Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আঁধার রাতের পথিক || Mayukh Chowdhury

আঁধার রাতের পথিক || Mayukh Chowdhury

আঁধার রাতের পথিক

বুড়ো–একটি নাম। নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আতঙ্কের কালো ছায়া… দল নিয়ে নয়, সম্পূর্ণ এককভাবেই সন্ত্রাসের রাজত্ব চালিয়ে বাস করছিল বুড়ো! দলের প্রয়োজন ছিল না, বুড়ো একাই এক-শো! বৃদ্ধ হলেও তার দেহে ছিল অসাধারণ শক্তি, পায়ে ছিল বিদ্যুতের বেগ!

বুড়োর প্রসঙ্গে গল্পের অবতারণা করতে হলে পাঠক-পাঠিকাদের কাছে পুমা নামক জন্তুটির বিষয়ে কয়েকটি কথা বলা দরকার। দক্ষিণ আমেরিকার অরণ্যময় পার্বত্য অঞ্চলে পুমার প্রিয় বাসভূমি। স্থানীয় বাসিন্দারা পুমাকে বিভিন্ন নামে ডাকে; সবচেয়ে প্রচলিত নামগুলো হচ্ছে–পুমা, কুগার এবং মাউন্টেন লায়ন বা পার্বত্য সিংহ। পুমা অবশ্য সিংহ নয়, যদিও তার চেহারার সঙ্গে কেশরহীন সিংহের কিছু কিছু সাদৃশ্য আছে। পুমার গায়ের রং ধূসর, দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মস্ত বড় একটা বিড়ালের মতো। বিড়ালজাতীয় অন্যান্য জীব অর্থাৎ বাঘ, সিংহ, লেপার্ড বা নিকটস্থ প্রতিবেশী জাগুয়ারের মতো হিংস্র ও ভয়ানক নয় পুমা। নিতান্ত বিপদে পড়লে সে রুখে দাঁড়ায় বটে কিন্তু পলায়নের পথ খোলা থাকলে সে পালিয়ে প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করে। যুদ্ধবিগ্রহের পক্ষপাতী সে নয়

তাকে নিরীহ আখ্যা দিলে সত্যের বিশেষ অপলাপ হয় না।

মাংসভোজী অন্যান্য শ্বাপদের তুলনায় নিরীহ হলেও পুমা মাংসাশী জীব।

গোরু, ভেড়া, ঘোড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশু তার খাদ্যতালিকার অন্তর্গত। সুযোগ পেলেই স্থানীয় অধিবাসীদের পোষা জানোয়ার মেরে সে শিকারের মাংসে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। সেইজন্য পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের কাছ মা হচ্ছে চোখের বালির মতোই দুঃসহ।

উপদ্রুত অঞ্চলের পশুপালকরা অনেক সময় পুমাকে দল বেঁধে শিকার করতে সচেষ্ট হয়–প্রয়োজন হলে তারা পুমার পিছনে লেলিয়ে দেয় শিক্ষিত শিকারি কুকুর।

আগেই বলেছি পুমা খুব দুর্দান্ত জন্তু নয়; বরং তাকে শান্তিপ্রিয় ভীরু জানোয়ার বলা যায়।

গৃহপালিত পশুকে সে হত্যা করে উদরের ক্ষুধা শান্ত করবার জন্য কিন্তু শিকারি কুকুরের সাহচর্য সে সভয়ে এড়িয়ে চলে। শিক্ষিত হাউন্ড কুকুর খুব সহজেই পলাতক পুমাকে আবিষ্কার করতে পারে। কুকুরের ঘ্রাণশক্তি অত্যন্ত প্রবল পুমার গায়ের গন্ধ শুঁকে শুঁকে সারমেয় বাহিনী তাকে অনায়োসে গ্রেফতার করে ফেলে। বেচারা পুমা গাছে উঠেও নিস্তার পায় না, কুকুরগুলো গাছের তলায় দাঁড়িয়ে চিৎকার করে শিকারিকে পুমার অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়। কুকুরের চিৎকার শুনে অকুস্থলে উপস্থিত হয় বন্দুকধারী শিকারি–পরক্ষণেই গাছের উপর থেকে মাটির উপর ছিটকে পড়ে গুলিবিদ্ধ পুমা প্রাণহীন দেহ।

পুমা অনেক সময় গাছ থেকে নেমে চম্পট দেওয়ার চেষ্টা করে। তৎক্ষণাৎ সারমেয় বাহিনীর আক্রমণে তার দেহ হয়ে যায় ছিন্নভিন্ন দলবদ্ধ শিকারি কুকুরের কবল থেকে কিছুতেই নিস্তার নেই।

কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলের বুড়ো হচ্ছে নিয়মের ব্যতিক্রম। কুকুরদের সে ভয় করে না।

ওঃ! বুড়োর পরিচয় তো দেওয়া হয়নি

বুড়ো হচ্ছে আমেরিকার ফ্ল্যাটহেড নামক পার্বত্য অঞ্চলের পুরাতন বাসিন্দা–পূর্ণবয়স্ক একটি পুমা।

ওই এলাকার লোকজন তার নাম রেখেছিল বুড়ো। সমস্ত অঞ্চলটায় আতঙ্কের ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছিল বুড়ো নামধারী পুমা। গোশালার ভিতর থেকে লুট করে নিয়ে যেত নধর গো-বৎস, হত্যা করত গোরুগুলোকে।

এলাকার বিভিন্ন গোশালায় মূর্তিমান মৃত্যুর মতো হানা দিয়ে ঘুরত ওই খুনি জানোয়ার। রাতের পর রাত ধরে চলছিল মাংসাশী দস্যুর নির্মম অত্যাচার…

কুকুর লেলিয়ে দিয়েও বুড়োকে জব্দ করা যায়নি। কুকুরের দল তাকে ঘেরাও করলেই উদ্যত নখদন্ত নিয়ে সে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর এবং চটপট থাবা চালিয়ে সারমেয় বাহিনীর ন্যূহ ভেদ করে চম্পট দেয় নিরাপদ স্থানে। পশ্চাৎবর্তী শিকারি অকুস্থলে এসে দেখতে পায় তার কুকুরগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছে আর অন্যগুলো রক্তাক্ত দেহে চিৎকার করছে আর্তস্বরে!

একবার নয়, দু-বার নয়–এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে বারংবার! বুড়োর আরও একটি বদনাম ছিল–সে নাকি নরখাদক! বদনামটা অবশ্য কতদূর সত্যি সেই বিষয়ে কারো কারো সন্দেহ। ছিল পুমা নরমাংস পছন্দ করে না, পারতপক্ষে মানুষকে সে এড়িয়ে চলতে চায়।

কিন্তু ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে এমন একটি ঘটনা ঘটল যে স্থানীয় বাসিন্দারা সকলেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হল এই সৃষ্টিছাড়া পুমাটা সুযোগ পেলে মানুষকে হত্যা করে নরমাংস ভক্ষণ করতেও দ্বিধা বোধ করবে না।

ঘটনাটা বলছি—

হারানো গোরুর খোঁজে টহল দিতে দিতে জর্জ টেলর নামে একটি রাখাল হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। প্রতিবেশীরা অনেক খোঁজাখুঁজি করে সাতদিন বাদে তার মৃতদেহটাকে আবিষ্কার করলে একটা গাছের নীচে। ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটার ওপর নজর বুলিয়ে সকলেই বুঝল কোনো মাংসাশী পশু জর্জের দেহটাকে মনের আনন্দে চর্বণ করেছে। আশেপাশে জমির উপর রয়েছে পুমার পায়ের ছাপ।

