খেতখামারে কাজ করতে হয় ভুবনকে
খেতখামারে কাজ করতে হয় ভুবনকে। খালেবিলে ঘুরতে হয়। সুতরাং সাপখোপের সঙ্গে তার মেলাই দেখাসাক্ষাৎ হয়ে যায়। কিন্তু সাপ মারে না ভুবন। মারতে নেই। মা মনসার বাহন বলে কথা। আর ভগবানের দুনিয়ায় যা কিছু আছে, সবটাকেই বোধ হয় দরকার।
কিন্তু আজ সাপটাকে মারতে হল বলে ভুবনের ভারী খারাপ লাগছিল। পলু পাকড়াশির সন্ধানে কুঁকড়োহাটি থেকে খুব ভোরবেলাই বেরিয়ে পড়েছিল সে। মোটে দু’ মাইল রাস্তা চোখের পলকে পেরিয়ে অষ্টপুরে ঢোকার মুখেই ঘটনা। ভাল করে আলো ফোটেনি তখনও। একটা জঙ্গুলে রাস্তা দিয়ে পোড়োবাড়ি পেরিয়ে আসার মুখে আচমকাই পথ আটকে ফণা তুলল সাপটা। একটু হলেই ঠুকে দিত। বিশেষ ভাবনা-চিন্তা না করেই কুড়ুলটা চালিয়ে দিয়েছিল ভুবন। সাপটা প্রায় দু’ আধখানা হয়ে পাশের ঘাসজমিতে ছিটকে পড়ে কিছুক্ষণ কিলবিল করল খুব। তারপর আর নড়াচড়া নেই।
ভুবন তার মায়ের কাছে শুনেছে মা মনসার দোর ধরে তার জন্ম হয়েছিল। মায়ের তাই বারণ ছিল, “সাপ মারিস না বাবা। ওতে বড় পাপ হবে।”
ভুবনের তাই সাতসকালেই বড় মনস্তাপ হচ্ছিল। যে গনগনে রাগ নিয়ে কুড়ুল হাতে সে পলু পাকড়াশিকে নিকেশ করতে বেরিয়ে পড়েছিল, সেটা যেন দপ করে নিভে গেল। নিচু হয়ে সাপটাকে দেখল সে। বড়সড় কালকেউটে। ছোবল মারলে রক্ষে ছিল না। কিন্তু না মারলেও হত। গাঁয়ের মানুষ সে, ভালই জানে মাটিতে চাপড় মারলে বা হাততালি দিলে সাপ বড় একটা ছোবল-টোবল দেয় না, বরং পালায়। কিন্তু আজ মাথাটা বড় গরম হয়ে ছিল, হিতাহিত জ্ঞান ছিল না।
কোমরের গামছায় কপালের ঘাম মুছে ভুবন তাই পাশের একটা গাছতলায় বসল, পাশে রক্তমাখা কুড়ুল। মায়ের দিব্যি দেওয়া ছিল, সেটা আজ সকালে ভঙ্গ হল বলে বড্ড দমে গিয়েছে মনটা। গাছে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে মনটাকে বাগে আনার চেষ্টা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে।
হঠাৎ দেখতে পেল, সামনে একটা খুব ঢ্যাঙা চেহারার লোক দাঁড়িয়ে। তার মাথায় টাক, নাকটা বেজায় চোখা, কটা চোখ, দাড়িগোঁফ কামানো, গায়ে একটা আলখাল্লার মতো, আর হাতে একটা লম্বা ডান্ডায় লাগানো বুরুশ। বলল, “একটা সাপ মারলেই যদি এত মনস্তাপ হয়, তা হলে একটা মানুষ মারলে আরও কত মনস্তাপ হবে, তা ভেবেছ?”
ভুবনের ভাবনা-টাবনা বিশেষ আসে না, তবু তার মনে হল, লোকটা ঠিক কথাই বলছে। সে তবু মিনমিন করে বলে, “কিন্তু সে যে আমার ভাইটাকে মেরেছে।”
“তাই আর একটা ভাইকেও মারতে চাও?”
