অসহায়তা
পার্কের এক পাশে একটা বেঞ্চে একাকী বসে পড়লেন দীননাথ।মনটা আজ তার বড়োই বিষণ্ণ,বিক্ষিপ্ত।মনে পড়ছে সেই পুরোনো দিনের কথা••
বাপ্পা তখন ছোট্ট ছিল তখন হঠাৎ ধনুষ্টঙ্কারে ওর মা সিক্তা চলে গেলো।সবজি কাটতে গিয়ে হাত কেটে গিয়েছিল,কিন্তু কেয়ার করেনি,বলা ভালো দীননাথ কেয়ার নেননি,তাই অসময়ে সিক্তা চলে গেল।সেজন্য এ যাবৎ কাল ধরে নিজেকে অপরাধী ভেবে কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু বাপ্পাকে কোনোদিন মায়ের অভাব বুঝতে দেননি।আজ সাতাশ বছর ধরে সেই মানসিকতা নিয়ে বাবা-মা দুজনের দায়িত্ব শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে পালন করে আসছেন।
বাপ্পা এখন একটা কোম্পানির সিইও।বছর দুই হলো বিয়েও দিয়েছেন।সংসারটা বেশ চলছিল, কিন্তু এখন বাপ্পা এতো বড়ো পোস্টে চাকরি করে ওনার চার কামরার দোতলা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চায় দক্ষিণ কোলকাতার মস্ত ফ্ল্যাটে। দীননাথ আপত্তি করেছিলেন কিন্তু বাপ্পার বৌ শ্বেতা আজ কঠিন স্বরে বলেছে;-“আপনার এই বাড়িটা যদি যথেষ্ট বড়ো মনে হয়, তাহলে আপনি থেকে যান বাবা,বাপ্পার অফিস থেকে প্রায়ই পার্টি দিতে হয়, এইটুকু বাড়িতে আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব নয়,তাই আমাদের যেতেই হবে।আপনি যদি আমাদের সঙ্গে যেতে চান তাহলে এই বাড়ি বিক্রি করে চলুন।আমরা সামনের রবিবার শিফ্ট করব।”
দীননাথ অসহায় দৃষ্টিতে বাপ্পার দিকে তাকালেন,বাপ্পা কঠিন মুখে চুপচাপ ব্রেকফাস্ট সারছিল। দীননাথ বাপ্পাকে জিজ্ঞেস করলেন;-“বাবু তুইও কি তাই চাস”?
বাপ্পা বিরক্ত হয়ে বলল;-“ও তো বলেই দিলো আমি আবার কি বলবো?”
এই বাড়ি সেই সিক্তা থাকতে বানিয়ে ছিলেন দীননাথ,আজ এতোগুলো বছর তিনি তো শুধু সেই স্মৃতি আঁকড়েই বসে আছেন!
কিছু আগে দীননাথ কে একা করে দিয়ে বাপ্পা আর শ্বেতা ওদের গল্ফগ্রীণের অ্যারিষ্টক্যাট ফ্ল্যাটে রওনা দিয়েছে।ওপর নীচ পুরো ফাঁকা, দীননাথ আজ বড়ো একা!কি করে কাটাবেন বাকি জীবন!
বিধ্বস্ত মনে দীননাথ তাই এখন পার্কে।কতো কথা মনে পড়ছে••সেই ছোট্ট বেলায় বাপ্পাকে ক্রেস থেকে ঘরে আনার পরে বলতো;-“বাবা, আমি যখন বড়ো হবো,তখন আর ক্রেসে থাকবোনা, সারাজীবন আমরা দুজন একসাথে থাকবো,তাই না বাবা!!”
আজ একসাথে থাকার দর্শনটাই শিক্ষিত বাপ্পার মাথার থেকে বেমালুম উড়ে গেছে।কি অবলীলায় “চলি বাবা,মাঝে মাঝে যেও”-বলে বেরিয়ে গেলো। তারমানে ওরা আসবেনা,এই বাড়িতে বাপ ছেলের আর একসাথে থাকা হলো না।ভাবতে ভাবতে কখন আঁধার নেমেছে ,উঠে পড়লেন দীননাথ••দূর থেকে গান ভেসে আসছে;–“আমি ভবে একা দাও হে দেখা প্রাণ সখা•••”।।