স্থানীয় অধিবাসীরা বললে জর্জের হত্যাকারী হচ্ছে বুড়ো। অধভুক্ত দেহটা দেখে তারা স্পষ্ট বুঝল বুড়ো একটি ভয়ংকর নরখাদক পুমা।

তারপর থেকে মাঝে মাঝে দু-একটি পথিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ আসতে লাগল। সংবাদগুলো হয়তো সম্পূর্ণ সত্য নয়, হয়তো সেগুলো গুজব মাত্র কিন্তু স্থানীয় মানুষগুলির মধ্যে দারুণ আতঙ্কের সৃষ্টি হল।

ইতিমধ্যে ওই এলাকায় আবির্ভূত হল একটি নতুন মানুষ। আগন্তুকের নাম অ্যালেন বর্ডার। সে বুড়োর কথা শুনল বটে কিন্তু বিশেষ গুরুত্ব দিলে না। মানুষ মেরে মাংস খায় এমন পুমার গল্প তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য নয়–নরখাদক পুমার অস্তিত্বে সে বিশ্বাস করে না।

পরবর্তী জীবনে তিক্ত অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে অ্যালেন জেনেছিল নখদন্তে সজ্জিত মাংসাশী শ্বাপদের খাদ্যতালিকার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই–বন্যপশুর স্বভাবচরিত্র বিশ্লেষণ করতে যদি ভুল হয় তবে ব্যক্তিবিশেষের ক্ষেত্রে সেই ভুলের পরিণাম মারাত্মক হতে পারে।

বার-এক্স নামক একটি র‍্যানব বা গোশালায় চাকরি করতে এসেছিল অ্যালেন বর্ডার। বিভিন্ন কাজের মধ্যে হারানো গোরু বাছুরের সন্ধান নেওয়া ছিল তার অন্যতম কর্তব্য।

সেদিন দুপুরবেলা সে এবং গোশালার মালিক ম্যাকবিল ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়েছিল কয়েকটা নিখোঁজ গোরুর সন্ধানে করার জন্য। অনেকক্ষণ ধরে একটা উপত্যকার উপর তারা নিরুদ্দিষ্ট তিনটি গোরুকে দেখতে পেল। ঘোড়ার লাগামে টান মেরে দুজনেই থমকে দাঁড়াল।

গোরু তিনটির কাছে যেতে হলে প্রায় আধমাইল লম্বা দুর্গম পাহাড়ী পথ বেয়ে যাত্রা করতে হবে। রাতের অন্ধকারে নিজের এলাকার মধ্যে গেলে তিনটি গোরুকেই হত্যা করবে বুড়ো শয়তান; অতএব সকালের জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।

গোরুগুলোকে বাঁচাতে হলে এখনই তাদের উদ্ধার করা দরকার।

ম্যাকগিলকে ঘরে ফিরে যেতে বলে অ্যালেন পাহাড়ি পথের ওপর দিয়ে গোরুগুলোর দিকে অশ্বকে চালনা করলে।

আকাশে দুলে উঠল সন্ধ্যার ধূসর অঞ্চল, পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় গ্রহণ করছে দিনান্তের শেষ আলোকধারা…

আচম্বিতে হল এক বিপদের সূত্রপাত।

অ্যালেনের বন্দুকটা ঘোড়ার পিঠে বাঁধা ছিল–হঠাৎ বন্ধনরঙ্কু আলগা হয়ে সেটা পড়ে গেল মাটির উপর। সঙ্গেসঙ্গে ভরা বন্দুকের গুলি ছুটে গেল; ঘোড়ার পায়ের তলায় বন্দুকের নল থেকে সগর্জনে নির্গত হলে চকিত অগ্নিশিখা!