“তা হলে কী করব?”
“মনে রেখো, যাকে মারতে চাও তাকে প্রভু বড় ভালবাসেন।”
“প্রভু কে?”
“প্রভু যার কাছে যেমন, ঠিক তেমন। মা মনসা হয়ে প্রভু তোমার কাছেই রয়েছেন। আমি তার ভৃত্য।”
মুখে কার একটা গরম শ্বাস পড়ায় চটকা ভেঙে চেয়ে ভুবন দেখতে পেল, তার সামনে উবু হয়ে বসে একটা লোক জুলজুলে চোখে তাকে দেখছে। তার পরনে একটা হাফপ্যান্ট আর একটা ঢলঢলে জামা। সে চোখ চাইতেই বলল, “উরেব্বাস রে! তুমি তো দোতলা বাড়ির মতো বড় একটা লোক! ঘরদোরের মধ্যে আঁটো কী করে?”
ভুবন একটা হাই তুলে সোজা হয়ে বসল। জবাব দিল না।
লোকটা গলা এক পরদা নামিয়ে বলল, “তা লাশটা কোথায় লুকোলে বলো তো!”
“লাশ! কীসের লাশ?”
লোকটা খুব বুঝদারের মতো একটু খুক করে হেসে বলল, “ভাবছ, আমি রটিয়ে বেড়াব? আমাকে সে বান্দা পাওনি। আমার মুখ দিয়ে কখনও বেস কথা বেরোয় না বাপু। কথা চেপে রাখতে আমি খুব ওস্তাদ।”
“বটে!”
“তবে!নবকান্তবাবুর গাছ থেকে ট্যাঁপা আর নবু যে আটটা কাঁঠাল চুরি করেছিল, সে কথা কাউকে বলেছি, বলো! হাসু মণ্ডল যে দুর্গা পাইনকে আড়ালে ‘কুমড়োপটাশ’ বলে, সেটা কখনও ফাস করেছি। কি? তেজেনবাবুর যে লেজ আছে, তা আর কেউ না জানুক আমি তো জানি। কিন্তু গলা টিপে মেরে ফেললেও সে কথা কাউকে বলব না। বেশি কথা কী, প্রাণপতি দারোগা ফাঁসির আসামি বলে যাকে হাজতে বন্ধ করে রেখেছে, সে যে আসলে পল্টু পাকড়াশি নয়, মাধবগঞ্জের নবীন দাস, সে কথা আমি ছাড়া কাকপক্ষীও কখনও টের পায়নি। বুঝেছ? আরও পাকা কাজ চাও তো দশটা টাকা ফেলে দিয়ো, মুখে স্কু এঁটে যাবে। লাশের খবর কেউ পাবে না।”
ভুবন ছোট চোখ করে লোকটার দিকে চেয়ে বলল, “তা হলে পল্টু পাকড়াশি কোথায়?”
“তার আমি কী জানি!”
ভুবন উঠে পড়ল। কুড়ুলটা কাঁধে ঝুলিয়ে বলল, “অষ্টপুরের থানাটা কোন দিকে বলো তো?”
ঘণ্টাপাগলা অবাক হয়ে বলে, “লাশের কথা কবুল করবে বুঝি! খুব ভাল, খুব ভাল। চলো, আমিই নিয়ে যাচ্ছি। তা কাকে মারলে বলো তো! নিশাপতি সাধুখাঁকে নাকি? নিশাপতি অতি পাজি লোক। তার পিতলের ঘটি চুরি করেছি বলে জুতোপেটা করেছিল আমাকে। উমেশ কর্মকারকে নয়তো! মেরে থাকলে কিন্তু খারাপ কয়রানি ভায়া। উমেশের গোয়ালঘর পরিষ্কার করতে রাজি হইনি বলে গরম লোহার ছ্যাকা দিয়েছিল। মোটে পাঁচ টাকা রেটে কি রাজি হওয়া যায় বাপু? গিরীন সামন্ত হবে কি? বেশ মুশকোমতো কালো বনমানুষের মতো চেহারা গো! বড়বড় দাঁত! তার বারান্দায় এক রাতে শুয়েছিলুম বলে কী হম্বিতম্বি! কান ধরে ওঠবোস অবধি করিয়েছিল। না হলে কি ধনপতি জোয়ারদার নাকি? ধনপতি হলে খুব ভাল হয়। গুন্ডার সর্দার। বিনি পয়সায় তার সাত জোড়া জুতো বুরুশ করে-করে আমার হাতে ব্যথা…”
প্রাণপতি খাসনবিশের আজ মেজাজ ভাল নেই। গতকাল সকালে সামনের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, ওই সময় তার মনটা ভারী ফুরফুরে থাকে। মাথায় উচ্চ চিন্তা আসতে থাকে।
তখন সবে সূর্য উঠি-উঠি করছে, গাছগাছালিতে বিস্তর পাখি ডাকছে, শরৎকাল আসি-আসি করছে বলে মিঠে হাওয়া দিচ্ছে, বাগানে ফোঁটা শিউলির গন্ধটাও আসছে খুব। গোরুর হাম্বা, কুকুরের ঘেউ ঘেউ যেন ভোরবেলাটাকে একেবারে হোল্লাই দিচ্ছিল। চা খেতে খেতে তিনি উচ্চ চিন্তায় উড়ে যাওয়ার জন্য তৈরিও হচ্ছিলেন। চিন্তার বিষয়টাও শানিয়ে রেখেছিলেন। একের ৬২
সঙ্গে এক যোগ করলে হয় দুই। তাই যদি হবে, তা হলে এই যে চারদিকে যা সব রয়েছে, বাড়িঘর, গাছপালা, হাঁস-মুরগি, গোরু বাছুর, রোদ-আকাশ এসব যোগ করলে যোগফল কী হবে। রোদের সঙ্গে হাওয়া যোগ দিলে কী দাঁড়ায়?
সবে ভাবনা শুরু করতে যাবেন, ঠিক এমন সময় দেখতে পেলেন ফটকের বাইরে একটা লোক দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে। লোকটা বেজায় লম্বা, মাথায় টাক, কটা চোখ, পরনে একটা আলখাল্লার মতো জিনিস।
তিনি হেঁকে বললেন, “কে ওখানে? কী চাই?”
লোকটা একটাও কথা না বলে পিছু ফিরে চলে গেল। একজন সেপাইকে ডেকে লোকটার খোঁজ করতে পাঠালেন। ঘণ্টা খানেক পর ফিরে এসে সে বলল, “আজ্ঞে বড়বাবু, কোথাও পাওয়া গেল না।”
সেই থেকে মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। উচ্চ চিন্তায় উড়ি-উড়ি করেও উড়তে পারলেন না।
কিন্তু ব্যাপারটা সেখানেই শেষ হল না। সকালে বাজারে যাওয়ার সময় টের পেলেন, কেউ যেন তাঁর পিছু নিয়েছে। একবার চকিতে পিছু ফিরে যেন দাড়িগোঁফওলা একটা লোককে চট করে একটা গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিতেও দেখলেন।
বাজার করতে করতেও সারাক্ষণ মনে হতে লাগল, তাকে কেউ নজরে রাখছে, তার গতিবিধি লক্ষ করছে। অথচ তিনি অষ্টপুরের বড়বাবু, বলতে গেলে দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এত সাহস কার যে, তার উপর নজর রাখে?
এতে হল কী, সারাদিন তার আর উচ্চ চিন্তা হল না।
উচ্চ চিন্তা না হলে প্রাণপতিবাবুর নানা রকম অসুবিধে হতে থাকে। অনিদ্রা হয়, হাই ওঠে, অরুচি হয়, নাক চুলকোয় এবং হাত-পা নিশপিশ করে। আজ সকালবেলায় কালকের মতোই পাখি ডাকছিল, শিউলির গন্ধ ছড়াচ্ছিল, গোরুর হাম্বা, কুকুরের ডাক কোনও কিছুরই অভাব ছিল না। কিন্তু প্রাণপতিবাবুর মনে হচ্ছিল, এমন বিটকেল সকাল আর দেখেননি, শিউলির কী বিচ্ছিরি গন্ধ, পাখিগুলো যে কেন এত চেঁচায় আর চা জিনিসটা যে কেন আহাম্মকরা খায়?
