অসম্মান (Asanman)
একটি মেয়েকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটানো হচ্ছে। এই দৃশ্যটি কিছুদিন আগে বাংলাদেশের কোনও এক পত্রিকায় দেখি। মেয়েটি গ্রামের কোনও অশিক্ষিত মেয়ে নয়। নড়াইলের ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী। নাম ববিতা। তো, এমন একটি শিক্ষিত মেয়েকে কারা জনসমক্ষে পেটাচ্ছে! পেটাচ্ছে তার শ্বশুরবাড়ির লোক। পেটানোর লোকদের লিস্টটা বেশ লম্বা। পেটাচ্ছে স্বামী শফিকুল, ভাসুর হাসান শেখ, শ্বশুর ছালাম শেখ, শাশুড়ি জিরিন আক্তার, চাচাশ্বশুর কালাম শেখ, প্রতিবেশী নান্নু শেখ ও পদ্মবিলা গ্রামের আজিজুর রহমান আরজুসহ আরও অনেকে। একটা একুশ বছর বয়সী মেয়েকে এতগুলো পুরুষ বাঁশ দিয়ে পেটালো। কী ভয়ংকর কাণ্ড। মেয়েটির মরে যাওয়ার কথা। মরেনি, তবে হাসপাতালে।
ঘটনা যতটুকু শুনেছি, তা হলো, ববিতার সঙ্গে শফিকুল নামের এক সেনার পরিচয়, প্রেম, এবং বেশ কয়েক বছর পর দুজনের গোপনে বিয়েও হয়। এরপর যখন প্রশ্ন ওঠে ববিতার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার, তখন থেকেই শফিকুল তাকে আর স্ত্রী বলে স্বীকৃতি দেয়নি। শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে অপমানিত আর নির্যাতিত হয়ে ফিরে এসেছে ববিতা। একসময় অতিষ্ঠ হয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করে সে। শেষ অবধি কী হয়! ববিতাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে আত্মীয় স্বজন ডেকে গাছের সঙ্গে বেঁধে পেটায় শফিকুল। শফিকুলের নাকি এক স্ত্রী আছে। ববিতার সঙ্গে তার কখনও বিয়ে হয়েছে বলে সে স্বীকার করে না।
এরকম ঘটনা অনেক ঘটে বাংলাদেশের সর্বত্র। ঘরের ভেতর বধূ নির্যাতন প্রতিদিনই হচ্ছে। বধুকে হত্যা করা হচ্ছে। খুনকে আত্মহত্যা বলে প্রচার করা হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাজারের মধ্যে নিয়ে হাজার লোককে দেখিয়ে মেয়েদের অপকর্মের শাস্তি দেয় পুরুষরা। পুরো উলঙ্গ করে গ্রাম জুড়ে তাদের হাঁটানো হয়। এসবের পরও দেখি দোষীরা শাস্তি পায় না। আমি তো বলবো নড়াইলে বধূনির্যাতনের কারণে যেভাবে স্বামী আর শ্বশুর-ভাসুরদের পুলিশ ধরে নিয়ে গেলো, সেভাবে অত শীঘ্র অন্য কোনও বধূরা সুবিচার পায় না। বধূ নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর আইন থাকা অত্যন্ত জরুরি। ভারতে ৪৯৮(এ) নামে এক আইন আছে, যেখানে মেয়েরা অভিযোগ করা মাত্র অত্যাচারী স্বামী শ্বশুরদের গ্রেফতার করা হয়। জামিন পাওয়া ওই আইনে সহজ নয়।
বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মেয়েদের পুরুষের সম্পত্তি বলে ভাবা হয়। সে কারণে সব পুরুষ মিলে একটা মেয়েকে নির্যাতন করতে দ্বিধা করে না। ববিতা সাহসী মেয়ে, সাহসী মেয়ে বলেই সে আদালতের সাহায্য চেয়েছে। বেশির ভাগ মেয়েই আদালতে যেতে চায় না। ওখানে মেয়েদের ভোগান্তি তো কম নয়! উকিলরাই অসম্মান করে। স্বামীর বাড়ি থেকে হুমকি আসে। তাছাড়া গাঁটের পয়সা প্রচুর যায়। ববিতার পাশে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যেন দাঁড়ায়। ববিতাকে দেখে যেন আরও মেয়েরা সাহস অর্জন করে। অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়ার অভ্যেসটা মেয়েদের এবার ত্যাগ করতে হবে।
মেয়েদের এই শ্বশুরবাড়ি থাকার নিয়মটা যে কবে শেষ হবে। ছেলে মেয়ে বিয়ে করবে, তো ছেলের বাপের বাড়িতে কেন মেয়েকে বাস করতে হবে। দুজনে মিলে আলাদা থাকার ব্যবস্থা চালু হওয়া উচিত। শ্বশুরবাড়ির সকলের সেবাযত্ন করার ভার মেয়ের ওপর পড়ে। এ তো সেকালের বউ আনার নাম করে বাড়িতে দাসি আনার মতো। মেয়েদের সমানাধিকারের কথা যদি ওঠেই, স্বামীর হাত ধরে একটা পরনির্ভর বস্তুর মতো শ্বশুরবাড়ি কেন বাস করতে যাবে মেয়েরা? তোমরা বিয়ে করেছো, তোমরা এইবার নিজেদের সংসার শুরু করবে। আলাদা বাড়িতে সংসার সাজাবে। শ্বশুরবাড়িতে না বাস করেও কিন্তু আত্মীয় স্বজন সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা যায়। আসলে দুরে থাকলেই সেই সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো থাকে। স্ত্রী দাসি নয়। স্ত্রী একসঙ্গে জীবন কাটানোর সঙ্গী, বান্ধবী, প্রেমিকা। কজন ঠিক এভাবে ভাবে? এভাবে ভাবে না বলেই স্ত্রীকে দাসী হিসেবে এবং সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে বাড়িতে রেখে দেওয়া হয়। আর বাইরে বান্ধবী বা প্রেমিকা যোগাড় করে নেয় পুরুষেরা।
এইসব নিয়ম কবে দূর হবে মাঝে মাঝে ভাবি। কোনও লক্ষণ দেখি না দুর হওয়ার। মেয়েরা শিক্ষিত হচ্ছে, টাকা পয়সা উপার্জন করছে, কিন্তু স্বনির্ভর হচ্ছে না, সচেতন হচ্ছে না। সত্যি কথা, হতে দেওয়া হচ্ছে না। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পুরুষের ভেতর থেকে তো দুর হচ্ছে না, মেয়েদের ভেতর থেকেও দুর হচ্ছে না। মেয়েরা হাজার বছর ধরে যে নিয়মের মধ্যে বংশ পরম্পরায় বেড়ে উঠেছে, সেই নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্য তাদের নেই। বাইরে গেলে যে অসম্মান, যে গ্লানি, যে দুর্ভোগ তাদের পোহাতে হয়, তা পোহানোর শক্তি সবার থাকে না। সেই শক্তি যেন মেয়েদের না থাকে, তেমন করেই মেয়েদের বড় করা হয়।
নড়াইলের মেয়ে ববিতা যেন কোনও অবস্থাতেই শফিকূলকে স্বামী হিসেবে মেনে না নেয়। এই অবিবেচক প্রতারক লোকটির সঙ্গে যেন সংসার না করে, এর সঙ্গে যেন কোনও সন্তান না নেয়। জীবনে কোনও ভালো পুরুষের দেখা যদি মেলে, তবেই যেন তার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়। যদি না পায় ভালো কোনও হৃদয়বান পুরুষ, তবে যেন একা থাকে। যেন স্বনির্ভর হয়। নিজের পায়ে দাঁড়ায়। মেয়েদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। অবশ্য নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাও নারী বিদ্বেষী সমাজে খুব সহজ নয়। নারী বিদ্বেষী পুরুষরা কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের হেনস্থার চূড়ান্ত করে। সহজ নয় কাজটিই নারীদের করতে হবে। কারণ স্বনির্ভর না হলে, যে পরনির্ভর জীবন তাদের জুটবে, সেটা আরও কঠিন, আরও ভয়ংকর। নারীদের পদে পদে কণ্টক। নারীর পথ কখনও কোনওদিন মসৃণ ছিল না।
পুরুষরা যে সমাজ বানিয়েছে, তা নারীকে অসম্মান করার জন্য। ববিতার অসম্মান আমরা চোখে দেখেছি। সাধারণত ঘরের দরজা বন্ধ করে মেয়েদের খুঁটিতে বেঁধে এভাবেই স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির লোকরা নির্যাতন করে। রান্নাঘরে ঢুকিয়ে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেয় শরীরে। লোকে যেন মনে করে রান্না করার সময় দুর্ঘটনা ঘটেছে। গলা টিপে মেরে ফেলে মৃত শরীর ঝুলিয়ে দেয় কড়িকাঠে নয়তো সিলিং ফ্যানে। ববিতার স্বামী শ্বশুররা ববিতাকে বাড়ির বাইরে নিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে মেরেছে বলে এ খবর জানাজানি হয়েছে। ফটো তুলে পত্রিকায় দিয়েছে বলে আরও জানাজানি হয়েছে। জানাজানি হয়েছে বলেই কিছু লোক প্রতিবাদ করছে। তা না হলে নড়াইলের লোকরাও মুখ বুজেই থাকতো। মেয়েরা অন্যায় করলে শাস্তি তো পুরুষরাই দেবে। এরকমই তো নিয়ম। শফিকুল নিজেকে ববিতার স্বামী হিসেবে না মানলেও নির্যাতন করার অধিকার রাখে বলেই বিশ্বাস করে। অধিকার পুরুষ হিসেবেই রাখে। পুরুষরা এই সমাজে নারীর অভিভাবক, এবং মালিক। সে কারণেই শফিকূলের পাড়াপড়শিরাও এসেই ববিতা-নির্যাতনে অংশ নিয়েছে।
মাঝেমাঝে ভাবলে গাশিউরে ওঠে, কী করে এই নারীবিদ্বেষী সমাজে আমি বেড়ে উঠেছি, স্বনির্ভর হয়েছি, আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচেছি। তা কি আর সহজ ছিলো? শিক্ষিত পরিবারে জন্ম নিয়েও, স্বনির্ভর হয়েও, আমার পথচলা সহজ হয়নি বাংলাদেশে। পদে পদে বাধা ছিল। আমিই যদি অত বাধার মুখোমুখি হই, তবে অন্যরা কতো বড় বাধার সামনে পড়ে তা অনুমান করতে পারি। প্রতিটি সিঁড়ি নারীকে ভাঙতে হয়, যে সিঁড়িগুলোর প্রতিটিই এক একটি মৃত্যুফাঁদ। পুরুষের সিঁড়ি পুরুষরা বানিয়েছে তরতর করে উঠে যাওয়ার জন্য। এমনি বৈষম্যের পৃথিবীতে বাস করি আমরা। পুরুষদের বড় ভালোবেসে বাস করি। পুরুষদের বড় আপন ভেবে বাস করি। পুরুষদের তৈরি এই বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন করলে আমাদের পুরুষবিদ্বেষী বলে গালি দেয় পুরুষরা। আমরা এই গালিকে ভীষণ ভয় পাই। তাই হাসিমুখে বরণ করি পুরুষের দেওয়া সকল নির্যাতন। আমাদের তো সহিষ্ণ হতে হবে। পুরুষরা অনেক আগেই বলে দিয়েছে আমদের হতে হবে ধরিত্রীর মতো সহিষ্ণ। আমরা তা ই হতে চেষ্টা করি। আর যদি ববিতার মতো অবাধ্য হই, তবে তো সমাজের সবাই মিলে আমাদের বাঁশ দিয়ে পেটাবে। সে কি আমরা জানি না? ববিতার ঘটনা আমাদের সবার জীবনেই ঘটে। একটু অন্যরকম করে ঘটে, এই যা।