ঘোড়া চমকে উঠে লাফ মারল এবং টাল সামলাতে না-পেরে ঘোড়ার পিঠ থেকে অ্যালেন সশব্দে অবতীর্ণ হল কঠিন মৃত্তিকার বুকে! ধরাশয্যায় শুয়ে শুয়েই সে শুনতে পেল পাথুরে জমির উপর বেজে উঠেছে ধাবমান অশ্বের পদশব্দ–ঘোড়া পালিয়ে যাচ্ছে।

অ্যালেন উঠে বসল। তার দেহে কোথাও আঘাত লাগেনি। শরীরের কয়েক জায়গা কেটে অল্পবিস্তর রক্তপাত হয়েছে বটে কিন্তু আঘাতগুলো মোটেই মারাত্মক নয়। বন্দুকটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে হাঁটতে লাগল। এই অঞ্চলের পথঘাট তার পরিচিত রাস্তাটা যে ভালোভাবেই চিনতে পেরেছিল।

কয়েক মাইল পথ ভেঙে পাহাড়ের নীচে নামতে পারলেই যে ঢালু জমিটার উপর পৌঁছে যাবে, সেখান থেকে গোশালায় ফিরে যেতে তার অসুবিধা হবে না। গোরুগুলোকে অবশ্য উদ্ধার করা যাবে না; কারণ ততক্ষণে অন্ধকার রাত্রির গর্ভে হারিয়ে যাবে দিবসের শেষ আলোকরশ্মি। ইতিমধ্যেই উপত্যকা আর খাদগুলোর উপর উড়েছে সুদীর্ঘ ছায়ার আবরণ–অন্ধকার হতে আর দেরি নেই।

বন্দুকটা হাতে নিয়ে অ্যালেন পাহাড়ি পথ বেয়ে পদচালনা করলে..

কিছুক্ষণের মধ্যেই অ্যালেনের দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে দিলে ঘন অন্ধকার। তারার আলোতে অস্পষ্টভাবে পথ দেখতে দেখতে সে পা ফেলতে লাগল অতি সন্তর্পণে…

হঠাৎ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ল অ্যালেন।

তার পিছন থেকে ভেসে এল একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার! নারীকণ্ঠের আর্তস্বর!

এক মুহূর্তের জন্য ভুল করেছিল অ্যালেন। না, কোনো রমণীর কণ্ঠস্বর নয়–ওই ভীষণ চিৎকার ভেসে এসেছে পুমার গলা থেকে। নারীকণ্ঠের সঙ্গে পুমার কণ্ঠস্বরের কিছুটা মিল আছে। বটে কিন্তু এমন ভয়াবহ জান্তব ধ্বনি ইতিপূর্বে অ্যালেনের কর্ণগোচর হয়নি।

অ্যালেন অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।

নির্ভরযোগ্য কোনো অস্ত্র তার হাতে নেই, যে মস্ত ছোরাটা সে সর্বদাই সঙ্গে রাখে সেটাও আজ সে ফেলে এসেছে তার টেবিলের উপর। হাতের বন্দুকে ছিল একটিমাত্র গুলি, একটু আগের দুর্ঘটনায় সেই গুলিটাও ছুটে গেছে। তবু খালি বন্দুকটা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরলে অ্যালেন, টোটা না-থাকলেও বন্দুকটাকে মুগুরের মতো ব্যবহার করা যাবে।

আবার! আবার সেই চিৎকার!

অন্ধকার রাত্রির নীরবতা ভঙ্গ করে অ্যালেনের পিছন থেকে ভেসে এল সেই উৎকট শব্দের তরঙ্গ!

দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে উঠল।

নিশ্চিত মৃত্যুর বার্তা বহন করে তার দিকে এগিয়ে আসছে হিংস্র শ্বাপদ!

দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অ্যালেন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটল। অন্ধকারের মধ্যে সংকীর্ণ গিরিপথটা আর এখন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না, তবু সে একবারও পথের দিকে দৃকপাত করলে না।

আতঙ্কে আত্মহারা হয়ে সে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে লাগল।

আচম্বিতে তার পায়ের তলা থেকে সরে গেল মৃত্তিকার নিরেট স্পর্শ, পাথরের গায়ে ধাক্কা লেগে খসে পড়ল বন্দুকটা তার হাত থেকে।

অ্যালেন অনুভব করলে তার দেহটা শূন্যপথে নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে!

অন্ধের মতো দু-হাত বাড়িয়ে দিতেই তার হাতে কয়েকটা গাছের শিকড় লাগল। শক্ত মুঠিতে শিকড়গুলো চেপে ধরে পতনোন্মুখ দেহটাকে সে কোনোরকমে রক্ষা করলে।

তার পায়ের ধাক্কা লেগে কয়েকটা পাথর পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে পড়ল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না–তবু বহুদূরে নীচের দিক থেকে স্থলিত প্রস্তরের যে পতন-শব্দ ভেসে এল সেই আওয়াজ থেকেই অ্যালেন বুঝল তার পায়ের তলায় হাঁ করে আছে গভীর খাদ। এখান থেকে পড়ে গেলে বাঁচবার আশা নেই।

অতিকষ্টে একটু একটু করে সে পাহাড়ের গা বেয়ে উপরে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু পরে একটা সংকীর্ণ জায়গায় সে পা রাখার মতো অবলম্বন খুঁজে পেল।

হঠাৎ অ্যালেনের সর্বাঙ্গে জাগল অস্বস্তিকর অনুভূতির তীব্র শিহরন। ঘন অন্ধকার ভেদ করে কোনো কিছু দৃষ্টিগোচর হওয়ার উপায় নেই কিন্তু সে অনুভব করলে শয়তান বুড়ো তার খুব কাছেই এসে দাঁড়িয়েছে।

মাথার উপর হিংস্র শ্বাপদ, পায়ের তলায় অতলস্পর্শী খাদ–ভয়াবহ অবস্থা!

অকস্মাৎ দারুণ আক্রোশে পরিপূর্ণ হয়ে গেল অ্যালেনের সমগ্র চেতনা। ভয়ের পরিবর্তে জেগে উঠল ক্রোধ। বিদ্যুৎচমকের মতো তার মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল।

বন্দুকটা তার হাত থেকে খসে পড়েছিল বটে কিন্তু অস্ত্রটা তখনও হাতছাড়া হয়নি। চামড়ার ফিতা দিয়ে বন্দুকটা আটকানো ছিল তার কাঁধের সঙ্গে, হাত থেকে খসে পড়লেও অ্যালেনের দেহলগ্ন চর্মরঙ্কুর বন্ধনে ঝুলছিল বন্দুক।

সে এইবার অস্ত্রটাকে বাগিয়ে ধরে কোট এবং টুপি খুলে ফেলল।

বন্দুকের নলের মুখে সে এমনভাবে কোট আর টুপি বসিয়ে দিল যে উপর থেকে দেখলে নির্ঘাত মনে হবে একটা মানুষ টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।

তারপর টুপি-কোট জড়ানো বন্দুকটাকে সে তুলে ধরলে খাদের মুখে।

আচম্বিতে তার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল–অন্ধকারের কালো যবনিকা ভেদ করে জ্বলছে একজোড়া প্রদীপ্ত শ্বাপদ চক্ষু!

পরক্ষণেই অন্ধকারের চেয়েও কালো এক অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ঝাঁপিয়ে পড়ল টুপি-কোট–জড়ানো বন্দুকের উপর! সেই দারুণ সংঘাতে। বন্দুকসমেত অ্যালেনের দেহটা আর একটু হলেই ছিটকে পড়ত। খাদের ভিতর কোনোরকমে টাল সামলে নিয়ে সে দেখল গিরিপথের উপর থেকে ঠিকরে এসে তার পাশেই সংকীর্ণ জায়গাটার উপর ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে। একটা চতুষ্পদ জীব! পুমা!