বাজারের দোকানিরা তাকে যথেষ্টই খাতির করে। ন্যায্য দামই নেয়, ওজনেও ঠকায় না। কিন্তু আজ বাজার করতে গিয়ে তার খুব ইচ্ছে করছিল, মাছওলা বিনোদকে একটা ঘুসি মারেন। কালুরামের মুদিখানায় ডাল আর সর্ষের তেল কেনার সময় তার খুব ইচ্ছে হল, কালুরামকে বেত মারতে মারতে থানায় নিয়ে হাজতে পুরে রাখেন। আর লাউ কেনার সময় সবজিওলা কেনারামকে বিনা কারণেই তিনি “গাধা’, ‘গোরু’ ও ‘রাসকেল’ বলে গালাগাল করে বসলেন। এবং করে মনে হল, ‘বেশ করেছি’। ওদের উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার।
একটু বেলার দিকে যখন থানায় এসে বসলেন, তখন তাকে কেউই যেন ঠিক চিনতে পারছিল না। রোজকার যেই ভোলাভালা, আনমনা ভালমানুষের জায়গায় যেন দারোগার চেয়ারে একটা ভালুক বসে আছে। চোখদুটো ভাঁটার মতো চারদিকে ঘুরছে। কথায় কথায় রুলটা তুলে ঠাস করে টেবিলে ঘা মারছেন। কেউ কাছে ঘেঁষতে সাহস পাচ্ছে না।
ঠিক এই সময় ঘণ্টাপাগলা গ্যালগ্যালে হাসিমুখে ঘরে ঢুকে একটা সেলাম ঠুকে বলল, “গুড মর্নিং, বড়বাবু। ব্রিং এ মার্ডারার। এই আজ সকালেই ফস্টারসাহেবের বাড়ির কাছে একজনকে খুন করে এসেছে হুজুর। এই যে, একেবারে হাতেনাতে ধরে এনেছি… কই হে, এসো…”
ঘণ্টার একটু পিছনে যে লোকটা ঘরে ঢুকল সে দেড় মানুষ লম্বা, তেমনি পেল্লায় পেটানো চেহারা। কাঁধে লটকানো একটা কুড়ুল এবং তাতে বাস্তবিক রক্তের দাগ।
প্রাণপতি একটা হুংকার দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন, “কাকে খুন করেছিস?”
লোকটা একটু হেসে হাত তুলে বরাভয় দেখিয়ে বলল, “ব্যস্ত হবেন না বড়বাবু। খুন-টুন করে আসিনি। পথে একটা কেউটে সাপের মুখে পড়ে গিয়েছিলাম, সেটাকেই মারতে হয়েছিল।”
ঘণ্টাপাগলা ভারী ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “খুন কররানি মানে? তুমি যে বললে, নিশাপতি না হয় তো উমেশ, গিরীন সামন্ত কিংবা ধনপতি, কাকে যেন মেরেছ?”
প্রাণপতি একটা পেল্লায় ধমক দিয়ে বললেন, “চোপ!” ঘণ্টা ধমকের শব্দে আঁতকে উঠল। প্রাণপতি বললেন, “এদের প্রত্যেকের সঙ্গেই একটু আগে আমার বাজারে দেখা হয়েছে। কিন্তু তুমি কে হে বাপু? কী চাও?”
দৈত্যটা হাত জোড় করে বলল, “আজ্ঞে, আমার নাম ভুবন মণ্ডল। পল্টু পাকড়াশির হাতে আমার ছোট ভাই খুন হয়। শুনেছি পল্টু সদরের জেল থেকে পালিয়েছে। তাকে খুঁজতেই আসা।”
“আর খুঁজতে হবে না। সে আমাদের হেফাজতেই আছে। শিগগিরই সদর থেকে ফোর্স এসে তাকে নিয়ে যাবে।”
“একটু কথা আছে হুজুর। এই পাগলাটা বলছে, আপনাদের হেফাজতে যে আছে সে নাকি পল্টু পাকড়াশি নয়, অন্য লোক!”
“হুঁ, আসামি নিজেও তাই বলছে। সে নাকি নবীন দাস। ফুঃ!”
“হুঁজুর যদি অনুমতি করেন, তা হলে একবার চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে যাই।”
প্রাণপতি এমন কটমট করে তাকালেন যে, ভুবন মণ্ডল জড়সড় হয়ে এক ফুটের মতো বেঁটে হয়ে গেল। প্রাণপতি ফোঁস করে একটা রাগের হলকা শ্বাস ফেলে বললেন, “কোনওরকম চালাকি করার চেষ্টা করলে কিন্তু সুবিধে হবে না বাপু।”
“আজ্ঞে না হুজুর, আপনার সঙ্গে বেয়াদপি করব, আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?”
ঘণ্টাপাগলা দারোগাবাবুকে যত দেখছে, ততই ধন্ধে পড়ে যাচ্ছে। অনেকক্ষণ মাথাটাথা চুলকে হঠাৎ একগাল হেসে বলল, “এইবার বুঝতে পেরেছি।”
প্রাণপতি ভ্রু কুঁচকে করাল দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বললেন, “কী বুঝতে পেরেছিস?”
“আপনি যে তিনি নন!”
প্রাণপতি ফুঁসে উঠে বললেন, “তার মানে?”
“প্রাণপতি খাসনবিশ বদলি হয়ে গিয়ে আপনি নতুন দারোগাবাবু এসেছেন তো! এটাই এতক্ষণ বুঝতে পারিনি মশাই। তবে কেমন যেন মনে হচ্ছিল, ইনি আমাদের সেই ভালমানুষ দারোগাবাবুটি নন। এই এতক্ষণে সব পরিষ্কার হয়ে গেল।”
প্রাণপতি ক্রুর দৃষ্টিতে ঘণ্টার দিকে চেয়ে বললেন, “হুঁ, কথাটা যেন মনে থাকে। আমি আর সেই আমি নই।”
এরপর প্রাণপতি ভুবন মণ্ডলের দিকে চেয়ে বললেন, “কুডুল বড় ভাল জিনিস নয়। কাজে লাগে, অকাজেও লাগে।”
“যে আজ্ঞে।”
“কুডুলখানা দরওয়াজার কাছে জমা দিয়ে তুমি আসামিকে দেখে আসতে পারো। যাবে আর আসবে। মনে থাকে যেন।”
আজ প্রাণপতির বজ্রগম্ভীর গলায় থানা যেন গমগম করতে লাগল। ভুবন মণ্ডল তটস্থ হয়ে একটা পেন্নাম ঠুকে ফেলল। এরকম জবরদস্ত দারোগা সে জন্মেও দেখেনি।
পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ঘুরে এসে ভুবন মণ্ডল বলল, “হুঁজুর, মা মনসার দিব্যি কেটে বলতে পারি, এ লোক কস্মিনকালেও পল্টু পাকড়াশি নয়। চেহারার মিল আছে বটে, কিন্তু পল্টু পাকড়াশির চোখ দেখলে সাপ পর্যন্ত পথ ছেড়ে দেয়।”
“কিন্তু প্রমাণ?”
মাথা নেড়ে ভুবন মণ্ডল বলে, “প্রমাণ নেই হুজুর। তবে একে ফঁসি দিলে বড় অধর্ম হবে।”
চিন্তিত প্রাণপতি গম্ভীর ভাবে শুধু বললেন, “হুঁ।”
ঘণ্টা খানেক বাদে তার বাড়ি থেকে খবর এল, তার মেয়ে আট বছরের মধুছন্দা স্কুল থেকে বাড়ি ফেরেনি। কোথাও তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রাণপতির স্ত্রী বিজু অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।
হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এসে তিনি দেখেন, পাড়াপ্রতিবেশীদের ভিড়ে বাড়ি গিজগিজ করছে। ভিড়ের ভিতর থেকে একজন এগিয়ে এসে একটা ভাঁজ করা কাগজ প্রাণপতিকে দিয়ে বলল, “এটা বউদির মুঠোয় ধরা ছিল।”
এক্সারসাইজ বুক থেকে ছেঁড়া পাতায় বিচ্ছিরি হাতের লেখায় একখানা চিঠি। তাতে লেখা,
মাননীয় মহাশয়, নিতান্ত অপারগ হইয়া আপনার কন্যাকে অপহরণ করিতে হইল। আমাদের শর্ত হইল, আজ রাত বারোটায় আপনি আপনার থানার তেরো নম্বর আসামি পল্টু ওরফে মৃগেন পাকড়াশিকে মুক্তি দিবেন। অন্যথায় আপনার কন্যার ভালমন্দের দায়িত্ব আমরা লইতে পারিব না। আমাদের প্রস্তাবে আপনি সম্মত হইলে আপনার সামনের বারান্দায় একটা লাল গামছা বা কাপড় টাঙাইয়া দিবেন।
প্রাণপতির আজ কী হয়েছে, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারছিলেন। মাথাটা বেশ কাজ করছে। এ যেন ঠিক তিনি নন, অন্য কেউ। তিনি চট করে একখানা লাল রঙের গামছা বাইরের বারান্দায় টাঙিয়ে দিয়ে সকলের দিকে চেয়ে বললেন, “একটা লম্বাপানা টাক মাথার লোক, কটা চোখ, গায়ে একটা আলখাল্লার মতো পোশাক, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাকে খুঁজে বের করা খুব জরুরি। এই কাণ্ডর মূলে সেই লোকটার হাত আছে।” সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল।
খোঁচা-খোঁচা দাড়ি, জুলজুলে চোখ, রোগা চেহারা, লুঙ্গি আর কামিজ পরা একটা লোক এগিয়ে এসে বলল, “তাকে খুঁজছেন কেন বড়বাবু?”
“সে-ই যত নষ্টের গোড়া।”
উদ্ধব খটিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে বলে, “আজ্ঞে, তাঁকে কি কেউ খুঁজে পাবে হুজুর?”
“তার মানে? তুমি কি তাকে চেনো?”
উদ্ধব মাথা চুলকে বলে, “যার কথা বলছেন তার সঙ্গে একজনেরই মিল আছে হুজুর। তিনি বড় ভাল লোক।”
“কিন্তু লোকটা কোথায়, তাকে ধরে আনো।”
হরেন চাটুজ্যের মা মৃদুভাষিণী দেবী এগিয়ে এসে বললেন, “ও বাবা প্রাণপতি, তুমি কাকে খুঁজছ বলো তো?”
“সে একজন কটা চোখের ঢ্যাঙা লোক মাসিমা, মাথাজোড়া টাক, ফর্সা রং আর গায়ে আলখাল্লা গোছের পোশাক।”
“সে কী করেছে বাবা?”
“এই তো গত কালই সকালবেলায় এসে আমাদের ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আমার উপর নজর রাখছিল।”
মৃদুভাষিণী মাথা নেড়ে বললেন, “তাকে খোঁজবার আর দরকার নেই বাবা। সে নিজেই তোমাকে ঠিক খুঁজে নেবে। ভেবো না। খুঁজলেও তাকে অত সহজে পাওয়া যাবে না।”
“আপনিও কি তাকে চেনেন মাসিমা?”
“চিনি বাবা। আমি চিনি, ওই উদ্ধব হতভাগা চেনে। তুমিও চিনতে পারবে। তবে এমনিতে চেনা বড় মুশকিল। দেখা পাওয়া আরও মুশকিল।”
“এ যে হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে মাসিমা?”
মৃদুভাষিণী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, “হেঁয়ালিই মনে হয় বাবা। এ যুগে কি আর ওসব কেউ বিশ্বাস করে?”