতে ওকে… বলতে বলতে শিউরে উঠলে সীতা। যেন ওকেই সাপখোপ কি শিকরে পাখি ধরেছে।
তখন বুঝলুম কেন অমন অস্বাভাবিক উড়ছিল মিঠু।
বললুম, তোমাদের মিঠু স্ত্রী না পুং জানি না। তবে ওর জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনও তো আছে। সে জন্যও কিন্তু ও পালাতে চাইবে। আত্মরক্ষা করতে পারুক আর না পারুক।
অবনী বলল, ওর মেট-এর চেষ্টা কি আর করিনি ভাবছিস। হি ইজ আ মেল, অনেক খুঁজেও ওর প্রজাতির ফিমেল পাইনি আমরা। অন্য প্যারট-টট দিয়ে চেষ্টা করে দেখেছি। তারা ওকে ঠুকরে শেষ করে দিতে চায়। তাই শেষ পর্যন্ত ও পাট চুকিয়ে দিতে হয়েছে।
মানে?
মানে আর কি! ক্যাসট্রেশন করিয়ে নিয়েছি।
ওইটুকু পাখি! তার…?
আমি বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকি? মুখ দিয়ে কথা সরে না। হঠাৎ একটা কথা মনে হয়। এই জন্যেই, এই জন্যেই বোধহয় এ দেশের আকাশে পাখি ওড়ে না। জঙ্গলের গভীরে যারা রয়েছে তারা রয়ে গেছে। কিন্তু বাকি সব পাখিকেই বোধহয় ওরা সন্তানসঙ্গহীন জীবনে শূন্যতা পূরণের মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনে পুষে ফেলেছে। সীতা-অবিনাশ দুই অভিমানী মা-বাবা এখন মিঠুকে নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। একবার এ আদর করছে আর একবার ও আদর করছে। কত রকমের দানা বেরিয়েছে স্টক থেকে আখরোট, কাবুলিচানা, ঝুরি ভাজা। আমি তৃতীয় ব্যক্তি, আনমনে দেখছি। দেখতে-দেখতে একটা অদ্ভুত জিনিস ঘটল। সোফায়-বসা আমার চারপাশে যেন ডানা ঝাপটানোর ঝড়ো আওয়াজ। পাখিহীন আমেরিকা মহাদেশের আকাশে, শুধু আমেরিকাই বা কেন, অল্পবিস্তর সারা সভ্য দুনিয়ার আকাশে আকাশে আমি অসংখ্য পাখি উড়তে দেখলুম। বার্মুডা আর টি-শার্ট, তাপ্পি দেওয়া জিনস আর পোলো নেক, সাদা ঝোলা-হাতা আর নীল সুতো ঝোলা… মোটের ওপর সবাই একই ধরনের, একই রকম উদগ্রীব উড়ান। তা-এর তাপে ডিম ফেটে ফেটে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছোটো পালকের বল, কচি কচি ডানা গজাচ্ছে আর সঙ্গে সঙ্গে উড়ে যাচ্ছে বেপরোয়া। আশ্চর্য! ওরা কি ভয় পাচ্ছে আমাদের এতদিনের এই সভ্যতা ভুলিয়ে-ভালিয়ে ওদের খোজা করে দেবে?
অনেকদিন পর খুঁজে পেলাম। ধন্যবাদ আপনাদের।