–দারুণ আতঙ্কে অ্যালেনের কণ্ঠ ভেদ করে নির্গত হল এক ভয়াবহ চিৎকার, দু-হাতে বন্দুকটা তুলে ধরে সে আঘাত হানতে উদ্যত হল।

কিন্তু প্রয়োজন ছিল না; পুমার নখগুলো পাথরের ওপর ফসকে গেল, জন্তুটা গড়িয়ে পড়তে লাগল নীচের দিকে!

অ্যালেন দেখল পুমা বার বার নখ দিয়ে পাহাড়ের ঢালু জমি আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছে। চেষ্টা সফল হল না।

মহাশূন্যে ছিটকে পড়ে অনেক নীচে অন্ধকারের গর্ভে অদৃশ্য হয়ে গেল সেই অতিকায় মার্জারের দেহ।

সকাল হল। নীচের দিকে তাকিয়ে ধরাশায়ী জন্তুটাকে দেখতে পেল অ্যালেন।

হ্যাঁ, বুড়োই বটে! জন্তুটা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছে কিন্তু তখনও মরেনি! তার কপিশ-পিঙ্গল চক্ষু দুটি নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অ্যালেনের দিকে!

অ্যালেন সবিস্ময়ে দেখল শ্বাপদের দৃষ্টিতে মৃত্যু-যাতনার চিহ্ন নেই–হিংস্র আক্রোশে দপদপ করে জ্বলছে পুমার দুই প্রদীপ্ত চক্ষু!

অ্যালেন চোখ ফিরিয়ে নিলে অন্যদিকে।

অকস্মাৎ ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো অকুস্থলে উপস্থিত হল অ্যালেনের মনিব ম্যাকগিল এবং দুজন রাখাল। ঘটনাস্থলে তাদের উপস্থিতি খুবই আকস্মিক বটে কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। যে ঘটনার সূত্র ধরে তাদের আবির্ভাব ঘটেছিল তা হচ্ছে এই :

অ্যালেনের ঘোড়া গতরাত্রেই তার আস্তানায় ফিরে গিয়েছিল। আরোহীবিহীন অশ্বের শূন্য পৃষ্ঠদেশ দেখে ম্যাকগিল উদবিগ্ন হয়ে ওঠে কিন্তু রাতের অন্ধকারে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব নয় বলেই সে অপেক্ষা করতে থাকে প্রভাতের জন্য।

ভোরের আলো ফুটতেই দুজন রাখালকে নিয়ে ম্যাকগিল খোঁজাখুঁজি শুরু করল এবং তার অভিজ্ঞ চক্ষু কিছুক্ষণের মধ্যেই খুঁজে পেল অ্যালেনের জুতোর দাগ। ওই দাগ ধরে একটু যেতেই তাদের চোখে পড়ল পুমার পায়ের ছাপ। শ্বাপদের পদচিহ্ন বিশ্লেষণ করে তারা যখন বুঝল পদচিহ্নের মালিক হচ্ছে বুড়ো এবং সংকীর্ণ গিরিপথে তার লক্ষিত শিকার হচ্ছে অ্যালেন, তখনই তারা অ্যালনকে জীবন্ত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার আশা ত্যাগ করেছিল। অক্ষত অবস্থায় নিখোঁজ মানুষটিকে দেখে তারা যেমন খুশি হয়েছিল তেমনই আশ্চর্য হয়েছিল।

ম্যাকগিল তার রাইফেল তুলে নীচের দিকে নিশানা করলে। পরক্ষণেই অগ্নি উদগার করে গর্জে উঠল রাইফেল।

ম্যাকগিলের সন্ধান অব্যর্থ, গুলি মর্মস্থানে বিদ্ধ হল, নিঃশব্দে মৃত্যুবরণ করলে বুড়ো।

ফ্ল্যাটহেড অঞ্চলে শেষ হল বিভীষিকার রাজত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *