Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » অষ্টপুরের বৃত্তান্ত || Shirshendu Mukhopadhyay

অষ্টপুরের বৃত্তান্ত || Shirshendu Mukhopadhyay

নগেন পাকড়াশি

নগেন পাকড়াশি তাকে একখানা নতুন সাইকেল, একজোড়া নতুন বাহারি জুতো, একখানা ঝকমকে হাতঘড়ি আর নগদ দশ হাজার টাকা আগাম দিয়েছিল, আর কাজ হয়ে গেলে আরও পাঁচ লাখ টাকার কড়ার। এ ছাড়াও, পাকড়াশির কাছে তার জমি বাড়ি বাঁধা দেওয়ার যেসব কাগজপত্র ছিল, তাও ফেরত দিয়েছিল। বলেছিল, “এই কাজটুকু করে দে বাবা, তোকে রাজা করে দেব।”

তা রাজাগজা বলেই নিজেকে মনে হয়েছিল নবীনের। পাকড়াশির খাজাঞ্চি ভোলারাম একদিন এসে তাকে সব জলের মতো বুঝিয়ে দিল। বলল, “কোনও বিপদ-আপদ নেই রে বাপু, জেলখানায় শুয়ে-বসে কয়েকটা বছর আরামসে কাটিয়ে দেওয়া, দোবেলা খাওয়ার চিন্তা নেই। বিনি মাগনা মুফতে সকালে রুটি গুড়, দুপুরে মাছ-ভাত, রাতে রুটি-মাংস। চোদ্দো বছর মেয়াদ বটে, কিন্তু বছরে ছ’ মাস করে মেয়াদ কমে যায়। হরেদরে তোর ওই বড়জোর সাত-আট বছর মেয়াদ খাটতে হবে। বেরিয়ে এলেই নগদ পাঁচ লাখ টাকা, বুঝলি?”

নবীন ঘাড় নেড়ে বলল, “বুঝেছি।”

“তোকে তো আমার হিংসেই হচ্ছে রে। এমন সুযোগ যদি আমি পেতুম, তা হলে বর্তে যেতুম। কিন্তু কপাল বটে তোর! কোন ভাগ্যে যে তোর চেহারাখানা হুবহু পল্টুর মতো হল, কে জানে বাবা। আমার যদি তোর মতো একটা ছেলে থাকত, আর পল্টুর মতো দেখতে হত, তা হলে তো কেল্লাই মেরে দিতুম রে।”

নবীনের ইদানীং দিনকাল ভাল যাচ্ছিল না। জমি-বাড়ি বাঁধা, ধারকর্জও রয়েছে মেলাই, দোকানে বাকিও পড়ে আছে। কাজেই নগেন পাকড়াশির প্রস্তাবটা এল যেন শাপে বর।

দশ হাজার টাকা পেয়ে সে ধারকর্জ কিছু শোধ করে দিল। তারপর শহরে গিয়ে ভাল রেস্টুরেন্টে ঢুকে গান্ডেপিন্ডে মাংস, পোলাও, রাবড়ি আর সন্দেশ সাঁটাল। সাইকেলে করে গা থেকে শহর বার কয়েক চক্কর দিল রোজ। আর ঘনঘন ঘড়ি দেখার কী ঘটা! টাইম দেখে-দেখে আর আশ মেটে না।

মাধবগঞ্জে কুচুটে লোকের অভাব নেই। নবীনের এমন ধাঁ-উন্নতি দেখে অনেকেরই চোখ টাটাল। উমেশ পরামানিক তো একদিন ডেকে দাওয়ায় বসিয়ে ভারী মিষ্টি-মিষ্টি করে বলল, “জানি বাছা, তোর অবস্থা তেমন ভাল নয়। জমি-বাড়ি বাঁধা আছে। তা বলে কি শেষে চুরিতে নাম লেখালি? তোর বাপ শত কষ্টেও তো কোনওদিন অসৎ পথে পা বাড়ায়নি! পীতাম্বর দাসের ছেলে হয়ে তুই কিনা শেষে…?”

মুশকিল হল, লোকের কাছে গোটা ব্যাপারটা তো আর খোলসা করে বলা যায় না। এ যে চুরির জিনিস নয়, রীতিমতো মজুরি, তা বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না।

মনোরঞ্জন চাটুজ্যে একদিন ভারী অবাক হয়ে বলল, “হ্যাঁ রে নবে, চাকরি পেয়েছিস নাকি? আজকাল ঘড়ি ধরে চলাফেরা করছিস দেখছি!”

নবীন মরমে মরে গেল। মনোজ্যাঠাকে গুহ্য কথাটা বলা যায় যে। হাটখোলার কাছে এক দুপুরে তাকে ধরল ল্যাংড়া মানিক। একখানা লম্বা লাঠি আচমকা তার চলন্ত সাইকেলের চাকায় ঢুকিয়ে দিতেই সে সাইকেল উলটে চিৎপটাং। মানিক মস্তান একটু খুঁড়িয়ে এসে তার গলায় একখানা গামছা পেঁচিয়ে ফাঁস দিয়ে দাঁড় করিয়ে বলল, “এই যে চাঁদবদন, বলো তো বাপু, টু পাইস আসছে কোথা থেকে?”

গরিবের দুটো পয়সা হলে কেন যে লোকের চোখ টাটায়, তা কে জানে বাবা। নবীন চি চি করে বলল, “খেটেখুটে ন্যায্য রোজগারে কেনা মশাই, চুরি-ডাকাতির জিনিস নয়।”

“বটে!” বলে মানিক তার পকেট হাতড়ে শত খানেক টাকা পেয়ে তাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “রোজগারপাতি তো খুব ভাল জিনিস রে! মাঝে-মাঝে একটু পেন্নামি দিয়ে যাস, তা হলে আর কেউ কোনও কথা তুলবে না। যাঃ, তোকে আজকের মতো ছেড়ে দিলুম।”

শুধু এতেই শেষ নয়। এক রাত্তিরে খুব বৃষ্টি নেমেছে। ঠান্ডা পেয়ে নবীন নিঃসাড়ে ঘুমোচ্ছিল নিজের ঘরে। হঠাৎ দমকা হাওয়া গায়ে লাগায় ঘুমের চটকা ভেঙে যেতেই সে দেখতে পেল, ঘরের দরজাটা হাট করে খোলা, হাওয়ায় কপাট দুটো আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। আর-একটা লোক তার সাইকেলখানা নিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বিপদ বুঝে নবীন লাফ দিয়ে পড়ে লোকটাকে সাপটে ধরল। লোকটা একটা মোচড় দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সাইকেলখানা ফেলেই পালিয়ে গেল।

নবীনের আর ঘুম হল না। বাকি রাতটুকু বসে ভাবল, এরকম হলে সে বড় বেকায়দায় পড়ে যাবে। টাকাপয়সা বা জিনিসপত্র সামলে রাখার বিদ্যে তার জানা নেই। সুতরাং বড়লোক হলেও তার সবই অন্যেরা কেড়েকুড়ে নেবে।

মনস্থির করে সে সকালেই গিয়ে নগেন পাকড়াশির গদিতে হাজির হয়ে সাইকেল, ঘড়ি, জুতো আর খরচ না-হওয়া সাতশো সাতান্ন টাকা ফেরত দিয়ে বলল, “কাজটা আমি পারব না কর্তা। টাকার গন্ধ পেয়েই চারদিকে নানা কথা উঠছে, অত্যাচারও শুরু হয়েছে। আমাকে আপনি রেহাই দিন।”

একথা শুনে নগেন আর্তনাদ করে উঠল, “পারবি না মানে! সব বন্দোবস্ত যে করে ফেলেছি! কম টাকা গচ্চা যাচ্ছে আমার! ছেলেটা মাথা গরম করে দু-দুটো খুন করে ফেলায় হয়রানির চূড়ান্ত। তার মধ্যে তুই এখন ব্যাক মারছিস!”

নগেনের পোষা গুন্ডাদের সর্দার হল চণ্ডীচরণ। তার পেল্লায় চেহারা। কাক করে এসে নবীনের ঘাড়টা ধরে নেংটি ইঁদুরের মতো শূন্যে ঝুলিয়ে বলল, “একটা রদ্দায় মাথা ভেঙে দিতে পারি, তা জানিস?”

নবীনের দম বন্ধ হয়ে চোখ উলটে ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। নগেন ফের আর্তনাদ করে উঠে বলল, “ওরে, ছেড়ে দে, ওকে ভড়কে দিসনি। তোতাই-পাতাই করে রাজি না করালে হবে না বাপু। ও বিগড়ে গেলে যে পল্টুর প্রাণ সংশয়!”

চণ্ডীচরণ তাকে ছেড়ে তো দিলই, তারপর তাকে খাতির করে চেয়ারে বসিয়ে ময়রার দোকান থেকে গরমাগরম কচুরি আর জিলিপি আনিয়ে খাওয়ানো হল।

নগেন পাকড়াশি একটা বড়সড় চটের থলি তার হাতে দিয়ে বলল, “এই নে বাপু, পুরো পাঁচ লাখ আছে। সাবধানে রাখিস, খোয়া-টোয়া না যায়। নামে চোদ্দো বছর, আসলে সাত-আট বছরের বেশি তো নয় রে। তা সাত-আট বছর পর তোর বয়স হবে মেরেকেটে তিরিশ। বাকি জীবনটা পায়ের উপর পা তুলে আরামে কাটিয়ে দিতে পারবি। এখন যা, আমার পাইকরা তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

পাঁচ লাখ টাকা পেয়ে নবীন যেন কেমনধারা ভোম্বল হয়ে গেল। এত টাকা! তাদের সাত পুরুষেও কেউ এত টাকা চোখে দেখেনি। কিন্তু টাকাটা কোথায় গচ্ছিত রেখে যাবে, সেইটেই ভেবে পাচ্ছিল নবীন।

তার পাড়াতুতো এক পিসি আছে, ননীবালা। তিরানব্বই বছর বয়স এবং নবীনের মতোই তারও তিন কুলে কেউ নেই। আর সেইজন্যই বুড়ি একটু নবীনের ডাক-খোঁজ করে, মোয়াটা, নাড়ুটা খাওয়ায়। টাকার পোঁটলা নিয়ে নবীন যখন এক দুপুরবেলা ননীপিসির কাছে হাজির হল, তখন প্রস্তাব শুনে পিসির মূৰ্ছা যাওয়ার জোগাড়। বলল, “বলিস কী বাছা! এই ভাঙা ঘরে থাকি, ও টাকা আমি কোথায় লুকোব? তারপর সাত-আট বছরের কথা বলছিস, ততদিন কি আমি বাঁচব রে? তা বাপু, ও টাকা পেলি কোথায়? চুরি-ডাকাতির টাকা নয় তো!”

“না পিসি, ন্যায্য টাকা। পরে সব বুঝিয়ে বলব।”

এর পর সাইকেল আর ঘড়ি বেচে দিল নবীন। সেই টাকায় আরও ভালমন্দ খেল, নতুন জামা কিনল একটা, দীনদুঃখীদের কিছু দিল-থুল। দানধ্যান তো জীবনে করার ফুরসত পায়নি।

তারপর এক ঝড়-জলের রাতে বন্দোবস্ত মতো নগেনের পাইকরা তাকে নিয়ে গিয়ে জেলের ফটকের কাছে হাজির করল। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেপাইরা তাকে ভিতরে নিয়ে গিয়ে নানা চোরা পথ পার হয়ে একটা গরাদওয়ালা খুপরি ঘরে ঢুকিয়ে তালা বন্ধ করে দিল।

জেলখানা জায়গাটা খুব একটা খারাপও লাগছিল না নবীনের। খেতে-টেতে দেয়, শোওয়ার জন্য কম্বল আছে, মাথার উপর ছাদ, আর চাই কী? কিন্তু দু-চার দিনের মধ্যেই সে কানাঘুষো শুনতে পেল যে, যাবজ্জীবন নয়, সে আসলে ফাঁসির আসামি। কেস নাকি এখন হাইকোর্টে, যে-কোনও দিন রায় বেরোবে।

এই খবরে নবীনের চুল খাড়া হয়ে উঠল। সর্বনাশ! নগেন পাকড়াশি তো সাংঘাতিক লোক! পল্টুর যে ফঁসির হুকুম হয়েছে, এটা তো সে নবীনকে বলেনি! শুনে সে খুব চেঁচামেচি শুরু করে দিল, “ওগো, তোমরা সবাই শোনো! আমি কিন্তু পল্টু নই। আমি হলুম নবীন দাস। মাধবগঞ্জের পীতাম্বর দাসের ছেলে।”

তার চেঁচামেচিকে কেউ পাত্তাই দিল না। শুধু মোটামতো একজন সেপাই এসে খুব ভালমানুষের মতো বলল, “ফাঁসির হুকুম হলে অনেকেরই তোমার মতো হয়। তবে ভয় খেয়ো না, ভাল করে খাও-দাও। ফঁসি যখন হবে, তখন হবে। ভেবে লাভ কী?”

শুনে নবীন তার খুপরিতে বসে বিস্তর কান্নাকাটি করল। লোভে পড়ে নিজের প্রাণটাকে এরকম উচ্ছ্বঘ্ন করাটা কি ঠিক হল তার? নগেনের কথায় বিশ্বাস করাটাও তার ভারী আহাম্মকি হয়েছে।

তার খাওয়া কমে গেল। ঘুম হতে চায় না। শরীর দুর্বল লাগে। মাথা ঝিমঝিম করে।

জেলে যাওয়ার মাসছয়েক বাদে হঠাৎ একদিন সকালে এক উকিলবাবু এলেন। তাকে দেখে হা হয়ে গেল নবীন। মনোমাস্টারের ছেলে শিবুদাদা। কয়েক বছর আগেও মনোরঞ্জন মাস্টারমশাইয়ের বাড়ি দুধ দোয়াতে গিয়েছে নবীন। তখন মনোমাস্টার তাকে পড়াত।

“শিবুদাদা! আমি নবীন!”

শিবপদ উকিল অবাক চোখে তার দিকে চেয়ে বলল, “তাই তো রে! থানার এক সেপাই আমাকে ক’দিন আগে চুপিচুপি খবর দিয়েছিল বটে, আসামি অদলবদল হয়েছে! তখন বিশ্বাস হয়নি।

এখন তো দেখছি, ঠিকই শুনেছি। ব্যাপারটা কী বল তো!”

নবীন হাউমাউ করে খানিক কেঁদে, খানিক ককিয়ে গোটা ঘটনাটা বলে গেল।

শিবপদ চিন্তিত মুখে বলল, “সর্বনাশ করেছিস। এখন যদি প্রমাণও হয় যে, তুই পল্টু নোস, তা হলে বিস্তর হ্যাপা আছে। সরকার এবং আদালতকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য তোর নামে মামলা হবে। আসামি বদলের জন্য জেলারসাহেবের চাকরি যাবে। তার উপর পল্টুর নামে হুলিয়া জারি হবে।”

“তা হলে আমার কী হবে শিবুদাদা?”

“দাঁড়া, ব্যাপারটা সহজ নয়। খুব ভাল করে উপায় ভাবতে হবে।”

কয়েকদিন উৎকণ্ঠায় থাকার পর একদিন শিবপদ গম্ভীর মুখে এসে বলল, “একটা উপায় হয়েছে। তোকে জেল থেকে পালাতে হবে।”

চোখ বড় বড় করে নবীন বলল, “কী করে পালাব শিবুদাদা? চারদিকে যে পাহারা!”

“সে তোকে ভাবতে হবে না। তোকে পালাতে না দিলে জেলারসাহেব আর তার কর্মচারীদেরও বিপদ। তারাই তোকে পালাতে দেবে।”

একগাল হেসে নবীন বলে, “তা হলে তো বড্ড ভালই হয়।” শিবপদ মাথা নেড়ে বলল, “না, হয় না। তুই পালালেও তোর বিপদ কাটবে না। পুলিশ তোকে খুঁজবে না ঠিকই, কিন্তু নগেন পাকড়াশি ছাড়ার পাত্র নয়। কারণ, তুই পালালে পুলিশ এখন হন্যে হয়ে পল্টুকে খুঁজবে। আর নগেনের উপর উৎপাত বাড়বে। কাজেই ছাড়া পেলে গা ঢাকা দিয়ে থাকিস। খবরদার, নিজের বাড়ি বা গাঁয়ের ধারে-কাছে যাস না।”

আবার এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে পুলিশ তাকে ভ্যানে করে নিয়ে গিয়ে একটা জঙ্গলের ধারে নামিয়ে দিল। বলল, “পালা বাপু। প্রাণপণে দৌড়ো। একটু পরে আমরা কিন্তু পিছন থেকে গুলি চালাব। লেগে গেলে দোষ নেই কিন্তু।”

এমন দৌড় নবীন জীবনে দেয়নি। অন্ধকারে গাছপালা ভেদ করে সে কী ছুট! পিছনে চার-পাঁচবার গুলির শব্দও হয়েছিল ঠিকই। ঝড়, বাদলা, অন্ধকার আর জঙ্গল সব মিলিয়ে সে এক অশৈলী অবস্থা। নবীন কতবার যে আছড়ে পড়ল, আর গাছে-গাছে ধাক্কা খেল, তার হিসেব নেই। কিন্তু প্রাণের ভয়ের চেয়ে বড় ভয় আর কী আছে! জঙ্গলটা শেষ হওয়ার মুখে একটা খালের জলে গিয়ে পড়ল নবীন। সাঁতরে খাল পেরিয়ে একটা ফাঁকা ঘাট। তারপর ফের জঙ্গল। নিশুত রাতে জলে ঝুম্বুস ভিজে সে যখন কাঁপছে, পা আর চলছে না, তখন একটা বাড়ির হদিশ পাওয়া গেল। কার বাড়ি, ঢুকলে চোর বলে ঠ্যাঙাবে কি না, সেইসব ভাবার মতো মনের অবস্থা নয়। সে কোনওরকমে বারান্দায় উঠে সামনের দরজায় একটা ধাক্কা দিল। কিন্তু কপাটহীন দরজায় ধাক্কাটা লাগল না, বরং নবীন হড়াস করে ঘরের ভিতরকার মেঝের উপর পড়ে গেল। কোনওরকমে উঠে একটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে হাঁটু তুলে তাতে মুখ গুঁজে হাঁফাতে লাগল। ক্লান্তিতে শরীর এমন ভেঙে এল যে, ভেজা গায়েই। নিঃসাড়ে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের মধ্যেও সে টের পাচ্ছিল, এ বাড়ির লোকেরা তার এই আকস্মিক আগমনে মোটেই খুশি হয়নি।

কে যেন বলল, “এটা আবার কে রে?”

কেউ যেন জবাব দিল, “গায়ে তো কয়েদির পোশাক দেখছি।”

একজন বুড়ো মানুষের গলা শোনা গেল, “ও হল ফাঁসির আসামি। নবীন।”

ধরাই পড়ে গেল কি না, সেটা বুঝতে পারল না নবীন। ধরা পড়লে আবার হয়তো হাজতেই নিয়ে যাবে তাকে। ফাঁসিও হতে পারে। এত খেটেখুটেও লাভ হল না তেমন। তবে শরীরটা ক্লান্তিতে বস্তার মতো ভারী হয়ে আছে বলে ভয়ডরও তেমন কাজ করল না।

সে কাত হয়ে মেঝেয় শুয়ে অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই নবীন ভারী বুরবক হয়ে গেল। সে একটা পোড়ো বাড়ির ভাঙাচোরা ঘরে ধুলোময়লার মধ্যে পড়ে আছে। চারদিকে উঁই হয়ে আছে আবর্জনা। এ বাড়িতে বহুকাল মানুষের বাস নেই। তবে কি ঘুমের মধ্যে সে ভুলভাল কথাবার্তা শুনেছে? তাই হবে। স্বপ্নই দেখে থাকবে হয়তো। এটা কোন জায়গা, তা তার জানা নেই। কাছেপিঠে লোকালয় আছে কি না, কে জানে। সবচেয়ে বড় কথা, খিদে চাগাড় দিচ্ছে, আর পকেটে পয়সা নেই।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9
Pages ( 1 of 9 ): 1 23 ... 9পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress